খোদাই
“খোদাই করবেন নাকি…..? কাঁসার থালা বাসন ঘটি বাটি গেলাস….”
ঝনঝনে ধাতব গলার নিরীহ হাঁক, অতি সাধারণ বাঙ্গালী বেশভূষা, হাতে ছাতা ও ছোট্ট ব্যাগ , নির্বিকার হেঁটে চলেছেন নিঃশব্দ পায়ে, এক ব্যক্তি, যেতে যেতে এক ঝলক দেখেও নিতেন আমাকে । কখন? প্রায়শঃ —যখন সময় দিতো অলস মুহূর্ত , বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়াবার। ঠিক বাচ্চা বালিকাকে কেই বা পাত্তা দেয় বিশেষ এই হকারেরা।
এও এক ফেরিওয়ালা বটে, জীবিকার অর্থে।
সেই ছোট্ট বেলার শহর , যেখানে তখনও মাঝে মাঝে ঢোল বাজিয়ে সরকারি সংবাদ পরিবেশন হতো, —–সন্ধ্যাবেলা ডুমডুম করে ডায়নামো বাজত “টকি সো” পরিবেশনে। কে জানত তখন, না সেই খোদাইকার, না আমি? একদিন তাকে দরকার হবে । জানতাম কি , তার শিল্পকর্ম আজও আমায় এতো মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখবে।
সেই সাবেকি কালে, ঠাস ঠাস করে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে রান্না ঘরের বারান্দায় আমরা দুপুরে ও রাতে ভাত খেতে বসতাম। কাঁসার থালা বাসনে, না বাঁ-হাত চলবে না, জলের গেলাসও ডান হাতে ধরে। যখন যেমন তখন তেমনই । যেমন খোদাইকারেরাও আর সেভাবে কাজকারবার চালায় কি ? এখন ত হাঁকেডাকে নয়, চলে পোষাকি সফিস্টিকেটেড ব্যবসায়ে।
সেই সময় আমার ও দিদির মাঝে মাঝেই দ্বন্দ্ব –ধন্দ বেঁধে যেতো কার কোন্ গ্লাস নিয়ে । দুজনেরই নিজেদের উপর প্রচন্ড আস্থা কোনমতে মীমাংসা হবার নয়, ঠিক হিন্দু মুসলিম বিবাদ। তো একবার এলেন কলকাতা থেকে বাবা, নীরবে আমাদের কাজিয়া দেখতে বাধ্য হলেন। সেদিন সান্ধ্যভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরে বাবা ডাকলেন আমাদের দুবোনকে, পেলাম সোনা ঝকঝক গ্লাস, কি আনন্দ ! দুটো তো হুবহু এক, তাহলে?
মুচকি হাসলেন বাবা—– আর ঠিক তার পরদিন সকালে পাড়ায় খোদাইকার যথা সময়ে এলো। আর কি? মুস্কিল আসান। ঘরের বারান্দায় খুঁট খুঁট করে তিনি বাবার দেওয়া চিরকুট থেকে খোদাই করলেন—- দুটি গেলাশে , দুটি পৃথক নাম — “করবী” আর “পূরবী “
আমরা ত খুব খুসী কিন্তু, একটা “কিন্তু ” খচ্ খচ্ রইল দুজনেরই মনে। তার জন্য দায়ী কে? না ঐ খোদাইকার !!
“করবী” নামের পাশে একটা সুন্দর ময়ুর পুচ্ছ নকশা !!!
আর “পূরবী ” নামের পাশে জ্বলজ্বলে কয়েকটি নক্ষত্র !!!
মন বড়ই খুঁত খুঁতে, দুজনেরই মনে হলো খোদাইকারের কিছু পক্ষপাতিত্ব ছিল হয়ত…… নিশ্চয়ই, নয়ত আবার কি? এদিকে মেনে নিতেই হলো উপায় কি?
sibling’s rivalry ত চিরকালীন, এও কি সেই গণ্ডির আওতায় ? মন কি ভালোবাসে সেও তো মনই জানে। এখনও চোখ বুজে, নাম লেখা ঐ গ্লাস দুটো দেখতে পাই। আমার কাছে অসাধারণ নিখুঁত এক শিল্পকলা।