খেলনা
শেষের বাসটি চলে গেল। ইম্ফলের দিকে। চৈতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে দেখল।
দেওয়ালে ঝোলানো আয়নায় মুখটি একবার দেখল, আলতো করে মুখে একটু পাউডারের প্রলেপ বুলোলো। তারপর কনে-দেখা-আলোয় বড়ো করে দগদগে একটি সিঁদুরের টিপ পরল।
রুদ্র ওদের বাড়ির লাগোয়া ব্যাচেলার্স মেসে তাস খেলতে গেছে। সেখানে তক্তপোশের উপর ঝুঁকে পড়ে বসে ওরা নিশ্চয়ই তাস খেলছে, কাপের পর কাপ চা খাচ্ছে, সিগারেটের পর। সিগারেট খাচ্ছে। ঘরটিকে এতক্ষণে আস্তাকুঁড় করে তুলেছে। ছেলেমাত্রই নোংরা। তার উপর
অতজন কমবয়সি ছেলে যদি একসঙ্গে থাকে।
আজ শনিবার। মনে পড়ল চৈতির। মনে যে এখনও পড়ে এটাই আশ্চর্য। এই বার্মা-সীমান্তের অজ্ঞাত শেষ গ্রাম মোরেতে ক্যালেন্ডারের কীই-বা দাম! পুরকায়স্থ কোম্পানির চাকরি করে রুদ্র, পাশের মেসের সকলেই তাই করে। জঙ্গলে থেকে কাঠ কাটায়, হাতি দিয়ে বইয়ে আনে, মোরের চেরাই কলে কাঠ চেরাই হয়। তারপর লরি বোঝাই হয়ে চালান যায়–প্যালেল হয়ে ইম্ফল।
চৈতি এখন সকাল-সন্ধ্যেয় রান্না করে, তারপর সন্ধ্যের পর পরই খেয়ে-দেয়ে ঘুম দেয়।
বিয়ের পর পর বেশ লাগত। এমন নিরালা নির্জন জায়গা। সমাজ নেই, লৌকিকতা নেই, শুধু। পাখির ডাক, বাঘের ডাক, আর অবিচ্ছিন্ন অবকাশ। নিজের স্বাধীনতার সংসারে নানারকম মজাও ছিল তখন। ভারত-বার্মা বর্ডারের চেকপোস্টের সকলের সঙ্গে ভাব সকলের। দিব্যি, সেই নো ম্যানস ল্যান্ডের নদীটির উপরের সাঁকো পেরিয়ে বার্মার গ্রাম তামুতে চলে যেত। স্বচ্ছ, রঙিন নাইলনের জামা-পরা বর্মি মেয়েদের সঙ্গে ইশারায় কথা বলত। ওরা ফানুসের মতো হাসিতে। ফুলে ফুলে উঠত–ফুলের মতো মুখে ওরা মুখরা হয়ে উঠত। কাঠের প্যাগোডাতে গিয়েও মাঝে মাঝে বেড়িয়ে আসত। তারপর ভারতের এলাকায় ফেরার পথে পাঞ্জাবি ব্যবসাদারের দোকান থেকে সস্তায় টুকিটাকি কিনে ফিরত। না পাসপোর্ট, না ভিসা, না এত কড়াকড়ি ছিল না। কয়েক বছর আগের দিনগুলোই ভালো ছিল।
এখন আর কোনো মজাও নেই। চৈতির জীবনের সব মজাই যেন শেষ হয়ে গেছে। রুদ্র যে মাইনে পায় তাতে কোনো মজার খেলনা তৈরি করতে রুদ্র মোটে সাহস পায় না। ওরা খালি ঘুমোয়, ঘুম ভেঙে ওঠে, খায়, রোজকার কাজ করে, আবার ঘুমায়। চৈতি অনেকবার হাবে-ভাবে বুঝিয়েছে, কিন্তু রুদ্র খেলনা পছন্দ করে না। খেলাও না। মাঝে মাঝেই বড়ো ক্লান্তি লাগে চৈতির।
প্রথম যেদিন রমাপিসির সঙ্গে এখানে বেড়াতে আসে, ওরা পাহাড়ের উপরের মোরে ডাকবাংলোতে ছিল। সে রাতে পিসেমশাই-এর গাড়ির পেট্রল ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে গেছিল। পিসেমশায়ের সহপাঠী পুরকায়স্থ সাহেবের কর্মচারী রুদ্র চ্যাটার্জির ডাক পড়েছিল তখন সে বাংলোয়। সেদিনও এমনি কনে-দেখা আলো ছিল আকাশে। খাকি শর্টস পরনে এবং খাকি। হাফশার্ট গায়ে, চটপটে সপ্রতিভ স্বাস্থ্যবান রুদ্র বাংলোর বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। পাহাড়ের পটভূমিতে সেই শেষবেলায় কী যে দেখেছিল জানে না চৈতি, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেনি। শুধু ওর হৃদয়টি একটি ঝিনুক-ঝিঝির মতো ঝুমুর ঝুমুর করে বেজেছিল।
তারপর যা হয়ে থাকে তাই হয়েছিল। ইম্ফলে বেড়াতে আসা কলকাতার মেয়ে এই মোরের বাংলোয় মরতে চেয়েছিল। মরে গেছিল। তাকে কেউ বাঁচাতে পারেনি।
এখন সূর্য ডুবে গেছে। সেপ্টেম্বর মাস। সারাদিন নীল আকাশে সোনালি রোদ সাঁতার কেটে কেটে বিকেলে হাঁফিয়ে বেড়ায়। ঝুরঝুর করে সজনে পাতায় দোল দিয়ে হাওয়া বয়। গেটের কাছের আমলকী গাছটা সারাদিন মুচুর-মুচুর করে পাতা ঝরায়। শেষ বিকেলে দাঁড়কাকটা চ্যাগারের। উপর বসে বসে শুদ্ধ গা-তে কাকা-কা-কা করে গান গায়। মণিপুরি মেয়েরা খোলের তালে। তালে বাড়ির উঠোনে উঠোনে পুং-চোলোম কিংবা থৈবি-খাম্বার নাচ নাচে। ওদের গানের সুর। দেখতে দেখতে কার্তিক মাসের কুয়াশার মতো সন্ধ্যের পর সমস্ত মোরের আকাশ বাতাস ভরে তোলে। সুরের সুরেলা চাঁদোয়ার মতো মোরের আকাশে ওদের গান আর খোলের শব্দ ভেসে বেড়ায়। দুলতে থাকে।
বেশ লাগে। ময়দা মাখতে মাখতে কী প্রেসার কুকারে মাংস চড়িয়ে বসে বসে চৈতি ওর কলকাতার জীবনের কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় যে, ইচ্ছে করলে ও-ও আজকে বালিগঞ্জ পাড়ার কোনো এক্সিকিউটিভের স্ত্রী হতে পারত, এই সময় আলো ঝলমল রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে ছোকরা চাকরকে সঙ্গে নিয়ে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে শপিং-এ বেরোতে পারত।
এখন ওর মনে হয়, ও যেন বরাবর এই মোরেতেই ছিল, মোরেতেই ও বড়ো হয়েছে, মোরেতেই ওর মরণ হবে।
এমন সময় ঝড়ের বেগে রুদ্র ঘরে ঢুকেই বলল, আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছিলে? খাবারদাবার কিছু আছে?
চৈতি হেসে বলে, দাঁড়াও, একটু বোসো ইজিচেয়ারে, আনছি।
ওসব বসা-টসার সময় নেই আমার। আমায় এক্ষুনি যেতে হবে।
কোথায় যাবে?
তা দিয়ে তোমার দরকার কী?
দরকার নেই?
না দরকার নেই। যাচ্ছি আমাদের ব্যাডমিন্টন ক্লাবে, মিটিং আছে।
চৈতি মুখ নামিয়ে বলল, বেশ।
অল্পক্ষণের মধ্যে জামাকাপড় বদলে রুদ্র বেরিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল-আমার জন্যে আবার বসে থেকো না খাবার নিয়ে, প্রেম দেখাবার জন্যে। বলেই, বেরিয়ে গেল।
চৈতি নিজের মনে বিড় বিড় করে বলল, প্রেম আমার আর নেই।
চৈতি জানে, রুদ্র কোথায় গেল এখন।
প্যালেলের রাস্তায় কিছুদূর গিয়ে ডান দিকে জঙ্গলের মধ্যে একটি শুড়িখানা আছে। ওর মণিপুরি ঠিকে ঝিয়ের কাছে সব শুনেছে চৈতি। বাঁশের বেড়া-দেওয়া ঘর। মোষের শিং-এর মতো বিনুনি বাঁধা মোটাসোটা খাসিয়া মেয়ে আছে ওখানে দুটি–তাদের দেখতেও-নাকি মোষের মতো। তা ছাড়া বর্মি মেয়েও আছে একটি। রুদ্ররা সেখানে যায়–সস্তায় দেশি মদ খায়–মেয়েগুলোর সঙ্গে কী করে না করে জানে না চৈতি। ভাবতেও পারে না। ভাবলেও ওর গা বমি বমি করে।
এই জঙ্গলে এসে বোধহয় হেরে গেছে চৈতি। যে জঙ্গল পাহাড়কে ভালোবেসে ও এখানে একদিন এসেছিল সেই জঙ্গল পাহাড়ই ওকে হারিয়ে দিয়েছে। ওর ঘরের মানুষকে ও বেঁধে রাখতে। পারেনি। রুদ্রকে নতুন কিছু দেবার মতো কিছু আর বাকি নেই চৈতির। চৈতি নিঃশেষে ফুরিয়ে গেছে। ওরা যদি দুজনে মিলে একটি হাসি-খুশি গাবলু-গুবলু ঝুমঝুমি বানাত, তবে হয়তো এমন হত না। তবে হয়তো এমনি সব সন্ধ্যেবেলায় ওরা বসে বসে সেই ঝুমঝুমি বাজাত–তাকে নাড়ত চাড়ত–তার কথা বলা, তার চোখ চাওয়া নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু একা একা তো চৈতি। কিছুই করতে পারে না। একলা একলা তো কেউ খেলনা গড়তে পারে না। মাঝে মাঝে ও মনস্থির করে ফেলে। ভাবে পরদিনই ভোরের বাসে ফিরে চলে যাবে ইম্ফল-সেখান থেকে কলকাতা। যাবে না তো কী! এখনও কি সেই শরৎচন্দ্রের যুগে আছে? না কি ও কাঁদতে বসবে? কান্নাকাটি নয়। ঝগড়াঝাঁটিও নয়। সোজা বেরিয়ে যাওয়া। এক বস্ত্রে। বাড়ি থেকে।
কিন্তু পারল কই? ভাবল তো কতদিন। যখন ভোরবেলা ঘুম ভেঙেছে, দেখেছে অসহায়ের মতো রুদ্র পাশে শুয়ে আছে। তার কোমরের উপর দিয়ে ডান হাতটি মেলে দিয়েছে। রুদ্রের লজ্জা নেই, ভয় নেই, গ্লানি নেই। তবু, রুদ্রর হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চৈতি উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়াতেই ভোরের মিষ্টি হাওয়া গায়ে লেগেছে। সকালের শুকতারাটি স্নিগ্ধ নীলাভ দ্যুতিতে ওকে রোজকার মতো সান্ত্বনা দিয়েছে–বাগানের বুলবুলিরা রঙ্গনের ডালে চুলবুল করে উঠেছে। ও সব ভুলে গেছে। শুধু মনে হয়েছে, রুদ্র এখুনি বেরিয়ে যাবে কাজে, বেচারা কত মাইল পথ পায়ে হেঁটে, হাতির পিঠে যাবে কে জানে? সব রাগ ভুলে গিয়ে তাড়াতাড়ি চায়ের জল বসাতে গেছে চৈতি।
কিন্তু আর নয়। আজ ও সত্যি সত্যিই প্রতিজ্ঞা করে ফেলল। আর নয়। লজ্জাহীনেরও লজ্জা আছে! সেই লজ্জার সীমাও তার পেরুনো হয়ে গেছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করবে সে। হেস্তনেস্ত মানে, চেঁচামেচি নয়। কাল ভোরের প্রথম বাসেই চলে যাওয়া। কোনো বন্ধন নেই চৈতির–রুদ্রর সঙ্গে। একদিন মা বাবার সঙ্গে যেমন ঝগড়া করে রুদ্রর হাত ধরে চলে এসেছিল এই পাহাড়-জঙ্গলে, আজ আবার রুদ্রর সঙ্গে ঝগড়া করে মা-বাবার কাছেই ফিরে যাবে। মা-বাবার কাছে আবার লজ্জা কী? কিন্তু, সত্যিই কি লজ্জা নেই? মাকে সে কী করে বলবে যে, যাকে ভালোবেসে সে মা-বাবাকে দুঃখ দিয়ে এই বার্মা সীমান্তে এসে, অতি দীন জীবনযাপন করছে-সেই রুদ্রই তাদের সুগন্ধি চৈতিকে সাঁঝবেলাতে একা ঘরে রেখে–মোষের মতো চেহারার দুটি পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে যায়। একথা কী করে কোন মুখে সে বলবে? না না তার চেয়ে ইম্ফলে গিয়ে লকটাক লেকে ডুবে মরবে। নইলে, মোরে ডাকবাংলো থেকে নীচের পিচের রাস্তায় ঝাঁপ দেবে। যাই করুক, কাল সকালে ও কিছু একটা করবেই।
রাত কত হয়ে গেছে জানে না চৈতি। বাইরের ফিকে জ্যোৎস্নাও ওর মতো খেলাহীন একাকিত্বে বেদনাতুর, স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকছে। আর নিঝুম নদীর পাশে পাশে, মাঝে মাঝে একটি হায়না হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে ওর ব্যথার বুক কাঁপিয়েছে। ছেলেদের মেসের কমোন পেট ভালুকের বাচ্চাটি মাঝে মাঝে কুঁক কুঁক কুঁক করে উঠেছে। ওর বোধহয় ভয় করছে কিংবা জ্বর আসছে চৈতির মতো।
চেয়ারে বসে বসেই চৈতি ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঝিঝিগুলো ঝিঝির ঝিঝির করে বাইরে বসে ওকে পাহারা দিচ্ছিল। এমন সময় দরজায় হঠাৎ ধাক্কা শুনে চৈতির ঘুম ভেঙে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজার পাশের খোলা জানলা দিয়ে টর্চের তীব্র এক ঝলক আলো ওর মুখে এসে পড়ল।
ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চৈতি ভীষণ ভয় পেল। অত ভয় ও এখানে এসে এর আগে কোনোদিন পায়নি। চৈতি কথা বলতে পারল না।
এমন সময় রুদ্র জড়ানো জড়ানো গলায় বলল, দরজা খোলো।
ও দরজা খুলেই রুদ্রর বুকে আছড়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। প্রথমে ও যে ডাকাতের হাতে পড়েনি এই ভেবে চৈতির আনন্দ হয়েছিল। পরক্ষণে ও যে ডাকাতের হাতেই পড়েছে, এইটে জেনেই ওর কান্না পেয়ে গেল। ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল রুদ্রর বুকে মুখ রেখে। রুদ্র ওকে সবল হাতে ধরে, ওর সামনে দাঁড় করাল তারপর টর্চের আলোটা আবার চৈতির মুখের সামনে ধরল। রুদ্র দেখল চৈতির দু-চোখে জল, এবং গাল বেয়ে ধারা নেমেছে। টর্চটা খাটে ছুড়ে ফেলে রুদ্র চৈতিকে এমন জোরে জড়িয়ে ধরল যে চৈতির মনে হল ওকে আজ রুদ্র গুঁড়িয়ে। ফেলবে। ফুরিয়ে যাওয়া একটি দেশলাইয়ের বাক্সর মতো ওকে আজকে ভেঙে ফেলবে। চৈতির সবকটি আগুন জ্বালানো কাঠিই বুঝি শেষ হয়ে গেছে। ও ফাঁকা। ফাঁকা দেশলাই।
কী করছ? লাগছে যে! তার চেয়ে আমাকে একেবারে মেরে ফেলো।
রুদ্র তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, খেতে দাও। ভীষণ খিদে পেয়েছে।
আশ্চর্য! তবু সে কাঁপা কাঁপা হাতে রুদ্রর জন্য খাবার বাড়ল। এবং খেতে বসার জায়গা করে দিল। রুদ্র হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে বলল, তোমার?
আমি খাব না।
তোমার ঘাড় খাবে।
ভদ্রভাবে কথা বলো।
কথা যে ভাবেই বলি না কেন,
অর্ডার?
হ্যাঁ অর্ডার।
বলে রুদ্র জোর করে চৈতিকে পাশে টেনে বসাল। নিজে হাতে এক গ্রাস ভাত মাংসের ঝোল দিয়ে মেখে, চৈতির মুখে তুলে দিয়ে বলল, খাও।
কথা না বলে ও লক্ষ্মীমেয়ের মতো নিঃশব্দে খেতে লাগল। তখনও ওর চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। রুদ্রর মনে কী হল যে সেই জানে, রুদ্র জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, তুমি আমার উপর রাগ করেছ?
আমি কি তোমার উপর রাগ করতে পারি? আমি তো তোমার খেলনা ছাড়া আর কিছু নই। আমাকে কি তুমি মানুষ বলে মনে করো?
রুদ্র খাওয়া থামিয়ে চৈতির দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, এ্যাই শোনো।
চৈতি ভাতমুখেই বলল, কী?
রুদ্র বলল, বলছি, আগে মুখের ভাত খেয়ে নাও।
চৈতি তাড়াতাড়ি ভাত গিলে ফেলে বলল, কী?
রুদ্র এঁটোমুখে ওর জল ভেজা গালে একটি সশব্দ অভদ্র চুমু খেয়ে বলল, আমরা না, আজকে খেলনা গড়ব।
চৈতির ভেজা চোখে আগুন জ্বলে উঠল। ও বলল, মিথ্যুক!
রুদ্র বলল, সত্যি। মিথ্যো কথা নয়। সত্যি।
কাঁদতে কাঁদতে চৈতি ফিক করে হেসে উঠল, বলল, আমি বিশ্বাস করি না।
প্রত্যয়-ভরা গলায় রুদ্র বলল, বিশ্বাস করো না? আচ্ছা তাড়াতাড়ি খাও।
কিন্তু আর খেতে পারল না চৈতি। থরথর করে ওর সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। ও ভাবতে পারছিল না যে, ওরা দু-জনে সত্যিই খেলনা গড়বে। ওদের দুজনের খেলনা।
ও বলল, তুমি আমার ভাগেরটাও খাও।
বলেই, মাংসের বাটিটা উপুড় করে রুদ্রর পাতে ঢেলে দিল।
রুদ্র বলল, এখনও খেলনার শখ গেল না খুকি। তুমি এখনও কচি খুকি।
রুদ্রর রুক্ষ চোখে ওর পেলব চোখ মেলে চৈতি বলল, তুমি ভীষণ অসভ্য। বলেই, খাবার জায়গা ছেড়ে উঠে গিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে, আনন্দে অস্থিরতায় বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দু-হাত দিয়ে একটি কোল বালিশকে আশ্লেষে আঁকড়ে শুয়ে পড়ল।
রুদ্র খাওয়া শেষ করে উঠে লণ্ঠনের শিখাঁটি কমিয়ে দিয়ে পাশে বসে একটি সিগারেট ধরাল।
ফস করে দেশলাইটি জ্বালল। লালে মেশা আগুনের অসংখ্য আঙুলগুলি দেওয়ালে দেওয়ালে কথাকলি নেচে গেল।
চৈতি মুখ ফিরিয়ে সেই আগুনের দিকে চাইল–ওর চাতক মনের চোখের সামনে সারে সারে শত শত নীল দেশলাইয়ের দেওয়ালি দারুণ দম্ভে দপদপিয়ে উঠল।
চৈতির মাথার মধ্যে ছোটোবেলার মিষ্টি ভাবনাগুলি ঝিনুক-ঝুনঝুনির মতো কোনো অদৃশ্য সেতারির ঝালায় ঝরতে লাগল। ললিপপ, লাল নীল দেশলাই, খেলনা, শিউলিফুলের গন্ধ, মায়ের চোখের চাউনি, সব একে একে সারে সারে, ওর মাথায় ভিড় করে এল। চৈতির মনে হল,
এই শারদ রাতে শুয়ে শুয়ে ও কোনো স্নিগ্ধ সুগন্ধি স্বপ্ন দেখছে।
রুদ্র হ্যারিকেনটা নিবিয়ে দিল।
একদল নরম তুলতুলে সাদা বেড়ালের মতো শরতের জ্যোৎস্না আমলকী গাছের ডাল বেয়ে জানলা গলে ঝুপঝুপিয়ে খাটে এসে নামল। টিনের চালে চৈতি শিশির পড়ার শব্দ শুনতে পেল–টুপ টুপ।
পাশে শুয়ে রুদ্র কী যেন বলতে যাচ্ছিল।
ওর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে চৈতি ফিসফিস করে বলল, চুপ, চুপ।