Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » খেয়ালি || Samaresh Majumdar

খেয়ালি || Samaresh Majumdar

জংশন স্টেশন থেকে দুপুর সাড়ে বারোটার ট্রেন ধরলে ঠিক পৌনে চারটের সময় গমনপুরে পৌঁছে যাওয়া যায়। অগ্রিম জানতে পারলে ভদ্রলোক স্টেশনে লোক রাখবেন। গমনপুর থেকে খেয়ালি গ্রাম গাড়িতে পনেরো মিনিটের পথ। ওই চিঠির উত্তরে জানিয়ে দিয়েছিলাম কবে যাচ্ছি। মুশকিল করল মেল ট্রেনটা। সারাটা পথ খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে যখন জংশন স্টেশনে ঢুকল তখন দুটো বেজে গেছে। গমনপুরের ট্রেন তার অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছে।

কথা বলে জানা গেল ওই লাইনে দিনে দুবার ট্রেন যায়, আসে। দ্বিতীয় ট্রেনটি ছাড়বে পৌনে ছ’টায়, গমনপুরে পৌঁছবে ন’টায়। তা না হলে আজকের রাতটা ওখানেই কাটাতে হবে, সেক্ষেত্রে কাল সাড়ে বারোটার আগে ট্রেন নেই। স্থির করলাম সন্ধের ট্রেনই ধরব। রাত ন’টায় পৌঁছে পনেরো মিনিটের বাসপথ নিশ্চয়ই ম্যানেজ করা যাবে। ধরে নেওয়া যাচ্ছে অরুণেশ্বরবাবুর লোক। অত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না।

ট্রেনের চেহারা এবং গতি ছ্যাকরা গাড়িকেও হার মানায়। যাত্রীরাও কোনও বিশেষ পরিচয়ের নয়। টুকরো-টুকরো কথাবার্তায় জানা গেল দিন দুয়েক খুব বৃষ্টি হওয়ায় এদিকের অনেক রাস্তা এখন প্লাবিত। জানা গেল, গমনপুরে কোনও হোটেল নেই।

ট্রেন ঠিকঠাক সময়ে স্টেশনে পৌঁছলে আবিষ্কার করলাম আমাকে নিয়ে মাত্র দুজন যাত্রী প্ল্যাটফর্মে পা দিল। টিমটিমে আলোর বাইরের পৃথিবীটায় ঘন অন্ধকার। একজন কর্মচারী গম্ভীর মুখে লুঙির ওপর ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে দেখছেন যেন ট্রেনটি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেলে ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে বললাম, ‘নমস্কার’।

ভদ্রলোক এমনভাবে মাথা উঁচু করে তাকালেন যে তাঁকে ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মনে হল।

‘আমি খেয়ালি গ্রামে যেতে চাই। কোথায় বাস পাওয়া যাবে?’

‘কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখানে কোনও হোটেল নেই, ধর্মশালা নেই, স্টেশনের ওয়েটিং রুমের অবস্থা খুব খারাপ। তাই হাঁটতে শুরু করুন। দু-ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন।’ ভদ্রলোক তাঁর অফিস ঘরের দিকে লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন।

স্টেশনের বাইরে এলাম। দুটো দোকান দেখতে পাচ্ছি তারার আলোয়, যাদের ঝাঁপ বন্ধ। লোকজন নেই। পাশেই রেল কোয়ার্টার্স। সেখানে রেডিওতে হিন্দি গান বাজছে। ওই ভদ্রলোক সম্ভবত ওখানেই থাকেন। এই সময় একটা সাইকেল দ্রুত চলে এসে ব্রেক কষল, ‘ট্রেন চলে গেল?’

আমার উদ্দেশ্যে নয়, তবু উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ।’

‘যাঃশালা! আজও সটকে গেল। রাস্তার যা অবস্থা কিছুতেই জোরে আসতে পারলাম না।’

‘আপনি এখানে থাকেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘এখানে মানে, আরামপুরে। চার মাইল দূরে। আপনি?’

‘ওই ট্রেন থেকে নেমেছি। যেতে চাই খেয়ালি গ্রামে।’ বিনীত ভঙ্গিতে বললাম।

‘ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। এত রাত্রে হাঁটতে পারবেন?

‘রাস্তাটা যদি বলে দেন–’

‘উঠুন, পেছনে বসুন। এক মাইল এগিয়ে দেব, তারপর আমি বাঁদিকে আপনি ডান দিকে। খেয়ালিতে কার বাড়িতে যাবেন?’

ততক্ষণে স্যুটকেশ নিয়েই ক্যারিয়ারে উঠে বসেছি। বললাম, ‘অরুণেশ্বরবাবু, অরুণেশ্বর বিশ্বাস।’

‘ও। ভদ্রলোকের জলজ্যান্ত ছেলেটা হুট করে মরে গেল। তা খবর দেননি কেন? দিলে নিশ্চয়ই লোক পাঠাতেন স্টেশনে!’ প্যাডেল ঘোরাতে-ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল লোকটা। জবাব দিলাম না। দিলে অনেক কিছু বলতে হত। আমি অন্ধকার দেখছিলাম। শহরে বসে এই অন্ধকার কল্পনা করা যাবে না। লক্ষ করলাম একটু-একটু করে মেঘ ছড়াচ্ছে আকাশে, ফলে তারার আলো নিভতে শুরু করেছে। খারাপ রাস্তায় চাকা পড়ায় শরীর লাফাচ্ছে। লোকটা একসময় থামল, ‘এবার আপনি ডান দিকের রাস্তা ধরে চলে যান। খেয়ালির আগে কোনও গ্রাম নেই।’

আমি নেমে দাঁড়াতেই সে নিমেষের মধ্যে হারিয়ে গেল অন্ধকারে। চারপাশে একটা পাক দিয়ে দেখলাম কোথাও আলো নেই। যেটাকে রাস্তা বলে গেল লোকটা সেটা মাটির। যা কাদা হয়ে আছে এবং পাঁচ হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না, এর চেয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা অনেক বেশি স্বস্তির ছিল।

হাঁটা শুরু করলাম। প্রায়ই কাদায় জুতো ডুবে যাচ্ছে। প্রথম দিকে জুতোর জন্যে যে মায়া হচ্ছিল পরে তা থাকল না। যা হচ্ছে হোক, পৌঁছতে যখন হবে তখন এসব ভেবে লাভ নেই। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ আওয়াজটা কানে এল। দু-পাশের মাঠ অন্ধকারে ঢাকা। ডান দিকের মাঠে একটি ব্যাং প্রবল আর্তনাদ করছে। ব্যাঙের ডাক শুনেছি, আর্তনাদ এই প্রথম। সম্ভবত সাপের পেটে যাচ্ছে ওটা। তখনই খেয়াল হল এই অন্ধকারে পায়ের সামনে সাপ পড়লেও তো বুঝতে পারব না। দ্রুত হাঁটলে ছোবল মারার সুযোগ পাবে না সাপ। সেই চেষ্টা করলাম। তারপরেই চলে এলাম বড়-বড় গাছের মাঝখানে। ওগুলো কী গাছ এখন চেনা সম্ভব নয়। তবে বেশ ঝাঁকড়া। গাছের নিচে আসতেই কান্না কানে এল। যেহেতু ওটা ওপর থেকে ভেসে আসছে তাই পাখির কান্না বলেই বোধ হল। পাখিও যে মানুষের গলার কাছাকাছি গলায় কাঁদতে পারে তা আগে। জানতাম না। শরীরে কাঁটা ফুটল।

আমি ভূতপ্রেত নিয়ে কখনও মাথা ঘামাবার প্রয়োজন অনুভব করিনি। ভূত এবং ভগবান, দুটোই দুর্বলচিত্ত মানুষের কল্পনায় তৈরি। কিন্তু পরিবেশ কখনও-কখনও এদের অস্তিত্ব তৈরি করতে সাহায্য করে। এই অন্ধকারে ওই গোঙানি, পাতার খসখস শব্দ, পায়ের তলার কাদা মাটি একত্রিত হয়ে ছেলেবেলা থেকে শুনে আসা ভূতের গল্পগুলোকে মনে আনতে সাহায্য করল। আমি দ্রুত হাঁটতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু কানের পরদা থেকে গোঙানির আওয়াজটা কিছুতেই দূর হচ্ছিল না।

শেষ পর্যন্ত কিছু ঘরবাড়ি চোখে পড়ল। বুঝলাম আমি একটি গ্রামে ঢুকেছি। এই গ্রামের নাম খেয়ালি হলেও হতে পারে। কিন্তু বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। আলো জ্বলছে না। এখন রাত বারোটার কাছাকাছি। গ্রামের মানুষ এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন! বিস্তর ডাকাডাকির পর সাড়া মিলল। দুজন বেরিয়ে এলেন। একজনের হাতে হ্যারিকেন, দ্বিতীয়জনের লাঠি। আমার অবস্থা। দেখে বোধহয় ওঁরা বুঝতে পারলেন আমি দুবৰ্ত্তনই। হ্যাঁ, গ্রামের নাম খেয়ালি। আর অরুণেশ্বরবাবু থাকেন দক্ষিণপাড়ায়। সামনের মোড় থেকে ডান দিকে হাঁটলেই দক্ষিণপাড়া। সবচেয়ে বড় বাড়িটাই তাঁর। ওঁর পিতামহ জমিদার ছিলেন। সেইসঙ্গে ওঁরা আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। ফাঁপরে পড়লাম। বানিয়ে বললাম, ‘আমি ওঁর সঙ্গে ইনসিওরেন্সের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।’ ওঁরা আমাকে বিদায় দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। লক্ষ করেছিলাম, কথা বলার সময় দুজনই চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে চারপাশে দেখছেন। সেই দৃষ্টি স্বাভাবিক ছিল না।

দক্ষিণপাড়ায় ঢুকেও একই দৃশ্য। কোনও বাড়িতেই আলো জ্বলছেনা। বই-এর পাতায় ভূতুড়ে গ্রামের যে বর্ণনা থাকে হুবহু তাই। শেষপর্যন্ত অন্ধকারেও বিশাল বাড়িটাকে ঠাওর করলাম। কোথাও কোনও আলো নেই। ছাদের দিকে তাকাতেই একটা সাদা বস্তুকে নড়তে দেখলাম। তার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। শুধু ছাদের এক পাশ থেকে সেটা অন্য পাশে চলে যাচ্ছে, ফিরে আসছে। আমি দ্রুত বাড়ির গেটে আওয়াজ করতে লাগলাম, ‘বাড়িতে কেউ আছেন? দরজা। খুলুন।’

বেশ কয়েকবার চিৎকার করার পর হঠাৎই দোতলা থেকে একটা টর্চের তীব্র আলো আমার ওপর এসে পড়ল। আমি চোখের ওপর হাতের আড়াল রেখে দেখার চেষ্টা করতেই গলার স্বর শুনতে পেলাম ‘কে? কে ওখানে?কী চাই?’

‘আমি শহর থেকে আসছি। অরুণেশ্বরবাবু আমাকে আসতে লিখেছিলেন!’ চেঁচিয়ে বললাম।

‘নাম বলুন!’

বললাম। তারপরেই হুকুম হল, ‘কার্তিক, দরজা খুলে ওঁকে ভেতরে নিয়ে আয়।

মিনিট দুয়েক বাদে দরজা খুলল। একটা হ্যারিকেন এগিয়ে এসে গেটের তালা খুলে সরে দাঁড়াতে আমি ভেতরে ঢুকলাম। আবার তালা লাগিয়ে লোকটা হাত বাড়াল, ‘ওটা দিন।’

এতটা পথ যখন বইতে পেরেছি তখন এটুকু পারব। বললাম, ‘থাক।’

‘না। কর্তার হুকুম। ওর ভেতরে অস্ত্র থাকতে পারে।’ তর্ক না বাড়িয়ে লোকটা আমার স্যুটকেশ হস্তগত করল। কেউ এই বাড়িতে লুকিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসবে এমন সম্ভাবনা আছে নাকি?

ভেতরে ঢোকার পর হ্যারিকেনের আলোয় বাঁধানো উঠোন চোখে পড়ল। দু-পাশে বারান্দা। যে ভদ্রলোক দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁর পরনে ফতুয়া এবং ধুতি। বয়স ষাট পেরিয়েছে। হাত বাড়িয়ে। বললেন, ‘আমার চিঠিটা কি সঙ্গে আছে?’

ছিল, দিলাম। সেটার ওপর চোখ বুলিয়েই ভদ্রলোকের গলার স্বর বদলে গেল, ‘ও হো! আমার লোক গিয়েছিল স্টেশনে। দুপুরের ট্রেনে আসার কথা, না দেখে ফিরে এসেছে। আপনি এই অন্ধকারে কাদাভরা রাস্তায় কী করে এলেন?’

অল্প কথায় ঘটনাগুলো জানালাম। স্টেশনে বসে রাত না কাটিয়ে হেঁটেই আসতে পারব ভেবে এগিয়েছিলাম। রাস্তার অবস্থা জানলে পা বাড়াতাম না।

‘আপনার খুব ভাগ্য ভালো তাই সশরীরে পৌঁছতে পেরেছেন। যাক, এখন পোশাক পালটে থিতু হয়ে বসুন। রাতের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে, খেয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে কাজের কথা হবে। কার্তিক, বাবুকে স্নানঘর দেখিয়ে দে।’ ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। ওঁর জুতোর শব্দ মিলিয়ে যাওয়া মাত্র বাড়িটা কী ভয়ঙ্কর চুপচাপ হয়ে গেল!

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর আমার জন্যে খাবার নিয়ে এল কার্তিক। মাছভাজা গোটা তিনেক, রুটি, ডাল বেগুনভাজা আর সামান্য ক্ষীর। কার্তিক বিনীত ভঙ্গিতে বলল, হেঁশেল তুলে দিয়েছিল, সবার খাওয়া তো শেষ হয়ে গেছে, এইটুকু কোনওরকমে–আপনার খুব অসুবিধে হবে!’

‘আমাকে তো সারারাত মাঠেঘাটে বসে থাকতে হত। এ তো অমৃত পাওয়া!’

‘আপনি খুব ভাগ্যবান বাবু।’

‘কেন?’

‘এত রাত্রে কুলকুলির মাঠ ভেঙে সশরীরে এলেন–!’

‘কেন? ওখানে কী হয়?’

‘আত্মারা থাকেন।’

‘ও। না, তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।’ খাওয়া শুরু করলাম, ‘আচ্ছা কার্তিক, তোমাদের গ্রামের মানুষরা এত তাড়াতাড়ি দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে কেন বলো তো? মনে হচ্ছে, বাইরের কাউকে ভয় করছে সবাই?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘আপনি এসব বড়বাবুর মুখে শুনবেন!’ কার্তিক নড়ে উঠল, ‘আপনি খাওয়া হয়ে গেলে দরজাটা বন্ধ করে দেবেন। থালাবাসন কাল সকালে নিয়ে যাবে। হ্যারিকেনটা অসুবিধে হলে জ্বেলে রাখবেন। আচ্ছা!’ কার্তিক চলে গেল।

ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। অতটা কাদাজলে হাঁটাহাঁটি করে শরীর বোধহয় আরাম চাইছিল। দেখলাম, বেশ রোদ উঠেছে। বাথরুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। কথাগুলো যদি সকালেই হয়ে যায় তাহলে দুপুরের ট্রেন ধরে ফিরে যাব।

ঘোমটা দেওয়া এক কাজের মহিলা চা নিয়ে এল ট্রেতে। শুধু চা নয়, সঙ্গে ফুলকো লুচি, বেগুন ভাজা আর ক্ষীর। বুঝলাম এ-বাড়িতে দুধের কোনও অভাব নেই। কিন্তু সকালে প্রথম কাপ চায়ের সঙ্গে এত ভাজাভুজি খাওয়া অভ্যেস আমার নেই। তাই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বললাম। স্ত্রীলোকটি একটু ইতস্তত করছিল। বললাম, ‘এখন আমি ওসব খাই না।’

‘বউদিমণি রাগ করবেন।’

বউদিমণি কে আমি জানি না। বললাম, ‘তাঁকে বুঝিয়ে বলো।’

অনিচ্ছা নিয়ে সে চায়ের কাপ নামিয়ে ট্রে তুলে চলে গেল।

চা শেষ হতেই কার্তিক দরজায় এল, ‘বড়বাবু বাগানে অপেক্ষা করছেন।’

বাগানটি ফুলের নয়। নানান ধরনের সবজি চারপাশে। তার মধ্যে দুটো বড় বেঞ্চি যার একটায় বসে ছিলেন অরুণেশ্বরবাবু। আমায় দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঘুম হল?’

‘হ্যাঁ। খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাই–’

‘বসুন। হ্যাঁ, প্রথমে আপনার পরিচয় একটু বিশদে শুনি।‘

‘আমি যা লিখেছি তার বেশি তো কিছু বলার নেই।’ বললাম।

‘আপনার বয়স উনচল্লিশ। এতদিন বিয়ে করেননি কেন?’

উদ্যোগ নেওয়ার কেউ ছিল না, নিজেরও ইচ্ছে হয়নি।’

‘বাড়িতে কে আছেন?’

‘বাড়ি নয়, ফ্ল্যাট। একজন কাজের লোক, অবশ্য তাঁকে কাজের লোক বলা চলে না। আমার বাল্যকাল থেকেই তিনি আছেন। বাবা-মা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসতে চাননি। ওখানেই মারা গিয়েছেন বয়স হওয়ায়। কাশীদাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমি চাকরি করার পর।’

‘আপনার সম্পর্কে খোঁজখবর করার তাহলে ওই কাশীদা ছাড়া কেউ নেই?’

‘আমি ঠিক জানি না।’

‘আপনি একটি বড় ওষুধের কোম্পানির ওই জেলার প্রতিনিধি। চিঠিতে যে মাইনের কথা লিখেছেন তা খুবই ভালো। একা লোক, কী করেন অত টাকা দিয়ে?’

‘বছরে একবার ভারতবর্ষ দেখতে যাই। বড় হোটেলে উঠি। বেশ খরচ হয়ে যায়।’

‘এবার বলুন, আপনার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?’

‘হ্যাঁ, আপনি লিখেছেন উনি আপনার মেয়ের মতো, ব্যাপারটা কী?

‘আর?’

‘কত বয়স? কী করেন? ছবিতে বয়স বোঝা যায়নি। মনে হয়েছে খুব কমবয়সি। সেক্ষেত্রে আমার আপত্তি আছে। কিন্তু আপনি লিখেছেন যে আপনার বয়স এখন ছিয়াত্তর। ছবির মেয়েটি আপনার মেয়ে হওয়া একটু অস্বাভাবিক। তাই–।’।

‘ঠিকই। ওটা আমার মায়ের বছর সাতেক আগে তোলা ছবি। এখন ওর বয়স তিরিশ।’

‘ও।’

‘এই সাত বছরে সে কিছুতেই ক্যামেরার সামনে যেতে চায়নি বলেই ওটা পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। অবশ্য বয়স বাড়া ছাড়া চেহারায় কোনও পরিবর্তন হয়নি।’ বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন।

আমি চুপ করে ওঁকে দেখছিলাম। বার্ধক্যেও উনি সুপুরুষ।

বললেন, ‘বছর সাতেক আগে আমি আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম। আমার একমাত্র সন্তান। মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়েটিকে পুত্রবধূ হিসেবে নিয়ে এসেছিলাম এ বাড়িতে। সেদিন ওদের কালরাত্রি। আলাদা থাকতে হয়। ছেলে গেল বন্ধুদের সঙ্গে রাত্রে যাত্রা শুনতে। ওই স্টেশনের ধারে। মাঝরাতে ফেরার সময় ওই জঙ্গলের পথে সে খুন হয়ে গেল।’ বৃদ্ধ চুপ করলেন, করে থাকলেন কিছুক্ষণ।

‘সে কী? কেন?”

‘ভুল করেছিল। যে পার্টি খুন করে তারা অন্য কাউকে খুন করতে চেয়েছিল, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। ওরা পরে খুব অনুতপ্ত হয়েছে, কিন্তু আমার ছেলে চলে গেল। এই হত্যার বদলা নিতে মারামারি চলল কিছুদিন। তারপর রাজনৈতিক খুনোখুনি বলে পুলিশ হাত গুটিয়ে নিল। আমার পুত্রবধূর ফুলশয্যা হল না। তার মামা এসেছিলেন খবর পেয়ে। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই অবস্থায় মেয়েটির কী হবে? আমি বলেছিলাম, বউমা যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমি তাঁকে আমার মেয়ে ভেবে মাথায় করে রাখব। আমার তো কোনও মেয়ে নেই। স্ত্রী চলে গেছেন, ছেলেও গেল, তিনি থাকলে আমি বাঁচতে পারব। সেই থেকে তিনি এখানে আছেন। কিন্তু আমার বয়স হচ্ছে। আমার পরে তাঁর কী হবে? এই ভাবনা থেকেই আমি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি।’

কিন্তু বিজ্ঞাপনে বা তার পরে চিঠিতে এসব প্রকাশ করেননি!

‘কারণ আমার পুত্রবধূকে আমি বিবাহিতা বলে মনে করি না। বিয়ের লগ্ন ছিল মধ্যরাতের পরে, সেসব চুকতে ভোর হয়ে আসে। দিনের বেলায় ফিরে আসে এ-বাড়িতে। সেই রাত কালরাত্তির। সব অর্থেই। সে শেষ হয়ে যায়। মেয়েটা নিজেকে বিবাহিতা ভাবার অবকাশই পায়নি।’ বৃদ্ধ। আমার দিকে তাকালেন, ‘অবশ্য আপনি আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন।’

আমি সত্যি কৌতূহলী হয়েছিলাম। পুত্রবধূকে নিজের মেয়ে মনে করে ইনি আবার বিয়ে দিতে চাইছেন, এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না।

বললাম, ‘এই ছবি সাত বছর আগের। এখন–!

‘নিশ্চয়ই।’ বৃদ্ধ গলা তুললেন, ‘কার্তিক!’

কার্তিক হাজির হলে বললেন, ‘মাকে একবার এখানে আসতে বলবে?’

মাথা নেড়ে সে চলে যেতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘একটা প্রশ্ন। কাল রাত্রে এই গ্রামে ঢোকার পর লক্ষ করেছি সবাই যেন ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরুচ্ছেন। কোথাও কোনও আলো জ্বলছিল না। ব্যাপারটা কী?’

অরুণেশ্বরবাবু মাথা নাড়লেন, ‘মানুষ ভয় পেয়েছে।’

‘কীসের ভয়? ডাকাতের?’

‘না। রাজনৈতিক দলগুলো জঙ্গিভাব দেখানোর পর এ অঞ্চলে কেউ ডাকাতির কথা ভাবতে পারে না। বছর পাঁচেক আগে একরাত্রে আটজন ডাকাতকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল পার্টির ছেলেরা। তারপর থেকে ওই ভয় দূর হয়েছে।’ অরুণেশ্বরবাবু বললেন।

‘তাহলে?’

‘গত ছয় মাসে এই গ্রামে তিনটি বাইরের মানুষ মারা গিয়েছে। গুলি বা ছুরিতে মৃত্যু হয়নি, শরীরের কোথাও সামান্য ক্ষতচিহ্ন পাওয়া যায়নি। প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে রাত্রে। পুলিশ তদন্ত করে রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি। ফলে গুজব ছড়িয়েছে, গ্রামের রাস্তায় দুষ্ট আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে সন্ধের পরেই দরজা-জানলা বন্ধ করে দিচ্ছে সবাই। আজ সকালে কয়েকজন খোঁজ করতে এসেছিলেন, কাল রাত্রে সত্যি কোনও অতিথি এ-বাড়িতে এসেছে কি না এবং যদি আসে তাহলে বেঁচে আছে কি? দেখুন, এসব আমি বিশ্বাস করি না কিন্তু আমি গোয়েন্দা নই।’ অরুণেশ্বরবাবুর কথার মাঝখানেই তাকে দেখতে পেলাম। বাগানের ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে

আসছে। বিন্দুমাত্র সাজগোজ ছাড়াই সে চোখ টানছে। না, ছবির সঙ্গে তার খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে একটু শীর্ণ আর বেশি ফরসা মনে হচ্ছে। এত ফরসা যে রক্তে হেমোগ্লোবিন নিশ্চয়ই বেশ কমে গেছে।

‘ডেকেছেন?’ তার গলাটি বেশ মিষ্টি।

‘ও হ্যাঁ। বসো মা।’ বেঞ্চির একটা পাশ দেখিয়ে দিলেন অরুণেশ্বরবাবু। সে বসলে বৃদ্ধ বললেন, ‘ইনি আমাদের অতিথি। শহর থেকে এসেছেন।’

সে হাতজোড় করল, ‘নমস্কার।’

আমি নমস্কার জানালাম।

‘গত রাতে আপনার খেতে অসুবিধে হয়েছে বলে আমরা দুঃখিত।’ সে বলল।

‘ছি-ছি। দোষ তো আমারই। না জানিয়ে মাঝরাতে এসেছি। অবশ্য খেতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে

হয়নি।’ মাথা নাড়লাম।

অরুণেশ্বরবাবু বললেন, ‘আপনার আসার কথা ছিল বিকেলে। রাত্রে আসছেন জানলে নিষেধ করতাম। তেমন হলে স্টেশনেই রাত কাটাতে বলতাম।’

সে আমার দিকে তাকাল, ‘হ্যাঁ। কাল ভাগ্য আপনাকে সাহায্য করেছে।’

প্রতিবাদ করলাম, ‘এ কী বলছেন? অকারণে আমাকে কেউ খুন করবে কেন?

‘ঠিকই। কোনও যুক্তি নেই। থানার দারোগা যখন অনেক অনুসন্ধান করেও কিছু পেলেন না তখন উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন বাড়ির ভেতর থাকলে যখন বিপদ হচ্ছে না তখন রাত-বিরেতে বাইরে না গেলেই ভালো। যাক গে, আপনারা কথা বলুন, আমার কিছু কাজ আছে, সারি গিয়ে।’ কথাগুলো বলে উঠে গেলেন অরুণেশ্বরবাবু।

ওর দিকে তাকালাম। দেখলাম সে স্থির চোখে আমাকে দেখছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাকে কেন উনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন!’

‘জানি। আপনাদের চিঠিগুলো উনি আমাকে পড়িয়েছেন।’ সে নিচু গলায় বলল।

‘তাহলে আপনার আপত্তি নেই!

‘আমার কথা পরে। এখানে আসার পরে বাবা নিশ্চয়ই আপনাকে আমার সব কথা বলেছেন। চিঠিতে লিখলে কি আসতেন?

‘জানি না। তবে কৌতূহল নিশ্চয়ই হত। শ্বশুর পুত্রবধূকে নিজের মেয়ে বলে ভেবে নিয়ে আবার তাকে সংসারী করতে চাইছেন, এই ব্যাপারটা একটু অভিনব।’

‘আপনি আর কী জানতে চান?

সাধারণত বিধবা হওয়ার পর মেয়েরা বাপের বাড়িতে ফিরে যান। আপনি তো তার সঙ্গে একটি রাতও থাকেননি। আপনি এখানে রয়ে গেলেন কেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘প্রথম কথা, আমার কোনও বাপের বাড়ি ছিল না। থাকতাম মামার বাড়িতে। এখানে আমি। পিতৃস্নেহ পেলাম। আমার নিজের বাবার স্মৃতি ঝাঁপসা। বিয়ের আগে আমার সম্মান নিয়ে কেউ ভাবেনি, এখানে সেটা আমাকে দেওয়া হয়েছে।’ সে বলল।

‘আমার কথা আপনি চিঠিতে পড়েছেন, আজ দেখলেন। আমাকে কি আপনার গ্রহণীয় বলে মনে হচ্ছে।’ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম।

‘গ্রহণ তো করে পুরুষেরা, মেয়েদের সেটা মেনে নিতে হয়। দেখুন, বিয়ের বাসনা আমার চলে গেছে। কিন্তু বাবাকে সন্তুষ্ট করতে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’ সে বলল।

‘বুঝলাম। আপনাদের এখানে এক অদ্ভুত আতঙ্ক রাত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ খুন হচ্ছে অথচ কীভাবে এবং কে খুন করছে বোঝা যাচ্ছে না। আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?

সে হাসল, ‘দুটোই। বিশ্বাসও করি, অবিশ্বাসও। ঠিক ভগবানের বেলায় যা হয়ে থাকে।’

‘কিছু মনে করবেন না, কাল রাত্রে আপনি এ-বাড়ির ছাদে ছিলেন?’

‘কেন?’ তার চোখ ছোট হল।

‘কাল রাত্রে এ-বাড়ির কাছে এসে দেখলাম ছাদে সাদা কিছু হাঁটছে। হয়তো সাদা শাড়ি পরা মহিলা। আপনি কি কাল সাদা শাড়ি পরেছিলেন?’

‘না, সাদা শাড়ি পরতে নিষেধ করেছেন বাবা। কিন্তু কথাটা আপনি ওঁকে বলেছেন?

‘না।’

সে উঠে দাঁড়াল, ‘আমার মনে হয় দিনের আলো থাকতেই আপনার এখান থেকে চলে যাওয়া ভালো। ওঁকে বললে উনিও একই কথা বলবেন।’

‘কারণটা জানতে পারি?’

‘যাঁরা রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছেন তাঁরা নাকি মৃত্যুর আগের রাত্রে সাদা কিছুকে অন্ধকারে হাঁটতে দেখেছিলেন।’

সিরসির করল মেরুদণ্ড, সেটাকে থামাতে বললাম, ‘আপনার কি মনে হয় না এটা নেহাতই গপ্পো? কষ্টকল্পনা!’

‘যা ঘটেছে তাই বললাম।’

এই সময় অরুণেশ্বরবাবু ফিরে এলেন, ‘কি, কথাবার্তা হল?’

উঠে দাঁড়ালাম, ‘আলাপ হল।’

‘মা আমার বড় ভালো মেয়ে।’

‘বাবা, আমি এখন যেতে পারি?’ সে জিজ্ঞাসা করল।

‘এসো মা।’ অরুণেশ্বরবাবু মাথা নাড়তেই সে চলে গেল গাছপালার মধ্যে দিয়ে বাড়ির দিকে।

অরুণেশ্বরবাবু বললেন, ‘এখনই আপনাকে কিছু বলতে হবে না। ফিরে গিয়ে ভেবে-চিন্তে জানালেই হবে। যদি আপত্তি থাকে তাহলেও জানাবেন।’

‘ঠিক আছে, আমি তাহলে তৈরি হই?’

‘সে কী কথা! স্নান খাওয়া না সেরে যাবেন কেন? আপনি আমার অতিথি।’

‘ট্রেন পাব তো?’

‘স্বচ্ছন্দে। বিকেল তিনটের সময় জংশনের ট্রেন আছে। কার্তিক তুলে দিয়ে আসবে। তা এখান থেকে আড়াইটে নাগাদ বের হলেই চলবে। ওই কথা থাকল। আমি একটু বেরুব।’

আমি মাথা নাড়তে অরুণেশ্বরবাবু চলে গেলেন।

বাগানটি বেশ বড়। ফলের গাছ ছাড়াও শাক-সবজির চাষ হয়েছে। তাদের নধর চেহারায় চোখের আরাম হল। ঘুরে-ঘুরে দেখছিলাম। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে খুব। বাড়ির এক পাশে গিয়ে। পুকুরটাকে দেখলাম। মাছ আছে বলেই মনে হল। ফেরার পথে গাছটা চোখে পড়ল। তার ডালে ডালে পাকা ফল ঝুলছে। আঙুরের আকৃতি ডাবল হলে যা দেখাবে এই ফলগুলো সেইরকম।। টুকটুকে লাল হয়ে আছে। প্রচুর মৌমাছি ঘুরছে গাছটাকে ঘিরে, পাখিরা কিন্তু এই গাছে বসেনি। এই ফলের নাম জানি না। এই রকম গাছ কখনও দেখিনি। মৌমাছিরা যখন আকর্ষণ বোধ করছে তখন নিশ্চয়ই ফলটি মিষ্টি। বিষফলের গাছ কেউ বাগানে রাখবে কেন?

হাত বাড়িয়ে একটা পাকা ফল ছিঁড়ে সামান্য চাপ দিতেই রস গড়াল। জিভ ঠেকাতে বেশ মিষ্টি লাগল। ফলটা মুখে পুরলাম। মিষ্টি রসে মুখ ভরে গেল। তারপরেই সমস্ত শরীরে অদ্ভুত ঝিমঝিম ভাব ছড়িয়ে পড়ল। কোনওরকমে ফলটি বাইরে ফেলে দিতেই আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে। গেল। ঘাসের ওপর বসে পড়লাম আমি। এই বসাটাও টের পেলাম না। আমি তাকিয়ে আছি কিন্তু কিছুই দেখছিনা, চিৎকার করছি কিন্তু শব্দ বের হচ্ছে না এমনকি আমার কানেও কোনও শব্দ ঢুকছে না। অথচ আমার বোধশক্তি নষ্ট হয়নি। হাত-পা নাড়াতে পারছি না।

কতক্ষণ পরে জানি না, আমাকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল। কার্তিক আর একটি লোককে সঙ্গে নিয়ে আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে বাড়িতে নিয়ে এল। বিছানায় শুইয়ে দিল যত্ন করে। তারপরেই অরুণেশ্বরবাবু এলেন হন্তদন্ত হয়ে। ঘটনাগুলো যে ঘটছে তা আমি টের পাচ্ছি না, কিন্তু অনুমান করতে পারছি। চোখে দেখতে পাচ্ছি না চোখ খুলেও কিন্তু ভাবতে ভালো লাগছে।

পরে শুনেছি ডাক্তার এসেছিল। গ্রামের ডাক্তার। লোকটা ওষুধ খাইয়ে বমি করিয়েছিল অনেকটা। তারপরেই আমি মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

ঘুম ভাঙলে দেখলাম আমি মশারির ভেতর শুয়ে আছি। ঘরে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। আর মশারির বাইরে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। আমাকে চোখ ঘোরাতে দেখে মূর্তি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ব্যাপারটা ভালো করে বুঝবার আগেই আবার ঘুমে চোখ জুড়িয়ে গেল। কিছুতেই জেগে থাকতে পারছিলাম না।

শেষ পর্যন্ত আমি মশারির বাইরে চলে এলাম। দ্রুত বাইরে আসতেই সেই ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেলাম। ধীরে-ধীরে হাঁটছে। আমি নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করলাম। মূল বাড়ির ভেতর ঢুকে একটা সিঁড়ির ওপর পা রাখতেই কেউ একজন ওর সামনে এসে দাঁড়াল, ‘আজ আর ছাদে যেও না মা।’

‘আমাকে বাধা দেবেন না বাবা।’ তার কণ্ঠস্বর।

‘অতিথি অসুস্থ। কোনওরকমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। ওঁর পাশে একজনের থাকা দরকার।’ ‘ওখানে বসে থেকে আমি ওঁর কোনও উপকারে লাগব না। তাই না?’ সে চলে গেল।

অরুণেশ্বর বললেন, ‘কার্তিক খেয়াল রাখিস, ভালো ঘুম হলে ঠিক হয়ে যাবে।’

আশেপাশে কোথাও কার্তিককে দেখতে পেলাম না।

সিঁড়ি যখন জনশূন্য হল তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। সে ছাদে গিয়েছে, গত রাতেও নিশ্চয়ই গিয়েছিল। যেভাবে সে ছাদে গেল তা স্বাভাবিক নয়। মনে হচ্ছিল সেখানে যাওয়ার

জন্যে সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। হাওয়া বইছে বাগানে। শব্দ হচ্ছে। ধীরে-ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দরজায় চলে আসতেই তাকে দেখতে পেলাম। ছাদের ঠিক মাঝখানে বাবু হয়ে বসে আছে, কিন্তু মেরুদণ্ড টান-টান। মুখ আকাশের দিকে। শূন্য বিশাল ছাদে এইরকম ভঙ্গির একটি মূর্তিকে মোটেই লৌকিক বলে মনে হচ্ছিল না।

আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। সময় বয়ে যাচ্ছে। মিনিট পঁয়ত্রিশ পরে সে মুখ নামাল। তারপর দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। মাথার ওপর দিয়ে একটি নাম না জানা রাতপাখি চিৎকার করে উড়ে গেল। সে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ সে গোপন করার চেষ্টা করছে না।

এই সময় সিঁড়িতে জুতোর আওয়াজ পেয়ে আমি দ্রুত সরে গেলাম। কোণের দিকে ফেলে রাখা ড্রামের আড়ালে যেতে না যেতেই অরুণেশ্বরবাবুকে দেখতে পেলাম। বড়-বড় পা ফেলে ওর। কাছে গিয়ে বললেন, ‘কি হচ্ছে কী? অ্যাঁ? তুমি এভাবে কাঁদছ জানলে লোকটা তোমাকে বিয়ে করবে? ওর আগে তিনজনকে ভাগিয়েছ তুমি, এবার কথা দিয়েছিলে বাধ্য হয়ে।’

সে মাথা নাড়ল। ‘না, আমি পারব না, কিছুতেই পারব না।’

‘পারতে তোমাকে হবেই। আমি তো বেশিদিন বাঁচব না। তখন শেয়াল-কুকুর তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। আমার কর্তব্য আমি করে যেতে চাই। ওঠো, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

‘না। ওরা আসবে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ সে উঠে দাঁড়াল।

‘আঃ। ওসব তোমার মনের ভুল। কেউ কখনও আসে না। তুমি নিজের মনে কথা বলো। শোনো, এরকম করলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।’ অরুণেশ্বর থামলেন, একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘দশ মিনিটের মধ্যে তুমি ঘরে যাবে, এ আমার আদেশ।’ জুতোয় শব্দ তুলে অরুণেশ্বর নেমে গেলেন ছাদ থেকে।

সে দাঁড়িয়েছিল, একা। দূর থেকেই বুঝতে পারলাম সে কাঁপছে। অসহায় এক কিশোরীর মতো এখনই ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল। আমি দ্রুত তার কাছে গেলাম। সামনে দাঁড়াতেই সে তাকাল। ফিসফিস করে বলল, ‘আমি এখন কী করব!’

‘আপনি যেমন থাকতে চান তেমনই থাকুন।’ বললাম।

‘সত্যি?’ তার মুখে হাসি ফুটল। তার পরেই সে হাঁটতে শুরু করল। দ্রুতগতিতে ছাদের এপাশ থেকে ওপাশে হেঁটে চলল। লক্ষ করলাম হাঁটার সময় সে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে চলেছে। কী বলছে শোনার জন্যে আমি ছাদের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু সে যখন আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল তখন অস্পষ্ট উচ্চারণ বুঝতে পারলাম না।

আমার সামনে নির্জন রাতের গ্রাম। কোথাও কোনও আলো জ্বলছেনা। রাস্তা শুনশান। এই গ্রামে। তিনজন মানুষ খুন হয়েছেন কিন্তু তাদের মৃত্যুরহস্য আজও অন্ধকারে। এটা কী করে সম্ভব? হঠাৎ কানে এল, ‘শুনতে পাচ্ছ? তোমরা শুনতে পাচ্ছ? আমি যেমন আছি তেমন থাকব।’ বলতে-বলতে সে ছাদের মাঝখানে গিয়ে বাবু হয়ে বসে পড়ল। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলছিল সে? কোনও অশরীরীর অস্তিত্ব আমি বিশ্বাস করি না। ওর মন কি একা থাকতে-থাকতে নিজের জগৎ তৈরি করে নিয়েছে? ওর পাশে গিয়ে বসলাম।

‘আপনি খুব একা?’

সে তাকাল। মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’

‘আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে আমি খুশি হব।’ বললাম।

‘অ্যাঁ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি যে বললেন, যেমন আছি তেমনই থাকতে পারব।’

‘এরকম থাকলে আপনি মারা যাবেন।

‘আমি বাঁচতে চাই না।’ শব্দে কান্না জড়ানো।

‘কেন?’

হাঁটুতে মুখ রেখে সে কাঁদতে লাগল।

এই সময় অরুণেশ্বরবাবুর গলা কানে এল, ‘তুমি নিচে যাও।’

বলার ধরনে এমন কর্তৃত্ব ছিল যে সে এক মুহূর্ত দেরি করল না।

‘আপনি অসুস্থ, এখানে আসা আপনার উচিত হয়নি।’ ভদ্রলোক জানালেন।

‘যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে এসেছি তাকে জানতে চাওয়াটা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়।’

‘তাই? বেশ, আপনার সিদ্ধান্ত জানতে পারি?’

‘উনি কেন, কী কারণে ছাদে এসে এমন আচরণ করেন জানতে পারলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’

‘সেটা না জানলে–?’

‘আমার পক্ষে ওঁকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।’

‘বেশ। আপনাকে আর আটকাতে চাই না। ভোর-ভোর একটা ট্রেন জংশনে যায়। সেটা ধরতে রাত তিনটে নাগাদ আপনাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। তৈরি থাকবেন, কার্তিক আপনাকে জানিয়ে দেবে।’ কথাগুলো বলে তিনি নেমে গেলেন।

এখন আমি একা ছাদে দাঁড়িয়ে। হাওয়ারা শব্দ তুলছে। হঠাৎ সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটল। অরুণেশ্বরবাবু আর আমাকে আতিথ্য দিতে চান না। তাই রাত তিনটে নাগাদ এই বাড়ি থেকে আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে ট্রেন ধরতে। তখন চারপাশ অন্ধকার, রাস্তায় আরও একাকিত্ব। নেমে এলাম। তিনটে বাজতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। ঘুমটুম মাথায় উঠল। আমার কেবলই মনে। হচ্ছিল এই যাওয়াটা সুখের হবে না।

ঠিক তিনটের সময় দরজায় শব্দ হল, কার্তিক এসে দাঁড়াল। আমি তৈরি ছিলাম, ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটাও কথা না বলে কার্তিক আমাকে গেটের কাছে পৌঁছে দিল।

‘দাঁড়ান। আপনাকে এগিয়ে দেব আমি।’ অন্ধকার ছুঁড়ে সে বেরিয়ে এল।

‘আপনি!

‘হ্যাঁ, এই গ্রামে আর একটা খুন হোক আমি চাই না।’

‘আমাকে কে খুন করবে? আর যদি করে, তাহলে আপনি কী করতে পারেন।’

‘যারা খুন হয়েছিল তাদের সঙ্গে কোনও সঙ্গী ছিল না। চলুন।’

‘এ কী! আপনি যাবেন না, বড়বাবু খুব রাগ করবেন।’ কার্তিক প্রতিবাদ করল।

সে জবাব দিল না। পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি একা ফিরবেন কী করে? আপনার উচিত হয়নি আমার সঙ্গে আসা।’

‘এতদিন ধরে শুধু উচিত কাজগুলো মেনে চলেছি, আজ না হয়–।’

আমরা গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলেছি। চারপাশের বাড়ি নিঝুম। কেউ কোথাও জেগে আছে বলে মনে হচ্ছে না। গ্রামের প্রান্তে এসে থামলাম, ‘দেখলেন কেন কিছুই হল না। এবার আপনি ফিরে যেতে পারেন।’

সে মাথা নাড়ল, ‘না। আপনাকে কুলকুলির মাঠের পাশ দিয়ে যেতে হবে। চলুন।

সেই ঝাঁকড়া গাছ, জঙ্গুলে পরিবেশ যখন ছাড়াচ্ছি তখন অন্ধকার অনেক পাতলা। যে মোড়ে এসে সাইকেলওয়ালা আমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেখানে পৌঁছে বললাম, আর এগোতে হবে না। আমার জন্যে আপনি অনেক কষ্ট করলেন!’

সে কথা না বলে হেঁটে চলছিল।

আমি দাঁড়ালাম, ‘স্টেশন আর দূরে নেই। অনেকটা পথ আপনাকে ফিরতে হবে।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি ফিরব।’

‘সে কী!’

‘মন থেকে ভয়টাকে সরাতে পারছি না।’

‘আপনি অনর্থক ভয় পাচ্ছেন।’

‘না। যে তিনজন মারা গিয়েছে তারা আমাকে দেখতে এসেছিল। সমস্ত কথা জানার পর আপনার মতো রাজি না হয়ে ফিরে গিয়েছিল। প্রত্যেককেই গভীর রাতে বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। এবার আমি মরিয়া হলাম। আপনাকে আমি কিছুতেই এখানে মরতে দেব না।’ হাঁটতে হাঁটতে সে বলছিল।

‘কেন তাদের মরতে হয়েছিল? শুধু প্রত্যাখ্যান করার কারণে?’ আমি নার্ভাস।

‘কিছুটা। আর বাকিটা হল, তারা অনেক কিছু জেনে গিয়েছিল।’ সে বলল, ‘সেই জানাটা বাইরে প্রচারিত হোক তা কাম্য ছিল না।’

‘কার কাছে?’

‘আমি ঠিক জানি না। আমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই।’

আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। টিকিটঘর এই ভোরে বন্ধ। সূর্য এখনও ওঠেনি।

হেসে বললাম, ‘আর কোনও চিন্তা নেই। এখানে আপনার গ্রামের ছায়া পড়বে না।’

সে মাথা নাড়ল।

বললাম, ‘অরুণেশ্বরবাবু নিশ্চয়ই খুব রাগ করবেন আপনার ওপর।’

‘আমি পরোয়া করি না। কী করবে?বড়জোর খুন করবে।’

‘একথা বলছেন কেন? উনি তো আপনাকে সংসারী করতে চান!’

সে ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, বিধবা হওয়ার পর মামার বাড়িতে ফিরে গেলে ওঁরা ভালো মনে নিতেন না। ঠিক। কিন্তু আমি কি বেওয়ারিশ ছিলাম? মেয়ের মতো তিনি নিজের কাছে রেখে দিলেন সবার বাহবা পেতে অথচ প্রতি রাত্রে এসে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে গেছেন তিনি কত একা। কতদিন নারীসঙ্গ পাননি। রাতের পর রাত তাঁকে ঠেকিয়ে রেখেছি। আমাকে কত লোভ দেখিয়েছেন। পুত্রবধূকে বিয়ে করা যায় না কিন্তু দুজনের শরীরকে তো তৃপ্ত করা যায়! যখন কিছুতেই রাজি হলাম না, রাত নামতেই ছাদে চলে যাই তখন বললেন তোমার বিয়ে দেব। বিয়ের পর তুমি আমার বউমা থাকবে না। তখন তোমাকে ঋণশোধ করতে হবে। আমি মেনে নিলাম। কিন্তু তিন-তিনজন পাত্র যখন আমার চেহারা দেখে সম্মতি জানালেন তখন আমাকেই সত্যি কথাটা বলতে হল। শোনার পর প্রত্যেকেই সিদ্ধান্ত বদলেছিলেন।’

‘কেন?বিয়ে হয়ে গেলে তো আপনাকে ওই বাড়িতে থাকতে হত না?’

‘আসতে হত। কারণ ওটা তখন আমার বাপের বাড়ি হয়ে যেত আর উনি ঠিক আমাকে আসতে বাধ্য করতেন। আপনার ট্রেন আসছে। ট্রেনে উঠে টিকিট কাটবেন।’

‘এর পরে ফিরে গেলে কী হবে বুঝতে পারছেন?’ বললাম ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পারেন।’

সে মাথা নাড়ল, ‘অসম্ভব। আমি পারব না। ওই বাড়ি ছেড়ে আমি যেতে পারব না। মাত্র একটা রাত, পাশে অনেক মানুষ, তবু একটা রাত ধরে তাকে দেখেছিলাম। ও-বাড়ির ছাদে গেলেই। তাকে দেখতে পাই। হোক সেটা কল্পনায়, তবু পাই তো।’

ট্রেনের জানলায় বসে তাকে দেখলাম। সবে ওঠা রোদ গায়ে মেখে মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে। খেয়ালির দিকে। হঠাৎ মনে হল, অরুণেশ্বরবাবুর শত্রু কি তাঁর মৃত সন্তান?

যাকে এ জীবনে তিনি কখনই হারাতে পারবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress