রামেশ্বরবাবুর বাড়িতে
পরদিন বেলা ন’টার সময় রামেশ্বরবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম।
বাড়িটা সরু লম্বা গোছের; দ্বারের সামনে মোটর দাঁড়াইয়া আছে। আমরা বন্ধ দ্বারের কড়া নাড়িলাম।
অল্পক্ষণ পরে দ্বার খুললেন একটা মহিলা। তিনি বোধ হয়। অন্য কাহাকেও প্রত্যাশা করিয়াছিলেন, তাই আমাদের দেখিয়া তাঁহার কলহোদ্যত প্রখর দৃষ্টি নরম হইল; মাথায় একটু আচল টানিয়া দিয়া তিনি পাশ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, মুদুকণ্ঠে বলিলেন, ‘কাকে চান?’
রামেশ্বরবাবুর বাড়ির দু’টি স্ত্রীলোকের সহিত আলাপ না থাকিলেও তাঁহাদের দেখিয়াছি। ইনি কুশেখরের স্ত্রী; দৃঢ়গঠিত বেঁটে মজবুত চেহারা, বয়স আন্দাজ চল্লিশ। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী, রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
মহিলার চোয়ালের হাড় শক্ত হইল; তিনি বোধ করি দ্বার হইতেই আমাদের বিদায় বাণী শুনাইবার জন্য মুখ খুলিয়াছিলেন, এমন সময় সিঁড়িতে জুতার শব্দ শোনা গেল। মহিলাটি একবার চোখ তুলিয়া সিঁড়ির দিকে চাহিলেন, তারপর দ্বার হইতে অপসৃত হইয়া পিছনের একটি ঘরে প্রবেশ করিলেন। ঘরটি নিশ্চয় রান্নাঘর, কারণ সেখান হইতে হাতা-বেড়ির শব্দ আসিতেছে।
সিঁড়ি দিয়া দু’টি লোক নামিয়া আসিলেন; একজন কুশেখর, দ্বিতীয় ব্যক্তি বিলাতি বেশধারী প্রবীণ ডাক্তার। দ্বারের দিকে অগ্রসর হইতে হইতে ডাক্তার বলিলেন, ‘উপস্থিত ভয়ের কিছু দেখছি না। যদি দরকার মনে কর, ফোন কোরো।’
ডাক্তার মোটরে গিয়া উঠিলেন, মোটর চলিয়া গেল। আমরা দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছি, কুশেশ্বর এতক্ষণ তাহা লক্ষ্য করে নাই; এখন ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইল। তাহার টাক একটু বিস্তীর্ণ হইয়াছে অবশিষ্ট চুল আর একটু পাকিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমাদের বোধ হয় চিনতে পারছেন না, আমি ব্যোমকেশ বক্সী। আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
কুশেশ্বর বিহ্বল হইয়া বলিল, ‘ব্যোমকেশ বক্সী! ও-তা-হ্যাঁ, চিনেছি বৈকি। বাবার শরীর ভাল নয়—‘
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি হয়েছে?’ কুশেশ্বর বলিল, ‘কাল রাত্রে হঠাৎ হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। এখন সামলেছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন? তা-তিনি তেতলার ঘরে আছেন–’
এই সময় রান্নাঘরের দিক হইতে উচ্চ ঠকঠক শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। কড়া আওয়াজ; আমরা তিনজনেই সেইদিকে তাকাইলাম; রান্নাঘরের ভিতর হইতে একটি অদৃশ্য হস্ত কপাটের উপর সাঁড়াশি দিয়া আঘাত করিতেছে। কুশেখরের দিকে চাহিয়া দেখি তাহার মুখের ভাব বদলাইয়া গিয়াছে। সে কাশিয়া গলা সাফ করিয়া বলিল, ‘বাবার সঙ্গে তো দেখা হতে পারে না, তাঁর শরীর খুব খারাপ-ডাক্তার এসেছিলেন–’
ওদিকে ঠকঠক শব্দ তখন থামিয়াছে। ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল, ‘বুঝেছি। ডাক্তারবাবুর নাম কি?’
কুশেশ্বর আবার উৎসাহিত হইয়া বলিল, ‘ডাক্তার অসীম সেন। চেনেন না? মস্ত হার্ট স্পেশালিস্ট।’
‘চিনি না, কিন্তু নাম জানি। বিবেকানন্দ রোডে ডিসপেন্সারি।’
‘হ্যাঁ’
‘তাহলে রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে দেখা হবে না?’
‘মানে-ডাক্তারের হুকুম নেই–কুশেশ্বর একবার আড়চোখে রান্নাঘরের পানে তাকাইল।
‘কত দিন থেকে ওঁর শরীর খারাপ যাচ্ছে?’
শরীর তো একরকম ভালই ছিল; তবে অনেক বয়স হয়েছে, বেশি নড়াচড়া করতে পারেন। না, নিজের ঘরেই থাকেন। কাল সকালে অনেকগুলো চিঠি লিখলেন, তারপর রাত্তিরে হঠাৎ–’
রান্নাঘরের দ্বারে অধীর সাঁড়াশির শব্দ হইল; কুশেশ্বর অর্ধপথে থামিয়া গেল। . ব্যোমকেশ বলিল, টরে-টক্কা! আপনার স্ত্রী বোধ হয় রাগ করছেন। — চললাম, নমস্কার।’
ফুটপাথে নামিয়া পিছন ফিরিয়া দেখি সদর দরজা বন্ধ হইয়া-গিয়াছে।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বিমানাভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, ‘ডাক্তার অসীম সেনের ডিসপেন্সারি বেশি দূর নয়। চল, তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাই।’
ভাগ্যক্রমে ডাক্তার সেন ডিসপেন্সারিতে ছিলেন, তিন-চারটি রোগীও ছিল। ব্যোমকেশ চিরকুট নাম লিখিয়া পঠাইয়া দিল। ডাক্তার সেন বলিয়া পাঠাইলেন-একটু অপেক্ষা করিতে হইবে।
আধা ঘণ্টা পরে রোগীদের বিদায় করিয়া ডাক্তার সেন আমাদের ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমরা তাঁহার খাস কামরায় উপনীত হইলাম। ডাক্তারি যন্ত্রপাতি দিয়া সাজানো বড় ঘরের মাঝখানে বড় একটি টেবিলের সামনে ডাক্তার বসিয়া আছেন, ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আপনিই ব্যোমকেশবাবু? আজ রামেশ্বরবাবুর বাড়ির সদরে আপনাদের দেখেছি না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। আমরা কিন্তু হৃদযন্ত্র পরীক্ষা করাবার জন্য আসিনি, অন্য একটু কাজ আছে। আমার পরিচয়—‘
ডাক্তার সেন হাসিয়া বলিলেন, ‘পরিচয় দিতে হবে না। বসুন। কি দরকার বলুন।’
আমরা ডাক্তার সেনের মুখোমুখি বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। কাল তাঁর নববর্ষের শুভেচ্ছাপত্র পেলাম, তাতে তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। এমনি একটা সংশয় জানিয়েছিলেন; তাই আজ সকালে তাঁকে দেখতে এসেছিলাম। এসে শুনলাম, রাত্রে তাঁর হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পেলাম না, তাই আপনার কাছে এসেছি তাঁর খবর জানতে। আপনি কি রামেশ্বরবাবুর ফ্যামিলি ডাক্তার?’
ডাক্তার সেন বলিলেন, ‘পারিবারিক বন্ধু বলতে পারেন। ত্ৰিশ বছর ধরে আমি ওঁকে দেখছি। ওঁর হৃদযন্ত্র সবল নয়, বয়সও হয়েছে প্রচুর। মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প কষ্ট পাচ্ছিলেন; তারপর কাল হঠাৎ গুরুতর রকমের কন্নড়াবাড়ি হল। যাহোক, এখন সামলে গেছেন।’
‘উপস্থিত তাহলে মৃত্যুর আশঙ্কা নেই?’
‘তা বলতে পারি না। এ ধরনের রুগীর কথা কিছুই বলা যায় না; দু’ বছর বেঁচে থাকতে পারেন, আবার আজই দ্বিতীয় অ্যাটাক হতে পারে। তখন বাঁচা শক্ত।’
‘ডাক্তারবাবু্, আপনার কি মনে হয় রামেশ্বরবাবুর যথারীতি সেবা-শুশ্রূষা হচ্ছে?’
ডাক্তার কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, শেষে ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘আপনি যা ইঙ্গিত করছেন তা আমি বুঝেছি। এরকম ইঙ্গিতের সঙ্গত কারণ আছে কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি রামেশ্বরবাবুকেই চিনি, ওঁর পরিবারের অন্য কাউকে সেভাবে চিনি না। কিন্তু আজ দেখেশুনে আমার সন্দেহ হল, ওঁরা বাইরের লোককে রামেশ্বরবাবুর কাছে ঘেষতে দিতে চান না।’
ডাক্তার বলিলেন, ‘তা ঠিক। আপনি রামেশ্বরবাবুর ফ্যামিলিকে ভালভাবে চেনেন না। কিন্তু আমি চিনি। আশ্চর্য ফ্যামিলি। কারুর মাথার ঠিক নেই। রামেশ্বরবাবুর স্ত্রী কুমুদিনীর বয়স ষাট, অথর্ব মোটা হয়ে পড়েছেন; কিন্তু এখনো পুতুল নিয়ে খেলা করেন, সংসারের কিছু দেখেন না। কুশেশ্বরটা ক্যাবলা, স্ত্রীর কথায় ওঠেবসে। একমাত্র কুশেখরের স্ত্রী লাবণ্যর ইশ-পর্ব আছে, কাজেই অবস্থগতিকে সে সংসারের কর্ণধার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘কিন্তু বাড়িতে চাকর-বামুন নেই কেন?’
‘লাবণ্য চাকর-বাকর সহ্য করতে পারে না, তাই সবাইকে তাড়িয়েছে। নিজে রাঁধতে পারে না, শুধু এটা হাবা কালা বামনী রেখেছে বাকি সব কাজ নিজে করে। কুশেশ্বরকে বাজারে পাঠায়।‘
‘কিন্তু কেন? এসবের একটা মানে থাকা চাই তো।’
ডাক্তার চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, এসবের মূলে আছে নলিনী।’
‘নলিনী। রামেশ্বরবাবুর মেয়ে?’
‘হ্যাঁ। অনেক দিনের কথা, আপনি হয়তো শোনেননি। নলিনী বাড়ির সকলের মতের বিরুদ্ধে এক ছোকরাকে বিয়ে করেছিল, সেই থেকে তার ওপর সকলের আক্ৰোশ। সবচেয়ে বেশি। আক্রোশ লাবণ্যর। রামেশ্বরবাবু প্রথমটা খুবই চটেছিলেন, কিন্তু ক্রমে তাঁর রাগ পড়ে গেল। লাবণ্যর কিন্তু রাগ পড়ল না। সে নলিনীকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে চায় না, বাপের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। পাছে রামেশ্বরবাবু চাকর-ব্যাকরকে দিয়ে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাই তাদের সরিয়েছে। রামেশ্বরবাবু বলতে গেলে নিজের বাড়িতে নজরবন্দী হয়ে আছেন, কিন্তু তাঁর সেবাশুশ্রূষার কোন ক্রুটি হয় না।’
ব্যোমকেশ ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল, ‘হঁ, পরিস্থিতি কতকটা বুঝতে পারছি। আচ্ছা, রামেশ্বরবাবু উইল করেছেন। কিনা। আপনি বলতে পারেন?’
ডাক্তার সেন সচকিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, ‘করেছেন। আমার বিশ্বাস তিনি উইল করে নলিনীকে সম্পত্তির অংশ দিয়ে গেছেন। আমি জানতাম না, কাল রাত্রে জানতে পেরেছি।’
‘কি রকম?’
‘কাল রাত্রি দশটার সময় রামেশ্বরবাবুর হার্ট-অ্যাটাক হয়; আমাকে ফোন করল, আমি গেলাম। ঘন্টাখানেক পরে রামেশ্বরবাবু সামলে উঠলেন। তখন আমি সকলকে খেতে পাঠিয়ে দিলাম। রামেশ্বরবাবু চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকালেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘ডাক্তার, আমি উইল করেছি। যদি পটল তুলি, নলিনীকে খবর দিও।’ এই সময়ে লাবণ্য আবার ঘরে ঢুকাল আর কোন কথা হল না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘স্পষ্টই বোঝা যায় ওরা রামেশ্বরবাবুকে উইল করতে দিচ্ছে না, পাছে তিনি নলিনীকে সম্পত্তির অংশ লিখে দেন। উনি যদি উইল না করে মারা যান তাহলে সাধারণ সুরক্সিকু নিয়মে ছেলে আর শ্ৰী সম্পত্তি পোব, মেয়ে কিছুই পাবে না—ব্রামেশ্বরবাবুরর বাঁধা উকিল কে?’
ডাক্তার সেন বলিলেন, ‘বাঁধা উকিল কেউ আছে বলে তো শুনিনি।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল, ‘আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। ভাল কথা, নলিনীর সাংসারিক অবস্থা কেমন?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘নেহাত ছা-পোষা গোরস্ত। ওর স্বামী দেবনাথ সামান্য চাকরি করে, তিন-চারশো টাকা মাইনে পায়। কিন্তু অনেকগুলি ছেলেপুলে–’
অতঃপর আমরা ডাক্তার সেনকে নমস্কার জানাইয়া চলিয়া আসিলাম। রামেশ্বরবাবুর পারিবারিক জীবনের চিত্রটা আরও পূণাঙ্গ হইল বটে, কিন্তু আনন্দদায়ক হইল না। বৃদ্ধ হাস্যরসিক, অন্তিমকালে সত্যই বিপাকে পড়িয়াছেন, অথচ তাঁহাকে সাহায্য করিবার উপায় নাই। ঘরের টেকি যদি কুমীর হয়, সে কি করিতে পারে?