রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে ব্যোমকেশের পরিচয়
রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে ব্যোমকেশের পরিচয় প্রায় পনেরো বছরের। কিন্তু এই পনেরো বছরের মধ্যে তাঁহাকে পনেরো বার দেখিয়াছি কিনা সন্দেহ। শেষের পাঁচ-ছয় বছর একেবারেই দেখি নাই। কিন্তু তিনি যে আমাদের ভোলেন নাই তাহার প্রমাণ বছরে দুইবার পাইতাম। প্রতি বৎসর পয়লা বৈশাখ ও বিজয়ার দিন তিনি ব্যোমকেশকে নিয়মিত পত্ৰাঘাত করিতেন।
রামেশ্বরবাবু বড়মানুষ ছিলেন। কলিকাতায় তাঁহার আট-দশখানা বাড়ি ছিল, তাছাড়া নগদ টাকাও ছিল অপব্যাপ্ত; বাড়িগুলির ভাড়া হইতে যে আয় হইত। তাহার অধিকাংশই জমা হইত। সংসারে তাঁহার আপনার জন ছিল দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কুমুদিনী, প্রথম পক্ষের পুত্র কুশেশ্বর ও কন্যা নলিনী। সবোপরি ছিল তাঁহার অফুরন্ত হাস্যরসের প্রবাহ।
রামেশ্বরবাবু হাস্যরসিক ছিলেন। তিনি যেমন প্ৰাণ খুলিয়া হাসিতে পারিতেন তেমনি হাসাইতেও পারিতেন। আমি জীবনব্যাপী বহুদর্শনের ফলে একটি প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করিয়াছিলাম যে, যাহাদের প্রাণে হাস্যরস আছে তাহারা কখনও বড়লোক হইতে পারে না, মা লক্ষ্মী কেবল প্যাঁচাদেরই ভালোবাসেন। রামেশ্বরবাবু আমার আবিষ্কৃত এই নিয়মটিকে ধূলিসাৎ করিয়া দিয়াছিলেন। অন্তত নিয়মটি যে সার্বজনীন নয় তাহা অনুভব করিয়াছিলাম।
রামেশ্বরবাবুর আর একটি মহৎ গুণ ছিল, তিনি একবার যাহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইতেন তাহাকে কখনও মন হইতে সরাইয়া দিতেন না। ব্যোমকেশের সহিত তাঁহার পরিচয় ঘটিয়াছিল তাঁহার বাড়িতে চৌর্য ঘটিত সামান্য একটি ব্যাপার লইয়া। ব্যাপারটি কৌতুকপ্রদ প্রহসনে সমাপ্ত হইয়াছিল, কিন্তু তদবধি তিনি ব্যোমকেশকে সস্নেহে স্মরণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। কয়েকবার তাঁহার গৃহে নিমন্ত্রণও খাইয়াছি। তিনি আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন, শেষ বরাবর তাঁহার শরীর ভাঙিয়া পড়িয়াছিল; কিন্তু হাস্যরস যে তিলমাত্র প্রশমিত হয় নাই তাহা তাঁহার ষান্মাসিক পত্র হইতে জানিতে পারিতাম।
আজ রামেশ্বরবাবুর অন্তিম রসিকতার কাহিনী লিপিবদ্ধ করিতেছি। ঘটনাটি ঘটিয়াছিল। কয়েক বছর আগে; তখন আইন করিয়া পিতৃ-সম্পত্তিতে কন্যার সমান অধিকার স্বীকৃত হয় নাই।
সেবার পয়লা বৈশাখ অপরাহ্রের ডাকে রামেশ্বরবাবুর চিঠি আসিল। পুরু অ্যান্টিক কাগজের খাম, পরিচ্ছন্ন অক্ষরে নাম-ধাম লেখা; খামটি হাতে লইতেই ব্যোমকেশের মুখে হাসি ফুটিল। লক্ষ্য করিয়াছি রামেশ্বরবাবুকে মনে পড়িলেই মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়া ওঠে। ব্যোমকেশ সস্নেহে খামটি নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘অজিত, রামেশ্বরবাবুর বয়স কত আন্দাজ করতে পারো?’
বলিলাম, নবাবুই হবে।’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘অত না হলেও আশি নিশ্চয়। এখনো কিন্তু ভীমরতি ধরেনি। হাতের লেখাও বেশ স্পষ্ট আছে।’
সন্তৰ্পণে খাম কাটিয়া সে চিঠি বাহির করিল। দু-ভাঁজ করা তকতকে দামী কাগজ, মাথায় মনোগ্রাম ছাপা। গোটা গোটা অক্ষরে জরার চিহ্ন নাই। রামেশ্বরবাবু লিখিয়াছেন–
বুদ্ধিসাগরেষু্,
ব্যোমকেশবাবু্, আপনি ও অজিতবাবু আমার নববর্ষের শুভেচ্ছা গ্রহণ করিবেন। আপনার বুদ্ধি দিনে দিনে শশিকলার ন্যায় পরিবর্ধিত হোক; অজিতবাবুর লেখনী ময়ুরপুচ্ছে পরিণত হোক!
আমি এবার চলিলাম। যমরাজের সমান আসিয়াছে, শীঘ্রই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসিবে। কিন্তু ‘থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়?’ যমদূতেরা আমাকে ধরিবার পূর্বেই আমি বৈকুণ্ঠে গিয়া পৌঁছিব।। কেবল এই দুঃখ আগামী বিজয়ার দিন আপনাদের স্নেহাশিস জানাইতে পারিব না।
মৃত্যুর পূর্বে বিষয়-সম্পত্তির ব্যবস্থা করিয়াছি। আপনি দেখিবেন, আমার শেষ ইচ্ছা যেন পূর্ণ হয়। আপনার বুদ্ধির উপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে।
বিদায়। আমার এই চিঠিখানির প্রতি অবজ্ঞা দেখাইবেন না। আপনি পাঁচ হাজার টাকা পাইলেন। কিনা তাহা আমি বৈকুণ্ঠ হইতে লক্ষ্য করিব।
পুনরাগমনায় চ।
শ্রীরামেশ্বর রায়
চিঠি পড়িয়া ব্যোমকেশ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বসিয়া রহিল। আমিও চিঠি পড়িলাম। নিজের মৃত্যু লইয়া পরিহাস হয়তো তাঁহার চরিত্রানুগ, কিন্তু চিঠির শেষের দিকে যে-সকল কথা লিখিয়াছেন, তাহার অর্থবোধ হইল না। …আমার শেষ ইচ্ছা যেন পূর্ণ হয়.কোন ইচ্ছা? আমরা তো তাঁহার কোনও শেষ ইচ্ছার কথা জানি না, চিঠিতে কিছু লেখা নাই। তারপর-পাঁচ হাজার টাকা পাইলেন কিনা…কোন্ পাঁচ হাজার টাকা? ইহা কি রামেশ্বরবাবুর নূতন ধরনের রসিকতা, কিংবা এতদিনে সত্যই তাঁহার ভীমরতি ধরিয়াছে।
ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল, ‘চল, কাল সকালে রামেশ্বরবাবুকে দেখে আসা যাক। কোনদিন আছেন কোনদিন নেই।’
বলিলাম, ‘বেশ, চল। চিঠি পড়ে তোমীর কি মনে হয় না যে, রামেশ্বরবাবুর ভীমরতি ধরেছে?’
ব্যোমকেশ খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘পিতামহ ভীষ্মের কি ভীমরতি ধরেছিল?’
সম্প্রতি ব্যোমকেশ রামায়ণ মহাভারত পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, হাতে কাজ না থাকিলেই মহাকাব্য লইয়া বসে। ইহা তাহার বয়সোচিত ধৰ্মভাব অথবা কাব্য সাহিত্যের মূল অনুসন্ধানের চেষ্টা বলিতে পারি না। অন্য মতলবও থাকিতে পারে। তবে মাঝে মাঝে তাহার কথাবাতায় রামায়ণ মহাভারতের গন্ধ পাওয়া যায়।
বলিলাম, ‘রামেশ্বরবাবু কি পিতামহ ভীষ্ম?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খানিকটা সাদৃশ্য আছে। কিন্তু রামায়ণের দশরথের সঙ্গেই সাদৃশ্য বেশি।’
বলিলাম, ‘দশরথের তো ভীমরতি ধরেছিল।’
সে বলিল, ‘হয়তো ধরেছিল। সেটা বয়সের দোষে নয়, স্বভাবের দোষে। কিন্তু রামেশ্বরবাবু যদি একশো বছর বেঁচে থাকেন ওঁর ভীমরতি ধরবে না।’
রামেশ্বরবাবুর পরিবারিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অতি সংক্ষিপ্ত। কলিকাতার উত্তরাংশে নিজের একটি বাড়িতে থাকেন। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কুমুদিনীর বয়স এখন বোধ করি পঞ্চাশোর্ধে্্, তিনি নিঃসন্তান। প্রথম পক্ষের পুত্রের নাম সম্ভবত রামেশ্বরবাবু নিজের নামের সহিত মিলাইয়া কুশেশ্বর রাখিয়াছিলেন। কুশেখরের বয়সও পঞ্চাশের কম নয়, মাথার কিয়দংশে পাকা চুল, কিয়দংশে টাকা। সে বিবাহিত, কিন্তু সন্তান-সন্ততি আছে কিনা বলিতে পারি না। তাহাকে দেখিলে মেরুদণ্ডহীন অসহায় গোছের মানুষ বলিয়া মনে হয়। তাহার কনিষ্ঠ ভগিনী নলিনী শুনিয়াছি প্রেমে পড়িয়া একজনকে বিবাহ করিয়াছিল, তাহার সহিত রামেশ্বরবাবুর কোনও সম্পর্ক নাই। মোট কথা তাঁহার পরিবার খুব বড় নয়, সুতরাং অশান্তির অবকাশ কম। তাঁহার অগাধ টাকা, প্ৰাণে অফুরন্তু হাস্যরস। তবু সন্দেহ হয় তাঁহার পারিবারিক জীবন সুখের নয়।