কম্পিটিশন
১১.
“কম্পিটিটরস ফর দ্য লেডিজ হান্ড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট, প্লিজ কাম টু দিয়ার স্টার্টিং ব্লকস্।”
জুপিটার সুইমিং ক্লাবের কম্পিটিশন প্রতিবছরই এই রকম জাঁকালোভাবে হয়। কমলদিঘির অর্ধাংশের চারটে গেট বন্ধ করে, জুপিটারের অংশটুকু টিন দিয়ে ঘেরা হয়েছে। কাঠের গ্যালারি তৈরী করা হয় দিঘির তিন-চতুর্থাংশ ঘিরে। সাঁতার শুরু হয় যেদিকের প্লাটফর্ম থেকে, তার পিছনে তিন সারি বিশিষ্ট অতিথিদের চেয়ার এবং তার পিছনেও গ্যালারি। প্ল্যাটফর্মের একধারে টেবিল। সেখানে মাইক্রোফোন নিয়ে ঘোষক আর জনা পাঁচেক টাইম রেকর্ডার। বুকে ব্যাজ ঝুলিয়ে, কয়েকটা স্যভেনির হাতে ধীরেন ঘোষ বিশিষ্ট অতিথিদের তদারকিতে ব্যত। কম্পিটিশনের চিফ রেফারি হরিচরণ।
ভিড়ে আজ ফেটে পড়ছে কমলদিঘি। গ্যালারি ভেঙ্গে কয়েকজন মাটিতে পড়েছে, একজনের হাত ভেঙ্গেছে। রেলিংয়ের ভিতরে পাড় ঘিরে লোক দাঁড়িয়ে। দুটি ছেলে ভিড়ের ধাক্কায় জলে পড়েছিল। অবশ্য তারা সাঁতার জানে। ডাইভিং বোর্ডে উঠেছে বহু ছেলে। জুপিটারের এলাকা যেখানে শেষ হয়েছে অর্থাৎ টিনের বেড়ার পরেই অ্যাপোলোর এলাকায়, রেলিং ঘিরে হাজার দুয়েক মানুষ। তারা দূর থেকেই প্রতিযোগিতা দেখবে।
প্রতিযোগিতার আজ শেষ দিন। দুপুর আড়াইটে থেকে শুরু হয়েছে। ছেলেদের এবং ছোট মেয়েদের তিনটি বিষয়ের ফাইনাল হয়ে যাবার পর ঘোষণা শোনা গেল : “কম্পিটিটরস ফর দ্য লেডিজ হান্ড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট, প্লিজ।… উইল কপিটিটরস কাম টু দিয়ার পোজিশনস। দিস ইজ সেকেন্ড কল…”
কমলদিঘির অ্যাপোলোর অংশে এতক্ষণ একজন, পাড়ের কাছে মন্থরভাবে সাঁতার কাটছিল। অ্যাপোলোর স্টাটিং প্ল্যাটফর্মটা জুপিটারেরই পাশ মিটার পাশে। সেখানে চপচাপ বসে চোখে পর, কাঁচের চশমা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল একটি লোক! কেউ তাকে লক্ষ করছে না। আজ কমলদিঘির আনাচে-কানাচে সর্বত্রই লোক, সকলের চোখ জুপিটারের এলাকার দিকে।
ঘোষণা শেষ হতেই ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল।
“কোনি?” শান্ত নরম গলায় সে ডাকল। জল থেকে কোন প্ল্যাটফর্মে উঠে এল। রেলিংয়ের ভীড়ের চোখ এদিকে ফিরল।
জুপিটারের প্ল্যাটফর্মে সাঁতারুরা এসে দাঁড়িয়েছে। অমিয়াকে দেখা গেল হেসে কথা বলছে অতিথিদের মধ্যে বসা এক বৃদ্ধার সঙ্গে। অত্যন্ত ঢিলেঢালা নিশ্চিন্ত ভঙ্গি। বেলা জলে নেমে মিনিট দুয়েক হাত ছুঁড়ে উঠে এল। এখন ভোয়ালে দিয়ে জল মোছায় ব্যস্ত। অন্য ছয়টি মেয়ে কিঞ্চিৎ নাভাস। তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেস্টা করেই মুখে শুকিয়ে ফেলেছে।
হরিচরণ উত্তেজিতভাবে ধীরেন ঘোষের কানে ফিসফিসিয়ে কি বলল। ধীরেন ঘাড় ফিরিয়ে অ্যাপোলোর প্ল্যাটফমের দিকে তাকাল। সেটা লক্ষ করে অমিয়াও তাকাল। পাঁচ নম্বর ব্লকের পিছনে দাঁড়ানো কালো কস্ট্যুম পরা মেয়েটিকে চিনতে তার অসুবিধা হল না। কোনির পাশে ঘড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ। সারা কমলদিঘি হঠাৎ যেন বুঝতে পেরেছে, এবার একটা কিছু ব্যাপার হতে চলেছে। চোখ গুলো অ্যাপোলোর দিকে নিবন্ধ হচ্ছে।
হরিচরণ কিছু একটা অমিয়াকে বলতেই অমিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল। অ্যাপোলো ক্লাবের বারান্দা থেকে বিষ্টু ধরের চীৎকার ভেসে এল : “ডাউন দিতেই হবে, কোনি।”
“অন দ্য বোর্ড।” স্টার্টারের চীৎকার শোনা গেল। এয়ার রাইফেলের নলটা আকাশমুখো তোলা। জুপিটারের বুকের উপর আটটি মেয়ে উঠল। অ্যাপোলোর পাঁচ নম্বর ব্লকে উঠেছে কোনি। সারা কমলদিঘি ঘিরে ভেসে উঠল মর্মর শব্দ।
ওরা ব্লকের কিনারে পায়ের আঙুলগুলো আঁকড়ে রেখে হাঁট, ভেঙ্গে, কাঁধ ঝুঁকিয়েছে। দু’হাত পাখির ডানার মতো পিছনে–যেন এখনি উড়বে।
“গেট…সেট…”
অমিয় ও কোনি ছাড়া বাকি মেয়েরা ঝপঝপ জলে পড়ল। এয়ার রাইফেলের ক্যাপ ফোটেনি। কমলদিঘি ঘিরে বিদ্রূপ ও আক্ষেপ এক চক্কর ঘরে গেল। অমিয়া আড়চোখে কোনির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল।
নতুন ক্যাপ লাগানো হয়েছে।
“অন দ্য বোর্ড।”
মেয়েরা আবার ব্লকের উপর উঠল।
“গেট…সেট…।”
এয়ার রাইফেলে ‘ফাটাশ’ শব্দ হল।
এক সঙ্গে নয়টি মেয়ে জলে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কমলদিঘির উপর গড়িয়ে পড়ল চাপা একটা গজন। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়েছে ফুটবল মাঠের মতো। তাদের চোখ ডাইনে-বামে ৫০ মিটার যাতায়াত করছে আগয়ান দুটি সাঁতারকে লক্ষ করতে করতে।
তিরিশ মিটার পর্যন্ত কোনি আর অমিয়া সমান রেখায়। বাকিরা ৭/৮ মিটার পিছনে। এরপর অমিয় একটু একটু করে এগোতে শুরু করল।
“কোও-ও-নিই।” অ্যাপোলোর দিকে ভীড়ের মধ্যে থেকে কে চীৎকার করে উঠল। “কোও-ও-নিইই।”
“গো, অমিয়া গো।” জুপিটার থেকে চীৎকার শোনা গেল।
ক্ষিতীশ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে কোনির দিকে তাকিয়ে। মুখে ভাবান্তর নেই।
অমিয়া দু’হাত এগিয়ে গেছে। বেলা তার পিছনে প্রায় আট মিটার দূরত্বটা সমানে রেখে চলেছে। বাকিদের দিকে কেউ তাকাচ্ছেই না।
অমিয় সবার আগে ৫০ মিটার বোর্ড ছুঁয়েছে। ঘুরে গিয়ে সে কোনিকে অতিক্রম করার সময় একবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কোনি যেন থমকে গেল। তারপরই বোর্ড ছুঁয়ে ঘরেই টর্পেডোর মতো ছিটকে এল।
রোগতপ্ত মানুষের মতো কমলদিঘি ভুল বকতে শুরু করেছে।
“কোও-ও-নিই।”
“এটা ছেলে না মেয়ে, মশাই!”
“মেয়ে মেয়ে, আমাদের ক্লাবের মেয়ে–কোনি।”
“পারবে না। এক বডি পেছনে পড়ে গেছে। কেন যে ক্ষিদ্দা এমন হাস্যকর, ব্যাপার করলো।”
৬০ মিটার। অমিয়া এগিয়ে চলেছে। ৬৫ মিটার। কোনি উঠছে।
৭০ মিটার। কোনি সমান রেখায় অমিয়ার সঙ্গে। নিঃশ্বাস নেবার জন্য অমিয়া ঘনঘন হাঁ করছে। পায়ের পাড়ি এলোমেলো হয়ে এসেছে। হাত দুটো উঠছে-পড়ছে যেন নিয়ম রক্ষার জন্য। জলের গভীরে ডুবিয়ে টেনে কোমরের পিছন পর্যন্ত আনার জোরটকু আর নেই। অমিয়া নিভে আসছে।
“কাম অন অমিয়া, কাম অন বেঙ্গল চ্যামপিয়ন।”
“ফাইট কোনি, ফাইট।”
হঠাৎ কমলদিঘি ঘিরে বিরাট একটা চীৎকার হাউইয়ের মতো আকাশে উঠল। কোনি পিছনে ফেলেছে অমিয়াকে। ওর ছিপছিপে শরীরটার মধ্যে দিনে দিনে সঞ্চিত যন্ত্রণায় ঠাসা শক্তির ভাণ্ডারটিতে যেন বিস্ফোরণ ঘটল। ছন্দোবদ্ধ ওঠা-নামা করে চলেছে দুটি হাত, তার সঙ্গে তাল রেখে চলেছে পা দুটি; ওর দুপাশে ইংরাজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো ঢেউয়ের রেখা ছড়িয়ে পড়ছে। পায়ের আঘাতে বিরাম হীন স্ফীত জলতরঙ্গ ওকে অনুসরণ করছে।
মসৃণ, স্বচ্ছন্দ কিন্তু হিংস্র ভঙ্গিতে কোনি নিজেকে টেনে বার করে নিয়ে গেল। ফিনিশিং বোর্ডে হাত লাগিয়েই সে উদ্বিগ্ন ব্যগ্র চোখে পাশে মুখ ফেরাল। তখনো অমিয় পৌঁছয়নি। ‘উইইই’ শব্দে তীক্ষ্ণ চীৎকার করে কোনি চিত হয়ে বোর্ডে পায়ের ধাক্কা দিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল আনন্দে।
“তিন বডি, ক্লিয়ার তিন বডিতে মেরেছে।”
“কোওন্নি…কেওওন্নি।” ভীড়ের মধ্যে তিনটি ছেলে তালে তালে সার করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কোনি হাত নাড়ল তাদের উদ্দেশে।
“কি রকম ডাউন খাওয়াল দেখলে! জুপিটার থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, এরই শোধ নিল।”
“অনেকদিন এমন মজা পাইনি কিন্তু!”
হঠাৎ সব আলোচনা, উত্তেজনা থমকে গিয়ে এবার দ্বিগুণ জোরে হৈ হৈ চিৎকার উঠল। হাততালি পড়ছে, শিস উঠছে একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে। অ্যাপোলোর স্টাটিং প্ল্যাটফর্মে এতক্ষণ ধরে প্রস্তরবৎ, ভাবলেশহীন ক্ষিতীশ এখন তিড়িং তিড়িং লাফাচ্ছে।
“কোথায় হরিচরণ, মুখখানা একবার দেখা।” লাফাতে লাফাতে ক্ষিতীশ চীৎকার করে চলল। “ওলিম্পিকের গুল মেরে কি আর সুইমার তৈরী করা যায় রে পাঁটা? বুদ্ধি চাই, খাটনি চাই, নিষ্ঠা চাই…গবেট গবেট সব।”
ব্যস্ত হয়ে প্ল্যাটফর্মের উপর ভেলো উঠে এসে ক্ষিতীশকে জড়িয়ে ধরল। “হচ্ছে কি ক্ষিদ্দা, এত লোকের সামনে, তোমার কি মাথাটা বিগড়ে গেল নাকি? চলো চলো, ক্লাবে চলো। বিষ্টু ধর ওদিকে একসাইটমেন্টে সেন্সলেশ হয়ে পড়েছিল। অ্যাই কোনি, উঠে আয়।”
ক্লাবের বারান্দায় বেঞ্চে শুয়েছিল বিষ্টু ধর। ক্ষিতীশকে দেখে ওঠার চেষ্টা করতেই দুজন তাকে সাহায্য করল।
“দশ কেজি রসগোল্লা আনতে পাঠিয়েছি।” ক্ষীণস্বরে বিষ্টু ধর বলল। “ব্যাণ্ড পার্টি আনাবো। কোনিকে সারা নর্থ ক্যালকাটা ঘোরাবো।”
“খবরদার, ও কাজটি করবেন না। তাহলে হাজার পাঁচেক ভোট কমে যাবে।”
বিষ্টু ধর ফ্যালফ্যাল করে ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে থেকে, অস্ফুটে আপন মনে বলল, “কিন্তু আমার যে জেনুয়িন আনন্দ হচ্ছে।”
ক্ষিতীশ কোনিকে ডেকে গম্ভীর মুখে বলল, “টার্নিংয়ে ভুল হল কেন?”
“তখন কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল। অমিয়াদি টার্ন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে, টাকল টানের কথা আর মনেই এল না।”
“আসলে নিজের ওপর তখন ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলিস। মনে এলে সময় আরো কমতো।”
‘আমার সময় কত হল ক্ষিদ্দা?”
বুক পকেট থেকে ঘড়ি বার করে তাকিয়েই ক্ষিতীশ ভ্রূ কুঞ্চিত করল এবং ক্রমশ মুখটা অপ্রতিভ হয়ে উঠল।
“ভুলে গেছি রে! ফিনিশের সময় এমন একইটমেন্ট চারদিকে…তবে বেঙ্গল রেকর্ড নিশ্চয় আজ ভেঙ্গেছিস। ইসস, সময়টা যদি রাখতুম।”
“ক্ষিদ্দা, আমায় যে এখন প্রজাপতিতে যেতে হবে, দেরী হলে বৌদি রাগ করবে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেরী করিসনি আর।” ক্ষিতীশ ব্যস্ত হয়ে বলল। কিন্তু কোন ইতস্তত করছে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কি হল?”
“কানে কানে বলব।”
ক্ষিতীশ নিচু করল মাথাটা।
“রসগোলা আনতে পাঠিয়েছে না!”
“তাই তো! নিশ্চয় ভেলোটা আনতে গেছে। তাহলে আজ আর তোর বরাতে রসগোল্লা নেই।”
“কে বললে নেই।” বিষ্টু ধর গজন করে উঠল। “ব্যাণ্ড পার্টি ঘোরান গেল না, রসগোল্লার হাঁড়িটাই তার বদলে প্রজাপতি ঘুরে আসবে।”
“তাহলে তোর বৌদির রাগও জল হয়ে যাবে।”
সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে ক্ষিতীশের প্রতি লীলাবতীর প্রথম উক্তি হল : “অত লোকের সামনে এই বুড়ো বয়সে ধেই ধেই কার নাচছিলে কেন? লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। সবার সামনে অসভ্যতা, দোকানের মেয়েরাও দেখল তো?”
ক্ষিতীশ মাথা চুলকোতে চুলকোতে কোনির দিকে তাকাল। “তোর বৌদি জানল কি করে?”
ফিসফিস করে কোনি বলল, “বৌদি দেখতে গেছল। আমি বলেছিলুম আজকের সাঁতারের কথাটা, নইলে ছুটি পেতুম না যে।” তারপর হেসে বলল, “বৌদি আমার মাপ নিয়েছে, একটা ফ্রক করে দেবে।” লাজুক স্বরে আবার বলল, “বৌদি বলেছে, ইন্ডিয়া রেকর্ড করলে সিল্কের শাড়ি দেবে।”
কোনিকে বাড়ি পৌঁছে দেবার পথে ক্ষিতীশ জিজ্ঞাসা করল, “কি মনে হচ্ছিল রে তোর, যখন সাঁতরাচ্ছিলিস।”
কোনি অনেকক্ষণ চুপ করে হাঁটল, তারপর স্বপ্নের ঘোরে যেন কথা বলছে, এমনভাবে বলল, “জানো ক্ষিদ্দা, রোজ যখন প্র্যাকটিস করি, তখন জলের মধ্যে নিচের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আমার সঙ্গে সঙ্গে একটা মুখও এগিল্পে চলেছে। বড্ড ভয় করে তখন।”
‘মুখটা কেমন দেখতে রে?”
“দাদার মতন। আজও ছিল আমার সঙ্গে।”
.
১২.
অবশেষে কোনি বাংলা সাঁতার দলে জায়গা পেল।
এবারের জাতীয় সাঁতার চ্যামপিয়নশিপ হচ্ছে মাদ্রাজে। বি এ এস এ নির্বাচন সভায় ধীরেন ঘোষ, বদু চাতুজ্জেরা প্রবল বিরোধিতা করেছিল অ্যাপোলোর কাউকে দলে নেওয়ায়। শুধু তাই নয়, জুপিটারের কম্পিটিশনে অ্যাপোলোর তরফ থেকে ‘অমার্জনীয় অখেলোয়াড়ি আচরণ করার জন্য’ ওই ক্লাবকে সাসপেন্ড করা হোক দাবীও তোলে।
জুপিটার দলে ভারি ছিল, তাদের প্রতাব গৃহীতও হচ্ছিল। এমন সময় আচমকা বালিগঞ্জ ক্লাবের প্রণবেন্দু বিশুবাস অর্থাৎ হিয়ার কোচ প্রস্তাব দিল, “অ্যাপোলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হোক, ভবিষ্যতে এই ধরনের আচরণ সম্পর্কে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্রণবেন্দু তারপর বলল, “বেঙ্গলের স্বার্থেই কনকচাঁপা পালকে টিমে রাখতে হবে।”
তুমুল হৈচৈ পড়ে গেল প্রণবেন্দর এই কথায়। অ্যাপোলোর কোন প্রতিনিধি সভায় নেই। ওরা ভেবেছিল প্রস্তাবটা বিনা বাধায় পাশ হয়ে যাবে। কেউ ভাবতেই পারেনি হিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষ নিয়ে প্রণবেন্দই কিনা লড়াই শুরু করবে। ধীরেন ঘোষ ক্ষদ্ধ হয়ে বলল, “স্টেট চ্যামপিয়নশিপে কি হল, সেটা তো তুমি নিজেই দেখেছ।”
“হ্যাঁ দেখেছি।” প্রণবেন্দু, স্থির চোখে ধীরেনের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল, “কি হয়েছিল আমি দেখেছি।”
শুধু প্রণবেন্দু নয়, আরো অনেকেই দেখেছে।
কোনির প্রতিদ্বন্দ্বিতা অমিয়ার সঙ্গে নয়, হয়েছিল হিয়ার সঙ্গে। ব্রেস্ট স্ট্রোকের ১০০ মিটারে ছিল কোনি, অমিয়া, হিয়া। চ্যামপিয়নশিপের অন্যতম রেফারি ছিল ধীরেন ঘোষ। স্ট্রোক জাজদের মধ্যে ছিল হরিচরণ, ইনসপেক্টর অফ টানস এবং টাইম কীপারদের মধ্যে কার্তিক সাহা, বদু চাটুজ্জে, যজ্ঞেশ্বর ভটচাজ ছাড়াও জুপিটারের গোষ্ঠিভুক্ত কয়েকটি ক্লাবের লোকেরা ছিল।
একই সঙ্গে কোনি আর হিয়া ৫০ মিটার থেকে টান নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বদু চাটুজ্জে লাল ফ্লাগ নাড়তে শুরু করে। রেফারী ধীরেন ঘোষ ছুটে গিয়ে ফ্ল্যাগ দেখাবার কারণটা জেনে, বলল, “কনকচাঁপা পাল ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে। টার্ন করেই আণ্ডারওয়াটার ডাবল-কিক নিয়েছে।”
শুনে অবাক হয়ে গেল ক্ষিতীশ। শুধু বলল, “এরকম ভুল করার কথা তো নয়।”
হিয়া প্রথম এবং তার থেকে ৬ মিটার পিছনে কোনি ৭ মিটার পিছনে অমিয়া সাঁতার শেষ করে। কোনিকে ২০০ মিটারে নামতে দেয়নি ক্ষিতীশ। ব্রেস্ট স্ট্রোকে পায়ের উপর অত্যধিক খাটনি পড়ে, অথচ তার পরেই রয়েছে ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট। কোনি মুলতঃ ফ্রি স্টাইলার। কিন্তু এতেও কোনি পারল না। সাঁতার শেষ করে ফিনিশিং বোর্ড ছুঁয়েই সে মুখ ঘুরিয়ে দেখল অমিয়া হাত ছোঁয়াল। কোনি একগাল হেসে মুখ তুলে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল। ঘড়িটা উঁচু করে ধরে গ্যালারি থেকে ক্ষিতীশ হাত নাড়ল। ঘোষণায় শোনা গেল অমিয়া প্রথম হয়েছে।
ক্ষিতীশ প্রথমে থ হয়ে গেল, তারপর ধীরেনের কাছে ছুটে গিয়ে বলল, “এসব কি হচ্ছে?”
“কি আবার হবে!” ধীরেন অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছিল, ক্ষিতীশ ওর হাত টেনে ধরল।
“আমিও টাইম রাখছি। কোনি আগে টাচ করেছে, ওর টাইম—”
“তোমার জাপানী ঘড়ির টাইম তোমার কাছেই রাখ।”
নকুল মুখুজ্জে প্রতিবাদ জানাল জুরি অফ অ্যাপীলের কাছে। প্রতিবাদ নাকচ হয়ে গেল। পনেরো মিনিট পরেই ছিল ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলি। কোনি বাটার ফ্লাইয়ে হিয়া এবং অমিয়ার কাছে পিছিয়ে পড়ল, ব্যাক স্ট্রেকে অমিয়াকে ধরে ফেলে টান নিতেই দেখা গেল যজ্ঞেশ্বর ভটচাজ লাল ফ্লাগ তুলে রয়েছে।
“ব্যাপার কি!” ক্ষিতীশ গ্যালারি থেকে নেমে এল। “ধীরেন, জোচ্চুরির একটা সীমা আছে। জগু তো আগে থেকেই ফ্লাগ তুলেছিল।”
“কে বলল আগে থেকে! তোমার মেয়েটা ফলটি টার্ন নিয়েছে, তারপর ফ্ল্যাগ দেখিয়েছে। শেখাও শেখাও, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো শেখাও। জুপিটারকে অপদস্থ করা ছাড়া আর কিছু তো শেখাওনি।” ধীরেন উত্তেজিতভাবে হাত নেড়ে বকের মতো গলাটা লম্বা করে বলতে লাগল, “আইনটাও শিখো যে, ব্যাক স্ট্রোকে টার্ন নেবার জন্য বোর্ডে হাত ছোঁয়াবার আগে নরম্যাল পজিশন অন দি ব্যাক থাকতে হবে। কনকচাঁপা ঘরে গিয়ে হাত ছুঁইয়েছে, নরম্যাল পজিশনে থেকে ছোঁয়ায়নি। যাও যাও, গিয়ে বোসো এখন।”
হিয়ার কাছে অমিয়া হেরে গেল এক সেকেণ্ডের তফাতে। কোনি আড়ষ্ট হয়ে গেল দুবার বাতিল হয়ে এবং প্রথম হয়েও দ্বিতীয় হয়ে যাওয়ায়। বাড়ি ফেরার সময় ক্ষিতীশ বাসে সারা পথ গজরাল এবং অবশেষে বলল, “কাল হান্ড্রেড মিটার, দেখি ধীরেনরা কি করে তোকে আটকায়।”
কিন্তু আটকাবার যে অনেক পখা আছে ক্ষিতীশ তা ভেবে দেখেনি।
পরদিন স্টাটিং ব্লকে যখন প্রতিযোগীরা এসে দাঁড়াল, ক্ষিতীশ একটু অবাকই হল। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিযোগীদের মধ্যে যারা সেরা তাদের মাঝখানে রাখা হয়,-৩, ৪, ৫ নম্বর লেনে। হিয়া ৩ নম্বরে, কোনি ৪ নম্বরে, অমিয় ৬ নম্বরে আর তাদের মাঝে জনপিটারের ইলা ৫ নম্বর লেনে। হিটে কোনক্রমে তৃতীয় হয়ে ইলা ফাইনালে উঠেছে। দু’ বছর আগে প্রি-ইউ পরীক্ষায় টোকার সময় ধরা পড়ে ইলা গার্ডকে কামড়ে দিয়েছিল।
ক্ষিতীশ এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরেনের দিকে। একজন ভলান্টিয়ার তাকে আটকে দিয়ে বলল, “প্ল্যাটফর্মে কম্পিটিটাররা আর অফিসিয়ালরা ছাড়া কেউ যেতে পারবে না।”
ফিরে এসে ক্ষিতীশ ঘড়ি হাতে নিয়ে বসল। শুরু থেকেই প্রচণ্ড রেস। অমিয়া বদ্ধপরিকর চ্যামপিয়নশিপ বজায় রেখে সাঁতার থেকে বিদায় নিতে। হিয়া মসৃণ ছন্দোবদ্ধ এবং দ্রুততালে নিখুঁত ভঙ্গিতে ভেসে যাচ্ছে। কোনি যেন তাড়া খাওয়া ব্যস্ত উদ্বিগ্ন জলকন্যা। জল তোলপাড় করে সে যেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলেছে। বাকিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এই তিনজনের পিছনে অন্তত ২০ মিটারের মধ্যে থাকতে। ইলার ব্যস্ততাটা একটু কম, সে বারবার মুখে তুলে তাকাচ্ছে আর ক্রমশই সরে যাচ্ছে কোনির লেনের দিকে।
বোর্ড ছুঁয়ে সবার আগে টান নিল কোনি। তারপর অমিয়া। ব্রেস্ট স্ট্রোকাররা ভাল ফ্রি স্টাইলার হয় না–হিয়া প্রায় দু’ মিটার পিছিয়ে পড়েছে। বাকিরা তখনো ৪০ মিটারেও পৌঁছয়নি। টান নিয়ে কোনি সবে মাত্র দু-তিনটি স্ট্রোক দিয়েছে, তখনই ব্যাপারটা ঘটল।
ইলা ঢুকে পড়েছে কোনির লেনে। দুজনে মুখোমুখি সঘর্ষ! “উঃ” বলে কোনি চেঁচিয়ে উঠল একবার, দেখা গেল ওরা জড়াজড়ি অবস্থায় এবং হাঁকপাক করে সে যেন নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে। কয়েক সেকেন্ড এভাবেই কাটল। ততক্ষণে অমিয়া এবং হিয়া ওদের অতিক্রম করে বেরিয়ে গেছে। বদু চাটুজ্জে লাল ফ্ল্যাগ উচিয়ে ইলার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউ ডিসকোয়ালিফায়েড।” ইলা আবার নিজের লেনে সরে গিয়ে চিত সাঁতার কেটে স্টাটিং প্ল্যাটফর্মের দিকে ফিরে যেতে লাগল।
কোনি শুধু একবার সামনে তাকিয়ে দেখল। তারপরই বড় হাঁ করে অনেক খানি বাতাস বুকে ভরে নিয়ে তাড়া করল সামনের দুজনকে। অনেক দেরী হয়ে গেছে, তবু শেষ চেষ্টা। এঞ্জিনের পিস্টনের মতো ওঠানামা করছে দুটো হাত, পায়ের কাছে টগবগিয়ে ফটছে জল।
“কাম অন পল, কাম অন।” দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচাচ্ছে আর কেউ নয়, হিয়ার বাবা। গ্যালারির হতভম্ব ভাবটা তাতে যেন ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়ল।
“জোরে জোরে, আরো জোরে!” শুধু এই চীৎকার ধাপে ধাপে উঠে অবশেষে আক্ষেপে ভেঙ্গে পড়ল। কোনি পারল না। অমিয়া তার খেতাব রক্ষা করল। দ্বিতীয় হল হিয়া। কোনি তৃতীয় হল বেলার সঙ্গে।
তারপর আর একটি ব্যাপার ঘটল। ধীরেন জলের ধারে ঝুঁকে এক গাল হেসে অমিয়াকে কিছু বলছিল, সেই সময় ভিড় ঠেলে ছুটে এসে ক্ষিতীশ তার পিছনে লাথি কষাল। ধীরেন উল্টে গিয়ে জলে পড়ল। তুমল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। কয়েকটি ছেলে ক্ষিতীশকে হিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেল সেখান থেকে। তখন শোনা গেল চীৎকার করে সে বলে যাচ্ছে, “পারবি না, এভাবে পারবি না।…”
রাস্তায় বেরিয়ে এসে কোনির তোয়ালে দিয়ে ক্ষিতীশ মুখ মুছল। ঠোঁটের কষ বেয়ে তখনো রক্ত গড়াচ্ছে। কোনির কপাল ফুলে উঠেছে। একটা পানের দোকান দেখে ক্ষিতীশ বরফ কেনার জন্য দাঁড়াল। ঠিক তখনই ওর পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হিয়ার বাবা নেমে এল।
‘সরি মিস্টার সিনহা। এমন ডার্টি ব্যাপার এখানে হবে আমি জানতাম না। হিয়া, তার মা, আমরা কেউই খুশি হতে পারছি না। এভাবে মেডেল জেতায় কোন আনন্দ নেই।”
ভদ্রলোক কোনির পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, “দুঃখ কোরো না। জোরে সাঁতার কাটার দরকারটা আজ তুমি অনুভব করতে পেরেছ, তুমি লাকি। তোমার লাস্ট ফরটি মিটারস আমি ভুলব না।”
ক্ষিতীশ প্রথমে বিভ্রান্ত তারপর অভিভূত হয়ে গেল। গাড়ির জানলা দিয়ে হিয়া এবং তার মা দেখছে। ক্ষিতীশ এগিয়ে এসে হিয়ার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “বড়ো হও মা।” তারপর ইতস্তত করে বলল, “সেদিন কোনিকে আমি খুব বকেছি।”
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির ছেঁড়া বুক পকেটটা টান মেরে ক্ষিতীশ খুলে ফেলল।
“তোর বৌদিকে এসব কিছু বলিসনি।”….
প্রণবেন্দু ঘরের সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, “কি হয়েছিল, আমরা জানি। সেকথা এখন আলোচনা করে লাভ নেই। বাংলার মান সম্মানের কথাই এখন আমাদের ভাবতে হবে, টিমটা যাতে সেরা হয় তার জন্য তুচ্ছ দলাদলি ভুলে যেতে হবে। মহারাষ্ট্রই আমাদের মেয়েদের একমাত্র রাইভ্যাল। ওদের রমা যোশির সঙ্গে ফ্রি স্টাইলে পালা দেবার মতো কেউ নেই, একমাত্র কনক চাঁপা পাল ছাড়া। ফ্রি স্টাইলের তিনটে ইনডিভিজুয়াল, আর একটা রিলে, এই চারটের মধ্যে অন্তত দুটোতে, একশো আর দোয় কনকচাঁপার সিক্সটি পারসেন্ট চান্স আছে ‘মনে যে, আছে?”
“কিসে বুঝলে যে, আছে?” একজন জানতে চাইল।
“শুধু ওর সেদিনের ফিনিশ করা দেখেই বুঝেছি। যেরকম রোখা জেদী সাঁতার ও দেখাল, তাতে স্প্রিন্ট ইভেটে ওর সমকক্ষ এখন বাংলায় কেউ নেই। আমি ওর ট্রেনিংয়ের খবর রাখি, দু-তিনবার দেখেও এসেছি, জোর দিয়েই বলছি মহারাষ্ট্রের কাছ থেকে চ্যামপিয়নশিপ ছিনিয়ে নিতে হলে এই মেয়েটিকে চাই।”
“শুধু ফ্রি স্টাইল জিতেই আমরা চ্যামপিয়ন হয়ে যাব?” ধীরেন ঘোষ তাচ্ছিল্যভরে বলল এবং অন্যান্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো হাসল। কিন্তু তাকে সায় দিয়ে কেউ মাথা নাড়ল না এবার।
“হিয়ার কাছ থেকে আমি তিনটে গোল্ড আশা করছি। দুটো ব্রেস্ট স্ট্রোকে, একটা ব্যাক স্ট্রোকে। মেডলিতেও ফিফটি-ফিফটি চান্স আছে। এছাড়াও অঞ্জু, পুষ্পিতা, বেলা ও অমিয়া পয়েন্ট আনবে। এ বছর আমরা লেডিজ চ্যামপিয়ন হতে পারি।”
“কিন্তু কনকচাঁপা পাল এ বছর কোন ক্লাব পোর্টসে নামেনি, স্টেট চ্যামপিয়নশিপে দুটোতে ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে আর একটায় প্রথম দুটো স্পেসের মধ্যে আসতে পারেনি, বাকিগুলোয় আর নামেনি। ওর টাইমিং কি, আমরা তা জানি না। সুতরাং কি করে ওকে সিলেক্ট করা যায়!” ধীরেন ঘোষ টেবলে ঘুষি মেরে চেঁচিয়ে উঠল।
কয়েক সেকেণ্ড সভাঘর নিস্তব্ধ রইল। সবশেষে ধীর শান্ত গলায় প্রণবেন্দু বলল, “তাহলে বালিগঞ্জ সুইমিং ক্লাবের সুইমারদের বাদ দিয়েই আপনাদের টিম করতে হবে। আমার মেয়েদের আমি উইথড্র করে নিচ্ছি।”
“হ্যাঁ কি করে হয়?” সভায় গুঞ্জন উঠল। একজন বলল, “কনকচাঁপা পালকে সিলেকশন দিলে ক্ষতিই বা কি? যাবে তো নিজের টাকায়।”
এরপর শুরু হল তর্কাতকি। সেটা পৌঁছল চীৎকারে। এক সময় ধীরেন রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় বলল, “প্রণবেন্দু ব্ল্যাকমেল করে অ্যাপোলোর সুইমার টিমে ঢোকাতে চায়। এতে ওর কি যে স্বার্থ আছে বুঝেছি না।”
প্রণবেন্দু জবাব দিল, “রমা যোশির সোনা কুড়োনো বন্ধ করা ছাড়া আমার আর কোন স্বার্থ নেই।”
.
কোনি মাদ্রাজ যাওয়ার মনোনয়ন অবশেষে পেল। বাংলার ম্যানেজার হয়েছে ধীরেন ঘোষ। মেয়েদের বিভাগে ম্যানেজার বেলেঘাটা সুইমিং ক্লাবের প্রণতি ভাদুড়ি এবং কোচ হরিচরণ মিত্র। মাদ্রাজ মেলে ওরা সন্ধ্যায় রওনা হবে। ক্ষিতীশ এসেছে ট্রেনে কোনিকে তুলে দিতে। আর এসেছে কার্তিক, চণ্ডু, ভাদু। কোনির ভাই গোপাল।
কামরায় জানলার ধারে বসেছে কোনি। জানলা থেকে দূরে সবার থেকে একটু তফাতে প্লাটফমে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে। কোনি কথা বলছে কান্তিদের সঙ্গে। ধীরেন ঘোষ হাঁকডাক করে তদারকিতে ব্যস্ত। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসছে, এখনো নাকি কয়েকজন পৌঁছয়নি।
কোনির মুখে চাপা ভয়। কলকাতার বাইরে সে কখনো যায়নি। সাড়ে চোদ্দশ’ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় ৩৫ ঘন্টা ট্রেনে বাস। কামরার আর এক কোণে জুপিটারের অমিয়া আর বেলা। ওরা অভ্যস্ত। এটা ওদের পঞ্চম ন্যাশনাল চ্যামপিয়নশিপ। হিয়া বাবা-মার সঙ্গে দুদিন পর প্লেনে যাবে।
কোনি কথা বলছে আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ক্ষিতীশের দিকে। তখন চোখ সরিয়ে নিচ্ছে ক্ষিতীশ।
“মাদ্রাজ একেবারে সমুদ্রের ওপর। তবে নামিসনি যেন। গঙ্গা আর সমুদ্রে অনেক তফাত। সমুদ্রের তলায় কারেন্ট আছে।” ভাদু সাবধান করে দিল।
“কোনি মুশকিলে পড়বি খাবার নিয়ে। ইডলি ধোসা যা জিনিস, খেলেই মালুম পাবি। বাঙালীদের পেটে ওসব ঠিক সহ্য হবে না। ওখানে পৌঁছেই খোঁজ করবি বাঙালী হোটেল-ফোটেল কোথায় আছে।” কান্তি পরামর্শ দিল।
“না রে আমাদের সঙ্গে রান্নার জিনিসপত্তর, ঠাকুর সব যাচ্ছে।”
“তোর ভয় কচ্ছে?” ভাদু জিজ্ঞেস করল।
কোনি ছলছল চোখে তাকাল।
“আরে ধেৎ, তোর থেকেও কতো ছোট ছোট মেয়ে ওয়ার্ড ঘুরছে একা। আর তুই তো অ্যাতোগুলো লোকের সঙ্গে যাচ্ছিস। ঘাবড়সনি।” চণ্ডু হাত ধরল কোনিয়।
ট্রেন ছাড়ার ঘন্টা পড়ল। ক্ষিতীশ কথা বলছিল একজনের সঙ্গে। মুখ ফিরিয়ে দেখল। কোনি তার দিকে তাকিয়ে, দুগাল বেয়ে জল পড়ছে।
“ক্ষিদ্দা!” কোনি ধরা গলায় ডাকল।
ক্ষিতীশ না শোনার ভান করল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
“আমার ভয় করছে ক্ষিদ্দা।”
ট্রেনের সঙ্গে হাঁটছে কান্তিরা। মুখ কাত করে কোনি জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল ক্ষিতীশকে, দেখতে পেল না।
ঘণ্টা দুয়েক পর খড়্গপুর স্টেশনে ট্রেন থামল। কৌতূহলে কোনি প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ পাশ থেকে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল ক্ষিতীশ।
“ক্ষিদ্দা!” কোনির চীৎকারে শুধু কামরারই নয়, প্ল্যাটফর্মেরও অনেকে ফিরে তাকাল।
“মনে আছে তো ঠিক দশটায় ঘুমোবি।”
“না।” অবাধ্য গোঁয়ারের মতো কোনি ঘনঘন মাথা দোলা। টপ টপ করে চোখ থেকে জল ঝরছে। “আমি কিচ্ছু শুনবো না, করবোও না। তুমি মাদ্রাজ যাবে, এটা আমার কাছে লুকিয়েছিলে কেন?”
একজন টিকিট চেকারকে এগিয়ে আসতে দেখে ক্ষিতীশ আড়ষ্ট হয়ে গেল। লোকটি তার পিছন দিয়ে চলে যাবার পর কোন কামরায় ওঠে, সেদিকে আড় চোখে নজর রাখতে রাখতে সে বলল, “যাচ্ছি কে বলল, এখান থেকেই আমি কলকাতায় ফিরে যাব।”
“ইসস।” কোনি দু’ হাতে আঁকড়ে ধরল ক্ষিতীশের পাঞ্জাবির হাত। “যাও তো দেখি।”
“কেন আমি যাব! তুই কি কখনো আমার কথা ভাবিস?”
“ভাবি কি না ভাবি, তুমি তা জানো?”
“জানিই তো। জলে ডাইভ দিয়ে পড়ার পরই তো আমাকে ভুলে যাস।”
টিকিট চেকারটি আবার আসছে। কোন উত্তর দেবার আগেই ক্ষিতীশ, “কাল সকালে বহরমপরে আসব,” এই বলেই সরে গেল।
কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে হরিচরণ একজনকে বলল, ‘আপদটা দেখছি সঙ্গে চলেছে।”
কিন্তু সকালে ক্ষিতীশকে দেখা গেল না। বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য রাতেই চেকারের হাতে ধরা পড়ে সে তখন রেল পুলিশের হেফাজতে।
.
১৩.
ঘরের একধারে এককোনে খাটে কোনি শুয়েছিল। রঙ ওঠা শতরঞ্চি আর বালিশ, গায়ে দেবার সুতির চাদর, মাথার কাছে টেবলে ক্যাবিসের ছোট ব্যাগ। তাতে আছে গোটা দুয়েক ফ্রক, আর ওর সব থেকে মূল্যবান সম্পত্তি কস্ট্যুমটা। টেবলে মাজন, ব্রাশ আর অর্ধেক দাঁত পড়ে যাওয়া একটা চিরুনী। খাটের নীচে চটি।
দুই বাহুতে চোখ ঢেকে কোনি শুয়ে, আর অন্যান্য মেয়েরা তখন বাইরে থেকে ফিরল। ওরা মাদ্রাজ শহর দেখতে, বাজার করতে বেরিয়েছিল। কোনি যায়নি, হাতে মাত্র পনেরোটি টাকা, তাই নিয়ে বাজার করা যায় না। শহর দেখার ইচ্ছাও নেই। ওর সঙ্গে কেউ কথা বলে না, হাবেভাবে মেয়েরা বুঝিয়ে দেয় সে ওদের সমপর্যায়ভুক্ত নয়। কোনিও এড়িয়ে চলল ওদের।
আজ আবার সকালে বেরোবার সময়, বেলা হঠাৎ বলে, “প্রণতিদি, আমাদের সঙ্গে কোনি যাবে না?”
“না বলছে তো, শরীর খারাপ, জ্বরজ্বর লাগছে।”
খাটে শুয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইল কোনি।
“তা হলে ঘরে কি ও একা থাকবে! কাল আমার ক্রিমের কৌটোয় খাবলা দেওয়া দেখেছি।”
“ওমা, বেলাদি, আমারও যে পেস্টের টিউবটা অনেকখানি খালি। ভয়ে আমি বলিনি, কি জানি কে আবার কি মনে করবে!”
“ঘরে তালা দিয়ে যাওয়া উচিত প্রণতিদি।”
“তা হলে কোনি কোথায় থাকবে!” প্রণতি ভাদুড়ির কড়া স্বরে ওরা চুপ করে গেছল।
লজ্জায় আর ভয়ে খাটের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে কোনি শুয়েছিল। থেকে থেকে চাপা একটা অভিমান গুমরে উঠছিল বুকের মধ্যে। ক্ষিদ্দা তাহলে সত্যি সত্যিই খড়্গপুর থেকে কলকাতায় ফিরে গেল! যদি এখানে সঙ্গে আসত তাহলে কষ্ট অনেক কমে যেত। অনেকের সঙ্গেই তো বাবা-মা এসেছে। ক্ষিদ্দা তাহলে এল না কেন!
হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল হিয়া। ওর বাবা-মা হোটেলে রয়েছে। তারা সকালে এসে হিয়াকে নিয়ে বেরিয়েছিল। ঘরে কাউকে না দেখে হিয়া প্রথমে থমকে গেল। তারপর কোনিকে দেখতে পেয়ে বলল, “বাবার বন্ধু মিস্টার সারঙ্গপানির বাড়িতে আমি যাচ্ছি, প্রণতিদিকে বলে দিও। ঘন্টা দুই পরে ফিরব।”।
ঘরের আর একদিকে হিয়ার খাট। সেখানে তার বিরাট স্যুটকেশে অজস্র রকমের জিনিস। ইংরাজি কমিকস, আর ট্রানজিস্টর রেডিও বিছানায়, খাটের নীচে তিন রকমের জুতো আর চকোলেটের মোড়ক ছড়ান। হিয়া চটপট ফ্রক বদল করে চুলে ব্রাশ বোলাল। হাত ব্যাগটার মধ্যে একটা চকোলেটের বার দেখতে পেয়ে আধখানা মুখে ঢুকিয়ে বাকিটুকু জেগে কোনির দিকে ছুঁড়ে দিল।
টুকরোটা এসে পড়ল কোনির বুকের কাছে। সেটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল হিয়ার দিকে। হিয়ার গায়ে লাগল।
একটু অবাক হয়ে হিয়া প্রশ্ন করল, “খাও না তুমি?”
“দিলেই খেতে হবে নাকি!” কোনি শুকনো স্বরে বলল।
চকোলেট টুকরোটা কুড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে হিয়া বলল, “বুঝেছি কেন খাবে না।”
“কি বুঝেছ?” স্প্রিংয়ের মতো কোনি ছিটকে উঠে বসল।
“যা বোঝার ঠিকই বুঝেছি। তুমি কমপ্লেক্সে ভুগছ, অযথা আমার ওপর রেগে আছ।”
হিয়া কথা বলতে বলতে বেলার টেবলের দিকে এগিয়ে গেল। ক্রিমের কৌটোটা খুলে আঙুল ডুবিয়ে খানিকটা ক্রিম তুলে গালে লাগাল। “বাবা বলেছিলেন, রমা যোশি গতবারের মতো ছ’টা গোল্ড এবার পাবে না যদি স্টেট মীটে যেভাবে হানড্রেড ফিনিশ করেছিল সেইভাবে তুমি কাটতে পারো। কিন্তু আমি বলছি তুমি তা পারবে না।”
হিয়া আর একটু ক্রিম তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে থমকে গেল। কোনির কাছে এসে, ওর মুখে সেটুকু লাগিয়ে দিয়েই হেসে উঠল সে এবং ছটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, “অত হিংসে ভাল নয়।”
কোনিকে বিভ্রান্ত করল হিয়ার এই কথাটা। আপন মনে সে বলল, “বয়ে গেছে আমার হিংসে করতে। বড়লোকমি দেখিয়ে চকলেট দেওয়া…কে চায় তোর ভিক্ষে, নিজের জিনিস অন্যকে দিতে হিয়া কার্পণ্য করে না, পরের জিনিস নেওয়াতেও কুণ্ঠা নেই। মুখে ক্রিমটুকু অন্যমনস্কের মতো বুলিয়ে নিয়ে কোনি আবার বলল, ‘এসব হচ্ছে বড়লোকি চাল। লোককে দেখানো আপন-পর জ্ঞান আমার নেই, বুঝি না যেন কিছু!’
ঘরে ঢুকল হরিচরণ।
“অঃ তুই একা রয়েছিস, ওরা গেল কোথায়? কি ঝামেলা দ্যাখতো, তোর নাম চারটে ইভেন্টে পাঠান হয়েছিল, অথচ কোনটাতেই নাম দেখছি না। নিশ্চয় গোলমাল হয়েছে কোথাও। খোঁজ নিয়ে দেখব’খন। অমিয়া ফিরলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস তো।”
যেমন বেগে এসেছিল তেমনিভাবেই হরিচরণ বেরিয়ে গেল। আর থ হয়ে রইল কোনি। এতদরে এসে চ্যামপিয়নশিপে সে নামতে পারবে না। আর কিছু সে ভাবতে পারল না। আস্তে আস্তে একটা কান্না তার সারা শরীরটাকে ঝাঁকাতে শুরু করল। ফাঁকা, বিরাট ঘরটা একটু একটু করে ভরে উঠতে লাগল মৃদু চাপা করুণ একটা স্বরে। আর তার মধ্যে একটা শব্দ মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে–”ক্ষিদ্দা, ক্ষিদ্দা।”
মেয়েরা ফিরল তর্ক করতে করতে। এবারের ওলিম্পিককে মেক্সিকো না মেক্সিকো সিটি ওলিম্পিক, কোনটা বলা সঠিক হবে। ওরা লক্ষই করল না কোনিকে।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ চীৎকারে সবই সচকিত হয়ে বেলার দিকে তাকাল। হাতে খোলা ক্রিমের কৌটো, বেলা ক্ষিপ্তের মতো বলে উঠল, ‘আমার ক্রিম! আবার কে নিয়েছে এখান থেকে। কে নিয়েছে? আমি আজ বার করবই, বেরিয়ে যাবার সময় যা ছিল, এখন তার থেকে অনেক কমে গেছে।”
কে একজন বলল, “ঘরে তো কোনি ছাড়া আর কেউ ছিল না।”
অমিয়া হঠাৎ বলল, “দ্যাখ তো কোনির ব্যাগটা, সরিয়ে-ফরিয়ে রেখেছে কিনা।”
বেলা ছুটে গিয়ে ক্যাবিসের ব্যাগটা খুলে উপুড় করল। সামান্য জিনিস ক’টা মেঝেয় পড়ল। কোনি বিস্ফারিত চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে। কথা বলার ক্ষমতা যেন লোপ পেয়েছে, এই ঘটনার আকস্মিতায়। বেলা পা দিয়ে কোনির কস্ট্যুমটা সরাতেই, “আহ” বলে সে নিচু হল কস্ট্যুমটা তোলার জন্য। বেলা সেই মুহূর্তে ওর চুল মুঠোয় টেনে মুখ উঁচু করে ধরল।
“কি মেখেছিস? অ্যাঁ, কি মাখা রয়েছে তোর মুখে?” আবিষ্কারের উত্তেজনায় বেলার দম বন্ধ হয়ে এল।
মেয়েরা এগিয়ে এল কোনিকে ঘিরে। অমিয়া একটা আঙুল দিয়ে কোনির গাল ঘষে, আঙুলটা নাকের কাছে ধরে বিচারকের মতো গম্ভীর স্বরে রায় দিল, “ক্রিম।”
“আমার ক্রিম।” বেলা চীৎকার করে উঠল।
তারপর ওরা সদ্য আবিস্কৃত একটি দ্বীপের দিকে তাকিয়ে থাকা নাবিকদের মতো কোনিকে দেখতে লাগল। কোনি পা ফলিয়ে খাটে বসে। মুখের বিস্ময়ভাব কাটেনি তখনো, অসহায় চোখে সকলের দিকে তাকিয়ে, কিছু বলার জন্য তার ঠোঁট নড়ছে কিন্তু বলতে পারছে না।
“কোনি বোধহয় ফরসা হতে চায়।” একজন মন্তব্য করল।
“বাব্বা, আমি যা ভয়ে ছিলুম, বেলাদি বোধহয় আমাকেই চোর সন্দেহ করছে।”
“আমার পেস্টও তাহলে কে কমিয়েছে এবার বোঝা গেল।”
কোনি এতক্ষণে কথা বলল, “হিয়া ক্রিম বার করে আমার মুখে মাখিয়ে দিয়েছে। আমি কখনো ক্রিম মাখি না।”
“কি বললি? হিয়া?” বেলা ঠাস করে কোনিকে চড় মারল। “হিয়ার নামে অপবাদ দিচ্ছিস? জানিস ও কতো বড়লোক! তোর মতো দশটা মেয়েকে ও ঝি রাখতে পারে। শেষকালে কিনা হিয়াকেই চোর বানাচ্ছিস!”
“সত্যি বলছি বেলাদি। আমায় বিশ্বাস করো। হিয়া এসেছিল, আবার বেরিয়ে গেল ওর বাবার বন্ধুর বাড়িতে। চকলেটের আধখানা আমায় দিল আর তোমার ক্রিমের কৌটো থেকে ক্রিম নিয়ে নিজে মাখল আর আমাকেও মাখিয়ে দিল।
“গপ্পো লেখ কোনি, তুই মস্তো লেখক হবি।” বেলার ধীরস্বরে বিদ্রূপ চাবকে উঠল।
“তাহলে তো একটা দ্বিতীয় ভাগ আগে কিনে দিতে হবে।” অমিয়া তার খাটে শয়ে মিটিমিটি হেসে বলল।
‘আমি সত্যি বলছি।” কোনির ঘর দুমড়ে মুচড়ে গেল কান্নায়। “তোমরা বিশ্বাস করো। হিয়া এলে ওকে জিজ্ঞেস কোরে দেখো।”
ওরা আর বেশি কথা বলল না। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি, ফিসফাস করল কিছুক্ষণ। কোনি দেয়ালে ঠেস দিয়ে কাঠের মতো বসে। প্রণতি ভাদুড়ি আর ধীরেন ঘোষ ঘরে ঢুকল। ওরা যেভাবে কোনির দিকে তাকাল তাতে বোঝা যায় যে, ব্যাপারটা ওদের কানেও ইতিমধ্যে কেউ পৌঁছে দিয়ে এসেছে।
“হিয়া না আসা পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষা করা উচিত ছিল।” প্রণতি ভাদুড়ি ঘরের সবাইকে লক্ষ করে বলল। “যাও, খেয়ে রেস্ট নাও।”
“অমিয়া, কাল সকালে তোর ফোর আর টু হানড্রেড হীট। যোশি ছাড়া আর কেউ তোর কম্পিটিটার নেই। তা হলেও হীটে টাইম ভাল করতে হবে। বেলা শুনে রাখ, যোশি পড়েছে তোর গ্রুপে। চেষ্টা করবি, পাঞ্জাবের কাউর বলে একটা মেয়ে শুনলাম ভাল টাইম করে এসেছে।”
ধীরেন ঘোষ প্রত্যেককে নির্দেশ দিতে দিতে শেষকালে কোনির দিকে তাকাল। “তোর নাম যে কেন বাদ গেল বুঝছি না। বলছে তো পাঠানোই নাকি হয়নি। সব বাজে কথা, নিজেদের দোষ ঢাকতে এখন এইসব বলছে। আমি অবশ্য প্রোটেস্ট করেছি, দেখি কি হয়। তবে প্র্যাকটিসে ঢিলে দিলে চলবে না, এটা রেগুলার করতেই হবে। মন খারাপ করিসনি, ন্যাশনাল তো বছর বছরই হয়, সামনের বছর আবার আসবি।”
মেয়েরা খাওয়া সেরে এসে বিছানায় শুয়েছে, এমন সময় হিয়া ফিরল। কোনি খেয়েই শুয়েছিল, হিয়াকে দেখা মাত্র উঠে বসে চেঁচিয়ে বলল, “এই তো হিয়া এসেছে।”
বেলা হাত ধরে হিয়াকে নিজের বিছানায় বসিয়ে বলল, “আজ একটা ব্যাপার ঘটেছে। কোনি তোমাকে চোর বলেছে।”
“হোয়াট?” ঝটকা দিয়ে হিয়া উঠে দাঁড়াল দুচোখে আগুন নিয়ে।
“বোসে বোসো, আগে আমার কথাটা শুনে নাও।” বেলা হাত ধরে টেনে হিয়াকে বসাল আবার।
“আমি জানি আমার প্রতি ও জেলাস। কিন্তু এমন নোংরা অপবাদ দেবে ভাবিনি।”
“আমরাও ভেবেছি নাকি! ক্রিম চুরি করে মুখে মেখে ধরা পড়ে গিয়ে বলেছে তুমি নাকি মাখিয়ে দিয়েছ। এমন বোকার মতো মিথ্যে কথা কেউ বলে!”
হিয়া থতমত খেয়ে গেল। প্রচণ্ড রাগটা মাথা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে যে ধাক্কাটা দিচ্ছে তা সামলে উঠে সে বলল, “ক্রিম তো আমিই ওর মুখে লাগিয়ে দিয়েছি।”
“য়্যা?“
“হ্যাঁ, তোমার কৌটোটা থেকে আমি মাখলাম, কোনির মুখেও লাগিয়ে দিলাম। কি করব বলল, তোমার পারমিশন নেবার সময় তখন ছিল না। কালও মেখে ছিলাম।”
হিয়া ব্যাপারটা সেখানেই শেষ করে দিয়ে, পোশাক বদলাতে ব্যস্ত হল। সারা ঘর চুপ। আড়চোখে পরস্পরকে দেখে নিয়ে অনেকেই ঘুমের ভান করল। কোনি একদৃষ্টে হিয়ার দিকে তাকিয়ে। মনে মনে সে বলল, তোমার খেয়ালখুশির জন্য আজ আমি চড় খেয়েছি, খারাপ কথা শুনেছি।
বেলা অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেছল। এখন তার রাগটা পড়ল হিয়ার উপর। বিরক্ত করে সে বলল, “পরের জিনিষ না বলে ব্যবহারটা খুব অন্যায়। তোমার নয় অনেক টাকা আছে, আমার ওই একটুখানি ক্রিম থেকে যদি সবাই মাখে…”
“আচ্ছা আচ্ছা, নয় তোমায় একটা কিনে দেব হয়েছে তো।” হিয়া হেসে অপরাধীর মতো মুখ করে হাত জোড় করল। ঠিক সেই সময়ই কোনি ছুটে এসে ওকে চড় মারল।
হিয়া গালে হাত দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। বিছানায় মুহূর্তে সবাই উঠে বলেছে। কোনি ধীর পায়ে নিজের খাটে ফিরে এসে বসল।
“এটা তোমার পাওনা ছিল। বেলাদিকে জিজ্ঞাসা করো, জানতে পারবে। তোমার জন্যই আমি আজ চড় খেয়েছি, চোর বদনাম পেয়েছি।” কোনি একটু থেমে আবার বলল, “তোমাকে আমি একটুও হিংসে করি না। আমি বস্তির মেয়ে, লেখাপড়াও জানি না, তোমার সঙ্গে পারব কেন। তবে একবার কখনো যদি জলে পাই…” দাঁতে দাঁত চেপে বাকি কথাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ায় কিছু শোনা গেল না।
.
১৪.
চিপকে সমুদ্রতীরে সুইমিং পুল।
কোনি আগে কখনো এমন পুল দেখেনি। যন্ত্রের সাহায্যে অবিরাম পরিশোধিত স্বচ্ছ জলের মধ্য দিয়ে পুলের তলদেশ দেখা যায়। একটা পিন পড়ে থাকলেও নজরে আসে। কোনি শুনেছে কলকাতায় সাহেবদের ক্লাবে এমন পুল আছে।
তিনদিকে কাজুবাদাম গাছের ডাল দিয়ে তৈরী হয়েছে গ্যালারি, মাথায় নারকেল পাতার ছাউনি। পাশেই ডাইভিং পুল। পুলের জলে প্রথম নেমে কোনি অস্বস্তি বোধ করেছিল। জলের সঙ্গে পরিচয়ের অনুভব পেতে অবশ্য তার বেশি সময় লাগেনি। হাতে স্টপ ওয়াচ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে নেই অথচ সে সাঁতার কাটছে, কোনি গত একবছর আর তা ভাবতে পারে না। কিন্তু মাদ্রাজে সে জলে নামার আগে পিঠে পরিচিত একটা হাতের স্পর্শ অভ্যাস মত পেয়ে মুষড়ে পড়ল। কি ট্রেনিং সে করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। কেউ কিছু বলছে না, দেখিয়েও দিচ্ছে না। হিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত প্রণবেন্দ। হরিচরণের অধিকাংশ নির্দেশ অমিয়ার জন্য। তবু কোনি মোটামুটি জোরে ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইল, কয়েকটা ২৫ মিটার প্রিন্ট, আবার ৪০০ মিটার, মিনিট পাঁচেক টান ও চাট, তারপর ২০০ মিটার মেডলি কাটলো।
স্টাটিং ব্লকে বসে কস্ট্যুম পরা একটি মেয়ে ওদের ট্রেনিং দেখছিল। কোনি জল থেকে উঠে তার পাশ দিয়ে যাবার সময় মেয়েটি হাসল।
“হোয়াটস ইওর নেম?”
“মাই নেম ইজ কনকচাঁপা পাল।”
“ইউ হ্যাভ এ বিউটিফল স্টাইল।”
কোনি এবার ফাঁপরে পড়ল। ইংরাজীতে জবাব দেওয়ার দায় এড়াবার জন্য সে শুধু হাসল। মেয়েটি আঙুল তুলে হিয়াকে দেখিয়ে বলল, “ইজ শী এ ফ্রি স্টাইলার?”
“কেয়া বোলতা?”
“উও ফ্রি স্টাইলার হ্যায়?”
“হাম হ্যায়। ও হ্যায় ব্রেস্ট স্ট্রোক্কা, মেডলিকা। তোমার স্ট্রোক কেয়া?”
মেয়েটি হেসে বলল, “রমা যোশি।”
কোনি এবার ভাল করে তাকাল। শ্যামলা মাজা রঙ, দোহারা গড়ন। চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাটা। সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই দেখতে। হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল ‘৭০’ সংখ্যাটা। কোনি দ্রুত ড্রেসিং রুমের দিকে পা চালাল।
বাংলাকে প্রথম গোল্ড এনে দিল হিয়া। পাঁচটির বেশি মেয়ে ভারতবর্ষে পাওয়া যায়নি ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতার কাটার জন্য, তাই হিট করার দরকার হয়নি। হিয়া ৩মি ৩২সে সময় নিল।
প্রতিযোগীদের জন্য নির্দিষ্ট গ্যালারিতে বসেছিল কোনি। দেখল ভিকট্রি স্ট্যাণ্ডে হিয়া উঠল আরো দুটি মেয়ের সঙ্গে। ওর গলায় মাদ্রাজের এক মন্ত্রী মেডেল ঝুলিয়ে দিল। ব্যাণ্ড বাজল। আর তার বুকের মধ্যে অসহ্য একটা কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল। পুলের ওধারে বসেছে হিয়ার বাবা-মা। ছুটে গেল হিয়া। বাবা জড়িয়ে ধরে চুমু দিল। হিয়াকে কোলে টেনে নিল মা। হিয়া তোয়ালের ক্লোথটা গায়ে দিয়ে এধারে এল।
“দেখি দেখি মেডেলটা।”
হিয়াকে ঘিরে ধরল মেয়েরা।
“কনগ্র্যাটস হিয়া।”
“থ্যাঙ্কয়ু।”
“দারুণ ফিনিশ করেছে। আমি তো ভাবলুম গুজরাট যেরকম নেক আণ্ড নেক যাচ্ছে, টারনিংয়ে যদি হিয়া ওকে না মারতে পারে তাহলে বোধহয়—”
“আমার শুধু ওই একবারই তখন ভয় হয়েছিল। টারনিংটা আমার এত খারাপ।”
“মাইশোরের মেয়েটাকে দেখেছিস কেমন যেন আগাগোড়াই মুখে তুলে রইল।”
কোনি তফাতেই বসে রইল। হিয়া বারকয়েক গ্যালারিতে চোখ বোলাবার সময় কোনির মুখের দিকে তাকিয়েছিল মাত্র। মেয়েদের একটিই ফাইনাল ছিল, বাকিগুলি ফ্রি স্টাইলের হিট। অমিয়া ফ্রি স্টাইলের তিনটিতেই ফাইনালে উঠেছে, বেলা ২০০ মিটারে এবং হিয়া ১০০ মিটারে। কথা ছিল হিয়া ২০০ ও ৪০০ মিটারেও নামবে কিন্তু প্রণবেন্দু শেষ মুহূর্তে ওর নাম প্রত্যাহার করিয়ে নেয় এই যুক্তিতে যে, ওর অন্য ইভেন্টগলো, যাতে ওর গোল্ড পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে, সেগুলোর ক্ষতি হবে।
তর্ক তুলেছিল হরিচরণ, “কি এমন ক্ষতি হবে? দুটো ব্রোঞ্জ তো শিওর আসতো, তার মানে বেঙ্গলের দুটো পয়েন্ট। এবার চ্যামপিয়নশিপের জন্য বেঙ্গলের খুব ভাল চান্স রয়েছে। প্রণবেন্দু তুমি শুধু হিয়ার কথাই ভাবছ, বেঙ্গলের কথাটা ভাবছ না।’
শোনা মাত্র প্রণবেন্দু দপ করে উঠেছিল। “বেঙ্গলের কথা আমি ভাবি না, শুধু আপনারাই ভাবেন। তাহলে মেয়েটা ওখানে বসে আছে কেন?” প্রণবেন্দু আঙুলটা গ্যালারিতে বসা কোনির দিকে তুলে বলল, “ও থাকলে বেঙ্গল শিওর চ্যামপিয়নশিপ পেত, কিন্তু আপনারা ক্ষিতীশ সিপ্পিকে জব্দ করার জন্য ওকে ভিক্টিমাইজ করলেন। আর এখন এসে বাংলার জন্য কাঁদনি গাইছেন? এবার আমি দেখব আপনার মেয়েরা কি করে, কতো পয়েন্ট আনে!”
কোনি জানত না তাকে কেন্দ্র করে দুটো দল পাকিয়ে উঠ ঝগড়া শুরু করেছে। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ফাইনাল বিকালে ১০০ মিটার বাটার ফ্লাইয়ের। অমিয়া আর বেলা পুল থেকে ফিরে এসেই বিছানায়। ধীরেন ঘোষ বিস্কুট আর কমলা লেবু এক হাতে, অন্য হাতে মধু ভর্তি শিশি নিয়ে ঘরে ঢুকল।
“কাল সকালের জন্য। দুধ দুজনের জন্য দু’ গ্লাস রেডি করে রেখো প্রণতি। ঠিক আটটায় পুলে পৌঁছনো চাই। এখন একদম রেস্ট, সাতটার মধ্যে খেয়ে নিয়েই ঘুম।”
যথাসাধ্য নির্দেশ দিয়ে ধীরেন ঘোষ ঘরের চারদিকে চোখ বোলাল।
“তোমাদের একটা কথাই বলব, প্রথম গোল্ড বাংলা আজ এনেছে। শুভ জয় যাত্রায় আমরা বেরিয়েছি, শেষ গোল্ডও আমাদের, আমরা চ্যামপিয়ন হবোই। মনে রেখো, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বাঙালী তোমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারা অধীরভাবে অপেক্ষা করছে বাংলার মেয়েরা চ্যামপিয়নশিপ নিয়ে ফিরবে… ফিরবেই। একটা গোল্ড পেয়েছি, বাকি আটটাও আমরা নোব। আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না।”
পরদিন দুটি ইভেন্টের দুটিতেই প্রথম হল রমা যোশি। ২০০ মিটারে অমিয়া ব্রোঞ্জ পেল। রুপো নিল মহারাষ্ট্রেরই নতুন মেয়ে সাধনা দেশপাণ্ডে। বেলা পঞ্চম স্থান পেল। চীৎকারের গোল্ড মেডেল থাকলে সেটা পেত হরিচরণ। অমিয়া যথাসাধ্য করেছে। কিন্তু গত বছরের থেকে তার সময় ৬ সেকেণ্ড কম হল।
গম্ভীর মুখে অমিয় জল থেকে উঠে গেল। বেলা ফুঁপিয়ে উঠল কয়েকবার। হিয়া এগিয়ে এসে যোশিকে অভিনন্দন জানাল। এরপর ঘোষণা, ভিকট্টি স্ট্যাণ্ডে গলায় মেডেল পরা, ব্যাণ্ডের বাজনা। কোনি উদাস চোখে সব কিছু দেখল মাত্র।
বিকেলে মেয়েরা দল বেঁধে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেল। কোনি পুলেই রয়ে গেল। বাটারফ্লাইয়ে রমার ধারে-কাছে কেউ আসতে পারল না। বাংলার কোন মেয়ে ফাইনালে নেই। দিল্লি আর গুজরাট বাকি মেডেল দুটি নিল। কোনি নিরুৎসক চোখে সব কিছু দেখল।
শুক্রবার সকালে সোনা জিতল হিয়া আর রূপো পুষ্পিতা ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে। ব্রোঞ্জ গুজরাটের। চ্যামপিয়নশিপের মাঝপথে বাংলার ১৪ ও মহারাষ্ট্রের ১৬ পয়েন্ট, হিয়া ও রমার দুটি কবে সোনা। চাপা একটা উত্তেজনা বাংলার ক্যামপে মৃদু কম্পন তুলল। কোনি কোন কথায় যোগ দিল না।
দুপুরে খেতে বসার আগে ধীরেন ঘোষ এসে বলে গেল, “বাংলা আবার ভারতের সাঁতারে নিজের জায়গায়”–ডান হাতের তর্জনী মাথার উপর তুলে গলা কাঁপিয়ে বলল, “উঠেছে।”
হিয়ার ট্রানজিস্টরে রক মিউজিক বাজছিল। প্রণতি ভাদুড়ি রেডিওটা বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে ধমক দিল, “শোনো, শোনো। ইনসপিরেশন পাবে তা হলে।”
“কিপ আপ দি ফ্ল্যাগ, এখন সমান চলেছে কিন্তু আমরা বেরিয়ে যাবই।”
রমা যোশি বিকেলে অমিয়ার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল ১৫০ মিটারে টান নিয়েই এবং অমিয়া যখন শেষবার টান নিচ্ছে তখন সে ৪০০ মিটার শেষ করল। যেন ১০০ মিটারে প্রতিযোগিতা করছে, এমন বেহিসাবীভাবে অমিয়া শুরু করে ছিল। সওয়াশো মিটার পর্যন্ত রমা পিছিয়ে ছিল প্রায় ১০ মিটার। তারপরই অমিয়া মন্থর হতে শুরু করে। রমা তার সমান গতিতে কোন হেরফের না ঘটিয়ে তিনশো মিটারের পর গতি বাড়াল এবং শেষ ৫০ মিটার একা সাঁতরে এল। পাঞ্জাবের মঞ্জিত কাউর ব্রোঞ্জ নিল।
অমিয়া সকলের আগেই ট্যাক্সি করে একা ক্যামপে ফিরে আসে। শনিবার সকালে হিয়ার দুটি হিট, মেডলি এবং ব্যাক স্ট্রোকের। সব মেয়ের চোখ এখন হিয়ার দিকে। গম্ভীর হয়ে গেছে সে। ধীরেন ঘোষ আজ আর বক্তৃতা দিল না। মাথা নেড়ে বলল, “অমিয়ার মতো ভেটারেনের কাছ থেকে এমন ব্যাডলি জাজড রেস কেউ আশা করেনি। আমরা চার পয়েন্টে পিছিয়ে পড়লাম।”
“হরিচরণদা যদি অমিয়াদিকে একটু বলেও দিত!” বেলা ক্ষীণস্বরে বলল।
“যাকগে যা হবার হয়েছে। এখন অনেক কিছু হিয়ার উপর নির্ভর করছে। কাল সকালে দুটো হিট, রাতে মেলির ফাইনাল। তোমরা ওকে কনসেনট্রেট করতে দাও।”
ধীরেন ঘোষ চলে যাবার পর সবাই হিয়ার দিকে তাকাল, একমাত্র কোনি ছাড়া।
হিয়া শনিবার সকালের দুটো হিট থেকে অনায়াসেই ফাইনালে উঠল। ব্যাক স্ট্রোকে রমা যোশি নেই। কিন্তু মেলির দ্বিতীয় হিট থেকে রমা ফাইনালে উঠল হিয়ার সময়কে দুই সেকেণ্ড ম্লান করে। ঘোষণায় রমার সময় শোনা মাত্র হিয়া পুল ছেড়ে চলে গেল বাবা-মার সঙ্গে।
মেয়েরা ফিসফাস কথা বলছে। খাটে উপুড় হয়ে রেডিওয় হিন্দি গান শুনছে হিয়া। গত চারদিন কোনির সঙ্গে কারর বাক্যালাপই হয়নি। অমিয়া কখনো বিছানায় শুচ্ছে, উঠে এসে জানলায় দাঁড়াচ্ছে, টেবলের এটা ওটা নাড়ছে। প্রণতি ভাদুড়ি তার খাটে শুয়ে কমিকস পড়ছে।
“অমিয়াদি শুয়ে পড়ো।”
অমিয়া বিরক্তমুখে বেলার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। “ভীষণ মাথা ধরেছে। তখন থেকে রেডিওটা জালাচ্ছে। হিয়া, ওটা বন্ধ করো।”
হিয়া রেডিও বন্ধ করার উদ্যোগ দেখাল না।
“বলছি, রেডিও বন্ধ করো।”
হিয়া একটু জোর করে দিল রেডিওর শব্দ। অমিয়া চীৎকার করে উঠল, “বন্ধ করবে কি করবে না, আমার ভাল লাগছে না।”
“রেডিও শুনতে আমার ভাল লাগছে।“ হিয়া শুকনো গলায় বলল, “আপনি চেঁচাবেন না।”
কি ঔদ্ধত্য! অমিয়া অবাক হয়ে ঘরের সকলের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কেউই তার দিকে তাকিয়ে নেই, এমনকি বেলাও গভীর মনোযোগে রহস্য কাহিনী পাঠে বাস্ত। এতদিন বাংলার মেয়ে সাঁতারু মহলে সে সম্রাজ্ঞীর মতো বিরাজ করেছে। এই মুহূর্তে সে বুঝল তার মাথা থেকে মুকুট তুলে নিয়েছে হিয়া। এবার ওকে মধ্যমণি করেই ওরা ঘুরবে, ওদের প্রশংসা, মনোযোগ এবার থেকে পাবে হিয়া। তার দিন ফুরিয়ে গেছে। বিছানায় এসে বসল অমিয়া। দিন কি সত্যিই ফুরিয়ে গেছে। কাল আছে ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল, ৪×১০০ রিলে। দেখা যাক, সত্যিই ফুরিয়ে গেছি কিনা, অমিয়া ভবল, কাল আমাকে দেখাতেই হবে।
কিছু পরে প্রণতি ভাদুড়ি উঠে এসে রেডিওটা বন্ধ করে দিল। হিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যায় পুলের হাজার হাজার ওয়াটের আলোয় স্টার্টিং ব্লকের উপর হিয়ার লাল কস্ট্যুম একটি স্থির শিখার মতো অপেক্ষা করছে। তার পাশে রমা মেশি, তার পাশে গুজরাটের আমি পটেল। স্টার্টারের বন্দুকের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দপ করে জলে উঠল হিয়া।
বাটারফ্লাইয়ে রমার তুল্য ভারতে কেউ নেই। প্রায় দশ মিটারে সে হিয়াকে পিছনে ফেলে গেল শুশুকের মতো ঢেউ খেলানো গতিতে। বোর্ড ছুঁয়েই ব্যাক স্ট্রোক। হঠাৎ গ্যালারী উদগ্রীব হয়ে উঠল। হিয়া এবার ব্যবধান কমাচ্ছে।
“গো হিয়া, গো।”
“কান অন রমা।”
গ্যালারী তোলপাড় হতে শুরু করল পুলের জলের মতোই। ব্যাক স্ট্রোকের শেষে রমা তখনো প্রায় চার মিটার এগিয়ে। এবার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং হিয়া জানে এইবারই তাকে বড় ব্যবধান তৈরী করতে হবে। এরপরই ফ্রি স্টাইল এবং রমার সঙ্গে এখানে সে পারবে না।
প্রচণ্ডভাবে হিয়ার দুটো হাতের সঙ্গে তাল দিয়ে পা দুটো জলে ধাক্কা দিতে শুরু করল। রমার সঙ্গে পাশাপাশি এসে গেল পুলের মাঝামাঝি এবং এই প্রথম সে রমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। পাশে মুখ ফিরিয়ে হিয়াকে দেখতে দেখতে রমাও জোর বাড়াল।
গ্যালারীতে প্রলাপ চীৎকার শুরু হয়েছে। বাংলার মেয়েরা একসঙ্গে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চীৎকার করে যাচ্ছে ‘হিয়া হিয়া।’ শুধু অমিয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে অনুত্তেজিত বসে কোনির পাশে, মুখে পাতলা একটা হাসি নিয়ে। আপন মনেই সে বলল, “হিয়া জিতবে।”
এবং হিয়া জিতল।
ফ্রি স্টাইল শরে, করেছিল হিয়া চার মিটার এগিয়ে থেকে। সেই ব্যবধান থেকে রমা অর্ধেকটা কেড়ে নিল সাঁতার শেষের তিরিশ মিটার বাকি থাকতেই। এবার শুরু হয় দুজনের মধ্যে বাঁচা-মরার লড়াই। ইনচি-ইনচি করে রমা এগিয়ে আসতে থাকে। ফিনিশিং বোর্ডে টাইম কীপাররা ঘড়ি হাতে ঝুঁকে অপেক্ষা করছে। গ্যালারীতে লোকেরা সরে আসছে ফিনিশ দেখার জন্য।
হিয়ার হাত বোর্ড ছোঁয়ার আধ সেকেণ্ডের মধ্যেই রমার হাত পৌঁছল। “বলেছিলুম।” অমিয়া আবার আপন মনে বলল।
কে জিতেছে জানার জন্য মোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল এবং মেয়েরা যখন হিয়াকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের চোখের জল তার গালে মাখিয়ে দিচ্ছিল, তখন একমাত্র কোনিই দেখতে পেল, অমিয়ার চোখের কোণে জল।
বাংলা এখনো দু’ পয়েন্ট পিছিয়ে। হিয়া ও রমার সোনা তিনটি করে। ধীরেন ঘোষ উত্তেজিত হয়ে রাত্রে খাবার আগে মেয়েদের বলে গেল, “কাল সকালে আর একটা গোল্ড পাচ্ছে হিয়া। বেঙ্গল এগিয়ে যাবে।”
“ধীরেনদা, ভুলে যাবেন না, তারপরও দুটো ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট আছে।”
অমিয়া ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে আনমনে বলল, “রমা যোশি ইন্ডিয়া রেকর্ড হোল্ড করছে।”
রবিবার সকালে অমিয়া পুলে গেল না। মেয়েরা চীৎকার করতে করতে যখন ঘরে ঢুকল, সে তখন একমনে চিঠি লিখছিল। মুখ না তুলেই বলল, “হিয়ার তাহলে চারটে গোল্ড হল।”
“অমিয়াদি, দারণ ব্যাপার, অঞ্জু একটুর জন্য ব্রোঞ্জ মিস করল।”
“অমিয়াদি, যোশিকে বিট করতে পারবে না?”
“অমিয়াদি, সবাই বলছে এখন তোমার ওপরই চ্যামপিয়নশিপ নির্ভর করছে। বাংলা-মহারাষ্ট্র এখন সমান পয়েন্ট।”
কোনির চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে। সে তখন একটা সেফটিপিন দিয়ে সেটাকে ব্যবহারযোগ্য করার চেষ্টায় ব্যস্ত। এইসব উত্তেজনা তাকে স্পর্শ করছে না।
অমিয়া লেখা বন্ধ করে বলল, “চেষ্টা করব।”
জাতীয় সাঁতারের আজ শেষ দিন। সন্ধ্যায় দু’টি মাত্র অনুষ্ঠান। প্রথমটিই মেয়েদের ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ফাইনাল। আটজন প্রতিযোগীর মাঝের লেনগুলিতে রমা, অমিয়া, হিয়া। আজ গ্যালারী উপচে পড়ছে। কোনি খালি পায়ে বসে। সেফটিপিনে চটিটাকে চলার যোগ্য করা যায়নি।
অমিয়া বন্দুকের শব্দের আগেই জলে পড়ল। দ্বিতীয়বার ফলসস্টার্ট নিল মহারাষ্ট্রের সাধনা দেশপাণ্ডে এবং হিয়া। এবপর একসঙ্গেই আটজন জলে পড়ল বন্দকের শব্দে। তিরিশ মিটারে দেখা গেল দুজন এগিয়েছে বাকিদের থেকে রমা ও অমিয়া। তারপরই প্রচণ্ডভাবে নিজেকে বিস্ফোরিত করে অমিয়া পিছনে ফেলল রমাকে। টান নিয়েই সে রমার থেকে এক মিটার এগিয়ে গেছে। রমার কিছুটা পিছনে হিয়া, তার পাশেই সাধনা। হরিচরণ চীৎকার করতে করতে কুঁজো হয়ে পড়েছে।
একটা অস্ফুট কাতরানি শোনা গেল। অমিয়া জলে ভাসছে আর ছটফট করছে পেট চেপে ধরে। মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত।
“ক্রাম্প, ক্র্যাম্প ধরেছে।”
জলে লাফিয়ে পড়ল দুজন। ছুটে গেল বাংলার অফিসিয়ালরা। হরিচরণ কপালে হাত দিয়ে বসল। রমা যোশি তখন ফিনিশিং বোর্ড দু’য়েছে। তার পিছনে হিয়া এবং সাধনা।
মহারাষ্ট্র তিন পয়েন্ট এগিয়েছে। শেষ ইভেন্ট ৪×১০০ মিটার রীলেতে সোনা জিতে ১০ পয়েন্ট আনতে না পারলে বাংলার চ্যামপিয়ন হওয়া সম্ভব নয়। এখন হিয়া ও রমা, দুজনেরই চারটি সোনা। পয়েন্টে দুজনেই সমান হয়ে ব্যক্তিগত যুগ্ম চ্যামপিয়ন হয়েছে। রীলের পয়েন্ট টিম পাবে কিন্তু ব্যক্তিগত সেনা পাওয়ায় কে এগিয়ে যাবে, সেটাও নির্ভর করছে এই ইভেন্টের উপর।
আর আধ ঘন্টার মধ্যেই চ্যামপিয়নশিপের শেষ অনুষ্ঠান মেয়েদের ৪x১০০ রিলে শুরু হবে। ছেলেদের ফ্যাইনাল এইমাত্র শেষ হল।
অমিয়া মেডিক্যাল রুমের টেবলে শুয়ে। ঘরের বাইরে ধীরেন ঘোষ বিষণ্ণকণ্ঠে বলল, “এত কাছে এসে ভরাডুবি হল। বাংলা তাহলে চ্যামপিয়নশিপটা পেল না। ভাগ্য, ভাগ্য!”
হরিচরণ থমথমে মুখে বলল, “অমিয়া তো নামতে পারবে না, তাহলে রীলে টিমটা কি হবে? আর কমিনিট মাত্র সময় রয়েছে। হিয়া, পুষ্পিতা, বেলা…ফোর্থ মেয়ে কে হবে?”
“রিজার্ভে আছে অঞ্জু আর–” ধীরেন ঘোষ থেমে গেল। হরিচরণ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে।
প্রণবেন্দু এবং আরো তিন-চারজন ব্যস্ত উত্তেজিত হয়ে হাজির হল। “একি, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে! রীলে টিমের কি হবে, আর যে সময় নেই।” প্রণবেন্দু বলল।
“সেইটেই তো ভাবছি।”
“ভাবাভাবির কিছু নেই, কনকচাঁপা পালকে নামান, অমিয়ার জায়গায়।” একজন রুক্ষস্বরে বলল।
“কিন্তু—”
“কিতু-ফিন্তু কিছু নেই ধীরেনদা। বেঙ্গলের এখনো একটা আউটসাইড চান্স আছে ওকে নামালে। অঞ্জু একদমই পারবে না।”
“আপনারা বসে বসে ভাবুন তাহলে, আমরাই ব্যবস্থা করছি।”
প্রণবেন্দু প্রায় ছুটেই চলে গেল। ধীরেন ঘোষ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে তারপর আচমকা ঘুম ভাঙ্গা মানুষের মতো অনুসরণ করল প্রণবেন্দুকে। হরিচরণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
কোনি যথারীতি গ্যালারীতে বসে। বাংলার মেয়েরা শুকনো মুখে অনিশ্চিত স্বরে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। পুরুষদের মেডলি রীলে ফাইনাল এবার শুরু হবে। প্রতিযোগীরা স্টার্টিং প্ল্যাটফমে আসছে।
“কোনি, কোনি!”
হাত নেড়ে প্রণবেন্দু এবং আরো কয়েকজন ডাকছে। কোনি বুঝতে পারল, তাকেই ওরা ডাকল কিনা।
“কোনি, তাড়াতাড়ি, কুইক।”
অবাক হয়ে কোনি তখনো বসে। ধীরেন ঘোষ হাত নাড়ছে তার দিকে। “কোনি, আর সময় নেই, তোমায় নামতে হবে রীলেতে অমিয়াদির জায়গায়।” হিয়া গ্যালারীতে উঠে এসে ওর হাত ধরল।
শিরশির করে উঠল কোনির শরীর।
“আমি!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি। কস্ট্যুম পরে নাও।”
“না, আমি নামব না।” কোনি হাত সরিয়ে নিল।
“বেঙ্গল চ্যামপিয়ন হতে পারবে না।”
“না পারুক, আমি নামব না।”
“তুমি বেঙ্গলকে ভালবাস না?”
“না, বাসি না।” কোনি মখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। বুকের থেকে উঠে আসা একদলা অভিমান ওর কণ্ঠে আটকে গেল। “ভালবাসতে হয় তুমি বাসো। আমি গরীব, আমাকে দেখতে খারাপ, লেখাপড়া জানি না, কত কথা শুনলাম। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। জোচ্চুরি করে আমাকে বসিয়ে রেখে এখন ঠেকায় পড়ে এসেছ আমার কাছে—”
হিয়া ঝুঁকে কোনির দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দাঁত চেপে চাপাস্বরে বলল, “আমি নিজের জন্য আসিনি। বেঙ্গলের হয়েই তোমাকে ডাকতে এসেছি।”
“না। এসছ নিজের জন্য। তুমি নিজের জন্য আর একটা গোল্ড চাও, রমা যোশিকে-” কোনি থেমে গেল।
চড় মারার জন্য হিয়ার হাতটা উঠেছে। কেনিও হাত তুলেছে। ছোরার মতো চারটে চোখের প্রচণ্ড সংঘর্ষে স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ল। ধীরস্বরে হিয়া বলল, “কোনি তুমি আনস্পোররটি।”
“কি বললে?” ছিলে-ছেঁড়া ধনকের মতো কোনি উঠে দাঁড়াল। “আমি কস্ট্যুম আনিনি।”
“আমার একস্ট্রা আছে।”
.
অ্যামপ্লিফায়ারে ঘোষণা হচ্ছে, এবার শেষ অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। মেয়েদের টিম চ্যামপিয়নশিপ নির্ধারিত হবে এই রীলে সাঁতারেই। একে একে টিমের নাম পড়া হচ্ছে। পলের প্রধান ফটকে এই সময় একটা হৈ চৈ উঠল। একটা পাগলা লোক তীরের মতো দৌড়ে পুলিস ও ভলান্টিয়ারদের ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তাকে তাড়া করেছে দু-তিনজন। প্রতিযোগীরা জলে নেমে শরীর ভিজিয়ে উঠে এসেছে। এখন তোয়ালেতে গা মোছায় ব্যস্ত। হিয়ার হাত থেকে তোয়ালেটা টেনে নিল কোনি।
“অন দা বোর্ড।” স্টার্টারের গলা শোনা যেতেই সারা পলে ঝপ করে স্তব্ধতা নেমে এল। ব্লকের উপর উঠেছে মহারাষ্ট্রের সাধনা, পাঞ্জাবের মঞ্জিত, বাংলার হিয়া, এবং আরো দুটি মেয়ে। পাঁচটির বেশি টিম হয়নি।
“গেট সেট…”
নিখুঁতভাবে জলে পড়ল হিয়া ও সাধনা। পুলের গ্যালারীতে মর্মরধ্বনি ক্রমশ ধাপে ধাপে উঠতে শুরু করল যখন হিয়া আগাগোড়া সাধনাকে পিছনে রেখে পুষ্পিতাকে তিন মিটার আগোন থাকার সুবিধা দিল।
কিন্তু পুষ্পিতা এই সুবিধাটা ৫০ মিটারের বেশি ধরে রাখতে পারল না। মহারাষ্ট্রের লিণ্ডা ডিসুজা তাকে অবহেলায় দুই লেংথে পিছনে ফেলল। ব্লকের উপর দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠিত বেলা দেখল তার পাশের লেনে ঝাঁপিয়ে পড়ল মহারাষ্ট্র।
ব্লকের পিছনে দাঁড়ানো হিয়া ফিসফিসিয়ে বলল, “বেলাদি অল আউট… বেলাদি লড়ে যাও।”
বেলা লড়ে গেল। সাধ্যের থেকেও নিজেকে বাড়িয়ে বেলা সাঁতার দিল। যে কোনো দিন, যেকোনো সময় দীপ্তি কারমারকার অন্তত চার লেংথে বেলাকে পিছনে ফেলবে। কিন্তু আজ বেলারই দিন। দীপ্তি দু’ লেংথের ব্যবধানটা এক ইঞ্চিও বাড়াতে পারল না। বেলা যে এই ফারাকটা বজায় রাখতে পারবে, বাংলার কেউ আশা করেনি।
হিয়া হাতটা চেপে ধরেছে কোনির। একটা মোটর এঞ্জিন স্টার্ট নেবার চেষ্টায় থরথর করে উঠেই আবার থেমে যাচ্ছে। এমনভাবে কোনির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একদৃষ্টে সে জলে বেলার দিকে তাকিয়ে। স্টাটিং ব্লকে ওঠার জন্য সে যখন পা তুলতে যাবে তখন–
“কো ও ও ও নিইইই!”
পা-টা নেমে এল।
“কো ও ও নিইইই!”
তিন দিকের গালারি সাঁতার থেকে একবার চোখ ফেরাল। পুলের পাশে দু-তিনটি ভলান্টিয়ারের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে ময়লা পাঞ্জাবি, মাথায় কাঁচাপাকা চল, পরে লেন্সের চশমা পরা একটি লোক।
“ফাইট, কোনি ফাইট।
বকসিংয়ের ভঙ্গিতে দুটো হাত চালাচ্ছে, “ফাইট, কোওওনিই।”
একটা আট সিলিণ্ডার এঞ্জিনে হঠাৎ যেন স্পার্ক প্লাগ থেকে বিক্ষোরণের বার্তা পৌঁছেছে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ধক ধক করে উঠল কোনি। চমকে হাতটা টেনে নিল হিয়া।
‘ক্ষিদ্দা?” হিয়া ঠেলে দিয়ে বলল, “কোনি ওঠো, কুইক।”
ব্লকে উঠতে উঠতে কোনি বলল, “ক্ষিদ্দা এসেছে।”
রমা যোশি জলে পড়ল। তিন সেকেন্ড পর কোনি।
পুলে যদি জলের বদলে মাটি থাকত তাহলে বলা যেত একটা কালো প্যান্থার শিকার তাড়া করেছে। কোনির শিকার টাইম-কীপারদের হাতের ঘড়ি।
তিরিশ মিটার পর থেকেই দর্শকরা বুঝতে পারল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তারা নিশ্বাস ফেলার সময়টুকু দিতেও ভুলে গেল। গলায় স্বর নেই। পলক পড়ছে না। গ্যালারির বহু লোক নেমে এসে পুলের ধারে দাঁড়িয়েছে। ভলান্টিয়াররাও।
জলকণায় তৈরী একটা আচ্ছাদনের ঘেরাটোপের মধ্যে কোনি যেন অশরীরী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। টানিংয়ের পরই দেখা গেল সে রমা যোশির পাশে। বিপদ এসে গেছে, এটা বুঝতে পেরেছে যোশি। জোর দিল সে। কোনি তবুও পাশে। আরো চল্লিশ মিটার পাশাপাশি রইল ওরা।
এরপরই অবরুদ্ধ উত্তেজনা ফেটে পড়ল পুলের চারধারে। কোনি প্রায় এক হাত এগিয়ে এসেছে। আর দশ মিটার বাকি। রমা বুকে বাতাস ভরে জলের উপর যেন লাফিয়ে উঠল হাতের প্রচণ্ড টানে।
চারিদিকে অন্ধকার, কোন কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর একটা যন্ত্রণা তার শরীরকে কামড়ে ধরেছে। সেটা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে বারবার নিজেকে ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার থেকে বেরোবার জন্য দাপাদাপি করছে তার শরীর। একটা শেষ চেষ্টা তাকে মরিয়া করে তুলল।
“কো ও ও নি ই ই!”
দীর্ঘ সুরেলা ধ্বনি জলের উপর দিয়ে ভেসে কোনির শরীরে মৃদু মৃদু আঘাত দিল। শিশু যেমন হাত বাড়িয়ে, দীর্ঘ অদর্শনের পর, মাকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেইভাবে তার হাত সে বাড়াল এবং বোর্ড স্পর্শ করল। রমা যোশীর আগেই।
.
হিয়া আর বেলার হাত ধরে কোনি জল থেকে উঠেই টলে পড়ছিল, ধীরেন ঘোষ জড়িয়ে ধরল। ছটে আসছে বাংলার মেয়েরা। রমা যোশির ক্লান্ত হাত কোনির পিঠে চাপড়ে দিয়ে গেল। কোনি চোখ বন্ধ করে হাফাচ্ছে। ওকে ঘিরে একটা ভীড় বৃত্ত রচনা করেছে। অভিনন্দন আর আদরে সে ডুবে যাচ্ছে।
এরপর ভিকট্রি স্ট্যাণ্ডে। একে একে গলায় মেডেল পরা, ব্যাণ্ড বাজনা। গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে কোনি পলের ধার দিয়ে ফিরতে ফিরতে থমকে দাঁড়াল। ক্ষিতীশ পিটপিট করে তাকিয়ে। মুখে দশ-বারো দিনের দাড়ি। শরীরটা আরো শীর্ণ হয়ে গেছে।
“কোথায় ছিলে?”
“বল তো কোথায় ছিলুম!”
কোনির ঠোঁট দুটি থরথর করে উঠল। জলে ভরে আসছে দু’চোখ। মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।
“মুখ্যুরা তোর টাইমটা রাখেনি, রাখলে দেখতে পেত…কি পেত বল তো?”
কথাগুলোকে অগ্রাহ্য করে রেগে উঠল। “কোথায় লুকিয়ে ছিলে তুমি? খালি বল তো আর বল তো!”
“কোথায় ছিলুম জানি, ওইখানে।” কুজো হয়ে ক্ষিতীশ ডানহাতের তর্জনীটা তুলে পুলের জলের দিকে দেখাল। “ওই জলের নিচে লুকিয়ে ছিলাম আর বলছিলুম–সব পারে, মানুষ সব পারে…ফাইট কোনি, ফাইট।”
“মিথ্যুক, মিথ্যুক।” কেনি ছুটে এসে ক্ষিতীশের বুকে দমদমে ঘুসি মারতে শুরু করল। “কিচ্ছু দেখিনি, কিচ্ছু শুনিনি। যন্ত্রণায় তখন আমি মরে যাচ্ছিলাম।”
“এইটেই তো আমি রে, যন্ত্রণাটাই তো আমি।”
বলতে বলতে ক্ষিতীশ হা হা শব্দে দরাজ গলায় হেসে উঠল। তখন অনেকেই তাদের দিকে তাকাল এবং দেখল পাগলাটে একটা লোকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ফোঁপাচ্ছে যে মেয়েটি এইমাত্র আশ্চর্য সাঁতার দিল, আর তার মাথায় টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে।