কৈশোর
ছোটপাহাড়ীতে বিকেলের দিকে একটাই মাত্র বাস যায়। মুমুকে চন্দনদার কাছে পৌঁছে দিয়ে আজ আর আমার ফেরার আশা নেই।
ফাঁকা বাসটা দাঁড়িয়ে আছে, ছাড়বে এক ঘণ্টা বাদে। সামনের দিকে দুটো সিট ভালো দেখে বেছে নিলুম। তারপর আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়ে মুমুকে জিজ্ঞেস করলুম, নীপা বৌদি হঠাৎ তোকে একা একা চন্দনদার কাছে পাঠাল কেন? বাড়িতে কোনো বিপদ-টিপদ হয়েছে নাকি?
মুমু বলল, কিছু হয়নি। আমি এমনিই বাপির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। আমার স্কুল ছুটি।
আমি বললুম, হুঁ, ব্রেইভ গার্ল! এগারো বছর বয়েসে আমাদের বাবা-মায়েরা একলা ছাড়ত না। কিন্তু টিকিটটা হারিয়ে ফেললি কী করে? সত্যি টিকিট কেটেছিলি তো?
মুমু বলল, আমি তোমার মতন বিনা টিকিটে কোথাও যাই না!
‘তোমার মতন’ বলার মধ্যে একটা খোঁচা আছে ঠিকই। বছরখানেক আগে আমি চন্দনদার বাড়িতে এক বর্ষার সন্ধ্যায় মুড়ি-আলুর চপ খেতে খেতে আমার বিনা টিকিটে আগ্রা যাওয়া, টিকিট চেকারকে দেখে বাথরুমে ঢুকে পড়ার রোমহর্ষক গল্প শুনিয়েছিলুম। তার যে অনেকটাই বানানো, তা চন্দনদাও বুঝেছিলেন, বুঝেও খুব হাসছিলেন। আর এই মুমু তখন আরও এক বছরের ছোট, আমার দিকে কঠোর ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে বলেছিল, তুমি বিনা টিকিটে ট্রেনে চেপেছ, হোয়াট আ শেইম! তুমি একটা ক্রিমিন্যাল।
আমি বললুম, আরে আমরা ছেলেরা যা পারি, মেয়েরা কি তা পারে কখনো? তুই টিকিট কেটেও হারিয়ে ফেললি?
মুমু বলল, আমি টিকিটটা সবসময় হাতে রেখেছিলুম, একবার বাদাম খেতে গিয়ে শুধু সেটা জানলার ওপর রেখেছি!
—খোলা জানলায় কেউ টিকিট রাখে? কী মেয়ের বুদ্ধি!
—মোটেই খোলা জানলায় রাখিনি। কাচ বন্ধ ছিল। একটা বোকা লোক ঠিক সেই সময় কাচটা তুলে দিল। সব ঐ লোকটার দোষ!
—টিকিট যার হারায় তারই দোষ হয়। এই মুমু, তখন তুই ওদের সামনে বললি কেন যে আমায় তুই একটু একটু চিনিস?
–তোমাকে বেশি চিনতে আমার বয়ে গেছে! তুমি কি আমার বন্ধু? তুমি আমার বাবারও বন্ধু না, বাবার থেকে তুমি অনেক ছোট। আমার থেকে অনেক বড়। তা হলে তুমি কার বন্ধু?
—ছোট হলে বুঝি বন্ধু হওয়া যায় না! আমি ঠিক সময় তোকে দেখতে পেয়ে গেছলুম বলেই তো তুই বেঁচে গেলি!
—আহা-হা, তোমায় কে যেতে বলেছিল? আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ!
—আহা-হা-হা, টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ? ঐ টিকিট চেকারটা ঠিক তোকে জেলে ভরে দিত! ওদের জেলের মধ্যে কত আরশোলা থাকে জানিস?
—আমি আরশোলাকে মোটেই ভয় পাই না। মা ভয় পায়। আমার শুধু মাকড়সা দেখলে ঘেন্না করে।
—ওদের জেলখানা ভর্তি মাকড়সার জাল। এই অ্যাত্ত বড় বড় মাকড়সা! বেশ হতো, জেলখানায় শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ কান্নাকাটি করতি—
–এই ব্লুকাকা, আমার তেষ্টা পেয়েছে। আমাকে একটা কোল্ড ড্রিংকস খাওয়াও!
ইস, কী হুকুমের সুরে কথা! মুমুর কাছে আর মাত্র দশ টাকা আছে, ও আমাকে দেখিয়েছে। ছোটপাহাড়ী পর্যন্ত বাস ভাড়া সাড়ে চার টাকা। সেইজন্যই ও টিকিট চেকারকে পাঁচ টাকা দিতে চেয়েছিল। নীপাবৌদি এত টায় টায় হিসেব করে টাকা দিয়ে মেয়েকে পাঠিয়েছে? অথচ চন্দনদা আর নীপাবৌদি দু’জনেই চাকরি করে, ওদের এই একটি মাত্র মেয়ে।
বাস থেকে নামতে হলো। কাছে একটা দোকান আছে। মুমু জানলা দিয়ে বলল, পাইন অ্যাপেল আনবে। কিংবা ম্যাঙ্গো। আমি অরেঞ্জ খাই না। আর খুব ঠাণ্ডা।
দোকানটাতে শুধু অরেঞ্জই আছে। আমি মুমুকে দূর থেকে সেই বোতলটা দেখালুম, ও হাত নাড়ল। সুতরাং কাছে এসে আমাকে বলতেই হলো, আর কিছু নেই, তেষ্টা পেয়েছে যখন, অরেঞ্জই খেয়ে নে এখন।
মুমু ঠোট উল্টে বলল, অরেঞ্জ আমার বিচ্ছিরি লাগে। না খাব না! আমি ধমক দিয়ে বললুম, এ কি পার্ক স্ট্রিট পেয়েছিস নাকি? এই যা পাওয়া যাচ্ছে তাই যথেষ্ট! খাবি তো বল!
মুমু বলল, তা হলে সঙ্গে এক প্যাকেট পটেটো চিপ্স নিয়ে এসো!
দোকানটায় ফিরে গেলুম আবার। ওদের কাছে পটেটো চিপ্সও নেই, আছে কিছু বিস্কুট, কিছু খোলা চানাচুর, আর কিছু লজেঞ্চুশ, যার রং দেখলেই বোঝা যায় ভেজাল। চানাচুরগুলোও বিশ্বাসযোগ্য নয়, আমি খেতে পারি অনায়াসে কিন্তু ইংরিজি ইস্কুলে পড়া ছেলেমেয়েরা একেবারে ঝাল মুখে দিতে পারে না। ইংরিজির সঙ্গে ঝালের একটা বিরাট বিরোধিতা আছে।
কিছু বিস্কুটই কিনে নিলুম।
অরেঞ্জের বোতলটায় মাত্র একটা চুমুক দিয়েই মুখ ভিরকুট্টি করে মুমু বলল, এঃ, একটুও ঠাণ্ডা নয়, একদম বাজে! খাব না, ফেলে দাও!
জিনিস নষ্ট করতে এদের একেবারে গায়ে লাগে না। পয়সার যেন কোনো মূল্যই নেই। আমি এইসব বোতলের স্যাকারিন দেওয়া সরবত একদম খাই না। তবু পয়সা নষ্ট হবে বলে মুমুর হাত থেকে বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোকে শেষ করে ফেললুম।
বিস্কুটের ঠোঙাটা এগিয়ে দিয়ে বললুম, খিদে পেয়েছে তো? দুপুরে ট্রেনে খাবার দেয়নি? এই বিস্কুটগুলো খেয়ে নে।
—আমি বিস্কুট খাই না। তোমাকে পটেটো চিপ্স আনতে বললুম না? তখন আমার মনে হলো, এই বারুদ-ঠাসা বিচ্ছুটার সঙ্গে আমার ছোটপাহাড়ীতে যাবার দরকারটা কী? ও ট্রেনে একা এতদূর আসতে পেরেছে, এখন বাসে তুলে দেওয়া হলে অনায়াসেই ছোটপাহাড়ীতে পৌঁছে যাবে।
কিন্তু তা হলে আমি যে মুমুকে জেলে যাওয়া থেকে এত কায়দা করে বাঁচালুম, সেই রোমহর্ষক গল্পটা চন্দনদাকে বলা হবে না। মুমু তো চেপে যাবে নিশ্চয়ই। আমার টিকিটটাই বা কেন আমি দিতে গেলুম ঐ চেকারটার হাতে? বেশি স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে ঐটা আমার বোকামি হয়ে গেছে। কলকাতার ট্রেন এখনো আসেনি, ঐ টিকিটটা ব্যবহার করা যেত।
যেন আমার এইসব চিন্তার প্রতিধ্বনি করেই মুমু বলল, এই ব্লুকাকা, তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছ কেন? আমি বুঝি একা যেতে পারি না? তোমাকে যেতে হবে না।
সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার মত বদলে ফেললুম। তা হলে যেতেই হবে ছোটপাহাড়ী। চন্দনদাকে সব বলে মুমুকে একটু বকুনি খাওয়াতেই হবে। এই বয়েসের একটা মেয়েকে এত আদর আর লাই দিয়ে মাথায় তোলা ঠিক না। কী অকৃতজ্ঞ, আমি ওকে বিপদ থেকে রক্ষা করলুম, এখন বলে কি না, তোমাকে যেতে হবে না আমার সঙ্গে?
বাসে উঠে এসে বললুম, ছোটপাহাড়ী যাবার পথে একটা জঙ্গল পড়ে। সেখানে মাঝে মাঝেই ডাকাতরা এসে বাস আটকায়। সেইরকম হলে তুই কী করবি?
ডাকাত এলে তুমি তাদের সঙ্গে মারামারি করবে? এই বলে মুমুর কী হাসি! যেন দৃশ্যটা কল্পনা করেই সে হাসি থামাতে পারছে না।
আমি বললুম, ডাকাত না এলেও, যদি বাসটা মাঝপথে খারাপ হয়ে যায়, তা হলেও আর কোনো উপায় থাকবে না। সারা রাত ঐ জঙ্গলে কাটাতে হবে।
মুমু হাসি থামিয়ে বলল, বাসে তো আরও অনেক লোক থাকবে!
—নাও থাকতে পারে। অনেক সময় ড্রাইভার-কণ্ডাক্টরদের সঙ্গে ডাকাতদের ষড়যন্ত্র থাকে। তোর মতন বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ডাকাতরা ধরে রাখে, তারপর বাবা-মায়েদের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা চাইবে। তুই নিজে তো বিপদে পড়বিই, তোর বাবা-মাকেও বিপদে ফেলবি!
-ষড়যন্ত্র কী?
–তোদের ইস্কুলে বুঝি একদম বাংলা শেখায় না? ষড়যন্ত্র হচ্ছে কন্সপিরেসি। কিংবা এখানে আণ্ডারস্ট্যান্ডিং-ও হতে পারে। কিংবা বলতে পারিস জয়েন্ট ভেনচার, টাকাটা ওরা শেয়ার করে নেবে।
ইংরিজি ইস্কুলে পড়া মেয়ের কাছে আমি ইংরিজি বিদ্যা ফলাবার চেষ্টা করলুম বটে কিন্তু ও তা শুনল না। হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল! খানিক বাদে বাস ছাড়ল। যাত্রীর সংখ্যা বেশ কম, অর্ধেক সিটও ভর্তি হলো না। আদিবাসীদের সংখ্যাই যাত্রীদের মধ্যে বেশি। কয়েকজন লোক বেশ বড় বড় লাঠি হাতে নিয়ে উঠেছে, দেখলে একটু গা ছমছম করে।
চন্দনদা কী যেন একটা লোহা-ইস্পাতের কোম্পানিতে বড় কাজ করেন। ছোটপাহাড়ীতে লোহার পিণ্ডের খনি আবিষ্কার হয়েছে, এ কথা কাগজে পড়েছিলুম বটে। সুতরাং চন্দনদা এখানে কোনো কাজে আসতেই পারেন। কিন্তু একেবারে ট্রান্সফার নিয়ে তাঁর মতন একজন অফিসার এখানে এসে আস্তানা গাড়বেন, তা হলে ছোটপাহাড়ীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার আছে মনে হচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুই যে আজ আসছিস, বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিস? তোকে বাসস্টপে নিতে আসবেন?
মুমু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।
–তোর স্কুলে এখন কিসের ছুটি রে? সামার ভ্যাকেশান শেষ হয়ে যায়নি?
—না।
—মাকেও সঙ্গে নিয়ে এলি না কেন? বেড়াবার পক্ষে বেশ ভালো জায়গা। ছোটপাহাড়ীতে সুন্দর একটা লেক আছে, পাহাড়ে একটা অনেককালের পুরোনো গুহা আছে, তার মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে গেলে একটা শিবঠাকুরের মুখ দেখতে পাওয়া যায়। পাথরের মধ্যে আপনি সেই মুখটা ফুটে উঠেছে। তুই তো এসব দেখবি না জানি, শুধু মিল্স অ্যান বুনের বাজে বাজে বই পড়বি, কিন্তু নীপা বৌদির এসব ভালো লাগত।
—মা’র অফিস আছে।
আমার সব কথার উত্তরেই মুমুর কাটা কাটা জবাব। আমার সঙ্গে গল্প করার কোনো আগ্রহই নেই তার।
রাস্তায় যেতে যেতে সত্যি একটা জঙ্গল পড়ল। এর মধ্যে সন্ধে হয়ে এসেছে। কিন্তু সেখানে বাসও খারাপ হলো না, ডাকাতও এলো না। কোনো ঘটনাই ঘটল না। মুমু আমার দিকে কয়েকবার বিদ্রূপের দৃষ্টিতে তাকাল।
তারপর বাসটা উঠতে লাগল পাহাড়ের ঘাট রাস্তায়। প্রায় আর সব যাত্রীই নেমে গেছে, আমরা ছাড়া আর দু’-তিনজন মাত্র রয়েছি। আজ সন্ধে হতে না হতেই উঠেছে একখানা বেশ গোল চকচকে চাঁদ। মেঘের গায়ে নদীর জলের মতন ছিটকে ছিটকে পড়েছে জ্যোৎস্না, জঙ্গলের মাথায় সেই জ্যোৎস্না ঝরনার মতন গলে গলে পড়ছে।
মুমু সেসব দেখছে না, দশ-এগারো বছর বয়েসে কি এসব দেখার চোখ জন্মায় না? সে সোজা তাকিয়ে কী যেন ভাবছে!
বাসটা ছোটপাহাড়ীতে এসে থামল। এখানেই এর যাত্রা শেষ। কাল ভোরে এই বাসটাই ফিরে যাবে।
সেখানে চন্দনদাকে দেখা গেল না!
তবে কি চন্দনদা তাঁর মেয়ের চিঠি পাননি? এখানে চিঠি আসতে কত দিন লাগে কে জানে? তা ছাড়া মুমুর ট্রেন লেট করেছে, ওর পৌঁছে যাবার কথা ছিল দুপুরে।
ছোটপাহাড়ীতে আগে ছিল শুধু আদিবাসীদের একটা ছোট্ট গ্রাম। এখন লোহার খনি আবিষ্কার হওয়ার ফলে দু’-একটা কোম্পানির কিছু কিছু কোয়ার্টার তৈরি হয়েছে সবে। একটা-দুটো মাত্র দোকান।
সন্ধেবেলা কোনো অফিস খোলা থাকে না, কিন্তু চন্দনদার অফিসে গিয়ে একজন কেয়ারটেকারকে পাওয়া গেল। চন্দনদা সেখানেও নেই। কেয়ারটেকারটিকে বললুম চন্দনদার কোয়ার্টারটা দেখিয়ে দিতে।
সে এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এল। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, লেকিন ঘোষালসাব তো এখানে নেই! কাজে বাইরে চলে গেছেন।
আমি চমকে উঠে বললুম, সেকি? কোথায় গেছেন?
লোকটি বলল, বোম্বাই না কলকাত্তা ঠিক মালুম নেই। তিন দিন আগে চলে গেছেন!
আমি বললুম, এই রে, মুমু, তোর বাবা তোর চিঠি পাননি! তুই কী রে, এইরকম ভাবে আসতে হয়? চন্দনদা তোর চিঠি পেয়ে কনফার্ম করেনি। তোর মা-ও তোকে ছেড়ে দিল এই ভাবে?
মুমু বোধহয় এবারে একটু ঘাবড়ে গেছে, সে কোনো কথা বলল না।
চন্দনদার কোয়ার্টার বেশ কাছেই, একেবারে ঝকঝকে নতুন বাড়ি, দেয়ালের রঙের গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যায়। সামনে একটু বাগান, তাতে অবশ্য গাছগুলো নেতিয়ে আছে। এখানে বৃষ্টি নামেনি এখনও।
কোয়ার্টারের দরজায় বিশাল তালা ঝুলছে।
তাহলে সত্যিই চন্দনদা এখানে নেই। কিন্তু চন্দনদা একা থাকেন, তাঁর কোয়ার্টার দেখাশুনো করবার নিশ্চয়ই কোনো লোক থাকবে? কাছাকাছি কারুকে দেখা যাচ্ছে না।
কেয়ারটেকারটি হাঁকাহাঁকি করে শেষ পর্যন্ত একজনকে খুঁজে আনল। তার নাম শিবলাল। সে আবার বড্ড একগুঁয়ে ধরনের মানুষ।
সে বলল, বাবু তো বাইরে গেছে। কেউ আসবে বলে যায়নি!
আমি জিজ্ঞেস করলুম, কবে ফিরবেন তা কিছু বলে গেছেন?
সে বলল, তিন দিন আগে গেছেন, কবে ফিরবেন জানি না!
আমি বললুম, তিন দিন আগে? তাহলে নিশ্চয় কলকাতায় যাননি। ঠিক আছে, তুমি ঘর খুলে দাও। রাত্তিরে খাবার-দাবার কিছু পাওয়া যাবে?
শিবলাল চুপ করে রইল।
কেয়ারটেকারটি বলল, খাবার তো পাবেন না। এখানে হোটেল-টোটেল কিছু নেই। বাড়িতে সবাই রান্না করে খায়।
শিবলালকে বললুম, ঠিক আছে, আগে ঘরটা তো খুলে দাও, জামা-প্যান্ট বদলাই। সারাদিন একেবারে ঘেমে নেয়ে গেছি! তোমাদের এখানেও খুব গরম দেখছি। একটুও হাওয়া নেই।
শিবলাল গোমড়া মুখে বলল, বাবু কিছু বলে যাননি আমাকে।
আমি বললুম, আমরা হঠাৎ এসে পড়েছি। এ হল বাবুর মেয়ে। আর আমি…আমি হচ্ছি বাবুর ভাই! ছোট ভাই!
শিবলাল এবার বলল, আমার কাছে চাবি নেই।
–চন্দনদা চাবি নিয়ে বোম্বাই চলে গেছে?
–বোম্বাই যায়নি, কলকাতায় গেছে।
—তিনদিন আগে কলকাতায় গেছে? তা কী করে হয়? তাহলে ওঁর মেয়ের সঙ্গে দেখাই হয়ে যেত।
—বাবু কলকাতায় গেছে, আমাকে বলে গেছে।
-তুমি ভুল শুনেছ, শিবলাল। কলকাতায় গেলে আগে নিজের বাড়িতে উঠবেন না? হয়তো জামসেদপুর যেতে পারেন। যাকগে, তুমি ঘর খোলার একটা ব্যবস্থা করো। রাত্রে আমরা থাকব কোথায়?
শিবলাল আবার একই সুরে বলল, বাবু আমাকে অন্য লোক আসার কথা কিছু বলেননি। আমার কাছে চাবি নেই।
ওর কাছে চাবি না থাকার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। এত বড় একটা তালার চাবিও নিশ্চয়ই বেশ বড় হবে। চন্দনদা সেই চাবি পকেটে নিয়ে ঘুরবেন কেন? চন্দনদা খোলামেলা প্রকৃতির মানুষ।
তা হলে কি এই লোকটা আমাদের সন্দেহ করছে?
আমি বললুম, আরে, আমাদের রাত্তিরে থাকতে হবে তো, ফেরার বাস নেই। তোমার বাড়িতে খুঁজে দেখো চাবি পাও কি না!
শিবলাল বলল, চাবি নেই!
আচ্ছা মুশকিল তো! লোকটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, আলবাৎ ওর কাছে চাবি আছে, কিন্তু ও খুলবে না!
ও না হয় আমাকে জোচ্চোর মনে করতে পারে। সে স্বাধীনতা ওর আছে। কিন্তু কোনো জোচ্চোর কি একটা এগারো বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে? তাছাড়া এই ছোটপাহাড়ীর মতন নগণ্য জায়গায় এতটা বাসরাস্তা ঠেঙিয়ে কোন জোচ্চোর আসতে যাবে? তাদের কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই?
মুমু একটু দূরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এই সব কথাবার্তা সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই তার।
কেয়ারটেকারটি আমাদের পক্ষ নিয়ে বলল, আরে এই বাবুরা রাত্তিরে যাবেন কোথায়? সঙ্গে একটা বাচ্চা লেড়কী আছে। দ্যাখ না, তোর কাছে চাবি আছে কি না!
শিবলাল মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, তোমার কাছে তো অনেক চাবি থাকে, তুমি ইচ্ছে হলে খুলে দাও!
কেয়ারটেকারটি বলল, আমার কাছে বাবুদের কোয়ার্টারের চাবি থাকবে কেন?
শিবলাল বলল, তবে তুমি ফড়ফড়াচ্ছো কেন, তুমি চুপ মেরে থাকো!
বোঝা গেল, এই কেয়ারটেকারের সঙ্গে শিবলালের তেমন একটা বন্ধুত্ব নেই। কেয়ারটেকারটি তুলনামূলকভাবে ভালো চাকরি করলেও শিবলালের ব্যক্তিত্ব বেশি। শিবলাল ভাঙবে তবু মচকাবে না।
তা হলে উপায়? তালা ভেঙে তো আর চন্দনদার ঘরে ঢোকা যাবে না!
আমাদের এই অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রেখে শিবলাল পেছন ফিরল!
কেয়ারটেকারটি বলল, শালা!
মুমুকে একলা ছোটপাহাড়ী বাসে তুলে দিলে সে এখন কী করত? তখনই আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিক বলে দিয়েছিল, নীললোহিত, সঙ্গে যাও! ছোটপাহাড়ী তোমায় ডাকছে।
আমি কেয়ারটেকারটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলুম, এখানে হোটেল নেই তা বুঝলুম, কিন্তু কোম্পানি কোনো গেস্ট হাউস বানায়নি?
কেয়ারটেকারটি বলল, বানাচ্ছে। এখনো পুরা হয়নি।
—পুরা হয়নি, আধা হয়েছে?
–একখানা ঘর মোটে হয়েছে।
–ঠিক আছে, ঐ একটা ঘরই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। একটু ব্যবস্থা করে দাও ভাই।
—সে ঘর এখনও সাফ হয়নি। খাট-বিছানা কিছু নেই। সেখানে থাকবেন কী করে আপনারা?
-সাফ-সুফ করে নেব। মাটিতে শোব।
—গেস্ট হাউস এখনো চালু হয়নি। কোম্পানির অর্ডার ছাড়া কী করে আমি দেব বলুন।
পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করলুম। এটাই তো কোম্পানির অর্ডার। এই তো সব জায়গায় ঢোকার গেট পাস। ন্যায়ের প্রতীক অশোক স্তম্ভের ছাপ মারা কাগজ থাকলে যে-কোনো অন্যায়, যে-কোনো বে-আইনী কাজ করা যায় এদেশে।
টাকাটা কেয়ারটেকারের মুঠোয় ভরে দিয়ে বললুম, একটা রাত্তিরের ব্যাপার তো, কোম্পানি এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না!
এবার সে মুমুর আর আমার ব্যাগ দুটো তুলে নিয়ে বলল, আসুন!
মিনিট পনেরো হাঁটার পর পৌঁছলাম একটা টিলার প্রান্তে। বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়েই গেস্ট হাউস তৈরি করা শুরু হয়েছে, চতুর্দিকে ইট-পাটকেল-বালির স্তূপ। একতলার ভিত হয়ে গেছে সবটাই। তার একপাশে শুধু একটি ঘর। বোঝাই যাচ্ছে যে প্রথমে কাজ চালাবার জন্য একটি ঘর রেডি করা হচ্ছে।
কেয়ারটেকার যতটা খারাপ বলেছিল, ঘরটার ভেতরের চেহারা কিন্তু ততটা হতাশাব্যঞ্জক নয়।
মোটামুটি পরিষ্কার আছে, কোনো ফার্নিচার নেই বটে, কিন্তু পাশেই রয়েছে একটি সুন্দর বাথরুম। এতখানি মোটেই আশা করিনি। একখানা শতরঞ্চি পেলে তো সোনায় সোহাগা!
কেয়ারটেকারটি বলল যে সে একটা শতরঞ্চি এনে দিতে পারবে। আমিও তাকে জানালুম যে কাল সকালে তাকে আমি খুশি করে দেব। এবং চন্দনদা ফিরে এলে শিবলাল বরখাস্ত হবে, যাদবলালের প্রমোশন হবে!
হ্যাঁ, কেয়ারটেকারটির নাম যাদবলাল এবং সে আমাদের পরিত্রাতার ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে।
রাত্তিরে কিছু খেতে হবে তো!
কথায় আছে রাত উপোসে হাতি পড়ে! আমি তো চুনোপুঁটি। রাত্তিরে পেট ভরে না খেলে আমার ঘুমই আসে না। দুপুরবেলা সে-ই কখন খেয়েছি, তাও সেটা আজ দুপুরে না কাল দুপুরে ঠিক মনে পড়ছে না। থাকার জায়গাটা ঠিক হয়ে যাবার পরই খিদেটা বেশ জমপেশ করে এসেছে।
যাদবলাল আর একটা লোককে ডেকে আনল, সে এখানে ইট-শুর্কি পাহারা দেয়, ভবিষ্যতে এই বাংলোর চৌকিদার হবে। আপাতত সে একটা ঝুপড়ি বানিয়ে গেটের কাছে থাকে।
এই লোকটির নাম হরিলাল। সবাই লাল এখানে!
হরিলাল এখানেই রান্না করে খায়। সে জানাল যে সে আমাদের জন্য ভাত রান্না করে দিতে পারে, কিন্তু তার ঘরে আর কিছু নেই। এখন সব দোকান বন্ধ, ডাল কিংবা সবজি পাওয়া যাবে না।
যাদবলাল তাকে বলল, গাঁও থেকে সাহেবদের জন্য একটা মুরগি এনে দিতে পারবি না? কতক্ষণে লাগবে?
হরিলাল বলল, হাঁ, মুরগি পাওয়া যাবে। দৌড়ে যাব, নিয়ে আসব!
যাদবলাল বলল, ওকে পঁচিশটা টাকা দিয়ে দিন স্যার। ও আপনাদের মুরগির ঝোল রেঁধে দেবে। ভালো রাঁধে 1
এ যে মেঘ না চাইতে জল। ভাতের সঙ্গে ডাল-তরকারিও পাওয়া যাচ্ছিল না। তার বদলে একেবারে মুরগির ঝোল! এ তো তোফা ব্যবস্থা!
অবশ্য পকেট থেকে পঁচিশ টাকা বার করার সময় আমার বুকে একটু খচ্ করে উঠল। দুপুরে যখন স্টেশনের বেঞ্চে বসেছিলাম, তখন আমার কাছে ছিল কলকাতায় ফেরার একখানা টিকিট আর পঁচানব্বই টাকা! বেশ বড়লোকের মতন অবস্থাই বলা যেতে পারে।
এখন আমার কাছে টিকিটও নেই, পকেটের টাকাও হু-হু করে কমে যাচ্ছে। চন্দনদা না এলে উদ্ধার পাব না। কিন্তু চন্দনদা যদি কালকের মধ্যেও না ফেরেন? যাক, সে কালকের কথা কাল চিন্তা করা যাবে। আজ তো মুরগির ঝোল খেয়ে নিই! যাদবলাল মুরগির কথাটা উত্থাপন করার পরেও আমি রাজি না হলে ও আমাকে কঞ্জুস ভাবত।
আর একবার যদি বুঝে যায় সে আমার পকেটে অশোকচক্রের ছাপমারা কাগজ বেশি নেই, তাহলেই বোধহয় গলা ধাক্কা দেবে!
তবু আগামীকালের চিন্তায় আজকের উপভোগটা নষ্ট করা ঠিক না। টুমরো ইজ অ্যানাদার ডে! এই তো আমার জীবনদর্শন।
যাদবলাল আর হরিলাল দু’জনেই সাময়িকভাবে বিদায় নিল শতরঞ্চি আর মুরগি আনতে!
গেস্ট হাউসটি তৈরি না হলেও একটা টেমপোরারি ইলেকট্রিক কানেকশান এসেছে। ঘরের মধ্যে একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। সেই বালবের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, আলো যখন আছে, তখন একটা পাখাও লাগাতে পারত।
এতক্ষণ পর মুমু বলল, আমি রাত্তিরে ভাত খাই না। আমি রুটি খাব!
আমি চমকে গিয়ে বললুম, রুটি? লোকটা যে বলল, ভাত রাঁধবে? আবার রুটি করতে বললে ও কি রাজি হবে? রুটি তৈরি করার অনেক ঝামেলা!
মুমু বলল, রুটির থেকে ভাত তৈরি করা বুঝি সহজ?
আমি মৃদু ধমক দিয়ে বললুম, ভাত তৈরি করা আবার কী? তোরা এত বাংলা ভুল বলিস! ভাত তৈরি হয় না, ভাত রান্না হয়। রুটি তৈরি হয়। যেমন রুটি রান্না করা,কেউ বলে না।
—রুটি না হলে আমি খাব না।
–কেন, তোদের ইস্কুলে বুঝি ভাত খেতে বারণ করে? ভাত খেলে ইংরিজি শেখা যায় না? জানিস, সাহেবরাও ভাত খায়? মাইকেল মধুসূদন পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি খেতে ভালোবাসতেন!
—আমি দিনের বেলা ভাত খাই, রাত্তিরে খাই না!
—একদিন রাত্তিরেও ভাত খেলে বুঝি পৃথিবী উল্টে যাবে? অত আর বায়নাক্কা করতে হবে না। এই যা পাচ্ছিস তাই যথেষ্ট!
—এই নীলকাকা, তুমি আমার সঙ্গে এরকম বকে বকে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি!
—মোটেই তোমাকে বকা হচ্ছে না। আমরা কতটা বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি, সেটা বোঝবার চেষ্টা করো। তুমি আর কচি খুকিটি নেই, বেশ বড় হয়েছ!
মুমু ওর ব্যাগটা তুলে ছুঁড়ে মারল আমার দিকে।
সত্যি, নীপা বৌদি আর চন্দনদা আদর দিয়ে দিয়ে মেয়েটার মাথা খেয়েছে একবারে। একটি মাত্র সন্তান বলে কি এত আদিখ্যেতা করতে হবে? ব্যাগটা কম ভারি নয়, আমার কাঁধে না লেগে নাকে লাগলে রক্ত বেরিয়ে যেত। নাক দিয়ে রক্ত পড়া আমি মোটেই পছন্দ করি না।
এখন এই ফাঁকা ঘরে মেয়েটার কান মুলে দু’খানা চড় কষানো যায় অনায়াসে। মুমুর কান দুটো বেশ ভালো করে মুলে দেওয়ার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের।
কিন্তু আমি মনটাকে শান্ত করলুম।
মেয়েটা বাবাকে খুব ভালোবাসে, মাত্র দু’মাস বাবাকে দেখেনি বলে একলা একলা ছুটে এসেছে এত দূরে। বাবার সঙ্গে তো দেখা হলোই না, বাবার কোয়ার্টারেও থাকতে পারল না, এজন্য ওর খুব মন খারাপ তো হবেই। আসলে তো একটা বাচ্চা মেয়ে। আমার ভেতরে যে একেবারেই দয়া-মায়া নেই, তাও তো নয়। এই সময় মেয়েটাকে শাস্তি দেওয়া চলে না।
ব্যাগটা নামিয়ে রেখে আমি আস্তে আস্তে বললুম, বী আ সেনসিবল গার্ল, মুমু! আমরা একটা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়ে গেছি, এখন তো একটু মানিয়ে নিতেই হবে। আমার কাছে বেশি টাকা নেই, তোর কাছেও ফেরার ভাড়া নেই, চন্দনদা এসে না পড়লে আমাদের কী অবস্থা হবে বল তো!
মুমু বলল, এবার বিনা টিকিটে যাব। কলকাতায় গিয়ে পুলিশে ধরুক না, আমার বড়মামা আছে। বড়মামা খুব বড় পুলিশ!
আমি বললুম, এটা ঠিক বলেছিস! চন্দনদা কালকের মধ্যে না এলে দু’জনে উইদাউট টিকিটে অ্যাডভেঞ্চার করব। তোর মামা কত বড় পুলিশ?
-অনেক বড়!
—বাঃ! একটা গল্প আছে জানিস তো। গ্রামের এক বুড়ি সবাইকে গল্প করত আমার ছেলে কলকাতায় পুলিশের চাকরি করে, কী তার ক্ষমতা। সে ইচ্ছে করলে লাট সাহেবের গাড়ি আটকে দিতে পারে। লাট সাহেব মানে হচ্ছে রাজ্যপাল, অর্থাৎ গভর্নর। তা হলে সেই বুড়ির ছেলে কত বড় পুলিশ বল তো?
মুমু ঠিক ব্যাপারটা ধরতে পারেনি, সে সোজা চোখে তাকিয়ে রইল।
আমি বললুম, ট্রাফিক কনস্টেবল। সে হাত তুললে রাস্তার সব গাড়ি থেমে যায়।
মুমু আবার একটা কিছু ছুঁড়ে মারার জন্য এদিক ওদিক খুঁজল।
আমি উঠে গিয়ে বাথরুমটা উঁকি দিলাম।
বাথরুমে বেসিন, কমোড, শাওয়ার সব কিছুই ফিট করা আছে। কিন্তু জ্বল নেই। দুটো বড় বড় খালি বালতি। যাদবলাল কিংবা হরিলাল এলে জল তুলে দিতে বলতে হবে।
মুমুকে বললুম, তুই জামা-টামা চেইঞ্জ করতে চাস তো করে নে। আমি একটু বাইরেটা ঘুরে দেখে আসছি।
বাংলোটার জন্য বেশ চমৎকার জায়গা বাছা হয়েছে। একেবারে পাশেই একটা পাহাড়ের পাদদেশ। একটু দূরে অন্ধকারে রুপোলি রেখার মতন যেটা চকচক করছে, সেটা নিশ্চয়ই নদী।
মাস ছয়েকের মধ্যে বাংলোটা পুরো তৈরি হয়ে গেলে তখন দলবল মিলে আবার আসতে হবে এখানে। আড্ডা মারার পক্ষে অতি উপযুক্ত জায়গা
দূরে কী যেন একটা ডেকে উঠল। শেয়াল না কুকুর? কেমন যেন করুণ সুর। শেয়াল বা কুকুর যা-ই হোক, তাদের করুণ সুরের ডাক শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। এই পাহাড়ে আবার বাঘ-টাঘ নেই তো? লেপার্ড থাকা আশ্চর্য কিছু না! রাত্তিরে ভালো করে দরজা বন্ধ করতে হবে। আশা করি, ছিটকিনি—টিটকিনিগুলো ঠিক আছে!
মুরগি আনতে হরিলালের একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু শতরঞ্চি আনতে যাদবলালের এতক্ষণ লাগছে কেন? তার অফিসেই শতরঞ্চি আছে বলে গেল। বালিশ পাওয়া যাবে না, আমাদের ব্যাগ দুটোই মাথায় দিতে হবে।
কী একটা জন্তু খরর-মরর করে দৌড়ে গেল পাহাড়ের দিকে। নাঃ, বাইরে খোলা জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না।
দূরের রাস্তা দিয়ে টর্চ দোলাতে দোলাতে কে যেন আসছে। আমি বেরিয়ে ডাকলুম, যাদবলাল! যাদবলাল!
সেই লোকটিই যাদবলাল। নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার চোখ দুটি এখন টকটকে লাল, মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া, মুখে ফুরফুরে হাসি।
শতরঞ্চিটা আমার পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে সে বলল, লিন, পেতে লিন! সব ঠিক আছে!
এই রে, এ যে একেবারে অন্য মানুষ। একে আগেই দশটাকা দেওয়া ঠিক হয়নি, সেই টাকায় মহুয়া খেয়ে এসেছে বুঝতে পারছি। ভুরভুর করে গন্ধ ছড়াচ্ছে। আজ রাত্তিরে আর কোনো কাজ পাওয়া যাবে না ওর কাছে
আমি বললুম, হ্যাঁ, ঠিক আছে। হরিলাল কতক্ষণে আসবে?
যাদবলাল বলল, গাঁয়ে গেছে স্যার, একটু মহুল তো খেয়ে আসবে। তবে আপনাদের রান্না করে দেবে ঠিক।
কথা জড়িয়ে গেছে যাদবলালের। ওকে দশটাকা দিয়েছি, তাতেই এই অবস্থা হরিলাল পঁচিশ টাকা’ পেয়ে কতটা খাবে কে জানে!
যাদবলালকে বললুম, ঠিক আছে, তুমি যাও!
যাদবলাল বলল, একটা সিগ্রেট দিন স্যার!
আমি পকেট থেকে প্যাকেটটা বার করে খুলতেই সে কাছে এসে উঁকি মেরে দেখে বলল, অনেক আছে, তাহলে দুটো দিন!
এরকম দু’একটা জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার আছে, যেখানে দিনের বেলার লোকগুলো রাত্তিরবেলা একদম বদলে যায়। দিনের বেলা খুব নিরীহ আর বিনীত, রাত্তিরবেলা শের।
বাথরুমে জল নেই, কিন্তু বোঝা গেল যে যাদবলালকে দিয়ে এখন আর কোনো কাজ করানো যাবে না। শতরঞ্চিটা যে আমার গায়ে ছুঁড়ে মারেনি, এই যথেষ্ট! এর পর হরিলাল আবার কোন মূর্তি ধরে আসে কে জানে!
যাদবলালকে বিদায় দিয়ে শতরঞ্চিটা নিয়ে এলাম ঘরে। সারা ঘরে কোথাও বসবার জায়গা নেই বলে মুমু একটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেতে ও মেয়ে কিছুতেই বসবে না।
আমাকে দেখেই মুমু বলল, মশা!
আমি বললুম, শোন্, এক বাড়িতে একজন ভাড়াটে খুব কম ভাড়ায় থাকত! একদিন তার ঘরের ছাদ দিয়ে বৃষ্টির সময় খুব জল পড়ছে, তাই সে রাগ করে বাড়িওয়ালাকে ধরে আনল। তারপর বলল, এই দেখুন, নিজের চোখে দেখুন আপনার ঘর দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে! বাড়িওয়ালা বলল, বৃষ্টির সময় জল পড়বে না কি পাইনঅ্যাপ্ল জুস পড়বে?
মুমু আজ কিছুতেই হাসবে না প্রতিজ্ঞা করেছে। সে আমার দিকে একটা কুটিল ভূভঙ্গি করে বলল, সারারাত মশা কামড়াবে?
আমি বললুম, ‘ভিক্ষের চাল কাড়া না আকাড়া’ বলে একটা কথা আছে, নিশ্চয়ই জানিস না। এইবার শিখে রাখ। বাংলা পরীক্ষায় বাক্য গঠন করো-তে আসতে পারে। এইবার শতরঞ্চিটা পেতে ফ্যালো তো লক্ষ্মী মেয়ে। আমি বালতি করে জল নিয়ে আসছি।
সামনের বাগানে একটা কুয়ো দেখে এসেছি। দড়ি-বালতিও আছে। কিন্তু পাহাড়ের দিকটা বড্ড অন্ধকার, কাছাকাছি আর একটাও বাড়ি নেই, খালি মনে হচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে জ্বলজ্বলে চোখে কেউ যেন আমাকে লক্ষ করছে। সাধারণত আমি তেমন ভীতু প্রকৃতির নই, তবে আজ এতটা ভয় ভয় করছে কেন?
নিজের দায়িত্ব আমি নিতে পারি, কিন্তু সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে রয়েছে, যদি হঠাৎ ডাকাত-টাকাত আসে। ডাকাতরা তো আর জানে না যে আমার কাছে কত টাকাপয়সা আছে!
কুয়ো থেকে জল তোলার ব্যাপারটা কিছুতেই তাড়াতাড়ি করা যায় না। হুড়োহুড়ি করে দড়ি টানলে কম জলে ওঠে। দু’খানা বালতি ভর্তি করতে করতে খালি মনে হলো, পেছন থেকে কে যেন এসে পড়বে।
বালতি দুটো দু’হাতে বয়ে এনে বাথরুমে রেখেই ঘরের দরজাটায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলুম। দরজায় একটা খিলও রয়েছে। নতুন দরজা, সহজে ভাঙা যাবে না।
মুমু শতরঞ্চিটা পাতেনি। সেই ভাঁজ করাটার ওপরেই বসে আছে।
রাগ করা উচিত নয়, সেই জন্য মুখখানা হাসি হাসি রেখে বললুম, তুই একদিকটা ধর, দু’জনে মিলে এটা পেতে ফেলা যাক! খাওয়া কখন জুটবে তার কোনো ঠিক নেই, তার আগে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে!
মুমু বলল, এই শতরঞ্চিতে তুমি আর আমি দু’জনে শোব?
আমি বললুম, হ্যাঁ, বেশ বড়ই তো আছে। দু’জন কেন, চারজন এঁটে যেতে পারে!
—তুমি রাত্তিরবেলা এই ঘরে থাকবে?
—তার মানে? এই ঘরে থাকব না তো কোথায় যাব? আর কোনো ঘর আছে নাকি?
–না, তুমি এই ঘরে থাকতে পারবে না! ছেলেরা আর মেয়েরা এক ঘরে শোয় না। আমি তো তোমাকে বিয়ে করব না, তা হলে তোমার সঙ্গে শোব কেন?
আমি শুধু স্তম্ভিত নয়, একেবারে ত-থ-দ-ধ মেরে গেলুম! এ মেয়ে বলে কি? আমি ওকে এঁচোড়ে পাকা বলে জানতুম, এ যে দেখছি ভাদ্দর মাসের গাছ—তুলতুলে আতা! এখনো এগারো বছর বয়েস পেরোয়নি, বুকে ঢেউ খেলেনি, এখনো পিউবার্টি আসেনি, তার মুখে হিন্দি সিনেমার নায়িকার মতন ডায়লগ!
এবার ওর কান ধরে একটা থাপ্পড় কষালে কেউ নিশ্চয়ই আমায় দোষ দিতে পারবে না। কিন্তু আমার দারুণ সংযম
মুমুর মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, তা হলে তো মুস্কিল হলো! এই ঘরে মশা আছে, তা ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরা এক শতরঞ্চিতে শুতে পারবে না, তবে তোকেই যে বাইরের বারান্দায় শুতে হবে মুমু! এখানকার জঙ্গলে চিতা বাঘ থাকে, শেয়াল আছে, ভাল্লুকও থাকতে পারে, তারা যদি এসে পড়ে, তুই তাদের সঙ্গে গল্প করবি!
–আমি বাইরে শোব না, তুমি শোবে!
—আহা রে, কী আবদার! আমি ঘর জোগাড় করলুম, শতরঞ্চি আনালুম, এখন আমি কেন বাইরে শুতে যাব! অত খাতির কিসের রে? দেখলি তো, তোর বাবার বাড়ির দরজা খোলা গেল না। আমি সঙ্গে না এলে তোকে রাস্তায় থাকতে হতো!
—আমার বাবাটা মহাপাজি! নাম্বার ওয়ান স্কাউন্ট্ৰেল!
-বা-বা-বা, কী চমৎকার শিক্ষা! তোদের ইস্কুলে বুঝি বাবাকে স্কাউন্ড্রেল বলতে শেখায়?
—খবর্দার, আমার ইস্কুলের নামে কিছু বলবে না!
–তোর বাবা কিসে পাজি হলো? তোর চিঠি চন্দনদা পাননি, সেটা তাঁর দোষ?
—হ্যাঁ, পাজিই তো। নিশ্চয়ই পাজি!
—বাবা যদি পাজিই হয়, তবে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য এত দূর ছুটে এলি কেন একা একা?
হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে মুমু হু-হু করে কেঁদে উঠল।
যতই বয়েস কম হোক, তবু মুমু এরই মধ্যে এই অস্ত্রের ব্যবহারটা শিখে নিয়েছে। যুক্তিতে হেরে গেলেই কান্না!
তা বলে আমি এক্ষুনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছি না। কাঁদুক, একটু কান্না স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
তা ছাড়া কান্নার এখনো তো অনেক কিছু বাকি আছে। চন্দনদা যদি কালকের মধ্যে না ফেরে তা হলে আমাকেও কাঁদতে হবে!
ততক্ষণে শতরঞ্চিটা পেতে ফেললে মন্দ হয় না। আমার সত্যিই একটু শুতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে আজ ভাত বা রুটি, কোনোটারই আশা নেই! তার ওপর আবার মুরগির ঝোলের লোভ! শুধু ফেনা ভাত খেয়ে পেট ভরানো যেত!
মুমুর কাছ থেকে শতরঞ্চিটা টেনে এনে বিছিয়ে দিলুম। তারপর একবার এদিকে, আর একবার ওদিকে গিয়ে আমাকেই টান টান করতে হলো। নিজের ব্যাগটা বালিশের মতন সাজিয়ে শোবার উপক্রম করছি, তখন মুমু কান্না থামিয়ে বলল, নীলকাকা, এটা কী?
আমি রুক্ষ গলায় বললুম, কোনটা আবার কী?
মুমু মুখে দু’হাত চাপা দিয়ে কাঁদছিল। এখন হাত সরিয়ে নিয়েছে। মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, এটা নড়ছে?
সেদিকে আমার চোখ পড়তেই আমার বুকের মধ্যে দুম দুম শব্দ হলো। চোখ দুটোও হয়ে গেল ছানাবড়া। এক মুহূর্তও চিন্তা করার সময় নেই, মুমুর হাত চেপে ধরে, প্রায় তাকে শূন্যে তুলে আমি একটা লাফ দিলুম। তারপর আরও দু’লাফে দরজার বাইরে। তারপর টেনে বন্ধ করে দিলুম দরজাটা!