কৈলাস চৌধুরীর পাথর – ০২
পরের দিন ছিল রোববার। সারা দিনের মধ্যে বেশির ভাগটা সময় ফেলুদা ওর ঘরে পায়চারি করেছে। বিকেলে চারটে নাগাত ওকে পায়জামা ছেড়ে প্যান্ট পরতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি বেরোচ্ছ?’
ফেলুদা বলল, ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের লিলি গাছগুলো একবার দেখে আসব ভাবছি। যাবি তো চ।’
ট্রামে করে গিয়ে লোয়ার সারকুলার রোডের মোড়ে নেমে হাঁটতে হাঁটতে পাঁচটা নাগাত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দক্ষিণ গেটটায় পৌঁছলাম। এদিকটায় লোকজন একটু কম আসে। বিশেষ করে সন্ধের দিকটায় যা লোক আসে সবই সামনের দিকে—মানে, উত্তরে—গড়ের মাঠের দিকে।
গেট দিয়ে ঢুকে বিশ হাতে আন্দাজ করে এগিয়ে গিয়ে দেখি বাঁ দিকে সত্যিই লিলি গাছের কেয়ারি। তার প্রথম সারির প্রথম গাছটার নীচেই পাথরটা রাখার কথা।
লিলি গাছের মতো এত সুন্দর জিনিস দেখেও গা-টা কেমন জানি ছম্ছম্ করে উঠল। ফেলুদা বলল, ‘কাকার একটা বাইনোকুলার ছিল না—যেটা সেবার দার্জিলিং নিয়ে গেছিলেন?’
আমি বললাম, ‘আছে?’
মিনিট পনেরো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঘুরে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলাম লাইটহাউসের সামনে। ফেলুদার কি সিনেমা দেখার শখ হল নাকি? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনেমায় না ঢুকে ও গেল উলটোদিকের একটা বইয়ের দোকানে। এ বই সে বই ঘেঁটে ফেলুদা দেখি একটা বিরাট মোটা স্ট্যাম্পের ক্যাটালগ নিয়ে তার পাতা উলটোতে আরম্ভ করল। আমি পাশ থেকে ফিসফিস করে বললাম, ‘তুমি কি অবনীশবাবুকে সন্দেহ করছ নাকি?’
ফেলুদা বলল, ‘এত যার স্ট্যাম্পের শখ, তার কিছুটা কাঁচা টাকা হাতে পেলে সুবিধে হয় বইকি।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু আমরা যখন দোতলা থেকে একতলায় এলাম, তখন যে টেলিফোনটা এল, সেটা তো আর অবনীশবাবু করেননি।’
‘না। সেটা করেছিল মসলন্দপুরের আদিত্যনারায়ণ সিংহ।’
বুঝলাম ফেলুদা এখন ঠাট্টার মেজাজে রয়েছে, ওর সংগে আপাতত আর এ-বিষয়ে কথা বলা চলবে না।
বাড়ি যখন ফিরলাম তখন আটটা বেজে গেছে। ফেলুদা কোটটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ফিয়ে বলল, ‘আমি যতক্ষণ হাতমুখ ধুচ্ছি, তুই ডিরেক্টরি থেকে কৈলাসবাবুর টেলিফোন নাম্বারটা বার কর তো।’
ডিরেক্টরি হাতে নিয়ে টেলিফোনের সামনে বসা মাত্র ক্রিং করে ফোনটা বেজে উঠে আমায় বেশ চমকে দিল। আমাকেই ধরতে হয়। তুলে নিলাম রিসিভারটা।
‘হ্যালো।’
‘কে কথা বলছেন?’
এ কী অদ্ভুত গলা! এ গলা তো চিনি না! বললাম, ‘কাকে চাই?’
কর্কশ গম্ভীর গলায় উত্তর এল, ‘ছেলেমানুষ বয়সে গোয়েন্দাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করা হয় কেন? প্রাণের ভয় নেই?’
আমি ফেলুদাকে নাম ধরে ডাকতে গেলাম, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। কাঁপতে কাঁপতে টেলিফোনটা রেখে দেওয়ার আগে শুনতে পেলাম লোকটা বলল, ‘সাবধান করে দিচ্ছি—তোমাকেও, তোমার দাদাকেও। ফল ভাল হবে না।’
আমি কাঠ হয়ে চেয়ারে বসে রইলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, ‘ও কী—ওরকম থুম মেরে বসে আছিস কেন? কার ফোন এসেছিল?’
কোনওমতে ঘটনাটা ফেলুদাকে বললাম। দেখলাম ও-ও গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর পিঠে একটা চাপড় মেনে বলল, ‘ঘাবড়াস না। লোক থাকবে—পুলিশের লোক। বিপদের কোনও ভয় নেই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে একবার যেতেই হবে কালকে।’
রাত্রে ভাল ঘুম হল না। শুধু যে টেলিফোনের জন্য তা নয়; কৈলাসবাবুর বাড়ির ভিতরের অনেক কিছুই বার বার চোখের স্মাওনে ভেসে উঠছিল। সেই লোহার রেলিং দেওয়া ছাদ পর্যন্ত উঠে যাওয়া সিঁড়ি, দোতলার মার্বেল-বাঁধানো অন্ধকার লম্বা বারান্দা, আর তার দরজার ফাঁক দিয়ে বার করা কৈলাসবাবুর বাবার মুখ। কৈলাসবাবুর দিকে ওরকম ভাবে চেয়েছিলেন কেন তিনি? আর কৈলাসবাবু বন্দুক হাতে ছাতে গিয়েছিলেন কেন? কীসের শব্দ পেয়েছিলেন উনি?
ঘুমোতে যাবার আগে ফেলুদা একটা কথা বলেছিল—‘জানিস, তোপসে—যারা চিঠি লিখে আর টেলিফোন করে হুমকি দেয়—তারা বেশির ভাগ সময় আসলে কাওয়ার্ড হয়।’ এই কথাটার জন্যই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ঘুমটা এসে গেল।