Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আমার মায়ের গুরুদেব বলেছিলেন, রাতের বেলা নিজেকে একটু সামলে রাখিস। রাত মানুষকে দুর্বল করে দেয়। জঙ্গলের রাত আর মনের রাতে বিশেষ তফাত নেই। বাঘ, ভাল্লুক, হায়না সব বেরিয়ে আসে। রাতে ঋষিরা তাই আগুন জ্বেলে বসে থাকতেন, আর নাম গান করতেন। অপেক্ষা করতেন কখন সূর্য উঠবে। পুব আকাশে রাশি রাশি জবা ফুল। অগ্নির শিখা। তপোবনে ঋষিদের সমবেত প্রার্থনা।

অসতো মা সদগময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।।

রাতে তোর দেহ ঘুমিয়ে পড়লেও মনটাকে জাগিয়ে রাখবি। সে যে লাঠি হাতে চৌকিদারের মতো বসে থাকে সারারাত।

মহীদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, মহারাজ রাতের শত্রু কে কে?

প্রথম শত্রু হল কাম। কাম একধরনের পোকা। উইপোকার মতো ক্ষুদ্র কীট। জানিস তো উইপোকা কত জ্ঞানের বই কেটেকুটে ঝাঁঝরা করে দেয়। কামকীট জ্ঞানী ব্যক্তিকেও অহরহ ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। উইঢিবির মতো ভেতরে ঢিবি তৈরি করে ফেলে। বাড়ালেই বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় শত্রু হল হিংসা। রাতের সংকল্পকে মানুষ দিনে কজে লাগাবার চেষ্টা করে। রাতের পৃথিবীকে দিনের আলোয় মেলে ধরার চেষ্টা করে। কাম থেকে আসে ক্রোধ। ক্রোধ থেকে আসে হিংসা। মহাজ্ঞানীরা সেইজন্যে সারারাত সাধনা করেন। প্রদীপটিকে সাধনার তেল দিয়ে সারারাত জাগিয়ে রাখেন।

মহীদা শুনে বলেছিলেন, আমার কোনো ভয় নেই সাধু মহারাজ। এক এক রাতে আমি এক এক চরিত্র। নিজেকে আর খুঁজে পাই কই।

বিরাট একটা আয়নার সামনে মহীদা বসে আছেন। শেষ বেলার লাল আলো ঢুকেছে ঘরে পশ্চিমের জানলা দিয়ে। দূর আকাশে টিপ টিপ পাখি। ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফিরছে। একটা দুটো করে আলো জ্বলে উঠছে ইতিউতি। আলোর এখনও তেমন চোখ ফোটেনি। কেমন যেন ফ্যাকাসে। আয়নার সামনে বসে মহীদা সাজগোজ করছেন। চওড়া পাড় দিশি ধুতির কোঁচা পেখমের মতো লুটিয়ে আছে পায়ের কাছে মেঝেতে। গায়ে ফিনফিনে পাতলা দুধের মতো সাদা পাঞ্জাবি। বুকটা খোলা। সরু সোনার চেন চিকচিক করছে। সরু গোঁফে মোম ঘষছেন। সারা ঘরে দামি আতরের গন্ধ ম ম করছে। ঝকঝকে মেহগনি কাঠের টেবিলে পলতোলা গেলাসে গোলাপি রঙের তরল পদার্থ ডিমের কুসুমের মতো আলো ভাসছে। পাশেই একটা বিষ রঙের চ্যাপটা বোতল। গায়ে যেন ফোসকা ফুটে আছে।

চুমুকে চুমুকে অল্প অল্প পান করছেন, আর বলছেন, মহী তুমি বেরিয়ে যাও। এ শরীরে তোমার আর থাকার অধিকার নেই। একটু পরেই তুমি হয়ে যাবে আলমগির। কে, কে ঘরে প্রবেশ করছে?

আমি খোকা।

খোকা? তুমি আমার দ্বাররক্ষী। আমি আলমগির।

আয়নার দিকে তাকিয়ে নাটকের সংলাপ শুরু করলেন।

দেশের পনেরো আনা লোক একবেলাও পেট ভরে আহার পাচ্ছে না। সেটা আমিও জানি রাজসিংহ। কিন্তু তাছাড়া আরও জানি, তুমি জানো না। এ দেশের অন্ন দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। সেখানে লোকে পাঁচ বেলা আহার করেও তা শেষ করতে পারছে না। আহার শেষে কুকুর বেড়ালের মুখের কাছে তা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এই পনেরো আনা লোকের জীবনরসে এত সরাব প্রস্তুত হয় যে তোমার ক্ষুদ্র মেবার ডুবিয়ে দিয়ে প্রবল বন্যার সৃষ্টি করতে পারে।

চুল আঁচড়ে মহীদা উঠে দাঁড়ালেন। ধুতির কোঁচা ঝেড়েঝুড়ে কোমরের কাছে কায়দা করে গুঁজে দিলেন। চোখে হালকা করে সুরমা টেনেছেন। শেষ চুমুকে গেলাস খালি করে দেয়ালে ঝোলানো বিশাল একটা ছবিকে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। তারপর আমাকে বললেন, মাস্টার, তোমার ডিউটি তুমি করো। আমার যাবার সময় হল। গাড়ি অনেকক্ষণ এসে গেছে।

মহীদা সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগলেন। যেন রাজা নামছেন। দু গালে গোলাপি আভা। আমার কাজ হল গেলাস আর বোতাল তুলে রাখা। মহীদাকে আমার মামা বলেই ডাকা উচিত। বলতুমও তাই। হঠাৎ একদিন বললেন, মামা মামা করিসনি তো। কেমন যেন চোর চোর শোনায়। আমাকে দাদা বলবি। আর তোর মাকে আমি ছোটো মা বলব। আমার এখন দুই মা। বড়ো মা, আর ছোটো মা।

বিরাট আয়না বসানো আলমারির পাল্লা খুললেই টুংটাং বাজনা বাজে। যতক্ষণ না বন্ধ করছি ততক্ষণ বাজবে। ভেতরের নানারকমের জিনিস। আতরই আছে পাঁচ—সাত রকমের। কোনোটার রঙ সোনালি, কোনোটা গাঢ় সবুজ। পাল্লা খুললেই ভুরভুর করে গন্ধ আসে নাকে। ঝলমলে রেশমের পোশাক পাটে পাটে রাখা। পরচুল তিন—চার রকমের। সাধুর জটাও আছে। গেরুয়া আলখাল্লা। গোটা গোটা রুদ্রাক্ষের মালা। একটা তাকে নানারকমের পুতুলও আছে। একটা পুতুল আমার ভীষণ ভালো লাগল। হাতে চিবুক রেখে সুন্দর চেহারার একজন মানুষ ভাবছে। ভেবেই চলেছে বন্ধ আলমারির ভেতর বসে বসে। কীসের এত ভাবনা তোমার? হ্যাঁগা। দিনরাত কী এত ভাবো!

গেলাস আর সেই অদ্ভুত বোতলটা তুলে আলমারি বন্ধ করে যেই ঘুরেছি অমনি ভয়ে গলা দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসার মতো হল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরলো না। কেন বুঝলাম না। শুধু বুঝলুম শরীর অবশ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে আমি মেঝের দিকে ভেঙে পড়ছি। একটু আগে আয়নার সামনে মহীদা গদি আঁটা চেয়ারে বসেছিলেন, সেই চেয়ারে বসে আছেন অসাধারণ সুন্দরী এক মহিলা। গাঢ় কমলালেবুর রঙের রেশমের ঘাঘরা। ঘন নীল রঙের কাঁচুলি আর ওড়না। জায়গায় জায়গায় রুপোর তারা বসানো। আলোয় ঝলমল করছে। কুচকুচে কালো রঙের পাতাকাটা চুল। ঘাড়ের কাছে জালমোড়া এতখানি খোঁপা। জালে অভ্রের দানা চিকচিক করছে। মা দুর্গার মতো টানা টানা দুটো চোখ। সোনার বর্ণ দু—হাতে পাথর বসানো গয়না। পাতলা নাকে নাকছাবি ঝিলিক দিচ্ছে। আমার দিকে মহিলা তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছে না। স্থির কাচের মতো দৃষ্টি। মানুষ না পুতুল। এতদিন এ বাড়িতে রয়েছি, কই একে তো কোনোদিন দেখিনি। মাসিমা, মা, রাধাদি যেকোনো একটা নাম ধরে চিৎকার করতে চাইছি, ভয়ে গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। মহিলার শরীরের রেখা চোষ কাগজে কালির মতো ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে যেতে লাগল। সুন্দর মুখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। ভোরের কুয়াশার মতো একটু একটু করে সেই ছবি অদৃশ্য হয়ে গেল। এতক্ষণ কী ভুল দেখছিলুম। চোখ দুটো একবার রগড়ে নিলুম। স্বপ্ন নয় তো! কে এই মহিলা! প্রথমে দেখেই যেরকম ভয় পেয়েছিলুম, সে ভয় অনেক কমে গিয়েছিল। শেষের দিকে দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল। মনে হচ্ছিল, রূপকথার কোনো রাজকন্যা। উঠে গিয়ে গদি আঁটা চেয়ারটা ভালো করে দেখলুম। গদিতে হাত রাখলুম। এতক্ষণ বসে থাকার কোনো গরম নেই। বড়ো বেশি ঠাণ্ডা। মেঝেতে খুঁজলুম, যদি পোশাক থেকে ঝরে পড়া একটা দুটো তারা পাওয়া যায়। না, নেই কিছু। শেষে নিজেরই সন্দেহ হতে লাগল। যা দেখেছি তা ঠিক দেখেছি তো! আবার যদি আসেন আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখব। প্রশ্ন করব, আপনি কে? এই দেখার কথা আমি আর কাউকে বলব না। আমাকে মেলার সেই সাধুবাবা বলেছিলেন, যে ভূত দেখে সে ভগবানকেও দেখতে পাবে। ভূত আর ভগবান একই, টাকার এ পিঠ ও পিঠ। আমি ভূত দেখলুম, না মা দুর্গা দেখলুম! আমার দাদা অমাবস্যার রাতে ব্রহ্মদৈত্য দেখেছিলেন। সেই দেখার পর থেকে তাঁর ভাগ্য ফিরে গিয়েছিল। জমিদারের নায়েব হয়েছিলেন। মনে হয় আমার ভাগ্যও এবার ফিরে যাবে। আমার খুব রেলগাড়ির ড্রাইভার হতে ইচ্ছে করে। কত কত দেশ দেখব। গভীর রাতে আমার ট্রেন ছুটবে নদীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে গুম গুম শব্দে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় ইচ্ছে করে সিটি বাজাব। পাহাড়ের ঘুম ভেঙে যাবে। অজানা স্টেশনে আমার ইঞ্জিন দাঁড়াবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাবে। টেলিগ্রাফের তারে রাত ঝিমঝিম করবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress