কেদার রাজা (Kedar Raja) : 14
কেদার ও গোপেশ্বর দুজনে মিলে খেটে বাড়ির উঠানটা অনেকটা পরিষ্কার করে তুলেছেন৷ কেদার তত নন, বলতে গেলে গোপেশ্বরই খেটেছেন বেশি৷ শরৎকাল পড়েছে, পূজার দেরি নেই, গোপেশ্বর একদিন উঠানের এক ধার খুঁড়ে কতকগুলো কচুর চারা পুঁতছেন, কেদার মহাব্যস্ত হয়ে এসে বললেন, দাদা, এসো—ওসব ফেলে রাখো—
—কি রাজামশায়?
—আরে একটা নতুন রাগিণীর সন্ধান পেয়েছি একজনের কাছে৷ মুখুজ্জে-বাড়িতে জামাই এসেছে—ভালো গায়ক৷ দেওগান্ধার ওর কাছে আদায় করতে হবে৷ থাকবে এখন কিছুদিন এখানে, চলো দুজনে যাই—
—দেবে কি রাজামশাই? ওসব লোক বড় কষ্ট দেয়৷ আমি কাশীতে এক ওস্তাদের কাছে বড় আশা করে যাই৷ একখানা ভীমপলশ্রীর আস্তাই দিলে অতি কষ্টে তো মাসাবধি অন্তরা আর দেয় না৷ কত খোশামোদ, কেবল অন্তরা এক মিনিটে নাকি হয়ে যাবে! হায়রান হয়ে গেলাম হাঁটাহাঁটি করে৷
—পেলে?
—কোথায় পেলাম? আদায় করা গেল না শেষ পর্যন্ত৷ সেই থেকে নাকে-কানে খৎ—ওস্তাদের কাছে আর যাব না৷
—যা হোক চলো দাদা৷ এ আমাদের গাঁয়ের জামাই—ওকে নিয়ে একদিন মজলিশ করা যাক—অনেকদিন থেকে দেওগান্ধারের খোঁজ করছি৷ ধরা যাক চলো—ওখানে কি হচ্ছে?
—মানকচুর চারা লাগিয়ে রাখলাম গোটাকতক৷ সামনের বছরে এক একটা কচু হবে দেখবেন কত বড় বড়! আপনার ভিটের এ জমিতে একটা মানকচু—
—জানি দাদা৷ ও এখন রাখো, হবে পরে৷ ও শরৎ—
শরৎ রান্নাঘর থেকে বার হয়ে এসে বললে, কি বাবা?
—আমাদের দুজনকে একটু তেল দ্যাও মা৷ রান্নার কতদূর?
—ওলের ডালনা চড়েছে—নামিয়ে ভাত চড়াব৷ তা হলেই হয়ে গেল—
—হ্যাঁ মা, রাজলক্ষ্মী এসেছে?
—না, আজ আসে নি এখনো৷ কেন?
—না বলছিলাম, মুখুজ্জে-বাড়ি জামাই এসেছে, ভদ্রেশ্বরে বাড়ি, কেমন লোক তাই তাকে জিজ্ঞেস করতাম৷
—সে খোঁজে তোমার কি দরকার? সে ভালো হোক মন্দ হোক—
—তুই তা বুঝবি নে বুঝবি নে৷ অন্য কাজ আছে তার কাছে৷ যদি এর মধ্যে রাজলক্ষ্মী আসে—
—মুখুজ্জে-বাড়ির কোন জামাই বাবা? আশাদিদির বর? আশাদিদির শ্বশুরবাড়ি তো ভদ্রেশ্বর—
—তাই হবে৷
—সে তো বুড়ো মানুষ৷ আশাদিদিকে বিয়ে করেছে দোজপক্ষে—
—তোর সে-সব কথায় দরকার কি বাপু? বুড়ো হয়, আরও ভালো!
—বলো না, কেন বাবা—
—নাঃ, সে শুনে কি করবি?
—না আমি শুনব—
—শুনবি? রাগিনী ভূপালী, বাদী গান্ধার বিবাদী মধ্যম আর নিখাদ—সম্বাদী ধৈবত—আরও শুনবি? রাগিনী আশারবী—বাদী—
—থাক, আর শুনে দরকার নেই—নেয়ে এসে ভাত খেয়ে আমায় খোলসা করে দিয়ে যত ইচ্ছে রাগিনী শেখো—
বেলা পড়ে গেল৷ ঘরের তালকাঠের আড়াতে কলাবাদুড় ঝুলছে, যেমন শরৎ আবাল্য দেখে এসেছে৷ কেদার ও গোপেশ্বর আহারাদি সেরে অন্তর্হিত হয়েছেন, মধ্যরাত্রে যদি ফেরেন তবে শরতের সৌভাগ্য৷ রাজলক্ষ্মীর জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকে সে৷ তবুও দুজনে গল্প করে সময় কাটে৷ রোজ রোজ বাবার এই কাণ্ড! ভালো লাগে!
এমন সময় কে বাইরে থেকে ডাকল—ও শরৎ, শরৎ—
শরৎ বাড়ির দাওয়ায় উঁকি মেরে দেখে বললে—কে? ও বটুক-দা, ভালো আছেন? আসুন৷
বটুককে শরৎ কোনো কালেই ভালো চোখে দেখত না৷ সেই বটুক, যে এক সময় শরতের প্রতি অনেক অসম্মানজনক ব্যবহার করেছিল, রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে যে বটুকের সম্বন্ধে সেযুগে কলকাতায় যাবার পূর্বে শরৎ আলোচনা করেছিল একবার৷
বটুক একটু ইতস্তত করে বললে, শুনলাম তোমরা এসেছ—কাকা এসেছেন, তাই একবার দেখা করতে—
শরৎ আগেকার মতো নেই—জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে অনেক সাহসী ও সহিষ্ণু করে দিয়েছে৷ আগেকার দিন হলে শরৎ বটুকের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথাও বলত না, এ নিশ্চয়ই৷ আজ শরৎ দাওয়ায় একখানা পিঁড়ি পেতে বটুককে বসতে বললে৷
বটুক একটু আশ্চর্য হয়ে গেল৷ শরতের কাছ থেকে এ আদর সে আশা করে নি এখানে৷ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বসলো৷ শরৎ তাকে চা করে খাওয়ালে৷ বললে, দুটি মুড়ি খাবে বটুকদা? আর তো কিছু নেই ঘরে৷ তুমি এলে এতদিন পরে—
—থাক, থাক, সে জন্যে কিছু নয়! আমি দেখতে এলাম, বলি দেখা হয় নি কত দিন৷ আচ্ছা শুনলাম নাকি কত দেশ-বিদেশে বেড়িয়ে এলে?
—তা বেড়ালাম বৈকি৷ রাজগীর, কাশী৷
—কাকা নিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?
—জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম—ওই যিনি আমাদের এখানে আছেন—
—তা বেশ বেশ৷
এই সময় দূরে রাজলক্ষ্মীকে আসতে দেখে বটুক তাড়াতাড়ি উঠে বিদায় নিলে৷ শরৎ বললে—আর একদিন এসো, বাবার সঙ্গে তো দেখা হল না! বাবা থাকতে এসো একদিন—
রাজলক্ষ্মী চেয়ে বললে—ও এখানে কি জন্যে এসেছিল? বটুকদা তো লোক ভালো না—
—কি মতলব নিয়ে এসেছিল কি করে বলব বল? এলো—বসতে দিলাম, চা করে দিলাম—
—না না শরৎদি, জানো তো—ওসব লোকের সঙ্গে কোনো মেলামেশা না করাই ভালো৷ তুমি কানে আঙুল দেবে৷ অতি বদ লোক৷ কি মতলব নিয়ে এসেছিল কে জানে?
—তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার বাড়ি এলো, আমি কি বলে না বসাই! তা তো হয় না, আমায় আমার কাজ করতেই হবে৷
—সেই যে প্রভাস কামার তোমাদের মোটরে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল, সে লোকটাও ভালো না, পরে শুনলাম৷ বটুকদা প্রভাসের খুব বন্ধু ছিল আগে—তবে এখন অনেকদিন আর তাকে এ গাঁয়ে দেখি নি৷ তোমরা চলে গেলে একবার এসেছিল যেন—
শরতের মুখ হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল, সে তাড়াতাড়ি অন্য কথা পাড়লে একথা চাপা দিয়ে৷ বললে—চল৷ দিঘির পাড় থেকে গোটাকতক ধুঁধুল পেড়ে আনি—কিছু তরকারি নেই, বাবাকে বলা না বলা দুই সমান—
রাজলক্ষ্মী বললে, আর কোথাও যেয়ো না শরৎদি, দুটি বোন এই গাঁয়ে কাটিয়ে দিই জীবনটা৷ আমারও যা হবে, সে বেশ দেখতেই পাচ্ছি৷ তুমি থাকলে বেশ লাগে৷
—খারাপ কি বল না! আমি কত জায়গায় গেলাম, কিন্তু তোকে ছেড়ে—কালোপায়রার দিঘি ছেড়ে—
—যা বলেছ শরৎদি৷ তুমি এসেছ আমি আর কোথাও যেতে চাই নে, স্বর্গেও না৷ দুজনে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করি—
—আর চাল-ছোলা ভাজা খাই—না রে? ভাজি দুটো চাল-ছোলা?
—না না, শরৎদি৷ ওই তোমার পাগলামি—
—পাগলামি নিয়েই জীবন৷ আয় আমার সঙ্গে রান্নাঘরে, তার পর আবার দুজনে এসে বসব৷
রাজলক্ষ্মী আজকাল সর্বদা শরতের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে৷ সন্ধ্যার আগে একাই বাড়ি চলে যায়, শরৎ দিদির মুখে বাইরের জগতের কথা শুনতে ওর বড় আগ্রহ৷ যে একঘেয়ে জীবন আবাল্য সে কাটাচ্ছে গড়শিবপুরে, যার জন্যে তার মনে হয় এ একঘেয়েমির চেয়ে যে কোনো জীবন বাঞ্ছনীয়, যে কোনো ধরনের—শরৎ দিদি আজ কিছু দিন হল বিদেশ থেকে ফিরে সেই একঘেয়ে আবেষ্টনীর মধ্যে যেন আগ্রহ ও নতুনত্বের সঞ্চার করেছে৷ তা ছাড়া জীবনে শরৎ দিদিই তার একমাত্র ভালোবাসার লোক, ও দূরে চলে যাওয়াতে রাজলক্ষ্মীর জীবন শূন্য হয়ে পড়েছিল, এখন আবার গড়বাড়িতে এসে, ওর সঙ্গে বসে গল্প করে, ওর সামান্য কাজকর্মে সাহায্য করে রাজলক্ষ্মীর অবসর-ক্ষণ ভরে ওঠে৷
শরৎ বললে, রেণুকার চিঠির জবাব দিলাম অনেকদিন, উত্তর তো এল না?
—আসবে৷ অত ব্যস্ত কেন? দিন দশেক হল মোটে জবাব গিয়েছে৷ ঠিকানা লেখা ঠিক হয়েছিল তো?
—ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন জ্যাঠামশায়৷ উনি কি আর ভুল করবেন? আমার বড় মন কেমন করে খোকনমণির জন্যে৷ সে যদি চিঠি লিখতে পারত আমায় নিজের হাতে—
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, একেই বলে মায়া! কোথাকার কে তার ঠিক নেই—
শরৎ ব্যথা-কাতর কণ্ঠে বললে, অমন বলিস নে রাজি৷ তুই জানিস নে, সে আমার কি! কেন তাকে ভুলতে পারি নে তাই ভাবি৷ কখনো অমন হয় নি আমার, কাশীতে থাকবার শেষ একটা মাস যা হয়েছিল৷ খোকাকে না দেখলে পাগলের মতো হয়ে যেতাম বুঝলি? কষ্টও যা গিয়েছে! আচ্ছা বল তো, সত্যিই সে আমার কে? অথচ মনে হত কত জন্মের আপনার লোক সে, তার মুখ দিনান্তে একবার না দেখলে—ভালোই হয়েছে রাজি, সেখানে বেশিদিন থাকলে মায়ায় বড্ড জড়িয়ে পড়তাম৷ আর তেমনি ছিল মিনুর মা!
—সে কে শরৎদি?
—যাদের বাড়ি ছিলাম সে বাড়ির গিন্নি৷ বলব তোকে সব কথা একদিন৷ এখন না—
—কাশীর কথা শুনতে বড্ড ভালো লাগে তোমার মুখে—কখনো কিছু দেখি নি—যেন মনে হয় এখানে বসে দেখছি সব৷ আজ একটু ঠাণ্ডা পড়েছে, না শরৎদি?
—তা হেমন্তকাল এসে পড়েছে, একটু শীত পড়বার কথা৷ একটা নারকোল কুরতে হবে—দা খানা খুঁজে দ্যাখ ততক্ষণ—আমি ছোলাগুলো ততক্ষণ ভেজে ফেলি—
—কেন এত হাঙ্গামা করছ শরৎদি? দাঁড়াও আমি নারকোল কুরে দিই—
শরৎ বললে, দুজনে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করব আর চালভাজা—কি বলিস?
ছেলেমানুষের মতো উৎসাহ ও আগ্রহভরা কণ্ঠস্বর তার৷ এই জন্যই শরৎ দিদিকে রাজলক্ষ্মীর এত ভালো লাগে৷ এই পাড়াগাঁয়ে সব লোক যেন ঘুমুচ্ছে, তাদের না আছে কোনো বিষয়ে আগ্রহ, না শোনা যায় তাদের মুখে একটা ভালো কথা৷ অল্প বয়সে বুড়িয়ে যেতে হয় ওদের মধ্যে থাকলে৷ শরৎ দিদি এসে বাঁচিয়েছে৷
রাজলক্ষ্মী হঠাৎ মনে পড়বার সুরে বললে, ভালো কথা, বলতে মনে নেই শরৎদি, টুঙিমাজদে থেকে তোমার নামে একখানা চিঠি এসেছিল একবার—
শরৎ চমকে উঠে বললে—টুঙি-মাজদে! কই সে চিঠি?
—আছে বোধ হয় বাড়িতে, খুঁজে দেখব৷ তোমরা তখন এখানে ছিলে না—আমি রেখে দিয়েছিলাম—
—কতদিন আগে?
—তা ছ-সাত মাস কি তার বেশিও হবে৷ গত বোশেখ মাসে বোধ হয়৷ আচ্ছা শরৎদি ওখানে তোমার শ্বশুরবাড়ি—নয়?
শরৎ অন্যমনস্কভাবে বললে, হাঁ৷
একটুখানি চুপ করে কি ভেবে বললে, কে দিয়েছিল, জানিস?
—খামের চিঠি৷ আমি খুলে দেখি নি—কে আছে তোমার সেখানে?
শরৎ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে, নিয়ে আসিস চিঠিখানা, দেখব৷
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ৷ তারপর রাজলক্ষ্মী বললে, খাও শরৎদি, সন্দে হয়ে আসছে—
—হুঁ—
—নারকোল কেটে দেব আর একটু?
—না, তুই খেয়ে নে৷ উত্তর দেউলে সন্দে দেখিয়ে আসতে হবে—
—এখন রোদ রয়েছে গাছের ডগায়, অনেক দেরি এখনো, খেয়ে নাও না—
—আমি আর খাব না এখন৷
—তুমি না খেলে আমার এই রইল—
—না, না, আচ্ছা খাচ্ছি আমি—নে তুই৷ কাঁচালঙ্কা একটা নিয়ে আসি—
উত্তর দেউল থেকে সন্ধ্যা-প্রদীপ দিয়ে কিছুক্ষণ পরে ওরা ফিরছিল, কালোপায়রা দিঘির ওপাড়ের ঘন জঙ্গলে যেখানে ছাতিম ফুল ফুটে হেমন্তসন্ধ্যার বাতাস সুবাসিত করে তুলেছে৷ শ্যামলতার লম্বা কালো ডাঁটায় কুচো কুচো সুগন্ধ ফুল প্রত্যেক বর্ষাপুষ্ট ঝোপের মাথায়৷ পায়ে চলার পথ গত বর্ষায় ঘাসে ঢেকে আছে, ভাঙা ইটের স্তূপে শেওলা জমেছে, গড়ের জঙ্গল ঘন কালো দেখাচ্ছে আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে৷ রাজলক্ষ্মীকে বাড়ি ফিরতে হবে বলে ওরা সন্ধ্যা-প্রদীপ দেখানোর কাজ বেলা থাকতে সেরে এল৷
শরৎ বললে, অনেক মেটে আলু হয়ে আছে বনে, আজ দু-বছর এদিকে আসি নি—
—তুলবে একদিন শরৎদি? আমিও আসব—
বাড়ি গিয়ে শরৎ বললে, চল তোকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি—গড়ের খাল পর্যন্ত যাই৷ জল নেই তো খালে?
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কোথায়! বর্ষায় সামান্য জল হয়েছিল, শুকিয়ে গেছে৷
—থাক না আজ রাতটা! একা থাকব?
—বাড়িতে বলে আসি নি যে শরৎদি—নইলে আর কি৷ আচ্ছা কাল রাত্রে বরং থাকব৷ বাড়িতে বলে আসতে হবে কিনা!
রাজলক্ষ্মীকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসবার পথে শরৎ একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসলো৷ হেমন্তের সান্ধ্য-বাতাস কত কি বন্য পুষ্প, বিশেষত বনমরচে ও শ্যামলতার পুষ্পের সুবাসে ভারাক্রান্ত৷ দেউড়ির ভাঙা ইটের ঢিবির সর্বত্র-এ সময় বনমরচে লতায় ছেয়ে গিয়েছে, পুরনো রাজবাড়ি, লক্ষ্মীছাড়া দৈন্য তাদের শ্যামশোভায় আবৃত করে রেখেছে৷ রাজকন্যার সম্মান রেখেছে ওরা সেভাবে৷
কি হবে এখুনি ঘরে ফিরে৷ বেশ লাগে বাইরের বাতাস৷ ভয় নেই ওর মনে, যা ছিল তাও চলে গিয়েছে৷ তা ছাড়া ভয় কিসের? সবাই বলে ভূত আছে, অপদেবতা আছে—তার পূর্বপুরুষের অভ্যুদয়ের দিনের শত পুণ্য অনুষ্ঠানে এ বাড়ির মাটি পবিত্র, এ বাড়ির সে মেয়ে, আবাল্য সে এ-সব এইখানেই দেখে এসেছে—তার ভয় কিসের?
উত্তর দেউলের দেবী বারাহী তাদের মঙ্গল করবেন৷
সে ঘরে ফিরে ডুমুরের চচ্চড়ি রান্না করবে বাবা আর জ্যাঠামশায়ের জন্যে৷ জ্যাঠামশায় অনেক ডুমুর পেড়ে এনেছেন আজ কোথা থেকে৷ জ্যাঠামশায় বেশ লোক৷ ওঁকে সে আর কোথাও যেতে দেবে না৷ উনি না থাকলে কে তাকে আনতো কাশী থেকে? বাবার সঙ্গে কে আবার দেখা করিয়ে দিত? যতদিন উনি বাঁচেন, সে ওঁর সেবা-যত্ন করবে মেয়ের মতো৷
শরতের হঠাৎ মনে পড়ল, রাজলক্ষ্মীকে তার শ্বশুরবাড়ির সে পুরনো চিঠিখানা আনবার জন্যে মনে করিয়ে দেওয়া হয় নি আর একবার৷ টুঙি-মাজদিয়া! কত দিন সেখানে যাওয়া হয় নি! কে-ই বা আছে আর সেখানে? চিঠি লিখেছেন বোধ হয় খুড়শাশুড়ি৷ তাই হবে—তা ছাড়া আর কে? সেখানকার সব কিছু যখন শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন ভালো জ্ঞানই হয় নি শরতের৷ এক উৎসব-রজনীর চাঁপাফুলের সুগন্ধ আজও যেন নাকে লেগে আছে৷ কতকাল আগে বিস্মৃত মুহূর্তগুলির আবেদন—আজও তাদের ক্ষীণ বাণী অস্পষ্ট হয়ে যায় নি তো! বিস্মৃতির উপলেপন দিয়ে রেখেছে চলমান কাল, সেই মুহূর্তগুলির ওপর৷ তবে সে ভালোবাসে নি, ভালোবাসলে কেউ ভোলে না৷ তখনও বোঝবার, জানবার বয়স হয় নি তার৷
টুঙি-মাজদে তার শ্বশুরবাড়ি৷ ওখানকার ভাদুড়ীরা তার শ্বশুরবংশ—একসময়ে নাকি ভাদুড়ীদের অবস্থা খুব ভালো ছিল৷ এখন তাদেরই মতো৷
টুঙি-মাজদে! নামটা সে ভুলেই গিয়েছিল, রাজলক্ষ্মী আবার মনে করিয়ে দিলে৷
বনের মধ্যে কোথায় গম্ভীর স্বরে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে, শুনলে ভয় করে—যেন রাত্রিচর কোনো অপদেবতার কুস্বর! শরৎ অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে ঘরে গিয়ে রান্নাঘরে খিল দিয়ে রান্না চড়িয়ে দিলে৷
অনেক রাত্রে কেদার এসে ডাকাডাকি করেন—ও মা শরৎ, দোর খোলো—ওঠো—
দিন দশেক পরে একদিন রাজলক্ষ্মী এসে বললে, চললাম শরৎদি—
শরৎ বিস্ময়ের সুরে বললে, কি রে? কোথায় চললি?
—সব ঠিক৷ আমার বিয়ে হচ্ছে সতেরোই অঘ্রাণ—জানো না?
—তোর? সত্যি?
—সত্যি না তো মিথ্যে?
—বল শুনি—সত্যি? কোথায়?
রাজলক্ষ্মী বেশি কিছু জানে না বোঝা গেল৷ এখান থেকে মাইল দশেক দূরে দশঘরা বলে অজ এক পাড়াগাঁয়ে যার সঙ্গে সম্বন্ধ হয়েছে, তার বয়েস নাকি তত বেশি নয়, বিশেষ কিছু করে না, বাড়িতেই থাকে৷
শরৎ বললে, তোর পছন্দ হয়েছে?
—পছন্দ হলেও হয়েছে, না হলেও হয়েছে—
—তার মানে?
—তার মানে বাবার যখন পয়সা নেই, আমি যদি বলি আমার বর হাকিম হোক, হুকুম হোক, দারোগা হোক, তা হলে তো হবে না! যা জোটে তাই সই!
—এখন যা হয় হলে বাঁচি, না কি?
—তোমার মুণ্ডু৷
তার পর ওরা বনের মধ্যে মেটে আলু তুলতে গিয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত রইল৷ বনের মধ্যে এক জায়গায় একটা পাথরের থামের ভাঙা মুণ্ডুটা মাটিতে অর্ধেক পুঁতে আছে৷ রাজলক্ষ্মী সেটার ওপরে গিয়ে বসল৷ পাথরের গায়ে সামুদ্রিক কড়ির মতো বিট কাটা, মাঝে মাঝে পদ্মফুল এবং একটা দাঁড়ি৷ আবার কড়ি, পদ্ম ও দাঁড়ি—মালার আকারে সারা থামটা ঘুরে এসেছে৷ নীচের দিকে একরাশ কেঁচোর মাটি বাকি অংশটুকু ঢেকে রেখেছে৷
রাজলক্ষ্মী চেয়ে চেয়ে বললে, এই নক্সাটা কেমন চমৎকার শরৎদি! বুনলে ভালো হয়—দেখে নাও—
শরৎ বললে, এর চেয়েও ভালো নক্সা আছে ওই অশ্বত্থ গাছটার তলায়—একটা খিলেন ভেঙে পড়ে আছে, তার ইঁটের গায়ে৷ কিন্তু বড্ড বন ওখানে আর কাঁটা গাছ—
—তোমাদেরই সব তো—একদিন শুনেছি গড়বাড়ির চেহারা অন্যরকম ছিল, না?
—কি জানি ভাই, ও-সবের খবর আমি রাখি নে৷ আজকাল যা দেখছি, তাই দেখছি৷ তেল জোটে তো নুন জোটে না, নুন জোটে তো চাল জোটে না৷
তার পর শরৎ কি ভেবে আনন্দপূর্ণ কণ্ঠে বললে, সত্যি রাজি, খুব খুশি হয়েছি তোর বিয়ের কথা শুনে৷ কত যে ভেবেছি, কাশীতে থাকতে কতবার ভাবতাম, ভালো সম্বন্ধ পাই তো রাজির জন্যে দেখি৷ একবার দশাশ্বমেধ ঘাটে একটা চমৎকার ছেলে দেখে ভাবলাম, এর সঙ্গে যদি রাজির বিয়ে দিতে পারতাম, তবে—
রাজলক্ষ্মী চুপ করে রইল৷ সে যেন কি ভাবছে৷
শরৎ বললে, প্রভাসদার দেওয়া সেই মখমলের বাক্সটা আছে রে?
—হুঁ৷ স্নোটা সব খরচ হয়ে গেছে—আর সব আছে৷ দ্যাখো শরৎদি, সত্যি সত্যি একটা কথা বলি, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না তোমায় ছেড়ে—আমি একবার বলেছি, আবার বলছি, মনের কথা আমার—
তার পর রাজলক্ষ্মী উঠে ধীরে ধীরে শরতের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, শরৎদি, তুমি আমায় ভালোবাস?
শরৎ তাকে ঠেলে দিয়ে হেসে বললে, যাঃ—
রাজলক্ষ্মীর চোখ দিয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে জল পড়ল৷ সে অশ্রুসিক্ত স্বরে বললে, তুমি ভালোবাস বলেই বেঁচে আছি শরৎদি৷ তুমি গরিব হতে পারো, আমার কাছে তুমি গড়বাড়ির রাজার মেয়ে, এই দেউল, মন্দির, দিঘি, গড়, ঠাকুর-দেবতার মূর্তি সব তোমাদের, আমি তোমাদের প্রজার মেয়ে, একপাশে পড়ে থাকি—তুমি সুনজরে দ্যাখো বলে বার বার আসি—
শরৎ কৌতুকের সুরে বললে, খেপলি নাকি, রাজি? কী হয়েছে আজ তোর?
রাজলক্ষ্মী চলে যাবার কিছু পরে বটুক এসে ডাকলে, ও শরৎ—বাড়ি আছ?
শরৎ তখন স্নান করতে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে, বটুককে দেখে একটু বিব্রত হয়ে পড়ল৷
মুখে বললে, এসো বটুকদা—
—হ্যাঁ, এলাম, তুমি বুঝি—
—নাইতে বেরিয়েছি বটুকদা৷ রাজির সঙ্গে বন থেকে মেটে আলু তুলতে গিয়েছিলাম কিনা! না ডুব দিয়ে ঘরে-দোরে ঢুকব না—
—ও, তা আমি না হয় অন্য সময়—
—কোনো কথা ছিল?
—হ্যাঁ, না—কথা—তা একটু ছিল—তা—
বটুকের অবস্থা দেখে শরতের হাসি পেল৷ মনে মনে বললে, কি বলবি বল না—বলে চলে যা—কাণ্ড দ্যাখো একবার!
মুখে বললে, কি বটুকদা? কি কথা?
বটুক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে তার পর মরীয়ার সুরে বললে, প্রভাস এসেছিল কাল কলকাতা থেকে—
বলে সে শরতের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল৷
শরতের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এক মুহূর্তে৷ তার সমস্ত শরীর কেমন ঝিম-ঝিম করে উঠল৷ কিন্তু তখনি সামলে নিয়ে বললে, তা আমায় এ কথা কেন? আমি কি করব?
বটুক মাথা চুলকে বললে, না—তা—এমন কিছু নয়, এমন কিছু নয়৷ প্রভাসের সঙ্গে গিরীনবাবু বলে এক ভদ্রলোক ছিল৷ এই গিয়ে তারা বলছিল—
এই পর্যন্ত বলে বটুক একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলে৷
শরৎ দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন টলে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে বললে, কি বলছিল?
—বলছিল যে—
—বলো না কি বলছিল?
—মানে, ওরা—তোমার সঙ্গে একবার লুকিয়ে দেখা করতে চায়৷ নইলে গাঁয়ে সব কথা নাকি প্রকাশ করে দেবে!
—হুঁ—তোমাকে তারা চর করে পাঠিয়েছে বুঝি?
শরতের অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বটুক ভয় খেয়ে গেল৷ সুর নরম করে বললে—আমার ওপরে অনর্থক রাগ করছ তুমি৷ আমায় তারা বললে, তোমাকে কথাটা বলতে—কেউ টের পাবে না, গড়ের জঙ্গলের ওদিকে হোক কি রানীদিঘির পাড়ে হোক—কি তারা বলবে তোমায়৷ আমায় বললে, বলে এসো৷ তারা কলকাতায় চলে গিয়েছে, আবার আসবে৷ নয়তো কলকাতায় কি হয়েছিল না হয়েছিল, সব গাঁয়ে প্রকাশ করে দিয়ে যাবে—
শরৎ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ৷ কোনো কথা নেই তার মুখে৷ তার মূর্তি দেখে বটুকের ভয় হল৷ সে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় শরৎ স্থিরগলায় বললে, বটুকদা, তোমার বন্ধুদের বোলো আমি লুকিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা কোনোদিন করব না৷ তাদের সাহস থাকে বাবা আর জ্যাঠামশায়ের সামনে এসে যেন দেখা করে৷ আমরা গরিব আছি, তাই কি—আমাদেরও মান আছে৷ না হয় তারা বড়লোকই আছে৷
বটুক বললে, না—এর মধ্যে আর গরিব বড়লোকের কথা কি?
—আর একটা কথা বটুকদা! তুমি না গাঁয়ের ছেলে? তোমার উচিত কলকাতায় সেই সব বখাটে বদমাইশদের তরফ থেকে আমায় এ-সব কথা বলা? আমি না তোমার ছোট বোনের মতো? তোমায় না দাদা বলে ডাকি? তুমি এসেছ চর সেজে?
বটুক আমতা আমতা করে বললে, আমি কি করব, আমি কি করব—তোমার ভালোর জন্যেই—
শরৎ পূর্ববৎ স্থিরকণ্ঠেই বললে, আমার বাড়ি তুমি এসেছ—আমার বলতে বাধে, তবুও আমি বলছি—আমার এখানে তুমি এসো না—আমার ভালো তোমায় করতে হবে না৷
বটুক ততক্ষণে ভগ্ন দেউড়ির পথে অদৃশ্য হয়েছে৷