কেদার রাজা (Kedar Raja) : 13
দিন দশ-পনেরো কেটে গেল৷
এ দিনগুলো কেদার ও গোপেশ্বরের কাটলো খুব ভালোই৷ ছিবাস মুদির দোকানে প্রায়ই সন্ধ্যার পর ছেঁড়া মাদুর আর চট পেতে আসর জমে, কেদার এসেছেন শুনে তাঁর পুরনো কৃষ্ণযাত্রা দলের দোহার, জুড়ি, এখানে গায়কেরা কেউ জাল রেখে, কেউ লাঙল ফেলে ছুটে আসে৷
—রাজামশাই! ভালো ছেলেন তো? এট্টু পায়ের ধুলো দ্যান—
—বাবাঠাকুর, এ্যাদ্দিন ছেলেন কনে? মোদের দল যে একেবারে কানা পড়ে গেল আপনার জন্যি!
গেঁয়োহাটি কাপালি পাড়ার মধু কাপালি, নেত্য কাপালি এসে পীড়াপীড়ি—গেঁয়োহাটিতে একবার না গেলে চলবে না৷ সবাই রাজামশাইকে একবার দেখতে চায়৷ এদের ওপর কেদারের যথেষ্ট আধিপত্য, অন্য সময় যে কেদার নিতান্ত নিরীহ—এদের দলের দলপতি হিসাবে তিনি রীতিমতো কড়া ও উগ্র মেজাজের শাসক৷
মধুকে ডেকে বললেন, তোর যে সেই ভাইপো দোয়ার দিত সে কোথায়?
—আজ্ঞে সে পাট কাটছে মাঠে—
কেদার মুখ খিঁচিয়ে বলেন, পাট তো কাটছে বুঝতে পারছি, চাষার ছেলে পাট কাটবে না তো কি বড় গাইয়ে হবে? কাল একবার ছিবাসের ওখানে পাঠিয়ে দিয়ো তো, বুঝলে?
—যে আজ্ঞে রাজামশাই—
—আর শশীকে খবর দিয়ো, দু-বছরের খাজনা বাকি৷ খাজনা দিতে হবে না? নিষ্কর জমি ভোগ করতে লাগল যে একেবারে—
নেত্য কাপালি এগিয়ে এসে বললে, বাবাঠাকুর, আপনি যদি বাড়ি থাকতেন, তবে, সবই হত৷ তারা খাজনা নিয়ে এসে ফিরে গিয়েল—
কেদার ধমক দিয়ে বললেন, তুই চুপ কর—তোকে ফোপর-দালালি করতে বলেছে কে?
কেদারের নামে বহু লোক জড়ো হয় ছিবাসের দোকানে—কেদারের বেহালার সঙ্গে মিশেছে ওস্তাদ গোপেশ্বরের তবলা৷ পাড়াগাঁয়ে নিঃসঙ্গ দিনেরাত্রে সময় কাটাবার এতটুকু সূত্রও যারা নিতান্ত আগ্রহে আঁকড়ে ধরে—তাদের কাছে এ ধরনের গুণী-সম্মেলনের মূল্য অনেক বেশি৷ দু-তিনখানা গ্রাম থেকে লোকে লণ্ঠন হাতে লাঠি হাতে জুতো বগলে করে এসে জোটে৷ সেই পুরনো দিনের মতো অনেক রাত্রে দুজনেই অপরাধীর মতো বাড়ি ফেরেন৷
শরৎ বলে, এলে? ভাত জুড়িয়ে জল হয়ে গিয়েছে—
গোপেশ্বর আমতা আমতা করে বলেন—আমি গিয়ে বললাম মা রাজামশায়কে—যে শরৎ বসে থাকবে হাঁড়ি নিয়ে—তা হয়েছে কি, উনি সত্যিকার গুণী লোক, ছড়ে ঘা পড়লে আর স্থির থাকতে পারেন না৷ জ্ঞান থাকে না মা—
কেদার গোপেশ্বরের পেছনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কৈফিয়ৎ তৈরি করেন৷
শরৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, আপনি জানেন না জ্যাঠামশায়, বাবার চিরকাল একরকম গেল আর যাবেও৷ আজ বলে না, কোন কালে ওঁর ছিল জ্ঞান, ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন না?
গোপেশ্বর মিটমাটের সুরে বলেন, না না, কাল থেকে রাজামশাই আর দেরি করা হবে না৷ শরতের বড্ড কষ্ট হয়, কাল থেকে আমি সকাল সকাল নিয়ে আসব মা, রাত করতে দেব না—
এই দুই বৃদ্ধের ওপর শাসনদণ্ড পরিচালনা করে শরৎ মনে মনে খুব আমোদ পায় এবং এঁদের সঙ্কোচজড়িত কৈফিয়তের সুরে যথেষ্ট কৌতুক অনুভব করে—কিন্তু কোনো তর্জনগর্জনেই বিশেষ ফল হয় না, প্রতি রাত্রেই যা তাই—সেই রাত একটা৷ নির্জন গড়বাড়ির জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকার গভীর আওয়াজের সঙ্গে মিশে শরতের শাসনবাক্য বৃথাই প্রতি রাত্রে নিশীথের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে৷
শরৎ বলে—আজ কিছু নেই বাবা, কি দিয়ে ভাত দেব তোমাদের পাতে? হাট না, বাজার না, একটা তরকারি নেই ঘরে, আমি মেয়েমানুষ যাব তরকারি যোগাড় করতে? ওল তুলেছিলাম কালোপায়রার পাড় থেকে একগলা জঙ্গলের মধ্যে—তাই ভাতে আর ভাত খাও—এত রাত্তিরে কি করব আমি?
কেদার সঙ্কুচিত ভাবে বললেন, ওতেই হবে—ওতেই হবে—
—তুমি না হয় বললে ওতেই হবে, জ্যাঠামশায় বাড়িতে রয়েছেন, ওঁর পাতে শুধু ওল ভাতে দিয়ে কি করে—
গোপেশ্বর তাড়াতাড়ি বলেন, যথেষ্ট, মা যথেষ্ট৷ তুমি দাও দিকি৷ ভেসে যাবে—কাঁচালঙ্কা দিয়ে ওল ভাতে মেখে এক পাথর ভাত খাওয়া যায় মা—
—তবে খান৷ আমার আপত্তি কি?
—কাল গেঁয়োহাটির হাট থেকে আমি ঝিঙে পটল আনব দুটো—মনে করে দিয়ো তো?
শরতের কি আমোদই লাগে! কতদিন পরে আবার পুরাতন জীবনের পুনরাবৃত্তি চলছে—আবার যে প্রতি নিশীথে গড়বাড়ির জঙ্গলের মধ্যে তাদের ভাঙা বাড়িতে সে একা শুয়ে থাকবে, বাবা এসে অপ্রতিভ কণ্ঠে বলবেন—ও মা শরৎ, দোর খুলে দাও মা,—এসব কখনো হবে বলে তার বিশ্বাস ছিল?
সেই সব পুরনো দিন আবার ঠিক সেই ভাবেই ফিরে এসেছে….
—জ্যাঠামশাইয়ের জন্যে একটু দুধ রেখেছি—ভাত কটা ফেলবেন না জ্যাঠামশায়—
গোপেশ্বর ব্যস্তভাবে বললেন, কেন, আমি কেন—রাজামশায়ের দুধ কই?
—বাবার হবে না৷ দু-হাতা দুধ মোটে—
—না না, সে কি হয় মা? রাজামশায়ের দুধ ও থেকেই—
কেদার ধীরভাবে বললেন, আমার দুধের দরকার নেই৷ আমরা রাজারাজড়া লোক, খাই তো আড়াইসের মেরে একসের করে খাব৷ ও দু-এক হাতা দুধে আমাদের—
কথা শেষ না করেই হা-হা করে প্রাণখোলা উচ্চ হাসির রবে কেদার রান্নাঘর ফাটিয়ে তুললেন৷
এইরকম রাত্রে একদিন গোপেশ্বর ভয় পেলেন কালোপায়রা দিঘির পাড়ের জঙ্গলে৷ বেশি রাত্রে তিনি কি জন্যে দিঘির পাড়ের দিকে গিয়েছিলেন—সেদিন আকাশে একটু মেঘ ছিল, ঘুম ভেঙে তিনি রাত কত তা ঠিক আন্দাজ করতে পারলেন না৷ দিঘির জঙ্গলের দিকে একাই গেলেন৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পরে কোথায় যেন পদক্ষেপের শব্দ তাঁর কানে গেল—গুরুগম্ভীর পদক্ষেপের শব্দ৷ উৎকর্ণ হয়ে কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে পা ফেলে চলেছে—তাঁর দিকেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে নাকি? চোর-টোর হবে কি তা হলে? না কোনো ছাড়া গরু বা ষাঁড়—
কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে হল এ পায়ের শব্দ মানুষের নয়—গরু বা ষাঁড়েরও নয়৷ পদশব্দের সঙ্গে কোনো কঠিন জিনিসের যোগ আছে—খুব ভারি ও কঠিন কোনো জিনিস৷
এক-একবার শব্দটি থেকে যায়—হয়তো এক মিনিট….তার পরেই আবার….
হঠাৎ গোপেশ্বরের মনে হল শব্দটি যেন—তাঁকেই লক্ষ্য করে হোক বা নাই হোক—মোটের ওপর খুব কাছে এসে গিয়েছে৷ তিনি আর কালবিলম্ব না করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকতেই পাশের বিছানা থেকে কেদার জেগে উঠে বললেন কি, কি—অমন করছ কেন দাদা?
—ইয়ে, একবার বাইরে গিয়েছিলাম—কিসের শব্দ—তাই ছুটে চলে এলাম—কেমন যেন গা ছম-ছম—
—শব্দ? ও শেয়াল-টেয়াল হবে—
—না দাদা, মানুষের পায়ের শব্দের মতো, ভারি পায়ের শব্দ—যেন ইট পড়ার মতো—
কেদার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হুঁ, আজ কি তিথি?
—তা কি জানি, তিথি-টিথির কোনো খোঁজ রাখি নে তো—
—হুঁ৷ নাও শুয়ে পড় দাদা…একটা কথা বলি অমন একা রাত্তির বেলা যেখানে-সেখানে যেয়ো না—দরকার হয় ডাক দিয়ো!
রাজলক্ষ্মী দুপুরবেলা হাসিমুখে একখানা চিঠি হাতে করে এসে বললে, ও শরৎদি, তোমার নামে কে চিঠি দিয়েছে দ্যাখো—
শরৎ সবিস্ময়ে বললে, আমার নামে! কে আনলে?
—দাদার সঙ্গে পিওনের দেখা হয়েছিল বাজারে—তাই দিয়েছে—
—দেখি দে—
—কোথাকার ভাবের মানুষ চিঠি দিয়েছে দ্যাখো খুলে—
বলে রাজলক্ষ্মী দুষ্টুমির হাসি হাসলে!
শরৎ ভ্রূকুটি করে বললে, মারব খ্যাংরা মুখে যদি ওরকম বলবি—তোর ভাবের মানুষেরা তোকে চিঠি দিক গিয়ে—জন্মজন্ম দিক গিয়ে—
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক শরৎদি, তাই বলো—তাই যেন হয়৷
—ওমা, অবাক করলি যে রে রাজি! সত্যি তাই তোর ইচ্ছে নাকি?
—যদি বলি তাই?
—ওমা, আমার কি হবে!
—অমন বোলো না শরৎদি৷ তুমি এক ধরনের মানুষ, তোমার কথা বাদ দিই—কিন্তু মেয়েমানুষ তো, ভেবে দ্যাখো৷ আমার বয়েস কত হয়েছে হিসেব রাখো?
শরৎ সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললে, কেউ আটকে রাখতে পারবে না যেদিন ফুল ফুটবে, বুঝলি রাজি? কাকাবাবুর হাতে পয়সা থাকলে কি আর এতদিন—ফুল যেদিন ফুটবে—
—ফুল ফুটবে ছাতিমতলার শ্বশান-সই হলে—নাও, তুমি যেমন! খোলো চিঠিখানা দেখি—শরৎ চিঠি খুলে পড়ে বললে, কাশী থেকে রেণুকা চিঠি দিয়েছে—বাঃ—
—সে কে শরৎদি?
—সে একটা অন্ধ মেয়ে৷ বিয়ে হয়েছে অবিশ্যি৷ গরিব গেরস্ত, এ চিঠি তার বরের হাতে লেখা, সে তো আর লিখতে—
—কাশীতে থাকে? কি করে ওর বর?
—চাকরি করে কোথায় যেন—
—দেখতে কেমন?
—কে দেখতে কেমন? মেয়েটা না তার বর?
—দুই-ই৷
— রেণুকা দেখতে মন্দ নয়, বর তার চেয়েও ভালো—ছোকরা বয়েস, লোক ভালোই ওরা৷ দ্যাখ না চিঠি পড়ে!
—অন্ধ মেয়েরও বিয়ে আটকে থাকে না, যদি কপাল ভালো হয়—
—হ্যাঁ রে হ্যাঁ৷ তোর আর বকামি করতে হবে না—পড় চিঠি—
রেণুকা অনেক দুঃখ করে চিঠি লিখেছে৷ শরৎ চলে গিয়ে পর্যন্ত সে একা পড়েচে, আর কে তার ওপর দয়া করবে, কে তার হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যাবে? ওঁর মোটে সময় হয় না৷ তার মন আকুল হয়েচে শরৎকে দেখবার জন্য, রাজকন্যা কবে এসে কাশীতে ‘কেদার ছত্র’ খুলছে? এলে যে রেণুকা বাঁচে—ইত্যাদি৷
চিঠি পড়ে শরৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল৷ অসহায়া অভাগী রেণুকা! ছোট বোনটির মতো কত যত্নে শরৎ তাকে নিয়ে বেড়াত—কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাট, জলে ভাসমান নৌকো ও বজরার ভিড়, বিশ্বেশ্বরের মন্দিরে সান্ধ্য-আরতির ঘণ্টা ও নানা বাদ্যধ্বনি৷…রেণুকার করুণ মুখখানি৷ এখানে বসে সব স্বপ্নের মতো মনে হয়৷ খোকা—খোকনমণি! রেণুকা খোকনের কথা কিছু লেখে নি কেন? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল রেণুকাকে কে বকসীদের বাড়ি নিয়ে যাবে হাত ধরে অত দূরে? তাই লিখতে পারে নি৷
রাজলক্ষ্মী কৌতূহলের সঙ্গে নানা প্রশ্ন করতে লাগল কাশী ও সেখানকার মানুষ-জন সম্বন্ধে, বহির্জগৎ সম্বন্ধে৷ শরৎ বিরাট অন্নসত্রগুলোর গল্প করল, রাজরাজেশ্বরী, আমবেড়ে, কুচবিহারের কালীবাড়ি৷
হেসে বললে, জানিস এক বুড়ি তৈলঙ্গিদের ছত্তরদের বলত তুণ্ডুমুণ্ডুদের ছত্তর!
—তৈলঙ্গি কারা?
—সে আমিও জানি নে—তবে তাদের দেখেছি বটে৷
রাজলক্ষ্মী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে৷ বাইরের জগৎ মস্ত একটা স্বপ্ন৷ জীবনে কিছুই দেখা হল না, একেবারে বৃথা গেল জীবনটা৷ শরৎদির ওপর হিংসে না হয়ে পারে?