কৃষ্ণকান্তের উইল – ১ম খণ্ড – ১১-১৫
একাদশ পরিচ্ছেদ
গোবিন্দলাল কৃষ্ণকান্ত রায়ের সদর কাছারিতে দর্শন দিলেন।
কৃষ্ণকান্ত প্রাতঃকালেই কাছারিতে বসিয়াছিলেন। গদির উপর মসনকদ করিয়া বসিয়া, সোণার আলবোলায় অম্বুরি তামাকু চড়াইয়া, মর্ত্যলোকে স্বর্গের অনুকরণ করিতেছিলেন। এক পাশে রাশি রাশি দপ্তরে বাঁধা চিঠা, খতিয়ান, দাখিলা, জমাওয়াশীল, থোকা, করচা বাকি জায়, শেহা, রোকড়–আর এক পাশে নায়েব গোমস্তা, কারকুন, মুহরি, তহদিলদার, আমীন, পাইক, প্রজা। সম্মুখে অধোবদনা অবগুণ্ঠনতী রোহিণী।
গোবিন্দলাল আদরের ভ্রাতুষ্পুত্র। প্রবেশ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে জ্যেঠা মহাশয়?”
তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া, রোহিণী অবগুণ্ঠন ঈষৎ মুক্ত করিয়া, তাঁহার প্রতি ক্ষণিক কটাক্ষ করিল।কৃষ্ণকান্ত তাঁহার কথায় কি উত্তর করিলেন, তৎপ্রতি গোবিন্দলাল বিশেষ মনোযোগ করিতে পারিলেন না; ভাবিলেন, সেই কটাক্ষের অর্থ কি। শেষ সিদ্ধান্ত করিলেন, “এ কাতর কটাক্ষের অর্থ, ভিক্ষা |”
কি ভিক্ষা? গোবিন্দলাল ভাবিলেন, আর্তের ভিক্ষা আর কি? বিপদ হইতে উদ্ধার। সেই বাপীতীরে সোপানোপরে দাঁড়াইয়া যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহাও তাঁহার এই সময়ে মনে পড়িল। গোবিন্দলাল রোহিণীকে বলিয়াছিলেন, “তোমার যদি কোন বিষয়ের কোন কষ্ট থাকে, তবে আজি হউক, আমাকে জানাইও |” আজি ত রোহিণীর কষ্ট বটে, বুঝি এই ইঙ্গিতে রোহিণী তাঁহাকে তাহা জানাইল।
গোবিন্দলাল মনে মনে ভাবিলেন, “তোমার মঙ্গল সাধি ইহা আমার ইচ্ছা; কেন না, ইহলোকে তোমার সহায কেহ নাই দেখিতেছি। কিন্তু তুমি যে লোকের হাতে পড়িয়াছ–তোমার রক্ষা সহজ নহে |” এই ভাবিয়া প্রকাশ্যে জ্যেষ্ঠতাতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে জ্যেঠা মহাশয়?”
বৃদ্ধ কৃষ্ণকান্ত একবার সকল কথা আনুপূর্বিক গোবিন্দলালকে বলিয়াছিলেন, কিন্তু গোবিন্দলাল রোহিণীর কটাক্ষের ব্যাখ্যায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন, কানে কিছুই শুনেন নাই। ভ্রাতুষ্পুত্র আবার জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে, জ্যেঠা মহাশয়?” শুনিয়া বৃদ্ধ মনে মনে ভাবিল, “হয়েছে! ছেলেটা বুঝি মাগীর চাঁদপানা মুখখানা দেখে ভুলে গেল!” কৃষ্ণকান্ত আবার আনুপূর্বিক গত রাত্রের বৃত্তান্ত গোবিন্দলালকে শুনাইলেন। সমাপন করিয়া বলিলেন, “এ সেই হরা পাজির কারসাজি। বোধ হইতেছে, এ মাগী তাহার কাছে টাকা খাইয়া, জাল উইল রাখিয়া, আসল উইল চুরি করিবার জন্য আসিয়াছিল। তার পর ধরা পড়িয়া ভয়ে জাল উইল ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে |”
গো। রোহিণী কি বলে?
কৃ। ও আর বলিবে কি? বলে, তা নয়।
গোবিন্দলাল রোহিণীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা নয় ত তবে কি রোহিণী?”
রোহিণীর মুখ না তুলিয়া, গদ্গদ কণ্ঠে বলিল, “আমি আপনাদের হাতে পড়িয়াছি, যাহা করিবার হয় করুন। আমি আর কিছু বলিব না |”
কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “দেখিলে বদ্জা তি?”
গোবিন্দলাল মনে মনে ভাবিলেন, “এ পৃথিবীতে সকলেই বদ্জািত নহে। ইহার ভিতর বদ্জা তি ছাড়া আর কিছু থাকিতে পারে। প্রকাশ্যে বলিলেন, “ইহার প্রতি কি হুকুম দিয়াছেন? একে কি থানায় পাঠাইবেন?”
কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “আমার কাছে আবার থানা ফৌজদারি কি! আমিই থানা, আমিই মেজেষ্টর, আমিই জজ। বিশেষ এই ক্ষুদ্র স্ত্রীলোককে জেলে দিয়া আমার কি পৌরুষ বাড়িবে?”
গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি করিবেন?”
কৃ। ইহার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, কুলার বাতাস দিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিব। আমার এলেকায় আর না আসিতে পারে।
গোবিন্দলাল আবার রোহিণীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বল, রোহিণি?”
রোহিণী বলিল, “ক্ষতি কি!”
গোবিন্দলাল বিস্মিত হইলেন। কিঞ্চিৎ ভাবিয়া কৃষ্ণকান্তকে বলিলেন, “একটা নিবেদন আছে |”
কৃ। কি?
গো। ইহাকে একবার ছাড়িয়া দিন। আমি জামিন হইতেছি–বেলা দশটার সময়ে আনিয়া দিব।
কৃষ্ণকান্ত ভাবিলেন, “বুঝি যা ভাবিতেছি, তাই। বাবাজির কিছু গরজ দেখছি|” প্রকাশ্যে বলিলেন, “কোথায় যাইবে? কেন ছাড়িব?”
গোবিন্দলাল বলিলেন, “আসল কথা কি, জানা নিতান্ত কর্তব্য। এত লোকের সাক্ষাতে আসল কথা এ প্রকাশ করিবে না। ইহাকে একবার অন্দরে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিব |”
কৃষ্ণকান্ত ভাবিলেন, “ওর গোষ্ঠীর মুণ্ডু কর্বে। এ কালের ছেলেপুলে বড় বেহায়া হয়ে উঠেছে। রহ ছুঁচো! আমিও তোর উপর এক চাল চালিব |” এই ভাবিয়া কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “বেশ ত |” বলিয়া কৃষ্ণকান্ত একজন নগ্দীকে বলিলেন, “ও রে! একে সঙ্গে করিয়া, একজন চাকরাণী দিয়া, মেজ বৌমার কাছে পাঠিয়ে দে ত, দেখিস, যেন পালায় না |”
নগ্দী রোহিণীকে লইয়া গেল। গোবিন্দলাল প্রস্থান করিলেন, কৃষ্ণকান্ত ভাবিলেন, “দুর্গা! দুর্গা! ছেলেগুলো হলো কি?”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
গোবিন্দলাল অন্তঃপুরে আসিয়া দেখিলেন যে, ভ্রমর, রোহিণীকে লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাল কথা বলিবার ইচ্ছা, কিন্তু পাছে এ দায় সম্বন্ধে ভাল কথা বলিলেও রোহিণীর কান্না আসে, এ জন্য তাহাও বলিতে পারিতেছে না। গোবিন্দলাল আসিলেন দেখিয়া ভ্রমর যেন দায় হইতে উদ্ধার পাইল। শীঘ্রগতি দূরে গিয়া গোবিন্দলালকে ইঙ্গিত করিয়া ডাকিল। গোবিন্দলাল ভ্রমরের কাছে গেলেন, ভ্রমর গোবিন্দলালকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “রোহিণী এখানে কেন?”
গোবিন্দলাল বলিলেন, “আমি গোপনে উহাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিব। তাহার পর উহার কপালে যা থাকে, হবে|”
ভ্র। কি জিজ্ঞেস করিবে?
গো। উহার মনের কথা। আমাকে উহার কাছে একা রাখিতে যাইতে যদি তোমার ভয় হয়, তবে না হয়, আড়াল হইতে শুনিও।
ভোমরা বড় অপ্রতিভ হইল। লজ্জায় অধোমুখী হইয়া, ছুটিয়া সে অঞ্চল হইতে পলাইল। একেবারে পাকশালায় উপস্থিত হইয়া, পিছন হইতে পাচিকার চুল ধরিয়া টানিয়া বলিল, “রাঁধুনি ঠাকুরঝি! রাঁধতে রাঁধতে একটি রূপকথা বল না |”
এ দিকে গোবিন্দলাল, রোহিণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বৃত্তান্ত আমাকে সকল বিশেষ করিয়া বলিবে কি?” বলিবার জন্য রোহিণীর বুক ফাটিয়া যাইতেছিল–কিন্তু যে জাতি জীয়ন্তে জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করিত, রোহিণীও সেই জাতীয়া–আর্যকন্যা। বলিল, “কর্তার কাছে সবিশেষে শুনিয়াছেন ত!”
গো। কর্তা বলেন, তুমি জাল উইল রাখিয়া, আসল উইল চুরি করিতে আসিয়াছিলে। তাই কি?
রো। তা নয়।
গো। তবে কি?
রো। বলিয়া কি হইবে?
গো। তোমার ভাল হইতে পারে।
রো। আপনি বিশ্বাস করিলে ত?
গো। বিশ্বাসযোগ্য কথা হইলে কেন বিশ্বাস করিব না?
রো। বিশ্বাসযোগ্য কথা নহে।
গো। আমার কাছে কি বিশ্বাসযোগ্য, কি অবিশ্বাসযোগ্য, তাহা আমি জানি, তুমি জানিবে কি প্রকারে? আমি অবিশ্বাসযোগ্য কথাতেও কখনও কখনও বিশ্বাস করি।
রোহিণী মনে মনে বলিল, “নহিলে আমি তোমার জন্যে মরিতে বসিব কেন? যাই হৌক, আমি ত মরিতে বসিয়াছি, কিন্তু তোমায় একবার পরীক্ষা করিয়া মরিব |” প্রকাশ্যে বলিল, “সে আপনার মহিমা। কিন্তু আপনাকে এ দুঃখের কাহিনী বলিয়াই বা কি হইবে?”
গো। যদি আমি তোমার কোন উপকার করিতে পারি।
রো। কি উপকার করিবেন?
গোবিন্দলাল ভাবিলেন, “ইহার জোড়া নাই। যাই হউক, এ কাতরা–ইহাকে সহজে পরিত্যাগ করা নহে|” প্রকাশ্যে বলিলেন, “যদি পারি কর্তাকে অনুরোধ করিব। তিনি তোমায় ত্যাগ করিবেন |”
রো। আর যদি আপনি অনুরোধ না করেন, তবে তিনি আমায় কি করিবেন?
গো। শুনিয়াছ ত?
রো। আমার মাথা মুড়াইবেন, ঘোল ঢালিয়া দিবেন, দেশ হইতে বাহির করিয়া দিবেন। ইহার ভাল মন্দ কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।–এ কলঙ্কের পর, দেশ হইতে বাহির করিয়া দিলেই আমার উপকার। আমাকে তাড়াইয়া না দিলে, আমি আপনিই এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইব। আর এ দেশে মুখ দেখাইব কি প্রকারে? ঘোল ঢালা বড় গুরুতর দণ্ড নয়, ধুইলেই ঘোল যাইবে। বাকি এই কেশ–
এই বলিয়া রোহিণী একবার আপনার তরঙ্গক্ষুব্ধ কৃষ্ণতড়াগতুল্য কেশদাম প্রতি দৃষ্টি করিল–বলিতে লাগিল, “এই কেশ–আপনি কাঁচি আনিতে বলুন, আমি বৌ ঠাকরুণের চুলের দড়ি বিনাইবার জন্য ইহার সকলগুলি কাটিয়া দিয়া যাইতেছি |”
গোবিন্দলাল ব্যথিত হইলেন। দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “বুঝেছি রোহিণী। কলঙ্কই তোমার দণ্ড। সে দণ্ড হইতে রক্ষা না হইলে, অন্য দণ্ডে তোমার আপত্তি নাই|”
রোহিণী এবার কাঁদিল। হৃদয়মধ্যে গোবিন্দলালকে শত সহস্র ধন্যবাদ করিতে লাগিল। বলিল, “যদি বুঝিয়াছেন, এ কলঙ্কদণ্ড হইতে কি আমায় রক্ষা করিতে পারিবেন?”
গোবিন্দলাল কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “বলিতে পারি না। আসল কথা শুনিতে পাইলে, বলিতে পারি যে, পারিব কি না |”
রোহিণী বলিল, “কি জানিতে চাহেন, জিজ্ঞাসা করুন |”
গো। তুমি যাহা পোড়াইয়াছ, তাহা কি?
রো। জাল উইল।
গো। কোথায় পাইয়াছিলে?
রো। কর্তার ঘরে, দেরাজে।
গো। জাল উইল সেখানে কি প্রকারে আসিল?
রো। আমিই রাখিয়া গিয়াছিলাম। যে দিন আসল উইল লেখাপড়া হয়, সেই দিন রাত্রে আসিয়া, আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল রাখিয়া গিয়াছিলাম।
গো। কেন, তোমার কি প্রয়োজন?
রো। হরলাল বাবুর অনুরোধে।
গোবিন্দলাল বলিলেন, “তবে কাল রাত্রে আবার কি করিতে আসিয়াছিলে?”
রো। আসল উইল রাখিয়া, জাল উইল চুরি করিবার জন্য।
গো। কেন? জাল উইলে কি ছিল?
রো। বড় বাবুর বার আনা–আপনার এক পাই।
গো। কেন আবার উইল বদলাইতে আসিয়াছিলে? আমি ত কোন অনুরোধ করি নাই।
রোহিণী কাঁদিতে লাগিল। বহু কষ্টে রোদন সংবরণ করিয়া বলিল, “না–অনুরোধ করেন নাই–কিন্তু যাহা আমি ইহজন্মে কখনও পাই নাই–যাহা ইহজন্মে আর কখনও পাইব না–আপনি আমাকে তাহা দিয়াছিলেন |”
গো। কি সে রোহিণী?
রো। সেই বারুণী পুকুরের তীরে, মনে করুন।
গো। কি রোহিণী?
রো। কি? ইহজন্মে আমি বলিতে পারিব না–কি। আর কিছু বলিবেন না। এ রোগের চিকিৎসা নাই–আমার মুক্তি নাই। আমি বিষ পাইলে খাইতাম। কিন্তু সে আপনার বাড়ীতে নহে। আপনি আমার অন্য উপকার করিতে পারেন না–কিন্তু এক উপকার করিতে পারেন,–একবার ছাড়িয়া দিন, কাঁদিয়া আসি। তার পর যদি আমি বাঁচিয়া থাকি, তবে না হয়, আমার মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবেন।
গোবিন্দলাল বুঝিলেন। দর্পণস্থ প্রতিবিম্বের ন্যায় রোহিণীর হৃদয় দেখিতে পাইলেন। বুঝিলেন, যে মন্ত্রে ভ্রমর মুগ্ধ, ভুজঙ্গীও সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়াছে। তাঁহার আহ্লাদ হইল না–রাগও হইল না–সমুদ্রবৎ সে হৃদয়, তাহা উদ্বেলিত করিয়া দয়ার উচ্ছ্বাস উঠিল। বলিলেন, “রোহিণী, মৃত্যুই বোধ হয় তোমার ভাল, কিন্তু মরণে কাজ নাই। সকলেই কাজ করিতে এ সংসারে আসিয়াছি। আপনার আপনার কাজ না করিয়া মরিব কেন?”
গোবিন্দলাল ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। রোহিণী বলিল, “বলুন না?”
গো। তোমাকেও এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে।
রো। কেন?
গো। তুমি আপনিই ত বলিয়াছিলে, তুমি এ দেশ ত্যাগ করিতে চাও।
রো। আমি বলিতেছিলাম লজ্জায়, আপনি বলেন কেন?
গো। তোমার আমায় আর দেখাশুনা না হয়।
রোহিণী দেখিল, গোবিন্দলাল সব বুঝিয়াছেন। মনে মনে বড় অপ্রতিভ হইল–বড় সুখী হইল। তাহার সমস্ত যন্ত্রণা ভুলিয়া গেল। আবার তাহার বাঁচিতে সাধ হইল। আবার তাহার দেশে থাকিতে বাসনা জন্মিল। মনুষ্য বড়ই পরাধীন।
রোহিণী বলিল, “আমি এখনই যাইতে রাজি আছি। কিন্তু কোথায় যাইব?”
গো। কলিকাতায়। সেখানে আমি আমার এক জন বন্ধুকে পত্র দিতেছি। তিনি তোমাকে একখানি বাড়ী কিনিয়া দিবেন, তোমার টাকা লাগিবে না।
রো। আমার খুড়ার কি হইবে?
গো। তিনি তোমার সঙ্গে যাইবেন, নহিলে তোমাকে যাইতে বলিতাম না।
রো। সেখানে দিনপাত করিব কি প্রকারে?
গো। আমার বন্ধু তোমার খুড়ার একটি চাকরি করিয়া দিবেন।
রো। খুড়া দেশত্যাগে সম্মত হইবেন কেন?
গো। তুমি কি তাঁহাকে এই ব্যাপারের পর সম্মত করিতে পারিবে না?
রো। পারিব। কিন্তু আপনার জ্যেষ্ঠতাতকে সম্মত করিবে কে? তিনি আমাকে ছাড়িবেন কেন?
গো। আমি অনুরোধ করিব।
রো। তাহা হইলে আমার কলঙ্কের উপর কলঙ্ক। আপনারও কিছু কলঙ্ক।
গো। সত্য; তোমার জন্য, কর্তার কাছে ভ্রমর অনুরোধ করিবে। তুমি এখন ভ্রমরের অনুসন্ধানে যাও। তাহাকে পাঠাইয়া দিয়া, আপনি এই বাড়ীতেই থাকিও। ডাকিলে যেন পাই।
রোহিণী সজলনয়নে গোবিন্দলালকে দেখিতে দেখিতে ভ্রমরের অনুসন্ধানে গেল। এইরূপে কলঙ্কে, বন্ধনে, রোহিণীর প্রথম প্রণয়সম্ভাষণ হইল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ভ্রমর শ্বশুরকে কোন প্রকার অনুরোধ করিতে স্বীকৃত হইল না–বড় লজ্জা করে, ছি!
অগত্যা গোবিন্দলাল স্বয়ং কৃষ্ণকান্তের কাছে গেলেন। কৃষ্ণকান্ত তখন আহারান্তে পালঙ্কে অর্ধশয়নাবস্থায়, আলবোলার নল হাতে করিয়া–সুষুপ্ত। এক দিকে তাঁহার নাসিকা নাদসুরে গমকে তানমূর্ছনাদি সহিত নানাবিধ রাগরাগিণীর আলাপ করিতেছে–আর এক দিকে, তাঁহার মন, অহিফেনপ্রসাদাৎ ত্রিভুবনগামী অশ্বে আরূঢ় হইয়া নানা স্থান পর্যটন করিতেছে। রোহিণীর চাঁদপানা মুখখানা বুড়ারও মনের ভিতর ঢুকিয়াছিল বোধ হয়,-চাঁদ কোথায় উদয় না হয়?–নহিলে বুড়া আফিঙ্গের ঝোঁকে ইন্দ্রাণীর স্কন্ধে সে মুখ বসাইবে কেন? কৃষ্ণকান্ত দেখিতেছেন যে, রোহিণী হঠাৎ ইন্দ্রের শচী হইয়া, মহাদেবের গোহাল হইতে ষাঁড় চুরি করিতে গিয়াছে। নন্দী ত্রিশূল হস্তে ষাঁড়ের জাব দিতে গিয়া তাহাকে ধরিয়াছে। দেখিতেছেন, নন্দী রোহিণীর আলুলায়িত কুন্তলদাম ধরিয়া টানাটানি লাগাইয়াছে, এবং ষড়াননের ময়ূর, সন্ধান পাইয়া, তাহার সেই আগুল্ফয়-বিলম্বিত কুঞ্চিত কেশগুচ্ছকে স্ফীতফণা ফণিশ্রেণী ভ্রমে গিলিতে গিয়াছে–এমত সময়ে স্বয়ং ষড়ানন ময়ূরের দৌরাত্ম্য দেখিয়া নালিশ করিবার জন্য মহাদেবের কাছে উপস্হিত হইয়া ডাকিতেছেন, “জ্যেঠা মহাশয়!”
কৃষ্ণকান্ত বিস্মিত হইয়া ভাবিতেছেন, “কার্তিক মহাদেবকে কি সম্পর্কে জ্যেঠা মহাশয় বলিয়া ডাকিতেছেন?” এমত সময় কার্তিক আবার ডাকিলেন, “জ্যেঠা মহাশয়!” কৃষ্ণকান্ত বড় বিরক্ত হইয়া কার্তিকের কাণ মলিয়া দিবার অভিপ্রায়ে হস্ত উত্তোলন করিলেন। অমনি কৃষ্ণকান্তের হস্তস্থিত আলোবোলার নল হাত হইতে খসিয়া ঝনাৎ করিয়া পানের বাটার উপর পড়িয়া গেল, পানের বাটা ঝন্ ঝন্ ঝনাৎ করিয়া পিকদানির উপর পড়িয়া গেল; এবং নল, বাটা, পিকদানি, সকলেই একত্রে সহগমন করিয়া ভূতলশায়ী হইল। সেই শব্দে কৃষ্ণকান্তের নিদ্রাভঙ্গ হইল, তিনি নয়নোন্মীলন করিয়া দেখেন যে, কীর্তিকেয় যথার্থই উপস্থিত। মূতিমান স্কন্দবীরের ন্যায়, গোবিন্দলাল তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন–ডাকিতেছেন, “জ্যেঠা মহাশয়!” কৃষ্ণকান্ত শশব্যস্তে উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বাবা গোবিন্দলাল?” গোবিন্দলালকে বুড়া বড় ভালবাসিত।
গোবিন্দলালও কিছু অপ্রতিভ হইলেন–বলিলেন, “আপনি নিদ্রা যান–আমি এমন কিছু কাজে আসি নাই|” এই বলিয়া, গোবিন্দলাল পিকদানিটি উঠাইয়া সোজা করিয়া রাখিয়া, পানবাটা উঠাইয়া যথাস্থানে রাখিয়া, নলটি কৃষ্ণকান্তের হাতে দিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত শক্ত বুড়া–সহজে ভুলে না–মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “কিছু না, এ ছুঁচো আবার সেই চাঁদমুখো মাগীর কথা বলিতে আসিয়াছে |” প্রকাশ্যে বলিলেন, “না। আমার ঘুম হইয়াছে–আর ঘুমাইব না |”
গোবিন্দলাল একটু গোলে পড়িলেন। রোহিণীর কথা কৃষ্ণকান্তের কাছে বলিতে প্রাতে তাঁহার কোন লজ্জা করে নাই–এখন একটু লজ্জা করিতে লাগিল–কথা বলি বলি করিয়া বলিতে পারিলেন না। রোহিণীর সঙ্গে বারুণী পুকুরের কথা হইয়াছিল বলিয়া কি এখন লজ্জা?
বুড়া রঙ্গ দেখিতে লাগিল। গোবিন্দলাল, কোন কথা পাড়িতেছে না দেখিয়া, আপনি জমীদারীর কথা পাড়িল–জমীদারীর কথার পর সাংসারিক কথা, সাংসারিক কথার পর মোকদ্দমার কথা, তথাপি রোহিণীর দিক দিয়াও গেল না। গোবিন্দলাল রোহিণীর কথা কিছুতেই পাড়িলেন না। কৃষ্ণকান্ত মনে মনে ভারি হাসি হাসিতে লাগিলেন। বুড়া বড় দুষ্ট।
অগত্যা গোবিন্দলাল ফিরিয়া যাইতেছিলেন,-তখন কৃষ্ণকান্ত প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্রকে ডাকিয়া ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সকাল বেলা যে মাগীকে তুমি জামিন করিয়া লইয়া গিয়াছিলে, সে মাগী কিছু স্বীকার করিয়াছে?”
তখন গোবিন্দলাল পথ পাইয়া যাহা যাহা রোহিণী বলিয়াছিল, সংক্ষেপে বলিলেন। বারুণী পুষ্করিণী ঘটিত কথাগুলি গোপন করিলেন। শুনিয়া কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “এখন তাহার প্রতি কিরূপ করা তোমার অভিপ্রায়?”
গোবিন্দলাল লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “আপনার যে অভিপ্রায়, আমাদিগেরও সেই অভিপ্রায়|”
কৃষ্ণকান্ত মনে মনে হাসিয়া, মুখে কিছুমাত্র হাসির লক্ষণ না দেখাইয়া বলিলেন, “আমি উহার কথায় বিশ্বাস করি না। উহার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, দেশের বাহির করিয়া দাও–কি বল?”
গোবিন্দলাল চুপ করিয়া রহিলেন। তখন দুষ্ট বুড়া বলিল, “আর তোমরা যদি এমনই বিবেচনা কর যে, উহার দোষ নাই–তবে ছাড়িয়া দাও |”
গোবিন্দলাল তখন নিশ্বাস ছাড়িয়া, বুড়ার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন।
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
রোহিণী, গোবিন্দলালের অনুমতিক্রমে খুড়ার সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার বন্দোবস্ত করিতে আসিল। খুড়াকে কিছু না বলিয়া, ঘরের মধ্যস্থলে বসিয়া পড়িয়া, রোহিণী কাঁদিতে বসিল।
“এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া আমার যাওয়া হইবে না–না দেখিয়া মরিয়া যাইব। আমি কলিকাতায় গেলে, গোবিন্দলালকে দেখিতে পাইব না? আমি যাইব না। এই হরিদ্রাগ্রাম আমার স্বর্গ, এখানে গোবিন্দলালের মন্দির। এই হরিদ্রাগ্রামই আমার শ্মশান, এখানে আমি পুড়িয়া মরিব। শ্মশানে মরিতে পায় না, এমন কপালও আছে। আমি যদি এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া না যাই, ত আমার কে কি করিতে পারে? কৃষ্ণকান্ত রায় আমার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবে? আমি আবার আসিব। গোবিন্দলাল রাগ করিবে? করে করুক,-তবু আমি তাহাকে দেখিব। আমার চক্ষু ত কাড়িয়া লইতে পারিবে না। আমি যাব না। কলিকাতায় যাব না–কোথাও যাব না। যাই ত যমের বাড়ী যাব। আর কোথাও না |”
এই সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া, কালামুখী রোহিণী উঠিয়া দ্বার খুলিয়া আবার–“পতঙ্গবদ্বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ”–সেই গোবিন্দলালের কাছে চলিল। মনে মনে নিতান্ত দুঃখিনী, নিতান্ত দুঃখে পড়িয়াছি–আমায় রক্ষা কর–আমার হৃদয়ের এই অসহ্য প্রেমবহ্নি নিবাইয়া দাও–আর আমায় পোড়াইও না। আমি যাহাকে দেখিতে যাইতেছি–তাহাকে যত বার দেখিব, ততবার–আমার অসহ্য যন্ত্রণা–অনন্ত সুখ। আমি বিধবা–আমার ধর্ম গেল–সুখ গেল–প্রাণ গেল–রহিল কি প্রভু? রাখিব কি প্রভু?–হে দেবতা! হে দুর্গা–হে কালি–হে জগন্নাথ–আমায় সুমতি দাও–আমার প্রাণ স্থির কর–আমি এই যন্ত্রণা আর সহিতে পারি না |”
তবু সেই স্ফীত, হৃত, অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ হৃদয়–থামিল না। কখনও ভাবিল, গরল খাই; কখনও ভাবিল, গোবিন্দলালের পদপ্রান্তে পড়িয়া, অন্তঃকরণ মুক্ত করিয়া সকল কথা বলি; কখনও ভাবিল, পলাইয়া যাই; কখনও ভাবিল, বারুণীতে ডুবে মরি; কখনও ভাবিল ধর্মে জলাঞ্জলি দিয়া গোবিন্দলালকে কাড়িয়া লইয়া দেশান্তরে পলাইয়া যাই। রোহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে গোবিন্দলালের কাছে পুর্নবার উপস্থিত হইল।
গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন? কলিকাতায় যাওয়া স্থির হইল ত?”
রো। না।
গো। সে কি? এইমাত্র আমার কাছে স্বীকার করিয়াছিলে?
রো। যাইতে পারিব না।
গো। বলিতে পারি না। জোর করিবার আমার কোনই অধিকার নাই–কিন্তু গেলে ভাল হইত।
রো। কিসে ভাল হইত?
গোবিন্দলাল অধোবদন হইলেন। স্পষ্ট করিয়া কোন কথা বলিবার তিনি কে?”
রোহিণী চক্ষের জল লুকাইয়া মুছিতে মুছিতে গৃহে ফিরিয়া গেল। গোবিন্দলাল নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। তখন ভোমরা নাচিতে নাচিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “ভাবছ কি?”
গো। বল দেখি।
ভ্র। আমার কালো রূপ।
গো। ইঃ-
ভোমরা ঘোরতর কোপাবিষ্ট হইয়া বলিল, “সে কি? আমায় ভাব্ছ না? আমি ছাড়া, পৃথিবীতে তোমার অন্য চিন্তা আছে?”
গো। আছে না ত কি? সর্বে সর্বময়ী আর কি! আমি অন্য মানুষ ভাবতেছি।
ভ্রমর তখন গোবিন্দলালের গলা জড়াইয়া ধরিয়া, মুখচুম্বন করিয়া, আদরে গলিয়া গিয়া, আধো আধো, মৃদু মৃদু হাসিমাখা স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্য মানুষ–কাকে ভাব্দছ বল না?”
গো। কি হবে তোমায় বলিয়া?
ভ্র। বল না!
গো। তুমি রাগ করিবে।
ভ্র। করি কর্ বো–বল না।
গো। যাও, দেখ গিয়া সকলের খাওয়া হলো কি না।
ভ্র। দেখ্কবো এখন–বল না কে মানুষ?
গো। সিয়াকুল কাঁটা! রোহিণীকে ভাবছিলাম।
ভ্র। কেন রোহিণীকে ভাবছিলে?
গো। তা কি জানি?
ভ্র। জান–বল না।
গো। মানুষ কি মানুষকে ভাবে না?
ভ্র। না। যে যাকে ভালবাসে, সে তাকেই ভাবে, আমি তোমাকে ভাবি–তুমি আমাকে ভাব।
গো। তবে আমি রোহিণীকে ভালবাসি।
ভ্র। মিছে কথা–তুমি আমাকে ভালবাস–আর কাকেও তোমার ভালবাস্লতে নাই–কেন রোহিণীকে ভাব্নছিলে বল না?
গো। বিধবাকে মাছ খাইতে আছে?
ভ্র। না।
গো। বিধবাকে মাছ খাইতে নাই, তবু তারিণীর মা মাছ খায় কেন?
ভ্র। তার পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করে।
গো। আমারও পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করি। রোহিণীকে ভালবাসি।
ধা করিয়া গোবিন্দলালের গালে ভোমরা এক ঠোনা মারিল। বড় রাগ করিয়া বলিল, “আমি শ্রীমতী ভোমরা দাসী–আমার সাক্ষাতে মিছে কথা?”
গোবিন্দলাল হারি মানিল। ভ্রমরের স্কন্ধে হস্ত আরোপিত করিয়া, প্রফুল্লনীলোৎপলদলতুল্য মধুরিমাময় তাহার মুখমণ্ডল স্বকরপল্লবে গ্রহণ করিয়া, মৃদু মৃদু অথচ গম্ভীর, কাতর কণ্ঠে গোবিন্দলাল বলিল, “মিছে কথাই ভোমরা। আমি রোহিণীকে ভালবাসি না। রোহিণী আমায় ভালবাসে |”
তীব্র বেগে গোবিন্দলালের হাত হইতে মুখমণ্ডল মুক্ত করিয়া, ভোমরা দূরে গিয়া, দাঁড়াইল। হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিল, “-আবাগী–পোড়ারমুখী–বাঁদরী মরুক! মরুক! মরুক! মরুক! মরুক!”
গোবিন্দলাল হাসিয়া বলিলেন, “এখনই এত গালি কেন? তোমার সাত রাজার ধন এক মাণিক এখনও ত কেড়ে নেয় নি |”
ভোমরা একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “দূর তা কেন–তা কি পারে–তা মাগী তোমার সাক্ষাতে বলিল কেন?”
গো। ঠিক ভোমরা–বলা তাহার উচিত ছিল না–তাই ভাবিতেছিলাম। আমি তাহাকে বাস উঠাইয়া কলিকাতায় গিয়া বাস করিতে বলিয়াছিলাম–খরচ পর্যন্ত দিতে স্বীকার করিয়াছিলাম।
ভো। তার পর?
গো। তার পর, সে রাজি হইল না।
ভো।ভাল, আমি তাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি?
গো। পার, কিন্তু আমি পরামর্শটা শুনিব।
ভো। শোন।
এই বলিয়া ভোমরা “ক্ষীরি! ক্ষীরি!” করিয়া একজন চাকরাণীকে ডাকিল।
তখন ক্ষীরোদা–ওরফে ক্ষীরোদমণি–ওরফে ক্ষীরাব্ধিতনয়া—–ওরফে শুধু ক্ষীরি আসিয়া দাঁড়াইল–মোটাসোটা গাটা গোটা–মল পায়ে–গোট পরা–হাসি চাহনিতে ভরা ভরা। ভোমরা বলিল, “ক্ষীরি,-রোহিণী পোড়ারমুখীর কাছে এখনই একবার যাইতে পারবি?”
ক্ষীরি বলিল, “পারব না কেন? কি বলতে হবে?”
ভোমরা বলিল, “আমার নাম করিয়া বলিয়া আয় যে, তিনি বললেন, তুমি মর|”
“এই? যাই |” বলিয়া ক্ষীরদা ওরফে ক্ষীরি–মল বাজাইয়া চলিল। গমনকালে ভোমরা বলিয়া দিল, “কি বলে, আমায় বলিয়া যাস |”
“আচ্ছা |” বলিয়া ক্ষীরোদা গেল। অল্পকালমধ্যেই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “বলিয়া
আসিয়াছি |”
ভো। সে কি বলিল?
ক্ষীরি। সে বলিল, উপায় বলিয়া দিতে বলিও।
ভো। তবে আবার যা। বলিয়া আয় যে–বারুণী পুকুরে–সন্ধ্যেবেলা কলসী গলায় দিয়ে– বুঝেছিস?”
ক্ষীরি। আচ্ছা।
ক্ষীরি আবার গেল। আবার আসিল। ভোমরা জিজ্ঞাসা করিল, “বারুণী পুকুরের কথা বলেছিস?”
ক্ষীরি। বলিয়াছি।
ভো। সে কি বলিল?
ক্ষীরি। বলিল যে “আচ্ছা |”
গোবিন্দলাল বলিলেন, “ছি ভোমরা!”
ভোমরা বলিল, “ভাবিও না। সে মরিবে না। যে তোমায় দেখিয়া মজিয়াছে–সে কি মরিতে পারে?”
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
দৈনিক কার্য সমস্ত সমাপ্ত করিয়া, প্রাত্যহিক নিয়মানুসারে গোবিন্দলাল দিনান্তে বারুণীর তীরবর্তি পুষ্পোদ্যানে গিয়া বিচরণ করিতে লাগিলেন। গোবিন্দলালের পুষ্পোদ্যানভ্রমণ একটি প্রধান সুখ। সকল বৃক্ষের তলায় দুই চারি বার বেড়াইতেন। কিন্তু আমরা সকল বৃক্ষের কথা এখন বলিব না। বারুণীর কূলে, উদ্যানমধ্যে, এক উচ্চ প্রস্তরবেদিকা ছিল, বেদিকামধ্যে একটি শ্বেতপ্রস্তরখোদিত স্ত্রীপ্রতিমূতি–স্ত্রীমূতি অর্ধাবৃতা, বিনতলোচনা–একটি ঘট হইতে আপন চরণদ্বয়ে যেন জল ঢালিতেছে,-তাহার চারি পার্শ্বে বেদিকার উপরে উজ্জ্বলবর্ণরঞ্জিত মৃন্ময় আধারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সপুষ্প বৃক্ষ–জিরানিয়ম, ভর্বিনা, ইউফির্বিয়া চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ–নীচে, সেই বেদিকা বেষ্টন করিয়া, কামিনী, যূথিকা, মল্লিকা, গন্ধরাজ প্রভৃতি সুগন্ধি দেশী ফুলের সারি, গন্ধে গগন আমোদিত করিতেছে–তাহারই পরে বহুবিধ উজ্জ্বল নীল পীত রক্ত শ্বেত নানা বর্ণের দেশী বিলাতী নয়নরঞ্জনকারী পাতার গাছের শ্রেণী। সেইখানে গোবিন্দলাল বসিতে ভালবাসিতেন। জ্যোৎস্না রাত্রে কখনও কখনও ভ্রমরকে উদ্যানভ্রমণে আনিয়া সেইখানে বসাইতেন। ভ্রমর পাষাণময়ী স্ত্রীময়ী স্ত্রীমূতি অর্ধাবৃতা দেখিয়া তাহাকে কালামুখী বলিয়া গালি দিত–কখনও কখনও আপনি অঞ্চল দিয়া তাহার অঙ্গ আবৃত করিয়া দিত–কখনও কখনও তাহার হস্তস্থিত ঘট লইয়া টানাটানি বাধাইত।
সেইখানে আজি, গোবিন্দলাল সন্ধ্যাকালে বসিয়া, দর্পণানুরূপ বারুণীর জলশোভা দেখিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে দেখিলেন, সেই পুষ্করিণীর সুপরিসর প্রস্তরনির্মিত সোপানপরম্পায় রোহিণী কলসীকক্ষে অবরোহণ করিতেছে। সব না হইলে চলে, জল না হইলে চলে না। এ দুঃখের দিনেও রোহিণী জল লইতে আসিয়াছে। রোহিণী জলে নামিয়া গাত্র মার্জনা করিবার সম্ভাবনা–দৃষ্টিপথে তাঁহার থাকা অকর্তব্য বলিয়া গোবিন্দলাল সে স্থান হইতে সরিয়া গেলেন।
অনেক্ষণ গোবিন্দলাল এ দিক ও দিক বেড়াইলেন। শেষ মনে করিলেন, এতক্ষণ রোহিণী উঠিয়া গিয়াছে। এই ভাবিয়া আবার সেই বেদিকাতলে জলনিষেকনিরতা পাষাণসুন্দরীর পদপ্রান্তে আসিয়া বসিলেন। আবার সেই বারুণীর শোভা দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, রোহিণী বা কোন স্ত্রীলোক বা পুরুষ কোথাও কেহ নাই। কেহ কোথাও নাই–কিন্তু সে জলোপরে একটি কলসী ভাসিতেছে।
কার কলসী? হঠাৎ সন্দেহ উপস্থিত হইল–কেহ জল লইতে আসিয়া ডুবিয়া যায় নাই ত? রোহিণীই একমাত্র জল লইতে আসিয়াছিল–তখন অকস্মাৎ পূর্বহ্নের কথা মনে পড়িল–মনে পড়িল যে, ভ্রমর রোহিণীকে বলিয়া পাঠাইয়াছিল যে, বারুণী পুকুরে সন্ধ্যেবেলা–কলসী গলায় বেঁধে। মনে পড়িল যে, রোহিণী প্রত্যুত্তরে বলিয়াছিল, “আচ্ছা |”
গোবিন্দলাল তৎক্ষণাৎ পুষ্করিণীর ঘাটে আসিলেন। সর্বশেষ সোপানে দাঁড়াইয়া পুষ্করিণীর সর্বত্র দেখিতে লাগিলেন। জল কাচতুল্য স্বচ্ছ। ঘাটের নীচে জলতলস্থ ভূমি পর্যন্ত দেখা যাইতেছে। দেখিলেন, স্বচ্ছ স্ফটিকমণ্ডিত হৈম প্রতিমার ন্যায় রোহিণী জলতলে শুইয়া আছে। অন্ধকার জলতল আলো করিতেছে!