পর্ব- ৮
পরদিন সূর্য উদয় হলে কৌরব ও পাণ্ডবগণ ভীষ্মকে প্রণাম জানিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো। ভীষ্ম অর্জুনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন,- ‘কৌন্তেয় তোমার বাণ আমার সারা শরীরে গ্রথিত হয়েছে, তৃষ্ণায় বেদনায় মুখ শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। তুমি আমাকে বিধিসম্মত জল দ্বারা আমার তৃষ্ণা নিবারণ করো।’
অর্জুন ভীষ্মকে প্রদক্ষিণ করে বাণ দ্বারা ভীষ্মের দক্ষিণ পাশের ভূমি বিদ্ধ করলেন। সেই বিদ্ধ ভূমি থেকে অমৃততুল্য নির্মল শীতল বারিধারা উত্থিত হলো। সেই জল পান করে পিতামহ তৃপ্ত হলেন।
ভীষ্ম দুর্যোধনকে শেষবারের মতো বোঝানোর চেষ্টা করলেন,- ‘বৎস, তুমি এতোদিন অনেক অন্যায় করেছ। তোমাকে আমি সতর্ক করলেও সে ভাবে শাসন করতে পারিনি। কারণ, আমি ছিলাম কৌরবদের অন্নে প্রতিপালিত। কিন্তু এখন আমার আর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই সকলের হিতের জন্য তোমাকে শেষবারের মতো বলছি, এখনও সময় আছে, তুমি পাণ্ডবদের সাথে সন্ধি করে নাও। ওদের অর্ধেক রাজত্ব ফিরিয়ে দাও। আমার মৃত্যুতেই এই শত্রুতার অবসান ঘটুক। প্রজাদের মধ্যে শান্তি ফিরে আসুক। এই রক্তক্ষয় বন্ধ হোক।’
কিন্তু না! দুর্জনের কানে কখনোই ধর্মের বাণী প্রবেশ করে না। সেইরকম দুর্যোধনেরও পিতামহর কথাগুলো মোটেই ভালো লাগলো না।
সকলে ভীষ্মকে প্রণাম করে নিজ নিজ শিবিরে ফিরে এলো।
সেই সময় সেখানে কর্ণ উপস্থিত হলেন। কিছুটা কুণ্ঠিতভাবে ভীষ্মকে প্রণাম করে একপাশে দাঁড়ালেন। ভীষ্ম তাঁকে দেখে অনেক ক্লেশে তাঁর দক্ষিণ বাহু দিয়ে কর্ণকে পিতার ন্যায় আলিঙ্গন করে সস্নেহে বললেন,- ‘আমি মহর্ষি নারদের কাছে শুনেছি, তুমি কুন্তীপুত্র। তোমার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। কিন্তু তুমি নীচ স্বভাব দুর্যোধনের আশ্রয়ে থেকে পরশ্রীকাতর হয়ে উঠেছ। আমি তোমার দুঃসাহসিক বীরত্ব, বেদনিষ্ঠা এবং দানের বিষয়ে জানি। অস্ত্রপ্রয়োগে তুমি কৃষ্ণের তুল্য। পাণ্ডবেরা তোমার সহোদর, তুমি তাদের সাথে মিলিত হও। আমার পতনেই এই শত্রুতার অবসান হোক।’
কর্ণ বললেন,- ‘মহাবাহু আমি দুর্যোধনের ধন ঐশ্বর্য ভোগ করেছি, এখন তার সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না। বাসুদেব কৃষ্ণ যেমন পাণ্ডবদের জয়ের জন্য দৃঢ়প্রতীজ্ঞ, তেমনি আমিও দুর্যোধনের জন্য ধন, মন, শরীর সব উৎসর্গ করেছি। এই নিদারুণ শত্রুতার অবসান ঘটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পিতামহ আমি একজন ক্ষত্রিয়, একজন ক্ষত্রিয়ের মতোই যুদ্ধ করে মরতে চাই। আমি আগামী দিনের যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হয়েছি, আপনি আমাকে অনুমতি দিন। চপলতার বশে কখনো আপনাকে কটুবাক্য বলে যে অন্যায় করেছি, তার জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাকে ক্ষমা করুন।’
ভীষ্ম বললেন,- ‘তুমি যদি এই বৈরীতা দূর করতে না পারো, তবে অনুমতি দিচ্ছি তুমি স্বর্গ কামনায় যুদ্ধ করো। আক্রোশ ত্যাগ করে সদাচারী হয়ে যুদ্ধ করো। ধর্মযুদ্ধ ভিন্ন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই। দুই পক্ষের শান্তির জন্য আমি দীর্ঘকাল বহু প্রচেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, তা সফল হলো না।’
ভীষ্ম মনে মনে বললেন- হে পিতাশ্রী আপনার কুরুবংশ আমি রক্ষা করতে পারলাম না। ধৃতরাষ্ট্র চিরকাল পাণ্ডবদের শত্রু মনে করে গেলো। নীচ স্বভাব দুর্যোধনের লোভের কারণে আর ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রের প্রতি অপত্যস্নেহের কারণে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে এতো রক্তক্ষয় হ’লো। কিন্তু তাতেও কি ওই মূঢ় সিংহাসনের মোহ ত্যাগ করতে পারলো! আমি এতো করে বোঝালাম, আমার মৃত্যুতেই এই শত্রুতার অবসান ঘটুক, কিন্তু ওই দুর্মতি আমার কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করলো না। এই কুরুবংশের জন্যই কি আমি আমার জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছিলাম! আজ নিজের প্রতি আমার যে ঘৃণা জন্মেছে তাতে আামার সারা অঙ্গে বিদ্ধ তীরের বেদনাও সে তুলনায় লঘু বোধ হচ্ছে।
ভীষ্মের পতনের পর আরও আট দিন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হ’লো। দ্রোণ, কর্ণ, দুঃশাসনের মতো অগণিত মহারথী যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ বলিদান দিলেন। দুর্যোধনও নিস্তার পেলো না। ভীমের গদার আঘাতে তার প্রাণও ঝরে গেলো। পাণ্ডবদের বিজয়ধ্বজা উড়লো। সময় এলো যুধিষ্ঠিরের রাজা হওয়ার। কিন্তু এতো আত্মীয়স্বজনের বিয়োগব্যথায় ক্লিষ্ট যুধিষ্ঠির কিছুতেই সিংহাসনে বসতে চাইলেন না। সকলে তাকে অনেক বোঝালেন। কোনো ফল হলো না, অবশেষে বাসুদেব কৃষ্ণ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বোঝানোয় যুধিষ্ঠিরের মন শান্ত হলো। কিন্তু তা সত্বেও রাজা হওয়ার বিষয়ে তার সংশয় আছে। রাজধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট দক্ষ নন। তখন ব্যাস তাকে পরামর্শ দিলেন রাজধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি, যা যা তুমি শিখতে চাও তা সবকিছু ভালোভাবে জানতে হলে তোমাকে কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মের কাছে যেতে হবে। তুমি পিতামহের কাছে যাও। তিনি তোমার সমস্ত প্রশ্নের সমাধান দেবেন।
আমরা দেখেছি শান্তনুর জীবদ্দশা থেকেই গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম হস্তিনাপুরের রাজপাট সামলাচ্ছেন। প্রথমে যখন তিনি যুবরাজ ছিলেন সেই সময় থেকেই তিনি রাজকার্যের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি রাজা না হয়েও হস্তিনাপুরের শাসনভার গ্রহণ করে সেই রাজ্য তিনি চালিয়ে গেছেন একজন বিশ্বস্থ রাজভৃত্যের মতো। কুরুরাজ্য তিনি রাজার অধিকারে কখনোই ভোগ করেননি। কিন্তু একটা বৃহৎ সময় ধরে সেই রাজ্য তিনি সুরক্ষিত রেখেছেন। এই যে রাজ অধিকার ভোগ না করেও রাজধর্ম পালন করা, এই নির্লিপ্ততাই তাকে রাজনীতির তত্ব বিষয়ে অনেক ব্যুৎপত্তির অধিকারী করেছিলো। আর সেই কারণেই ব্যাস, যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্মের কাছে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কারণ ভীষ্মকে তিনি দেখেছিলেন অত্যন্ত কাছের থেকে। পাণ্ডু রাজা হওয়ার পর ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে যে স্বার্থ ভাবনার উদয় হয়েছিল, কিম্বা পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তার পাঁচ পুত্র যখন হস্তিনাপুর ফিরে এলো, সেই সময় ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের মধ্যে যে স্বার্থপরতা দেখা গেছে, তার প্রতিবাদে ভীষ্মকে ব্যাসদেব যেভাবে নির্লিপ্ত পরামর্শদাতার ভূমিকায় দেখেছেন- তাতে রাজনৈতিক এবং তাত্বিক প্রায়োগের ক্ষেত্রে ভীষ্মের পরম মাহাত্ম্য তিনি উপলব্ধি করেছেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন – ‘যাঁর কথা ব্রহ্মর্ষি ঋষিরা পর্যন্ত মন দিয়ে শোনেন, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে যার অগাধ ব্যুৎপত্তি, তুমি তার কাছে যাও, তিনি এখনও প্রাণ ত্যাগ করেননি, তোমাকে এখনও যথার্থ উপদেশ দিতে পারবেন।’
ব্যাসের কথা শুনে যুধিষ্ঠির লজ্জায় নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললেন,- ‘আমি কোন মুখে পিতামহের কাছে যাবো? যাঁকে আমরা ছলনা করে মেরেছি, তার কাছে কি ভাবে এসব জানতে চাইবো?’
তখন কৃষ্ণ বললেন,- ‘তুমি আগে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসো, তার পর ভীষ্মের কাছে রাজধর্মের উপদেশ গ্রহণ করতে যাবে।’