পর্ব- ৪
সত্যবতীর সাথে শান্তনুর বিবাহের পরবর্তী সময়ে সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর দুটি পুত্র হ’লো- ‘চিত্রাঙ্গদ’ ও ‘বিচিত্রবীর্য’। শান্তনুর মৃত্যুর পর ভীষ্ম সত্যবতীর মত নিয়ে চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে রাজপদে প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুদিনের মধ্যেই গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ কুরুনন্দন চিত্রাঙ্গদকে যুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করে। তখন উপায়ন্তর না পেয়ে ভীষ্ম নাবালক বিচিত্রবীর্যকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। বিচিত্রবীর্য যৌবন লাভ করলে ভীষ্ম তার বিবাহ দেওয়ার জন্য কাশীরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে সয়ম্বর সভা থেকে বলপূর্বক হরণ করে হস্তিনাপুর নিয়ে এলেন। ভীষ্ম কাশীরাজের স্বয়ম্বরসভায় পৌঁছে, অনায়াসে সয়ম্বর সভার বরাসনে গিয়ে বসলেন। তা দেখে অনেকেই তার ব্রহ্মচর্য্য নিয়ে কটূক্তি করতেও ছাড়লো না। যদিও তিনি জানতেন, তিনি নিজের বিবাহের জন্য আসেননি, কিন্তু হয়তো তার মনের সুপ্তকোণ থেকে স্বয়ংবর সভার বরাসনে বসার আকাঙ্ক্ষাটা অবদমন করতে পারেননি; তাই সকলের বিদ্রুপের জবাব দিতে তিনি কাশীরাজের তিন কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে এলেন।আসার পথে তাঁর সাথে সয়ম্বর সভায় আমন্ত্রিত নৃপতিদের ভীষণ যুদ্ধ হল। কিন্তু সকলেই ভীষ্মের রণকৌশলের কাছে পরাজয় স্বীকার করলেন।শাল্বরাজ অনেকদূর পর্যন্ত তাড়া করে এসেও ভীষ্মের পরাক্রমের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। হস্তিনাপুর পৌঁছে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা ভীষ্মকে বললেন যে, তিনি শাল্বরাজের বাগদত্তা। ভীষ্ম তখন অম্বাকে শাল্বের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু অপমানিত শাল্বরাজ অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করে এই বলে, ‘একজন পুরুষ যখন কোনো নারীকে স্ত্রী কামনায় স্বয়ংবর সভা থেকে হরণ করে নিয়ে যায়, তাকে স্পর্শ করে, আমি আর কোনদিন সেই নারীকে নিজের স্ত্রী বলে গ্রহণ করতে পারি না’। অম্বা নিদারুণ অপমানিত হয় শাল্বের এই কথায়। তার সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়লো ভীষ্মের উপর। তিনি ভীষ্মের বিনাশ কামনা করে পরশুরামের কাছে গেলেন। পরশুরাম অম্বাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, ভীষ্মের সঙ্গে বিবাদে না যেতে, কিন্তু কোনো ফল হলো না। তিনি শেষে বিবশ হয়ে কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গণে এসে তার প্রিয় শিষ্য ভীষ্মর কাছে দূত পাঠালেন। ভীষ্ম যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে পাদর্ঘ্য নিয়ে পরশুরামের সামনে উপস্থিত হলেন। দুজনের মধ্যে অম্বাকে নিয়ে অনেক কথপোকথন ও তর্কবির্তক হলো। পরশুরাম কোনভাবেই যখন ভীষ্মকে বোঝাতে পারলেন না, তখন দুজনের মধ্যে শুরু হলো ঘোর যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধের পরিণতি পরশুরামের বিপক্ষে যাচ্ছিল। তিনি হেরে যাচ্ছিলেন। শুভাকাঙ্ক্ষীগণ এই যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দিলেন। পরশুরামও যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ালেন। ভীষ্ম গুরুর চরণ বন্দনা করে গুরু-শিষ্যের পূণর্মিলন হলো। কিন্তু অম্বার, ভীষ্মের বিজয়ে কোনপ্রকার আনন্দ হলো না। ক্রোধানলে দগ্ধ হতে হতে অম্বা প্রতিজ্ঞা করলেন ‘ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ তিনিই হবেন’ এই কথা বলে তিনি বনবাসী হলেন। ভীষ্মের বুকে কোথাও একটা ব্যথা চিনচিন করছে, যে তারই কারণে একজন নিরপরাধী সুন্দরী যুবতীর জীবন নষ্ট হয়ে গেলো। তাই তার ভীষ্মের প্রতি ক্রোধ এবং ভীষ্মকে হত্যা করার বাসনা তো একেবারে অযৌক্তিক নয়। ভীষ্মও যেন নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তপূর্বক ওই রমনীর হাতেই মরতে চান। তাই তিনি অম্বার গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখতে গুপ্তচর নিয়োগ করলেন।
এদিকে অম্বিকা ও অম্বালিকা দুই পরমাসুন্দরী পত্নীকে পেয়ে বিচিত্রবীর্য কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে অপুত্রক অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেন। সত্যবতী দেখলেন কুরুবংশ অস্তমিত। এখন বংশ রক্ষার উপায়? তিনি ভীষ্মকে অনুরোধ করেন তার দ্বারা যেন অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে কুরুবংশের বংশধর আসে। সেদিন ভীষ্ম অভিমানে অলক্ষ্যে অশ্রুমোচন করেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস; একদিন যে সত্যবতীর জন্য তিনি স্বেচ্ছায় ব্রহ্মচর্য্য পালনে ব্রতী হলেন, সেই সত্যবতী আজ তাকে কুরুবংশের বংশধর এনে দিতে বলছেন! কিন্তু তিনি মনের কথা মনেই দমন করে সত্যবতীকে বললেন,- মাতা, কোনো তেজস্বী ব্রাহ্মণ দ্বারা সন্তান উৎপাদনে বংশ রক্ষা সম্ভব। তখন সত্যবতী তার কুমারী অবস্থার সন্তান মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাসকে আহ্বান জানালেন। কিন্তু ব্যাসের ভয়ানক চেহারা দেখে অম্বিকা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আর অম্বালিকা ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলেন। ব্যাস মাতা সত্যবতীকে বললেন, – মাতা অম্বিকার গর্ভে যে সন্তান হবে, সে হবে অন্ধ। এই পুত্র শত হস্তিতুল্য বলবান বুদ্ধিমান এবং শত পুত্রের পিতা হবে। আর অম্বালিকার গর্ভের সন্তান হবে পাণ্ডুবর্ণ। এই পুত্র বিক্রমশালী খ্যাতিমান এবং পঞ্চপুত্রের পিতা হবে।
যথাসময়ে অম্বিকা একটি অন্ধ পুত্র (ধৃতরাষ্ট্র) এবং অম্বালিকা একটি পাণ্ডুবর্ণ পুত্রের(পান্ডু) জন্ম দিলেন। সত্যবতী অম্বিকাকে আর একবার ব্যাসের কাছে যেতে বলাতে তিনি নিজে না গিয়ে তার এক দাসীকে পাঠালেন। ওই দাসীর গর্ভে যে সন্তান হয় তাকেই আমরা বিদুর নামে জানি।