পর্ব- ১১
সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের স্মরণে এলো পিতামহ ভীষ্মের অন্তিমকাল এসে গেছে, এখন তাঁর কাছে যাবার সময় উপস্থিত হয়েছে। তিনি ভীষ্মের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ঘৃত, মাল্য, চন্দন, অগুরু, ক্ষৌমবস্ত্র প্রভৃতি দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে, তাঁর চার ভাই, যাজকগণ, ধৃতরাষ্ট্র সহ সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করলেন। কৃষ্ণ, বিদুর, সাত্যকি প্রমুখ তাঁকে অনুসরণ করলেন। তাঁরা ভীষ্মের নিকট পৌঁছে দেখলেন, ব্যাসদেব, নারদ প্রমুখ সেখানে আগেই পৌঁছে গেছেন। সকলকে অভিবাদন করে যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বললেন – ‘হে কুরুশ্রেষ্ঠ পিতামহ ভীষ্ম, আমি যুধিষ্ঠির। আপনি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন। মহাবাহু আপনি চোখ মেলে সকলকে দেখুন, আমরা সকলে এসেছি। আপনার অন্ত্যেষ্টির জন্য যা যা আবশ্যক সমস্ত কিছুর আয়োজন আমি করেছি।’
ভীষ্ম সকলের দিকে দৃষ্টি-বিনিময় করলেন, তারপর যুধিষ্ঠিরের হাত ধরে জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
– ‘কৌন্তেয় তুমি সঠিক সময়ে এসেছো। সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়েছে। আটান্ন দিন এই তীক্ষ্ণ শরশয্যায় শুয়ে মনে হচ্ছে, যেন শতবর্ষ অতিক্রান্ত।’
তারপর তিনি ধৃতরাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন,- ‘তুমি ধর্মজ্ঞ। বেদ ও ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব তুমি জানো, এই দুঃখময় সময়ের জন্য তুমি কষ্ট পেয়ো না; পাণ্ডুর পুত্ররা ধর্মত তোমার পুত্রতুল্য, তুমি ধর্মানুসারে এদের পালন করো। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির শুদ্ধ স্বভাবের, গুরুবৎসল ও অহিংস; ও তোমার আজ্ঞানুবর্তী হয়ে চলবে। তোমার পুত্রেরা দুরাত্মা, লোভী ও ঈর্ষান্বিত ছিলো। তাদের জন্য শোক করো না।’
ভীষ্ম কৃষ্ণকে বললেন,- ‘হে জনার্দন, সুরাসুরবন্দিত, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী ভগবান, তোমাকে আমার শতকোটি প্রণাম। তুমি সনাতন পরমাত্মা, আমি তোমার একান্ত ভক্ত। পুরুষোত্তম এবার তুমি আমাকে ত্রাণ করো।
আমি দুর্মতি দুর্যোধনকে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, যে পক্ষে কৃষ্ণ, সেই পক্ষে ধর্ম। আর যেখানে ধর্ম, সেখানে জয়। আমি বারবার দুর্যোধনকে বলেছিলাম- পাণ্ডবদের সাথে সন্ধি করে নিতে, কিন্তু ওই মূঢ় আমার কথার মান্যতা দেয়নি। কুরুক্ষেত্রের বিধ্বংসী যুদ্ধে কত মাতা তাদের স্বামী সন্তান হারালো!’
এই বলে ভীষ্ম সবার অলক্ষ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তিনি কৃষ্ণকে বললেন, – ‘আমি এখন কলেবর ত্যাগ করবো, হে পরমব্রহ্ম কেশব, তুমি আজ্ঞা করো আমি যেন পরমগতি পাই।’
কৃষ্ণ বললেন, – ‘হে গঙ্গানন্দন, আপনি নিষ্কলুষ, পিতৃভক্ত, দ্বিতীয় মার্কণ্ডেয় তুল্য। মৃত্যু আপনার কাছে ভৃত্যের ন্যায় বশবর্তী হয়েছে। আমি আজ্ঞা দিচ্ছি আপনি বসুগণের লোকে যান।’
ভীষ্ম উপস্থিত সকলকে সম্ভাষণ জানিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন – ‘মহারাজ, ব্রাহ্মণগণ বিশেষত আচার্য ও ঋত্বিকগণ তোমার পূজনীয়। তুমি দয়া-ধর্ম নিয়ে প্রজাপালন করো। মনে রেখো সুদক্ষ এবং সুশাসক রাজা একদিন রাজচক্রবর্তী হয়ে ওঠেন।’
গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম এবার নীরব হলেন। তিনি যোগবলে মন বুদ্ধিকে মূলাধারে স্থির করলেন। তারপর যোগসাধনার দ্বারা তাঁর প্রাণবায়ু যতো ঊর্ধ্বগামী হতে লাগলো- সেই সঙ্গে তাঁর শরীর থেকে বাণগুলি খসে পড়ে যেতে লাগলো। তারপর ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে তাঁর প্রাণবায়ু উল্কার ন্যায় আকাশে উঠে বিলীন হয়ে গেলো। তাই দেখে দেবতারা আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন। এইভাবে ভীষ্ম স্বেচ্ছায় তার ইচ্ছামৃত্যু সম্পন্ন করলেন।
ভীষ্মর আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তার অন্তিমসংস্কারের কাজ শুরু হলো। যুধিষ্ঠির ও বিদুর ভীষ্মের নশ্বর শরীরে ক্ষৌমবস্ত্র পরিয়ে ফুলের মালায় আচ্ছাদিত করলেন। যুযুৎসু ভীষ্মের মাথার উপর আশ্বমেধিক ছত্র মেলে ধরলেন। ভীমার্জুন শুভ্র চামর দোলাতে লাগলেন। নকুল সহদেব তাঁকে রাজকীয় উষ্ণীষ পরিয়ে দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র এবং যুধিষ্ঠির ভীষ্মের পাদদেশে দাঁড়িয়ে রইলেন। যাজকের হোমযজ্ঞ আর সামগায়ীদের সামগানের মধ্যেই ভীষ্মের চিতায় অগ্নিদান করলেন পুত্রপ্রতিম ধৃতরাষ্ট্র এবং তারপর অন্যেরাও। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হলে সকলে ভাগীরথী-তীরে গিয়ে তর্পণ করলেন। সেই সময় সকলের সামনে দেবী জাহ্নবীর আবির্ভাব হলো। যিনি ভীষ্মের গর্ভধারিণী; তিনি জল থেকে উঠে ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন,- ‘আমার পুত্র রাজোচিত গুণসম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান ও মহাকুলজাত ছিলেন। ঋষি পরশুরামের কাছে যিনি অস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত হননি, তিনি কিনা শিখণ্ডীর দিব্য অস্ত্রে নিহত হয়েছেন? প্রিয় পুত্রর মৃত্যু আমাকে বিদীর্ণ করেনি, আমাকে পীড়া দিচ্ছে এটাই, যে সুরাসুরের অজেয় ছিলো, সে কিভাবে শিখণ্ডীর বাণে নিহত হলো!’
জাহ্নবীর আর্তি শুনে বাসুদেব কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, – ‘তুমি শান্ত হও জননী, তোমার পুত্র তো সাধারণ মানুষ নন, তিনি তো অষ্টবসুর এক বসু; সে কথা তো তোমার অজানা নয়। তাঁর ইচ্ছামৃত্যুর পর তিনি পুনরায় বসুলোকে ফিরে গেছেন। শিখণ্ডী তাঁকে হত্যা করেছে, এ কথা ঠিক নয়। তোমার পুত্র বীর ক্ষত্রিয়ের মতো যুদ্ধ করছেন। অর্জুনের বাণ তাঁর সারা দেহে গ্রথিত হয়েছিল। নয়তো সম্মুখ যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করতে পারে এমন যোদ্ধা ভূ-ভারতে নেই। অতএব তুমি অনুশোচনা করো না মাতা; তিনি শিখণ্ডীর হাতে নিহত হননি।’
কৃষ্ণের কথায় দেবী জাহ্নবী আশ্বস্ত হলেন।
ভীষ্মের অন্ত্যেষ্টি-তর্পণ শেষ হলে ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠিরগণ হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন। এরপর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন। তিনি নিরাপদে রাজপাট চালাতে লাগলেন; কিন্তু কুরুরাজ্যের সমৃদ্ধি ভীষ্মের জীবদ্দশায় যে পর্যায়ে পৌঁছেছিলো, তার মৃত্যুর পর আর কোনোদিনই সেই পর্যায়ে পৌঁছোয়নি। ভীষ্মের মতো এমন পিতৃভক্তি আর কে দেখাতে পেরেছে? পিতার বিবাহের জন্য একজন পূর্ণবয়স্ক যুবক আমৃত্যু ব্রহ্মচারী থাকার প্রতিজ্ঞা করলো। শুধু কি তাই! সিংহাসন ত্যাগের প্রতিজ্ঞাও তো কম কথা নয়! অথচ ওই সিংহাসনে বসা প্রত্যেকটা অপরিণত বৈমাত্রেয় ভাইদের, তাদের বংশধরদের অভিভাবক হয়ে, তাদের সমস্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে ভরত-কুরুবংশের যোগ্য রাজা করে তোলা এসমস্ত কিছুর মধ্যেই তাঁর ক্ষত্রিয়োচিত মনোভাব প্রকাশ পায়, যা ভীষ্মের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অস্তমিত হয়েছে। আসলে মহামতি ভীষ্ম নিজেই এক ইতিহাস, যিনি ভরত-কুরুবংশের রাজসূয় যজ্ঞের সমিধ হয়ে আমৃত্যু রয়ে গেলেন। নিজেকে আহুতি দিয়ে কুরুবংশের গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে যিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ভীষ্ম নিজে যদি রাজ-সিংহাসনে বসতেন, তাহলে হয়তো ভরত-কুরুবংশের ইতিহাস অন্যরকম হতো। হয়তো তাঁকে কুরুবংশের সমিধ হয়ে জ্বলতে হতো না। হয়তো এই মহাকাব্যের নাম ভীষ্মের নামেই হতো।
যার ইঙ্গিত মহাভারতের কথক, স্বয়ং কবি বৈশম্পায়ন দিয়েছেন,
– “যস্যেতিহাসো দ্যুতিমান্ মহাভারতমুচ্যতে।” অর্থাৎ- ভীষ্মের ইতিহাসই মূলত মহাভারত নামে কথিত।