দ্বিতীয় খণ্ড – চতুর্থ পর্ব : ৪.২
কলকাতার ময়দান এবং চৌরিঙ্গীর সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারা সকলেই প্রায় এ পাগলকে চেনে। সে সাহেব-মেমেরাও চেনে। তারা শখ করেও দেখতে আসে বিকেলে। গঙ্গার ধারে নতুন পোস্তা বাঁধাই হয়ে পাকা রাস্তা তৈরী হয়েছে স্ট্র্যান্ড রোড। নতুন নতুন নৌকো ভিড়ানোর অসংখ্য ঘাট এবং ঘাটের উপর দু-চারটে দোকান গড়ে উঠেছে। চাঁদপাল ঘাট থেকে নতুন কেল্লা পর্যন্ত সোজা সুন্দর রাস্তার ধারে গাছের শ্রেণী। সুন্দর দেখায়, এখানে বিকেলে সাহেব-বিবিরা বেড়াতে আসে। দেশী বড়লোকেরাও আসে। নতুন আমদানী রকমারী গাড়ীঘোড়া পাল্কির ভিড় জমে। সাহেব-মেমেরা হাত ধরাধরি করে হাওয়া খায়। পথটার নাম ‘রেসপন্ডেন্সিয়া ওয়াক’। এখানে বেড়াতে এসে অনেক সাহেব-মেম, দেশী বড়লোক এসপ্লানেড রো ধ’রে এসে চৌরিঙ্গীর কাছাকাছি গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ে। তারপর দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলে। ওদিকে এখনও জলা নলখাগড়ার জঙ্গল আছেল; তারই মধ্যে পাগল কোথাও থাকে। আজ এখানে কাল ওখানে। নিত্য সকালে উঠে চলে একবার কালীঘাট মুখে, মন্দিরের কাছ বরাবর গিয়ে নাকি এমনি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ফিরে পালিয়ে আসে। তারপর কোথাও পড়ে থাকে। চীৎকার করে। বিকেল নাগাদ সুস্থ হয়। তখন লোকে তাকে ঘিরে ধরে। পাগল বলে—গন্ধ নিবি? গন্ধ নিবি? নে।
শূন্যের দিকে হাতটা বাড়ায় তারপর ঘষে দেয় সকলের হাতে, সঙ্গে সঙ্গে অতি মধুর গন্ধে তাদের নিঃশ্বাস ভরে যায়।
পাগল খানিকটা মাটি তোলে মুঠো করে তারপর আকাশের দিকে তুলে বলে–নে খা।
লোকে দেখে মাটি নয়, গুড় হয়ে গেছে।
পাগল বলে—সরবৎ খাবি?
তারা বলে-খাব বাবা।
—তবে জল আন। জল আন।
তারা জানে, আগে থেকেই জল নিয়ে আসে, পাগল তার ময়লা হাতখানাই ঘটির মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। তার পর বলে—খা।
তারা খেয়ে বুঝতে পারে—জল সরবৎ হয়ে গেছে।
অসুখ-বিসুখে তারা পাগলের কাছে আসে, ধরে, ভাল করে দাও বাবা।
পাগল কখনও রাগ করে চীৎকার করে ওঠে। বলে-না-না-না। তারপর ছুটে পালায়। চীৎকার করে—জোচ্চুরি-ঠকামি- ছেনালি আর কত কত কত করবি? বাবারে, বাবারে, আর পারি না, পারছি না! হাউ হাউ করে কাঁদে। নিজের গলা টিপে ধরে বলে- ছেড়ে দে, ছেড়ে দে বলছি। ওরে ছেড়ে দে। আমাকে বলতে দে—।
লোকে অবাক হয়ে যায়, আবার ভয়ও পায়। অনেকক্ষণ পর হয়তো সুস্থ হয়ে নলখাগড়ার পাতা কি ঘাস কি কিছু যা সামনে পায় ছিঁড়ে হাত বাড়িয়ে আকাশের দিকে তুলে ধরে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর সে প্রার্থীর হাতে দিয়ে বলে—খাইয়ে দিগে যা। যা। ভাল হয়ে যাবে।
লোকে বলে—ভাল সত্যি হয়ে যায়।
সাহেবরা ওষুধ নেয় না, কবচ নেয়। গন্ধ শোঁকে। মাটি গুড় হয়ে যাওয়া দেখে টাকা দিয়ে যায়, পাগল কখনও নেয় কখনও ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
বীরেশ্বর দূরে দাঁড়িয়ে এসব দেখেছেন। হেসেছেন সাহেব-মেমের বিস্ময় দেখে। তাঁর নিজের এসবের জন্য কোন আকর্ষণ নেই। তিনি জানেন, এর মধ্যে কোথায় এমন সুক্ষ্ম জালিয়াতি আছে তা ধরা যায় না। অথবা যদি এটা সত্যিও হয় তবে ওতে তার কি দরকার? ওর দাম কতটুকু? গল্প আছে—কে একজন সিদ্ধিলাভ করে ভরানদীর স্রোতের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে পার হয়ে এসেছিল। তা দেখে লোকের যত বিস্ময়ই লাগুক, দাম কষলে তো তার দাম একটা পয়সা। খেয়াঘাটের পারানি তো এক পয়সা। আবার তাঁর মত লোকের কাছে কিছুই না, যত বড় তুফানই হোক বীরেশ্বর রায় সাঁতার দিয়ে পার হতে পারেন।
এসবের জন্য নয়, বীরেশ্বর রায় ওদিকে বেড়াতে যেতেন রাত্রিকালে। সহিসদের মশাল নিভিয়ে দিতে বলতেন। তারপর অন্ধকারে অপেক্ষা করতেন। একদিন শুনতে পেয়েছিলেন গান। কলকাতায় আসার ক’দিন পরেই। সোফিয়ার সঙ্গেও তখন নিজেকে জড়ান নি।
অপূর্ব গান গাইছিল কেউ। অপরূপ। অধিকাংশ গানই রামপ্রসাদী সুরে। তার মধ্যে বাক্য- বিন্যাস অদ্ভুত, কিন্তু একটি বেদনা আছে। সর্বোপরি কণ্ঠস্বর। এবং সুরের আরোহী-অবরোহীর মধ্যে অতি সূক্ষ্ম দ্যুতিময় খেলা। প্রথম দিনের শোনা গানের কলিটা মনে আছে—
“হেরেছি, তবু হার মানিনি!
ধরেও বেঁধে রাখিনিকো,
পালাবি তুই তা জানি নি।”
ভারী ভাল লেগেছিল। কোনখানে যেন নিজের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল কথাগুলো। তিনি উদ্ভ্রান্তের মত জঙ্গল ভেঙে খুঁজে বের করেছিলেন গায়ককে। একটা গাছতলায় বসেছিল এই পাগল। ওকে চিনতেও পেরেছিলেন। চৌরিঙ্গীর ধারে ওর বুজরুকি এর আগে দেখেছিলেন। বীরেশ্বর রায়কে দেখে পাগল চমকে উঠেছিল।
বীরেশ্বর হেসে বলেছিলেন—ভয় পাচ্ছ? আমি পুলিশ নই।
পাগল উঠে দাঁড়িয়েছিল, তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে বলেছিল—তুমি কে? কি নাম তোমার?
—কেন?
—তুমি প্রেত?
ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন বীরেশ্বর, ধমক দিয়ে বলেছিলেন—চোপরও উল্লুক।
গ্রাহ্য করে নি পাগল, মুখের দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে তাকে দেখছিল। বলেছিল-আমি তোমাকে চিনেছি। ঠিক চিনেছি। কীর্তিহাটের ওপারে জঙ্গল—মাঝখানে কাঁসাই। হাঁ!
চমকে উঠেছিলেন বীরেশ্বর। দু পা পিছিয়ে এসে বলেছিলেন—কে তুমি? কি করে জানলে এসব?
হা-হা করে হেসে উঠেছিল পাগল। হা-হা-হা-হা-হা-হা! গাছের ভিতর থেকে সে হাসির আওয়াজে কটা বাদুড় উড়ে পালিয়েছিল। কিছুটা দূরে কারা যেন ভয়ে বু-বু শব্দ করে উঠেছিল। ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল, চাঁদের আলোয় দেখতে পেয়েছিলেন বীরেশ্বর। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলেন—থাম, থাম, এমন করে হেসো না তুমি! বীরেশ্বর রায় ওতে ভয় পায় না। থমকে গিয়েছিল পাগল। আরও কাছে সরে এসে—পাগল বলেছিল-বীরেশ্বর? বীরেশ্বর! ব দিয়ে নাম।
চাঁদের আলোয় তার চোখ দুটো চক-চক করছিল। তারই মধ্যে বীরেশ্বর অনুভব করেছিলেন পাগলের ওই দৃষ্টির মধ্যে বিস্ময় আর বিমুগ্ধতা ফুটে উঠেছে।
পাগল বলেছিল—সেই বেইমান—সেই জোচ্চোর-সেই নুড়িটা—সেটা আছে তো? সৌভাগ্য-শিলা? রাজ-রাজেশ্বরী? অনেক টাকা অনেক ভূমি দিয়েছে তো? রাজা করে দিয়েছে? খুব ননী খেতে দাও—মাখন- ছানা—মালপো-পায়েস দাও তো!—আর সেই নেংটি সব্বনাশী? ওঃ-ওঃ-ওঃ। বেশ কথা বলতে বলতে পাগল যেন হঠাৎ যন্ত্রণায় অধীর হয়ে বলে উঠেছিল—ধরলি, টিপে ধরলি গলা? ধরলি? ছেড়ে দে, ছেড়ে দে! বলে নিজেই নিজের গলা দুই হাতে টিপে ধরলে। এবং মুখ গুঁজে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগল!
বীরেশ্বর রায় বাঘ শিকার করেছেন-রাত্রির অন্ধকারে সুন্দরবনের মধ্যে বসে কাটিয়েছেন। দুর্দান্ত সাহসী পুরুষ। তিনি সেদিন ঘামে ভিজে গিয়েছিলেন। গ্রীষ্মের কাল ছিল না, সেটা ছিল শীতকাল, তবু ঘাম দেখা দিয়েছিল ওই পাগলের কথায়, তার পাগলামিতে। পাগলামি তো নয়। এর কথা তো প্রলাপ নয়। এ তো সব সত্য! তাঁর পা দুটো যেন অবশ হয়ে গিয়ে- ছিল, চলেও আসতে পারেন নি। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন!
পাগল শাস্ত হয়েছিল অনেকক্ষণ পর। শান্ত হয়েছিল কেঁদে। বীরেশ্বর আস্তে আস্তে চলে আসতে পেরেছিলেন এতক্ষণে। গাড়ীর কাছে যখন পৌঁছেছিলেন তখন কোচম্যান ওসমান এবং সহিস দুজন ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। সহিসেরা নেভানো হাত-লণ্ঠন জ্বেলে বসেছিল। তারা পাগলের ওই হাসি শুনেছে। কজন লোককে পালিয়ে যেতে দেখেছে। আর অনেক দুরে হলেও তার ডাক শুনেছে। রাত্রিকালে তার নাম করতে নেই। ওসমান ঠিক এদেশী মুসলমান নয়। তবু এদেশের প্রবাদ মানে, এদেশে বাস করছে অনেকদিন থেকে, এ ডাক যে ডেকেছে তাকে ‘বড় মেয়া’ বলে। বড় মেয়া দক্ষিণ থেকে কলকাতা পর্যন্ত ধাওয়া করে। এক প্রহরে পাড়ি মারে পাঁচ সাত কোশ!
এরপর বীরেশ্বর বহুবার মনে করেছেন পাগলের কাছে যাবেন। কিন্তু যেতে সাহস হয় নি। তিনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না, ধর্মকে বিদ্রূপ করেন, তবু সেদিনের ঘটনার পর না-মেনে পারেন নি যে, এই পাগল অন্তর্যামীর মতো মানুষের কথা জানতে পারে, বলতে পারে। তিনি ভয়ে যান নি। যদি পাগল বলে—সে মরে নি! বলে যদি তেমনি অট্টহাসি হাসে। বললে তো তাঁকে বন্দুক নয় পিস্তল পকেটে নিয়ে দুনিয়া ছুঁড়ে বেড়াতে হবে, তাকে বের করে ওই বাঘিনীটার মত গুলি করে মারতে হবে। না হলে আত্মহত্যা করতে হবে। তবে দূরে দাঁড়িয়ে গান শুনে আসতেন। গানগুলির সুর রামপ্রসাদী হলেও গান রামপ্রসাদের নয়। রামপ্রসাদের গানের তখন খুব প্রচলন। রামপ্রসাদের গান সবাই চেনে এবং জানে। এ গান সম্ভবতঃ ওই পাগলেরই গান। ধর্ম ঈশ্বর মিথ্যা হোক, সিদ্ধপুরুষ বলে যারা খ্যাত তারা বুজরুক হোক ভণ্ড হোক, কিছু তৃষ্ণার্ত আকুল মানুষ আছে যারা মরীচিকার পিছনে ছুটে পাগল হয়ে যায়। বিচিত্রভাবে কিছু কিছু শক্তিও তারা পায় ওই পাগলের মত। যারা ওই পেয়ে খুশী হয় তারা করে খায় ওই ভাঙিয়ে, যারা খুশী হয় না তারাই পাগলটার মত কাঁদে। পাগল সুস্বর সুদক্ষ গায়ক, হয়তো নিজের দুঃখ গান বেঁধেই গেয়ে থাকে। গান শুনেছেন, ভুলেও গেছেন বীরেশ্বর। প্রথম দিনের দু কলি মনে আছে, আর আছে আর একদিনের গান—
“এবারে রণে ক্ষান্ত দে মা
মা বলে ধরিলে পায়ে
তবুও কি তোর নাই ক্ষমা!
না হয় এবার খড়্গাঘাতে
শেষ করে দে মুণ্ডপাতে
মুণ্ডটা ঝুলায়ে হাতে
তা-থৈ-তা-থৈ নাচো শ্যামা!
এ পাগল তো সেই পাগল। সহিসরা বললে—দক্ষিণেশ্বরে তারা ওকে দেখেছিল। ওসমান বললে—দৌড়কে দৌড়কে আকে বস্।
—হ্যাঁ হুজুর, সব্বাঙ্গে ধুলো মেখে এল। আমাদের গাড়ীর ছামনে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর মন্দিরের চূড়োর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর যা করে কালীঘাটে গিয়ে, ওই ফিরে পালিয়ে আসে—
বীরেশ্বর রায় জিজ্ঞাসা করলেন—পালিয়ে আসে কেন?
ওসমান বললে—উ কৌন জানে হুজুর? ই তো সিদ্ধাই ফকীর! উসকা বাত কোই নেহি জানতা!
বীরেশ্বর রায় সেদিন পথে ওই পাগলকে ফেলে চলে আসতে পারেন নি। আঘাত লোকটিকে কম লাগেনি। বেশ আঘাত পেয়েছে। ঘোড়া দুটো লাগামের টানে নিজেদের সামলাতে সামনের পা চারটে তুলে ‘শিরপা’ হয়ে ডাইনে ঘুরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, না হলে পাগলের উপর দিয়ে তারা দুর্দান্ত বেগে গাড়ীখানাকে টেনে নিয়ে চলে যেত, গাড়ীটা হয়তো খানিকটা লাফিয়ে উঠত, বীরেশ্বর রায় ঝাঁকানি খেতেন। কিন্তু লোকটা চাপা পড়ত। মরে যেত। এতে লোকটা চাপা পড়ে মরে নি, কিন্তু গাড়ীর বোমের এবং ঘোড়ার মুখের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে ঘায়েল হয়ে গেছে। রায় লোকটিকে চিনে পথে ফেলে দিয়ে আসতে পারেন নি, তাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে ফিটনের পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে, নিজে সামনের ডগসিটে বসে কলকাতা এসেছেন। গাড়ীটা যখন টালা পেরিয়ে কলকাতা ঢুকছে, লোকটির তখন হুঁশ হয়েছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল সে বীরেশ্বর রায়ের দিকে।
রায় বলেছিলেন–কি? কেমন মনে হচ্ছে?
সে বলেছিল—তুমি সাক্ষী রইলে তো!
—কিসের?
—কি রকম মারলে আমাকে? কিন্তু দেখ, মারলে না! উঁহু, মারতে পারলে না।
—বাজে বকো না। পড়ে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। এখন কেমন মনে হচ্ছে?
—ভাল। ভাল। এই পিঠে হ্যাঁ, এইখানে কন্ক করছে। ও কিছু নয়! ভাল হয়ে যাবে। তা আমাকে নামিয়ে দাও না কেন?
—না, চল, যাবে তো চৌরিঙ্গীর মাঠে। আমি যাব জানবাজার। নামিয়ে দোব চল।
—তুমি বীরেশ্বর? বীরেশ্বর রায়?
—হ্যাঁ। কি ক’রে চিনলে আমাকে? সত্যি বলবে!
—সেদিন তুমি বললে!
—না। তুমি আমাকে চিনেছিলে আগেই। বল।
—বলব?
—হ্যাঁ।
মুহূর্তে রূপান্তর ঘটে গেল পাগলের, সে নিজের গলা টিপে ধরে বললে-ছাড়। ছাড় ছাড়। আঃ-আঃ! নিজের হাতের মুঠি সে ক্রমশঃ কঠোর থেকে কঠোরতর করে তুলতে চাচ্ছে। বীরেশ্বর শঙ্কিত হয়ে তার হাত দুখানাকে ছাড়াবার জন্যে টেনে ধরলেন। পাগল হাত ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর বললে—বলতে দেয় না। গলা টিপে ধরে।
—কে?
—কে আবার? ওই ওই, মন্দিরে এসেছে আজ! ওই!
—পালিয়ে এলে কেন?
—ভয়ে! ভয়ে! আমাকে দেখলেই আঃ-আঃ-ছাড় ছাড়! আবার সে টিপে ধরলে নিজের গলা।
বীরেশ্বর আবার টেনে ছাড়িয়ে দিলেন, বললেন –থাক, বলতে হবে না!
সে গাড়ীর কোণে চুপ করে বসে রইল। বীরেশ্বর ভাবছিলেন ওরই কথা। মনে ঘুরছিল শেকসপীয়রের হ্যামলেটের কথা—
There are more things in heaven and earth-than are dreamt of in your philosophy.
বীরেশ্বর ওই কোটেশনটা মনে করে সান্ত্বনা পেলেন। সান্ত্বনা ঠিক নয়—মনে মনে একটা কিনারা খুঁজে পেলেন। হঠাৎ মনে পড়ল—ক’দিন আগে কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়ী গিয়েছিলেন, তিনি এক ব্রাহ্ম নেতার বাড়ীর গল্প বললেন, তাঁর স্ত্রীকে ডাইনীতে নজর দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ডাক্তার বৈদ্য হার মেনে গেলে ওঝা এনেছিলেন তিনি, তাইতেই রোগিণী সুস্থ হয়েছে।
ভাবতে ভাবতেই তিনি পাগলকে ভাল করে দেখছিলেন। এককালে পাগল নিঃসন্দেহে সুপুরুষ ছিল। মাথাভর্তি কাঁচাপাকা রুখু চুল, মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ, সর্বাঙ্গে একটা ধুলার আস্তরণ, তার নিচে ময়লার একটা ছোপ পড়েছে। কপালটা যেন ছেঁচা। চামড়া কুঁকড়ে গেছে। একটা লম্বা কাটা দাগ, লম্বালম্বি নেমে এসেছে কপাল থেকে গোঁফের উপর পর্যন্ত, বাকীটা গোঁফদাড়ির মধ্যে বিলুপ্ত, দেখা যায় না!
বললেন-তোমার কপালে মুখে ওই দাগগুলো কিসের?
শান্তকণ্ঠে পাগল বললে—হেঁচেছে। ছেঁচে ছেঁচে মেরেছে পাথর দিয়ে।
—কে?
—কে আবার! সর্বনাশী! ওঃ, কী প্রহার কী প্রহার কী প্রহার! ও আর কতটুকু? বুকের ভিতরে আগুনে পুড়িয়ে লোহার শিক দিয়ে বেঁধে।
চুপ ক’রে রইলেন বীরেশ্বর। বুঝলেন না ঠিক। তবে সে যে অধ্যাত্মসাধনার কথা বলছে তাতে আর তাঁর সন্দেহ রইল না। এবং তাঁর নাস্তিকতাবিশ্বাসী মনের যে ধারালো ব্যঙ্গবিদ্রূপের ছুরিখানি, সেখানি যেন কেমন ভোঁতা হয়ে গেল। লোকটার সর্বাঙ্গে তার জীবনের বার্তাগুলি ফুটে রয়েছে, তা যেন পাথরে খোদাই করা বার্তা। ওকে ছুরির ধারে মুছে বা চেঁচে ফেলা যায় না!
গাড়ী লর্ড ওয়েলেসলির তৈরী বাহার সড়ক বা সার্কুলার রোড ধরে ডিহি শেয়ালদহকে বাঁয়ে রেখে এন্টালীতে ধর্মতলার মোড় নিয়ে উঠল জানবাজারে। স্নানযাত্রার দিন আজ, চীৎপুর রোডে ভিড়ের অন্ত নাই। কাতারে কাতারে লোক ছুটেছে গঙ্গায় চুবতে। এ ছাড়াও বাবু-ভাইয়েরা বজরা নৌকো পানসী করে চলেছে মাহেশ। তার উপর এবার রাণী রাসমণির মন্দির প্রতিষ্ঠা দক্ষিণেশ্বরে। বাহার সড়কের এ পাশে হিদুর অঞ্চল কম। মুসলমান দেশী ক্রীশ্চান বেশী, পথটাও ভাল। গাড়ী ধর্মতলার মোড়ে চৌরিঙ্গীতে মোড় নিল। রায় ভাবলেন, ওকে নামিয়ে দেবেন। কিন্তু লোকটা যেন ধুঁকছে। ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ ক’রে কোণে ঠেস দিয়ে বসে আছে। দেখে মমতা হল বীরেশ্বরের। ওকে ডাকলেন না। একেবারে বাড়ির দরজায় এসে গাড়ি দাঁড়ালে ওকে ডাকলেন—শুনছ?
—এ্যাঁ!
—এসে পড়েছি, নামো।
চারিদিক চেয়ে দেখে পাগল বললে-এ কার বাড়ী?
—আমার।
—তোমার? কীর্তিহাটের রায় হুজুরের?
—হ্যাঁ।
—এখানে কেন নামব?
—আমি বলছি বলে নামবে।
—আমার সব কেড়ে নেবে?
হেসে ফেললেন বীরেশ্বর, বললেন—কি আছে তোমার?
—হ্যাঁ, কিছুই নাই। কিছুই নাই।
—চল। ভয় নাই। স্নান করে। কিছু খাও। তারপর সুস্থ হয়ে যাবে তোমার যেখানে ইচ্ছে।
—চল।
—মারবে না তো?
—না।
বাড়ীতে ঢুকে পাগল বাড়ীর আসবাব ঐশ্বর্য দেখে বোধ হয় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। দেওয়ালে কুড়ারাম রায়-ভট্টচাজের এবং সোমেশ্বর রায়ের অয়েল পেন্টিং টাঙানো ছিল। তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইল। হঠাৎ সোমেশ্বরের ছবিকে বললে—নরক ভোগ করছ তুমি! হুঁ—হুঁ, করবে না? তারপর ঘাড় নেড়ে বললে না—না। না—তুমি প্রায়শ্চিত্ত করেছ। তা করেছ!
কুড়ারামকে বললে—আচ্ছা লোক। তোমাকে কিছুতে ছুঁতে পারে না। আচ্ছা লোক!
বীরেশ্বর চাকরকে বললেন—একে যত্ন ক’রে স্নান করা। নতুন কাপড় দিবি। বুঝলি? কিছু খেতে দে। বলে উপরে চলে গেলেন।
সোফিয়া থাকত নিজের বাড়ীতে বউবাজারে। আসত সন্ধ্যেবেলা। গাড়ী গিয়ে নিয়ে আসত। দিনের বেলা বাড়ীটা চাকর-বাকরের হাতে। চাকর অনেক। বীরেশ্বর রায় উপরে গিয়েই প্রথম এক গ্লাস মদ্য পান করে স্নান করলেন। তারপর খেতে বসবার আগে চাকরকে জিজ্ঞাসা করলেন—পাগলটাকে স্নান করিয়েছিস? খাইয়েছিস?
—হ্যাঁ।
—নতুন কাপড় দিয়েছিস?
—দিয়েছি। তা ছিঁড়ে আধখানা ক’রে পরেছে।
—কি করছে?
—মেঝের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
—তা হ’লে ঘুমুক। ডাকিস না ওকে।
এরপর রায়ও ঘুমিয়েছিলেন। ঘুমের জন্য তাঁর শরীরও কাতর হয়েছিল। কলকাতার ফ্যাশানে সেকালে বিদগ্ধ এবং ধনীসমাজের কেউ রাত্রি বারোটা-একটার আগে শুতেন না। উঠতেন বেলা দশটায়। রায় সোফিয়াকে নিয়ে জেগে থাকতেন, দুটো তিনটে পর্যন্ত মাইফেল হত। বন্ধুবান্ধব জুটত। তারা বিদায় হত বারোটায়, তারপর সোফিয়া আর তিনি উল্লাস করতেন। উন্মত্ত উল্লাস! সোফিয়া ক্লান্ত হত, তিনি হতেন না। মধ্যে মধ্যে সোফিয়া বলত—মেরি মালিক!
—বাতাও।
—হুকুম দাও তো বাঁদী একটা কথা বলে।
—বল। বল। দো চার দশ বিশ যত তোমার দিল চায় বাতাও!
—এ যে তুমি তোমার শরীরকে বিলকুল বরবাদ করছ মালিক। এমন করলে শরীর তোমার ক’দিন টিকবে?
—যত দিন ঢেঁকে।
—যদি বেমারি হয়! যদি ভেঙে পড়ে যাও।
—তো জহর পিকর মর যাউঙ্গা। বলে হা হা করে হেসে উঠেছিলেন। তারপর বলেছিলেন –কি তুমি মথকে গেছ?
ক্লান্তভাবে হেসেছিল সোফিয়া। রায় বলেছিলেন—তা হ’লে বল তোমার সঙ্গে আরও একজন দু’জনকে আনি!
সোফিয়া বলেছিল—না। কিন্তু রায় মানেন নি, সন্ধ্যার আসরে সোফিয়ার সঙ্গে নিত্যনূতন একজনকে আনবার ব্যবস্থা করেছিলেন। জীবনে প্রচুর সম্পদ পেয়েছেন তিনি এবং জেনেছেন নারী শুধু ভোগেরই সামগ্রী, —ভালবাসা একনিষ্ঠা ওসব মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা। সুতরাং ভোগের বিষয়ে তিনি উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। রাত্রি তিনটের আগে তাঁর দেহমন ক্লান্ত হত না। উঠতে দেরী হত, দশটার আগে নয়, বারোটাও হয়ে যেত এক-একদিন। আজ সকালে উঠতে হয়েছিল রাণীজীর মন্দিরপ্রতিষ্ঠার নিমন্ত্রণরক্ষার জন্য। ফিরে এসে খেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙল গানের সুরে। ঘুমের ঘোরের মধ্যে কয়েক মুহূর্ত তিনি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। তারপরই মনে হল পাগলের কথা। এ সেই পাগল গাইছে। সেই কণ্ঠস্বরই বটে। কিন্তু আজ আর সেই গান অর্থাৎ রামপ্রসাদী সুরে মনের কথার গান নয়। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ ছিল, টানা পাখা চলছে, কিন্তু তাতেও যেন অসহ্য গুমোট। দেহে অবসাদ, চোখের পাতায় ঘুমের জড়িমার সঙ্গে মদের ঘোর রয়েছে। পাগলের সুরের খেলা মৃদুধ্বনিতে কানে আসছে; ধীরে ধীরে তিনি বুঝলেন—মিয়া-কি-মল্লারে আলাপ করছে পাগল। পাগলেরও বোধ হয় এই গুমোট গরম অসহ্য বোধ হয়েছে। ৩১শে মে—জ্যৈষ্ঠের অর্ধেক চলে গেছে। আজ কুড়িদিন বিন্দুবর্ষণ হয় নি, মেঘ ঝড় উঁকি মারে নি। পৃথিবী যেন পুড়ছে, ঝলসাচ্ছে। তবু বিকেলে একটা ঝড়ো হাওয়া বয়, ঠাণ্ডা জলো ভারী হাওয়া। তাও দু’দিন থেকে বন্ধ। পাগল মিয়া-কি-মল্লার সাধছে বোধ হয় মেঘ জলের জন্য। একটু হাসলেন বীরেশ্বর। কিন্তু সে হাসি শেষ হতে না-হতে তিনি চমকে উঠলেন একটা দীপ্তিতে। বদ্ধ দরজা-জানালা ঘরেও একটা রূঢ় তীব্র আলোর আভাস চকিতে ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট গর্জনে মেঘ ডেকে উঠল। তিনি উঠে পড়লেন বিছানা থেকে। উঠে গিয়ে পশ্চিমদিকে রাস্তার ধারের জানালাটা খুলে দিলেন।