Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাঠপিঁপড়ে || Atin Bandyopadhyay

কাঠপিঁপড়ে || Atin Bandyopadhyay

বিশ্বরূপ আজ মোট উনিশটি কাঠপিঁপড়ে নিধন করে …ধরের দরজার দিকে এগোল। খুব খুশি। ওদিক থেকে আবার একটা তেড়ে আসছে। পাঁচিল থেকে নেমে সেফটি ট্যাঙ্কের দিকে এগোচ্ছে। আর এগোতে দেওয়া যায় না। পালাবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। পালাচ্ছে না। সারবন্দি যারা যাচ্ছিল—তারা নেই। জানবে কি করে বিশ্বরূপের মেজাজ গরম। এত উৎপাত কাঠপিঁপড়ের! শেষ করে দাও।

চটাস। চটি দিয়ে পিঁপড়ের দফা রফা। চেপ্টে গেছে। সারা বাড়িটার এখানে সেখানে সে সুযোগ পেলেই বের হয়ে পড়ে। এত মারছে, তবু শেষ হচ্ছে না। এদের চলার রাস্তা পাঁচিল ধরে, তারপর সেফটি ট্যাঙ্ক, তারপর সিঁড়ির দরজা। সামনের বারান্দায়ও ঢুকে যাবার ফন্দি। বাসা বানাবার তালে আছে। দরজা জানালার ফাঁকফোকড় খুঁজছে। কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিল না বিশ্বরূপ। এত বিষ হুলে, যে একবার তার বড়ো নাতনির পাছায় হুল ফুটিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্রণায় কাতর —চুন লাগিয়ে দেওয়ার পর পাছাখানা কিছুদিন টিবি হয়েছিল। বিষ বেদনায়ও কষ্ট পেয়েছে।

আসলে পাঁচিলের পাশের আমগাছটা ছিল এদের আস্তানা। গাছের খোঁদলে বাসা। গাছ থেকে খাবারের খোঁজে হয়তো বাড়ির দেওয়ালে, পাঁচিলে, বারান্দায় এমনকী দোতলার জানালার কাঠে ঘোরাঘুরির মজা পেয়ে গেল। হয়তো তার এ নিয়ে মাথা ব্যথাও থাকত না।

মুশকিল বাঁধাল, প্রথম বড়ো নাতনির পাছায় হুল ফুটিয়ে। তারপর একদিন বিশ্বরূপ নিজেও আক্রান্ত হল।

চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিল, হঠাৎ দংশন ঊরুর নীচে। প্রচণ্ড জ্বালা। সঙ্গে সঙ্গে সে ওটির নিধন পর্ব সেরে চুন হলুদের ব্যবস্থা। এবং পর পর বাড়ির সবাই যখন কোনো-না-কোনোভাবে আক্রান্ত হতে থাকল, বড়ো পুত্রবধূর অভিযোগ গাছটা থাকলে, কাঠপিঁপড়ে কামড়াবেই। যত রাজ্যের পোকা-মাকড়ের উপদ্রব গাছটায়। শত হলেও গাছটা বিশ্বরূপ নিজে লাগিয়েছে। তার মায়া হবার যথার্থ কারণ আছে।

ছোটো ছেলেরও ইচ্ছে গাছটা কেটে ফেলা হোক। কাঠপিঁপড়ের উপদ্রব থেকে তবে বাঁচা যাবে। বিশ্বরূপ একদিন কি ভেবে নিজেই গাছটায় উঠে গেল। … তারপর নেমে এল ফুলে ঢোল হয়ে। জ্বালা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে চিৎকার করে ডাকল, পূর্ণ আছিস। কর্তার ডাকে, আজ্ঞে বলে হাজির। গাছে পূর্ণকেও উঠতে বলতে পারত। তবে বাড়ির সবাই যখন গাছটা কেটে ফেলার ব্যাপারে সমর্থন জানাচ্ছে, তখন পূর্ণ গাছে উঠেই—ওরে বাবা গেলুমরে মলুমরে বলে চেঁচামেচি শুরু করে দিতে পারে। সবার সমর্থনের বিরুদ্ধে সে যেতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। কাঠপিঁপড়েতে গাছটা ছেয়ে আছে কর্তা, সে বলতেই পারে। সত্য মিথ্যা যাচাই করতে গেলে তার না উঠে উপায় কি! গাছটা যেন সবাইকে কামড়াচ্ছে।

একটা গাছও রাখা গেল না। চার কাঠা জমি নিয়ে বাড়ি। ফল ফুলের গাছ না থাকলে বাসস্থান হয়, তবে নিজের ঘরবাড়ি মনে হয় না। গাছ না লাগালে বাড়ির জন্য মায়াও জন্মায় না। সেই ভেবে একটা আম গাছ, একটা শেফালি গাছ, পেয়ারা গাছ দুটি এবং একটি কামিনী ফুলের গাছ সে লাগিয়েছিল। গিন্নিরও মেজাজ প্রসন্ন। গাছগুলো বড়ো হতে থাকলে গিন্নি একদিন অত্যন্ত আদরের গলায় বলেছিল, এখন তোমার বাড়িটাকে বাড়ি মনে হচ্ছে। বাড়িতে শুধু পুত্র-কন্যারাই বড়ো হযে, গাছ বড়ো হবে না হয়!

গিন্নি নেই। তিনি গত হয়েছেন চার পাঁচ সাল আগে। পেয়ারা গাছদুটো সে নিজেই কেটে ফেলেছে। পাশের প্রাথমিক স্কুলের হনুমানগুলির জ্বালায় দুপুরের ঘুম মাটি। সারা দুপুর গাছে উৎপাত, দাও কেটে, বাঁচি। বছর খানেক আগে শিউলি গাছটাও কেটে ফেলতে হল। বর্ষাকালে এত শুয়োপোকার উপদ্রব যে, ঘরের মেঝেতে, দেয়ালে তারা উঠে আসতে থাকল। জামা-প্যান্টের ভিতরও খুঁজে পাওয়া যেতে থাকল। জ্বালা যন্ত্রণা, চাকা চাকা দাগ। কী আর করা! দাও কেটে। ছিল আমগাছটা।

সে নিজে উঠে যায়। ফুলে ঢোল হয়ে নামল, তখন আর সংশয় থাকার কথা। দিল কেটে। কাঠপিঁপড়ের ঘাঁটিটি অন্তত তছনছ করে দেওয়া গেল।

এখন গাছের কাঠপিঁপড়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটে। সারা বাড়িটায় বোধহয় ছড়িয়ে পড়ার তালে আছে।

ছোটোছেলে জানাল, ছোটোবৌমা মাস দুই পরেই চলে আসছে নবজাতককে নিয়ে। তার একমাত্র বংশধর। নীচের তলায় থাকুক আর উপরের তলাতেই থাকুক কাঁথা কাপড়ের সঙ্গে অগোচরে দুটো-একটা কাঠপিঁপড়ে বিছানায় উঠে আসবে না বলা যায় না। কামড়ালে কি যে হবে! আর যদি কানের ভিতর ঢুকে যায়, শিশু সে বুঝবে কি করে দাদুর আমগাছের পিঁপড়ে তার কানে ঢুকে গেছে, আর যদি কানের পর্দায় হুল ফুটিয়ে দেয়, তবেই হয়েছে। যেন বিষধর সর্প তার সামনে ফণা তুলে আছে। আতঙ্ক।

সুতরাং গাছটি কেটে ফেলা ছাড়া তার উপায়ও থাকল না। গাছ না থাকলে তারাও থাকবে না। অন্য কোথাও ডেরা বানিয়ে নেবে।

গাছ কাটল ঠিক, ফল হল বিপরীত। সারা বাড়ির দেয়ালে পাঁচিলে, দরজায় পিলপিল করে ধেয়ে আসছে। কাঠপিঁপড়ে কি শেষ পর্যন্ত তাদের বাড়িছাড়া করে ছাড়বে!

প্রথমে গ্যামাকসিন।

যে যাই বলে। বেগন স্প্রে করুন। কেরোসিন তেল ঢেলে দিন চলার রাস্তায়। গ্যামাকসিন ছড়িয়ে দিন। বেগন স্প্রে করল। গ্যামাকসিন দিল। কেরোসিন তেল ছড়িয়ে দিল, কিছুটা উৎপাত কমল বটে, তবে রেহাই পাওয়া গেল না। বৃষ্টিতে ধুয়ে-মুছে গেল ফের উৎপাত। তারপর দেখা গেল, কোনো কিছুতেই আর কাজ হচ্ছে না।

অল প্রুফ কাঠপিঁপড়ে।

অনায়াসে তারা গ্যামাকসিনের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। ঘরে ঢোকে। মেঝেতেও দু-একটা চোখে পড়ে। বারান্দার দেয়ালে। যে যা বলছে, সবই করে দেখেছে। কিছুই ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

অগত্যা নিধনযজ্ঞও।

রোজ অবসর পেলেই, একটা চটি হাতে উঠে আসে। প্রথম বারান্দা দিয়ে শুরু। বারান্দার দেওয়ালে তিনটে কাঠপিঁপড়ে হাঁটছে। চটি দিয়ে চটাস। একটা পড়ে গেল। হাত-পা গুড়িয়ে গেল। পেট চেপ্টে গেল। আরও একটা চটাস। পড়ল ঠিক তবে মরল না। মরবে মরবে ভাব। রান্নাঘরে নেই। পাঁচিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পিলপিল করে আসছে। সে মারছে আর আসছে। মারছে। আবার আসছে। এক সময়ে মনে হল পাঁচিল ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বারান্দায় ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে, অবাক হয়ে দেখছে, আবার ঠিক তিনটে কাঠপিঁপড়ে। মরা কাঠপিঁপড়েগুলো পিঠে নিয়ে উঠে যাচ্ছে।

ঠিক মরা বলা যায় না। হাত-পা নড়ছে। সে চেপ্টে দিয়েছিল, বেলুনের মতো বাতাসে আবার ফলে উঠছে যেন। কাঠপিঁপড়ের জান এক কঠিন। কচ্ছপের। চেয়েও বেশি। পাঁচিলের দিকটায় গিয়ে দেখতে হয়। আবার কোথা থেকে আধমরাগুলো পিঠে তুলে কাঠপিঁপড়েরা হেঁটে যাচ্ছে। তবে সে হেঁটে যাবার সুযোগ দিচ্ছে না। জোড়ায় জোড়ায় নিধন হচ্ছে এবারে।

মাসখানেক ধরে এই করে যাচ্ছে। কিন্তু একটা পিঁপড়েরও খোঁটা ওলটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। মরে যায় আবার দুদিন গেলেই বেঁচে ওঠে।

সে কাঠপিঁপড়ের গতিবিধিও লক্ষ রাখছে। আসলে সে এক সকালে একই জায়গায় বসে কাঠপিঁপড়ে নিধনে মত্ত হল। মারছে। মরছে। আবার কোথা থেকে মৃত কাঠপিঁপড়েদের খোঁজে পিলপিল করে তারা চলে আসছে। কি করে খবর পেয়ে যায়—সে বোঝে না। সাঙ্কেতিক বার্তা পাঠাতে পারে বোধহয়। সারা বাড়ি ঘোরারও দরকার নেই, তবে এক জায়গায় বসে ক্রমাগত মেরে গেলেই হয়।

চটাস শব্দ শুনলেই বাড়ির সবাই বুঝে ফেলে বাবা এখন পিঁপড়ে নিধনযজ্ঞে মেতে গেছেন। পূর্ণ বলবে, কর্তার শুরু হয়ে গেল। মাথায় তার কেমন একটা জেদ চেপে গেল।

একসময় দেখল, সে নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে গেছে। ফকির আমজাদ মাঝে মাঝে ভিক্ষে করতে আসে। বাবুর সঙ্গে তার সুখ-দুঃখের গল্পও হয়। আগে এলে দেখতে পেত, বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে তিনি কি পাঠ করছেন, এখন এলে দেখে পাঁচিলের পাশে গোঁজ হয়ে বসে আছেন। কিছু বললেই, হাত তুলে ইশারা, ভিক্ষে দিয়ে চলে যাও। কথা না। এত মনোযোগ দিয়ে কি করেন।

সে না পেরে একদিন পাঁচিলে উঁকি দিয়ে দেখেছিল, বাবুর একহাতে চটি, এক পায়ে চটি। একটা চটি হাতে, একটা চটি পায়ে কেন! সে ভড়কে গিয়ে বলেছিল, বাবুর কি মাথা ঠিক আছে।

বিশ্বরূপ তাকাল। করিম ভিক্ষে, ধর্মের নামে বড়ো বড়ো কথা, আমার মাথা ঠিক নেই, তোমার আছে! সে জবাব দিল না।

বাবু রেগে গেছেন কথাটাতে। হেন অযৌক্তিক কথা বলা ঠিক হয়নি। সে খুব বিব্রত বোধ করে বলল, বাবু কী খুঁজছেন?

বিষধর সাপ।

কোথায়!

এই যে বলে কাগজে কুড়নো ডাইকরা মৃত পিঁপড়ে দেখাল। বলল, শালাদের পুড়িয়ে মারছি। আমার সঙ্গে চালাকি।

ফকির আমজাদ বলল, বাবু ভাবলে বিষধর সর্প—না ভাবলে জীব। সে যার মধ্যে বিচরণ করে। আপনি আমি তার কি ক্ষতি করতে পারি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *