Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

শীত আসিতেছে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

শীত আসিতেছে। সকালে ঘাসে আলগা শিশির লাগিয়া থাকে, শেষরাতের দিকে চাদর গায়ে টানিয়া দিতে হয়। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঘরে উনানে আঁচ পড়িলে ধোয়া জমিয়া যায়, বাতাস না থাকায় ধোঁয়া সরে না। রাত্রে আকাশ একেবারে পরিষ্কার হইয়া যায়, মেঘ আসিয়া নক্ষত্রদের ঢাকিয়া দেয় না। পাড়ায় পাড়ায় ধুনুরীদের হক শোনা যায়-লেপ বানাবে নাকি মা-ঠাকরুন, বাছাই করা ভালো তুলে ছিল–

তারপর শীত আসিয়া গেল। কাজল শীত ভালোবাসে, শীত পড়িলে তাহার মনের ভিতরে একটা বড়ো রকমের ওলটপালট হয়। যে মন লইয়া সে গ্রীষ্ম উপভোগ করে, তাহা লইয়া কখনই শীতের রিক্ত রূপ উপলব্ধি করা যায় না। শীত আসিবার আগে হইতেই সে মনে মনে প্রস্তুতি চালাইতে থাকে, মনের জানালা হইতে পুরাতন পর্দা খুলিয়া নূতন পর্দা লাগায়, ফ্রেম হইতে ছবি খুলিয়া দেয় সেখানে নূতন ছবি লাগাইবে বলিয়া। হেমন্তের মাঠে মাঠে হাঁটিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে শীতের জন্য মন তৈয়ারি হইয়া ওঠে। খাইতে বসিয়া রান্নায় ধনে পাতার গন্ধ পাইলেই বোঝা যায় আর দেরি নাই।

ঠাণ্ডার মধ্যে মাঠে ঘুরিতে আলাদা আমেজ। মৃদু রৌদ্রে পিঠ দিয়া দূরে তাকাইয়া থাকিলে ক্রমশ মনটা উদাস হইয়া যায়। কলিকাতার কলরবের ভিতর সে নিজেকে ঠিক মেলিয়া ধরিতে পারে না–নিজের মনে বসিয়া চিন্তা করিবার অবকাশও সেখানে নাই। সমস্ত সপ্তাহ নগর জীবনের কোলাহলের মধ্যে কাটাইয়া একটা দিন শীতের মাঠে কাটাইতে ভালো লাগে। আল ছাড়াইয়া মাঠে নামিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে পায়ের নিচে মাটির ঢেলা গুঁড়াইয়া যায়, রৌদ্রদগ্ধ মাটি হইতে কেমন গন্ধ আসিতে থাকে—যে গন্ধ নিশ্চিন্দিপুরে ছোটবেলায় সে পাইত।

একদিন হাতকাটা সোয়েটারটা লইয়া কাজল কাঠালিয়ার মাঠে বেড়াইতে গেল। রৌদ্র তখন পড়িয়া আসিয়াছে, ঠাণ্ডা কিছুক্ষণ বাদেই হাড়ের ভিতর উঁচ ফুটাইতে আরম্ভ করিবে।

কাঁঠালিয়ার বাঁশবনটায় ঢুকিতে মনে হইল সে যেন স্বপ্নের রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। উৎসবের দিনে বাড়ির ছাদে সামিয়ানা খাটাইলে তাহার নিচে দ্বিপ্রহরেও যেমন একটা নরম আলো থাকে, বাঁশবনের ভিতরও তেমনি। না নড়িয়া চুপ করিয়া থাকিলে বাঁশপাতা ঝরিয়া পড়ার হালকা শব্দ শোনা যায়। বাতাস ক্রমেই ঠাণ্ডা হইতেছে, কিন্তু শীতের আমেজ জমাইবার জন্য কাজল সোয়েটার পরে নাই। একটা বাঁশের গায়ে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া সে অনুভব করে এ সমস্ত ছাড়িয়া সে বাঁচিতে পারিবে না। কলিকাতা তাহাকে প্রিয় বস্তু হইতে দূরে লইয়া যাইতেছে।

পানাপুকুরের পাশ দিয়া কাজল আখের আলির বাড়ি গেল। আখের উঠানের কিছু অংশ লইয়া একটা মুদির দোকান দিয়াছে। জিনিসপত্র বেশি নাই, নুতন দোকান। ব্যস্ত হইয়া আখের তাহাকে একটা নড়বড়ে কাঠের টুলে বসিতে দিল। কাজল বসিয়া বলিল–কেমন আছ আখের ভাই?

—আমাদের আবার থাকা না থাকা, তুমি কেমন আছ সেইটেই বড়ো কথা। তুমি তো এখন কলেজে পড়ো, না?

-হ্যাঁ, আই-এ পড়ি।

—কবছর লাগে এটা পড়তে?

–দু’ বছর। তারপর পাস করলে আবার দুবছর লাগে বি-এ পড়তে।

–বাব্বাঃ! তোমাদের দেখছি সারাজীবন ধরে পড়া আর পড়া! পড়া শেষ হতে হতে তো বুড়ো হয়ে যাবে।

–পড়াশুনো না শিখলে চলবে না আখের ভাই, চাকরি তো করতে হবে।

আখের একটা বড়ো রকমের নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—তা তো বটেই। আমার মতো নয়, সারাটা জীবন এখানেই কাটল–কিছুই শিখতে পারলাম না।

-কতদিন আছ তোমরা এখানে?

–অনেকদিন হয়ে গেল, আমার ঠাকুরদার বাবা প্রথমে এই জায়গায় এসে বসতি করেন। আমারও সারাজীবন এই গ্রামে কাটল বারকয়েক কলকাতায় গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু দেশ বেড়ানো যাকে বলে তা কিছুই হয়নি আমার কপালে।

এরপর আখের তাহাকে খাওয়াইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কাজল খাইবে না, সেও ছাড়িবে না। দোকানের টিন হইতে একটা ঠোঙায় করিয়া মুড়কি তাহার হাতে দিয়া বলিল—খাও, ভালো মুড়কি। নিজেদের খাবার জন্য রয়েছে, বিক্রির নয়।

আখেরের দোকান হইতে উঠিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। কিছুতেই সে ছাড়িতে চায় না। শীঘ্রই আসিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া কাজল মাঠের দিকে রওনা দিল। ঠাণ্ডা আর সহ্য করা যায় না, সোয়েটার গায়ে দিতে দিতে কাজল দেখিল, গোধূলির শেষ আলোকচ্ছটাও আকাশের গা হইতে মিলাইয়া গিয়াছে।

অন্ধকার মাঠের মধ্য দিয়া রোমাঞ্চকর যাত্রা। আকাশে চুমকির মতো অজস্র নক্ষত্রের ভিড়। জীবনটা যেন হঠাৎ শরীরের সংকীর্ণ পরিসর হইতে বাহির হইয়া দিহীন মহাশূন্যে মিশিয়া যাইতে চাহিতেছে। কাজলের মনে হইল, জীবন পৃথিবীর গণ্ডীর মধ্যে আরদ্ধ নহে—পৃথিবীতে বাঁচিয়া আছে বটে, কিন্তু পৃথিবী শেষ কথা হইতে পারে না। আপন অস্তিত্বকে সে মহাবিশ্বের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া অনুভব করিতেছে—তাহা কি মিথ্যা?

কাজল আজকাল বুঝিতে পারিতেছে বাবার সহিত তাহার মানসিকতার একটা আশ্চর্য মিল আছে। বাবার উপন্যাসগুলি পড়িতে পড়িতে সে অবাক হইয়া ভাবে, এমন নির্ভুলভাবে তাহার মনের কথা বাবা লিখিল কী করিয়া? ছোটবেলায় সে যাহা ভাবিত, আকাশের দিকে তাকাইলে তাহার মনে যে ভাব হইত, সব বাবা হুবহু লিখিয়াছে।

কাজল জানে, জীবন সাধারণভাবেই কাটিয়াছে। বাবা দারিদ্র্যের সহিত যুদ্ধ করিয়া, প্রতিপদে সংগ্রাম করিয়া তবে মানুষ হইয়াছিল। সে কিন্তু জন্মের পরে খুব একটা অসচ্ছলতা দেখে নাই, দারিদ্রের ভিতর যে কল্যাণস্পর্শ আছে তাহা সে কখনও অনুভব করে নাই। মাঝে মাঝে কাজলের মনে হয়, কিছুই তাহার বলিবার নাই। ইট-কাঠ-পাথরের ভিতর বাস করিয়া কিছু বলিবার থাকিতে পারে না। তবু এ কথাও মিথ্যা নয় যে তাহার তীক্ষ অনুভূতি তাহাকে অনেক রহস্যের সম্মুখীন করিয়াছে। জীবনের ভিতরও আর একটা গভীরতর জীবন আছে, তাহা সে বুঝিতে পারে। কী করিয়া সে এসব কথা না বলিয়া পারিবে?

একটা খাতায় দুইটি গল্প লিখি সে বন্ধুদের পড়াইয়াছিল। কলেজের বন্ধুদেব (মনেব মিল বেশি না থাকা সত্ত্বেও দুই-একটি বন্ধু তাহার হইয়াছে) মধ্যে অনেকেই তাহার বাবাব ভক্ত। তাহারা গল্প দুইটা আদ্যোপান্ত শুনিয়া বলিল–ভালোই হয়েছে, মন্দ কী! তবে ব্যাপার কী জানো, লেখার মধ্যে তোমার বাবার প্রভাব বড্ড বেশি।

কাজল মহা হাঙ্গামায় পড়িয়াছে। সে ইচ্ছা করিয়া বাবার বই দেখিয়া নকল করিতেছে না। তাহার চিন্তাধারার সহিত বাবার চিন্তাধারা মিলিয়া গেলে সে কী করিতে পারে?

প্রকাণ্ড মাঠের অর্ধেক পার হইয়াছে—এমন সময় কাজল দেখিল, কিছুদূরে মাঠের ভিতর বসিয়া কাহারা আগুন পোহাইতেছে। বেশ দৃশ্যটা। চারিদিকে শূন্য মাঠ, উপরে খোলা আকাশ, তাহার নিচে বসিয়া খড়-বিচালি জ্বালাইয়া কেমন আগুন পোহাইতেছে লোকগুলি। কীসের আকর্ষণে সে পায়ে পায়ে আগাইয়া গিয়া অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়াইল।

লোকগুলি দরিদ্র। এই ভয়ানক শীতে গায়ে একটা করিয়া সূতির জামা। তাহারা গায়ে গায়ে ঘেঁষিয়া হাত আগুনের উপর ছড়াইয়া নিজেদের মধ্যে কী গল্প করিতেছিল। কাজল আসিয়া দাঁড়াইতে লোকগুলি অবাক হইয়া তাহার দিকে তাকাইল। কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে কাজল অপ্রস্তুত বোধ করিয়া বলিল—আগুন পোহাচ্ছেন বুঝি?

অবান্তর প্রশ্ন। শীতের রাতে আগুন জ্বালাইয়া তাহার উপর হাত ছড়াইয়া অতগুলি লোক আগুন পোহানো ছাড়া অন্য কী করিতে পারে?

একজন বলিল–হ্যাঁ বাবা, আপনি বুঝি শহরে থাকেন? এই বুধো, সরে যা ওদিকে। বসুন বাবু ওইখেনটায়, আগুনের কাছে এসে বসুন।

বুধো তাহাকে সম্মান দেখাইয়া সরিয়া বসিল, কিন্তু বাকি কয়জন কেমন আড়ষ্টভাবে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল। তাহাদের চোখে শুধু বিস্ময় নহে, একটু যেন আতঙ্কও মিশ্রিত আছে।

প্রথম লোকটি বলিল—এই বুধেই গল্প বলছিল বাবু। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরবার সময় মাঠের মধ্যে ওকে এলে-ভূতে পেয়েছিল। এলে-ভূত জানেন তো? মাঠের মধ্যে পথ ভুলিয়ে লোককে দুরে বেজায়গায় টেনে নিয়ে যায়, তারপর মেরে ফেলে। তা বুধো সন্ধেবেলা বেরিয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে, আর ভূত লেগেছে তার পেছনে–

একজন অনুচ্চকণ্ঠে বলিল–নাম করিস্‌ না রাত্তিরে—

গল্পটা দীর্ঘ। কাজলকে সবটা শুনিতে হইল-কী করিয়া কাপড়টা ঝাড়িয়া উলটাইয়া পরিয়া তবে বুধো ভূতের হাত হইতে রক্ষা পায়। শুনিতে শুনিতে অনেকে পিঠের উপর দিয়া পিছনের মাঠের দিকে তাকাইয়া দেখিতেছিল। এবং ক্রমাগত আগুনের কাছে অগ্রসর হইতেছিল। ইহাদের আতঙ্কের কারণ এইবার কাজল বুঝিল। অন্ধকার মাঠে বসিয়া প্রেতযোনির গল্প হইতেছিল-রীতিমত গাশিরশির-করা পরিবেশ। এমনি সময় মাঠের ভিতর হইতে আচমকা কাজলের নিঃশব্দ আবির্ভাব। প্রথমটা তাহারা বেজায় চমকাইয়াছিল, আগুনের আলোয় কাজলের ছায়া পড়িতেছে ইহা না দেখা পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়িতে পারে নাই।

ঠাণ্ডা ক্রমশ বাড়িতেছে। তাহারা আরও কাঠকুটা আনিয়া আগুনের মধ্যে ফেলিয়া দিল। শুকনা ডালপালা পুড়িবার পটপট শব্দ উঠিতেছে, বাতাসে পোড়া পাতার গন্ধ। হাত বাড়াইয়া আগুনের উত্তাপ উপভোগ করিতে করিতে কাজলের মনে হইল, এই লোকগুলি তাহার ভারি আপন।

(কাজলের ডায়েরি থেকে)

আমার ডায়েরি লেখার অভ্যেস মোটেই পুরোনো নয়। ছোটবেলায় কিছুদিন লিখেছিলাম বটে, কিন্তু সে বাবাকে দেখে শখ করে। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে আমার এ বয়সটা একটা বেকর্ড বাখা দরকার—যাতে পরবর্তী সময়ে এর থেকে মানসিক প্রগতির হারটা ধরতে পারি।

কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে পুরী থেকে ঘুরে এলাম। কলেজে প্রথমে খুব খারাপ লাগছিল। পরে তিন-চার জন ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, যাদের সঙ্গে এখন বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। তারাই উদ্যোগ করে বেড়াতে যাবার আয়োজন করলে আমি তাদের সঙ্গী হয়ে পড়লাম।

মার এখনও ধারণা, আমি সেই ছেলেমানুষই আছি। ঘুমোলে আমার গায়ে চাদর টেনে দেন—সকালে উঠে টের পাই। তাছাড়া আমার বইপত্র গুছিয়ে রাখা, কলেজে বেরুনোর সময়ে কলম পেনসিল খুঁজে দেওয়া, এসব তাকেই করতে হয়। কাজেই স্বনির্ভরতার পথে খুব একটা এগিয়ে গেছি—এমন বলা চলে না। মার চোখে হোটই রয়ে গেছি।

আমি, পরমেশ, অমল আর রমানাথ একদিন সন্ধেবেলা ট্রেনে চেপে বসলাম। সারারাত্তির জেগে বসেছিলাম। ছোট স্টেশনে গাড়ি থামছে না, হুহু কবে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে যাচ্ছে। কখনও নদীর ওপর দিয়ে গুম গুম করে ব্রিজ পার হচ্ছে—কখনও নীর অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে দেখছি এঞ্জিন থেকে ভেসে আসা জ্বলন্ত কয়লার কুচি।

সকালে কটক। আমার চোখ রাত্রি জাগরণক্লান্ত। তাকিয়ে দেখলায় অদ্ভুত পোশাক পরা রেলওয়ে পুলিশ প্ল্যাটফর্মে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। পরমেশ চা খাওয়ালে সবাইকে। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের ভাড় নিয়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো সত্যিই এক বেড়াতে চলেছি তাহলে। জীবনে কখনও কোথাও একা বেরুই নি।

দুদিন আগে রাত্তিরে স্বপ্নে সমুদ্র দেখেছিলাম। তখন পুরী যাওয়ার কথা চলছে, দেখলাম সমুদ্রের ধারে বালির উপর পায়চারি করছি। হলুদ বালির বেলাভূমি, তার ওপর শ্রেণীবদ্ধ নারকেলগাছ অশান্ত হাওয়ায় থরথর করে কাঁপছে। মাথার ওপরে দীপ্ত সূর্য। ভালো করে দেখতে পাইনি, কারণ সমুদ্র সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।

কটক ছেড়ে কেয়াঝোপ দেখতে দেখতে চললাম। লাইনের দুদিক কেয়াঝোপে সবুজ হয়ে আছে। মনের মধ্যে উচ্চগ্রামে মাদল বাজছে যেন, একটু পরেই জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখবো।

ট্রেন মালতীপাতপুর ছাড়াল, সামনে পুরী। কী সুন্দর নামটা-মালতীপাতপুর!

দু হাত পেছনে রেখে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল বাবার কথা। অনেকদিন আগে, আমি তখন ছোট, বাবা এসেছিল পুরীতে মাকে নিয়ে। বেলাভূমিতে বাবার পায়ের ছাপ কবে মুছে গেছে ঢেউ-এর অক্লান্ত তাড়নায় কিন্তু তবু মনে হচ্ছে, পুরীর বাতাসে যেন বাবার গায়ের গন্ধ– ছোটবেলায় বাবার বুকে মুখ গুঁজে থাকলে যেমন পেতাম।

মৌপাহাড়িতে বিস্তৃত প্রান্তর দেখেছি, কিন্তু বিস্তৃতি যে কতদূর প্রসারলাভ করতে পারে তা আজ বুঝলাম। ভালো লাগছে বলার চেয়ে কষ্ট হচ্ছে বলাই বেশি সঙ্গত, কারণ সমস্ত সমুদ্রটা আমি একসঙ্গে বুকের ভেতর পুরে নিতে পারছি না। এত বিশালকে একই সঙ্গে সমস্ত দিক দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। ভীষণ ছটফট করছি, কিছুতেই একজায়গায় মন বসাতে পারছি না। সমুদ্র যেন ক্রমশঃ রক্তের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। প্রাণের স্পন্দন প্রথম জেগেছিল জলে। সূর্যের অনুকূল উত্তাপে প্রথম এককোষী প্রাণীর সৃষ্টি সমুদ্রের বুকে। সমুদ্র জীবনের ধাত্রী। জীবনসৃষ্টির কোটি কোটি বছর আগেও এই সমুদ্র এইরকম অশান্ত হয়ে ঝাপাঝাপি করত বেলাভূমিতে। অন্য সব কিছু থেকে সমুদ্র অনেক বেশি অভিজ্ঞ-বহুদর্শী। অন্ধকার ঢেউ-এর মাথায় মাঝে মাঝে স্বতঃপ্রভ আলো। দিনরাত ভীষণ শব্দ করে সমুদ্র যে কী একটা জানাতে চাইছে, আমি তার ভাষা বুঝতে পারছি না। বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছিল। এখন বেঁচে থাকলে বাবার কাছ থেকে জেনে নিতাম।

মানুষ বড়ো অসহায়, তার বলবার কথা সে কিছুতেই গুছিয়ে বলতে পারে না। সামনে ওই elemental fury দেখে মনে একটা আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সমস্ত বিশ্বটার মধ্যে যে একটা master plan আছে সেটা সমুদ্রের মতোই বিশাল, অতিমানবিক। কী রহস্য লুকিয়ে আছে আকাশে-মাটিতেজলে-জীবনে! দর্শনগ্রন্থের সামনে সদ্য অক্ষরপরিচয়প্রাপ্ত শিশুর মতো আমাকে এই বিশালত্বের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

একটা জিনিস আমি বুঝেছি, আমার জীবনটা অন্যান্য মানুষের চেয়ে একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। উত্তরাধিকারসূত্রে যেদিন থেকে চিন্তা করতে শিখেছি, সেদিন থেকে আমার ভেতরে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের বীজ একই সঙ্গে উপ্ত হয়েছে। চিন্তা দিয়ে আমার নিজের জন্য একটা ভিন্নতর জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। কিন্তু চিন্তা আমাকে আলোর পথ দেখাতে পারছে না, শুধুমাত্র একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করছে। মুক্তি চাইলেও পাবে না—যে চিন্তাশীল, তার মুক্তি নেই। বন্ধুরা আমার সান্নিধ্য থেকে আর যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছে না। তারা যেভাবে আনন্দ ভোগ করতে চায়, তা আমার আনন্দের ধারণা থেকে আলাদা। ফলে আমি অনেক মানুষের মধ্যেও একা বোধ করি। চেনা মুখের ভিড়ে একলা থাকা বড়ো কষ্টের। আমি প্রাণপণে চাইছি ওদের সবার সঙ্গে ওদের মতো হয়ে মিশে যেতে, ওদের মতো ভাবতে, কথা বলতে। প্রত্যেকবারই কে পেছন থেকে টানছে, বলছে-হবেনা, আর তা হয় না। বাবার সহজ আনন্দটা আমার মধ্যে কমে আসছে, আমি শুধু চিন্তার কঠিন মাটিতে খালি পায়ে হাঁটছি।

কোনারক।

বন্ধুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিকওদিক, আমি চুপ করে বসে আছি। সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া এসে প্রাঙ্গণের ধুলো ওড়াচ্ছে। নোনা বাতাসে মন্দিরের গায়ে উত্তীর্ণ ভাস্কর্য দিন দিন ক্ষয়ে আসছে। বন্ধুদের গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, দূর থেকে ভেসে আসছে কানে। কী নিয়ে যেন ওরা খুব হাসাহাসি করছে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরের চাতালে একটা কোণায় বসে আছি। এখানটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন, কাছেপিঠে লোকজন নেই। মনে হয় শব্দের জগৎ থেকে আমি নির্বাসিত। বন্ধুরাও হাসি থামিয়েছে।

আমার ডানদিকে পাথরে উৎকীর্ণ একটা পদ্ম। তাতে কনুই রেখে ওপরে তাকিয়ে দেখলাম মন্দিরের চুড়ার কাছে দুই পাথরের দেওয়ালের ফাঁকে নীল আকাশ ঝকঝক করছে। ফাঁকটা দিয়ে একটুকরো সাদা মেঘ ত্বরিত গতিতে ভেসে গেল।

হঠাৎ দেখলাম, আমার মনে সেই বিশেষ ভাবটা জাগছে—বিপুলগড়ের শিব-মন্দিরে যেমন হয়েছিল। ইতিহাস যেন চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। বহু শতাব্দী আগে যখন রোজ পুজো হতো, পুরোহিতের উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যেতো, সেই আগেকার দিনগুলোকে বড্ড ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে। আমার কাছে বর্তমান যেমন সত্য, উঠোনের ওই ধুলোর ঘূর্ণি যেমন সত্য—সেই সব অতীতের মানুষদের কাছেও তাদের বর্তমান তেমনই সত্য ছিল। কিছুই আমরা চিরদিন আঁকড়ে থাকতে পারি না। সমুদ্রের ঢেউ, সূর্যাস্তের বং সব কিছু একদিন আমাকে ছেড়ে দিতেই হবে।

পরমেশ ফিরে আসছে।

-কী রে অমিতাভ, আমাদের সঙ্গে না থেকে বড়ো যে এখানে একলা বসে আছিস?

কী-ই বা উত্তর আমি দিই? উঠে বললাম—চল, তোদের সঙ্গে যাই।

যেতে যেতে ওপরে তাকিয়ে চোখ-ধাঁধানো সূর্যটা দেখে মনে হলো, বছরের পর বছর ধরে সূর্য কর্কটক্রান্তি থেকে মকরক্রান্তি পর্যন্ত এইরকম ভাবে পরিক্রমা করবে, সমুদ্রে একবার জোয়ার একবার ভাটা আসবে। আমাদের স্মৃতিটুকুও উত্তরপুরুষদের মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে—কেবল মাথা তুলে সুর্যমন্দিরটা দাঁড়িয়ে থাকবে আরও অনেক শতাব্দী।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *