রাঁচির গণেশলাল লেনে
রাঁচির গণেশলাল লেনে মেজর তারাপদ ভৌমিকের বাড়ি। দোতলার বারান্দার পাশেই একটি পাইনগাছ। সকালের ট্রেনে স্টেশনে পৌঁছুনোর পর মেজর ভৌমিক তার গাড়িতে কর্নেলকে নিয়ে এসেছেন। ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর কফি। কফির পর চুরুট। দুই বন্ধুর অনেক দিন পরে দেখা। প্রথমে খোশগল্প, তারপর পাইনগাছটির কথা উঠেছিল। কর্নেল বলেছিলেন, আশ্চর্য আপনার দক্ষতা মেজর ভৌমিক! পাইনগাছ! ভাবা যায় না। বিশেষ করে এত বড় পাইনগাছ!
মেজর সগর্বে বলেছিলেন, শিলংও উঁচু জায়গায়, রাঁচিও তাই। আমি জেদ ধরেছিলুম, এখানকার মাটিতেও এই সিকুইয়া পাইন কেন হবে না? হলো।
এসব আলোচনার পর বেতলা জঙ্গলের প্রসঙ্গ উঠল। কোয়েল নদী, মদনরাজার কেল্লা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। তারপর কর্নেল বললেন, ট্রাঙ্ক করে সুব্রত কথা বলল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুব্রতই কথা বলল কি না আমি নিশ্চিত নই। একবার শোনা গলা। সেই গলার স্বর মনে থাকলেও ট্রাঙ্ক কলে সুদূর ডালটনগঞ্জ থেকে সেই গলা সনাক্ত করা কঠিন। কাজেই……. বলে তিনি অট্টহাসি হাসলেন।
মেজর উৎসুক হয়ে বললেন, কাজেই?
আমার লগেজে একটা আশ্চর্য জিনিস এনেছি। দেখাচ্ছি। কুমোরটুলির প্রখ্যাত এক মৃৎশিল্পীর তৈরি। আপনি অবাক হয়ে যাবেন দেখলে।
বলে তিনি লগেজ আনলেন ঘর থেকে। খুলতেই বেরিয়ে পড়ল ভাঁজকরা কিছু খোলজাতীয় জিনিস। একটা মুণ্ড। কর্নেল সবগুলো জোড়া দিয়ে বললেন, কাকে দেখছেন?
অবাক মেজর বললেন, মাই গুডনেস! ইট ইজ ইউ! হ্যাঁ, আমি। সরি, মাই ডামি। কেমন চমৎকার নকল কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, বলুন?
অসাধারণ! কিন্তু……
কিন্তু কী?
ভেঙে যাবে না হ্যাঁ করতে?
ভাঙেনি। ভাঙবে না। কারণ প্লাস্টার অফ প্যারিস আর শোলার তৈরি। এবার দেখুন শোলার তৈরি বাইনোকুলার দুহাতে চোখে ঠেকিয়ে দিচ্ছি। পেছনে সুতো দেখছেন। ষাট গজ লম্বা নাইনলের সুতো। পুতুলনাচ তো দেখেছেন। এই সুতো ধরে দূর থেকে টানলে ডামি মূর্তির দুহাতে ধরা শোলার বাইনোকুলার চোখে উঠে আটকে যাবে। সুতো ঢিলে করলে গলা থেকে খুলে পড়বে।
আপনার বুদ্ধির প্রশংসা নতুন করে করার নয়। তবু বলব, আপনি টেক্কা দিয়েছেন। মেজর হাসতে হাসতে বললেন, কিন্তু যদি ওটা সত্যি শত্রুপক্ষের ফাঁদ হয়, তারা আপনার সঙ্গে কথা বলবে আগে। ডামি কথা না বললে সন্দেহ হবে।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, ডামিও কথা বলবে! দেখবেন!
আপনার রহস্য বোঝা কঠিন।
রহস্য নয় মেজর ভৌমিক! খুব সোজা পরিকল্পনা। ওখানে পাথর আর ঘন জঙ্গল আছে দেখেছি। অসুবিধে হবে না।
এগারোটার মধ্যে দুই বন্ধুতে খেয়েদেয়ে রওনা হলেন। প্রায় দেড়শো মাইল। রাস্তা। অপূর্ব দৃশ্য মাঝে মাঝে। জঙ্গল, পাহাড়, ছোট্ট বাজার। পালামৌ জেলায় পালামৌ রেঞ্জের পাহাড় পেরুনোর সময় দার্জিলিং এলাকার কথা মনে পড়ে যায়। নীচে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা চলেছে চড়াই থেকে উত্রাই।
ডাল্টনগঞ্জগামী রাস্তার মোড়ে বাঁ দিকে ঘুরল গাড়ি। বেতলা আর মাত্র। কয়েক মাইল। কোয়েল ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে বেতলা এলাকা। দুধারে টিলা পাহাড়, ঘন জঙ্গল।
বেতলায় একটা বেসরকারি লজে ঘর পাওয়া গেল। প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। ফরেস্ট বাংলোর কাছে পিচ রাস্তার ধারে একটা দোকানে অখাদ্য কফি খেয়ে কর্নেল এবং মেজর রুমে ফিরলেন। তারপর মদনরাজার কেল্লার দিকে রওনা হলেন গাড়ি নিয়ে।
ঘন জঙ্গলের ভেতর কেল্লার সামনের চত্বর ফঁকা। বাঁ দিকে ধ্বংসাবশেষের আড়ালে গাড়ি লক করে রেখে দুজনে বোঁচকাটি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলেন।
কোয়েল নদীর তীরে জঙ্গলে পাথরের প্রকাণ্ড চাই ইতস্তত। তার আড়ালে বসে কর্নেল ঝটঝট ডামিটি জোড়া দিলেন। গুঁড়ি মেরে দুজনে ডামিটিকে ঠেলতে ঠেলতে (যেন…হেঁটে চলেছেন কর্নেল) নিয়ে গেলেন নদীর ধারে বালির চড়া থেকে উঁচিয়ে ওঠা একটা পাথরের কাছে। সেই পাথরে ডামিটি বসানো হলো। তখন সাড়ে চারটে বাজে। বাতাস বইছিল। তাই ডামিটির দুধারে পাথর সেঁটে দিলেন কর্নেল। গুঁড়ি মেরে পিছিয়ে এসে ঝোপে বসলেন।
নদীর ওধার থেকে বা দুপাশ থেকে দেখলে, এমন কি পেছন থেকে দেখলেও, কর্নেল বসে আছেন। মাঝে মাঝে সুতো টানলে ডামি কর্নেল চোখে বাইনোকুলার তুলে রাখছে দুহাতে। ঢিলে করলে হাত এবং বাইনোকুলার নামাচ্ছে। হালকা ওজনের পলকা ফোপরা মূর্তি।
পাঁচটা বেজে গেল দেখতে দেখতে। শরঙ্কালের বনভূমিতে এখনই অন্ধকার ছমছম করছে। কোয়েল নদী এখন ভরা। বুকে বড় বড় পাথর। চারদিকে পাখপাখালি তুমুল চাঁচামেচি করছে। মাঝে মাঝে হনুমান বাঁদর হুপহাপ, কিচমিচ করে ডাকছে। তারপর নদীর ওপার থেকে সম্বর হরিণের ডাক ভেসে এল, তাঁ ক! টাক!
ডামি কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার উঠল। মিনিট তিনেক পরে বাঁ দিকে জঙ্গল ভেঙে দুটি লোক বেরুল। তাদের একজনের হাতে বন্দুক। সে একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যজন যুবক। চোখে সানগ্লাস। ডামির কাছে গিয়ে বলল, এসে গেছেন তা হলে?
মেজর অবাক হয়ে শুনলেন, ডামি বাইনোকুলার নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, এস ডার্লিং, বলো তোমার কী কথা?
মেজর কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করলেন।
আপনার গলার স্বর অমন কেন, কর্নেল?
তোমার গলার স্বর অমন কেন, সুব্রত?
সানগ্লাস-পরা যুবকটি পেছনে ঘুরে বন্দুকবাজকে ইশারা করল। সে বন্দুক তুলল। তারপর গুলির শব্দ। কর্নেলের ডামি ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে গেল। তীব্র স্রোতে ভেসে চলল ওলট-পালট হতে হতে। যুবক হাসল। চলো কুন্দন সিং! কাম ফতে! আভি ডালটনগঞ্জ যানা পড়ে। উহা বাস পাকাড়কর কলকাতা যায়েগা। সাবকা পাশ বাকি রুপৈয়া আদা করনে হোগা!
চলিয়ে।
মেজর ফিসফিস করে বললেন, ওদের ধরে ফেলা উচিত। শিগগির।
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, রিস্ক নেওয়ার দরকার নেই। ওরা সশস্ত্র। যেতে দিন। ভাড়াটে গুণ্ডা।
কিন্তু ডামি কথা বলল, এই রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে না।
কর্নেল মুচকি হাসলেন। স্রেফ ভেন্ট্রিলোকুইজম! স্বরজাদু। আমি এ বিদ্যাটা জানি। আপনি নিশ্চয় ম্যাজিকে কথা বলা পুতুল দেখেছেন?
মেজর শ্বাস ছেড়ে বললেন, তা-ই! আমি ভেবেছিলুম কোনও যন্ত্রট নাকি!
দুজনে সাবধানে মদনরাজার, কেল্লায় ফিরলেন। তখন অন্ধকার ঘন হয়েছে জঙ্গলে। গাড়িটা আড়ালে রাখা ছিল। স্টার্ট দিয়ে মেজর বললেন, কী সর্বনেশে লোক। এ তল্লাটে বিস্তর ভাড়াটে খুনী পাওয়া যায় জানতুম। এই প্রথম স্বচক্ষে দেখলুম। কিন্তু ওরা গেল কোন পথে?
বেতলা গ্রামের দিকেই গেল মনে হচ্ছে। ফরেস্ট বাংলোর দক্ষিণে বেতলা গ্রাম।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
আমাদের এখনই রাঁচি ফিরতে হবে কিন্তু। আপনার কষ্ট হবে। আমি ড্রাইভ করব বরং।
মেজর হাসলেন। দুজনেই বুড়োমানুষ। তবে আমি ডাক্তার, ডোন্ট ফরগেট দ্যাট।
ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে বাবামশাইকে দেখে তারপর ফিক করে। হাসল। কর্নেল রাঁচি থেকে বাসে এসেছেন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ থাকা স্বাভাবিক। রুষ্ট হয়ে বললেন, হাসির কী আছে! কফি।
ষষ্ঠী তবু ফিকফিক করে হাসতে লাগল।
হাসি কেন রে হতভাগা? কর্নেল আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে দাড়ি ঝেড়ে বললেন, আবার হাসি? তবে রে?
ষষ্ঠী কয়েক হাত পিছিয়ে গিয়ে বলল, বাবামশাই কি সত্যি রাঁচি গিছলেন?
হুম। আগে কফি।
আপনাকে ছেইড়ে দিলে?
ছেইড়ে দিলে মানে?
আজ্ঞে, ওই যে গো, কিসের যেন গারদ আছে রাঁচিতে।
কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন, ব্র্যাভো ডার্লিং! এতদিনে গাঁইয়া ভাব গিয়ে স্মার্ট হয়েছ। হুঁ, রসবোধও জন্মেছে। ভাল, ভাল। তবে আগে কফি।
ষষ্ঠীর কফি করতে সময় লাগে না। কর্নেল পোশাক বদলে বাথরুম সেরে ফিটফাট হয়ে আরামকেদারায় বসলেন। কফিও পেলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, কিছু খবর আছে এ দুদিনের? বল, শুনি।
এবার ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, খালি ফোং ফোং আর ফোং! আবার কে? ওই…….
নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব?
আজ্ঞে। তিনি তো বটেই। কাল আবার ডেভিডসায়েব এসে হাজির। ভুতে জ্বালাচ্ছে। আর…… ষষ্ঠী মাথা চুলকে স্মরণ করে বলল, হালদারমশাই! তার দেখি গোঁফ নেই। খেকুঠে মড়ার মতো চেহারা। জল থেকে মড়া উঠে এসেছে যেন। তা, পরে…….হ্যাঁ, ফোং! কী যেন নাম যেন…….পেটে আসছে, মুখে আসছে না……
সুব্রত চৌধুরি?
ষষ্ঠী জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, না। মেয়েছেলে! নরম গলা।
সুরঞ্জনা দেবী, যাঁর মেয়ে খুন হয়েছে?
ধূস!! কা…কা……না, না! ক…………কথা……কথা…..তাপরে কী যেন, ক……কলি? নামটা কেমন যেন গোলমেলে। বিচ্ছিরি!
কথাকলি?
ষষ্ঠী দাঁত বের করল। আজ্ঞে, তা-ই। কথাকলি চ……চ…চক্কবত্তিই হবে।
কী বলেছিলি?
আপনার খোঁজ করছিল। আমি বললুম, নেই।
উঁহু, রাঁচি গেছি বলেছিলি!।
ষষ্ঠী ফের দাঁত বের করল। তা হতে পারে। কী করব? খালি ফোং আর ফোং। তাই বলেও থাকতে পারি।
কথাকলি চক্কবত্তি কী বলল?
বললে সব্বোনাশ! মারা পড়বেন যে! শুনে আমি বললুম, বাবামশাইকে মারে এ সাধ্যি ভগবানেরও নেই।
তাই বললি?
বললুম। বলব বৈকি।
হ্যাঁরে বুদ্ধ, মানুষ বুঝি মরে না?
মরে। তবে আপনাকে মারে কে? বলে ষষ্ঠী পা বাড়াল।
কর্নেল ডাকলেন, শোন হতভাগা!
রান্না করিগে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, পেটে কিছু পড়েনি।
সবে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ডিনার খাব দশটায়। তুই শোন্!
বলুন। বলে ষষ্ঠী সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
কথাকলি চক্কবত্তি আর কী বলল?
ভেংচি কাটছেন। বলব না। আমি কি শুদ্ধ কথা বলতে পারিনে? চকরোবর্তী! হলো তো?
হলো। বল্!
বললে, এক্ষুণি পুলিশে খবর দাও। কর্নেলসায়েবের বিপদ হতে পারে। আমি যত বলি, আমার বাবামশাই নোহার মানুষ তত বলে, বিপদ হবে। পুলিশে খবর দাও। তো কী করি, নালবাজারে…….
ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। ……অরিজিৎ! হ্যাল্লো ডার্লিং! কী খবর?
অরিজিৎ বললেন, বেঁচেবর্তে ফিরেছেন? আজ দুপুরেই রাঁচিতে রেডিও মেসেজ পাঠিয়েছি। বাপস্! কী যে করে বেড়ান!
ষষ্ঠীর মুখে শুনেই…..
নাঃ! সাম গার্ল! নাম বলেনি। ইয়াং বলেই মনে হচ্ছিল গলা শুনে। বলল, কর্নেলসায়েব রাঁচিতে ফাঁদে পা দিতে গেছেন, তাকে বাঁচান। লাইন কেটে গেল। এক্সচেঞ্জে এনকোয়ারি করে জেনেছি জি পি ওর পাবলিক বুথ থেকে ফোন করেছিল। এনিওয়ে, ব্যাপারটা কী?
এসে শুনো। চলে এস।
বাই দা বাই, আপনার হালদারমশাইকে নিয়ে পারা গেল না। এইমাত্র খবর পেলুম, ওঁকে আমাদের লোক কিঞ্চিৎ ভোলাই করেছে। ওদের দোষ নেই। কবরখানায় সন্ধ্যাবেলা গেছেন আড়ি পাততে। যাই হোক, ওঁকে লালবাজারে আনতে বলেছি। ওঁকে সঙ্গে নিয়েই যাব। ওয়েট!…….
কর্নেল ফোন রেখে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। কথাকলি চক্রবর্তী কে? একটা নতুন সুতোর খেই এই রহস্যজটে। কে সে? কর্নেলের হিতাকাঙিক্ষণী মনে হচ্ছে। সে কী করে জানল কর্নেল রাঁচি যাচ্ছেন বা গেছে এবং সেখানে ফাঁদ পাতা হয়েছে তাকে হত্যা করতেই? সে অরিজিৎ লাহিড়ীকেও ফোন করেছে। কিন্তু নাম বলেনি নিজের।
কর্নেল চার্লস গ্রিয়ার্সনের বইটি নিয়ে এলেন র্যাক থেকে। তারপর ফলকের বিবরণ পড়ে ড্রয়ার থেকে সেই ইংরেজি উপদেশাবলী বের করলেন, যেটি গির্জার বাইবেলের ভেতর গোঁজা ছিল। আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে থাকলেন।
আধঘণ্টা ধরে খুঁটিয়ে দেখা এবং পড়ার পর টেবিল ল্যাম্পের বালবের আরও কাছে নিয়ে গেলেন। ক্রমে এই কথাগুলি উপদেশবাক্যের মাথায় স্পষ্ট ফুটে উঠল।
FOR COLONEL N. SARKAR.
কর্নেলের ঠোঁটের কোণায় সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠল। ভ্যানিশিং ইংকে লেখা ছিল তার নাম। উত্তাপ দিলেই ভ্যানিশিং ইংকে লেখা ফুটে ওঠে।
কার লেখা এটা?
গোমেশ জেভিয়ারের কি?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের উদ্দেশে এই উপদেশ লেখার কারণ কী? আবার উপদেশগুলি পড়তে শুরু করলেন। তার মধ্যে হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি।
তারপর ড্রয়ার থেকে চুরুটের বাকসো বের করে চুরুটটি কাগজটির ওপর লম্বালম্বি রাখলেন। চুরুট কফি খেয়েই ধরাবেন। ফ্যানের হাওয়ায় কাগজটা উড়ে যাচ্ছে। চুরুটটা কাগজের কাপনে একটুখানি গড়িয়ে ঠাইনড়া হলো।
একটা পেপার-ওয়েট বের করে চাপাতে গিয়েই কর্নেল চমকে উঠলেন, মাই গুডনেস!
ষষ্ঠী কফি আনছিল। বলল, রাচির গারদ থেকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তারবাবুরা কাজটা ভাল করেননি। আবার সেই…..
কর্নেল উঠে গিয়ে ষষ্ঠীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ওরে হতভাগা! আমার বড় আনন্দ হচ্ছে। দে দে কফি খাই। ওঃ! ষষ্ঠী! আমার নাচতে ইচ্ছে করছে রে!
সব্বোনাশ! সব্বোনাশ। ষষ্ঠী বেজায় ভড়কে গেল। ছাড়ুন, ছাড়ুন! গরম
কর্নেল এসে ধপাস করে বসলেন। কফিতে চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালেন। তা হলে গোমেশ-ই চিঠিটা লিখে রেখে গেছেন! হতভাগ্য কেয়ারটেকার! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। তবু একটা পুণ্যকর্ম করে গেছেন এই উপদেশটি লিখে।……
.
আধঘণ্টা পরে অরিজিৎ লাহিড়ী এলেন। সঙ্গে কাচুমাচু মুখে গোয়েন্দা হালদারমশাই।
তিনি ধপাস করে বসে বললেন, সেমসাইড!
অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে সঙ্গে দেখালে সেমসাইড হতো না! এনিওয়ে, কর্নেল! আপনার এই চর ভদ্রলোককে একটা সামলান। যদি কোনও অ্যাসাইনমেন্ট দেন, তা হলে অন্তত আমাকে একটু জানিয়ে রাখবেন।
কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন, হালদারমশাই মাঝে মাঝে বিপদে পড়লেও কিছু মূল্যবান সূত্র যোগান দেন। আশা করি, কাল্লু……
হালদারমশাই বললেন, কাল্লুরে ধরেছে! ডি সি সায়েবরে, জিগ্যান!
অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, কাল্লু হালদারমশাইকে গঙ্গায় খুব নাকানি চোবানি খাইয়েছে। ভাগ্যিস, তখন কলোনির ঘাটে লোকেরা স্নান করছিল। তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
কর্নেল আবার অট্টহাসি হাসলেন।
অরিজিৎ বললেন, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রাঁচি থেকে ফিরে আপনি পাগল হয়ে গেছে। লোকে যায় পাগলামি সারাতে। আপনি সম্ভবত কাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামের সব পাগলের পাগলামি সংগ্রহ করে ফিরেছেন?
আজ এ মুহূর্তে আমার মনমেজাজ খুশি ডার্লিং! এত খুশি যে আমার কাছে ঘৃণ্য পাখি কাক এবং শকুনদের ক্ষমা করে দিয়েছি। যাই হোক, বলুন হালদারমশাই! আপনার এপিসোড শোনা যাক।
হালদারমশাই ফাঁচ করে হেসে নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, ড্যাং সায়েবড়ারে পাওয়া যায় নাই। আপনে আগে কইয়া দ্যান স্যার! আমার পরে কমুঅনে!
অরিজিৎ হাসি চেপে বললেন, না, না। আপনারটা আগে বলুন। আপটু দ ইস্টার্ন সাব-আর্বন খ্রীস্টান সিমেট্রি এপিসোড। গো অন!
হালদারমশাই শুরু করলেন। তার মধ্যে কফি ও স্ন্যাক্স এসে গেল। লম্বা চওড়া কাহিনীটি শেষ করে হালদারমশাই বললেন, মজাটা দেখুন কর্নেলস্যার.! ড্যাংসায়েব আমাকে হায়ার করতে আসত। কেন, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।
কর্নেল বললেন, যাচ্ছে। পারস্যের পহলভিসম্রাট আর্দশিরের ফলক উদ্ধার করতেই।
অরিজিৎ অবাক হয়ে বললেন, তার মানে?
ডার্লিং! চার্লস গ্রিয়ার্সন নিজের কবরে যে ফলক লাগিয়েছিলেন, সেটাই সেই পহলভি ফলক। উল্টোপিঠে কী লেখা ছিল, এই দেখ। বলে কর্নেল গ্রিয়ার্সনের বইটা এগিয়ে দিলেন অরিজিৎ লাহিড়ীকে।
অরিজিৎ আগ্রহে বইটার পাতায় চোখ রাখলেন। হালদারমশাই তাঁকে পাশে উঁকি মেরে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! অনেক ধকল গেছে। এবার বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়া দরকার। টানা ঘুম!
হাই তুলে হালদারমশাই বললেন, হঃ! যাই গিয়া। তবে ঘুম হইব না।
চেষ্টা করবেন। ভেড়ার পাল গোনার চেষ্টা করবেন। মনে আছে তো সেবারকার রূপগঞ্জের কাহিনী? পালের গাড়লটাকে ধরার চেষ্টা করবেন। ঘুম এসে যাবে।
ফাঁচ শব্দে হেসে হালদারমশাই ডি সি ডি ডি-কে প্রথাসিদ্ধ স্যালুট ঠুকে বেরিয়ে গেলেন।
অরিজিৎ পড়া শেষ করে বললেন, বুঝলুম। কিন্তু ফলকটা নিয়েই কি এই খুনোখুনী?
তাই মনে হচ্ছে, ডার্লিং! কর্নেল সায় দিয়ে বললেন। তবে টিনিও এই চক্রে জড়িত ছিল। মাই গুডনেস!
কী হলো হঠাৎ?
কথাকলি চক্রবর্তী সুব্রত চৌধুরির নতুন প্রেমিকা নয় তো?
কথাকলি চক্রবর্তী? হু ইজ শি?
তোমাকে ফোন করেছিল। আমাকেও করেছিল। তখন আমি রাঁচিতে।
অরিজিৎ একটু চুপ করে থেকে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, সুব্রত সম্ভবত কলকাতাতেই আছে তাহলে। হুঁ, আপনার কাহিনী শুনি।
কর্নেল তার বেতলা-অরণ্য-অভিযান বর্ণনা করতে থাকলেন।…..
.
ডিনার খেয়ে চুরুট ধরিয়ে শূন্যোদ্যানে উঠে কিছুক্ষণ অভ্যাসমতো পায়চারির পর কর্নেল শুতে এলেন। সবে শুয়েছে, বেডরুমের পাশের ফোনটা বাজল। বিরক্তিকর! হালদারমশাই আবার কোনও বিপদ বাধালেন নাকি? তারই উত্তেজিত কণ্ঠস্বর!
কর্নেল বললেন, আপনাকে ঘুমোতে বলেছিলুম, হালদারমশাই!
কী যে কন কর্নেলস্যার? রহইস্য ভ্যাদ না হওয়া পর্যন্ত ঘুম আসব? শোনেন!
আপনি কোত্থেকে ফোন করছেন?
বউবাজার ফাড়ি থেকে। একটুর জন্য ড্যাংসায়েব ফস্কে গেল কলেস্যার! হালদারমশাইয়ের শ্বাস-প্রশ্বাসজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভাবলুম, বড় ধকল গেছে। একটু ড্রিংক করা উচিত। না কর্নেলস্যার, আমি ড্রিংক করি না। জাস্ট এক পেগ ব্রান্ডি খাই রোজ শোওয়ার আগে। ডাক্তারের পরামর্শ। তো মুনলাইট বারে গিয়ে ঢুকলুম। ঢুকেই দেখি, ড্যাংসায়েব
আর একটা আজেবাজে চেহারার লোক বসে আছে।
আজেবাজে চেহারার লোক মানে?
থার্ড ক্লাস, কর্নেলস্যার। বারে মানায় না। শুড়িখানায় মানায়। বেশ। তারপর?
তক্ষুণি বেরিয়ে গেলুম। সোজা বউবাজার ফাড়িতে। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। এসে দেখি পাখি উড়েছে।
আপনার থার্ড ক্লাস লোকটা?
সে-ও নেই। দুজনেই কেটে পড়েছে। আমাকে দেখতে পেয়েছিল, কর্নেলস্যার! বুঝলেন তো?
বুঝলুম। রাখছি। আপনি…….ধন্যবাদ হালদারমশাই! আপনি এবার বাড়ি যান। ব্র্যান্ডির চেয়ে হালকা ডোজের ঘুমের পিল খেয়ে নেবেন বরং। ট্রাংকুলাইজার পাওয়া যায় যে-কোনও দোকানে। পাঁচ মিলিগ্রামের পিলই যথেষ্ট। পুনশ্চ ধন্যবাদ! অসংখ্য ধন্যবাদ! ফোন রেখে দিলেন কর্নেল।
ড্যানি ঘোষের সঙ্গে থার্ড ক্লাস লোকটা কে হতে পারে? ওর বডিগার্ড? কর্নেল টেবিলবাতির সুইচ অফ করে দিলেন।…
সকালে গার্ডেনিংয়ের জোব্বা পরে কর্নেল তার শূন্যোদ্যানে কিম্ভুত কিমাকার অথচ পুষ্পবতী গাছগুলির সেবা করছিলেন। মাঝে মাঝে উঠে দূরের দেবদারুশীর্ষে বাইনোকুলারে শকুনের বাসা দেখছিলেন। কখনও শরতের নীল আকাশে কোনও পাখি। আজ অবিশ্বাস্যভাবে কোথায় ঘুঘু পাখি ডাকছে। সত্যিকার ঘুঘু তো?
বাবামশাই, ফোং! বাবামশাই, সেই ফোং!
ঘুরে দেখলেন ষষ্ঠী ছটফট করছে। কর্নেল বললেন, কার ফোন বলবি তো হতভাগা? সেই ফোং আবার কী?
ষষ্ঠী গম্ভীর হয়ে গেল। কথাকলি চকরবর্তী। দেখুন গে না! আমার কী আপনারই ক্যাস।
কর্নেল হাসলেন। কেস রে কেস! এত শিখিয়েও কথাটা রপ্ত হলো না! বল্, কে-স।
ওই হলো। হালদারমশাই বলেন না? শুনে-শুনে মুখস্থ।
কর্নেল তেড়ে গেলেন। বল্ কে-স!
খেস!
থাপ্পড় খাবি। খেস নয়, কেস।
ষষ্ঠী কেস, কেস করতে করতে হাসতে হাসতে নেমে গেল।
কর্নেল খুরপি রেখে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। ড্রংইরুমে গিয়ে ফোন তুলে আস্তে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।
আপনার কোনও বিপদ হয়নি তো?
কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ। আসল-নকল একটি বাক্য শুনে বোঝা অসম্ভব। তবে সুরেলা কণ্ঠস্বর। কর্নেল বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছি, আগে জানতে চাই।
আমার নাম কথাকলি চক্রবর্তী।
হুঁ সুব্রত…।
আপনার কোনও বিপদ হয়নি তো?
হতে পারত। হয়নি? তো বলো–বলুন?
আপনি-টাপনি নয়। আমি আপনার মেয়ের মতো। টিনি আমার বন্ধু ছিল।
তুমিও কি বারের গাইয়ে?
ভ্যাট্! কেন এ কথা বলছেন?
তোমার কণ্ঠস্বরটি গায়িকার।
ধন্যবাদ। শুনুন, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু আমার ভয় করছে, অকারণ পুলিশ যদি আমাকে…….
না। পুলিশ আমার বাড়ি পাহারা দেয় না। তুমি চলে এস।
প্লিজ কর্নেল! আমি সামান্য নেয়ে। আমার আয়ের ওপর একটা বড় ফ্যামিলি বেঁচে আছে। আমার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ভাইবোনেদের লেখাপড়া, সংসার…
এনাফ। নির্ভয়ে চলে এস, ডার্লিং! এই বৃদ্ধের অবস্থা বটবৃক্ষের মতো। সবাইকে আশ্রয় দিয়ে খুশি হয়। চলে এস।
কর্নেল ফোন রেখে গার্ডেনিং জোব্বা খুলতে গেলেন। বাথরুম সেরে ড্রইং রুমে এলেন। চুরুট ধরালেন। একবার ভাবলেন, আবার কোনও ফাঁদ নয় তো? আবার মনে হলো, কণ্ঠস্বরে অভিনয়ের ছাপ নেই। থাকলে আঁচ করার ক্ষমতা আছে তার। অবশ্য তিনি চিরকুমার। সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর মতো মেয়েসঙ্গ করার অভিজ্ঞতা তার নেই। ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রে বলেছে, মেয়েদের বুঝতে দেবতাদেরও হিম্মত নেই, মানুষ কোন ছার!
মাত্র পনের মিনিট পরে ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠীকে বললেন কর্নেল, তোর সেই চকরবর্তী এলে নিয়ে আসবি এ ঘরে। অন্য কেউ হলে বুঝেছিস তো! ওয়েটিংরুমে বসিয়ে নামধাম সব জিজ্ঞেস করবি।
ষষ্ঠী বোঝে। ঝটপট সে যাকে নিয়ে এল, তার বয়স কুড়ি-একুশের মধ্যে। পরনে প্যান্ট-কোর্তা। স্মার্ট মড চেহারা। ছোট করে ছাঁটা চুল। নমস্কার করে। বসল।
কর্নেল অমায়িক হেসে বললেন, তুমি টিনির বন্ধু! ওয়েল, তোমারও ডাকনাম থাকা উচিত।
কলি।
সুইট নেম, ইনডিড! কর্নেল নিভন্ত চুরুট ধরিয়ে বললেন, তুমি আমার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলে। সেজন্য ধন্যবাদ। তবে বুঝতে পারছি, তুমি টিনির খুনীদের চক্রটি সম্পর্কে খবর রাখো। প্লিজ, এই পয়েন্টটা আগে ক্লিয়ার করে দাও।
কথাকলি মুখে বিষণ্ণতা ফুটিয়ে বলল, টিনি আমাকে মুখ ফসকে বলেছিল, সে শিগগির ভাল পাড়ায় উঠে যাবে। কারণ সে অনেক টাকা পাচ্ছে শিগগির। ওকে ইনসিস্ট করেছিলুম। তখন শুধু বলল, কাকেও যেন না বলি, একটা দামী পাথরের খোঁজ পেয়েছে একটা সিমেট্রিতে। সে…
এক মিনিট। সুব্রতর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?
কথাকলি একটু হাসল। সুব্রত টিনি আমার কমন ফ্রেন্ড।
সে কোথায় জানো?
কথাকলি একটু চুপ করে থেকে একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, ও নির্দোষ। ও টিনিকে বাঁচাতে চেয়েছিল। টিনিকে খুনের চক্রান্ত সে মুনলাইট বারে শুনেছিল।
কেন টিনিকে খুন করা হবে সে জানতে পেরেছিল?
টিনি কোনও খ্রীস্টিয়ান সিমেট্রির দামী পাথর নাকি অন্য কাউকে বেচতে চেয়েছে। এটা ড্যানি ঘোষ বরদাস্ত করবে না। সুব্রত আমাকে পরে সব বলেছে।
ড্যানি ঘোষকে তা হলে তুমি চেনো?
কথাকলি একটু হাসল। সুব্রতর সঙ্গে মুনলাইট বারে দিন তিনেক বিয়ার? খেতে গিয়েছিলুম। সে ড্যানিকে চিনত। বলেছিল ওই লোকটা সাংঘাতিক খুনী। টিনি ওর পাল্লায় পড়েছে।
ওয়েল, রাঁচিতে আমাকে ফাঁদে ফেলা হবে, কেমন করে জানলে তুমি?
কর্নেল! সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী আমার দূরসম্পর্কের দাদা। আমিও দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার স্টাফ। তবে অফসেট প্রিন্টিংয়ে কাজ করি। কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়েছি। সেই সূত্রে আপনাকে বিশেষভাবে জানি। সুব্রতও জানে। সুব্রত ড্যানিকে পাল্টা ফাঁদে ফেলার জন্য, মানে টিনি খুন হওয়ার পরে ওর সঙ্গে গোপনে দেখা করেছিল রয় কোম্পানিতে। সুব্রত ড্যানিকে বলেছিল, টিনি যে পাথরটা বেচতে চেয়েও বেচেনি, সেটা কোথায় আছে সে জানে।
ভেরি ইন্টারেস্টিং। তারপর?
সুব্রত বলেছিল, সিমেট্রির কেয়ারটেকার গোমেশের কাছে পাথরটা আছে। গির্জাঘরে লুকিয়ে রেখেছে। এটা সুব্রতর বোকামি। খামোকা বেচারা গোমেশ খুন হয়ে গেল। সুব্রতর রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ তাকেও খুঁজছে। ও একটা বোকার বোকা। মিথ্যা বলে একটা লোকের প্রাণ চলে গেল!
হয়তো মিথ্যা বলেনি! কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, সুব্রত কোথায়?
কলকাতায় আছে। কথাকলির মুখে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল।
তো শুনুন, ড্যানির সঙ্গে সুব্রত খুব জমিয়ে নিয়েছিল। ড্যানি ওকে পোপোজ করে ডাল্টনগঞ্জে গিয়ে আপনাকে ফোন করতে। সুব্রত ড্যানির প্ল্যান শুনে ঘাবড়ে যায়। সে আর ড্যানির ছায়া মাড়ায়নি।
হুঁ। ড্যানি ডালটনগঞ্জের কোনও বাঙালি ছেলেকে সুব্রত সাজিয়ে আমাকে ট্রাংককল করেছিল। এনিওয়ে, সুব্রতকে নিয়ে এস। একটা জট এখনও খুলছে না। সেটা সে খুলতে পারে। তাকে আমার জরুরি দরকার।
কথাকলি আগ্রহ দেখিয়ে বলল, কী জট বলুন না কর্নেল?
টিনি যে রাতে খুন হয়, সেই রাতে যা সব ঘটেছিল, সুব্রত জানে। আর জানতেন গোমেশ। গোমেশ ইজ ডেড। আমার ভয় হচ্ছে, সুব্রত……
সুব্রতকে বেরুতে দিলে তো? কথাকলি হেসে ফেলল।
কর্নেল তার বিশাল অট্টহাসি হেসে বললেন, খাঁচায় পুরেছ? ভেরি ওয়েল, ডার্লিং! কামনা করি, এ খাঁচা স্থায়ী হোক।
কথাকলি ঈষৎ রাঙা হয়ে বলল, উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস!
ওক্কে। ওকে নির্ভয়ে নিয়ে এস।
সুব্রত ভীষণ অনুতপ্ত, কর্নেল! গোমেশ বেচারাকে ওর ভুলের জন্য মরতে হলো। টিনি অবশ্য জেদী গোঁয়ার মেয়ে ছিল। নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সুব্রত সৎ ছেলে, আমি বলছি!
হুঁ, ওকে আজই নিয়ে এস। বিকেলের মধ্যে আনলে ভাল হয়। তা হলে আমার ফাঁদ পাতার সুবিধে হবে।
কথাকলি চমকে উঠে বলল, কিসের ফাঁদ কর্নেল?
খুনীদের চক্রটি আমরা জানি। তুমি এবং সুব্রতও জানো। কিন্তু কে টিনিকে খুন করল এবং গোমশ জেভিয়ারকেও খুন করল, তাকে আমি চিনতে পেরেছি। তোমরা পারোনি। অথচ তোমরা–হয়তো তুমি নও, সুব্রত তাকে ভালই চেনে। কিন্তু শুধু জানে না, সে সাংঘাতিক খুনী। টিনি বোকামি করে তার সাহায্য নিতে গিয়েই…..নাঃ। তুমি সুব্রতকে আজই নিয়ে এস। ফাঁদ পাতব।
ষষ্ঠী জানে, মেয়েরা কফি পছন্দ করে না। চা-ও খুব কম মেয়ে খায়। তাই সে স্ন্যাক্স, সন্দেশ এবং চা এনেছিল। কর্নেল, সস্নেহে বললেন, সুখবর এনেছ। মিষ্টিমুখ কারো ডার্লিং?
কথাকলি হাসল। জয়ন্তদার কাছে শুনেছি, পুরুষ-মেয়ে সবাইকে আপনি ডার্লিং বলে সম্ভাষণ করেন। ইট ইজ আ বিট…
হুঁ, ইট ইজ আ বিট স্ট্রেইঞ্জ! কর্নেল আবার বিশাল হাসি হাসলেন। কলি! ইংরেজি ভাষার মজাটাই এই। বাংলায় এই ডার্লিং শব্দের বিকল্প নেই। বলো, আছে?
কথাকলি সন্দেশ খেতে খেতে বলল, বোধ হয় নেই।
বাছা শব্দটা চলত। কিন্তু ওটা একেবারে বালক-বালিকাঁদের ওপর চলে। এদিকে দেখ, ইংরেজিতে হনি শব্দটাও উভলিঙ্গ। ডার্লিং! ইংরেজরা মহা ধূর্ত জাতি!
আবার এক অট্টহাসি।
কথাকলি অবাক চোখে দেখছিল। এতদিন পরে রহস্যভেদী ধুরন্ধর বৃদ্ধ ঘুঘুর সঙ্গে ঘটনাচক্রে তার অপ্রত্যাশিতভাবে পরিচয় হয়ে গেল।