কর্নেলের শুন্যোদ্যান থেকে
কর্নেলের শুন্যোদ্যান থেকে বাইনোকুলারে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের ওদিকে উঁচু-উঁচু দেবদারুগুলি চমৎকার দেখা যায়। দেবদারুশীর্ষে শকুনের বাসা! রোজ সকালে বাসাগুলি দেখা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে কর্নেলের। ষষ্ঠীকেও ব্যাপারটা দেখিয়েছেন। ষষ্ঠী বলে, ভাবগতিক ভাল ঠেকছে না বাবামশাই! বড় কুলক্ষণ। কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দেন। কলকাতা ভবিষ্যতে কি ভাগাড়ে পরিণত হবে, এ তারই পূর্বাভাস? শকুনের আশ্চর্য এক ইন্দ্রিয় আছে। কোথায় মড়া প্রাণী পড়েছে, ঠিকই টের পায়। কলকাতাকে প্রধানমন্ত্রী মুমূর্য নগরী বলেছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা তাই শুনে খাপ্পা হয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি কলকাতা ধুকছে না? সেদিন কাগজে কে শাসিয়ে লিখেছে, দেখে নিও, কলকাতা একদিন মোহেনজোদাড় হয়ে যাবে! শকুনগুলির গাছে গাছে বাসা বেঁধে বংশবৃদ্ধি সেই শাসানিরই প্রতীক কি? এদিকে একদল হুজুগে লোক কলকাতার তিনশো বছর পূর্তি উপলক্ষে উৎসবের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে! বুড়ো থুথুড়ে এক শহর চুলে কলপ দিয়ে যুবক সেজে আছে, মুখে পেন্ট। হার্ট কমজোর, সেদিকে কারও লক্ষ্য নেই! বোকা। বোকা!…
বোকা! কী আশ্চর্য! আপনি যা বললেন, তাই করলুম। আর উল্টে বলছেন, বোকা?
কর্নেল দ্রুত ঘুরলেন। অরিজিৎ লাহিড়ীকে দেখে একটু হেসে বললেন, ও! তুমি? মর্নিং ডার্লিং!
কিন্তু বোকা বলাটা কি ঠিক হলো বসু?
কর্নেল অট্টহাসি হাসতে গিয়ে সংযত হলেন। না, না। তোমায় নোকা বলিনি!
অরিজিৎ বললেন, দিব্যি বোকা বলছে শুনতে পেলুম! এনিওয়ে, ষষ্ঠী বলে যে তার বাবামশাই আজকাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন। আপনমনে বিড়বিড়, করে কথা বলেন! কর্নেল, দিনকতক বাইরে কোথাও ঘুরে আসুন বরং!;
কর্নেল চেপে রাখা অট্টহাসিটি ছেড়ে দিলেন। তারপর বললেন, সতি, আজকাল আমার কী যেন একটা গণ্ডগোল ঘটেছে। ডার্লিং! বরাবর নিজের ইনটুইশনের গর্ব করতুম। বর্মার জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধের তালিম নেওয়ার পর যষ্ঠেন্দ্রিয়জাত বোধ জেগে উঠেছিল। এতদিনে তা কি নিঃসাড় হয়ে আসছে? এই যে তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ, টের পেয়েছিলুম, ঠিকই–তবে ঐ ভেবেছিলুম তুমি নও, ষষ্ঠী! আমার আশঙ্কা অরিজিৎ, এর পর পেছনে কোন আততায়ী এসে দাঁড়ালেও…।
ডি সি ডি ডি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, প্লিজ কর্নেল! এই সাতসকালে দৌড়ে এসেছি। পরে আপনার বিষাদকাহিনী রিয়ে-তারিয়ে শুনব খন। হাতে সময় কম।
হুঁ, রাতে রয় অ্যান্ড কোম্পানিতে হানা দিয়ে কিছুই মেলেনি তো?
অরিজিৎ হাসলেন। হ্যাঁ। তবে সে কথা ফোনেই জানাতে পারতুম।
কর্নেল পাশের একটা অর্কিডের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশা করি, তার, চেয়ে খারাপ কোনও খবর এনেছ?
ইয়া!
কর্নেল দ্রুত ঘুরে বললেন, কারও মৃত্যুসংবাদ কি?
অরিজিৎ গম্ভীর হয়ে বললেন ফের, ইয়া!
মাই গুডনেস! মিঃ গোমেশ জেভিয়ার…
হি হ্যাঁজ কমিটেড সুইসাইড। আত্মহত্যা করেছেন ভদ্রলোক। অন্তত আপাতদৃষ্টে তাই মনে হয়।
কর্নেল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর একটু কেশে বললেন, কোথায়?
সিমেট্রির ওধারে রেলইয়ার্ডে ভোর ছটায় রেলপুলিশ বডি পেয়েছে। রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইঞ্জিনের সামনে!
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন? ড্রাইভার দেখেছেন?
অরিজিৎ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, তদন্ত সবে শুরু। তবে ওটা রেলপুলিশের ভার্সান। মর্গের রিপোর্ট না পেলে কোনও সিদ্ধান্ত করা অবশ্য উচিত নয়। কোনও সুইসাইডাল নোটও ঘরে গোমেশ রেখে যাননি।
কর্নেল দুঃখিতভাবে তার ছাদের বাগিচার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, চলল! নিচে গিয়ে বসি। কফি ডার্লিং! কড়া কফি দরকার এ মুহূর্তে।
নিচের ড্রইংরুমে বসার সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গেল। নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব বরাবর তার কাছে রহস্যময় ব্যক্তি, তার বাবামশাইয়ের চেয়েও। সে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল বললেন, পা দেখা যাচ্ছে হতভাগা। আড়ি পাততেও শিখলিনে এখনও? বোকা! বোকা!
যষ্ঠীর পা দুটো দরজার পর্দার তলা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অরিজিতের তাড়া ছিল। সংক্ষেপে জানালেন, রয় অ্যান্ড কোম্পানির অফিস, গোডাউন, এমন কি মালিকের বাড়ি পর্যন্ত তন্ন-তন্ন খুঁজেও গ্রিয়ার্সনের কবরের দামী পাথরের ফলক মেলেনি। সমস্যা হলো, রয়সায়েব প্রভাবশালী লোক। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে, দোস্তি আছে। অরিজিৎ একটু উদ্বিগ্ন।
অরিজিৎ কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, আপনার কথায় তখন মনে। হলো, গোমেশের মরার পথ তাকিয়ে ছিলেন। কারণটা বলতে আপত্তি আছে?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, আজ ঘুম থেকে ওঠার পরই কেন যেন মনে হয়েছিল, গোমেশ বিপন্ন।
ওটা কোনও ব্যাখ্যা হলো না!
ডার্লিং! আমাদের সব অনুভূতির কার্য-কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না।
প্লিজ! মনস্তত্ত্ব নয়। তাড়া আছে। বেরুব। একটু কংক্রিট ব্যাখ্যা পেলে ভাল হয়।
নিজেই এখনও অন্ধকারে ঘুরছি অরিজিৎ! যা কিছু ঘটতে দেখছি, মেলাতে পারছি না একটার সঙ্গে আরেকটাকে।
অন্তত একটা ঝাড়ুন। নইলে মনে কাঁটা খচখচ করবে।
রয়সায়েবের এক ভাগ্নে ঘোষসায়েবকে নজরে রাখো। সে থাকে চন্দননগরের আউটকার্স্টে ইভনিং ভিলায়। ড্যানি ঘোষ। কিন্তু সাবধান! সে যেন টের না পায় তাকে নজরে রাখা হয়েছে।
অরিজিৎ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, হাই ওল্ড ডাভ! তাহলে গতকাল কি…ওকে! নো মোর টক। বাই।
বলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডি সি ডি ডি ধাঁই করেই বেরিয়ে গেলেন।
কর্ণেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! দরজা বন্ধ করে দে! আমি ওপরে যাচ্ছি।
শূন্যোদ্যানের সকালবেলার পরিচর্যা বাকি আছে। ক্যাকটাস-অর্কিডের ক্ষতে লোশন লাগাতে হবে। কর্নেল হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে সেই দূরের দেবদারুশীর্ষে শকুনের বাসাগুলির দিকে বাইনোকুলারের নল রাখলেন। ওই শকুনগুলো…কোনও মানে হয়? শহরটা কি ভাগাড় ভেবেছে ওরা? পুরসভা করছেটা কী? অত সুন্দর দেবদারুর মাথায় শকুন!
অ্যারিজোনার কচ্ছপ-ক্যাকটাসটার কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসলেন কর্নেল। মাথার ভেতরটা শূন্য লাগছে। গোমেশ জেভিয়ার মারা পড়লেন? আত্মহত্যা…হু, কাল রাতে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কর্নেলকে ডাকতে দেখেই উধাও হয়ে গেলেন। চন্দননগরে ইভনিং ভিলায় লুকিয়ে ছিলেন। কাল্লু তাকে লুকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত গোমেশ আড়াল থেকে কর্নেলকে দেখে থাকবেন। তাই বিপদ আঁচ করেই কি আত্মহত্যা করে ফেললেন?
নাকি কেউ বা কারা তার মুখ বন্ধ করতেই মেরে ফেলল?
গোমেশ একটু বোকা আর ভিতু লোক ছিলেন তো বটেই।…
.
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার চিফ অব দা নিউজব্যুরো তারক গাঙ্গুলি টেবিলে ঝুঁকে খুব মনোযোগে দা গার্ডিয়ান পত্রিকা পড়ছিলেন। সামনে থেকে কেউ চাপা স্বরে বললেন, ব্রিটেন বরাবর বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি।
তারক গাঙ্গুলি মুখ না তুলেই বললেন, ধূর্ত! চিরধূর্ত! পাঞ্জাবের টেররিস্টদের দমন করবে বলছে, আবার তলায়-তলায় সাহায্যও করছে। বাজি রেখে বলতে পারি।
আসলে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের দেশ। সব তাতে রক্ষণশীল। আইরিশ টেররিস্টদের ওপর রাগটা…
রাইট, রাইট! আমরা মরছি ঘা খেয়ে তো তোরা ইন্ডিয়ানরাও ঘা খেয়ে মর! হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ!
অবশ্য থ্যাচার খুব জাঁদরেল মহিলা।
মহিলা বলেই তো বন্দী বিনিময় চুক্তি নিয়ে টালবাহানা করছে। আমাদের সম্পর্কে গাদাগাদা বিধিব্যবস্থা বরাদ্দ করে যাননি! রামায়ণ মহাভারত আঠারো পুরাণ সবখানে মহিলা নিয়ে গণ্ডগোল। ট্রয়ের যুদ্ধ!
এবং ইস্টার্ন সাবআর্বান সিমেট্রিতে খুন।
অ্যাঁ? বলে এতক্ষণে তারক গাঙ্গুলি কাগজ নামিয়ে মুখ তুললেন। তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠে হাত বাড়ালেন করমর্দনে। হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো ওল্ড বস! কী আশ্চর্য কী অদ্ভুত!
কর্নেল তাকে চুরুট অফার করে বললেন, আমার চেয়ে আশ্চর্য-অদ্ভুত মানুষ পৃথিবীতে বিস্তর আছেন মিঃ গাঙ্গুলি!।
তারক গাঙ্গুলি হেসে,কুটি কুটি হয়ে বললেন, আছে, আছে! আমি কারণ এতক্ষণ দিব্যি কথা চালিয়ে যাচ্ছি, অথচ মুখ তুলে দেখছি না হুম আই অ্যাম টকিং টু! সাংবাদিক মহালের প্রবাদ, তেত্রিশটে বেড়াল মরে একটা সাংবাদিক জন্মায়। আমি হোপলেস! সেজন্যই কোম্পানি আমাকে এখানে নিষ্কর্মা করে বসিয়ে রেখেছে। নামেই চিফ অব দা নিউজব্যুরো। কাজের মধ্যে শুধু কাগজ পড়া। বরং ওই সুব্রতর মতো পদ্য লিখতে পারলেও…..ওই দেখুন! ও কি খবর লিখছে ভাবছেন? পদ্য লিখছে!
তারক গাঙ্গুলি আঙুল তুলে অদূরে এক যুবককে দেখালেন। মুখে দাড়ি। পরনে সাদাসিধে প্যান্ট-শার্ট। কিন্তু শিল্পীসুলভ চেহারা। ঈষৎ লাজুক হাবভাব। কর্নেলের দিকে সে তাকিয়ে ছিল। তারক গাঙ্গুলিকে বলল, কিছু বলছেন তারকদা?
বলছি। তুমি নিশ্চয় পদ্য লিখছ! তারক গাঙ্গুলি সহাস্যে বললেন। এঁকে চেনো কি? নতুন এসেছ। চিনবে না। জয়ন্তের ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
সুব্রত মুখ নামিয়ে কাজে মন দিল। তারক গাঙ্গুলি বললেন, তুমি ওয়ার্থলেস! যোগ্য সাংবাদিক হতে হলে প্রথম গুণ অবজার্ভেশন–পর্যবেক্ষণ! কাম হিয়্যার মাই বয়! কাম, কাম! আলাপ করিয়ে দিই। আ ম্যান অব হাই কানেকশনস। আখেরে লাভ হবে।
সুব্রত মুখ তুলে একটু হাসল। কিন্তু উঠল না। তারক গাঙ্গুলি চটে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, আমাকে আর কেউ গ্রাহ্য করে না কর্নেল! এক্সটেনসনে আছি তো! যত্তোসব আজকালকার কিম্ভুত ছেলেছোঁকরা ঢোকাচ্ছে কোম্পানি। খবরে সাহিত্য ফলায়। খবর হবে অবজেক্টিভ। তা নয়, খালি মেয়েলি ভাষায় কাব্যি।
কর্নেল উঠে গেলেন সুব্রতর কাছে। সুব্রত তাকাল। কর্নেলের মনে হলো, চাউনিটা মাছের। আজকাল ছেলেছোঁকরাদের হাবভাব এরকমই। আর-সব রিপোর্টাররা হইহই করে উঠল। হ্যাল্লো ওল্ড বস! একটা স্কুপ ঝাড়ুন প্লিজ!
আজ একেবারে খবরে ভাটা।
কর্নেল সবাইকে হাত তুলে সম্বাধনের ভঙ্গি করে সুব্রতর সামনে বসলেন। চেয়ারটা খালি ছিল। সুব্রত আস্তে বলল, বলুন কর্নেল সরকার!
কর্নেল একটু হাসলেন। সত্যসেবক পত্রিকায় নতুন জয়েন করেছেন বুঝি?
হ্যাঁ। আপনার কিছু খবরটবর ছাপার থাকলে প্লিজ চিফ রিপোর্টারকে দিন। আমার কিছু সরাসরি করার ক্ষমতা নেই।
খবর আছে। তবে সেটা আপনার জন্য।
সুব্রত চমকে উঠল। আমার জন্য? কী খবর?
আমি একটা ম্যাগাজিন বের করছি। শুনলুম, আপনি কবিতা লেখেন…
সুব্রত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, গাঙ্গুলিদা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেন। আমি কবিতা লিখি না।
গল্প লেখেন?
চেষ্টা করি।
বেশ একটা গল্পই দিন না প্লিজ! যৎকিঞ্চিৎ সম্মান দক্ষিণা আমি দেব, যদি কিছু মনে না করেন। শুধু একটা অনুরোধ…..
বলুন!
প্রেমের গল্প হলে ভাল হয়। একটু ট্রাজিক ধরনের……বোঝেন তো, বাঙালি পাঠক বড্ড রোমান্টিক। একটু সঁতসেঁতে প্রেম ট্রেম চায় আর কী! কর্নেল হাসতে লাগলেন। আর একটা ব্যাপার থাকলে ভাল হয়। সেক্স নয়, অন্তত, খানিকটা ভায়োলেন্স, রহস্য-টহস্য…….ধরুন, পরিবেশ রোমাঞ্চকর করার জন্য কবরখানায় নায়ক-নায়িকা……
সুব্রত চুপচাপ শুনছিল। এবার শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে রুষ্টস্বরে বলল, ফরমায়েসি গল্প আমি লিখি না।
না, না! জাস্ট পত্রিকার ক্যারেক্টার অনুসারে বলছি।
ওইসব ট্র্যাশ পত্রিকায় আমি লিখি না! আমি লিখি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। সুব্রত চাপা স্বরে বলল, আমি যা লিখব, তা ছাপতে পারেন আসবেন, নয় তো আসবেন না!
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, তবে তাই। বাই দা বাই, স্পেশাল রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরির সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে?
না। আমি যেচে কারুর সঙ্গে আলাপ করি না। তা ছাড়া আমি জয়েন করেছি সদ্য দিন দশেক আগে। উনি এখন পাঞ্জাবে আছেন লং অ্যাসাইমেন্টে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বাও করে পা বাড়িয়েছেন, সুব্রত ডাকল, শুনুন!
কর্নেল ঘুরে বললেন, বলুন!
সুব্রতকে এবার একটু নরম দেখাচ্ছিল বলল, একটা কথা। কিছু অ্যাডভান্স করলে ভাল হতো। আমার টাকার দরকার।
কর্নেল দ্রুত পকেট থেকে পার্স বের করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট খুঁজে দিলেন ওর হাতে। সুব্রতও দ্রুত তা পকেটস্থ করল। তারপর কর্নেল লম্বা নিউজ রুমের শেষ প্রান্তে এসেছেন, পেছনে হল্লা শুনে ঘুরলেন। রিপোর্টাররা সুব্রতকে ঘিরে ধরেছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
শুধু একটা জিনিস চোখে পড়ার মতো। সুব্রত তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা এবার অসম্ভব সাদা–পাণ্ডুর। কর্নেল হনহন করে বেরিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলেন। লিফটের দিকে গেলেন না।
একেবারে অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার নয়। দৈবাৎ প্রাপ্তি নয়। নিউজপ্রিন্ট, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার যোগসূত্র, মুনলাইট বারের কাছে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস, এই কয়েকটি পয়েন্ট ধরে তাহলে ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে হাঁটছিলেন। সন্ধ্যা ছটা বাজে। রাস্তা জ্যাম। খানাখন্দের ওপর আলো পড়ে মনে হচ্ছে, কলকাতা সত্যি মুমূর্ষ এবং ক্ষতবিক্ষত। অথচ এত জেল্লা চারদিকে ওপরে ওপরে।
হুঁ, সুব্রতর পায়ে নতুন চপ্পল, তাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু সুব্রত…
হঠাৎ ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। কর্নেল মুনলাইট বারে ঢুকলেন। বারের মালিকই ম্যানেজার। নাম যশোবন্ত সিনহা। কর্নেলকে দেখেই হাত তুললেন। গুড ইভনিং স্যার! আফটার হাউ লং ডেজ……আইয়ে, আইয়ে!
কর্নেল কাউন্টারের সামনে গেলেন। বৃষ্টির জন্যই বোধ করি ছোট্ট বারে ভিড় বেড়ে গেল দেখতে দেখতে। পাশের ছোট্ট ডায়াসে এক পপ সিঙ্গার প্রাচ্য-প্রতীচ্য খিচুড়ি পরিবেশন করছে। জগঝম্পে কানে তালা ধরে যায়। সিনহা কর্নেলকে কাউন্টারের ভেতরে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন। ইংরেজিতে বললেন, আপনি তো বিয়ার ছাড়া কিছু ছোঁবেন না। এক মিনিট। সিঙ্গাপুর থেকে একডজন বিয়ারক্যান পাওয়া গেছে। আপনাকে দিয়েই উদ্বোধন হোক।
বিয়্যারক্যানে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, মেয়েদের দিয়ে গান করালে যথার্থ বারের আবহাওয়া গড়ে ওঠে মিঃ সিনহা! পুরুষেরা বড় রাফ!
সিনহা হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক! কিন্তু আমার বরাত মন্দ। একটা সুন্দর মেয়ে যোগাড় করলুম। তো তার চরিত্র ভাল নয়। খুন হয়ে গেল। কাগজে পড়েননি? পুলিশের হাঙ্গামা সামলাতে জেরবার।
বলেন কী!
সিনহা আগাগোড়া তার যেটুকু জানা, সব বর্ণনা করে চোখ নাচিয়ে বললেন, পাড়ার মস্তানদের নিয়ে খেলত। তাদেরই কেউ খতম করেছে। বোকা মেয়ে! আপনি স্যার এই কেসটা…….
আচ্ছা মিঃ সিনহা! এই বারে তো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিকরা অনেকে আসেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ! ওঁদের অনেকে আমার নিয়মিত খদ্দের। সিনহা চাপা স্বরে বললেন, টিনির মার্ডার কেস হাতে নিয়েছেন বুঝি?
কর্নেল জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি ওসব লাইন কবে ছেড়েছি, মিঃ সিনহা! এখন স্রেফ নেচারিস্ট। এই যে দেখছেন, সব সময় বাইনোকুলার ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছি। পাখি টাখি দেখি। ছবি তুলি।
জানি, জানি। সিনহা সকৌতুকে বললেন। আপনার বাইনোকুলারে কত কিছু দেখেন। তো আমি বলি কী, এই কেসটাও দেখুন। মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়, কর্নেল!
কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, বয়স হয়েছে। আর ছোটাছুটি করতে পারি না!
বলে কর্নেল বারের ভিতরটা দেখতে থাকলেন। বাইরে বৃষ্টির জন্য তাগড়াই চেহারার প্রহরী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময় দরজা খুলে কাউকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করল। কর্নেল ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে মুখ নামালেন। চন্দননগরের সেই ড্যানি ঘোষ ঢুকছে। সঙ্গে দুজন লোক।
প্রহরী দুই মাতালকে ঠেলে বের করে দিল বৃষ্টির মধ্যে। তারা নাচতে শুরু করেছিল। আসলে ড্যানি ঘঘাষকে আসন করে দিল সে। বাকি দুই মাতাল ভয়ে ভয়ে কেটে পড়ল আসন ছেড়ে। ড্যানি ঘোষের চোখে চোখ পড়ল কর্নেলের। সে ক্রুর চোখে তাকিয়ে আছে।
কর্নেল বললেন, আপনার প্রহরীটি বেশ। বারেরও একটা নীতিবোধ নিয়মকানুন থাকা উচিত। সে তা বজায় রাখে।
সিনহা বললেন, যোসেফ? ওঃ খুব হুঁশিয়ার এসব ব্যাপারে।
ওর নাম যোসেফ নাকি?
হ্যাঁ। একসময় ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকার সব মস্তান ওর পায়ের তলায় থাকত। ওকে পুলিশ সোর্স থেকে বলে কয়ে নিয়ে এসেছিলুম। ও ছিল পুলিশের ইনফরমার। কাজেই ওর-ও নিজের নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল।
যোশেফকে ড্যানি কিছু ইশারা করছে কর্নেলকে দেখিয়ে। যোসেফ হেসে কী বোঝাচ্ছে। কর্নেল আস্তে বললেন, ওই ভদ্রলোককে চেনেন? যোসেফ যার সঙ্গে কথা বলছে।
কে চেনে না ড্যানি ঘোষকে? ওর মামা নিলামের কারবারী। রয় অ৬ কোং আছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। সব এক ঘাটের মড়া। ড্যানি অবশ্য চন্দননগরে মেমসায়েব বউয়ের কাছে থাকে।
এবার ঢুকল সুব্রত। ঢুকেই টেবিল খালি পেল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ কর্নেলের চোখে পড়তেই বেরিয়ে গেল।
কর্নেল বললেন, ওই যুবকটিকে চেনেন?
খুব চিনি। সুব্রত চৌধুরি। আমিই সত্যসেবকের মালিককে ধরে ওকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছি।
বাঃ! ভাল কাজ করেছেন!
সিনহা মিটিমিটি হাসলেন। ছেলেটা ভালই। প্রথম প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে আসত। তাদের পয়সায় খেত। আলাপ হয়ে গেল। একদিন দেখি টিনিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। বলে, মেয়েটি ভাল গায়। নাচতেও পারে। যদি ওকে চান্স দিই……
বুঝতে পেরেছি। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলি মিঃ সিনহা। আবার দেখা হবে।
কর্নেল দরজার বাইরে গিয়ে দেখলেন, বৃষ্টিটা কমেছে।……
.
ইস্টার্ন সাব-আরবান সিমেট্রির পুবে রেল ইয়ার্ড, দক্ষিণে একটা বস্তি এলাকা। বস্তিটা ক্রমশ তার সত্তা হারাচ্ছে, এটা শুভ লক্ষণ নাকি অশুভ, কর্নেল ভাবছিলেন। ইতস্তত তিন থেকে পাঁচ তলা বাড়ি উঠেছে বস্তি খুঁড়ে। কবি কিপলিঙের পভার্টি অ্যান্ড প্রাইড/সাইড বাই সাইড এখানে মর্মান্তিক সত্য। নতুন উঁচু বাড়িগুলোতে নিশ্চয় বস্তির লোকেরা থাকে না। তার মানে, তাদের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়নি। তাদের উচ্ছেদ করেই বস্তি মালিকেরা ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়েছেন। তারা হয়তো ফুটপাতে কি অন্যত্র আবার আশ্রয় নিয়েছে। ঝোপড়ি বেঁধেছে। দশ-বিশ বছর পরে কোন বড়কর্তার খেয়াল হবে, তখন পুলিশ গিয়ে ঝোপড়ি ভাঙবে। তারা আবার ছড়িয়ে পড়বে মহানগরের অন্যত্র। সভ্যতার দেহে মারীবীজাণুর মতো জন্ম নেবে আঁকে ঝাঁকে রাস্তার ছেলেমেয়েরা। মহানগরের রক্ত দূষিত করবে। সভ্যতাকে পচিয়ে দেবে তীক্ষ্ণ আণবিক দাঁতের কামড়ে।
দিক। কর্নেল রিকশো থেকে নেমে মনে মনে বললেন, একচোখা সভ্যতার পতন ঘটুক। কার্ল মার্ক্সের বর্ণিত সত্যিকার সর্বহারারা মারীজীবাণু হয়ে উঠুক।
তবেই নতুন সভ্যতার জন্ম হবে। আসলে এখনও মানুষ বর্বরতার যুগ অতিক্রম করতে পারেনি।
সাব! ভাড়া……
কর্নেল বললেন, সরি! এই নাও ভাই!
রিকশোওয়ালা ভাড়া নিয়ে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল। বস্তির ভেতরটা কেমন থমথম করছে। বাতিগুলি নিষ্প্রভ। ইতস্তত কিছু জটলা। শ্রমজীবীরা আড্ডা দিচ্ছে। তাস খেলছে। একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করলে টিনির মা সুরঞ্জনা দেবীর বাড়ি দেখিয়ে দিল।
একটুকরো পোড়া জমি এবং ভোলা ড্রেন পেরিয়ে একতলা জরাজীর্ণ বাড়ি। ভেতরে আলো দেখা যাচ্ছিল খোলা জানালা দিয়ে। কর্নেল দেখলেন, কলিং বেল আছে। টিনির আশা-আকাঙক্ষার একটা সামান্য চিহ্ন। টিপলে পিয়ানোর শব্দ হলো। বুকের ভেতর ঝংকৃত হলো ধ্বনি। যেন টিনির আত্মা সাড়া দিল।
কে রে? মহিলাকণ্ঠে ভেতর থেকে সাড়া এল।
কর্নেল বললেন, আমি একটু দেখা করতে চাই আপনার সঙ্গে।
কে আপনি? বলে এক প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, রোগা, বিধ্বস্ত চেহারা। কর্নেলকে দেখে এক পা পিছিয়ে বললেন, আপনি কোত্থেকে আসছেন স্যার?
কর্নেল হাসলেন। আমাকে স্যার বলবেন না। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
সুরঞ্জনা দেবী একটু ইতস্তত করে বললেন, কী ব্যাপার…পুলিশকে তো…….
আমার নামটা আপনার জানা মনে হচ্ছে সুরঞ্জনা দেবী? কর্নেল শুকনো হাসলেন।
সুরঞ্জনাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, কর্নেলসায়েব। আমি মেয়ে। বয়স হয়েছে। তাতে বুকে এই পাথরচাপা শোক। পুলিশকে যা বলার সব বলেছি। আর নতুন কথা তো নেই।
কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে কেউ নিষেধ। করেছে, বুঝতে পারছি।
সুরঞ্জনা কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, আপনি চলে যান কর্নেলসায়েব! আপনার সঙ্গে কথা বললে আমার আরও বিপদ হবে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না! পুলিশ কত দিন আমার বাড়ি পাহারা দেবে?
যে শাসিয়ে গেছে, সেই বলেছে বুঝি?
দরজা মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেল। কর্নেল মুহূর্তে শক্ত হয়ে গেলেন। জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে দ্রুত রিভলবারটি বের করে প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন এবং সেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন।
একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। ঝোঁকের মাথায় রাত আটটায় এখানে আসা ঠিক হয়নি। আলো-আঁধারি পরিবেশ। আততায়ীর পক্ষে দারুণ সুযোগ।
দ্রুত পোড়ো জমিটা পেরিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছুলেন। আলোকিত অংশে এসে সাহস ফিরে পেলেন।
ইনটুইশন? হয়েতো তাই। কেন হঠাৎ তখন মনে হলো তিনি বিপন্ন? বড় রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে হাঁটতে থাকলেন। কোনও ট্যাক্সি নেই। ডাইনে দূরে সেই কবরখানার গেটের সামনে আলো জ্বলছে। এক দঙ্গল পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে দেখতে পেলেন কর্নেল।
একটু অন্যমনস্ক হলেন। কেউ আজই শাসিয়ে গেছে টিনির মাকে। কে সে? সুব্রত? কোনও কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগই পেলেন না। হ্যাঁ, সুব্রতর কথাই জানতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুব্রত…….।
পেছনে গরগর শব্দ। ঘুরেই দেখলেন, হেড লাইটহীন একটা গাড়ি তার মাত্র কয়েক গজ দূরে। এক লাফে উঁচু ফুটপাতে উঠলেন। জনহীন খাঁ খাঁ রাস্তা। প্রাইভেট গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে এগিয়ে গিয়ে ব্রেক কষল। সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল পকেট থেকে রিভলবার বের করে তৈরি হলেন। গাড়ির দরজা খুলে দুটি লোক বেরুল। চোখে কালো চশমা।
বাঁ দিকে একটা হাউসিং কলোনি। কর্নেল বাঁ দিকে ফুটপাতে। হঠাৎ মনে হলো, অকারণ একটা খুনোখুনি ঘটিয়ে লাভ নেই। হাউসিং কলোনির গেট দিয়ে ঢুকে পড়লেন। ছোট পার্কে কয়েকটি যুবক উজ্জ্বল আলো জ্বেলে ভলিবল খেলছে। কর্নেল খেলা দেখার ছলে একটু দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখলেন। লোক দুটো তাকে ফলো করে আসেনি। কিন্তু ও পথে যাওয়া আর নিরাপদ নয়।
হাউসিং কলোনির উল্টোদিকে একটা বস্তি। এই বস্তিটা সচ্ছল অবাঙালি মুসলিমদের। বস্তিতে রিকশো পাওয়া গেল। বললেন, পার্ক সার্কাস! জলদি……
.
সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেল অরিজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে। সবে নেমে আসছিলেন। কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিলুম। বাট হাউ ফানি! আপনাকে ঝোড়ো কাক দেখাচ্ছে কেন?
কর্নেল হাসবার চেষ্টা করলেন। চলো, বলছি! আমায় সত্যিই বাহাত্তুরে ধরেছে ডার্লিং!
ষষ্ঠী দরজা খুলে দিলে বললেন, কফি! কড়া কফি! তারপর ধপাস করে বসে রুমালে মুখ মুছলেন।
অরিজিৎ বসে বললেন, ঝড়টা কিসের?
এক মিনিট। ড্যাম টায়ার্ড। আগে কফি, পরে কথা। বলে হঠাৎ অট্টহাসি হাসলেন, বোকা! আমি এক নম্বর বার্ধক্য এবার সত্যিই…ওঃ! ভাবা যায় না!
ষষ্ঠী এই হাসি শুনলেই পর্দার ফাঁকে উঁকি মারে। চোখে চোখ পড়লে কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন, কফি!
ষষ্ঠী অদৃশ্য হলো।
অরিজিৎ কপট গাম্ভীর্যে বললেন, কফির আগেই এই পৈশাচিক হাসি। বড় গোলমেলে ব্যাপার।
কর্নেল দাড়ি খামচে ধরে বললেন, ওই কবরখানার পিশাচের সংস্পর্শে গিয়ে পড়েছিলুম, ডার্লিং! যাই হোক, আমারটা কফি খেয়ে হবে। তোমারটা শোনা যাক।
গোমেশ জেভিয়ার……
সুইসাইড করেননি।
অরিজিৎ কপট রোষে বললেন, তা হলে আমার হয়ে আপনিই বলুন, আমি শুনি।
সরি ডার্লিং! আর স্পিকটি নট। মুখ বন্ধ করলুম।
গোমেশকে মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। তারপর বডি তুলে নিয়ে রেলইয়ার্ডে ফেলে রাখা হয় লাইনের ওপর। বৃষ্টি হচ্ছিল। ড্রাইভার কিছু দেখতে পাননি। তবে এসব ক্ষেত্রে যা হয়! তার অনুমান–জাস্ট উইশফুল থিংকিং বলা যায় যে, গোমেশ ইঞ্জিনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ পরে তার এমনটি মনে হয়েছিল মাত্র।
কর্নেল কী প্রশ্ন করতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্নটা করলেন না।
অরিজিৎ বললেন, বৃষ্টি এবারও রক্ত ধুয়ে ফেলেছে। কবরখানা তন্নতন্ন খুঁজে রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ওঁর ঘর, গির্জার ভেতরটা–কোথাও না।
ষষ্ঠী কফি আনল। চুপচাপ কফি খেতে থাকলেন, কর্নেল। অরিজিৎ দুবার খেয়েছেন। অতএব আর খাবেন না।
কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট জ্বেলে ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, আঃ!
এবার তাহলে আপনার কথা।
কর্নেল দৈনিক সত্যসেবক-সুব্রত উপাখ্যান এবং মুনলাইট অংশ বাদ দিয়ে শুধু টিনিদের বস্তিতে যাওয়ার ঘটনাটির সরস বৃত্তান্ত দিলেন। সঙ্গে প্রচুর অট্টহাসি।
অরিজিৎ মন দিয়ে শুনছিলেন। সবটা শোনার পর খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন ঠিকই। তবে আমরা আর সহ্য করব না। ড্যানি ঘোষকে, তার মামা রায়সায়েবকে আর ওই ধূর্ত যুধিষ্ঠিরকে দুরমুশ করব। নো, নো! আর আপনার কথা শুনবই না।
দুরমুশ করে লাভটা কী হবে, অরিজিৎ? কোর্টে প্রমাণ করতে পারবে ওরা টিনি এবং গোমেশের হত্যাকারী অথবা হত্যার জন্য দায়ী? কী প্রমাণ তোমার হাতে আছে?
ডি সি ডি ডি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, আপনার ওপর হামলা করার স্পর্ধা গুঁড়িয়ে দেব।
ডার্লিং! নিজেকে রক্ষার ক্ষমতা আমার আছে। একটু ধৈর্য ধরো। কর্নেল নিভন্ত চুরুট ফের ধরিয়ে বললেন, যুধিষ্ঠিরের ওপর অকারণ চাপ দিলে কিছু হবে না।
সে গভীর জলের মাছ!
তেমন কোনও কথা কি বের করতে পেরেছ তার কাছ থেকে?
আজ এক দফা জেরার মুখে সে বলে ফেলেছে, গোমেশ টিনি হত্যার একদিন আগে টিনিদের বাড়ি গিয়েছিলেন।
ইজ ইট? কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন।
যুধিষ্ঠির বলেছে, সে গোমেশ কে জানে না। তখনও জানত না। তবে একজন অ্যাংলোসায়েবকে সে যেতে দেখেছিল। টিনিকে তার সঙ্গে বেরিয়ে যেতেও দেখেছিল। অরিজিৎ শ্বাস ফেলে বললেন, অ্যাংলোসায়েবের চেহারার যে বর্ণনা দিয়েছে সে, তা গোমেশের সঙ্গে মিলে যায়।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, অরিজিৎ! যথেষ্ট দেরি হয়ে গেলেও এবার বলব, টিনিদের বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করা দরকার বিশেষ করে টিনির যা কিছু আছে, সেইগুলো। আসলে……
কর্নেলকে থামতে দেখে ডি সি ডি ডি ভুরু কুঁচকে বললেন, শুট! কর্নেল জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, জীবনে এই প্রথম একটি কেসে আমি উল্টোমুখে হেঁটে যাচ্ছিলুম। ডার্লিং! তোমাকে তো বরাবর বলে এসেছি, খুনীকে ধরতে হলে তার ছায়ার পেছনে দৌড়ো না, যে খুন হয়েছে তাকেই খুঁজে দেখ। খুনীকে তার মধ্যেই পেয়ে যাবে। সব হত্যাকারী লুকিয়ে থাকে তার ভিকটিমের মধ্যে। এবার আমি……বয়স অরিজিৎ, বয়স! আমাকে বাহাত্তুরে ধরেছে!
অরিজিৎ একটু হাসলেন। টিনিদের বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে? ওকে! কী সূত্র আশা করছেন আপনি?
কিছু না। তবে যেখানে দেখিবে ছাই/উড়াইয়া দেখ তাই/পাইলে পাইতে পার অমূল্য রতন! বলে কর্নেল আবার এক অট্টহাসি ছাড়লেন।
ওঃ! আপনি বড্ড বেশি পৈশাচিক হাসি হাসছেন আজ! অরিজিৎ মন্তব্য করলেন।
কর্নেল হাসি থামিয়ে চোখ বুজে অভ্যাসমতো দুলতে শুরু করেছেন।
অরিজিৎ উঠে বললেন, চলি। আমিও বড় টায়ার্ড!
ডার্লিং, সুব্রত……
অরিজিৎ চমকে উঠলেন। সুব্রত? হু জি দ্যাট ফেলো?
সুব্রত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক এবং গল্প লিখিয়ে।
বিরক্ত ডি সি ডি ডি বললেন, হেঁয়ালির স্বভাব আপনার গেল না!
অরিজিৎ! সুব্রত হয়তো বিপন্ন। তার পুলিশ প্রোটেকশন দরকার। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। সেজন্যই এখনই তাকে গ্রেফতার করে হাজতে রাখার ব্যবস্থা করো। সেটাই হবে তার প্রকৃত প্রোটেকশন। না, তার ওপর জুলুম কোরো না। তাকে হাজতে সাচ্ছন্দ্যে রাখবে। গল্প লেখার সুযোগ দেবে। খাওয়া-দাওয়া যেন কয়েদিদের মতো না হয়। সুব্রত এই কেসে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘুটি। এক মিনিট, সে এখন কাগজের অফিসে আছে কি না জেনে নিই।
বলে কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করলেন। তারক গাঙ্গুলিকে চাইলেন।
তারক গাঙ্গুলি নটায় চলে গেছেন। চিফ রিপোর্টার অমল গুপ্ত লাইনের ও প্রান্তে। কর্নেল বললেন, সুব্রত চৌধুরি। আপনাদের নতুন রিপোর্টার……। নেই?…….। অসুস্থতা…….ওক্কে! ওর বাড়ির ঠিকানাটা……হ্যাঁ, ধরে আছি।
ডান হাতে টেবিল থেকে প্যাড-কলম টেনে বললেন, ১২/২ গোবিন্দ মিস্ত্রি লেন, কলকাতা ১৭……। ওকে! পার্ক সার্কাস……ও! বেকবাগান এরিয়া? থ্যাংকস্ ডার্লিং! না, না! আমি সত্যিই একটা পত্রিকা করছি। অপরাধ তদন্ত বিষয়ক পত্রিকা। তার ভেতর দুটো গল্প, খান চারেক পদ্য না ঢোকালে পাবলিক খাবে না! হাঃ হাঃ হাঃ!
ফোন রেখে কর্নেল অরিজিতের দিকে তাকালেন। কুইক! ঠিকানা লিখে নাও। সুব্রত বিপন্ন। আর একটা কথা, সুব্রতের হাতের লেখার নমুনা আমি দেখেছি। তবু টিনির পার্সের ভেতর পাওয়া লেখাটির সঙ্গে ভালভাবে মিলিয়ে দেখা দরকার। আর তার আঙুলের ছাপের সঙ্গে ওই লেখাটির কাগজে পাওয়া ছাপ…
এনাফ! বলে ডি সি ডি ডি কর্নেলের টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন।