ছেঁড়া একপাটি স্যান্ডেল
সকাল নটায় ছেঁড়া একপাটি স্যান্ডেল নিয়ে অরিজিৎ লাহিড়ী চলে গেলে কর্নেল বেরুলেন। পায়ে হেঁটেই গেলেন। ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারটেকার সোসাইটির অফিস মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই বাঁ দিকে পড়ে। গেটের কাছে পৌঁছুলে উঁচু বারান্দায় ডেভিড প্যাটার্সনকে দেখতে পেলেন। বারান্দায় টেবিলের সামনে বসে সিগারেট ফুকছে।
কলকাতায় কয়েকটা আন্ডারটেকার সোসাইটি আছে। এঁরা হিন্দু সত্ত্বার সমিতির মতোই মৃত খ্রিস্টানদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করেন। কফিন তৈরি, কফিনবাহী গাড়ি, পাদ্রি ইত্যাদি সবই এঁরা ব্যবস্থা করে দেন।
কর্নেলকে দেখেই ডেভিড তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। মর্নিং! মর্নিং কর্নেল! বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য। ঈশ্বর না করেন, লিন্ডার ঠাকমার কিছু সুসমাচার নেই তো?
আন্ডারটেকার-কর্মী হাসতে লাগলেন। লিন্ডারা থাকে কর্নেলের তিনতলা বাড়ির দোতলায়। ওর ঠাকমা অনেকদিন ধরে শয্যাশায়িনী। বুড়ো বয়সে হাজারটা অসুখ।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, না মিঃ প্যাটার্সন। আপনাকে সেই সুসমাচার এ মুহূর্তে দিতে পারছি না।
ডেভিড একটু নিরাশই হলেন যেন। এক সপ্তাহ যাবৎ কোনও বডি পাচ্ছেন। এমনিতেই এ শহরে খ্রিস্টান সংখ্যা কমে গেছে দিনে দিনে। তার সোসাইটির রোজগারপাতিও কমে গেছে। বড় আশা করে আছেন, লিন্ডার ধনী ঠাকুমার বডি পড়লে দামী কাঠের কফিন অর্ডার আসবে। ফিউনারাল হবে জম্পেশ রকমের। ভাব গোপন করে বললেন, প্রভুর ইচ্ছা! আসুন, বসুন। গল্প করা যাক। চমৎকার আবহাওয়া অজ।
কর্নেল বসে বললেন, এটা কথা জানতে এলাম মিঃ প্যাটার্সন?
বলুন, বলুন! আপনার মোর জন্য আমি সর্বদা তৈরি।
রেলইয়ার্ডের পাশের ওই সিমেট্রি কোন চার্চের প্রপার্টি?
ডেভিড বাঁকা মুখে বললেন, ওটা একরকম পোড়া কবরখানাই বলতে পারেন কর্নেল! কে যাবে অতদূরে? তার ওপর চোর-ডাকাত-ওয়াগনব্রেকারদের আচ্ছা। আমি প্রভুর নামে দিব্যি কেটে বলতে পারি, কোনও ধনী খ্রিস্টান গত চল্লিশ বছরে ওখানে বডি নিয়ে যাননি। কেন জানেন? মার্বেল ফলক, দামী কাঠের ক্রস, সব রাতারাতি ডাকুরা উপড়ে নিয়ে পালাবে। শয়তানের কবলে পড়েছে কবরখানাটা! তা ছাড়া ওটা প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের সম্পত্তি। ক্যাথলিক চার্চ হলে বরং রক্ষণাবেক্ষণ হতো!
সেই প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের ঠিকানাটা জানেন?
ডেভিড একটু অবাক হয়ে বললেন, কিছু কি ঘটেছে?
কর্নেল বুঝলেন, ডেভিড খবরের কাগজে ছোট করে বেরুনো খুনের খবরটা পড়েননি। চেপে গিয়ে বললেন, নাঃ মিঃ প্যাটার্সন! আপনি তো জানেন আমি বার্ড-ওয়াচার, গতকাল ওখানে পাখি দেখতে গিয়ে কবরখানার দুর্দশা লক্ষ করলুম। অনেক বিখ্যাত ইংরেজদের কবর আছে ওখানে। আপনি যা বলছিলেন, সব দামী ফলক আর ক্রস লোপাট হয়ে গেছে। তাই ভাবলুম…….
হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে রুষ্ট ভঙ্গিতে ডেভিড বললেন, কিছু করা যাবে না। কেন জানেন? কেয়ারটেকার গোমেশ বুড়োই হলো যত নষ্টের গোড়া। আমার দৃঢ় ধারণা, সে-ই ফলক আর ক্রসচোরদের সাহায্য করে। বখরা পায়। গোমেশ মূর্তিমান শয়তান।
গোমেশকে আপনি চেনেন?
চিনি না মানে? ডেভিড ফুঁসে উঠলেন। জীবনে অসংখ্য কাজ সে করেছে, যা কোনও কবরখানার কেয়ারটেকার কখনই করবে না।
যেমন?
গোমেশ রেস খেলত।
বলেন কী!
ডেভিড আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, রেসে ফতুর হয়ে যাচ্ছিল দেখে ওর বউ আত্মহত্যা করেছিল। ওর ছেলেমেয়েরা রাগ করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমার কাছে গোমেশ একবার পঞ্চাশ টাকা ধার করে নিয়ে গেল। আর শোধ দেবার নাম নেই। শেষে ওর খুড়তুতো বোনকে গিয়ে ধরলুম! ভদ্রমহিলা পরিবারের সম্মান বাঁচাতে টাকাটা শোধ করলেন। কর্নেল! যদি ওর সব কথা ওদের চার্চকে জানাতুম, ওর চাকরিই থাকত না। প্রভু যিশুর দিব্যি, টাকাটা না পেলে আর মুখ বুজে থাকতুমই না।
কর্নেল চুরুটের কৌটো বের করে ডেভিডকে একটি চুরুট দিলেন। ডেভিড সিগারেট তক্ষুণি ঘষটে নিভিয়ে অমায়িক হেসে চুরুটটির তারিফ করলেন। এতক্ষণে কর্নেলের আপ্যায়নের জন্য হাঁক দিলেন, বারবারা! হোয়ার আর ইউ, হনি? কাম অ্যান্ড সি, হু ইজ হেয়া!
ডেভিডের ধুমসি বউ বারবারা ঘর থেকে উঁকি মেরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ও! মাই, মাই! তারপর ধুপধাপ শব্দে এসে সামনে দাঁড়ালেন। ইউ নটি বয়। কতোদিন পাত্তা নেই। আজ আপনার শাস্তি।
এক পেয়ালা কফি, ডার্লিং! কর্নেল অট্টহাস্য করলেন। বারবারা ধুমসি সাহেব হলেও খুব চটপটে, হাসিখুশি, চঞ্চল মহিলা। স্বামীর উল্টো। তখনই অতিথি সৎকারে ছুটলেন। ডেভিড বাঁকা মুখেই ছিলেন। এই সময় চাপা গলায় বলে উঠলেন, আস্ক হার অ্যাবাউট গোমেশ। শি অলসো নোজ এভরিথিং। তাছাড়া গোমেশের খুড়তুতো বোন আবার বারবারার বন্ধু। তা নইলে কি টাকাটা ফেরত পেতুম?
সেই বোনের ঠিকানা জানেন?
ডেভিড নাকের ডগা কুঁচকে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, চন্দননগরে . থাকে। আমি ঠিকানা জানি না। বারবারা জানে।
একটু পরে বারবারা ট্রে সাজিয়ে নিয়ে এলেন। কর্নেল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছেন। কিন্তু বারবারা তাকে ডবল ব্রেকফাস্ট না খাইয়ে ছাড়বেন না। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, বারবারা, ডিয়ারি! তোমার হাতের কফির কোনও তুলনা হয় না!
বারবারা ভঙ্গি করে বালিকার চাপল্যে বললেন, আই গেস, সামথিং থ্রিলিং হ্যাঁজ হ্যাঁপড় সামহোয়্যার। ওকে নটি বয়! আস্ক মি হান্ড্রেডস অফ কোয়েশ্চস্। আইম রেডি টু আনসার।
ডেভিড চমকে উঠলেন এতক্ষণে। মাই গড! আমার এটা ভাবা উচিত ছিল।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, তেমন কিছু নয়। ঠিক আপনার মতোই ব্যাপার। গোমেশ আমার কাছে একশো টাকা ধার করেছেন। প্রায়ই ওই কবরখানায় পাখি দেখতে যেতুম। তো কাল বিকেলে গিয়ে দেখি, ওঁর ঘরের দরজায় তালা আটকানো।
ডেভিড দ্রুত বললেন, বারবারা। ইউ ডু সামথিং এগেন! দা ব্লাডি বাস্টার্ড সোয়াইন!
বারবারা স্বামীকে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ! দিনটাকে নষ্ট কোরো না। কর্নেল! সমস্যা হলো, বেচারি ইভলিন আর তার কাজিন ব্রাদারের টাকা শোধ করতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ আছে। ইভলিন মিশনারি কলেজের অধ্যাপিকা। দয়া করে ওকে এক্সটেনশন দিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। ওঁর-ও তো ভবিষ্যৎ আছে। তবে আমি চিঠি লিখে আপনাকে পরিচয় দিতে পারি।
উনি কি চন্দননগরে থাকেন? কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন।
ইভলিন থাকে একটু দূরে। ব্রিটিশ চন্দননগরের কাছে নিরিবিলি এলাকায় গঙ্গার ধারে ওর পৈতৃক বাড়ি। পুরানো বাড়ি ওর বোন এমা বিয়ে করেছে এক হিন্দু ভদ্রলোক সাম মিঃ ঘোষকে। এমা তার স্বামীকে নিয়ে দিদির বাড়িতেই থাকে। বারবারা একটু ভেবে নিয়ে ফের বললেন, ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, তবে ইভলিনকে দয়া করে পীড়াপীড়ি করবেন না, হেভস্ সেক!
না, না। গোমেশ কোথায় গেলেন, সেটা খোঁজার জন্য ওঁর সাহায্য চাইব।
ডেভিড বললেন, বদমাশটা ঠিক ওখানে গিয়ে জুটেছে দেখবেন। আর যাবে কোন চুলোয়? অস্ট্রেলিয়া যে যায়নি, তা আমি দিব্যি কেটে বলতে পারি। যাবার টাকা ও পাবে কোথায়?
বারবারা স্বামীর কথায় সায় দিলেন। হ্যাঁ, ইভলিনের ঘাড়ে গিয়ে চাপতেও পারে। ইভলিনটা যে বড্ড বেশি দয়ালু মেয়ে।…
.
কর্নেল চন্দননগরে ট্রেন থেকে যখন নামলেন, তখন প্রায় বারোটা বাজে। ইভলিনকে এখন কলেজে পাওয়া যাবে। তাই রিকশো করে মিশনারি কলেজে গেছেন।
গিয়েই নিরাশ হলেন। ইভলিন তিন দিন আগে ছুটিতে গেছেন। সম্ভবত মুসৌরিতে বেড়াতে গেছেন।
কিন্তু তার বোন এমা ঘোষ আছেন। অন্তত থাকার সম্ভাবনা আছে। কারণ, দিদির সঙ্গে তিনিও মুসৌরি চলে যেতে পারেন। তবু শেষ চেষ্টা। গোমেশের খোঁজ যদি মেলে!
গোমেশ এই হত্যারহস্যের একটা প্রধান সূত্র।
রিকশোওলা গাঁইগুই করছিল। ওই এলাকায় রাস্তাঘাট নাকি ভাল নয়। বখশিসের লোভে সে শেষে রাজি হলো। গঙ্গার ধারে রাস্তা ধরে শহর এলাকা ছাড়িয়ে তারপর আমবাগান, বাঁশবন, জঙ্গল পোড়ো বাড়ির ভেতর দিয়ে কাঁচা পথ। বৃষ্টিবাদলায় কাদা আর খানাখন্দে ভরা। রিকশোওলা তেতো মুখে মাঝে মাঝে নেমে সাইকেল রিকশো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
কর্নেল তৈরি হয়েই বেরিয়েছেন। কিটব্যাগে লাঞ্চের প্যাকেট, হ্যাঁভারস্যাকে জল আছে। ফ্লাস্কভর্তি কফিও মজুত। বাইনোকুলার ক্যামেরা যথারীতি ঝুলছে গলা থেকে। হাতে প্রজাপতি ধরা নেটস্টিক। রথদেখা কলাবেচা দুই-ই হবে। বরাবরকার অভ্যাস।
বাঁ দিকে দূরে সুদৃশ্য হাউসিং কলোনি। একখানে রিকশোওলা গোঁ ধরে দাঁড়াল। আর যেতে পারব না স্যার! ওই দেখুন কত্তো জল। আপনি দয়া করে চলে যান।
সত্যি আর রিকশা যাবে না। অগত্য নেমে পড়লেন। বখশিস অবশ্য কথামতো দিলেন। রিকশোওলা একটু বিশ্রাম নিতে বসল একটা গাছের তলায়।
কর্নেলের পায়ে গামবুট। জলকাদা ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন, ইভলিন কলেজে যান কোন রাস্তায়? নিশ্চয় ভুল রাস্তায় এসে পড়েছেন। সম্ভবত ওই হাউসিং কলোনির ভেতর দিয়ে ভাল রাস্তা আছে।
হ্যাঁ, ভুলটা নিজেরই। দূরত্বটা বেশি হতো ওদিকে গেলে। কিন্তু নিজেই গঙ্গার শোভা এবং পাখি-প্রজাপতির ধান্দায় এদিকে নিয়ে এসেছিলেন রিকশোলাকে।
তবে লাভ হলো। পাখির রাজত্ব এদিকটায়। কত রকমের প্রজাপতিও। সাধারণ প্রজাতির প্রজাপতি বলে নেটে ধরার চেষ্টা করলেন না। জঙ্গুলে এলাকা। মুসলিম গোরস্তান। ভাঙা মসজিদ। কোথাও ধ্বংসাবশেষ।
একটা বাজে। গঙ্গার ধারে বসে লাঞ্চ সেরে নিলেন কর্নেল।
চুরুট ধরিয়ে আবার হাঁটতে থাকলেন। এবার গাছপালার ফাঁকে জরাজীর্ণ কিছু বাড়ি চোখে পড়ল। বনেদী বড়লোকের বাড়ি ছিল একদা। কিন্তু মানুষজন চোখে পড়ল না। এগুলো বাগানবাড়ি বলেই মনে হচ্ছিল। খানিকটা এগিয়ে বা দিকে সুরকি-বিছানো ক্ষয়টে এক ফালি সংকীর্ণ রাস্তার ধারে একটা গেট। গেটের মাথায় বোগনভেলিয়ার ঝুঁপি। নিচু পাঁচিলঘেরা একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। গেটের ফলকটা টুটাফাটা। লেখা আছে; ইভনিং ভিলা। এই সেই বাড়ি!
গেট বন্ধ। গরাদ দেওয়া গেট। ভেতরে ফুলবাগিচা অযত্নে জঙ্গল হয়ে আছে। বাড়ির সিঁড়ির মাথায় খোলা পার্লারে একটা হাফপ্যান্ট গেঞ্জিপরা লোক বসে পালক দিয়ে কান চুলকোচ্ছে। আরামে চোখ বন্ধ। কর্নেল খুক করে কাশতেই সে তাকাল। তারপর হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে সেলাম দিল।
কর্নেল, মিসেস ইভলিনের ভাই গোমেশকে একটু ডেকে দাও না ভাই!
লোকটি হকচকিয়ে গেল। তারপর জোরে হাত নেড়ে বলল, গোমসায়েব নেই স্যার! তাকে এখানে পাবেন কে বলল? সে তো কলকাতায় থাকে।
কর্নেল ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করেছিলেন। কিন্তু লোকটির প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত। এর দুটো অর্থই হয়। গোমেশ এখানে আছেন এবং নিষেধ করা আছে, কিংবা এ বাড়িতে তিনি অবাঞ্ছিত লোক।
কর্নেল অমায়িক হেসে বললেন, মিসেস ইভলিনের বাড়িতে ওঁর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল।
লোকটি গেটের গরাদে বুক ঠেকিয়ে চাপা গলায় বলল, স্যার কি মাল কিনবেন? তা হলে এখানে নয়। মেমসায়েবের বকুনিতে গোমসায়েব আর এখানে মাল এনে রাখতে সাহস পায় না। অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখে। দামী পাথর স্যার! আদ্ধেক দামে পাবেন। কিছু বখশিস ছাড়ুন। পাথর কেনার ব্যবস্থা করে দেব।
একটা চক্রের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কর্নেল বললেন, পাথর? পাথর নয়। গোমেশ আমার কাছে টাকা ধার করেছেন। দিদির কাছে টাকা নিয়ে…
লোকটা হাসতে লাগল। সে-গুড়ে বালি। বড় মেমসায়েব গোমসায়েবকে টাকা দেবেন? তার এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আসা বারণ।
বড় মেমসায়েব তো এখন মুসৌরিতে। তাই…
গোমসায়েব আপনাকে আমোক কষ্ট দিয়েছে স্যার! লোকটা আরও হাসতে লাগল।
কর্নেল দাড়ি চুলকে বললেন, ছোট মেমসায়েব তো আছেন। তাঁকে একটু ডেকে দাও তা হলে।
ছোট মেমসায়েব আর সায়েব কলকাতা গেছেন।
কখন ফিরবেন?
কিছু বলে যাননি। বিকেলে ফিরতে পারেন; রাত্তিরেও ফিরতে পারেন। লোকটা হাই তুলে বলল। তবে ছোট মেমসায়েব আরও তেজী। গোমসায়েবের নাম শুনলেই খেপে যান।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, এদিকে রাস্তাটা খারাপ। ভাল রাস্তা কোনদিকে?
লোকটা বাঁ দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই দিকে। স্টেশনে যাবেন তো? দূর হবে। তবে রিকশা পেয়ে যাবেন কলোনির মোড়ে।
সে চলে গেল। পার্লারে গিয়ে বসে আবার পালক দিয়ে কান চুলকোতে থাকল। কর্নেল বাঁ দিকে এগিয়ে একটা মোটামুটি ভাল রাস্তা দেখতে পেলেন। তারপর ঘুরে লক্ষ্য করলেন, লোকটা এবার চোখ বুজে নেই। তাকে দেখছে। দাঁত দেখা যাচ্ছে। তাঁকে বোকা ভেবে হাসছে নাকি।
একটু গাছের আড়ালে গিয়ে কর্নেল ডাইনে ঘুরলেন। তারপর গঙ্গার ধারে একটা বটগাছের তলায় গেলেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে বাড়িটা দেখতে থাকলেন।
লোকটা ঘরে ঢুকে গেল সদ্য। মিনিট দুতিন লক্ষ্য রাখলেন কর্নেল। কিন্তু তাকে বেরুতে দেখলেন না। দোতলা বাড়িটার দরজা-জানালা সব বন্ধ।
এবার গাছতলায় বসে গঙ্গার শোভা দেখতে থাকলেন। এক ঝাঁক হাঁস গঙ্গার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে বাঁকা রেখার মতো। ভরা গঙ্গায় পালতোলা নৌকো। খেয়া নৌকো। একটা লঞ্চ। চিরাচরিত দৃশ্য।
হ্যাঁ, গোমেশ নিজেও লুকিয়ে কবরের ফলক বেচতেন। ওই লোকটার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল। পেছনে একটা চক্রও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে টিনি হত্যারহস্যের সম্পর্ক কী?
ছেঁড়া চিঠিটা এবং গোমেশের হঠাৎ অন্তর্ধান…
খুব জট পাকিয়ে গেল ব্যাপারটা। টিনি সম্পর্কে যে ওই নিউজপ্রিন্টে অনবদ্য আখ্যায়িকা লিখেছে, সে-ই টিনিকে লেখা একটা চিঠি গোমশকে দিয়েছিল, টিনিকে দেবার জন্য। গোমেশ তোমাকে সব কথা বলবে লিখেছিল। কী কথা?
গোমেশকে সবার আগে খুঁজে বের করা দরকার। সে আর কোথায় যেতে পারে, সে-খোঁজ এমা সম্ভবত দিতে পারবেন। অতএব এমার সঙ্গে দেখা না করে কলকাতা ফেরা উচিত নয়।
তিনটে পনের বাজে, একটা রিকশো দেখতে পেলেন কর্নেল। রিকশোয় এক মেমসায়েব এবং এক দিশী সায়েব। রিকশোটা ইভনিং ভিলার দিকে ঘুরলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।
রিকশো থেকে দুটিতে নেমেছে, কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে বললেন, গুড আফটারনুন!
দুজনেই তাকালেন। পুরুষটির চেহারায় রুক্ষ ভাব। চোখের তলায় কালচে ছোপ। চল্লিশের মধ্যে বয়স।
কর্নেল বললেন, আশা করি মিসেস এমা এবং মিঃ ঘোষকেই আমি দেখছি!
ঘোষসায়েব কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, তার আগে এমা বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলুম না!
আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইলিয়ট রোডের আন্ডারটেকার মিঃ ডেভিড প্যাটার্সনের স্ত্রী মিসেস বারবারা আমার পরিচিত। তিনি আপনার দিদিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন। বলে কর্নেল চিঠিটা দিলেন এমাকে।
এমা চিঠিটা পড়ে বললেন, কিন্তু দিদি তো নেই।
দিদি নেই, কিন্তু তার বোন আছেন! কর্নেল একটু হেসে বললেন। আশা করি, তাঁর সহযোগিতা পাব।
এমা একটু পরে বললেন, ওকে। ভেতরে আসুন।
সেই লোকটা দৌড়ে এসে গেট খুলেছিল। দম্পতি আগে ঢুকলেন। পেছনে কর্নেল। তার চোখে চোখ পড়তেই লোকটা কর্নেলকে চোখ টিপল। এর একটাই অর্থ হয়। পাথর সম্পর্কে কোনও কথা যেন কর্নেল না তোলেন। লোকটা হাত দুটো জোড়ও করল।
হুঁ, লোকটাকে যতই গুণ্ডা দেখাক, নেহাত ভিতু ছিচকে। হয়তো বাঘের পেছনকার ফেউয়ের মতো কিছু বখরাকড়ি পায়-টায়। কর্নেল মুচকি হেসে চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করলেন।
মেমসায়েব বারান্দায় ওঠার সময় বললেন, কাল্লু! দরওয়াজা-জানলা বন্ধ কাহে? তুমকো বোলা, কভি বন্ধ নেহি রাখনা। হওয়া পাস নেহি করে গা। খুল দো জলদি!
কাল্লু কঁচুমাচু মুখে বলল, আভি খুল দেতা মেমসাব! একেলা থা। হম্! চোট্টাউট্টাকা ডর লাগতা থা। ইস্ লিয়ে…।
শাট আপ! এমা ধমক দিলেন। কভি এইসা না কিও।
কাল্লু দৌড়ে ঢুকে প্রথমে বসার ঘরের জানালা খুলে দিল। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল। এমা কর্নেলকে বসতে বললেন। ততক্ষণে পাশের ঘরে জানালা খোলার শব্দ এবং তার একটু পরে ওপরেও। একটু হেসে বললেন, পুরনো বাড়ি। এই আবহাওয়ায় স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ওঠে। অথচ কাল্লু বড় ভিতু। আমরা না থাকলেই জানালাগুলো বন্ধ করে ফেলবে। যাই হোক, গোমেশদাকে টাকা ধার দেওয়া নিয়ে এর আগে অনেক ঝামেলা দিদিকে পোয়াতে হয়েছে। বারবারাদির কথা আলাদা। কিন্তু অন্য যারা টাকা ধার দিয়েছে, সবাই কিন্তু পাথর কেনার জন্যই দিয়েছে। না, না–আমি বলছি না, আপনিও একই উদ্দেশ্যে দিয়েছেন। আপনাকে সেরকম লোক মনে হচ্ছে না।
কর্নেল দ্রুত বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, ম্যাডাম! আমি একজন নেচারিস্ট-প্রকৃতিপ্রেমিক। ওই কবরখানায় প্রচুর গাছ আর পাখি। এই দেখছেন বাইনোকুলার। পাখি দেখতে গিয়ে মিঃ গোমেশের সঙ্গে পরিচয়। তো, উনি কি এখানে এসেছেন?
…এলে কাল্লু আমাকে এখনই জানাত। কাজেই আসেনি। তা ছাড়া এ বাড়িতে ওকে দিদি ঢুকতে বারণ করেছেন। আমি তো দিদির চেয়ে আরও কড়া। ওকে বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখলে ভাগিয়ে দিই। কারণ, কবে না আমাদের চোরাপাথরের কারবারে ফাঁসিয়ে দেয়! এমা শক্তমুখে কথাগুলি বললেন।
কর্নেল বললেন, গোমেশের কবরখানার ঘরের দরজা বন্ধ। খবর নিয়েছি, উনি কোথায় চলে গেছেন। দয়া করে যদি জানান, আর কোথায় ওঁর যাওয়ার চান্স আছে?
এমা মাথা নেড়ে একটা ভঙ্গি করে বললেন, যাবে কোন চুলোয়! অবশ্য ওর সঙ্গে চোরচোট্টাদের ভাব আছে। কলকাতায় কোথাও থাকতে পারে। আপনি বরং পুলিশে খবর দিন। ওর এবার শাস্তি হওয়া দরকার!
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনাদের বাড়িটা একবারে প্রকৃতির রাজ্য। বড় সুন্দর পরিবেশ।
এমা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আর পরিবেশ! সব জঙ্গল হয়ে গেল। কী ছিল এই বাড়ি ব্রিটিশ স্বর্ণযুগে! এখন নরকের মাঝখানে আছি। চারদিকে চোর ডাকাত। আইন-শৃঙ্খলা নেই। ভাবছি, শিগগির বাড়ি বেচে দিয়ে আমরা বাইরে চলে যাব।
বলে কর্নেলকে এতক্ষণে ভাল করে লক্ষ্য করে হাসলেন। ইউ লুক আ ফরেনার! জাস্ট লাইক আ ক্যাথলিক ফাদার! হাউ ফানি! ইউ আর আ কর্নেল! ডিড ইউ সার্ভ আন্ডার দা গোল্ডেন ব্রিটিশ এম্পায়ার?
কর্নেল হাসলেন মাত্র। প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললেন, তা হলে গোমেশকে কোথায় পাব, আপনি বলতে পারছেন না?
এমা মাথা নাড়লেন। হি ইজ ইন দা হেল! প্লিজ ডোন্ট টক অ্যাবাউট হিম।
তাহলে উঠি ম্যাডাম!
জাস্ট আ মিনিট কর্নেল সরকার। আই অ্যাম সরি! বলে এমা উঠে দাঁড়ালেন। এ বাড়ির একটা বনেদি কালচার আছে। অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যান। অথবা একটা কোল্ড ড্রিংক!
ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ! কর্নেল উঠে বললেন, চলি!
এই সময় ঘোষসায়েব জীর্ণ পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে বললেন, এমা, হনি! দ্যাটস্ এনাফ। লেট হিম গো!
ড্যানি! ডোন্ট টক ননসেন্স! হি ইজ আ জেন্টলম্যান আ রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার।
সো হোয়াট?
ড্যানি ঘোষ যে ঘরে ঢুকেই মদ গিলেছেন, বোঝা যাচ্ছিল। জড়ানো গলায় কথা বলেছিলেন। পর্দা ঠেলে ঢুকে কর্নেলের দিকে চোখ কটমটিয়ে বাংলায় বললেন, দেখুন মশাই! শিকারী বেড়ালের গোঁফ দেখলেই চেনা যায়। আমি মাল চিনি। আপনি নির্ঘাত পুলিশের লোক! তবে এখানে সুবিধে হবে না। কেটে পড়ুন!
এমা তাকে ধাক্কা দিতে দিতে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কর্নেল বারান্দায় পৌঁছেছেন, তখন তিনি ফিরে এলেন! প্লিজ, প্লিজ কর্নেল সরকার! ড্যানি একটুতেই মাতাল হয়। আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না। আই অ্যাম সো সরি ফর মাই হাজব্যান্ড!
কর্নেল অমায়িক হেসে ভব্য-জনোচিত বাও করে চলে এলেন।
হঠাৎ ড্যানি ঘোষের ওসব কথা বলার কারণ কী? কর্নেল গঙ্গার ধারে সেই যে বটতলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। নিঝুম নিরিবিলি প্রকৃতিতে পাখিদের দিনশেষের হল্লা অর্কেস্ট্রার মতো। আলোর রঙ বদলে গোলাপি হয়েছে। বাইনোকুলারে চোখ রেখে বাড়িটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। …
নিচের একটা ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে ড্যানি ঘোষের মুখ উঁকি দিল। রুষ্ট দৃষ্টিতে তিনি সম্ভবত কর্নেলকে খুঁজছেন। প্রত্যেকটি রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাইনোকুলারে।
তারপর এমার মুখ দেখা দেল। তাকে কিছু বোঝাতে চাইছেন। ড্যানি ঘোষ ফুঁসছেন রাগে।
কিন্তু তারপর বাইনোকুলার ঘোরাতেই দক্ষিণ-পূর্বে পাঁচিলের কোনায় ঝোঁপের কাছে কালুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। কাকে ওদিকে হাতের ইশারা করছে।
কর্নেল আগের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু সেদিকে আর কাউকে দেখতে পেলেন না। কাল্লু তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে বাঁদিকে ঘুরে কর্নেলকে দেখতে পেল। অমনি পাঁচিলের একটা ভাঙা অংশ ডিঙিয়ে বাইরে এল। কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন।
জনহীন, ঝোপঝাড় গাছপালা আর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে জল-কাদা খানাখন্দে ভরা একটা রাস্তা কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে চলতে শুরু করলেন। কাল্লুকে আর দেখা যাচ্ছিল না। কাল্লু কি তাকে কোনও কথা বলতেই অমন করে এগিয়ে আসছিল তাঁর দিকে?
একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় থকথকে কাদা। কাদা এড়িয়ে গাছের গুঁড়ির গা ঘেঁষে কর্নেল ওধারে যেতেই কাল্লুকে দেখতে পেলেন, একেবারে মুখোমুখি। তার হাতে একটা চকচকে ছুরি। মুহূর্তে কাম্পু ছুরির ডগা কর্নেলের গলায় ঠেকিয়ে হিসহিস শব্দে বলল, শালা বুড়ো খোচড়! বল, কেন এসেছিলি? আ বে শালা! তোর বাপরা ঘোষসায়েবের পোষা বেড়াল জানিস? দেব শালাকে গঙ্গায় মড়া ভাসিয়ে। বল্!
কর্নেল একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই ইনটুইশন কোথায় গেল? এ যে একেবারে অতর্কিত এবং অপ্রত্যাশিত। কাল্লুকে কী ভেবেছিলেন?
হুঁ, জীবনে এরকম দুএকটি ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত নেই, এমন নয়। ভাগ্যিস ফলাটা সঙ্গে সঙ্গে গলায় ঢুকিয়ে দেয়নি। গঙ্গায় টেনে নিয়ে ফেলে দিলে ভেসে যেতেন মড়া হয়ে। খুনটা কোথায় হয়েছে পুলিশ টেরই পেত না। ডেভিডের কাছে যাওয়ার কথা কাউকে বলে আসেননি। অরিজিৎ লাহিড়ীর পক্ষে খেই পাওয়া অসম্ভব হতো।
বিচলিত ভাবটা তখনই কাটিয়ে উঠলেন কর্নেল। বললেন (ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে), ভাই কাল্লু! আমাকে প্রাণে মেরো না। সব খুলে বলছি। বরং একশোটা টাকাও…।
কাল্লু ঝটপট বলল ছুরির ডগায় একটু চাপ দিয়ে, তবে আগে ঝাড় বে! মানিব্যাগ বের কর! জলদি!
কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেটে মানিব্যাগ বের করার ছলে হাত ঢোকালেন এবং বেরিয়ে এল তার রিভলবার। মুহূর্তে তার নল কাক্কুর গলায় ঠেকিয়ে সহাস্যে বললেন, মরলে দুজনেই মরি তবে!
কাল্লু ভ্যাবাচাকা খেয়েছিল। সেই সুযোগে কর্নেল হাঁটু তুলে তার পেটে গুঁতো মারলেন। কাল্লু অঁক্ শব্দে পড়ে গেল। কর্নেল একটা গামবুট তার ছুরিধরা হাতে চাপিয়ে অপরটা তার বুকে রাখলেন। কাল্লু হাঁসফাঁস করে বলল, অ্যাই বাপ! মরে যাব! আর কক্ষণও এমন করব না…মাইরি স্যার! ওই শালা ঘোষসায়েবের কথায়…মা কালীর দিব্যি…শালা ঘোসায়েব…বাবা রে!
কর্নেল ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকালেন। তারপর তার গেঞ্জির কলার ধরে ওঠালেন। তাকে টেনে গাছের গুঁড়ির আড়ালে এনে গুঁড়িতে ঠেসে ধরে বললেন, পাথর কোথায় পাওয়া যায়?
ঘোষসায়েব জানে স্যার! মাইরি মা কালীর দিব্যি!
রিভলবারের নল গলায় আরও চেপে কর্নেল বললেন, তখন বললি তুই ঠিকানা জানিস! ব! নইলে তোকে মড়া করে গঙ্গায় ভাসাব!
করুণ হাসল কাল্লু। মাইরি পাথর কিনবেন স্যার? তা হলে শালা ঘোষসাহেব বলল যে আপনি পুলিশের টিকটিকি!
বল! চার গুনতে গুনতে না বললেই মড়া। এক…দুই…তিন…
কলকাতায় স্যার, কলকাতায়।
ঠিকানা বল্!
ঘোষসায়েবের মামার কাছে স্যার! ফিরি ইস্কুল স্টিট স্যার! রায় কোম্পানিতে স্যার? কাল্লু ভাঙা গলায় বলল। তবে এই শালা ঘোষসায়েবের চিঠি ছাড়া দেবে না।
গোমেশ কোথায়?
কথাটা বলেই কর্নেল কাল্লুর নাভির ওপরটা খামচে ধরলেন। যন্ত্রণায় গোঙিয়ে উঠে কালু বলে ফেলল, এসেছিল। ছোট মেমসায়েবের ভয়ে লুকিয়ে, ছিল কোনার ঘরে। আপনি আসার পরই পালিয়ে গেল। স্যার, এবার গোমসায়েব খুব দামী পাথর বেচেছে কোম্পানিকে। ফিরি ইস্কুল স্টিটে গেলেই পেয়ে যাকেন।
কর্নেল তাকে ছেড়ে দিতেই সে দিশেহারা হয়ে গা ঢাকা দিল। দেখার মতো দৃশ্য।
কিন্তু হাসতে গিয়ে হাসতে পারলেন না কর্নেল। আবছায়া ঘনিয়ে এসেছে। বড় বিপজ্জনক জায়গায় এসে পড়েছেন। হনহন করে হাঁটতে থাকলেন।
বসতি এলাকায় পৌঁছে একটা সাইকেল রিকশো পেয়ে গেলেন। বললেন, স্টেশন!
স্টেশনে পৌঁছুতে প্রায় আধঘণ্টা লাগল। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখলেন, হাওড়াগামী ট্রেন সবে হুই দিচ্ছে। সামনের কামরায় উঠে পড়লেন। বড্ড ভিড়। এবার চুরুট টানতে পারলে মাথার ঘিলু চাঙ্গা হতো। কিন্তু এই ভিড়ে সেটা সম্ভব নয়।
ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছুনোর পর কর্নেল নেমে চুরুট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে সেই ধোঁয়ার ভেতর আচমকা আবিষ্কার করলেন, ভিড়ে গোমেশ চলেছেন।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে ডাকলেন, হ্যাল্লো ব্রাদার গোমেশ!
গোমেশ ঘুরে তাঁকে দেখামাত্র প্রায় দৌড়ে ভিড় ঠেলে নিপাত্তা হলে গেলেন। এতক্ষণে কর্নেল হাসতে পারলেন।…
.
ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে খুঁটিয়ে কর্নেলকে দেখছিল। কর্নেল বললেন, কী রে? ষষ্ঠী একটু হেসে বলল, বাবামশাইকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।
কেমন?
কেমন যেন…ঝড়জল খাওয়া কেমন শুটকো…ষষ্ঠী জুতসই উপমা খুঁজে পাচ্ছিল না।
কর্নেল চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন, খুব হয়েছে! অরিজিৎ কটায় আসবে বলেছে বললি যেন?
ষষ্ঠী যেতে যেতে বলে গেল, ঠিক ধরেছি। কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। বললুম নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব ফোং করবে বলেছেন, আর বলেন, কী, কটায় আসবে?
হুঁ। কটায় ফোন করবে?
রাত্তির নটা বাজুক! ঘড়ির কাটা জায়গামতো যাক্। বলে ষষ্ঠী পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
সত্যিই বড় ধকল গেছে দিনটায়। তার ওপর নিজের সেই ষষ্ঠেন্দ্রিয়জাত বোধের ব্যর্থতা! ভাবতে বুক ধড়াস করে ওঠে, কালু যদি সত্যি তাকে মড়া করে গঙ্গায় ফেলে দিত? রহস্যটার অন্য একটা দিক এটা, নাকি ওটা আলাদা একটা ব্যাপার–টিনির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যোগসূত্রহীন?
যোগসূত্র শুধু গোমেশের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছেঁড়া চিঠিটা। তার মানে, রহস্য যদি দুটি পৃথক ঘটনাকেন্দ্রিক হয়, তাহলেও গোমেশ একটা যোগসূত্র হয়েই থাকছেন। গোমেশের অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? এইসব কথা ভাবতে ভাবতে রাত নটা দুমিনিটে ফোন এল অরিজিৎ লাহিড়ীর। হাই ওল্ড বস! সারাদিন কোথাও কি পাখি-প্রজাপতি-অর্কিডের খোঁজে নিপাত্তা হয়েছিলেন? নাকি।…
ডার্লিং। নাকি অংশটাই ঠিক। এনিওয়ে, কোনও খবর আছে বুঝতে পারছি। বলো!
চার্লস গ্রিয়ার্সনের নাম চেনা মনে হচ্ছে?
ইয়া। যদি তিনি হন এইটিন্থ সেঞ্চুরির ব্রিটিশ অ্যাডভেঞ্চারার!
কারেক্ট। ইস্টার্ন প্রোটেস্ট্যান্ট সিমেট্রিতে তার কবর আছে।
তার কবরের ফলক চুরি গেছে কি?
ইউ আর ড্যাম রাইট, বস! তবে সাধারণ মার্বেল নয়। উনি নিজের কবরের ফলকের জন্য দুর্মূল্য পাথর এনেছিলেন পার্সিয়া থেকে। কালো একরকম দুর্লভ পাথর। সরি! দেখতে পাথর, কিন্তু আসলে রত্ন। ছ ইঞ্চি বাই ন ইঞ্চি মাপ। দাম আজকাল কম করেও লাখ টাকা।
কী করে চুরি যাওয়ার খবর পেলে?
দুপুরে আবার গোমেশের ঘর এবং গির্জায় পুলিশ গিয়েছিল তদন্তে। সঙ্গে চার্চের যাজক এবং কমিটির মেম্বাররা ছিলেন। যে-কবরে টিনি খুন হয়েছে, তার কয়েক হাত তফাতে চার্লস গ্রিয়ার্সনের কবর। যাজক ফাদার হুবার্টই আবিষ্কার করলেন, ফলকটা নেই। পরে এক্সপার্ট টিম গিয়ে তদন্ত করলেন। ফলকটা ওপড়ানো হয়েছে, এটাই আশ্চর্য, টিনির মৃত্যুর পরের রাতে। ডঃ মহাপাত্রকে আপনি তো জানেন–ইওর বুজম ফ্রেন্ড! উপড়ে ফেলা ঘাসগুলোর অবস্থা পরীক্ষা করে ওঁর এই সিদ্ধান্ত। টিনি খুন হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পরে ঘটনাটি ঘটেছে।
অরিজিৎ! কুইক! এখনই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে রয় অ্যান্ড কোমর নিলামঘর, অফিস, গোডাউন সার্চ করো!
হো-য়া-ট?
রয় অ্যান্ড কোম্পানি। ইউ নো দেম।
মাই গুডনেস! কিন্তু…
কোনও কিন্তু নয়। মেক্ হেস্ট!
একটু পরে অরিজিতের গলা শোনা গেল ফের, ওল্ড বস! আর য়ু দেয়ার?
বলো!
তা হলে আপনি কোনও সূত্রের সন্ধানে আজ সারাটা দিন…
নো মোর টক। ডু দ্যাট অ্যাট ওয়ান্স। অবশ্য জানি না, ওরা কতটা বোকা বা বুদ্ধিমান। তবু দেখা যাক।
ওক্কে। গুড নাইট!
ফোন বন্ধ হলো। কর্নেল ফোন রেখে রিসিভারে হাত চেপে রাখলেন কিছুক্ষণ। তারপর ফের ফোন তুলে ডায়াল করলেন দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায়। সাড়া এলে বললেন, প্লিজ পুট মি টু দা চিফ অব দা নিউজ ব্যুরো প্লিজ!
মহিলা অপারেটর বললেন, প্লিজ, হোল্ড অন!
একটু পরে চিফ অফ দা নিউজ ব্যুরো তারক গাঙ্গুলির সাড়া এল, হ্যাঁ! গাঙ্গুলি।
আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, মিঃ গাঙ্গুলি!
হ্যাল্লো সান্তা ক্লজ! ক্রিসমাসের তো ঢের দেরি! হাঃ হাঃ হাঃ।
জয়ন্তকে কি পাঞ্জাবের সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে লড়তে পাঠিয়েছেন?
আপনার শাগরেদ রোজ একখানা করে সাসপেন্স থিলার টেলেক্সে পাঠাচ্ছে।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলি, আপনাদের সাংবাদিকরা তো নিউজপ্রিন্টে ডটপেনে লেখেন?
আরে, আরে! কী সর্বনাশ! হঠাৎ এসব…
প্যাডের সাইজটা কাইন্ডলি বলবেন?
কী কাণ্ড!…এক মিনিট।… হুঁ, বারো বাই আট জেনারেলি, কখনও চৌদ্দ বাই দশ।
থ্যাংকস! কর্নেল লাইন অফ করে ফোন নামিয়ে রাখলেন। তারক গাঙ্গুলি আকাশ-পাতাল হাতড়াচ্ছেন। তাকে ফোন করবেন ভেবেই কর্নেল টেবিলে ফোনটা কাত করে রাখলেন। কাগজের লোকেরাও আজকাল রহস্যের গন্ধ পেলেই হইহই বাধিয়ে ছাড়ে। খবরের কাগজে অন্ততদন্ত অধুনা হিড়িক ফেলে দিয়েছে। পাবলিক খুব খাচ্ছে।