Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও আশ্চর্য দ্বীপ || Sunil Gangopadhyay » Page 7

কাকাবাবু ও আশ্চর্য দ্বীপ || Sunil Gangopadhyay

পদ্মনাভন ফিরে গেলেন তাঁর অফিসে। সন্তু আর কাকাবাবু হোটেলে এসে ঘরে

গিয়ে নীচের লবিতেই বসে রইলেন।

ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে। অনেক লোক যাচ্ছে, আসছে। বারোটায় অনেকে হোটেল ছেড়ে চলে যায়। এই হোটেলের এক তলায় একটা রেস্তরাঁ আছে, অনেক বাইরের লোকও খেতে আসে সেখানে।

হঠাৎ সন্তু এক সময় বলে উঠল, রাধা!

কাকাবাবু বললেন, রাধা? কোন রাধা? কোথায়?

সন্তু বলল, বাঃ, তোমার মনে নেই, অন্ধ্রের মেয়ে, এক সময় কলকাতায় থাকত। বাংলা জানে, আগেরবার দেখা হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, রাধা, মানে সেই রাধা, রাধা গোমেজ। পিটার গোমেজের মেয়ে? সে কোথায়?

সন্তু বলল, এইমাত্র এসে কাউন্টারে দাঁড়াল। দ্যাখো।

কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে শাড়িপরা একটি ছিপছিপে চেহারার মেয়ে। মাথায় ফুল গোঁজা, চোখে কালো রোদচশমা।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এই সেই রাধা? এত বড় হয়ে গেছে? দু-তিন বছর আগে যাকে দেখেছি। সে তো ছিল একটা বাচ্চা মেয়ে?

সন্তু বলল, যারা ছোট থাকে, তারা কি বড় হয় না, আমিও তো বড় হয়েছি। ও বোধহয় আমাদের দেখতে পায়নি।

উঠে গিয়ে কাউন্টারের কাছে গিয়ে ইংরিজিতে বলল, যদি ভুল হয়, মাপ করবেন, আপনি কি রাধা গোমেজ?

মেয়েটি সন্তুর দিকে মুখ না ফিরিয়ে কাঁপা গলায় বলল, সন্তুদাদা, আমি তোমাদের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। কিন্তু এখানে কথা বলা যাবে না। তোমরা নিজেদের ঘরে চলে যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি।

সন্তু কাউন্টার থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে ইঙ্গিত করল কাকাবাবুর দিকে। তারপর লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

রাধা এসে পৌঁছল ঠিক পাঁচ মিনিট পরে।

নিজেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে রাধা বলল, আমি ওদের চোখে ধুলো দিয়ে অনেক ঘোরাপথে এসেছি। তবু বলা যায় না। যদি টের পায় যে আমি তোমাদের কাছে এসেছি, তা হলে আমার মা আমাকে মেরে ফেলবে।

কাকাবাবু বললেন, আগে বোসো। জল খাও। সন্তু জল দে। কেন রাধা, তোমার মা তোমাকে মেরে ফেলবে কেন? মা কি কখনও মেয়েকে মেরে ফেলে?

রাধা বলল, কাকাবাবু, তোমার মনে নেই আমার মায়ের কথা? আমার নিজের মা নয়। নতুন মা, সবাই যাকে মঞ্চাম্মা বলে। তোমাকেও তো সে মেরে ফেলতে গিয়েছিল সেবার।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। খুব দুর্দান্ত মহিলা। পুলিশ অবশ্য ওর বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। তোমার বাবা তো জেল খাটছে, নাকি জেল থেকে পালিয়েছে।

রাধা বলল, না, না, পালায়নি। দশ বছরের জেল। ভাল হয়েছে জেল খাটছে। আমার বাবা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। স্মাগলিং-এর দল তৈরি করেছিল, মানুষ মারত। আমি শুধু আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম, যাতে ফাঁসি না হয়।

কাকাবাবু বললেন, পিটার গোমেজ মানুষটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তোমার মতন এমন একটা সুন্দর মেয়ের বাবা হয়ে…তোমার মা নিশ্চয়ই খুব ভাল ছিলেন।

রাধা বলল, আমার মা ছিলেন, আপনারা বাংলায় যেমন বলেন, লক্ষ্মী।

সন্তু বলল, তোমার বাবা জেলে, তুমি কোথায় থাকো?

রাধা বলল, আমার তো সতেরো বছর বয়েস, তাই আমি একলা থাকতে পারি। আমার এক মামা আমার গার্জেন, তাঁর কাছেই থাকি। আমার মামা খুব নামকরা লোক, এক সময় হাইকোর্টের জজ ছিলেন।

কাকাবাবু খানিকটা অস্থিরভাবে বললেন, রাধা, তোমার বাকি সব কথা পরে শুনব। এখন বলো তো, তুমি আমাদের কী খবর দিতে এসেছ?

রাধা বলল, জোজোদা কোথায়? সে কি এবারে আপনাদের সঙ্গে আসেনি?

সন্তু বলল, জোজোকে একদল গুন্ডা ধরে নিয়ে গেছে। আর দুদিনের মধ্যে তাকে খুঁজে বার করতেই হবে!

রাধা বলল, আমি তাকে দেখেছি। প্রথমে আমিও তাকে চিনতে পারিনি। বড় বড় চুল রেখেছে, অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। তারপর মুখটা দেখে মনে হল–

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করল, তুমি জোজোকে কোথায় দেখলে?

রাধা বলল, আমাদের বাড়িতে।

কাকাবাবু আর সন্তু একসঙ্গে বলে উঠল, তোমাদের বাড়িতে?

রাধা বলল, হ্যাঁ। আমি তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করেছি। পারিনি। আমার বাবা তো জেলে, আমার মা কিন্তু এখনও বদমাশ লোকদের সঙ্গে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়িটাকে করে ফেলেছে ডাকাতদের আড্ডা। ওই বাড়িটাতে তো আমারও ভাগ আছে, আমার এই মা আমাকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিল। আমার মামা চেপে ধরেছেন। আমার মামাকে অনেকেই ভয় পায়। মামাই বলেছেন, মাঝে-মাঝে আমরা ওই বাড়ি দেখতে যাব। কয়েকখানা ঘরে তালা দিয়ে রাখব, টাকা-পয়সার হিসেব নেব। কালকে গিয়ে দেখি–

কাকাবাবু চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, কী দেখলে? জোজোকে ওরা মেরেছে? রাধা বলল, তা বুঝতে পারিনি। তবে মুখ বাঁধা ছিল!

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে। একদম সময় নষ্ট করা যাবে না।

তিনি সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর মাথায় সেলাই করা হয়েছে। তোর যাওয়ার দরকার নেই। তোকে বিশ্রাম নিতে হবে।

সন্তু বলল, আমার একটুও ব্যথা নেই। আমি জোজোর কাছে যাব।

কাকাবাবু কোট পরে নিতে নিতে রাধাকে জিজ্ঞেস করলেন, জোজোকে পাহারা দিচ্ছে কজন? শুধু ওই মঞ্চাম্মা?

রাধা বলল, আমাদের কয়েকজন পুরনো কাজের লোক আছে। তারা মঞ্চাম্মার ভয়ে চুপ করে থাকে। মঞ্চাম্মার বন্ধু হয়েছে রকেট নামে একটা লোক, সে ডিমেলোর দলের একজন পাণ্ডা। ওরা প্রায়ই আসে। চার-পাঁচজন।

কাকাবাবু কোটের ভেতরের পকেটে রিভলভারটা একবার দেখে নিয়ে সন্তুকে বললেন, কী রে, ওরা যদি চার-পাঁচজন হয়, তা হলে তুই আর আমি সামলাতে পারব?

সন্তু রাধার দিকে ফিরে বলল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? তুমি নিজের থেকে আমাদের কাছে এসেছ, না কেউ তোমাকে পাঠিয়েছে?

রাধা খুব অবাক হয়ে বলল, আমাকে কে পাঠাবে? আমি যে তোমাদের কাছে এসেছি, তাই তো কেউ জানে না।

সন্তু বলল, বলা তো যায় না। কেউ হয়তো তোমার মামাকে আটকে রেখেছে। তারপর তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে, আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে ফাঁদে ফেলতে চায়।

রাধা হঠাৎ দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, যাঃ, তুই কী বলছিস সন্তু! রাধা খুব সরল আর ভাল মেয়ে। ও কখনও এমন কাজ করতে পারে?

তিনি উঠে এসে রাধার পিঠে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, তুমি কিছু মনে কোরো না! আসলে ব্যাপার কী জানো, জোজোকে হারিয়ে আমার মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু তোমাকে আমরা মোটেই অবিশ্বাস করি না। কেঁদো না লক্ষ্মীটি!

রাধা তার ব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, কাকাবাবু, জোজোর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে আপনারা আমাকে মেরে ফেলবেন। মঞ্চাম্মা এমনিতেই আর আমাকে বাঁচতে দেবে না।

কাকাবাবু বললেন, তোমার মঞ্চাম্মা যদি জোজোকে আটকে রাখার জন্য দায়ী হয়। তবে তাতেও এবার জেল খাটতে হবে। চলো, চলো, তোমাদের সেই বাড়িটা কোথায়?

রাধা বলল, ঋষিকোণ্ডার কাছেই। পর্তুগিজদের একটা পুরনো বাড়ি, বাবা সারিয়ে নিয়েছিল। অনেক ঘর।

কাকাবাবু বললেন, চলো, বেরিয়ে পড়ি। পদ্মনাভনকে বোধহয় একবার জানিয়ে রাখা দরকার।

তিনি পুলিশ কমিশনারকে ফোন করলেন।

তিনি খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে বললেন, পিটার গোমেজের বাড়ি? সে জেলে আছে বলে ওবাড়ি আমরা সার্চ করার কথা চিন্তা করিনি। রাজাবাবু, আপনি কিছুতেই সেখানে একলা যাবেন না। শহরের বাইরে আমার এলাকা নয়। না হলে আমি নিজেই আপনার সঙ্গে যেতাম। আমি ডি জি সাহেবকে জানাচ্ছি। বাছাই করা একগাড়ি পুলিশ আপনার সঙ্গে যাবে। আপনি আধঘণ্টা অপেক্ষা করুন প্লিজ।

আধঘণ্টাও লাগল না, পঁচিশ মিনিটের মধ্যে এসে গেল পুলিশ। একটা বড় স্টেশন ওয়াগান এনেছে, দেখতে পুলিশের গাড়ি বলে মনে হয় না।

সবাই একসঙ্গে উঠে বসল সেই গাড়িতে।

আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা, রোদ ওঠেইনি। শহর ছাড়িয়ে খানিকটা বাদেই চলতে লাগল সমুদ্রের ধার দিয়ে। দুদিকের দৃশ্য ভারী সুন্দর, কিন্তু তা দেখার মন নেই, কাকাবাবু ও সন্তু দুজনেই বসে আছে চুপ করে।

এক সময় গাড়িটা ঢুকে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গল মানে শুধুই নারকোল গাছ। তার মধ্যেও রাস্তা আছে। একটা জায়গায় জেলেদের গ্রাম, সেখানে শুটকি মাছের তীব্র গন্ধ।

গাড়িটা এসে থামল একটি বাড়ির সামনে।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন খাকি পোশাক পরা পাহারাদার। তার কোমরে রিভলভার।

রাধা ফিসফিস করে কাকাবাবুকে বলল, এইরকম পাহারাদার কিন্তু আগে ছিল না।

পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেলিম নামে একজন অফিসার। তিনি গাড়ি থেকে নেমেই পাহারাদারটির কাছে গিয়ে নিজের ব্যাজ দেখিয়ে বললেন, পুলিশ, আমরা এই বাড়ি সার্চ করব।

লোকটির কোমর থেকে রিভলভারটি তুলে নিয়ে সেলিম বললেন, এটা আপাতত আমায় কাছে রইল, পরে ফেরত দেব।

গাড়ি থেকে আরও পুলিশদের নামতে দেখে লোকটি বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টা করল না।

বাড়ির থেকে টুং টাং পিয়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। কেউ তার সঙ্গে গান গাইছে খুব চাপা গলায়।

দরজা খুলে দিল একজন বৃদ্ধ কাজের লোক।

রাধা তাকে নিজেদের ভাষায় কিছু বলল, লোকটি উত্তর দিল না।

বারান্দার পাশে বসবার ঘরের দরজাটা খোলা। পিয়ানোর আওয়াজ আসছে। সেখানে থেকেই।

কাকাবাবুরা ঘরে ঢুকে দেখলেন, এক কোণে পিয়ানোর সামনে বসে আছেন এক মাঝবয়েসি মহিলা। তার পরনে লাল-পাড় সাদা শাড়ি। চুল খোলা পিঠের ওপরে। হাতে কিংবা কানে কোনও গয়না নেই।

কাকাবাবু চিনতে পারলেন, এই সেই ডাকাত দলের নেত্রী মঞ্চাম্মা। অতি নিষ্ঠুর, একবার কাকাবাবুকে গুলি করে খুন করতে চেয়েছিল ঠান্ডা মাথায়। এখন দেখে মনে হচ্ছে যেন খুবই ভক্তিমতী মহিলা। জীবনে কখনও বন্দুক-পিস্তল দেখেইনি।

এই দলটিকে দেখে বাজনা থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কে?

সেলিম বললেন, আমরা পুলিশ থেকে আসছি।

মঞ্চাম্মা বলল, আবার পুলিশ? আমার কাছে? আপনারা অন্যায়ভাবে আমার স্বামীকে জেলে দশ বছরের শাস্তি দিয়েছেন। এখন আমি একা একা থাকি, আপনমনে গান বাজনা করি, তাও আবার আপনারা আমাকে জ্বালাতে এসেছেন?

সেলিম বললেন, আমাদের কাছে খবর আছে, জোজো নামে একটি ছেলেকে আটকে রাখা হয়েছে।

মঞ্চাম্মা বলল, এখানে আমি কাউকে আটকে রাখব কেন? আমার নিজেরই এখন রান্নার লোক নেই। কে আপনাদের এই আজগুবি খবর দিয়েছে।

রাধা এক পা এগিয়ে জোর দিয়ে বলল আমি! আজ ভোরবেলাই আমি ছেলেটিকে দেখে গেছি!

মঞ্চাম্মা কাকাবাবুর দিকে তাকালই না। সেলিমকে বলল, আপনারা এর কথায় বিশ্বাস করে এতদূর ছুটে এসেছেন? জানেন না, এর মাথা খারাপ? এই মেয়েই তো ওর বাবাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।

সেলিম তাকাল কাকাবাবুর দিকে।

কাকাবাবু বললেন, বাজে কথা। ও মোটেই ওর বাবাকে ধরিয়ে দেয়নি, সে ধরা পড়েছে নিজের দোষে। রাধার জন্যই ওর বাবা ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচে গেছে। এই মহিলাটিরই আসলে মাথা খারাপ। নইলে, একবারে শিক্ষা হয়নি। আমার ডিমেলোর দলে যোগ দিয়ে এইসব কাজ করছে।

মঞ্চাম্মা বলল ডিমেলো আবার কে? কখনও তার নামই শুনিনি।

কাকাবাবু বললেন, আমরা এই বাড়িটা সার্চ করব।

মঞ্চাম্মা বলল, আপনাদের কী অধিকার আছে? সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন?

কাকাবাবু রেগে গিয়ে বললেন, সার্চ ওয়ারেন্টের নিকুচি করেছে। সেলিমসাহেব, আর দেরি করে লাভ কী?

একতলায় যে-ঘরে জোজো ছিল, সেখানে কেউ নেই। দোতলার সব কটি ঘর ফাঁকা।

রাধা বলল, এ বাড়িতে একটা সুড়ঙ্গ আছে, আমি জানি। সেখানেই নিশ্চয়ই লুকিয়ে রেখেছে।

মঞ্চাম্মা হা-হা করে হেসে উঠল।

সুড়ঙ্গের মধ্যে একটি মাত্র ঘর। শেষে কঠিন পাথরের দেওয়াল। সেই ঘরটিতেও জোজোর কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না।

সেলিমসাহেব বললেন, পাখি উড়ে গেছে। কিংবা, এই মেয়েটি যে খবর দিয়েছে তা কি পাকা খবর?

রাধা বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি।

সন্তু বলল, এই ঘরে কিছুক্ষণ আগেও কেউ ছিল, তার প্রমাণ আছে।

সেলিম জিজ্ঞেস করলেন, কী প্রমাণ? ঘরের এককোণ থেকে একটা বাটি তুলে এনে সন্তু বলল, এতে একটু একটু তরকারির ঝোল লেগে আছে। হাত দিয়ে দেখুন, টাটকা।

সেলিম বলল, বাপ রে! তুমি দেখছি শার্লক হোমসের মতন! সত্যিই তো, গতকালের হলে শুকিয়ে যেত!

কাকাবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,এবার কী করা হবে?

কাকাবাবু বললেন, এখানে দেরি করে আর লাভ নেই। জোজোকে ওরা আজই সরিয়ে নিয়ে গেছে, হয়তো খুব দূরে যেতে পারেনি।

সেলিমের পকেটের সেল ফোনে সারে জাঁহা সে আচ্ছা, গানের সুর বেজে উঠল।

সেলিম সেটা কানের কাছে নিয়ে ভাল শুনতে না পেয়ে অ্যা অ্যাঁ অ্যাঁ কী বলতে বলতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন সুড়ঙ্গ থেকে।

কাকাবাবুও বেরিয়ে এলেন সন্তুকে নিয়ে। তাঁর মুখোনা বিরক্তিতে ভরা। এত দূরে এসেও, জোজোকে পাওয়া গেল না! আর একটু আগে যদি আসা যেত।

জোজোকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা এই মঞ্চাম্মা খুব সম্ভবত জানে। কিন্তু এ অতি কঠিন মহিলা, এর পেট থেকে কথা বার করা শক্ত।

সেলিম ফোন বন্ধ করে বললেন, পুলিশ কমিশনার জানতে চাইছিলেন, এখানে ছেলেটিকে পাওয়া গেল কি না।

কাকাবাবু মুখোনা গোমড়া করে রইলেন।

সেলিম আবার বললেন, এখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি জেনে উনি বললেন, এখুনি ফিরে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। উনি একজন বোটচালকের সন্ধান পেয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে চলুন, চলুন।

নিজেই আগে আগে ক্রাচ নিয়ে খানিকটা এগিয়ে আবার থেমে গিয়ে বললেন, আমার কারুকে অ্যারেস্ট করার অধিকার নেই। কিন্তু সেলিমসাহেব, আপনি কি এই মহিলাকে থানায় নিয়ে যেতে পারেন? ওকে অন্তত একদিন আটকে রাখা দরকার। জোজোর নিরাপত্তার জন্য এই মহিলাটিকেও আটক রাখা দরকার।

সেলিম বলল, হ্যাঁ পারব না কেন?

মঞ্চাম্মার দিকে সে ফিরে বললেন, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আপনি যদি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে চান, খুব তাড়াতাড়ি–

মঞ্চাম্মা মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, আমি যাব না!

সেলিম বললেন, আপনাকে যেতেই হবে।

মঞ্চাম্মার বলল, অত সহজ? অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট কোথায়? আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগের প্রমাণ নেই।

সেলিম বললেন,প্রমাণ আছে কি নেই, সে আমরা বুঝব। কারুর ওপর সন্দেহ হলেও তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করা যেতে পারে।

মঞ্চাম্মা বলল, আমি যাব না, ব্যস! জোর করে ধরে নিয়ে যাবেন? মেয়ে-পুলিশ কোথায়? পুরুষ-পুলিশ আমার গায়ে হাত দিলে আমি কেস করে দেব!

সেলিম একটু অসহায়ভাবে তাকালেন কাকাবাবুর দিকে। বললেন, মহিলাদের গায়ে হাত দেবার নিয়ম নেই আমাদের। এই রাধা কি পারবে; রাধা যদি জোর করে ওকে টেনে নিয়ে একবার গাড়িতে তুলতে পারে—

জোজোকে পাওয়া যায়নি বলে রাধা একেবারে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। মুখ নিচু করে আছে।

কাকাবাবু বললেন, না থাক। মেয়েকে দিয়ে তার মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া মোটেই উচিত নয়। নিজের মা না হোক, তবু তো সম্পর্কে মা!

সেলিম বললেন, দুজন পুলিশকে এখানে বাইরে পাহারায় রেখে যাচ্ছি, পরে মেয়ে-পুলিশ পাঠব।

আবার গাড়িতে ওঠার পর সেলিম বললেন, এ মহিলার সাংঘাতিক মনের জোর, পুলিশ দেখে একটুও ঘাবড়ায়নি। রাধা, তুমি এর সঙ্গে থাকো কী করে?

রাধা বলল, আমি এখানে থাকি না। মামার বাড়িতে থাকি।

কাকাবাবু বললেন, এই মঞ্চাম্মার কিছুতেই শিক্ষা হয় না। আগেরবারই ওকে জেলে পাঠানো যেত, আমাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি কোনও অভিযোগ করিনি। এখন ভালভাবে বাঁচতে পারত, তা নয়, আবার খারাপ লোকেদের সঙ্গে মিশে এই সব কাজ করছে!

সেলিম বললেন, এবার জেলে ভরে দিতে হবে।

বিশাখাপত্তনমে ফিরে এবার পুলিশ কমিশনারের অফিসের বদলে যাওয়া হল সুরেশ নাইড়ুর অফিসে। তিনি জল-পুলিশের একজন বড় কর্তা।

তিনি বললেন, আমি পদ্মনাভনের কাছ থেকে সব শুনেছি। আমাদের এই এলাকায় যতগুলো মোটর বোট আছে তার চালকদের ছবি আর পরিচয়পত্র আমাদের কাছে থাকে। তারিককে সেইসব ছবি দেখাবার পর সে একজনকে চিনতে পেরেছে। সে হলফ করে বলেছে যে, জোজোকে ধরে নিয়ে গিয়ে যেবোটে তোলা হয়, সেই বোট চালাচ্ছিল এই লোকটি। এর নাম ফ্রেড।

কাকাবাবু বললেন, ফ্রেড? আমাদের একদিন একটা বোটে করে একটা দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিল, সেই চালকের নামও ছিল ফ্রেড। একই লোক হতে পারে?

সুরেশ নাইড়ু বললেন, হতেও পারে, নাও হতে পারে। ফ্রেড খুব কমন নাম। আর নাম শুনে কিন্তু বোঝা যাবে না, এরা ক্রিশ্চান না হিন্দু। এ লোকটির পুরো নাম ফ্রেড গোয়েল।

কাকাবাবু বললেন, আমি ছবিটা একবার দেখতে পারি?

সুরেশ নাইড়ু বেল টিপে একজনকে আনতে বললেন ছবিগুলো। তারপর বললেন, এর মধ্যে আমরা ফ্রেডের বাড়িতেও খোঁজ করেছি। মোটর বোটের মালিকও সে নিজেই। আজ সকালেই সে বেরিয়ে গেছে বোট নিয়ে। কোথায় গেছে, তা অবশ্য তার বাড়ির লোক জানে না।

কাকাবাবু বললেন, জানলেও বলবে না। জোজোকে যদি অন্য কোনও বাড়িতে সরিয়ে ফেলতে চায়, তা হলে গাড়িতেই নিতে পারত। মোটর বোটে যদি নিয়ে যায়, তা হলে কি কোনও দ্বীপে নিয়ে গেছে?

সুরেশ নাইড়ু বললেন, হতেও পারে। কিংবা সমুদ্রের ধারেই যদি অন্য কোনও দূরের শহরে নিয়ে যেতে চায়, তা হলে মোটর বোটেই সুবিধে, কেউ সহজে পিছু তাড়া করতে পারবে না।

একজন কর্মচারী ছবির ফাইলগুলো নিয়ে এলেন। কাকাবাবু আর সন্তু ফ্রেডের ছবিটা দেখামাত্র চিনতে পেরে বললেন, এই তো!

কাকাবাবু বললেন, যে-কোনও উপায়ে হোক, এই ফ্রেডকে এখন খুঁজে বার করা দরকার। সে রকেট নামে লম্বা লোকটাকে চেনে। ফ্রেডের কাছ থেকে রকেটের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, রকেট হায়দরাবাদি? সেও এর মধ্যে আছে নাকি? তাকে একবার আমরা প্রায় ধরে ফেলেছিলাম, একটা দ্বীপে পালিয়ে ছিল, সেখান থেকে নিয়ে আসার সময় লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, সে আর বেঁচে নেই।

কাকাবাবু সোজা হয়ে বসে বললেন, দ্বীপ? কোন দ্বীপ? এখানকার দ্বীপগুলোতে লুকিয়ে থাকা যায়? আপনাদের কাছে দ্বীপগুলোর ম্যাপ আছে।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, তা অবশ্যই আছে। কিছু ছোট ছোট দ্বীপ কিছুদিন দেখা যায়, আবার জল বাড়লে ড়ুবে যায়। বুঝতেই পারছেন, সেগুলোতে কোনও গাছপালাও জন্মাতে পারে না। মোট চারটে দ্বীপ আছে, কিছুটা বড়। তার মধ্যে দুটোতে কোনও কনস্ট্রাকশান নেই, মানে বাড়ি-ঘর কিছু নেই। একেবারে ন্যাড়া। সেখানে কেউ বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। বিশেষত এখন ঝড় বৃষ্টির সময়, কখনও টানা চব্বিশ ঘণ্টাও বৃষ্টি হয়। আর দুটো দ্বীপের নাম রবার্টস আয়ল্যান্ড আর কিউকাম্বার কোভ। এই দুটোতে সাহেবি আমলের ভাঙাচোরা বাড়ি আছে। এর মধ্যে কিউকাম্বার কোভ দ্বীপটার আকৃতি শশার মতন, তাই লোকে বলে শশা দ্বীপ, রবার্টস সাহেবের নামের দ্বীপটা হয়েছে রাবার দ্বীপ। কিছু লোকের ধারণা, ওই রবার্টস আয়ল্যান্ডে ভূত আছে। আমি নিজে সেখানে গেছি। কিছু দেখিনি। কিছুদিন আগে একদল বৈজ্ঞানিক গিয়েছিলেন, তাঁরাও কিছু আবিষ্কার করতে পারেননি।

সন্তু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু তাকে চাপা দিয়ে বললেন, খুনে-গুন্ডারা ভূতের ভয় পায় না। তারা ওই রাবার দ্বীপে আড্ডা গাড়তে পারে না? এক হিসেবে তাদের পক্ষে ভালই, অন্য কেউ সেখানে ভয়ে যাবে না।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। গুন্ডাশ্রেণীর লোকেরা ভূতের ভয় পায় না। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, এই রবার্টস আয়ল্যান্ড তারা এড়িয়ে যায়। আমাদের লঞ্চ ওখানে গিয়ে নিয়মিত চেক করে, কারুর থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিউকাম্বার কোভের কাছের দিকটায় মাঝে-মাঝে পিকনিক পার্টি যায়। আর একেবারে শেষ প্রান্তে আছে একটা টালির বাড়ি।

কাকাবাবু বললেন, আমার মনে হয়, জোজোকে ওরা খুব দূরে নিয়ে যাবে না। তিনদিন মাত্র সময়। তার মধ্যে প্রায় দেড় দিন তো কেটেই গেল! চলুন, আমরা

ওই দ্বীপ দুটোই আগে গিয়ে দেখি।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, চলুন। আমাদের ঢাকা লঞ্চ আছে। বৃষ্টি হলে অসুবিধে হবে না। আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress