Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও আশ্চর্য দ্বীপ || Sunil Gangopadhyay » Page 6

কাকাবাবু ও আশ্চর্য দ্বীপ || Sunil Gangopadhyay

এরকম আগে কখনও হয়নি যে, কাকাবাবুর সামনেই কেউ গুলি চালাল, অথচ কোনও বাধা দিতে পারলেন না। জোজোকে ধরে নিয়ে গেল, অথচ সন্তু আটকাবার কোনও চেষ্টাই করতে পারল না, এরকমও আগে হয়নি।

নরেন্দ্র ভার্মার গায়ে গুলি লাগার পর তিনি মারা গেছেন কি না, এই চিন্তাই তখন কাকাবাবুর কাছে প্রধান। তিনি দেখলেন, নরেন্দ্র ভার্মা কাত হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর সারা বুক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সন্তুও অজ্ঞান।

অন্য বোটটা জোজোকে নিয়ে চলে যাচ্ছে, কাকাবাবু সেদিকে দেখলেনই না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে নরেন্দ্র ভার্মার পাশে বসে পড়ে সিরাজুদ্দিনকে বললেন, শিগগির চলুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, হাসপাতালে, কোনও ডাক্তারের কাছে…

বিশাখাপত্তনমে একটা নার্সিং হোম একেবারে শ্রীরামকৃষ্ণ বিচের ওপরেই। সেখানে পৌঁছতে পঞ্চাশ মিনিট লেগে গেল। এর মধ্যে সন্তুর জ্ঞান ফিরে এসেছে, কিন্তু নরেন্দ্র ভার্মার শরীরে কোনও সাড় নেই, বেঁচে আছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না।

কাকাবাবু বারবার ডাকছেন, নরেন্দ্র, নরেন্দ্র! আর হাউ হাউ করে কাঁদছেন ছেলেমানুষের মতন।

নার্সিংহোমের ডাক্তার বললেন, অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে, আর বেশি দেরি হলে বাঁচানো যেত না। দু বোতল রক্ত দিতে হবে।

কাকাবাবু ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি রক্ত দেব। সন্তু রক্ত দেবে, যে-কোনও উপায়ে হোক, আমার বন্ধুকে বাঁচান।

ডাক্তার কাকাবাবুকে বললেন, আপনি অত বিচলিত হবেন না। সবার রক্ত তো নেওয়া যায় না। ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করে দেখছি। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমরা ওঁকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাচ্ছি।

এর মধ্যে খবর পেয়ে চলে এলেন পুলিশ কমিশনার ও আরও অনেকে।

নরেন্দ্র ভার্মার ভাগ্যটা ভাল বলতে হবে। দুটো গুলিই লেগেছে তার বাঁ কাঁধের ঠিক নীচে। আরও একটু নীচে লাগলে আর চিকিৎসার কোনও সুযোগই পাওয়া

যেত না।

অপারেশন করে গুলি দুটো বার করা গেল, কিন্তু জ্ঞান ফিরে না-আসা পর্যন্ত বিপদ কাটে না। কাকাবাবু সর্বক্ষণ বসে রইলেন সে নার্সিং হোমে, তিনি কিছু খেলেন না, কিছুতেই তাঁকে বিশ্রাম নিতে পাঠানো গেল না।

সন্তুর মাথাতেও অনেকখানি গর্ত হয়ে গেছে, সেলাই করতে হল চারটে, তাকে একটা বেডে শুইয়ে রাখা হল প্রায় জোর করে।

রাত দেড়টায় নরেন্দ্র ভার্মার জ্ঞান ফিরল, তিনি জল খেতে চাইলেন। এখনও তাঁর সঙ্গে অন্য কারও কথা বলা নিষেধ, কাকাবাবু শুধু ক্যাবিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলেন বন্ধুকে। দুজনের চোখাচোখি হল।

অত রাতে কাকাবাবু পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি এখন আপনার বাড়িতে গিয়ে এক কাপ কফি খেতে পারি?

পদ্মনাভন বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই আসতে পারেন। আমার বাড়িতে সারা রাতই কফির ব্যবস্থা থাকে। তবে, ট্যাক্সি করে আসবেন না। নার্সিংহোমের বাইরে

একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেই গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।

সন্তু এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে আর ডাকলেন না কাকাবাবু।

পদ্মনাভনের বাড়ির সামনে ও ভেতরে জ্বলছে অনেক আলো, ঘোরাফেরা করছে কিছু লোক, এত রাত বলে মনেই হয় না।

কাকাবাবুকে দোতলায় নিয়ে বসিয়ে পদ্মনাভন বললেন, আমি জানি, সারাদিন আপনার পেটে একটা দানাও পড়েনি। কফির সঙ্গে গরম গরম দুটো চিংড়ির কাটলেট খান।

কাকাবাবু বললেন, এত রাতে গরম গরম চিংড়ির কাটলেট? আপনার ঘুম নষ্ট করার জন্য আমার আসতে লজ্জা করছিল। কিন্তু আমার হাতে বেশি সময়

নেই—

পদ্মনাভন বললেন, আপনার লজ্জা পাবার কোনও কারণ নেই। প্রায় প্রতি রাত্রে আমাদের বাড়িতে এই রকম চলে।

সে কী? আপনার স্ত্রী আপত্তি করেন না?

আমার স্ত্রী তো এখানে থাকেন না। তিনি হায়দরাবাদের একটা কলেজে পড়ান। তবে এখানে থাকলেও আপত্তি করতেন না। তিনি আমার স্বভাব জানেন। অফিসে তো সর্বক্ষণ বাইরের লোক আসে কিংবা মিনিস্টারদের ফোনের কথা শুনতে হয়। আমার অফিসারদের সঙ্গে সব জরুরি কাজের কথা হয় এই সময়ে।

আপনি ঘুমোন কখন?

পুলিশের লোকদের কম ঘুমোনো শিখতে হয়। আমি ঘুমোই ঠিক রাত সাড়ে তিনটে থেকে সকালে সাড়ে সাতটা। ওই সময়টাতে দেখবেন, পৃথিবীতে কেউ ডিস্টার্ব করে না।

মাত্র চার ঘণ্টা ঘুম? ব্যস?

নেপোলিয়নও শুনেছি চার ঘণ্টা ঘুমোতেন। তবে তিনি নাকি ঘোড়ার পিঠে যেতে যেতেও ঘুমিয়ে নিতেন। সেটা আমি পারি না।

আমি কেন এত রাতে এসেছি বুঝতে পারছেন? প্রত্যেকটি ঘণ্টা মূল্যবান। ওরা মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছে। তার মধ্যে ডিমোলোকে মুক্তি না দিলে ওরা জোজোর মুণ্ডু কেটে আমার দোরগোড়ায় রেখে যাবে বলেছে।

পদ্মনাভন গম্ভীর হয়ে গিয়ে নিজের চিবুক চুলকোতে লাগলেন।

কাকাবাবু কফির কাপ হাতে নিয়ে ভুলে গেলেন চুমুক দিতে।

একটু পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পদ্মনাভন বললেন, আমি সব শুনেছি। কিন্তু রায়চৌধুরী সাহেব, আমাদের হাত-পা যে বাঁধা। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ আছে, অপহরণকারীদের কোনও দাবিই মানা হবে না। না হলে দিন দিন ওদের দাবি বেড়েই চলবে। অপহরণও দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেমন করে তোক, ওদের ঠান্ডা করতেই হবে!

কাকাবাবু বললেন, অপহরণ করে তো খুনও হচ্ছে। ওদের দাবি না মানলে ওরা জোজোকে খুন করে ফেলতে পারে।

পদ্মনাভন বললেন, তা অসম্ভব নয়। এরা অতি নৃশংস। ডিমেলোকে ধরার জন্য হইচই পড়ে গেছে। অনেকগুলো কেস আছে তার নামে। আমরা খবর নিয়েছি, যে-লম্বা লোকটির কথা আপনি বলেছেন, তার নাম রকেট। ওই নামেই সবাই তাকে জানে। এই রকেট হচ্ছে ডিমেলোর ডান হাত। ওদের দলে একজন মহিলাও আছে, তার আর রকেটের ক্ষমতা প্রায় সমান সমান। পুলিশ ওদের খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই।

কাকাবাবু সামনের কাচের টেবিলে প্রচণ্ড জোরে একটা কিল মেরে চিৎকার করে বললেন, আপনি ভেবেছেন কী? আমরা এখানে বসে অকারণ কথা বলে যাব, আর ওরা জোজোকে খুন করে ফেলবে? কিছুতেই না, কিছুতেই না। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

কাচের টেবিলটা ফেটে গেছে। কাকাবাবুর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে কয়েকজন ছুটে এল।

পদ্মনাভন বললেন, রায়চৌধুরী সাহেব, আপনি শান্ত হন। আমরা সবরকম চেষ্টা করবই।

অন্য একজনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বেংকট, তুমি তো কেসটা সব জানো। ডিমেলোকে ছেড়ে দেওয়ার কোনও উপায় আছে?

বেংকট বলল, একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ সে অর্ডার দিতে পারেন।

কাকাবাবুর উত্তেজনা এখনও কমেনি। তিনি আবার চেঁচিয়ে বললেন, আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাব। এক্ষুনি!

বেংকট বলল, স্যার, মুখ্যমন্ত্রী জাপান গেছেন। চারদিন পরে ফিরবেন। ওই ডিমেলোর দলবলের ডেরা খুঁজে বার করা ছাড়া উপায় নেই।

পদ্মনাভন বললেন, মুশকিল হচ্ছে, ওরা ঘন ঘন ডেরা বদলায়। আর এখানে সমুদ্রে অনেক ছোট ছোট দ্বীপ আছে, তার কোনও একটায় যদি লুকিয়ে থাকে… সবগুলো দ্বীপ খুঁজতে অনেক সময় লেগে যাবে—

বেংকট বলল, ওই ডিমেলোকে যদি আরও জেরা করা যায়, সে হয়তো জানবে।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন, আমি ডিমেলোকে নিজে জেরা করব। চলুন, চলুন।

পদ্মনাভন বললেন, এত রাতে কি জেলখানায় যাওয়া সম্ভব? আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন। হয়তো ঘুম আসবে না, তবু শুয়ে থাকুন, তাতেও বিশ্রাম হবে। ঠিক সকাল নটায় আমি আপনাকে নিয়ে যাব।

জেলের মধ্যে গিয়ে কারও সঙ্গে দেখা করা সহজ নয়, অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়। কারামন্ত্রী নিরঞ্জন ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে পদ্মনাভন সে ব্যবস্থা করে ফেললেন।

পদ্মনাভন ঠিকই বলেছিলেন, হোটেলের বিছানায় শুয়ে এক মিনিটও ঘুমোতে পারেননি কাকাবাবু। সন্তুকে ওরা ধরে নিয়ে গেলে তিনি এত চিন্তা করতেন না।

সকাল হতেই স্নানটান সেরে নিয়ে কাকাবাবু চলে এলেন নার্সিং হোমে। সন্তু দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তার মাথায় সেলাই হয়েছে বটে, কিন্তু তার জন্য সে শুয়ে থাকতে চায় না। এর মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠেছে।

নরেন্দ্র ভার্মার কঁধ আর বুক জোড়া মস্ত বড় ব্যান্ডেজ। তাঁর বিপদ কেটে গেছে। বটে কিন্তু এখনও কথা বলা নিষেধ।

একজন নার্স তাকে চা খাইয়ে দিচ্ছে। কাকাবাবু তাঁর পাশে এসে বললেন, নরেন্দ্র, তোমাকে কথা বলতে হবে না। এখানকার পুলিশ আমাকে সবরকম সাহায্য করছে। একটু পরেই আমি ডিমেলোর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি জেলখানায়। আবার দুপুরে আসব তোমার কাছে।

ডাক্তারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা হলে এবারেও আমি বেঁচে গেলাম, কী বলো?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আর কোনও ভয় নেই। তবে, আমি প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, তুমি নাকি কাঁদছিলে? অ্যাঁ? বলো কী, তুমি কাদতে পারো? আমি তো আর পারি না।

নার্সটি বললেন, আপনি কথা বলবেন না প্লিজ!

নরেন্দ্র ভার্মা সে কথাও না শুনে সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, জোজো কোথায়?

সন্তু আমতা আমতা করে বলল, আছে, জোজো ভাল আছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ওরা পুলিশ সেজে এসেছিল বলে আমরা প্রথমে কিছু সন্দেহ করিনি। কিন্তু উচিত ছিল, প্রথম থেকেই আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিল।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে নরেন্দ্র। আমরা এখন আসছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমাদের আর সেই দ্বীপে ভূত দেখতে যাওয়া হল না। তবে যাব, ঠিকই যাব, একটু সেরে উঠি।

কাকাবাবু ঝুঁকে নরেন্দ্র ভার্মার কপালে একটু হাত রেখে বললেন, নিশ্চয়ই যাব!

পদ্মনাভন গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, তার সঙ্গে দেখা হল জেলের গেটের কাছে। কারামন্ত্রী নিরঞ্জন ওসমান নিজেও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন।

তিনি কাকাবাবুর হাতে হাত মিলিয়ে বললেন, আমি আপনার কথা জানি। সেই যে আগে একবার আরাকু ভ্যালিতে একটা সাংঘাতিক স্মাগলারদের গ্যাংকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, তাতে আমার বিশেষ কিছু কৃতিত্ব ছিল না। যা কিছু এই ছেলেটিই করেছে। হ্যান্ড গ্রেনেডগুলি সব ধ্বংস করে দিয়েছিল।

তিনি সন্তুর কাঁধে হাত দিলেন।

সন্তু লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলল।

ওসমান বললেন, আপনার ডিমেলোকে জেরা করে দেখুন, কিছু বার করতে পারেন কি না। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি আপনাদের জানাতে বলেছেন যে ডিমেলোকে তো একেবারে মুক্তি দেওয়া যাবে না, তবে বাবা-মায়ের অসুখ বা মেয়ের বিয়ের নামে দু-এক দিনের জন্য ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য জামিন রাখতে হবে।

এই জেলটি অনেক পুরনো আমলের। আগাগোড়া পাথরের তৈরি। বাইরের থেকে দুর্গ বলে মনে হয়।

সুপারের ঘরটি সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো। একটা টেবিলকে ঘিরে অনেকগুলি চামড়ামোড়া চেয়ার। দেওয়ালে গাঁধীজি, নেতাজি, নেহরুজি, রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণন এরকম অনেকের ছবি।

ডিমেলোকে আনা হল সেই ঘরে।

প্রায় ছফুট লম্বা, মাথার চুল খুব ছোট করে ছাটা। মুখোনা চৌকো ধরনের, চোখ দুটো ছোট ছোট। কয়েদির পোশাক নয়, সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা।

ঘরে ঢুকেই সে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে কোনও কথাই বলব না। আমার একজন উকিল চাই।

জেল সুপার অরবিন্দন বললেন, উকিল পরে হবে। এখন আমরা যা বলতে চাই, শোনো।

কাকাবাবু অরবিন্দনকে বললেন, ওকে বসতে বলুন।

অরবিন্দন বললেন, কয়েদিদের বসবার নিয়ম নেই। দাঁড়িয়েই থাকুক।

কাকাবাবু বললেন, ইনি তো এখনও কয়েদি নন। বিচার হয়নি। আদালত থেকে ওঁকে জেল কাস্টোডিতে রাখতে বলা হয়েছে। বিচারের শাস্তি না হলে অপরাধী বলা যায় না।

ডিমেলো কাকাবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। তারপর নিজেই বসে পড়ল একটা চেয়ার টেনে।

কাকাবাবু তাকে বললেন, মিস্টার ডিমেলো, পুলিশ আপনাকে সন্দেহের বশে গ্রেফতার করেছে। বিচারে যদি আপনাকে দোষী প্রমাণিত না করা যায়, তা হলেই আপনি মুক্তি পাবেন। তার আগেই আপনি ছাড়া পেতে চাইছেন, আপনি অনেকদিন এ লাইনে আছেন, তা যে সম্ভব নয়, তা কি আপনি জানেন না?

ডিমেলো বলল, কে বলল সম্ভব নয়? জামিনে ছেড়ে দেওয়া যায়। টাকা নকল করার কাজে আমি মোটেই যুক্ত নই, তা পুলিশ ভালভাবেই জানে। ওই স্কাউড্রেল ধুমলটা বদমাইশি করে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে।

পদ্মনাভন বললেন, তোমার নামে আরও তিনটে বড় বড় কেস আছে। তখন তোমাকে ধরা যায়নি।

ডিমেলো বলল, ওসব কথা বাদ দিন। টাকা জাল করার কেসে ধরেছেন, সে কাজ আমি করিনি, তা হলে কেন ধরে রাখবেন?

পদ্মনাভন বললেন, এ তো অদ্ভুত কথা। ছিচকে চুরির অভিযোগে একজনকে ধরা হল। তারপর ইনভেস্টিগেশানে দেখা গেল, ওই চুরিটা সে করেনি বটে, কিন্তু আগে দুটো খুন আর ডাকাতি করেছে। তবু তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে?

ডিমেলো বলল, হ্যাঁ। এই কেসটা ফল্স, সে জন্য আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। পুরনো কেসগুলোর জন্য যদি আপনাদের হিম্মত থাকে আমাকে আবার ধরার চেষ্টা করুন।

কাকাবাবু বললেন, এ যে দেখছি চোর-পুলিশ খেলা। এর মধ্যে আমাদের জড়াচ্ছেন কেন? একটা ছোট ছেলেকে ধরে রেখেছেন।

ডিমেলো বলল, হ্যাঁ, বদলা নেওয়ার ভয় তো দেখাতেই হবে। নইলে পুলিশ কি এমনি এমনি আমাকে ছাড়বে নাকি? তিন দিনের মধ্যে আমি মুক্তি না পেলে, শুধু ভয় দেখানো নয়, সত্যি ওই ছেলেটি খুন হয়ে যাবে। তারপর ধরা হবে আর একজনকে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, খুন হয়ে যাবে?

ডিমেলো দুকাঁধ ঝাকিয়ে বলল, একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি!

কাকাবাবু এতক্ষণ শান্তভাবে কথা বলছিলেন, এবার ঠান্ডা, কঠিন গলায় বললেন, শোনো ডিমেলো, ওই জোজো নামের ছেলেটির জীবনের দাম আমার চেয়েও বেশি। আমার অনেক বয়েস হয়ে গেছে, ওই জোজোর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে আমি নিজে তোমাকে গুলি করে মারব। তারপর আমার ফঁসি হয় তো হবে!

ডিমেলো বলল, আমাকে ওসব ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। আমাকে একবার জেল থেকে বেরুতেই হবে।

পদ্মনাভনের পকেটে সেল ফোন বেজে উঠল।

তিনি উঠে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেটাতে কথা বলতে বলতে কাকাবাবুকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন।

কাকাবাবু যেতেই তিনি বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমার অফিস থেকে ফোন করছে। একজন মহিলা বার বার ফোনে আপনার ঠিকানা জানতে চাইছে। তিনি বললেন, তাঁর খুব জরুরি দরকার।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, একজন মহিলা? আমার তো এখানে সে রকম কেউ চেনা নেই।

পদ্মনাভন বললেন, তিনি তার নাম জানাতে চান না। তিনি আজই আপনার সঙ্গে কোনও কারণে দেখা করতে চান। আপনার হোটেলের নাম তো হুট করে সবাইকে এখন জানানো যায় না! কার কী মতলব থাকে কে জানে।

কাকাবাবু বললেন, শেষ পর্যন্ত কি একজন মহিলাকেও ভয় পেতে হবে নাকি?

পদ্মনাভন বললেন, আপনি জানেন না, আজকাল মেয়েরাও কত দুঃসাহসের কাজ করে। এই ডিমেলোর মতন লোকদের দলে সব সময় দুতিনজন নারীও থাকে।

কাকাবাবু বললেন, মহিলাটি যদি আবার ফোন করে, তাকে জানিয়ে দেওয়া হোক, আপনার অফিসে এসে দেখা করতে। সেখানে আমি থাকব।

পদ্মনাভন বললেন, সে কথা জানানো হয়েছিল। মহিলাটি থানায় আসতে রাজি নয়। সে একা একা আপনার সঙ্গে দেখা করে কিছু বলবে।

কাকাবাবু বললেন, আমার কৌতূহল হচ্ছে। তা হলে আমার হোটেলের নামই জানিয়ে দিন। দুপুরবেলা বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত আমি সেখানে থাকব। কী আর হবে।

পদ্মনাভন বললেন, ডিমেলোর পেট থেকে কোনও কথা বার করা যাবে বলে মনে হয় না। মুশকিল হচ্ছে, অনেক চেষ্টা করেও ওর আস্তানাগুলো আমরা কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারিনি।

কাকাবাবু বললেন, ওকে যদি আজই ছেড়ে দেওয়া হয়। ও কোথায় যাবে?

পদ্মনাভন বললেন, আমার ধারণা, ও সোজা কোনও হোটেলে গিয়ে উঠবে। সেখান থেকে আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে। জোজোকে যেখানে লুকিয়ে রেখেছে, সে জায়গাটা নিশ্চয়ই আমাদের দেখিয়ে দেবে না। এই কিডন্যাপিং-এর কেসগুলোয় পুলিশ প্রায় অসহায়।

চেয়ারে ফিরে এসে কাকাবাবু সোজা ডিমেলার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, ডিমেলোও চোখ সরিয়ে নিল না। খানিক বাদে কাকাবাবু বললেন, জোজোকে যদি ছেড়ে দাও, তা হলে আমরা ভাইজাগ ছেড়ে চলে যাব কলকাতায়। তোমাদের কোনও ব্যাপারে মাথা গলাব না। আর যদি জোজোকে না ছাড়তে চাও, তা হলে আমি তোমার নামে যত অভিযোগ আছে, তার সব প্রমাণ জোগাড় করে দেব। তোমাদের দলের সর্বনাশ করে দেব, কেউ বাইরে থাকবে না।

ডিমেলো বলল, ঠিক আছে, চ্যালেঞ্জ রইল। আমাকে বিনা শর্তে মুক্তি না দিলে ওই ছেলেটি বাঁচবে না, এই আমার শেষ কথা।

জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে পদ্মনাভন বললেন, দেখলেন তো, হার্ড নাট টু ক্র্যাক। ডিমেলোকে মারধর করলেও ওর পেট থেকে কোনও কথা বার করা। যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, পেট থেকে না বেরুলেও মাথা থেকে বার করার উপায় আছে। আজকের দিনটা অন্যভাবে চেষ্টা করা যাক। যদি জোজোর খোঁজ না পাই, তা হলে কাল এসে আমি ডিমেলোকে আমার দায়িত্বে জেলের বাইরে নিয়ে যাব।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমাদের বোট যিনি চালাচ্ছিলেন, তার নাম সিরাজুদ্দিন তারিক। তিনি হয়তো অন্য বোটটার চালককে চিনতে পারেন। যদি তাকে খুঁজে বার করা যায়।

পদ্মনাভন বললেন, তারিককে কালই জেরা করা হয়েছে। অন্য বোটের চালককে সে চেনে না। তবে আবার দেখলে চিনতে পারবে।

কাকাবাবু বললেন, এদিকে যতগুলি মোটর বোট আছে, তাদের মালিক আর চালকদের তালিকা করুন। বিকেলের মধ্যে তাদের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ফ্রেড নামে একজন চালকের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে। তার আগে এই মহিলাটি আমাকে কী জানাতে চায়, সেটা দেখা দরকার।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress