Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাঁঠালহাটির গল্প || Tarapada Roy

কাঁঠালহাটির গল্প || Tarapada Roy

কাঁঠালহাটির গল্প

এই গল্পের নাম পাঠ করেই সকল বুদ্ধিমান পাঠক এবং অনুরূপ বুদ্ধিমতী পাঠিকা বুঝতে পেরেছেন যে এই গল্পটা কাঁঠালহাটি নামে একটা গ্রামের ব্যাপার নিয়ে।

সর্বশ্রী পাঠকগণ ও সর্বশ্রীমতী পাঠিকাগণ ঠিকই ধরেছেন।

কিন্তু একটা গোলমাল আছে।

গ্রামের নাম কাঁঠালহাটি শুনে আপনারা কেউ যদি ভেবে থাকেন, এই গাঁয়ে প্রচুর কাঁঠাল হয়, গ্রামের ভিতরে বা পাশে সেই কঁঠালের হাট বসে সেই কারণে এমন নামকরণ, তা হলে কিন্তু ভুল করেছেন।

কাঁঠালহাটিতে কাঁঠালগাছ নেই তা নয় কিন্তু সে হাট বসানোর মতো ব্যাপার নয়।

তা ছাড়া কাঁঠালহাটিতে কোনও হাট নেই। নিকটতম হাট এখান থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে মোল্লারপাড়ায়। সেখানে তরিতরকারি, মাছ-মাংস, চাল-ডাল, মরশুমি ফল এইসব পাওয়া যায়। কাঠালের মরশুমে দু-চারটে কাঁঠালও পাওয়া যায়, তবে তাকে কঁঠালের হাট বলা যায় না।

কাঁঠালহাটিতে হাট না থাকলেও বেশ বড় বাজার আছে। গ্রামের সামনের দিকে হাইওয়ের পাশে নতুনবাজার, সেখানে সুপার মার্কেট হবে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। গ্রামের ভিতরের দিকে রয়েছে পুরনো বাজার।

কাঁঠালহাটিকে অবশ্য গ্রাম বলা অনুচিত হচ্ছে। কাঁঠালহাটিতে পঞ্চায়েত অফিস আছে, থানা আছে। বিডিও অফিস থেকে ভিডিও হল সবই আছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আছে। হাইওয়ের পেট্রল পাম্পের পাশে বাসস্টপ থেকে এক্সপ্রেস বাস ধরলে সাড়ে তিন ঘণ্টায় কলকাতার ময়দানে পৌঁছে দেয়।

বছর তিরিশ চল্লিশ আগে কাঁঠালহাটিকে হয়তো বলা যেত গ্রাম, গণ্ডগ্রাম। কিন্তু এখন জায়গাটি পুরো গ্রাম্যতা বিসর্জন না দিলেও আধাআধি শহর হয়ে উঠেছে।

কাঁঠালহাটি গ্রামের মাঝখানে পুরনো বাজারের উলটো দিকে রয়েছে পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিস। ডাকঘর আর থানা।

কাঁঠালহাটি থানার বড় বিপদ।

না। পাঠক-পাঠিকা চট করে ভুল ভেবে নেবেন না।

এখানে প্রতিদিন দিনে-রাতে ডাকাতি-রাহাজানি হচ্ছে, তা নয়, খুন-ধর্ষণ খুব বেড়ে গেছে তাও বলা যাবে না। এত বড় একটা থানা এলাকায় মাসে-দুমাসে দুয়েকটি খুন, দুয়েকটি ধর্ষণ, দু-চারটি ডাকাতি-রাহাজানি, দু-দশটি চুরি বাটপারি এসব তো থাকবেই। যতদিন চন্দ্রসূর্য আছে, জোয়ার ভাটা আছে এসব তো ঘটবেই। মানুষের চরিত্র কি কখনও বদল হবে?

কিন্তু এসব কোনও সমস্যা নয়। এসব তো চিরদিনের মামুলি ঝামেলা। কাঁঠালহাটি থানার বিপদ হয়েছে একটি হনুমানকে নিয়ে। হনুমান না বলে বীর হনুমান বলাই ভাল।

বিপুল আকার ও আয়তনের এই হনুমানটিকে গ্রামের লোকেরা ভালবেসে নাম দিয়েছে বীর হনুমান। কৃত্তিবাসের রামায়ণে অঙ্গদ রায় পরে (লঙ্কাকাণ্ডের প্রায় প্রথমেই যে বিশাল বানরের কথা বলা আছে, তার বর্ণনা এই হনুমানের সঙ্গে বেশ মেলে।

এই বীর হনুমানটির সঙ্গে আজ প্রায় দশ-এগারো দিন হয়ে গেল বিরোধ বেধেছে কাঁঠালহাটি থানার বীরবিক্রম বড়বাবুর।

কোনও এক অজ্ঞাত কারণে অধিকাংশ পুলিশ থানারই ও. সি. বা বড় দারোগা হলেন সদব্রাহ্মণ। কারণটা কেউ জানে না, বোধ হয় সরকার বাহাদুরও অবহিত নন।

কাঁঠালহাটি থানার ও. সি. হলেন রামগতি গঙ্গোপাধ্যায়। ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করেন। একাদশী-অমাবস্যায় উপোস করেন। বস্তুত গাঙ্গুলিমশায় এই আজকের দিনেও এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। বর্ণহিন্দু ভিন্ন অন্য কোনও আসামিকে পেটালে কিংবা চড়-চাপড় দিলেও জামাকাপড় ছেড়ে গঙ্গাস্নান করেন। বেজাত কুজাতের বাড়িতে কিংবা নিষিদ্ধ পল্লিতে তল্লাশি বা ধরপাকড় করতে গেলে গলার পইতে, হাতের পলা বসানো মন্ত্রসিদ্ধ রুপোর আংটি একটা টিনের কৌটোয় ভরে থানার সিন্দুকে রেখে যান।

অপর দিকে রামগতিবাবুর মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ বড় দারোগা আজকাল বিরল। তাঁর প্রতাপে সরকার পক্ষীয় এবং সরকার বিরোধী স্থানীয় পানাসক্ত নেতারা একই ঠেকে চুল্লু খায়, কখনও কোনও গোলমাল হয় না।

যাঁরা ঠেকের ব্যাপারটা জানেন, বুঝতে পারছেন, মুরশিদকুলি খাঁর আমলে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়ার পরে এরকম ঘটনা আকছার ঘটে না।

প্রবল প্রতাপান্বিত রামগতিবাবুর শাসনে এই কাঁঠালহাটি অঞ্চলে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থাই ছিল। চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি মধ্যে মধ্যে হয়, দু-চারজন দোষী ধরা পড়ে ঘুষ দেয়, খালাস হয়। আবার চুরি-ডাকাতি করে। সব কিছু বেশ চক্রাকারে চলছিল। গোলমাল শুরু হল নিতাইমাস্টারকে দিয়ে। তিনি একজন স্থানীয় নেতা।

এই নিতাইমাস্টার গত দশ বছরে ছয়বার দল পালটেছেন। তিন পাত্র পেটে পড়ার পর তার আর মনে থাকে না তিনি এখন কোন দলে আছেন।

ঠেকের চারচালা ঘরের এক প্রান্তে একটা নড়বড়ে টুলে শালখুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে একাই কখনও গান্ধীর সঙ্গে, কখনও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে, কখনও সুভাষ বসুর সঙ্গে, কখনও ডাঙ্গেনাম্বুদ্রিপাদ বা চারু মজুমদারের সঙ্গে আপন মনে ঝগড়া করেন।

নিতাইমাস্টার হিসেবি মানুষ। ইচ্ছে করেই নড়বড়ে টুলটায় বসেন। একটু এদিক ওদিক হলেই টুলটা দুলতে থাকে, ভ্রম হয় খুব বেশি নেশা হয়েছে। দু-পাত্র পানীয় কম খেলে চলে।

বীর হনুমানের হাতে প্রথম নির্যাতিত হন এই নিতাইবাবু।

সেদিন সকাল থেকে ছিল বৃষ্টি বৃষ্টি, মেঘলা। সন্ধ্যার পর থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল। নিতাইমাস্টার যে শালখুঁটিটায় হেলান দিয়ে নড়বড়ে টুলে বসেন তার পাশেই একটা গরাদহীন জানলা।

অনিবার্য কারণেই এইসব চুল্লু বা চোলাই মদের স্বাধীন ঠেকগুলিতে জানলায় গরাদ থাকে না। সমস্ত প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও আবগারি ও পুলিশের কর্তারা রুটিনমাফিক হানা দেন অকুস্থলে। দরজায় দাঁড়িয়ে খুব হম্বিতম্বি করেন। সেই সময়ে মাননীয় খদ্দেররা অনর্গল জানলাপথে নিষ্ক্রান্ত হন। খদ্দেরদের এটুকু না দেখলে তারা পড়ে থাকবে কেন, চারপাশে তো ঠেকের অভাব নেই।

সেই বৃষ্টির সন্ধ্যায় সেই খোলা জানলা দিয়ে শীতল বাতাস এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুড়িখানার ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। নিতাইমাস্টার বেশ উপভোগ করছিলেন পরিবেশটা।

আজকের চুল্লু বেশ কড়া আঁঝের। দু গেলাস খেতেই বেশ গোলাপি নেশা হয়েছে।

ঠেকে গেলাস দেয় না। এখানে মাটির ভড়। কিন্তু মাটির ভাঁড়ে মদ খেতে নিতাই মাস্টারের আত্মসম্মানে লাগে। তিনি একটা ছোট কাঁচের গেলাস তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে রাখেন।

দ্বিতীয় গেলাসটি শেষ করে সবে তৃতীয় গেলাসটি পূর্ণ করেছেন। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে। কোথায় একটা কামিনী ফুলের গাছ থেকে জলে ভেজা সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। ঘরের সামনের দিকে। ঝোলানো স্তিমিতপ্রায় একটা হ্যারিকেন লণ্ঠনের হলুদ আলোয় সব কিছুই কেমন ছায়া-ছায়া। খুব মৌজে ছিলেন নিতাইমাস্টার।

আজ ভাগ্য খারাপ ছিল স্বর্গীয় ইন্দিরা গান্ধীর। সন্ধ্যা থেকে তাকে তুলোধোনা করেছেন নিতাইমাস্টার। শুধু তাকে নয়, তার বাপ-ঠাকুরদা জহরলাল-মতিলালকে নিয়ে পড়লেন তিনি তৃতীয় পাত্রে ছোট একটি চুমুক দিয়ে।

সেই মুহূর্তে একটি অভাবিত ঘটনা ঘটল। আধো অন্ধকার ঘরে, নিতাইমাস্টার কিংবা অন্য কেউ কিছু বুঝবার আগে শীর্ণ অথচ ক্ষিপ্র ও সবল, একটি লোমশ হাতের থাপ্পড় খেলেন নিতাইমাস্টার। ডান গালে সটান এক চড়।

সেই সঙ্গে সেই লোমশ হাতের মালিক এক ঝটকায় কেড়ে নিল নিতাইবাবুর হাতের চুল্লুর গেলাস। দুই দমে সে সেটা শূন্য করে দিল।

ইতিমধ্যে নিতাইবাবুর আর্ত চিৎকারে পুরো ঠেক নেশার আমেজ ছিঁড়ে সচেতন হয়ে উঠেছে।

লণ্ঠনের আলোয় কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। কী হচ্ছে? কেন মাস্টার চেঁচাচ্ছেন?

একজন কারও হাতে একটা টর্চলাইট ছিল। সে তাড়াতাড়ি টর্চটা জ্বেলে আলো ফেলতে গেলাস হাতে কে যেন খোলা জানলা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।

এই ক্ষণিক দৃশ্য সেইসঙ্গে নিতাইমাস্টারের আর্তনাদ, এ দুটো মিলিয়ে সবাই বুঝতে পারল যে জানলা দিয়ে কেউ ঠেকের মধ্যে ঢুকে নিতাইমাস্টারের হাত থেকে মদের গেলাস কেড়ে নিয়ে চলে গেল।

এরকম অসম্ভব ঘটনা এই ঠেকের ইতিহাসে কখনও হয়নি। ঘোর নকশাল আমলে নকশালেরা একবার এসে মালিক আর খদ্দেরদের লাঠিপেটা করে, মদ ঢেলে ফেলে দিয়ে, কাঠের বেঞ্চি ভেঙে ঠেক তুলে দিয়েছিল।

আরেকবার আবগারির এক গান্ধীবাদী বড়সাহেব স্বয়ং সেপাই নিয়ে এসে ঠেক তছনছ করে মালিক সহ জনাপাঁচেক খদ্দেরকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে জেলা সদরে নিয়ে যান।

কিন্তু এরকম অতর্কিতে জানলা দিয়ে ঢুকে সম্মানিত খদ্দেরের হাত থেকে পানীয়ের গেলাস। কেড়ে নিয়ে যাবে–এ তো ভাবা যায় না। কাঁঠালহাটিতে এমন কখনও ঘটেনি।

মাতালেরা সবাই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতে না উঠতে সেই জানলার মধ্য দিয়ে বীর হনুমান একটি হুম শব্দ করে ঠেকে প্রবেশ করলেন।

তার হাতে তখনও নিতাইবাবুর কাঁচের গেলাসটি ধরা রয়েছে, চুল্লুর স্বাদ হনুমানজির খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি আরেক পাত্র পানীয় নিতে এসেছেন।

কাঁঠালহাটি ঠিক রামরাজ্যের এলাকা নয়। এ অঞ্চলে বানর-হনুমান খুব সুলভ নয়।

তদুপরি বীর হনুমান ঘরে ঢুকেই চোখে টর্চের আলো পড়তে যেরকম দাঁত খিচোলেন আর সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ আগের চড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে নিতাইমাস্টার যেরকম ওরে বাবারে, গেছি রে বলে চেঁচিয়ে লাফ দিলেন–তাতে হুলুস্থুল পড়ে গেল।

রীতিমতো হইচই শোরগোল। লোকে ভাবল বুঝি ডাকাত পড়েছে। আশেপাশের পাড়া থেকে, পুরনো বাজার থেকে লোজন এমনকী থানা থেকে সেপাইরা ছুটে এল।

বড় দারোগা রামগতিবাবু থানার অফিস ঘরে বসে সন্ধ্যার পর এই সময়টা শক্তিসাধনা করেন। তার একটা পকেট কালী আছে। তিনি টেবিলের ওপরে একটা সুদৃশ্য কাঁচের পেপারওয়েটের গায়ে। ঠেস দিয়ে মা কালীকে স্থাপিত করেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সিঁদুর কৌটো আর। দুটো প্লাস্টিকের লাল জবা বের করেন। লাল জবা দুটো মায়ের পদতলে রেখে কৌটো খুলে এক বিন্দু সিঁদুর নিয়ে মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে তারপর নিজের কপালে সিঁদুরফেঁটা পরেন।

এইসব আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হলে পিছনের কাঠের আলমারি থেকে জমাদার শুকদেও যাদব একটি বিলাতি সুধার বোতল এবং একটি শ্বেতপাথরের গেলাস বার করেন। টেবিলের বাঁদিকের একটি শূন্য ড্রয়ার টেনে শুকদেও গেলাস ও বোতলটি রেখে দেন।

এবার রামগতিবাবু শ্বেতপাথরের গেলাসে অল্প অল্প করে কারণসুধা ঢেলে চুকচুক করে পান। করতে করতে ইষ্টদেবীর জপ করতে থাকেন। তাঁর ইষ্টদেবী হলেন ধূলোচন কালীমাতা।

গুনে গুনে একশো আটবার বড় দারোগা সাহেব ইষ্টদেবীর জপ করেন। জপের সংখ্যা ঠিক রাখবার জন্যে তিনি একটি উপায় উদ্ভাবন করেছেন। তার হাতের মাপ খুব পাকা। প্রতিবার গেলাসে ছোট চুমুকের পরের চুমুক পানীয় ঢালেন। প্রতিটি চুমুকের পর একবার করে ইষ্টদেবীর জপ করেন। এইভাবে নয় গেলাস পান করার সঙ্গে একশো আটবার জপ সম্পূর্ণ হয়।

জপ করার সময় কেউ রামগতিবাবুকে বিরক্ত করতে সাহস পায় না, শুধুমাত্র ঘুষদাতা ছাড়া। তবে তিনি তাদের সঙ্গে কোনও কথাই বলেন না। তা ছাড়া তিনি ঘুষের টাকা হাত দিয়ে স্পর্শ করেন না।

পানীয়ের বোতল এবং গেলাস যে খোলা ড্রয়ারে থাকে সেখানেই নিঃশব্দে টাকা রেখে যেতে হয়, কেউ কেউ অতি সাবধানী সঙ্গে একটা ছোট চিরকুটে নিজের নাম, ঠিকানা, প্রয়োজনে একটা রবারের গার্টারে টাকার সঙ্গে জড়িয়ে দেন। অবশ্য তার কোনও দরকার পড়ে না। বড় দারোগার শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝে নেন কে কীসের জন্যে টাকা দিচ্ছে।

আজ এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির সন্ধ্যায় রামগতিবাবু খুব আয়েশ করে ইষ্টনাম জপ এবং কারণ সুধা পান করছিলেন। পানীয়টি খুবই উচ্চমানের। খাঁটি বিলিতি এবং তাই শুধু নয় খুবই পবিত্র। মহামান্য পোপের ভ্যাটিকান প্রাসাদের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দিয়ে পানীয়টির নামকরণ হয়েছে ভ্যাটিকান বা ভ্যাট ৬৯ (Vat 69)৷

রামগতিবাবু সবে একাত্তর নম্বর ইষ্টজপে পৌঁছেছেন, ধূলোচনার সাধনা করতে করতে ক্রমশ তিনিও ধূলোচন হয়ে উঠেছেন। আজ আমদানিও ভাল হয়েছে।

মালেরপাড়ায় বনমালী চট্টরাজ খুন হয়েছে বলে সেই পাড়ার একুশজন লোককে কিছুদিন আগে খুনের মামলায় ফৌজদারিতে চালান দিয়েছিলেন। আজ সেই বনমালী চট্টরাজ সশরীরে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন।

বিকেল থেকে বড় দারোগার মনটা খুঁতখুঁত করছিল। দিনকাল খারাপ, কীসে কী হয়ে যায় কে জানে?

অবশেষে এতক্ষণে একাত্তর চুমুক প্রসাদ সুধা পান করে এবং সমপরিমাণ ইষ্টনাম জপ করে তিনি একটু ধাতস্থ বোধ করছিলেন।

আরেক চুমুক হলেই ছয় নম্বর গেলাস শেষ হয় এমন সময় ইষ্টজপে বাধা পড়ল।

চুল্লুর ঠেকে ডাকাত পড়েছে ভেবে যে সেপাইরা থানা থেকে ছুটে গিয়েছিল, তারা এবং তাদের সঙ্গে আরও বহু লোকজন, তার মধ্যে ঠেকের খদ্দেররাও আছে চেঁচাতে চেঁচাতে থানার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সকলের মুখে এক কথা, হনুমান নিতাইমাস্টারকে চড় মেরেছে।

এই অবৈধ প্রবেশে তদুপরি তার ধর্মকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করায় বড়বাবু খুবই চটে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিনকাল বড় খারাপ। আজ আদালতের ঘটনাটাও খুব সুবিধের নয়। তা ছাড়া থানার মধ্যে উত্তেজিত জনতা।

ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন রামগতিবাবু। বহু লোকের সম্মিলিত কলরবে তিনি হনুমান শব্দটি শুনতে পাননি শুধু শুনেছেন নিতাইমাস্টারকে চড় মেরেছে।

পাকা দারোগার মতো রামগতিবাবু ঘটনার ভিতরে প্রবেশ করলেন, নিতাইমাস্টারকে কেন চড় মেরেছে?

জনতার মধ্যে একজন বলল, নিতাইমাস্টার মদ খাচ্ছিলেন।

রামগতিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, চড় যে মেরেছে সে অন্যায় কিছু করেনি। মাতালদের চাবকান উচিত। বলতে বলতে ছয় নম্বর গেলাসের শেষ চুমুকটি না খেয়েই গেলাসটি অতি সন্তর্পণে খোলা ড্রয়ারে স্থানান্তরিত করলেন।

নিতাইমাস্টারকে কেউ চড় মেরেছে এটা জেনে রামগতিবাবু মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন। লোকটা কখন কোন দলে কিছু বোঝা যায় না। একেক সময় বড় জ্বালায়, এমন কী সরকারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়। কিন্তু এখন মনের ভাব গোপন করে দারোগাসুলভ গাম্ভীর্যে তিনি জানতে চাইলেন, তখন নিতাইমাস্টার কী করছিলেন?

চুল্লুর ঠেকের এক প্রত্যক্ষদর্শী খদ্দের বললেন, কী বলব স্যার, নিতাই মহীয়সী ইন্দিরা গান্ধীকে গালাগাল করছিল, অনেকক্ষণ ধরেই করছিল।

একথা শুনে রামগতিবাবুর মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি ইমারজেন্সি রিক্রুট। দিনের পর দিন মাসের পর মাস দেয়ালে দেয়ালে এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধী লিখে দারোগার চাকরি পেয়েছিলেন।

রামগতিবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কী যে হল। হঠাৎ আঁতকিয়ে উঠে উত্তেজিত জনতা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পথ করে দিল আর সেই বীর হনুমান তার হাতে তখনও ধরা রয়েছে নিতাইমাস্টারের কাঁচের গেলাস সে মুখে হুপ-হুঁপ শব্দ করতে করতে এবং স্পষ্টতই প্রমত্ত অবস্থায় টলতে টলতে থানা কক্ষে প্রবেশ করল।

তখন বড় দারোগা রামগতিবাবুসম্বিৎ হারাননি, তিনি হনুমানের উদ্দেশ্যে হেঁকে উঠলেন, এই এখানে কী? ভাগ এখান থেকে?

হনুমান ঘরের মধ্যখানে এসে গেছে। সে কটমট করে রামগতিবাবুর দিকে তাকাল, সেও ইতিমধ্যে ধূম্রলোচন হয়ে গেছে, সে দৃষ্টি বড় ভয়ংকর।

জমাদার শুকদেও যাদব বড় দারোগার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি বললেন, সাহেব হিন্দিমে বলিয়ে বজরঙ্গবলি বাংলা সমঝায় না।

উপস্থিত জনতার মধ্যেও অনেকে বলল, স্যার হনুমান বাংলা কি বুঝবে, ওর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলুন।

কিন্তু, দুঃখের বিষয়, হিন্দি বা বাংলা কোনও ভাষাই ব্যবহার করার সুযোগ পেলেন না রামগতিবাবু। তার আগেই হনুমান এক লাফে টেবিলে উঠে সটান এক চড় কষাল রামগতিবাবুর গালে।

একাত্তর চুমুক কারণ সুধার পরে এই রকম একটা মত্ত হনুমানের চড়ে রামগতিবাবু চোখ উলটিয়ে মেঝেতে টলে পড়লেন।

হইহই কাণ্ড। চোখে মুখে জল ছিটাও, ডাক্তার ডাকো।

বীর হনুমান কিন্তু নির্বিকার। সে ধীরে-সুস্থে টেবিলের ওপর বসে খালি ড্রয়ারের মধ্যে হাত গলিয়ে প্রথমে বড় দারোগার পাথরের গেলাসটা বার করে অবশিষ্ট বাহাত্তরতম চুমুকটি শেষ করল।

জিনিসটা তার ভালই লাগল। এবার সে শ্বেতপাথরের গেলাসটা মেঝেতে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলে দিল। তারপর নিতাইমাস্টারের কাঁচের গেলাসটায় ভ্যাট ঊনসত্তুরের বোতল থেকে মূল্যবান পানীয় ঢেলে ঢেলে খেতে লাগল।

এতক্ষণে তার দৃষ্টি পড়ল টেবিলের ওপর স্থাপিত পেপার-ওয়েট নির্ভর পকেট কালীটার দিকে। মা কালীর পদপ্রান্তের সিঁদুর সাবধানে সাবধানে একটা আঙুলে ছুঁইয়ে নিজের নোমশ কপালে মাখল, তার আগে অবশ্য অল্প একটু সিঁদুর জিব দিয়ে চেটে পরীক্ষা করেও দেখেছিল।

এরপর যেটুকু করার বাকি ছিল সেটুকুও করল। একটি ছোট লাফ দিয়ে বড়বাবুর সদ্য পরিত্যক্ত সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল।

এদিকে ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে মুখে চোখে জল ছিটোতে একটু পরে রামগতিবাবুর জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরতেই তিনি প্রথম আদেশ দিলেন, ওই বানর হারামজাদাকে গুলি করে মার।

আদেশ শুনে হনুমানভক্ত জমাদার শুকদেও যাদব শিউরে উঠলেন। জিব কেটে, চোখ বুজে, কানে আঙুল দিলেন। তারপর ধাতস্থ হয়ে বীরের মতো জানালেন, তিনি তার শরীরে প্রাণ থাকতে বজরঙ্গবলির ওপর গুলি চালাতে দেবেন না। জনতার মধ্যেও অনেক সমস্বরে শুকদেওজিকে সমর্থন জানাল।

ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে, ভঙ্গ নেশা নিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে রামগতিবাবু কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন।

পরের দিন সকালবেলায় হনুমানটাকে কাঁঠালহাটির কোথাও দেখা গেল না। সবাই, বিশেষ করে রামগতিবাবু এবং নিতাইমাস্টার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

কিন্তু ভর সন্ধ্যায় কোথা থেকে যে ফিরে এল হনুমান। প্রথমে চুল্লুর ঠেকে এবং পরে থানায় আক্রমণ চালাল। যথাক্রমে নিতাইমাস্টার এবং রামগতিবাবু নির্যাতিত হলেন।

তারপর থেকে আজ দশদিন একনাগাড়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে।

দিনমানে বীর হনুমানের টিকিটিও দেখতে পাওয়া যায় না। অন্ধকার ঘন হতেই তার হামলা শুরু হয়।

দ্বিতীয় দিন চড় খাওয়ার পরেই নিতাইমাস্টার ঠেকে আসা এবং চুলু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

তৃতীয় দিন থেকে রামগতিবাবু সন্ধ্যাবেলা থানায় না বসে নিজের কোয়ার্টারেই ধূম্রলোচনার সাধনা করেছিলেন। কিন্তু চতুর্থ দিনেই গন্ধে গন্ধে হনুমান সেখানে হাজির।

বন দপ্তরকে রামগতিবাবু খবর দিয়েছিলেন, তাঁরা বলেছেন দিনের বেলায় হনুমান বেরোলে জানাবেন। আমাদের লোক গিয়ে ধরে আনবে। রাতের বেলায় সম্ভব হবে না, কর্মীদের তা হলে ওভারটাইম দিতে হবে।

ফায়ার ব্রিগেড অনেক সময় এ ধরনের কাজ করে। মহকুমা সদরে গিয়ে দমকল দপ্তরে কথা বলে এসেছেন। কিন্তু তারা নারাজ। আগুন না লাগলে তারা নড়বেন না।

কাঁঠালহাটি থানার বড় বিপদ।

রামগতিবাবু স্থির করেছেন একদিন সন্ধ্যায় গোপনে থানায় আগুন ধরিয়ে দেবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress