কাঁটাচুয়া
ডক্টর প্রণব নাথ একজন বছর তেত্রিশের এমবিবিএস ডাক্তার, নিজের বিচারেই তিনি সাধারণ। অল্পস্বল্প প্রাইভেট প্র্যাকটিস আর বেসরকারি হাসপাতালের সহযোগিতায় তাঁর দিনকাল ভালোই কাটে। স্ত্রী এবং চার বছরের মেয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, এক সঙ্গে টিভি দেখা, সময়মতো খাওয়াদাওয়া, আরাম-বিশ্রামের সুযোগ পান। অধিকতর সফল বন্ধুবান্ধব কি দামি ডাক্তাররা যখন পিঠ-চাপড়ানোর ভঙ্গিতে বলেন, তুমিই ভালো আছ প্রণব, একেবারে প্ল্যানড আউট লাইফ অ্যান্ড লাইফস্টাইল, আমাদের দ্যাখো মাঝরাত অবধি দৌড়োচ্ছি, সামাজিকতার তো প্রশ্নই নেই, ফ্যামিলির সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করা কোনো অতীতের কথা, যে কোনো দিন বউ ডিভোর্স চাইতে পারে—তখন প্রণবের মনের অবস্থাটা ঠিক কী দাঁড়ায় বলা মুশকিল। বগুলোর ওপর ক্রোধ, না কি হীনম্মন্যতা, না কি বেশ আছি, তোদের রক্তবেচা কালো টাকা আমার দরকার নেই গোছের একটা মনোভাব? কে জানে, তবে সেদিন রাত নটা নাগাদ প্রণব ডাক্তার নিজের চেম্বারে তিরিক্ষি মেজাজে বসেছিলেন। সন্ধে ছ-টা থেকে ঝাঁপ খোলেন। আজ একটিও মক্কেল নেই। গত দু-দিনও প্রায় এই অবস্থাই গেছে। যে ওষুধের দোকানটার লাগোয়া তাঁর চেম্বার, তারা এমনিতেই তাঁর ওপর একটু চটা, কেননা, তিনি সবসময়ে তাদের দোকানে পেশেন্ট পাঠান না, তারা যেসব ব্র্যান্ড রাখে সেগুলোও সবসময়ে রেকমেন্ড করেন না। রোজ বেরোনোর সময়ে তারা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে, অন্তত প্রণবের তাই মনে হয়। শীতকাল ন-টায় চেম্বার বন্ধ করার কথা। দূর হোক গে, আর অপেক্ষা করবেন না, এক্ষুনি বন্ধ করে দেবেন। উঠে চেয়ারের পিঠ থেকে কোটটা নিয়ে হাত গলাচ্ছেন, শূন্য ওয়েটিং রুম থেকে কতকগুলো বিধবস্ত, কেমন আতঙ্কিত গলা ভেসে এল।
ডক্টর আছেন?
প্রণব ডাক্তার দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর পেশাদার গলায় বললেন, আসুন।
একটি রক্তাক্ত ছেলেকে ধরাধরি করে আনল আরও দুটি ছেলে, তাদেরও শার্ট প্যান্টে ছোপ।
কী ব্যাপার? অ্যাকসিডেন্ট! হাসপাতালে চলে যান স্ট্রেট।
না, ঠিক অ্যাকসিডেন্ট বলা যায় না স্যার, আগে প্লিজ একটু দেখুন, একটা ফার্স্ট এড যদি…
ছেলেটির বাহারি টিশার্ট, তার তলায় বহু বিজ্ঞাপিত গেঞ্জি একেবারে রক্ত মাখামাখি হয়ে গেছে। আর্তনাদ করছে ছেলেটি। কিন্তু উধ্বাঙ্গের জামাকাপড় তো খুলতে হযেই। খুলে বড়ো আশ্চর্য জিনিস দেখলেন ডাক্তার। ছেলেটির সারা গায়ে সমান দূরত্বে কতকগুলো ফুটো ফুটো ক্ষত। কাঁটার মতো ছোটো নয়, গুলির মতো বড়ো নয়। রক্ত পড়ছে ঝুঁঝিয়ে। বেশ গভীর…..চটপট ডিসইনফেকট্যান্ট দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগিয়ে ড্রেসিং করে দিলেন তিনি। প্রেসক্রিপশনের ওপর কলমটা স্থির, একটু গেরেম্ভারি চালে বললেন, কিছু ফুটেছে। কী করে হল?
অন্য দুই তরুণের চোখে হঠাৎ একই সঙ্গে ভয় আর সতর্কতার লালচে-কালচে আলো জ্বলতে দেখলেন তিনি। বললেন, কী করে হল ঠিক করে বলো!
এতক্ষণে তিনি হৃদয়ংগম করেছেন, ছেলেগুলি বাইশ-তেইশের মধ্যে। জামাকাপড়, হেয়ার স্টাইল, মোবাইলের মহার্ঘতা এবং মুখের চেহারা দেখে মনে হয় হয় এরা পয়সাঅলা, কিন্তু নিম্নরুচির পরিবারের ছেলে। যেমন এখন চারদিকে প্রচুর হচ্ছে। হিন্দি সিনেমায় নগ্নিকারা সুইটহার্ট, নায়করা এদের রোল মডেল, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ভোগ্যবস্তুর প্রাচুর্যের দিকে এরা লঙ্গরখানাগামী ভিখারিদের মতোই আদেখলা চোখে ছুটে যায়।
কী করে হল—তিনি আবারও কড়া গলায় বললেন, বাড়িতে কি কোনো বন্যজন্তু পোষা হয়?
সেটাই তো!–একটি ছেলে বলে উঠল, বাইপাসের দিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম মানে এই আমরা তিনজন। মেন রাস্তা ছেড়ে একুট পাশের দিকে নেমে, মানে নেচারস কল। আমাদের এই বন্ধু…
নাম কী?
নাম মানে ইয়ে মানে আদিত্য আগরওয়াল…
হ্যাঁ, তারপর বলো…
ও-ই নেমে যায় আগে। কিছুর ওপর ও হুমড়ি খেয়ে পড়ে চিল্লাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
ইতিমধ্যে আদিত্য আগরওয়াল ছেলেটি নেতিয়ে পড়েছে। প্রণব হঠাৎই বুঝলেন সারা সন্ধে রুগি না আসার পরে একটি মক্কেল পেয়ে অতি উৎসাহে তিনি একটু অসাবধানই হয়ে গিয়েছিলেন। একে অবিলম্বে হাসপাতালে পাঠানো দরকার। এক্ষুনি রক্ত দিতে হবে। নেতিয়ে গেছে রুগি। ছেলেগুলিকে বোঝালেন—কেস খুবই সিরিয়াস। ভয় খেয়ে গেল সব।
ডাক্তারবাবু আপনিই ব্যবস্থা করে দিন।
একটু ভেবে প্রণব ফোন লাগালেন ড. জহর দাশকে।
ড. জহর দাশ প্রণব নাথের মাস্টারমশাই। খুব ভালো ছাত্র না হলেও খাঁটিয়ে বলে ড. দাশ তাঁকে স্নেহ করেন এখনও। জানেন, প্রণবের মধ্যে কোনো ফাঁকি বা চালাকি নেই।
এই সময়টা ড. দাশ একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে ডিউটিতে থাকেন।
কী বললে? —ড. দাশের গলায় একটা বিস্ময়। তা ছাড়াও কিছু একটা আছে প্রণব ঠিক ধরতে পারলেন না।
হ্যাঁ, আমি সব রেডি রাখছি। পাঠিয়ে দাও।
তরুণগুলি সন্ত্রস্ত মুখ করে চলে গেল।
আমি সব রেডি রাখছি, পাঠিয়ে দাও—কথাটা প্রণবের ভেতরে কোথাও একটা ওয়ার্নিং বেল বাজাতে লাগল। কেন, তিনি বুঝতে পারলেন না।
ঘড়িতে দশটা বাজল। অ্যাসিন্ট্যান্ট রবিকে চেম্বার বন্ধ করতে বলে গাড়িতে উঠলেন ড, জহর দাশ। দ্রুত হাত ধুয়েছেন। অ্যাপ্রন টাঙিয়েছেন হুকে, তর সইছে না। কেননা আসছে কাল তাঁর পিতৃহীন ভাইপো অবনীশের বিয়ে। কালকে বিকেলের অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিটে একবার চোখ বুলিয়ে রবিকে বললেন সব ক্যানসেল করে দিতে। বাড়ি খুব কাছেই, মহানির্বাণ থেকে একডালিয়া। এই রক্ষা। খোলা দরজা দিয়ে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন ডাক্তার। স্ত্রী গোপা এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, ও কী?
কী?
পেছনে দ্যাখো।
ডাক্তার পেছন ফিরে দেখলেন সিঁড়ি থেকে প্রতি ধাপে দরজা বরাবর তাঁর জুতোর ছাপ, রক্ত। একটু দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়েও বাবার গলা পেয়ে ছুটে এসেছিল। তিনজনেই দেখল জুতোয় রক্তের ছাপ।
জহর একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এত ভয় পাবার কী আছে। একটা অ্যাকসিডেন্ট কেস এসেছিল। হসপিটালে পাঠালাম। চেম্বারে দরজার কাছে রক্ত ছিল বোধহয়। খেয়াল করিনি। রবিটাও…জুতো জোড়া খুলে ফেললেন তিনি। মেয়ে হাত বাড়িয়ে নিল। মোজা পরা পায়ে নিজের বাড়ির দোতলায় উঠতে উঠতে ড. দাশ একদম অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। ওপরে উঠে ঘরের দরজা বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকে যান তিনি সোজা। মোবাইলটা বার করেন নাইন এইট থ্রি ওয়ান ফাইভ নাইন সেভেন জিরো থ্রি থ্রি। এনগেজড। কুশারীর এখন ব্যস্ত থাকারই কথা। তিনি খুব অস্থির হাতে জামাকাপড়গুলো চেয়ারের পিঠে ছুঁড়ে দিলেন, পড়ে গেল লক্ষ করলেন না। ঠান্ডা-গরম মিলিয়ে শাওয়ার নিলেন একটা। তারপর কোনোক্রমে পায়জামাটা গলিয়েই আবার ফোন করলেন নাইন এইট থ্রি ওয়ান.বাজছে। সারে জঁহা সে আচ্ছা। কুশারী ধারেকাছে আছে তো। এক মিনিট প্রায় তারপরে ওধারের কণ্ঠ বলল, ডা. দাশ! বলুন…
যে কেসটা পাঠিয়েছিলুম…
অনুভব ভট্টাচার্য?
হ্যাঁ
ডেড।
জহর একটু থেমে বললেন, আশঙ্কা করেছিলুম। কিন্তু ব্যাপার কী?
ওরা বলল, ময়দানে এমনি আড্ডা মারতে গিয়েছিল, ঘুরছিল, হঠাৎ এই বন্ধুটি মানে অনুভব কিছুর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জন্তুটা অন্ধকারে শনাক্ত করা যায়নি। কালো মতো গোল প্রাণী একটা। বেশ বড়ো। পালিয়ে গেল। কিন্তু অনুভবের অবস্থা ওই…
শজারু?
মনে হচ্ছে।
শিওর নও?
ড. দাশ আজকাল কতরকম নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্র বেরোচ্ছে। জাস্ট হোম মেড। ব্লেড, ছুরি, হেঁসো, চপার এসবে আর অ্যাডভেঞ্চার নেই। দুষ্কৃতীরা নতুন নতুন চিজ বার করছে।
তোমার তাই মনে হয়?
বললাম না, শিওর নই। ওদের মুখে মাদকের গন্ধ নিশ্চয়ই নোট করেছিলেন।
তোমার ধারণা ওরাই নিজেদের মধ্যে…
শিওর নই। আমি ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছি। কে ঝামেলায় যাবে?
ড. দাশ কিছুক্ষণ স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর আর একটা নম্বর টিপলেন। এটাও বেশ খ্যাতনামা বেসরকারি হাসপাতাল।
হ্যালো জেমস, একটা কেস রেফার করেছিলুম।
ইয়েস ডক্টর-আদিত্য আগরওয়াল, এই কিছুক্ষণ আগে মারা গেল, ন্যাস্টি উন্ডস।
কী মনে হয়?
ওরা তো বলছে রাস্তার ধারে ঝোপে এনসি অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছিল। একটা কিছুর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
তোমার কী মনে হয়?
আ অ্যাম থিংকিং…
কী করবে, পুলিশে ইনফর্ম করবে?
স্ট্রেঞ্জ ড. দাশ, আগরওয়ালের বাড়ির লোকেরা চাইছে পুলিশে ইনফর্ম করা হোক, যা-কিছু আপত্তি দেহ কাঁটাছেড়া হবে মর্গে যাবে বলে। কিন্তু সঙ্গী ছেলেগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। বলছে…
কী বলছে?
পুলিশ মিছিমিছি ওদের জড়াবে। ওরা তো যা করার করেছে বন্ধুর জন্য। দিজ আর মানিড পিপল। ড. য়ু নো হোয়াট আই মিন!
ইয়েস।
মোবাইলটা প্রায় হাত থেকে খসেই পড়ে গেল ড. দাশের। কুশারী আর জেমস দু-জনেই হসপিটালের রুটিন ময়না তদন্ত করে বড়ি ছেড়ে দেবে। পার্টি যথেষ্ট টাকা খরচ করেছে। কিন্তু কেস দুটো কাঁটার মতো ফুটে রয়েছে তাঁর ডাক্তারি বিবেকে। একই রকম কেস একই সন্ধেয় দুটো। নতুন কিছু। ডাক্তার হিসেবে তাঁর কিছু কর্তব্য ছিল। এবং…এবং তার চেয়েও বড়ো কথা—প্রশ্ন। প্রশ্ন জাগছে। জন্তুটা কি ময়দান থেকে উড়ে বাইপাস গেল? না কেউ তাকে গাড়ি-টাড়িতে বহন করে নিয়ে গেল?
ভাইপোর বিয়ের বরকঠাগিরিটা ঠিক মন দিয়ে কয়তে পারলেন না ড, দাশ। বিশেষত নাথ দু-তিনবার ফোন করেছিল বলে। আগরওয়াল ছেলেটি কি মারা গেছে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট কী? ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…এই মাঝারি মানের ডাক্তাররা যে-কোনো অস্বাভাবিক কেসের পেছনে এঁটুলির মতো লেগে থাকে। প্রণবকে তিনি ভালোই চেনেন। তার প্রশ্নের সদুত্তর কোনো না কোনো সময়ে তাঁকে দিতেই হবে। আপাতত ভাইপোর বিয়েতে বরযাত্রী যাচ্ছি, বাড়ির বিয়ে… কোন কেস? তাঁর মনে নেই। ও সেইটা? কাঁটা ফুটিয়ে এসেছিল? নাঃ তিনি এখনও খোঁজ করেননি… এসব বলে কাটিয়ে দেওয়া গেছে।
কিন্তু প্রণব নাথ তাঁর প্রশ্নের উত্তর ড, দাশ নয়, অন্য জায়গা থেকে পেয়ে গেলেন। পসারঅলা ডাক্তারদের টিভি দেখবার সময় হয় না, খবরের কাগজ পড়া তো দূরের কথা। কিন্তু প্রণব টিভি দেখবার সময় পান। কতকগুলো অনুষ্ঠান তাঁর বিশেষ প্রিয়। তার মধ্যে একটা হল—অপ্রাকৃত কি এখনও আছে?–এখানেই কোনো মির্যাকল বাবার ভুটিনাশ করেছিল ইলেকট্রনিক মিডিয়া। বাবার চেহারা, তাঁর চরণামৃতর মধ্যে আংটি লুকিয়ে ফেলার কায়দা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই তারা ক্যামেরার আওতায় আনে। জাদুকর পি, সি, সরকারের হাত-সাফাই আর বাবা কামেশ্বরের পা-সাফাই বলে খুব পাবলিসিটি পেয়েছিল খবরটা। এ প্রণব তাঁর প্রশ্নের জবাব পেলেন। একে অবশ্য জবাব ঠিক বলা যাবে না। বিজ্ঞানের নিয়ম হচ্ছে দৃষ্টান্ত জোগাড় করা, যত নজির ততই যুক্তির আওতায়। কোনো ল-এর আওতায় আসার সম্ভাবনা তথ্যের বেশি। সেই তথ্য পেয়ে গেলেন প্রণব অপ্রাকৃত অনুষ্ঠানে।
গ্রামের নাম গহরাশোল। পঞ্চাশোর্ধ কামরান আলি ভিন গাঁয়ে কুটুমবাড়ি গিয়েছিলেন। মাঝখানে বিশাল ধানখেত পড়ে। সেই ধানখেতের মধ্যেই কামরানের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। বুক থেকে নাভি, নাভি বেয়ে নিম্নাঙ্গের দিকেও চলে গেছে ছোটো ছোটো ফুটো, রক্ত জমাট বুকের তলায় ফুটোগুলিও সাক্ষাৎ এক একটি রক্তমুখ। বোঝা যায় স্রেফ রক্তপাতেই মৃত্যু হয়েছে কামরানের। প্রাকৃত এখানেই শেষ হয় না। জামাইডোবা গ্রামে কার্তিক পাল নামে এক ব্যক্তিকে মেলার মাঠের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়। সে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে কাঁটাচুয়া, কাঁটাচুয়া… বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যায়, জ্ঞান আর ফেরে না।
মাঠে, খেতে, বাইপাসে ময়দানে একই রকম। কিন্তু যেবার কানাই মাঝির বাড়ির মধ্যে গগন পাড়ইয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল, সেবার সমস্ত দেশে আতঙ্কের ছায়া নেমে এল। পাড়ইয়ের ক্ষেত্রে মোটামুটি সাক্ষী ছিল কানাই মাঝির বউ রাধা। রাধার জবানবন্দি-সন্ধের পরটায় তখনও কানাই ঘরে ফেরেনি। গগন তার খোঁজে আসে, রাধা তাকে চা দেয়, লেড়ো বিস্কুট দেয়। তারপর সে কুয়োতলার দিকে হাত ধুতে গিয়েছিল। বিকট আর্তনাদ শুনে রাধা ছুটে যায়। দেখে এই কাণ্ড! সে তখনই চ্যাঁচামেচি করে লোক জড়ো করেছিল। জবার পাতা থেঁতো করে গগনের সর্বাঙ্গে লাগায় পাড়াপড়শিরা। কিন্তু গগনকে বাঁচানো যায়নি, সে রাধার দিকে চেয়ে কাঁটাচুয়া, কাঁটাচুয়া… বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কাঁটাচুয়ার খোঁজে পড়শিরা কানাই মাঝির বাড়ি, তার আশপাশ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে লন্ডভন্ড করে ফেলেছিল কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কি না কোনো অজ্ঞাত কারণে স্রেফ শূন্য থেকে এক ধরনের ভয়াবহ শজারু জন্ম নিচ্ছে বা আবির্ভূত হচ্ছে। এবং কোনো একজন ব্যক্তিকে আক্রমণ করে একেবারে খতম করে দিচ্ছে। অপ্রাকৃতর অ্যাংকর বঙ্কিম হেসে তির্যক ভঙ্গিতে বললেন দর্শকদের, আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ দেখিয়ে চলেছি, অপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত বলে কিছু নেই। আপাতদৃষ্টিতে যা অতিপ্রাকৃত বলে মনে হচ্ছে তা আসলে কোনো শঠের চতুরালি। সাধারণ মানুষ খুব সহজে এতে বশ হয়ে যান—ডাকিনী, মন্ত্র-তন্ত্র, ওঝা, মরা মানুষ বেঁচে ওঠা, ভূতের ঢিল—সবেতেই আম-জনতার অগাধ বিশ্বাস। বিশ্বাস করতে পারলে যেন মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। কিছুদিন আগে একটি গ্রাম পুরো খালি হয়ে গিয়েছিল স্রেফ ভূতের ভয়ে। অথচ পরে দেখা গেল রণপা পরে কঙ্কালের মুখোশ পরে কিছু লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভয় দেখাচ্ছিল। এই তথাকথিত শজারু ভূতের রহস্যও সমাধান হয়ে যাবে, যদি মানুষ একটু সহযোগিতা করেন।
বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা শুরু হল, ট্রামে-বাসে, রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে, সরকারি অফিসে…। কেউ বললে—যোগসূত্র আছে কি না দেখো। রাজনীতি। কী রাজনীতি করত ওইসব মৃত মানুষেরা? গ্রামের মানুষগুলি কিছু-না কিছু রাজনীতির খাতায় নাম তোলাতে বাধ্য। কিন্তু দেখা গেল মোটেই সব এক পার্টির নয়। শাসক দল, বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করছে বা বিরোধী দল শাসক দলের সমর্থকদের বেছে বেছে মারছে এমন কোনো তত্ত্ব খাড়া করা গেল না। না, অসবর্ণ বিয়ে নিয়ে রাগারাগি না, কোনো সামান্য সূত্রই পাওয়া গেল না। শহরাঞ্চলে তো ব্যাপার আরও গোলমেলে। তরুণ যুবক, আজকের প্রজন্ম, জিনস আর ছাপ্পা টি শার্ট পরা, পুলিশম্যান খাঁকি উর্দি পরা, আধবুড়ো মাস্টারমশাই ধুতি-শার্ট পরা, লুঙি পরা দোকানদার। রাজনৈতিক সমর্থন, বয়স, কাজ পেশা কোনো সূত্রই খাটছে না।
ডক্টর জহর দাশ একদিন বাড়িতে আলোচনার সময়ে কথাটা বলেই ফেললেন। তিনিই প্রথম ডাক্তার যিনি নাকি শজারু-ফুটো মানুষ রুগি পেয়েছিলেন। স্ত্রী-কন্যার কাছে এ কথাটা বলায় এখন বেশ একটা আত্মপ্রসাদ আছে। কোনো না কোনো একটা বিষয়ে প্রথম হতে কে না চায়?
জহরের কথা শুনে স্ত্রী গোপা তো আতঙ্কিত।
কী সর্বনাশ! শজারু যদি এবার তোমাকে ধরে। ডাক্তার যতই বোঝন শজারুবিদ্ধ মানুষগুলির ডাক্তার বা আত্মীয়স্বজনকেও শজারু তাক করেছে এমন কোনো খবর নেই, ততই গোপা বলে যান, তোমাদের সব কিছুই লাইটলি নেওয়া অভ্যেস। কাল তাক করেনি বলে আজ বা আসছে কাল তাক করবে না তার কোনো গ্যারান্টি আছে? ডাক্তারদের ওপর তো আজকাল সব মানুষের রাগ, কেউ একটা শজারু লেলিয়ে দিলেই হল।
গোপার এখন কাজ হল শোবার আগে বিছানা, খাটের তলা, গাড়িতে ওঠবার আগে সিট খুঁজেপেতে দেখা। পইপই করে স্বামীকে বলে দেন, কোনো রোগীকে অবহেলা করবে না, রোগীর আত্মীয়স্বজনকে রাগাবে না। যথেষ্ট আলোকিত রাস্তা ছাড়া নামবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ড, দাশ যখন বললেন, এসব মেনে চলা অসম্ভব তখন গোপা এমনকি সাশ্রনয়নে নিজের ও মেয়ের মাথার দিব্যিও দিয়ে ফেললেন।
মাথার দিব্যি? সে আবার কী? ড. দাশ ও তাঁর মেয়ে নন্দনা হেসে খুন।
তোরা কোনো জিনিসই সিরিয়াসলি নিবি না। কাঁদো-কাঁদো মুখে গোপা উঠে গেলেন।
নন্দনা নিজের ঘরে বসে আপন মনে পিনকুশনটা ঘোরাচ্ছিল। সে ভাবছে। খুব ভাবছে। পেশায় নন্দনা সাংবাদিক। তবে ফ্রিলান্স। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখনও সে গাঁটছড়া বাঁধেনি। নিজের ইচ্ছেমতো বিষয়ে, কারও আদেশে নয়। কারও দেওয়া কাজ নয়। একদম নিজের পছন্দের বিষয়ে নিজের কায়দায় স্টোরি করে সে। তার টাকার দরকার নেই। বাবা পাঁচ হাজার করে মাসোহারা তার নামে ব্যাঙ্কে জমা করেন। জন্মদিন, পুজো, দোল, রথ যে কোনো উপলক্ষ্যে তাঁর মেয়েকে জিনিসপত্র ছাড়াও টাকা উপহার দেওয়া চাই। তবু নন্দনা কুঁড়ে, বাবা নির্ভর ডাঁটিয়াল হয়ে যায়নি। টাকার অভাব না থাকাটা একটা ঐশ্বরিক আশীর্বাদ এটা সে তাদের কাজের মেয়ে জলি, তার বাবার চেম্বারের রিসেপশনিস্ট অণিমা এবং আরও অনেককে দেখে দেখে বুঝতে শিখেছে। জলি বেচারি গ্রামের হলেও ভদ্র কৃষক ঘরের মেয়ে, মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছিল। কিন্তু গঙ্গার ভাঙনে তাদের গ্রাম তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে জমিজমা, বাড়িঘর, ইস্কুল, বাবা সব। পড়াশোনা বিসর্জন দিয়ে জলি আর তার মা শহরে এসে বাড়ির কাজের লোকের দলে নাম লিখিয়েছে। জলি দেখতেও ঢোটলে। ভারি শান্ত, সশ্রী, কথাবার্তায় কোনো গ্রাম্য টান নেই। অনেক কবিতা মুখস্থ বলতে পারে। হিসেবপত্তরে ওর কখনও ভুল হয় না। খুব সংকোচের সঙ্গে ও নন্দনার কাছ থেকে কবিতার বই, গল্পের বই পড়তে চায়। নন্দনার মা প্রায়ই বলেন জলির অনেক ভাগ্য যে সে তাঁদের মতো ভদ্র বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে। নন্দনার মনে হয়, এর উলটোটাও তো সত্যি, জলির মতো লোক পেয়ে তারাও কি বর্তে যায়নি! জিনিসপত্রের মর্যাদা বোঝে। বই কখনও এদিক-ওদিক করে না। নন্দনার যা-কিছু ফরমাশ হাসিমুখে খাটে। লেখবার সময়ে নন্দনার বারেবারে ফ্রেশ চা চাই। কে এনে দেয় বুঝেসুঝে জলি ছাড়া? একটি ভদ্র ভূসম্পত্তিওলা পরিবারের মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া চমৎকার মেয়ে কলেজে না গিয়ে নন্দনাদের সুখসুবিধে দেখছে! তাদের জুতো পালিশ, তাদের ঘর গুছোনো, জামাকাপড় কেচে ইস্ত্রি করে যার যার ঘরে রেখে আসা! ভালো মন্দ খাবার তৈরিতেও সে এক্সপার্ট। নন্দনার বন্ধুরা এলে জলিকে বলতে হয় না। প্রথমেই এক দফা কফি দেবে। তারপর বিশেষ ফরমাশটা কী জেনে নেবে। আধ ঘন্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট বড়ো জোর।
অণিমা মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। লেখাপড়ায় খুব ভালো না হলেও পাস কোর্সে বিএ পাস করেছে। ওর বাবা কিছুতেই বরপণ জোগাড় করে উঠতে পারেননি। তাই অণিমা ডক্টর দাশের চেম্বারে কাটা চুল ফুলিয়ে, ঠোটে লিপস্টিক, রিসেপশনিস্টের কাজ করে। নন্দনাকে দেখসেই আগে আগে উঠে দাঁড়াত, নন্দনা অনেক বলে বলে সেটা বন্ধ করেছে।
বাবার টাকায় ফুটানি করার মনোবৃত্তি নন্দনার নেই। তাই বলে সে যেমন করে হোক নিজের উপার্জনের জন্যও হন্যে হয়ে ওঠেনি। বাবার সে একমাত্র মেয়ে, টাকার জন্য কোনোদিন তাকে কারও কাছে খেলো হতে হবে না। এটা, ওই যে বললাম, তার কাছে ঐশ্বরিক আশীর্বাদ বলে মনে হয়। তাই সে টাকার জন্যে নয়, নিজের খুশিতে সংবাদ খোঁজে। লেখে, অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানই তার লেখা প্রায়ই বার করে। নন্দনা লেসবিয়ানদের নিয়ে লিখেছে। ভারতের ক্রিকেট-জ্বর নিয়ে লিখেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা লিখেছে। নন্দনা দাশ অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত নাম।
পিনকুশনটা বাঁইবাঁই করে ঘুরছিল। হঠাৎ নন্দনার মনে হল ওই পিনকুশনটাই তার এবারের বিষয়। তার অবচেতন থেকে বিষয়টা উঠে আসছে। পিনকুশনটা প্রতীক। শজারু-বিদ্ধ মানবদেহের।
বেশ কিছুকাল আগে স্টোনম্যান নামে এক আতঙ্ক আবিভূর্ত হয়েছিল কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়। তখন সে বেশ ছোটো। সে সমস্যাটার সমাধান হয়নি। যে বা যারা রাতের আঁধারে ফুটপাতের ঘুমন্ত গরিব মানুষের বা পথচারীদের মাথা পাথরের আঘাতে থেঁতলে দিত, তারা হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল পুলিশকে বোকা বানিয়ে। শজারু আতঙ্ক এখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে ঠিকই, কোথাও বাদ নেই। যেদিন একটা ইংরেজি কাগজের পাতায় শজারুর আবির্ভাবের কথা জানা গেল, সেদিন থেকে তো পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে আর কোনো আলোচনা নেই। দিল্লিতে শজারুর আক্রমণে মারা গেছে তেইশ জন। শুধু দিল্লি শহরেই। বিহারে সাতাশি জন। লখনউ শহরে তেরোটি, কলকাতায় সরকারিভাবে আটাশ, লোকে বলছে এর উলটোটাও হতে পারে, অর্থাৎ বিরাশিটি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-গঞ্জের কোনও স্ট্যাটিস্টিকস নেই।
যেমন হঠাৎ একদিন আবিভূর্ত হয়েছে তেমনই হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যাবে শজারু-আতঙ্ক। নিশ্চয় কেউ বা কারা কোনো উপায়ে এই আতঙ্ক তৈরি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য কী? শুধু আতঙ্ক ছড়ানো? এক ধরনের টেররিজম? যেন এ জিনিসের কিছু কম আছে এখন পৃথিবীতে! নন্দনা ঠিক করল সে নয়নপুর গ্রামের কানাই মাঝির বউ রাধা মাঝিকে ইন্টারভিউ করবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। নয়নপুর হুগলি জেলার একটি মোটের ওপর সমৃদ্ধ গ্রাম। ট্রেন থেকে নেমে বাসে যেতে হয় মাইল দশেক। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন কানাই মাঝির ঘরে পৌঁছোল নন্দনা তখন বেলা পড়ে এসেছে। বউটি দাওয়ায় বসে কুলোয় করে চাল ঝাড়ছিল। নন্দনাকে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। অজ গাঁয়ে একজন শার্ট-প্যান্ট পরা বব চুল সোমন্থ যুবতি, কাঁধে ক্যামেরা, হাতে ঝোলা ব্যাগ…
কে আপনি?
আমি খবরের কাগজের লোক। আপনাকে ইন্টারভিউ করতে, মানে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
আজ্ঞে খবরের কাগজ তো ইন্টারভু নিয়ে গেছে।
আমি অন্য কাগজের লোক। আপনাকে একটুও বিরক্ত করব না।
সন্ত্রস্ত গলায় বউটি বলল, আমার সোয়ামি আসার আগে যা করার করুন। সে এসব পছন্দ করে না।
আচ্ছা। গগন পাড়ই আপনার স্বামীর কেমন বন্ধু ছিল?
খুব বন্ধু। মাঝি কখনও স্যাঙাতকে মারবে না, তা বলে দিলুম।
না, না, তা বলছি না আপনার সঙ্গে কীরকম সম্পর্ক ছিল!
মেয়েটি এবার ঝেঝে উঠল, মেয়েছেলে হয়ে কথার ছিরি দ্যাখো। সোয়ামির স্যাঙাত তো আমার কে? আমার কী? এলে বাটি করে চা দেব, দুটো মুড়ি দেব বাস, ফুরিয়ে গেল।
সেদিন গগনকে মুড়ি-চা দিয়েছিলেন?
বিস্কুট দিয়েছিলুম সাধের স্যাঙাতকে।
আহা রাগ করছেন কেন? কুয়োতলার দিকে উনি গেলেন কেন?
সে কি আমাকে বলে গিয়েছিল? ব্যাটাছেলে কোথায় যাচ্ছে না-যাচ্ছে, জিগ্যেস করতে গেলুম আর কি! তারপরে তখন আমার কী গা বিড়োচ্ছে, বাপরে!
গা বিড়োচ্ছে?
হ্যাঁ গো দিদি, হঠাৎ কেমন যেন সব ঘুলিয়ে উঠল। ভীষণ বমি পাচ্ছে, চক্ষে আঁধার দেখছি, শরীরটা কেমন করছে…তখন সে কুয়োয় গেছে, কী মাঠে নেমে গেছে খেয়াল করবার অবোস্তা আমার?
তা কী করে ঠিক হল?
কিছুক্ষণ পর আপনাআপনি ঠিক হয়ে গেল। আমি তো ভেবেছি পেটে এবার কিছু একটা এল বোধ হয়।
তা এসেছে?
বউটি বিমর্ষ মুখ বলল, নাহ। সে ভাগ্যি করে কি এসেছি!
কখন চিৎকার শুনতে পেলেন স্যাঙাতের?
শুনতে পাচ্ছিলুম, মোটে নড়তে পারিনি। তারপর শরীরটা একটু ঠিক হতে যাই, লোকজন ডাকি।
গগন লোকটা কেমন ছিল?
বউটি মুখ বিকৃত করে নিজের কাজে মন দিল।
কেমন আবার?
ক্যামেরা টেপ-রেকর্ডার সব গুটিয়ে নন্দনা স্টেশনের দিকে রওনা হল। সে একটু ভাবিত হয়ে পড়েছে। একটি মাত্র ইন্টারভিউ নেওয়া গেল, তা-ও সন্তোষজনক নয়। অন্য কোনো কেসের প্রত্যক্ষদর্শী বলে কেউ নেই। সাক্ষী-সাবুদ হলে সে কী রিপোর্ট করবে, তদন্তই বা কী, আর স্টোরিই বা কী?
ইতিমধ্যে শজারুর নতুন শিকার, আবার শজারু, ভূতুড়ে শজারু নাম দিয়ে নানা কাগজে নানান সংবাদ বেরিয়েই চলেছে, বেরিয়েই চলেছে।
সেদিন সন্ধেবেলা। শীতের সন্ধে যেন কুটকুটে ভোটকম্বলের মতো নেমে পড়েছে শহরতলিতে, হাওয়া নেই, তাই যত কিছু দূষণ আটকে রয়েছে ভূগোলকের ওপর। মা বললেন, রুণা আজ আর পড়তে যাসনি।
রুণা চুল আঁচড়াচ্ছিল। তার মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে এসে গেছে। অঙ্ক-সায়েন্স বাঘ। সপ্তাহে তিন দিন পড়তে যায়। একদিন বাদ গেলে স্যার আর একটা দিন বার করতে পারবেন না। কিন্তু মা-র বোধহয় শরীরটা আজও ভালো নেই, সে বলল, মা তুমি চুপচাপ শুয়ে থাক, আমি বেশিক্ষণ পড়ব না। জাস্ট একটা চ্যাপ্টার বুঝে নিয়ে চলে আসব।
ঠিক আসিস কিন্তু। বলে মা চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
রুণার মনটা হালকা। স্যার ভালো পড়ান। ফিজিক্স, বায়োলজিতে আগের ভয়টা তার আর নেই। কেমিস্ট্রিতে বড্ড মুখস্ত করতে হয়, এটাই মুশকিল। আগে জিয়োমেট্রিক রাইডারগুলো সে বেশিরভাগই পারত না। শশাঙ্ক স্যারের কাছে কোচিং নেবার ছ মাসের মধ্যে এ ব্যাপারেও তার অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে তার পড়াশোনাটা একটা দুর্ভেদ্যে দুর্গ বলে মনে হত। শশাঙ্ক স্যারের দৌলতে এখন তার বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সায়েন্স গ্রুপে লেটার মার্কস পাওয়াটাই এখন রুণার লক্ষ্য। বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাসে তার কোনো সমস্যা নেই। ইতিহাসে মেমারির সমস্যা ছিল। সেটাও স্যার কীভাবে কী পদ্ধতি অনুসরণ করে মনে রাখতে হয় শিখিয়ে দিয়েছেন। এগারোশো, বারোশো, তেরশো, চোদ্দশো সব সনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো সে লম্বা সারি করে পর পর লিখে রাখে। বাস। জয়েন্ট দেবার ইচ্ছে রুণার নেই। সে পিয়োর সায়েন্স পড়বে, গবেষক হবে। সেদিনই বাবা কাগজে পড়ে বলছিলেন, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের চর্চা সাংঘাতিক কমে গেছে আমাদের দেশে। বিজ্ঞানের মহা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সে বিজ্ঞানী হবে। নানান বিষয়ে কৌতূহল জাগছে তার। বেণি দুলিয়ে, ঝোলা ব্যাগ কাঁধে স্কার্ট পরা রুণা বেশ আত্মমগ্ন হয়ে চলেছে। এই মূহুর্তে তার মায়ের জ্বরের কথা মনে নেই। এ সেই মধ্য-কৈশোর যখন মা-বাবা স্মৃতির পেছন কোঠায় স্থান নিতে থাকে। সামনের কোঠাগুলো দখল করতে থাকে বন্ধুবান্ধব। প্রতিদিনকার উত্তেজক বর্তমান, ভবিষ্যতের হাতছানি, নানারকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং নিজে নিজে, যাকে বলে স্বয়ং। রুণার চারদিকের পৃথিবী রঙিন, বাস্তবে তা যতই দূষিত, কৃষ্ণবর্ণ ধূলিধূসর হোক না কেন।
শশাঙ্ক স্যার একটা বাড়ির একতলায় ঘর নিয়েছেন। এখানেই কোচিং করেন। ওপরে থাকেন এক বয়স্ক দম্পতি। তাঁদের সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। দরজাটা খোলাই থাকে। আজ দেড় ঘন্টা তাকে একা সময় দিয়েছেন স্যার মাধ্যমিক এসে গেছে বলে। পরের দেড় ঘন্টা অম্বু অর্থাৎ অম্বুজের। ও এইচএস দেবে। সারাবছর ক্লাস সিস্টেমে পড়া, কিন্তু পরীক্ষার মুখোমুখি সময়ে এইটুকু তাদের জন্যে করেন স্যার, এর জন্য বেশি চার্জ নেন অবশ্য। কিন্তু কী করা যাবে!
দরজা খুলে ঘরে ঢুকল রুণা। কেমন একটা বুনো গন্ধ। জান্তব। রুণা কোনোক্রমে টলতে টলতে ভেতরে ঢুকল। স্যার, স্যার একটা গোঙানির মতো আর্তনাদ তার গলায়, সে চিৎকার করে জ্ঞান হারাল। স্যার কৌচের ওপর ধসে পড়েছেন, শরীর দিয়ে ঝুঝিয়ে রক্ত ঝরছে।
পরে ডাক্তার এসে দেখে বললেন, হিউম্যান পিনকুশন হয়ে গেছেন ইনি। পিনগুলো মিসিং। একটি মাত্র সন্দেহজনক তথ্যের আভাস পাওয়া গেল এক্ষেত্রে।
অম্বু। অম্বুজের দেড় ঘন্টা পরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সে দেড় ঘন্টা আগেই এসেছে। রুণার আর্তনাদ শুনে সেই প্রথম ছুটে আসে। কেন?
পুলিশ প্রশ্ন করছে—কেন?–অম্বুর কাছে কোনো সদুত্তর নেই। তাকে তন্নতন্ন করে ঘেঁটে ফেলা হয়েছে—একটা ক্যালকুলাস কষা খাতা, আর একটা এইচএস এর ফিজিস্কের বই ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে যা আশ্চর্য তা হল শশাঙ্ক পুরকায়স্থর চোখের দৃষ্টি, আতঙ্ক যেন ছিটকে আসছে।
এই রুণার কেসটা পড়বার পর নন্দনার নতুন করে আশা জাগল, স্টোরিটা সে করতে পারবে।
একডালিয়া থেকে বারাসত অনেক দূর। তবে বাইপাস দিয়ে হু-হু করে যাওয়াই যায়। ইদানীং বাবা-মার বাইপাসে আতঙ্ক। কলকাতার সবচেয়ে বেশি শজারু-মৃত্যু বাইপাস ও সংলগ্ন অঞ্চলেই হয়েছে। মা বিশেষ করে ভীষণ রাগারাগি করেন, ভয়ও পান খুব। নন্দনা মনে মনে হাসে। সে ঠিক ফাঁক খুঁজে নেবে। প্রতি শুক্রবার মা তাঁর সমাজসেবা কেন্দ্রর কাজে যান। কী সমাজসেবা হয় তার বিশদ বিবরণ নন্দনাকে মাঝেমধ্যেই শুনতে হয়। মা আবার সেক্রেটারি। মাসের একটা অধিবেশনে মাকে রিপোর্ট পেশ করতে হয়। আজ সেই শুক্রবার। নন্দনা ফাইল, টেপ, ক্যামেরা গুছিয়ে নিয়েছে। প্রায় পা টিপেটিপেই বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, ইশ এ শুক্রবার বাবা সকাল সকাল ফিরবেন। মা থাকবেন না, সে থাকবে না। সে জলিকে ডেকে বলে গেল। বাবাকে যেন ঠিকমতো খাবার-টাবার দেওয়া হয়। সাধারণত এ কাজটা মা বাবা সে-ই করে, বাবা অন্যদের হাতে খাবার-টাবার
একেবারে পছন্দ করেন না। ধারেকাছে লোকজন থাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, সে যত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই হোক না কেন।
একটা দিন, বাবা প্লিজ চালিয়ে নাও।
বিশ্বাস করুন আমার মেয়ে কিছু জানো না।–রুণার মা বললেন, আমাদের একটা দিনও স্বস্তিতে কাটছে না। কোনো না কোনো কাগজ, টিভি চ্যানেল থেকে লোক আসছেই। আচ্ছা তুমিই বলো, তোমাকে তুমি বলছি—একটা এই বয়সের মেয়ে এই রকম একটা ক্রাইমের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে, কাগজে টিভি-তে তার ছবি প্রচার করলে তার ভবিষ্যৎটা কী হবে! তার ওপর পরীক্ষা মুখের গোড়ায়।
নন্দনা বলল, মাসিমা, আপনাকে মাসিমাই বলছি, এটা তো মানবেন। যে এটা ভয়ানক এক সন্ত্রাস, যার কোনো সূত্র, কোনো প্রমাণ আমরা পাচ্ছি না। সমাধান করতে না পারলে আপনার বাড়ি আমার বাড়িতেই আক্রমণ হবে না, কে বলতে পারে! চিহ্নিত করা দরকার এই শয়তানকে। আমরা কেউ সেফ নই, মাসিমা।
আমরা আর কবে সেফ ছিলাম! বলো, উঠতি বয়সের মেয়েকে নিয়ে যে আমাদের কী ভয়ে ভয়ে দিন কাটে! ঠিক আছে তুমি যদি ছবি তুলবে না, আসল নাম ব্যবহার করবে না কথা দাও—তো ডাকছি।
রুণা মেয়েটি খুব স্মার্ট। কিন্তু শজারুর উল্লেখে তার মুখে আতঙ্কের ছায়া দেখলে যে কোনো মানুষ ভয় পাবে। ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল রুণার মুখ। নন্দনা যখন বলল, ভালো করে মনে করো কখন ঠিক কীভাবে ওঁকে দেখলে। কেউ ধারেকাছে ছিল কি না। তুমি সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলে কি না।
রুণার ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে যেতে থাকল। যেন দৃশ্যটা এখনও তার চোখের সামনে ঘটছে।
অনেকটা সময় দেওয়া সত্ত্বেও রুণার থেকে বিশেষ কিছুই কথা বার করা গেল। সে যে ঘরে একটা বিশ্রী বুনো গন্ধ পেয়েছিল, তার অবিশ্রান্ত মাথা ঘুরছিল। গা বমি করছিল, চোখের সামনে যেন একটা ধূসর কুয়াশার পর্দা ঝুলছিল, সেভাবে সে কিছুই দেখতে পায়নি। ঘোরটা কেটে যেতে দেখে তবে ভয়ানক দৃশ্যটা তার চোখে পড়েছে—এইটুকুই। কোনো জন্তু-জানোয়ার কিছু না।
নন্দনার মনে হল মেয়েটি কিছু যেন একটা চেপে যাচ্ছে। সে বলল, মাসিমা। যদি কিছু মনে না করেন আমাকে একটু চা খাওয়াবেন?
নিশ্চয়ই—ভদ্রমহিলার নন্দনাকে ভালো লেগেছে।
রুণা চটপট বল তো-নন্দনা বেশ হাসি-হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, অম্বুজকে ধারে-কাছে পাওয়া গেল কেন? তুমি নিশ্চয়ই জানো ও পুলিশের নজরে আছে!
এবার রুণার লাল হয়ে গেল, তারপর ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। সে ফিসফিস করে বলল, আপনাকে বলছি দিদি, প্লিজ আর কাউকে বলবেন না। আমি পনেরো মিনিট আগে বেরোতাম আর অম্বু পনেরো মিনিট আগে পৌঁছে যেত। ওই আধঘন্টা আমরা একটু গল্প করতাম হাঁটতে হাঁটতে।
অম্বুজ তোমার বন্ধু?
আবার লাল হয়ে রুণা বলল, হ্যাঁ, মানে ওই, কাউকে বলবেন না।
না, এ আবার কাউকে বলে না কি? তা ছাড়া এ তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তুমি অত লজ্জা পাচ্ছ কেন? আচ্ছা রুণা অম্বুজ ছেলেটি তো সেদিন আরও অনেক আগে চলে এসেছিল…
ম মানে ও ওইরকম করছিল। ওর সইছিল না। সারাক্ষণ পায়চারি করবে।
তার পরে তোমার আর ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না দিদি। আমি তো বেরোই-ই না। মা ফোন পর্যন্ত গার্ড দিয়ে রেখেছে।
আচ্ছা। অম্বুজের ঠিকানাটা আমায় দাও।
রুবি হসপিটালের কাছে নন্দনা পৌঁছে গেল। তখন তার ঘড়িতে আটটা বাজছে।
তার মোবাইলটা ঝনঝন করে বাজছে। এখন ধরার উপায় নেই।
বাইক চালাতে চালাতে মোবাইল সে ধরে না। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবার বাসনা তার নেই। থেমে গেছে। কিন্তু আবার বাজছে। বিজন সেতু থেকে নেমে একডালিয়ার মোড়ে বাইকটা এক পাশ করে সে মোবাইলটা তুলল, মিসড কল। এ তো বাড়ির নম্বর! আবার একটা মিসড কল—সেটাও বাড়ির নম্বর। তার মানে মা এসে গেছে। সে তো পৌঁছেই গেল। আর এখন কলের জবাব দেবার দরকার নেই। একডালিয়া ঢোকার মুখে সে দেখল একটা পুলিশের কালো গাড়ি। একটা অ্যাম্বুল্যান্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে গেল। ভিড় কাটাতে কাটাতে সে শুধু আশপাশ থেকে কটা টুকরো কথা শুনতে পেল, একেবারে খোদ ডাক্তারের বাড়ি, ভাবতে পারেন দোতলায় উঠল কী বেয়ে? ভয়াবহ।… তা-ও ভরসন্ধেবেলা, মাঝরাত্তির তো নয়। কেউ দেখতে পেল না।
কী ব্যাপার? চোর ডাকাত না কি? ডাক্তার? এখানে আরও ডাক্তার থাকেন। ডক্টর শ্রীমানী, ডক্টর প্রীতি চ্যাটার্জি। তবে একটু এগিয়ে সে বুঝতে পারল ঘটনা যা-ই ঘটে থাকুক, সেটা তাদের বাড়িতেই। লোকে লোকারণ্য। তাকে পথ ছেড়ে দিল সবাই। দু-চার লাফে সিঁড়ি টপকে টপকে সে ওপরে উঠে গেল। কেউ নেই, লোকজনের মধ্যে বাহাদুর নীচে ভ্যাবলার মতো ধপাস করে বসে আছে। আর ওপরে জ্যাঠতুতো দাদা অবনীশ যার সেদিন বিয়ে হল আর কেউ নেই। রাত সাড়ে আটটায় যেন বাড়িতে মাঝরাত নেমে এসেছে।
এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও অবুদাকে দেখে নন্দনার মন বিস্বাদ হয়ে উঠেছিল। সে অবনীশকে পছন্দ করে না। ছোটো থেকেই তারা আদায়-কাঁচকলায়। ঝগড়াঝাঁটি নেই। কিন্তু সে অন্তত এই কাজিনটিকে এড়িয়ে যায়। কারণ অনেক।
সে যাই হোক আজ অবনীশকে বিধবস্ত লাগছিল। বলল, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? বাড়িতে এত বড় একটা বিপদ হয়ে গেল!
কী হয়েছে? নন্দনার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে ভয়ে। মা কোথায়? আর সব? বাবা? জলি?
অবনীশ একটু ইতস্তত করল। সময় নিল, তারপর বলল, মনটা শক্ত কর বাচ্চু। শজারু…আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছে। কাকাবাবু… জলি খাবার দিতে গিয়ে দেখে… সে-ও অজ্ঞান। কাকিমা ছিলেন না। পরে এসে দেখেন এই কাণ্ড। এই সময়টা কোনো হেল্প ছিল না। জানি না কী হবে!
নন্দনার ভেতর থেকে একটা ফোঁপানি উঠে আসছে। সে সেটাকে প্রাণপণে চাপা দেবার চেষ্টা করছে। ভেতরে ভেতরে ওইভাবে কাঁদতে কাঁদতে সে বাবার ঘরের দিকে ছুটল। হা-হা করছে দরজা। ভেতরে টাটকা রক্তের স্বাদ। তাড়াতাড়ি করে মুছে নেওয়া হয়েছে মেঝে। ন্যাড়া গদি কামানো মাথার মতো তার দিকে চেয়ে রয়েছে।
কোন হসপিটাল? সে কোনোমতে জিজ্ঞেস করল। তার এক চমকে মনে পড়ে যাচ্ছে মায়ের সাবধানবাণী। মা মাথার দিব্যি দিয়েছিলেন। তারা হেসেছিল। আড়ালে বসে আরও কেউ বোধহয় হেসেছিল।
অবনীশ এবার এগিয়ে এসে তার হাত ধরল, বাচ্চু প্লিজ, তুই এরকম ভেঙে পড়িসনি। তোর এই অবস্থা হলে কাকিমার কী হবে বল তো!
ব্যস, নন্দনার আর আবেগের বাঁধ থাকল না। ঝড়ের সমুদ্রের মতো সে ভেঙে পড়ল বাবার বিছানার গদির ওপর। সে জানে কোনো আশা নেই। একজনও বাঁচেনি। প্রথম দুটো কেসই তো বাবার নিজের। যথেষ্ট মেডিক্যাল হেল্প পেয়েছিল। বাঁচেনি। আর বাবার ক্ষেত্রে কুড়ি মিনিট কি আধঘন্টা কত দেরি হয়েছিল ভগবানই জানেন।
অবনীশ এবার গভীর মমতায় তার কাঁধে হাত রাখল, বাচ্চু তুই একটা শক্ত, বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুই এরকম করবি! তোর সেলফ কনট্রোল কোথার গেল? একটু সামলে নে প্লিজ। তোকে নিয়ে যাব বলেই তো আমি অপেক্ষা করছি। কাকিমা বারবার করে বলে গেছেন তোকে যেন একলা না ছাড়ি।
নন্দনা কোনো কথাই বলতে পারছে না। গদিটা আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে প্রাণপণে। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে, বাবা! বাবা!
অবনীশের চোখ ছলছল করছে। সে হঠাৎ নীচু হয়ে ভেঙে পড়া নন্দনাকে জোর করে তুলে ধরল। গাঢ় গলায় বলল, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে বাছু? এই টপটা তুই খুলে ফ্যাল।
নন্দনার টপের জিপার চড়াত করে খুলে গেল।
তুই এই জিনসটাও খোল—তার গলা ধরে এসেছে। চোখ ধকধক করছে অস্থির হাত এখন চলে যাচ্ছে প্যান্টের জিপারে। নিবিড়ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছে অবনীশ। তুই অসহ্য সুন্দর বাচ্চু, শোকে তোকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। তুই আমায় পাগল করে দিস, ওহ—চকিতের মধ্যে তার বুকের ভাঁজে ঢুকে গেল অবনীশের ঠোঁট।
আর তার পরেই সে দেখল তার ঠোঁট জোড়া যেন পেরেকে গেঁথে গেছে। ক্রমশ শোকসন্ধ্যার অন্ধকার আরও দম বন্ধ করা, ক্রমশ এক বুনো জান্তব গন্ধে ভরে যায় ঘর। প্রবল বমি পেতে থাকে নন্দনার। তার বাহ্যসংজ্ঞা লোপ পাচ্ছে। সামনে দুলছে কুয়াশার পর্দা। ভেদ করে কিছু দেখা যায় না। প্রত্যেকটি লোমকূপ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে চকচকে মসৃণ তীক্ষ্ণদৃঢ় শলাকা। শিউরে শিউরে উঠছে গা। হাড়গোড় মানছে না, গুটিয়ে বর্তুলাকার হয়ে যাচ্ছে শরীর। অসহ্য মোচড়াচ্ছে।
দু-চার মিনিটের ব্যাপার। শলাকা ত্বরিতে গুটিয়ে যায় ত্বকের মধ্যে। এত চিকন যে তাতে কোনো ক্লেদ লেগে থাকে না। বর্তুলাকার বদলে সটান হয়ে যায় শরীর। মাথায় ঝিম ধরে আছে, যেন সে নেশাগ্রস্ত। মেঝের ওপর এক হাত এলিয়ে পড়ে থাকে এক অর্ধনগ্ন অর্ধচেতন তরুণী। অদূরে ছিটকে পড়ে থাকে এক যুবকদেহ। বিমুখ রক্তরা সহস্র ছিদ্রপথে বেরিয়ে আসছে। চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে ভয়।
ক্রমে জ্ঞান ফেরে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় ডক্টর দাশের উচ্চশিক্ষিত কন্যা। পেশায় সাংবাদিক। এই দৃশ্য সে এই প্রথম দেখল। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে তার। কাঁপা হাতে ঊধ্বাঙ্গের জামা পরে নেয় সে, জিনস কোমরে তোলে, আঠা-আঠা হাতে ফোনের ডায়াল ঘোরায়। প্রথমে অ্যাম্বুল্যান্স, তারপর পুলিশ, তারপরে মা। ম মা-আআ র বাচ্চু বলছি, শ শ জারুটা যায়নি মা, অবনীশদাকে…। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে নন্দনা, অকারণেই হাত বোলায় মসৃণ বাহুতে। কী যেন! কী যেন! তার মনে পড়ে না। সে কিছু জানে না। গিরগিটি যখন রং বদলায়—লাল, হলুদ, সবুজ—সে কি বুঝতে পারে? জানে? প্রকৃতি জানে। গিরগিটি জানে না।