Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কলিংবেল || Tarapada Roy

কলিংবেল || Tarapada Roy

কলিংবেল

…সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।

পায়ের শব্দ উপরের দিকে উঠে আসছে।

ক্রিং-ক্রিং ক্রিং।

কলিংবেল বেজে উঠল।…

সেই কবে জ্ঞান হওয়া থেকে, বলা উচিত, বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ পেরুনোর পর থেকেই, রহস্য উপন্যাস পড়ে আসছি। সেই থেকে আমার কলিংবেলের সঙ্গে পরিচয়। তখন কলিংবেল চোখেও দেখিনি, আমাদের বহু দূরের মফস্বল শহরে বিদ্যুৎই ছিল না কলিংবেল থাকবে কী করে?

কলিংবেল নামক বস্তুটির সঙ্গে আমার চাক্ষুষ আলাপ পনেরো বছর বয়েসে কলকাতায় এসে। তার আগে আরও দু’-একবার কলকাতায় আসিনি তা নয়, কিন্তু আমরা উঠতাম শ্যামবাজারে, সেখানে কোনও বাড়িতে কলিংবেল তখন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মফস্বলের মতোই লোকেরা বাড়ির রোয়াকে উঠে ডাকত, ‘শ্যামবাবু বাড়ি আছেন নাকি?’ সাড়া না পেলে আরও চেঁচিয়ে তারপর আরও চেঁচিয়ে শ্যামবাবুর অনুসন্ধান চলত যতক্ষণ পর্যন্ত না উত্তর আসে। আর তা ছাড়া দরজা খোলা থাকলে, একটু জানাশোনা থাকলে যে কোনও দিগ্‌গজের বাড়িতে যে কেউ উঠোনে বা ভিতরে ঢুকে পড়ত, এটা কোনও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, কোনও জানান দেওয়ার আবশ্যক ছিল না। এমনকী গলা-খাঁকারি দিতেও হত না।

কিন্তু ইতিমধ্যে মোহন সিরিজ, কিরীটি রায় রহস্য কাহিনীর পৃষ্ঠা অতিক্রম করে ক্রিং ক্রিং করে কলিংবেল এসে গেছে, বাড়িতে বাড়িতে সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু বাংলা রহস্য উপন্যাসেই নয় এই ফাঁকে বিলিতি রোমাঞ্চমালাতেও ক্রমাগত শুনেছি কলিংবেলের শব্দ, কখনও শব্দের মুহূর্তেই শব্দের ঠিক ওপাশে মারাত্মক সমস্ত রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে গেছে। রোমহর্ষক না হলেও আমার এখনকার প্রিয়তম গোয়েন্দা নায়ক ফেলুদার বাড়িতে একবার বিনা বিদ্যুতেই লোডশেডিংয়ের সময় কলিংবেল বেজেছিল।।

অবশ্য বিদ্যুৎহীন কলিংবেল যে নেই তা নয়, অনেক অফিসের টেবিলেই সেটা বাজে, সেটা বাজিয়ে বড় সাহেবরা কীভাবে চাপরাশিদের ডাকতেন, নাকি তখন চাপরাশিদের ডাকবার জন্যে চাপরাশি ছিল।

অফিসের কলিংবেল নয়, বাড়ির কলিংবেলের কথা বলি। বাড়ির দরজায় কলিংবেল দেখলেই আমার মফস্বলি মনে কীরকম একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর একটা সম্ভাব্য কারণ বোধহয় এই, বছর পনেরো আগে একবার এক প্রচণ্ড বর্ষার দিনে সন্ধ্যাবেলা এক বাড়ির ভিজে দরজায় কলিংবেল টিপতে গিয়ে এমন সাংঘাতিক ইলেকট্রিক শক খেয়েছিলাম ভাবতে গেলে এখনও পায়ের তালু থেকে মাথার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত ঝিনঝন করে ওঠে। এর পর থেকে কোনও বাড়ির দরজায় কলিংবেল দেখলেই আমি ভয় পাই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে যে বাড়িতে বিশেষ প্রয়োজনে সাত রাজ্য পার হয়ে চারবার ট্রাম বাস বদলিয়ে তারপর এসে পৌঁছেছি, সেখানে ঢুকতে কেমন একটা ভয় হয়, সাহস হয় না বেল টিপতে, ইচ্ছে হয় ফিরে যাই।

কিন্তু উপায় নেই। এখন এমন একটি বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন যার সদর দরজা বন্ধ থাকে না এবং যে দরজায় একটি কলিংবেল লাগানো থাকে না। সদর দরজা হাট করে খুলে বাইতের বসে যারা হইহই করে গল্প করত, তক্তপোশে বসে তাস খেলত সেই লোকেরা কোথায় গেল?

সে যা হোক, একটা কলিংবেল তবু ভাল, অনেক বাড়ির দরজায় একাধিক কলিংবেল লাগানো থাকে। তখন একটা সমস্যা, হেড না টেল, কোনটা আসল, উপরেরটা না নীচেরটা কোনটা বাজবে?

দুটোই বাজিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হয় কোনটা বাজে? বাজে মানে ক্রিয়াপদ, বিশেষণ নয়। কোনটা থেকে শব্দ বেরয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাপত্রও কি ছিদ্রহীন? অনেক বাড়িতেই কলিংবেলের ঘণ্টা যন্ত্রটি থাকে বহিরাগতের শ্রুতি সীমার বাইরে, তখন বারবার বাজিয়ে অধীরভাবে কান পেতে থাকতে হয়, বেল বাজল কিনা, সিঁড়িতে কিংবা বারান্দায় কারও পায়ের শব্দ পাওয়া যায় কিনা।

অনেক সময় আবার খুব গোলমালও হয়। একই সদর দরজায় দুটো বেল দুই পাশাপাশি ফ্ল্যাটের, কে বুঝবে? দুটি বেল উপরে নীচে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চার মিনিটে আটবার বাজানোর পর একসঙ্গে দুই প্রান্তে দুটি দরজা খুলে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি আরম্ভ হয়ে গেল, তখন বুঝিয়ে বলা কঠিন কেন এই অসৎ কর্ম করতে বাধ্য হয়েছি।

অনেক কলিংবেলের নীচে ছোট ছোট অক্ষরে কীসব নির্দেশ লেখা থাকে। রোদে-বৃষ্টিতে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, যখন অস্পষ্ট ছিল না তখনও ঘাড় উঁচু করে দৃষ্টিসীমার ঊর্ধ্বে ওই ছোট ছোট বর্ণমালা থেকে কোনও অর্থ উদ্ধার করা খুব সহজ ছিল বলে মনে হয় না। অবশ্য এর আবার উলটোদিক আছে, সেখানে কলিংবেলের নীচেই একটা ঘণ্টার ছবি আঁকা থাকে যাতে কারও অসুবিধা না হয় বুঝতে যে এই ঘণ্টাটি বাজাতে হবে।

তবে কোনও কোনও বাড়িতে এও দেখেছি যে, তির কিংবা হাতচিহ্ন দিয়ে দূরে নির্দেশ দেওয়া আছে, পাশে ইংরেজি ও বাংলাতে লেখা, বেল ইন সাইড প্যাসেজ, ঘণ্টা পাশের প্যাসেজে। বলা বাহুল্য এ রকম ক্ষেত্রে দরজায় ধাক্কা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, পাশের অন্ধকার প্যাসেজে বেলের অনুসন্ধান করতে না যাওয়াই ভাল। অন্তত একবার গিয়ে আমার এক আত্মীয় পা পিছলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, ভাগ্য ভাল দেড় ঘণ্টার মাথায় আরেকজন সেই বেল বাজাতে এসেছিলেন এবং তিনিই আমার সেই আত্মীয়কে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেয়ে অতি সাবধানে উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।

সব দেখে শুনে তবুও আমাদের শিক্ষা হয় না। আমরা নিজেরাই বাড়িতে একটা কলিংবেল লাগিয়েছিলাম। ভালই চলছিল, কিন্তু মাসখানেকের মাথায় একদিন রাত দেড়টা নাগাদ সেটা একা একাই অকারণে বেজে ওঠে এবং সারারাত ধরে বাজতে থাকে, শেষে সাড়ে চারটা নাগাদ এক বিরক্ত প্রতিবেশী ঘুম থেকে উঠে এসে বুদ্ধি করে মেন সুইচ বন্ধ করে দেন, আমরা রক্ষা পাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *