কবি ফররুখ আহমদ
ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ই জুন বর্তমান মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী এবং বেগম রওশন আরার দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন তিনি। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু। পরে তিনি কলকাতার তালতলা মডেল স্কুল ও বালিগাঁও হাইস্কুল এবং খুলনা জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন। শেষোক্ত স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন ও ১৯৩৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। সেখানকার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজেও তিনি লেখাপড়া করেছেন। ছাত্র জীবনে, খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। ক্লাসে সবসময় প্রথম হতেন। পরে প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজিতে অনার্স পড়তে ভর্তি হলেও কবিতার প্রতি তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহের ফলে তিনি তা শেষ করতে পারেননি। স্কুলজীবনেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে ‘লাশ’ কবিতা লিখে তিনি প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন।
““যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ’পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখেনা সে মৃতের খবর”।
কিংবা –
“শাশ্বত মানব সত্তা মানুষের প্রাপ্য অধিকার
ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার
মানুষের হাড় দিয়ে তার আজ গড়ে খেলাঘর
সাক্ষ্য তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরনীর পর।”
(লাশ)
কবি গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেমের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মানবতাবাদী আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়ে বামপন্থী মনোভাব পোষণ করতেন। পরবর্তীকালে তিনি পুরোপুরি ইসলামী আদর্শের অনুসারী হয়ে যান।
১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিসে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতায় এরপর সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টেও কিছু দিন কাজ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি বিখ্যাত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকে ছিলেন। দেশ বিভাগের পরপরই তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় যোগদান করেন।
১৯৪২ সালের নভেম্বরে তিনি তাঁর প্রথম খুড়তুত বোন সাইদা তাইয়্যেবা খাতুন লিলিকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে উপলক্ষে আহমেদ উপহর কবিতাটি লেখেন, যা সওগাত থেকে ১৯৪২ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়। তাদের এগারোটি সন্তান ছিল: সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ। বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহ আল-মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহ আল-মাসুদ, সৈয়দ মনজুর-ই-এলাহী, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান (আহমদ আখতার), সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান এবং সৈয়দ মুহাম্মদ আবদুহু।
ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা ‘রাত্রি’ ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায় (শ্রাবণ-১৩৪৪ সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়। সে-বছরই কবির একগুচ্ছ কবিতা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়। ১৯৪৪ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশের পর তাকে প্রতিভাবান কবি হিসেবে চেনা গেল। যেন তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন- সেই সঙ্গে হৃদয়েও গেঁথে বসলেন। ওই বছরই অকাল প্রয়াত প্রতিভাবান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত “আকাল” সংকলনে ফররুখ আহমদের বিখ্যাত “লাশ” কবিতাটিকে স্থান দেন। ফররুখ আহমদের কবি জীবন দু’টি ভাগে বিভক্ত। কলকাতার জীবনে তার কবিতা ডান-বাম উভয় গোষ্ঠীর পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ঢাকাতেই তিনি পাড়ি জমান। তিনি শুধুমাত্র কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন গীতিকার, (যার বহু গান ফেরদৌসি রহমান-সহ অনেক ভালো ভালো গায়ক গেয়েছেন) কাব্য নাটক, গদ্য নাটক-রচিয়তা (যার নাটকে মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যকার অভিনয় করেছেন)। তিনি একমাত্র কবি, যিনি পাকিস্তানী সরকার প্রদত্ত “সিতারা-ই ইমতিয়াজ(১৯৬৬)” খেতাব প্রত্যাখ্যান করে ঝড় তুলেছিলেন। এরকম শক্তিমান কবিকেও স্বাধীনতার পরে চাকরির ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যারা পাকিস্তান আমলে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তারাই হয়ে গেলেন তীব্র বিরোধী। কবির অপরাধ ছিল অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের সাথে তিনি যৌবনের শুরুতেই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। তাই আহমদ শরীফের ও শওকত ওসমানের লেখায় ফররুখ আহমদ নিন্দিত হয়েছেন। একসময় চাকরি থেকেও বরখাস্ত হয়েছেন। তবে আহমদ ছফা ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার ১লা আষাঢ় ১৩৮০ সংখ্যায়, জানিয়ে দিলেন- ইকবাল আর মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর উপর “সঞ্চয়িতা’র মত গাদাগাদা কবিতা লিখে সুফিয়া কামাল যদি সরকারী দলের প্রতিনিধি হিসেবে মস্কো সফরে যেতে পারেন, তাহলে ফররুখ আহমদের দোষ কোথায়? এই প্রতিবেদনে কাজ হলেও কবি ফিরে পেলেন না তাঁর আনন্দের আসল জায়গা। হারালেন বেতার-শিল্পীর মর্যাদাশীল পদ। এরপর তিনি আর বেশি দিন বাঁচেননি। ১৯৭৪ সালের ১৮ই অক্টোবরে ঠিক সন্ধ্যে বেলায় তিনি মারা যান।
এটা ঠিক যে ফররুখ আহমদের সময়ের সাহিত্যিক পরিবেশ এখন আর নেই। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি পায় দলীয় আদর্শের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে। বাম গোষ্ঠীর কিছু অংশ এখনও মনে করেন, ফররুখ আহমদ হলেন মক্কা-মদীনার সৌরভে আমোদিত কবি। এও অভিযোগ করা হয় তাঁর কবিতায় দেশজনতার প্রভাব নেই বললেই চলে। তবুও ফররুখ আহমদের কবিতার অসামান্যতা কবিতার গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছেন যাকে উৎপাটন করা সহজ নয়। হয়তো এই কারণে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতন বিরুদ্ধবাদী তাকে যথার্থ আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অপরাজেয়’ বলে। যদিও এই মতামত হুমায়ূন আজাদের মোটেও পছন্দ হয়নি।
কবিকে মূল্যায়ন করার অন্যতম হাতিয়ার হল তার রচনাকর্ম সহজলভ্য হওয়া। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ফররুখ আহমদের বেলায় তা হচ্ছে না। ফররুখ আহমদ চিরকালই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থক ছিলেন। আমরা তাঁর কাছে থেকে যে কয়েকটি প্রবন্ধ পেয়েছি তার মধ্যে একটি বাংলা ভাষা বিষয়ে, শিরোনাম হল “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য”। সেখানে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়েছেন- “আমি আগেই বলেছি যে, বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সাংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।”
হয়তো অনেকেই জানেন না যে, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিকের শাহাদাতের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার বাহিরে প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনি তুলেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বেতারের শিল্পীরা; তাদের অন্যতম ছিলেন ফররুখ আহমদ। ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমির উদযাপিত নাট্য সপ্তাহে “নৌফেল ও হাতেম” নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, তিনি এই সালেই প্রতিষ্ঠানের ফেলো নির্বাচিত হন। কিন্তু সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল ওই বছরেই। কবিতাই প্রথম বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনায়। অনেকের ধারণা ছিলো কবি জসীমউদ্দীন এই পুরস্কার পাচ্ছেন, কারণ তখন তিনি প্রবীণ কবিদের অন্যতম। তিনি পুরস্কার না পাওয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ার উত্তরে বাংলা একাডেমি কতৃপক্ষ বলেছিল তিনি তো পুরস্কারের উর্ধ্বে। তবে এটা জসীমউদ্দীনকে আহত করেছিলো। এই কারণে তাঁর রচনাবলি প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুমতি দেননি। পরবর্তীকালে অনেক বই তাঁর বড় ছেলের প্রতিষ্ঠিত ‘পলাশ প্রকাশনী’ থেকে বের হয়েছে। কবি ফররুখ আহমদের অন্যতম সৃষ্টি ‘হাতেম তাই’ প্রকাশ করেছিলো বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমির জন্মলগ্ন থেকেই ফররুখ আহমদ জড়িয়ে পড়েছিলেন।
ফররুখ আহমদের সৃজনশীলতার উপর অনেক সমালোচক তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। সেগুলো এক করা দরকার। ফররুখ আহমদের বেশ কিছু কবিতা ‘কবিতা’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল সেগুলি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংগ্রহ করা দরকার। যাতে ভবিষ্যতে যারা কবির উপর গবেষণা করতে চান, তাদের পক্ষে সহজ সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় এর আগে ফররুখের কাব্যগ্রন্থ, অনুবাদ, কবিতা ও প্রবন্ধ সমন্বয়ে একটি রচনাবলি বের হয়েছিলো। যার সম্পাদনায় ছিলেন ফররুখ অনুরাগী দুই কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ও প্রয়াত আবদুল মান্নান সৈয়দ। এই গ্রন্থ প্রকাশের অনেক পরে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সুদক্ষ সম্পাদনায় দুই খন্ডে রচনাবলি বের করে বাংলা একাডেমি।
বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যে অসাধারণ জননন্দিত কবি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁর ওপর গবেষণা কর্মের সংখ্যা হাতে গোনা। এমনও শোনা যায়, এই কবির কবিতা পড়ানো ও বোঝানোর মতো দক্ষ শিক্ষকও নেই। আমরা ফররুখ আহমদের কবিতা আলোচনা করার সময় কিছুটা হলেও তাঁকে সরলীকরণ করে ফেলেছি। সেটা কেমন? আমি প্রায়ই সভা-সমিতিতে শুনতাম- ‘তিনি রেনেসাঁর কবি!’ কারণ তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের জাগরণ কামনা করেছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণকামী অধিকারের সমর্থনকারী কবি। কারণ তিনি ইংরেজদের হাতে বন্দী মুসলমানের দুঃখ নিরসন করার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী একটি সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতায় বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ কারণে সমসাময়িক অন্যান্য মুসলমান কবির মতো পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে তিনিও জড়িয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী কবি। তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে –
“তোমরা এনেছো জ্যোছনা- ভেজানো স্বপ্ন-সবুজ শাখে
গভীর রাতের গূঢ় মোরাকাবা বন- ডাহুকীর ডাকে,
কোথা নলবনে চৌচির হয়ে বাঁশী যেতে চায় ফেটে,
কোথা জোলায়খা দেখায় মাশুক চাঁপার আঙ্গুল কেটে।
কোথা মজনুর বিরহী হৃদয়ে আকাশের নিরবতা
কোন ঝরোকায় শাহেরজাদীর ঘুম ভাঙ্গা রূপকতা,
নিশীত রাতের ঘনায়িত ব্যথা কোথা লাইলির প্রাণে,
মৌসুমী হাওয়া বলে গেছে বুঝি তোমাদের কানে কানে।
তোমাদের সুরে শুনেছি আমরা পথ চলবার বাঁশী
রুদ্ধ কপাটে যেখানে ঝঞ্ঝা বেজেছে সর্বনাশী।
ম্লান জড়তার জড়বাদ – বাঁধ ভাঙ্গে তোমাদের হাতে
গোলাব কলির ফুটবার খোঁজ দাও অমাবশ্যাতে
বন্ধু! তোমরা এনেছো দরদ উমরের বুক হতে
কল্পলোকের আকাশ ছেড়েও নেমেছো ধূলির স্রোতে।
দুর্গত জনগণের সঙ্গে বেঁটে নাও ব্যথা বিষ,
মরু ওয়েসিসে জাগাও তোমরা দোয়েলের মিঠে শিস্”
[দল-বাঁধা বুলবুলি, মাসিক মোহাম্মদী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫০].
“কাঁচড়া পাড়ায় রাত্রি। ডিপোতলে এঞ্জিন বিকল
সুদীর্ঘ বিশ্রান্ত শ্বাস ফেলে জাগে ফাটা বয়লার,
অবরুদ্ধ গতিবেগ। তারপর আসে মিস্ত্রিদল। গলানো ইস্পাত আনে, দৃঢ় অস্ত্র হানে বার বার।
জ্বলন্ত অগ্নির তাপে এই সব যন্ত্র জানোয়ার দিন রাত্রি ঘোরে ফেরে সুদুর্গম দেশে, সমতলে সমান্তর, রেলে রেলে, সেতুপথ পার হয়ে আর অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে দার্জিলিংয়ে আসামে জঙ্গলে।
আহত সন্ধ্যায় তারা অবশেষে কাঁচড়া পাড়াতে। দূরে নাগরিক আশা জ্বলে বালবে লাল-নীল-পীত; উজ্জীবিত কামনার অগ্নিমোহ-অশান্ত ক্ষুধাতে; কাঁচড়া পাড়ার কলে মিস্ত্রিদের নারীর সঙ্গীত।
(হাতুড়িও লক্ষ্যভ্রষ্ট) ম্লান চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ রাতে কাঁচড়া পাড়ায় জাগে নারী আর স্বপ্নের ইঙ্গিত।”
(“কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি”, প্রথম প্রকাশ: সওগাত, ১৯৪১ সাল)
ফররুখ আহমদের কবিতা আমাদের মানবিক চেতনাকে আঘাত করে বসে। যেমন –
“এ নয় জোছনা-নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর
এ নয় পরীর দেশের ঝরকা নারঙ্গী বন্দর।
এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার
ক্ষুধিত শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।
আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙ্গা মাস্তুল দেখা দিক করতালি-
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।”
(সাত সাগরের মাঝি)
“যেখানে উত্তাল স্রোতে দিশাহারা মত্ত এ নাবিক
সমুদ্রের ঘন বনে নাহি খুঁজে পায় তার দিক
শুধু দেখে বহু দূরে জোনাকির উজ্জ্বল প্রদীপ
জ্বলিয়া মাটির মেয়ে মরীচিকা তালে পরে টীপ,
যার লাগি প্রতি রগে জেগে উঠে টান
মৃত্তিকা সে নাবিকের প্রাণ।”
(হে বন্য স্বপ্নেরা)
“যখন শুনেছি আমি মৃত্যু আছে সূর্যেরও সমান
অগণন জ্যোতিষ্কের ভাগ্যলিপি মৃত্যু দিয়ে ঘেরা,
তখনি হয়েছে মনে এ আকাশ রহস্যের ডেরা,
তখনি হয়েছে মনে এ জীবন ক্ষণিকের গান।”
(মুহূর্তের কবিতা)
আল্লামা ইকবালের ভাবশিষ্য জাতির সমস্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে ফররুখ আমাদের দেখিয়ে বলেছিলেন,
‘”হে মাঝি এবার তুমিও পেয়ো না ভয়
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক তারকার বিস্ময়
ঝরুক এ ঝড়ে নারঙ্গী পাতা তবু পাতা অগণন
ভিড় করে সেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজতোরণ।”
চিত্রকল্প ও প্রতীকের ব্যবহারে ফররুখ ছিলেন অনন্য। কবির ভাষায়-
“রাত্রির অগাধ বনে ঘোরে একা আদম-সুরত
তীব্রতর দৃষ্টি মেলে তাকায় পৃথিবী
জাগো জনতার আত্মা ওঠো। কথা কও।
কতোকাল আর তুমি ঘুমাবে নিসাড় নিস্পন্দ।”
রাত্রি’ কবিতায় কবি বলেন,
“এই সব রাত্রি শুধু এক মনে কথা কহিবার
নিজেদের সাথে,
পুরানো যাত্রীর দল যারা আজি ধূলির অতিথি
দাঁড়ালো পশ্চাতে।
কায়খসরুর স্বপ্ন কঙ্কালের ব্যর্থ পরিহাস
জীবাণুর তনু পুষ্টি করিয়াছে কবে তার লাশ!
শাহরিয়ার দেখে যায় কামনার নিস্ফল ব্যর্থতা,
জিঞ্জিরে আবদ্ধ এক জীবনের চরম রিক্ততা।”
কিংবা –
“কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানিনা তা
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?
সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে
ডাকে জাহাজ
অচল ছবি সে, তসবীর যেন দাঁড়ায়ে
রয়েছে আজ।”
হুমায়ুন আজাদের মতো বামধারার কবি-সমালোচক স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, কবি শামসুর রাহমানের প্রাথমিক জীবনে কবি ফররুখ আহমদের প্রভাব ছিল। কবি শামসুর রাহমান তাঁর জীবনের প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ফররুখ আহমদের ওপর, যা সেই সময় দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার ‘সাহিত্য পাতায়’ প্রকাশিত হয়েছিল।
ফররুখ আহমদ আপাদমস্তক ছিলেন একজন সৃজনশীল মানুষ। তাঁর প্রত্যেকটি রচনায় দেখা গেছে, তিনি পরিবেশ সৃজনে যে কাব্যভাষা ব্যবহার করেছেন তা ছিল যথাযথ। তবে তাঁর কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের আধিক্য ছিল। তবে ফররুখ আহমদ আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগ ছাড়াও অনেক কবিতা লিখেছেন। যেমন ধরা যাক এই সনেট কবিতাটি।
“আমার হৃদয় স্তব্ধ, বোবা হয়ে আছে বেদনায়
যেমন পদ্মের কুঁড়ি নিরুত্তর থাকে হিম রাতে,
যেমন নিঃসঙ্গ পাখী একা আর ফেরে না বাসাতে
তেমনি আমার মন মুক্তি আর খোঁজে না কথায়।
যখন সকল সুর থেমে যায়, তারারা হারায়,
নিভে যায় অনুভূতি-আঘাতে, কঠিন প্রতিঘাতে;
নিস্পন্দ নিঃসাড় হয়ে থাকে পাখী, পায় না পাখাতে
সমুদ্র পারের ঝড় ক্ষিপ্রগতি নিশান্ত হাওয়ায়…
মুখ গুঁজে পড়ে আছে সে পাখীর মতো এ হৃদয়
রক্তক্ষরা। ভারগ্রস্ত এ জীবন আজ ফিরে চায়
প্রাণের মূর্ছনা আর নবতর সৃষ্টির বিস্ময়,
উদ্দাম অবাধ গতি, বজ্রবেগ প্রমুক্ত হাওয়ায়;
অথচ এখানে এই মৃত্যু-স্তব্ধ রাত্রির ছায়ায়
রুদ্ধ আবেষ্টনে আজ লুপ্ত হয় প্রাণের সঞ্চয়।”
এই সনেটটি প্রকাশিত হয়েছিল কবি কায়সুল হক সম্পাদিত অধুনায় বাংলা ১৩৬২ সালে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সঙ্কলনে জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, আবুল হোসেন, আহসান হাবীবের কবিতাও প্রকাশিত হয়েছিল।
ফররুখ আহমদ বলেছেন, কবিতা লিখতে গেলে জানতে হয় কবিতার প্রকরণশৈলী। তিনি তাঁর কবিতাকে ছন্দময় করতে চেয়েছিলেন।গদ্যছন্দের দিকে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। তাঁর প্রথম কবিতা ছিল সনেট, আর শেষ কবিতাটিও ছিল সনেট। অনুজ কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল লক্ষ্য করেছিলেন কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে বসবাসের পর থেকেই তিনি রোমান্টিকতার দিক বদলে ক্লাসিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
এই সময় তার প্রিয় কবি ছিলেন ইকবাল, এলিয়ট এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর এলিয়ট থেকেই পেয়েছিলেন ঐতিহ্য চেতনার উত্তারিধিকার, তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন ‘ঐতিহ্য চেতনা’ ছাড়া কবিতা শক্তিশালী হয় না। তিনি এলিয়টকে নিবিড়ভাবে পাঠ করেছিলেন। সে কারণে দেখা যায়, সমালোচক ও নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ তাকে এলিয়ট পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবুও তিনি এলিয়টের কাব্য-প্রক্রিয়াকে অশান্ত মনে করতেন, সে জন্য ইসলামের দিকেই ধাবিত হয়ে শান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সামাজিক বৈষম্য তাকে ক্রমান্বয়ে ক্ষুব্ধ করেছিল। তিনি তাঁর বিশ্বাসের উপর ভর করে সৃজনশীলতা দিয়েই বিপরীত আদর্শের অনুসারীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফররুখ একজন রোমান্টিক কবিও বটে! তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘পানজেরি’।
পানজেরি
ফররুখ আহমেদ
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলার এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা, পেরেশান মুসাফির দল।
দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে
নিরাশায় ছবি এঁকে!
পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের þöান জুলমাত হেরি!
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।
মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।
কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!
ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।
পাঞ্জেরি!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!
আমাদের কবিতার বিবর্ণতার মূল কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। যার ফলে কবিতা ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে আজগুবি দুর্বোধ্যতার জটাজালে। কবি অনেক আগেই আমাদের জানিয়েছেন তাঁর কবিতায়-
“আর একবার তুমি খুলে দাও ঝরোকা তোমার,
আসুক তারার আলো চিন্তার জটিল উর্নাজালে,
যে মন বিক্ষত, আজ জাগ্রত তোমার ছন্দ তালে
এখানে সমস্যাকীর্ণ এ জগতে এসো একবার।”
(কবিতার প্রতি : মুহূর্তের কবিতা)
ফররুখ আহমদ ছিলেন আপাদমস্তক ক্লাসিক ধাঁচের কবি, পাশাপাশি তরুণরা ইদানীং তথাকথিত মুক্তছন্দে কবিতা সৃজনের দিকে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সেই দিক থেকে স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের বিরোধ থেকেই যাচ্ছে। এ কথা আমাদের স্বীকার করা ভালো যে, ফররুখ আহমদ ছিলেন গদ্যছন্দের বিরোধী, কবি আবুল হোসেনের গদ্যছন্দকে ‘কোলকাতার চটকদারী ছন্দ’ বলে অ্যাখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেননি। যদিও তাঁর সমসাময়িক কবিবন্ধু সৈয়দ আলী আহসান এই মতামতের বিরোধিতা করেছেন।
অনেক আগেই টি এস এলিয়ট স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন – ‘সৎ সমালোচনা ও সংবেদনশীল মূল্যায়ন হয় কবি নয়, কবিতাকে কেন্দ্র করে। আমরা যদি সংবাদপত্রের সমালোচকদের দ্বিধান্বিত মূল্যায়ন এবং পুনরাবৃত্ত জনপ্রিয় ধারার হইচই শুনি, তা হলে আমরা অনেক কবির নাম শুনতে পাব। কেতাবি জ্ঞানের মুখাপেক্ষী না হয়ে আমাদের কবিতা থেকে আনন্দ খুঁজতে হবে।’
শিশু-কিশোরদের জন্য ফররুখ আহমদ প্রচুর ছড়া-কবিতা লিখেছেন। কবি তাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতেন, আদর করতেন। তিনি শুধুই শিশু-কিশোরদের উপযোগী লেখা লিখে ক্লান্ত হননি, লিখেছেন এক্কেবারে সোনামণিদের জন্যেও। তাঁর ‘হরফের ছড়া’ গ্রন্থটি এরই উজ্জ্বল উদাহরণ।
তাঁকে সহজে ভুলতে পারা যায না। ধরা যাক একসময় তাঁকে আমরা ভুলেই গেলাম। অমনি শুরু হলো বৃষ্টি! ঠিক তখনই হৃদয়ে দোলা দিয়ে উঠবে তাঁর সেই বিখ্যাত ছড়াটি –
“বিষটি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাস বনে
বকের সারি কোথারে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।
নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকলো দূরে দেয়া যে,
কোন্ সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে!”
কবি ভালবাসতেন সব মানুষকে। এমন কি প্রকৃতির প্রতিও ছিল তাঁর অফুরন্ত ভালবাসা। তাঁর ‘শরতের সকাল’, ‘পউষের কথা’ কিংবা ‘হৈমন্তীর সুর’ কবিতাগুলোর কোন তুলনা হয়? ‘ফাল্গুনে’ শিরোনমের কবিতাটি পড়লেই আমরা তাঁর প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার কিছুটা নিদর্শন পাই –
‘”ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী,
ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙানি,
এক ঝাঁক পাখি এসে ঐকতানে
গান গায় এক সাথে ভোর বিহানে,
আযানের সুর মেশে নীল আকাশে
শির শির করে ঘাস হিম বাতাসে,
আচানক দুনিয়াটা আজব লাগে
আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে,
লাল নয়, কালো নয়, সবুজ ছাতা
জেগে ওঠে একরাশ সবুজ পাতা,
হাই তুলে জাগে সব ফুলের কুঁড়ি
প্রজাপতি ওড়ে যেন রঙিন ঘুড়ি।”
পাখি নিয়ে তাঁর অনেক বিবিত্র-ধর্মী ছড়া-কবিতা আছে। এখানে তার কয়েকটি লাইন –
“নদী নালার দেশে আবার আসে দূরের হাঁসগুলো,
চমকে ওঠে তাল, সুপারি, নারকেল গাছ, বাঁশগুলো।
নানান রঙের ঝিলিক দিয়ে পাখিরা সব যায় চলে,
হাজার সুরে দূর বিদেশের খবর তার যায় বলে।
পর পাখনা নাড়া দিয়ে রঙিন পাল যায় রেখে
ঝিল হাওরে, নদীর তীরে পাখিরা সব যায় ডেকে।”
কবি ফররুখ আহমদ বেশ কিছু মজাদার হাস্যরসের ছড়াও লিখেছেন। তবে সে সবের আলাদা বৈশিষ্ট হলো এই যে, তাতে শুধু হাসি আর কৌতুকই থাকে না, সেখানে থাকে জানার অনেক কিছু। এ ছাড়া কবির ‘সিন্দাবাদ ও বুড়োর কিসসা’, ‘দুষ্ট জ্বিনের কিসসা’, ‘হাতেম তায়ীর কিসসা’ ও ‘নৌফেল বাদশা’ প্রভৃতি দীর্ঘ কবিতাগুলো পড়লেও যেমন আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি অনেক কিছু শেখা যায়।
ব্যক্তি জীবনে কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী। সব সময় সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন তিনি। অর্থ-বিত্তের লোভ কখনোই তাঁকে লোভী করে তোলেনি। তাঁর যে খ্যাতি এবং পরিচিতি ছিল তা দিয়ে তিনি চাইলেই অঢেল সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি অর্থ কষ্টে দিন যাপন করেও কারও কাছে হাত পাতেননি।
কবি বলেছেন –
‘”তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া,
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।”
(ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার – ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম)
[ তাঁর বই ]
সাত সাগরের মাঝি (সাত সাগরের নাবিক), ডিসেম্বর, ১৯৪৪ সাল।
সিরাজাম মুনিরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২ সাল)
নওফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১ সাল)
মুহুর্তের কবিতা (একটি মুহূর্তের কবিতা), সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ সাল।
ধোলাই কাব্বো (জানুয়ারি, ১৯৬৩ সাল)
হাতেমতয়ী (মে, ১৯৬৬ সাল)
কাফেলা (আগস্ট, ১৯৮০ সাল)
হাবিদা মারুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১ সাল)
সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩ সাল)
দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ সাল)
শিশুদের জন্য বই
পাখির বাসা (১৯৬৫ সাল)
Horofer Chhora (বর্ণমালার ছড়া, ১৯৭০ সাল)
ছোটর আসর (ছড়ার দল, ১৯৭০ সাল)
চিড়িয়াখানা (১৯৮০ সাল)
ফুলের জোলসা (ফুলের কনসার্ট, ডিসেম্বর, ১৯৮৫ সাল)।
(প্রাপ্ত পুরস্কার)
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬০ সাল)
প্রাইড অফ পারফরম্যান্সের জন্য রাষ্ট্রপতির পুরস্কার (১৯৬১ সাল)
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬ সাল)
ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬ সাল)
একুশে পদক (মরণোত্তর, ১৯৭৭ সাল)
স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৮০ সাল। এই পুরস্কারটি স্বাধীনতা পদক নামেও পরিচিত)।
ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্রের সাথে জীবন যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। দারিদ্রতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ভোগ বিলাসিতা তিনি ঘৃণা করতেন। তার কবিতার মতই ছিল কবির দৈনিক জীবন।
“তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।”
জীবনের শেষ বেলায় এসে কবি খুব কষ্ট পেয়েছেন। বিনা চিকিৎসায় তাঁর মেয়ে মারা গেছে। মৃত মেয়ের জামাই, যার সঙ্গে কবি থেকেছেন তাঁরও চাকুরি ছিল না। নিজে তো আগেই বেতার শিল্পী পদ হারিয়ে বেকার হয়ে গিয়েছিলেন (নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন)। মেয়ে তো মারাই গেছে। যারা বেঁচে ছিলেন, কি অভাবে, কোন অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনগুলো পার করছেন, সে খবর কেউ রাখেনি। এরপর তিনি আর বেশি দিন বাঁচেননি। ১৯৭৪ সালের ১৮ই অক্টোবরে ঠিক সন্ধ্যে বেলায় তিনি মারা যান।
—————————————————————-
[ তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত ]
সূত্র নির্দেশকা –
“ফররুখ আহমদের জীবনী”। ৩০শে ডিসেম্বর ২০১২ সালে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ – ২রা নভেম্বর ২০১২ সাল।
“কবি ফররুখের ছেলে আহমদ আখতার আর নেই”। যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ – ১৪ই ফেব্রুযারি ২০২১ সাল।
অনীক মাহমুদ (২০১২ সাল)। “আহমদ, ফররুখ”।
ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)।
ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901. ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743.
“কবি ফররুখ আহমদের ৪৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ | সাতসতেরো”। Risingbd Online Bangla News Portal (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ – ১৫ই এপ্রিল, ২০২৪ সাল।
ন, সু ম ন আ মী। “ফররুখ আহমদ জীবন ও সাহিত্য”। DailyInqilabOnline (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ – ১৫ই এপ্রিল, ২০২৪ সাল।
“ফররুখ আহমদের কবিতাবলী”। ৩০শে ডিসেম্বর ২০১২ সালে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২রা নভেম্বর ২০১২ সাল।
“কাজীর বিচার : ফররুখ আহমদের আবেহায়াত”। ২৮ শে মে ২০১৬ সাল। তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬শে মে ২০১৬ সাল।