কনফেশন্
মিস আগরওয়াল ইভিএস টিচার। প্রায় প্রতিদিন প্রথম আধ ঘন্টা খুব মজার মজার খেলা হয়। অবন, আব্রু সহ ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা ভীষন আনন্দ পায় এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। তিয়া প্রায়শই নিশ্চুপ থাকে। বাকী একঘন্টা পড়াশোনা আর ক্লাস ওয়ার্কসে ব্যস্ত থাকে সবাই। আজ টিফিনের পর ইভিএস এর মিস ক্লাস নিতে আসবেন। অবন, আব্রু নিজেদের মধ্যে বেট ধরে বসলো। অবন বললো,- আজ ইতিহাসের মজা হবে। আব্রু মাথা ঝাকিয়ে বললো,- উঁহু, আজ অংকের মজা হবে। কি রে তিয়া, আজ তুই কার দলে থাকবি?
দলে থাকলে তো অবনের দলে থাকতে হয়। মনে মনে ভাবল তিয়া। এও ভাবলো, অবনের নাম নিলে আব্রু আবার কষ্ট পেয়ে যাবে।
তিয়া হাত তুলে মাথা বেকিয়ে বলল,- আজ আমি তোদের কারো দলে থাকব না। আজ মিসের দলে থাকব।
টিফিন ব্রেকের ঘন্টা বাজতেই অসমাপ্ত যুদ্ধটা শিকেয় তুলে ওরা ক্লাসে চলে গেল। মিস আগরওয়াল ক্লাসে ঢুকেই বলে উঠলেন,- হ্যালো চিল্ড্রেনস আজ আমরা এক নতুন খেলা খেলব। তোমর রাজি তো?
তিয়া প্রথমেই হাত তুলে বলল,- ইয়েস্ মিস। আড় চোখে অবন আর আব্রুকে দেখে ফিক করে হেসে উঠল। আব্রুর রাগ হোল। গোল গোল চোখে তিয়াকে একবার দেখে মিসের দিকে হাত তুলে সবার সাথে বলে উঠল,- ইয়েস মিস।
সবার হাতে একটি করে ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন,- সবাইকে আজ কনফেশন্ করতে হবে যে, কে কে, কি কি গোপন কথা মনে মনে ভাব অথচ অন্যের কাছে সেটা স্বীকার করতে পার না। একথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। একটি পিন পড়ার শব্দও সবাই শুনতে পারছে। এ ভাবেই প্রায় সাত মিনিট সময় কেটে গেল।
তিয়া প্রথমে হাত তুলতে যাবে, ঠিক তখনই আব্রু, সায়ন একসাথে বলে উঠল,- কনফেশন্ লেখা হয়ে গেছে মিস।
বেশ, চিরকুটের পিছনে নিজের নাম, রোল নং লিখে এই সাজেশন বক্সে ফেলে দাও। নেক্সট উইকে খেলাটা আমরা শেষ করব।
সবার কনফেশন্ শেষ হয়েছে। ক্লাসের হোম টাস্ক কালেক্ট করে নতুন পড়া শুরু করলেন। টপিকস্ সোসাল এনভায়রনমেন্ট। পড়া শেষ হলো। মিস আগরওয়াল সবাইকে তিনটি করে বন্ড পেপার দিয়ে বললেন,- এই পেজগুলো হলো ‘সানডে ম্যাজিক’। আগামী রবিবার সবাই নিজেদের মতো করে ছবি এঁকে তা দিয়ে কমপক্ষে একশ শব্দের গল্প লিখে আনবে। সবচেয়ে ভালো প্রথম দশ জনের গল্প ছবিসহ স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে বের হবে। কী, সবাই পারবে তো? মিসের কথা শেষ হলো না। সবাই একবাক্যে বলে উঠল,- পারব পারব।
মিস খুব খুশী হয়ে সবাইকে টা টা করতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ‘বাই বাই মিস’ বলে বিদায় জানাল।
অবনকে ঘিরে ধরলো ক্লাসের সব বন্ধুরা। সবাই জানে অবন ভালো গল্প লিখতে পারে। গল্প লেখার কিছু কায়দা কানুন জেনে নিতে পারলে ভালো হয়। অবন বললো,- অযথা ভাবছ তোমরা। মনের ভিতরে যে যে শব্দ জড়ো হবে, সেগুলো পর পর সাজিয়ে যেও। এক সময় বুঝতে পারবে মনে আর কোন শব্দ আসছে না। তখন বুঝবে গল্প শেষ, এই তো! এজন্য ভেব না বেশী। অঙ্কের দিদিমনি এসে যাবেন। আজ গুনের সাথে ভাগ শিখতে পারলেই আমরা ঐকিক নিয়মের অঙ্ক শুরু করতে পারবো। নাও, নাও সব বসে পর।
স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজতেই আব্রু করুণ চোখে বলল, – আগামী রবিবার তোদের বাড়ি যেতে চাই। অবন মাথা নেড়ে বললো,- আয় না, একসাথে ছবি এঁকে গল্প লিখব। এ কথায় তিয়ার খুব আনন্দ হলো। হাত নাড়িয়ে চোখ নাচিয়ে বলল,- রবিবার কেন? শনিবার তো ছুটি। তুই ভালো জ্যাঠুকে বলে রাখবি, শুক্রবার স্কুল ছুটির পর আমরা একসাথে অবনদের বাড়ি চলে যাব। খেলা, মজা, ছবি আঁকা,গল্প লেখা সব কিছুই করতে পারব। এ কথায় আব্রু রাজি হয়ে গেল। তিন বন্ধু ক্লাস রুম থেকে বের হবার সময় লক্ষ্য করলো শ্রিমিলি অবনের দিকে জল ভরা চোখে তাকাতে তাকাতে স্কুল বাসের ভিতরে ঢুকে গেল। অবন ভাবলো, শ্রিমিলি তো কখনো টিফিনের সময় গল্প করতে আসে না। রেয়ন, পৃথ্বী ওর বেস্ট ফ্রেন্ডস। তিয়া, আব্রুর দিকে তাকাল অবন। অঙ্কের ধাঁধার জট খুলতে পারছে না অবন। ওরাও ঠোঁট উল্টে অবনকে জানিয়ে দিল, এই ধাঁধাটির উত্তর ওদেরও না জানা।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। শুক্রবার সন্ধ্যায় তিন বন্ধু হৈ হৈ, রই রই করে অবনের বাড়ি চলে এলো। একথা বাড়ির সবার জানা। ওদের ভালো লাগা খাবার, জল খাবারের কথা মীনামাসীকে জানিয়ে দিয়ে বসুধা সকালে স্কুলে গিয়েছে। কর্তাবাবা সেইমতো বাজার করেছেন। বাজারে যাবার আগে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আব্রুর বাবা, মা এলে খুব ভালো লাগতো। এবার আব্রুই চমকে দিল সবাইকে। স্কুল থেকে ফিরেই আব্রু তাক লাগিয়ে বলেই দিল,- দত্তবাবুরা সন্ধ্যার পরে পরেই চলে আসবেন। ভালো বাবা, ভালো মা এবার লেগ স্পিনে ক্লীন বোল্ড হয়ে যাবে। মীনামাসী’তো রান আউট হয়েই গেল।
অবন, তিয়া একথা শুনে ভাবল, ঠিকই তো, ড্রাইভার কাকু খুব ব্যাস্ত ভাবেই ওদের নামিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। অবন মাথা ঝাকিয়ে বলল,- নারে আব্রু, আমার আর গোয়েন্দা হয়ে ওঠা হবে না। জলজ্যান্ত প্রমাণ হাতের নাগালে পেয়েও ধরতে পারলাম না। আব্রু হাসতে হাসতে বলল,- এটাই আসল গোয়েন্দার লক্ষণ।
শনিবার হৈ চৈ, গল্প তামাশার মধ্যে কেটে গেল দিনটা। ঠিক হয়েছে সবাই মিলে নদীর পাড়ে বেড়াতে যাবে বিকেল বিকেল। সূর্যি ডোবা দেখে সবাই বাড়ি ফিরবে। অবন, তিয়া, আব্রু প্রমাদ গুনলো। ওদের নদীর পাড়ে হঠাৎ করে দেখে মুন খেলতে চলে আসে তবেই মুশকিল।। খুব বে-কায়দায় পরে যাবে ওরা। খুব চিন্তায় পরে গেল তিনজনে।
অবন বলল,- বেশি ভেবে কাজ নেই। যেমন অবস্থা হবে ঠিক তেমনই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এসো আমরা তিনজনে ছবি এঁকে ফেলি। গল্পও আজই শেষ করে ঘুমতে হবে। কালকের জন্য ফেলে রাখলে আরো বড় বিপদ হতে পারে। অবন বলেছে আর কোন কথা নেই। ড্রয়িং শীট নিয়ে তিন জনেই বসে গেল ছবি আঁকতে।
আধা ঘন্টা শেষ হতে না হতেই তিন জনের আঁকা শেষ।
‘My early sun’ এঁকেছে আব্রু। রাস্তার বুক চিড়ে সূর্য উঠেছে পূব আকাশে। পাঁচ রঙে পাঁচ আলোর ঝলকানি। প্রতিটি রঙের গভীরে আরো রঙ, আরো রঙ। রঙের মহোৎসব। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আগামী সূর্য।
অবন এঁকেছে ‘ দ্য মাদার লাস্ট’। ছোট ক্যাপশনে লেখা আছে ‘ ..the last wishes she saved..
তিয়ার আঁকাটি ভীষন আকর্ষক। ‘ মাই আর্থ থ্রি থাউজেন্ডস, এডি- পৃথিবীর উপরে জ্যোৎস্না রাতের মেঘ বলয়। নৌকার মতো ভাসছে অর্ধচন্দ্র। মেঘ মাল্লারে তারার চকমকি। নৌকার উপরে সমস্ত ব্রক্ষাণ্ডই মাকড়সার জালে আবদ্ধ। কী ভয়ঙ্কর তার প্রচেষ্টা। জাল কেটে প্রকাশিত হতে চায়, অথচ পারছে না।
অবন হাততালি দিয়ে উঠল,- চমৎকার, চমৎকার সব ছবি। নাও রেডি হও। যে ভাবনার গভীরতায় ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে, ঠিক সেই ভাবনায় গল্প লিখতে শুরু করে দাও। স্লো বাট স্টেডি। যা লিখবে সেটাই ফাইনাল। কারেকসন্ করার কোন উপায় নেই।
অবনের কথা শেষ হতেই তিন বন্ধুর গল্প লেখা শুরু হলো। নিস্তব্ধ ঘরের বাতাসে তিন বন্ধুর হৃদস্পন্দনের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।
-অবন অবন, বেলা গড়াচ্ছে। তোরা ওঠ এবার।
বসুধা ভোরের বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের দরজা খুলেই থ বনে গেল।
-এ কী অবস্থা তোদের। ঠিক মতো শুতেও পারিস নি। যে যেমন পেরেছিস ঘুমিয়ে পরেছিস। কথা শেষ হতেই বসুধা চমকে উঠে ঘরের মেঝের দিকে তাকালেন। ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু লেখা পড়ার কাগজ। বসুধা কাগজগুলো হাতে নিয়েই চোখের সামনে ধরতেই বিস্ময়ের ঘোর লাগলো চোখে। মনে মনে ভাবল,- সারা রাত ধরে তিন বন্ধু গল্প লিখেছে। অবশেষে ক্লান্তিতে সেখানেই ঘুমিয়ে পরেছে। দ্রুত পায়ে খাটের নিকট এসে চমকে উঠল বসুধা। তিনটি ছবিই যেন উষার কুসুম আলোয় বিছানার উপর তাকিয়ে আছে। কী অনবদ্য রূপ বিন্যাস। কী পরিনত রঙের ব্যবহার। কোনটাই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় নয়। এতো সমস্ত সংখ্যার ঊর্ধ্বে এক অনবদ্য চিত্রকল্প। বসুধা তিনটি শিশুর শরীরে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে ওদের ঠিকঠাক শুইয়ে দিলেন। মায়ের মনের ছবিতে জেগে উঠল ওদের গোটা হাতের লেখা গল্পগুলির মাধুর্য। আর কিছু দেখবার বা পড়ার কোন বাসনা জন্মালো না। বাঁধন ছাড়া নদীদের আপন মনে বইতে দেবার দৃঢ় সংকল্প প্রদীপ শিখার মতো গেঁথে নিলেন নিজের মনের মধ্যেই। সবকিছু সযত্নে গুছিয়ে রাখলেন বসুধা। ভাবলেন, এই ঘুম বড় তৃপ্তির, বড়োই আদুরে।
‘চিকস্ চিকস্’ ডাকে অবনের অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেল। জানালার কাছে দৌড়ে এলো।
-কি হোল, এই সাতসকালে এতো হাঁক ডাক কেন?
কাঠবিড়ালি ভাই বোন এক লাফে বিছানায় উঠে এলো। ছোট্ট লেজের সুড়সুড়িতে তিয়া, আব্রুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। ছানাবড়া চোখে নিয়ন, আইসকে কোলে নিয়ে সে কী আহ্লাদপনা।
-কি রে কেমন আছিস। আজ বিকেলে খেলতে যাবি তো?- তিয়া
-না না,- আৎকে উঠল আইস। চোখ দুটো ছলছল করছে। আব্রু দম বন্ধ করে জানতে চাইলো,- ভয় পাচ্ছিস কেন? বল, কিসে এতো ভয় পাচ্ছিস। অবন আইসকে আদর করতে করতে সাহস যোগাল।
-আজ আর খেলা হবে না। তোমরা কেউ নদীর পাড়ে যেও না।
-কেন রে , নদীর পাড়ে যাব না কেন? ওখানে কিসের ভয়,- অবন প্রশ্নটা করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো আইসের দিকে।
-আজ নদীতে বান আসবে। শিরীষ গাছের তলা পর্যন্ত নদীর জল ধেয়ে আসবে। অনেক ছোট ছোট কীট-পতঙ্গ বানের জলে ভেসে যাবে,-নিয়ন এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে তিয়ার কোলে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো।
-এ কথা জানলে কি ভাবে,-তিয়ার মনে বন্যার করাল ছায়া ধেয়ে এলো। খুব বাবার কথা মনে পড়ল। এ রকমই নদীর বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউ একদিন ওদের গ্রামটা ভাসিয়ে দিয়েছিলো। সে রকম কিছু হবে না তো!
–মুনের বাবা বলেছে। মাটির উপর কান পেতে মাটির গভীরে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে পেয়েছে। চিৎকার করে সবাইকে সজাগ করে দিয়েছে,- সাবধান, সাবধান। নদীতে বান আসছে। নদীর জল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে চারিদিক। অবনকে সংবাদ দাও। আজ বিকেলে নদীর পাড়ে কেউ যাবে না। আইস বারবার ঢোক গিলে কথাগুলি বলে হাঁপাতে লাগলো।
– মুনেরা এখন কোথায়, আইস। উঁচু জায়গায় তো উঠে আসতে হবে,-অবন গভীর চিন্তায় জানতে চাইল।
এক লাফে অবনের কোলে উঠে চোখদুটো ছলছল করে নিয়ন বললো,- সবাই শিরীষ গাছের তলায় এসে উপস্থিত হয়েছে। পিছনের ঢিপিটায় মুনেদের অস্থায়ী ঘর বানানো হয়েছে। রাজারানী হাওয়ায় ভেসে ভেসে ছোট ছোট কীট-পতঙ্গ, পদ্মরাণীকে সংবাদ দিয়ে এসেছে। পদ্মরানী সমস্ত পিঁপড়েদের নিয়ে বট গাছের শুকনো ছালে আশ্রয় নিয়েছে। বেজী দাদা ও বাস্তুসাঁপ দাদা জঙ্গলের সমস্ত শান্ত, হিংস্র প্রাণীদের বিপদের কথা জানিয়ে দিয়েছে। তোমরা বাকি ছিলে তাই বলতে এসেছি।
অবন খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল। আব্রু বললো,- ভালো’বাবা, ভালো’মাকে জানাব কি করে! তিয়ার মন তো কালো হয়ে উঠেছে অতীতের কথা ভেবে। তিয়াকে শান্ত হতে বলে অবন পড়ার টেবিল থেকে কাগজ আর কলম আনতে গেল। পড়ার টেবিলে ওদের আঁকা ছবি আর গল্পের পাতাগুলি যত্ন করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। মামমামের হাতের স্পর্শ চারিদিক ছুঁয়ে আছে। মামমাম সকালে ঘরে ঢুকেছিল। না, আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না।
ডায়েরির একটি পাতায় লিখল,-আজ নদীতে বান আসবে সাবধান। নীচে নিজের নাম লিখল ‘অবন’। তিয়া ও আব্রুকে নিজেদের নাম লিখতে বলল। ওরা কিছুই বুঝতে পারল না। নিজেদের নাম লিখে দিয়ে তিয়া জানতে চাইল,-এই কাগজটা নিয়ে কি হবে?
-বুঝলি না, এই লেখাটা আমাদের নতুন ‘কনফেশন্’। মামমামের হাতে পৌঁছে দিতে হবে । তাহলেই আমাদের কাজ শেষ।
তিন বন্ধুর এ রকম পালভাঙ্গা চেহারা দেখে বসুধা মনে মনে প্রমাদ গুনলো। এই তো বেশ ঘুমাচ্ছিল। একসাথে তিন জনের ঘুম ভাঙ্গল!
বসুধা রীতিমত বিহ্বল হয়ে পরলো। প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল,- তোদের হলো কি! আধারে ছেয়ে গেছে মুখগুলো। কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছিস কেউ! কি হয়েছে তোদের বল।
বসুধার চিৎকারের চাইতে গলার আওয়াজে উৎকণ্ঠার ছাপ সমস্ত বসুবাড়ি ছেয়ে গেল। সাত সকালে কার সর্বনাশের ছোঁয়া লাগল এ বাড়িতে। মীনামাসী রান্নাঘর থেকে ছুটে বারান্দায় এলো। দত্তগিন্নী সকালের এলোমেলো কাপড় ঠিক করতে করতে উদ্বেগে হোঁচট খেয়ে বসুধার পাশে এসে দাঁড়াল। মাকে দেখে তিয়া মার কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। গলা ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। অবনের গোল চোখে অশ্রু দানা। আব্রু অতিকষ্টে কাগজের পরচাটা ভালোমায়ের হাতে পৌঁছে দিয়ে কাঁপতে লাগল। বসুধা আসন্ন বিপদের কথা ভাবতে ভাবতে আব্রুকে নিজের কাছে টেনে নিল। ছোট মনে এ কিসের আতঙ্ক! দ্রুত পরচাটা খুলে পড়ে নিল,-‘আজ নদীতে বান আসবে, সাবধান।‘।
অস্থির বসুধা দুহাতে অবন, আব্রুর হাত ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। প্রায় আর্তনাদের স্বরে বলে উঠল,- এখানে আসা অবধি দেখছি আমাদের এই নদী শান্ত ভাবেই বইছে। আজ আবার কিসের ভীমরতিতে ধরলো। কী ব্যাপার আমাকে পরিষ্কার করে খুলে বল। সকাল হতে না হতেই গোয়েন্দাগিরি। কে তোমাদের ভয় দেখাচ্ছে?
-না মামমাম, না। কেউ ভয় দেখায় নি। আমরা সত্যি কথাই বলছি। বসুধা পরিষ্কার দেখল, অবনের গোল চোখে বড় বড় জলের দানা।
অবনের কষ্টার্জিত কথাগুলো কর্তাবাবা ও দত্তবাবুর কানে পৌঁছাল। বাজারের ব্যাগ দুটো বারান্দার উপর রেখেই ওরা গোলযোগের ন্যূনতম দূরত্বে পৌঁছে গেল।
বিষয়ের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বেলা চারটেয় সবাই এসে হাজির হলো নদীর পারে। দত্তগিন্নী, দত্তবাবু সাগরের মুখ দেখেছে কয়েকবার দীঘা, পুরীতে। নদী দেখল এই প্রথমবার। আব্রু এই নদীটাকে চেনে, নাম ক্ষণা। অবনের হাত ধরে বহুবার ঘুরে গেছে। আজ বড় ভয় পাচ্ছে আব্রু। অবন, তিয়ার হাত ধরে আব্রু দেখছে অত্যন্ত করাল রঙ নিয়ে শুয়ে আছে ক্ষণা। বাতাস বইছে না, নিঃশ্বাসের শব্দ নেই, বুকে দোল ওঠা ঢেউয়ের কোন লক্ষণ নেই ক্ষণার।
বসুধার মনে কূ ডাকছে। অজ গ্রামের মেয়ে মীনামাসী। নদী, খাল, বিল বিলক্ষণ চেনে। ওর চোখ এড়ানো খুব মুস্কিল। ঝড়ে পড়া নৌকার মতো অকস্মাৎ চিৎকার করে ওঠে,- খোকাবাবু, তিয়া, আব্রু এক্ষুণি ঘরে চলো। মা জননী, নদীতে বান আসছে , চলো। অবন দেখছিল ক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্রমশ কর্কষ হয়ে উঠছে ক্ষণা।
তিনটে বাচ্চাকে নিয়ে সবাই বাড়ির ছাঁদে প্রহর গুনছে। হঠাৎই নিথর, শব্দহীন গাছের পাতায় মর্মর ধ্বনি দরজায় কড়া নাড়াবার মতো ঝনঝন্ করে বেজে উঠল। অবনকে বুকে চেপে বসুধা কান্নায় ভেঙে পরলো। তিয়া মার হাত ধরে নদীর পারের দিকে তাকিয়ে আছে। অতীতকে চোখের মধ্যে রুদ্ধ করে মীনার চোখ দুর্দান্ত নটরাজের ভৈরব নৃত্য দেখছে। প্রায় সঙ্গাহীন আব্রুর পুতুল শরীরকে বুকের মধ্যে ঠাঁই দিয়ে দত্তগিন্নী আর্তস্বরে আছড়ে পরলো,- নদী ফুলছে। ঐ দেখ দেখ। দত্তগিন্নী ব্যাস্ত হয়ে উঠলো কোথায় লুকাবে বাচ্চাগুলিকে!
ভাঙ্গা জলের কলকল শব্দ নদীর পার থেকে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। ততই বাড়ছে হৃদপিণ্ডের শব্দ। সময়ের অপেক্ষা করল না বেগবতী ক্ষণা। মূহুর্তে পথ ঘাট, জলা জঙ্গল ছাপিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সেই শিরীষ গাছটির গোড়ায়। নদী আর বাড়ছে না। আর কোন শোক নেই ক্ষণার মনে। কিছুক্ষণে ধীরে ধীরে ফিরে গেল সে। রাত নামল বসুধার ঘরে। বাচ্চাদের কোলাহল, ছন্দগল্পে ভরে গেল চারিদিক। অবনের ইন্দ্রিয় মুখখানা হাতের পাতায় ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল,- আর কত সাহসী হবি তোরা।
ঢং ঢং ঢং। টিফিন শেষের ঘন্টা বেজে গেল। এবার ইভিএস ক্লাস। আব্রু ভয় ভয় পাচ্ছে। অবন এবার জেনে যাবে ওর ‘কনফেশন্-এ’ কি লেখা আছে। অবন ভাবছে অন্য কথা। বড়রা কেন ‘কনফেশন্’ করে না। কী গোপন রাখতে ভালোবাসে? ঠিকই করে ফেলল, মামমামকে ‘কনফেশন্’ লিখতে হবে। ড্যাডি, মীনামাসীও বাদ যাবে না। আব্রুর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে ভালোকাকু আর ভালোকাকিমা অর্থাত আব্রুর বাবা, মা ওদের এই খেলায় যোগ দেবে কিনা।
বড় ম্যাডামকে সাথে নিয়ে ইভিএস ম্যাম মিস আগরওয়াল ক্লাসে ঢুকতেই চমকে গেল বাচ্চারা। এমন আকস্মিক পরিদর্শন বড় ম্যাডামের আগে কখনো ঘটেনি। দু তিন সেকেন্ড ক্লাস ঘরটি নির্বাক হয়ে পরেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে ক্লাসের সবাই দাঁড়িয়ে এক সাথে বলে উঠল,- গুড মর্নিং ম্যাডাম, গুড মর্নিং ম্যাম।
-গুড মর্নিং চিল্ড্রেনস। উই হ্যাভ অ স্পেশল ক্লাস টু ডে,- বড় ম্যাডাম হাত তুলে সবাইকে বসতে বললেন।
আগরওয়াল ম্যাম সেই কাঙ্খিত ছবি আর গল্প জমা দিতে বললেন। শেষ বেঞ্চ থেকে পর পর উঠে এলো অঙ্কিত, দীপ্র, নয়না ছবি আর গল্প জমা দিতে। এই স্কুলের এটাই নিয়ম শেষ বেঞ্চ থেকে শুরু প্রথম বেঞ্চে এসে শেষ। তবে কে কোথায় বসবে সেটা বাচ্চারাই ঠিক করে নেয়। সপ্তাহে একদিন সোমবার অবন, তিয়া, আব্রু একসাথে বসতে পারে। তবে মোটামুটি ভাবে সবাই প্রায় একই জায়গায় বসে যে যার বেষ্ট ফ্রেন্ডসের সাথে।
-আজ আমি এই ‘কনফেশন্-টারগেট ওয়ানের’ ক্লাসিক রিপোর্ট টাঙ্গিয়ে দিচ্ছি। কোন নাম, রোল নং থাকবে না। একদম বাম পাশে কিছু সংখ্যা থাকবে, অর্থাত ক্লাসের অত জনই সেই ‘কনফেশটি’ করেছ, অথচ কেউ কারোরটা জানতে পারবে না। এটাও একটি খেলা। মেন্টাল হেল্থ এর কাউন্ট-ডাউন খেলা। সবাই রেডি তো,- বড় ম্যাডাম হাসতে হাসতে কথা গুলি বলে একটি ড্রয়িং শীট টাঙিয়ে দিলেন ক্লিপ বোর্ডে। ক্লাসের বাচ্চারা বারবার চমকে চমকে উঠছে। চার কোনে চারটি পিন গেঁথে দিলেন। সবাই দেখল জ্বল জ্বল করছে ‘ কনফেশন্- টারগেট ওয়ান’।
১। মা ।
৮। বাবার থেকে মাকে ভালোবাসি বেশী।
১০। বাবা, মা খুব ঝগড়া করে, মন খারাপ লাগে।
২। আমার বাড়িটা পচা।
১। আমি চুপি চুপি আমার পুতুলের বিয়ে দিয়েছি।
২। বাবা সবসময় ফোনে ব্যাস্ত থাকে।
১। আমার বাড়ির পিছন থেকে চাঁদওঠে, আমি দেখতে পাই না।
২। আমার মা টিভি দেখে আমাকে দেখতে দেয় না।
৪।। স্কুলটাই আমার ভালো।
বড় ম্যাডাম, ক্লাস টিচার খুব গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করছেন বাচ্চাদের মুখ। কেউ ভয় পাচ্ছে না তো? না, তেমন কোন শঙ্কা নেই। তবে ক্লাসে তো মোট বত্রিশ জন। একজনের ‘কনফেশন্’ নেই কেন? বাচ্চারা সবাই সবাইয়ের মুখ দেখছে। বড় ম্যাডামের দৃষ্টি গিরে পরল শ্রিমিলির উপর। ওনার গোটা গোটা চোখ দেখে শ্রিমিলির খুব কান্না পেয়ে গেল। চোখ নামিয়ে নিল টেবিলের উপর। কয়েক মিনিট শেষ হলো। বড় বড় টানা টানা চোখে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ধরে শ্রিমিলি শুনতে পেল বড় ম্যাডাম ডাকছেন ওকে।
-শ্রিমিলি, মাই চাইল্ড, আমার কাছে এসো।
-ইয়েস ম্যাডাম,- কান্না অশ্রু মেশানো গলায় কোন প্রকারে উচ্চারণ করে শ্রিমিলি বড় ম্যাডামের কাছে গেল।
বড় ম্যাডাম শ্রিমিলিকে কাছে টেনে নিলেন। বললেন,- মাই ডিয়ার চিল্ড্রেনস্ আমার কাছে আরো একটি ‘কনফেশন্’ আছে। যেটা ক্লিপ বোর্ডে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তোমরা সবাই জানতে চাও, তাই না? ক্লাসের সবাই হাত তুলে জানতে চাইল।
-অবন, আমার কাছে এসো। বড় ম্যামের কাছ থেকে এমন আকস্মিক প্রত্যাশা কারো ছিল না। অবন ধীর পায়ে বড় ম্যামের পাশে দাঁড়াল। অবনকে স্কুলের সবাই ভালোবাসে। অবন বুঝতে পারে না বড় ম্যামের এই হাবভাব। বড় ম্যাডাম হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন,- শ্রিমিলি অবনকে একটি বার্তা দিয়েছে। অবনকেই পড়ে সবাইকে শোনাতে হবে।
ভাজ করা কাগজটি পড়েই অবনের চোখ ছলছল করে উঠল। অবন পড়ল, শ্রিমিলি লিখেছে,- ‘ অবন ওর ভালো বন্ধু হতে পারে, কিন্তু অবনের ইচ্ছে নেই’।
শ্রিমিলির মনের কথা সবাই জানতে পারল। অবন লক্ষ্য করলো, আব্রু আর তিয়ার চোখে জল। ওরা শ্রিমিলিকে খুব ভালোবাসে কিন্তু অবন কথা বলে না। শ্রিমিলির মনের কষ্ট অবন বুঝতে পারল। শ্রিমিলির হাত ধরে বলল,- সরি, আগামীকাল কাল থেকে আমরা একসাথে টিফিন খাব, গল্প করব।
শ্রিমিলির হাত ধরে অবন ওকে ওর বসার জায়গায় পৌঁছে দিল। একযোগে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। শ্রিমিলির চোখে মুখে খুশির টানটান উৎসব দেখল সবাই।
শ্রিমিলির মুখে সব কিছু শুনে তার পিতা মাতা যারপরনাই খুশি হলেন। ফোনে ফোনে তিন পরিবারের ভাব বিনিময় হলো। বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠল। এদিকে স্কুলে চার বন্ধুর এমন মিল দেখে স্কুল কতৃপক্ষ ভাবতে বসল, কি ভাবে নতুন আঙ্গিকে ‘ ভ্যালেনটাইন ডে’ পালন করা যায়।
সপ্তাহ দুই অতিবাহিত হল। ‘কনফেশন্- টারগেট ওয়ান’ স্কুলের ছেলে মেয়েদের ভিতর তোলপাড় তুলল। বড় ক্লাসের দাদা, দিদিরা নিয়ম মাফিক নিজেদের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নিল। বেশ কিছু নামী স্কুল থেকে ম্যানেজমেন্টের গ্রুপ এসে বিষয়টির পজিটিভ, নেগেটিভ দিক জেনে গেল। সবাই মানতে বাধ্য হলেন,- বড়দেরও ‘ কনফেশন্’ করার এটাই রাইট টাইম।
চার বন্ধু গোল হয়ে বসে সিদ্ধান্ত নিল, সুযোগ, সুবিধা মতো তাদের পিতা, মাতার ও পরিজনদের ‘ কনফেশন্ ‘ আদায় করবে। এবারের স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন বের হবার পরে পরেই এই কাজটি সম্পূর্ণ করতে হবে।
ইতিমধ্যে উল্লিখিত মোট দশটি ছবি স্কুলের মেইন ক্লিপ বোর্ডে টাঙান হয়েছে। সমস্ত ছাত্র, ছাত্রীরা ছবিগুলো দেখবার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। কেউ সুন্দরভাবে দেখতে পারছে না। স্পোর্টস স্যার এসে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। একাদশ শ্রেনীর ছাত্র, ছাত্রীদের নির্দেশ দিলেন, সবাই যেন শান্ত ভাবে ছবি দেখে ক্লাস রুমে চলে যায়। এই ছবিগুলোই আগামী বাৎসরিক ম্যাগাজিনে গল্প সহ বের হবে। সবাই তা পেয়েও যাবে।
বসুধার বাড়িতে আজ হাট বসেছে। নতুন বন্ধুর আগমন। শ্রিমিলি ও তার পিতা, মাতা বসুবাড়ির নতুন অতিথি। দত্তগিন্নী ও বসুধা আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে এলো। মীনামাসী শ্রিমিলিকে নিয়ে অবনের ঘরে পৌঁছতেই চার বন্ধুর বাঁধনছাড়া আনন্দে ঘর আলো হয়ে উঠল। শ্রিমিলির লেখা গল্প প্রথম হয়েছে। গল্পটির নাম ‘ টু ফ্রেইন্ডস ‘। গল্প পড়ে অবন, তিয়া, আব্রু খুব কেঁদেছে। বসুধা, দত্তগিন্নী দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে গল্পটি পুনরায় পড়তে লাগল :
আলফ্রেড স্যান্ট আট বছরের বালক। তার বাবা, মা দুজনেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। পিতা স্যামুয়েল স্যান্ট আর মাতা আন্না স্যান্ট। জাতিতে ইহুদী। তারা একটি আকাশ যান তৈরী করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘ আলফ্রেড দ্য মিশন ‘। এটা একটি রবারের বল। স্পেস ক্রাফট। যার ঘর্ষন, তাপ ও ঘনত্বের পরিমান মাইনাস জিরো টু দ্য পাওয়ার থার্টিন। এই মহাকাশ যানটি তৈরী করতে বারো বছর লেগেছে। মহাকাশ গবেষণায় ভয়ঙ্কর যে তথ্যটি সামনে এসেছে তা যেমন মারাত্মক ঠিক তেমনি ভয়ানক। জাগতিক সোলার সিস্টেমে অতি সুক্ষ ফাটল আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি একদিন পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হতে পারে। আলফ্রেডের জন্মের দিন পৃথিবীর সমস্ত শিশুকে বাঁচাবার জন্য স্যামুয়েল ও আন্না প্রতিজ্ঞা করেছে, যেভাবেই হোক তারা পৃথিবীকে রক্ষা করবেন।
আজ সেই দিন। আর মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে ‘ আলফ্রেড দ্য মিশন ‘ যাত্রা শুরু করবে। গন্তব্য দ্য ডিপ ওসান অফ সোলার সিস্টেম। মাইক্রো ওয়েভ স্থাপন করতে হবে। যে তেজস্ক্রিয় উৎপন্ন হবে , তা অত্যন্ত মারাত্মক। পৃথিবী বাঁচবে কিন্তু আলফ্রেডের পিতা, মাতা বাঁচবে না।
আলফ্রেড দু হাত বাড়িয়ে ড্যাডি ও মাম্মিকে জড়িয়ে ধরলো। চুম্বন করে দু হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। ধূসর ঊটরঙা গাড়িতে চেপে মহাকাশে উড়বার জন্য চলে গেল দুই বন্ধু। আলফ্রেড দেখল সামনে দাঁড়িয়ে তার গ্রান্ড-মা দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে। আলফ্রেড দৌড়ে গিয়ে গ্রান্ড-মার কোলে ঝাপিয়ে পড়ল। দু চোখ জলে ভরে উঠেছে আলফ্রেডের। গ্রান্ড-মার হাত ধরে সে এখন চলে যাবে ক্যালিফোর্নিয়া। গ্রান্ড-মার বাড়িতে। ভেজা গলায় আলফ্রেড জানতে চাইল,- ‘ টু ফ্রেইন্ডস উইল কামবেক, গ্রান্ড’মা ‘।
বাকরুদ্ধ বৃদ্ধা অতিকষ্টে বলিলেন,-ইয়েস্, মাই সন।
গল্প শেষ হলেও কেউই কথা বলতে পারছে না। শ্রিমিলি’ই বুদ্ধি বের করে অবনের হাত ধরে বলে উঠল,- টু ফ্রেইন্ডস উইল কামবেক, ডোন্ট ওরি। একথা শুনেই বাড়ির সবাই হেসে উঠল। মীনামাসীও বুঝলো, দুই বন্ধু ফিরে আসবে। সেও হেসে উঠল।
বাড়িতে কলরব উঠলে কি হবে! চার বন্ধু ফন্দি এঁটে বসে আছে। রাত্রে খাবারের পরে চার বন্ধুর খেলা শুরু হলো। সবার বাবা, মার হাতে কাগজ দিয়ে একসাথে বলে উঠল,- তোমরা ‘কনফেশন্- টারগেট ওয়ান’ লিখে সকালের মধ্যে এই বাক্সে জমা দেবে। মীনামাসীও ছাড় পাবে না। একথায় বড়রা আশ্চর্য হলেও মীনামাসীর খুব লজ্জা লাগল কারণ তার হাতের লেখা বকের পায়ের মতো। সেটা বাচ্চাদের দেখানো যায় না।
অবন, তিয়া বন্ধুদের নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেই বড়রা গোল টেবিলে বসে পরলো। সবার একমত বাচ্চাদের আহত করা যাবে না। যে যার ‘ কনফেশন্’ লিখে সকালে বাচ্চাদের রাখা বক্সে রেখে দেব। ওরা বড় হচ্ছে, ওরাই ডিসিশন নেবে।
আজকের বসুবাড়ির সকালটা বড়ই অন্যমনষ্ক। কনফেশন্- টারগেট ওয়ান কালেক্ট করে ছটি কাঁচের বোতলে ছিপি আটকে রাখা হলো। বাচ্চারাও আরো একবার কনফেশন্ লিখে চারটি কাঁচের বোতলে রেখে দিল। মীনামাসী এতই লজ্জা পাচ্ছে যে নিজেই নিজের কনফেশন্ বোতলে রেখে খোকাবাবুর হাতে দিল। কেহ কারো ‘কনফেশন্’ দেখে নি, জানেও না। সকালেই প্রাতরাশ শেষ হলেই চার বন্ধু ব্যাগের ভিতরে বোতলগুলি পরিপাটী করে নিয়ে নদীর পারে এসে দাঁড়াল। মীনামাসী দূর থেকে গোয়েন্দাগিরি করতে লাগল।
নদীতে জোয়ার এসেছে। নদীর বিস্তীর্ণ পার জলে ভরে উঠেছে। চার বন্ধু মিলে বোতলগুলি জলে ভাসিয়ে দিল। নৌকার মতো ভাসতে ভাসতে জলের ধাক্কায় বোতলগুলি অদৃশ্য হয়ে গেল।
মীনামাসী বাড়িতে ঢুকেই আর্তস্বরে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল। বাড়ির বড়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশ্চিন্ত হলেন। বসুবাবু বলিলেন,-বোধ হচ্ছে বড়দের ‘কনফেশন্’ করার এটাই উপযুক্ত সময়।