Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » এম সি আই || Sankar Brahma

এম সি আই || Sankar Brahma

কালো একটি বিড়াল ধীরে সুস্থে রাস্তা পার হচ্ছিল। লিলি বিড়ালটিকে দেখতে পেল। লিলির বয়স দশ বছর। বিড়ালটিকে দেখে তার খুব পছন্দ হল। সে ভাবল বিড়ালটিকে বাড়িতে নিয়ে পুষবে। তাই সে বিড়ালটির কাছে গিয়ে তাকে ধরতে গেল। বিড়ালটির কাছে যেতেই লিলি দেখতে পেল, বিড়ালের চোখগুলি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আগুনের ভাটার মতো। অথচ বিড়ালটি দেখা যাচ্ছে না। সে বাতাসে মিলিয়ে আছে, আর তার চোখ দু’টি জ্বলছে জ্বলজ্বল করে।
লিলি তা দেখল অবাক হলো। ভয়ে তার চোখ দু’টি বড় বড় হয়ে উঠল। কারণ সে বুঝতে পারল যে কালো বিড়ালটি আসলে একটা ভূত। লিলি পিছনে ফিরে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্ত সে তা পারল না। তার পা দু’টি পাথরের মতো ভারী লাগল, সে কিছুতেই পা দু’টি মাটি থেকে তুলতে পারল না। পালাবে কি করে?

কালো বিড়ালটি তখন অদৃশ্যভাবে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, ” আমাকে ধরতে চাইছো কেন তুমি?” লিলি দ্বিধায় পড়ল, কী বলবে সে? এর আগে সে কখনও কোনও ভূতের পাল্লায় পড়েনি। দেখেনি তাদের। লিলি তখন ভাবল, ভূতটাকে ভয় করা নাকি সাহস দেখানো উচিৎ হবে।

কালো বিড়ালটি এবার দৃশ্যমান হয়ে, এক পা দু’পা করে কাছে এগিয়ে এল, ওর চোখগুলি জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালটি বলল, “তুমি যদি আমাকে যেতে দাও, তবে আমি তোমার একটি ইচ্ছে পুরণ করব”। লিলির চোখ উত্তেজনায় চকচক করে উঠল। বিড়ালটি বলার আগে এক মুহুর্তের জন্য লিলি ভেবেছিল, “আমি যদি ছোট বড় সমস্ত প্রাণীর সঙ্গে যেন কথা বলতে পারতাম।”

কালো বিড়ালটি হেসে বলল, “তাই হবে। তোমার ইচ্ছাটি মঞ্জুর করলাম। এবার আমি যাই।” বলে সে ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেল। লিলি তা দেখে, বিস্ময়ে শিহরিত হলো।

সেদিন থেকে, লিলি সব প্রাণীদের কথা বুঝতে পারে। তাদের সাথে কথা বলতে পারে। তাদের বিপদ আপদে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। তাদের সেবা যত্ন করে।

লিলির বাবা সনাতন হাজরা চা খেতে খেতে খবরের কাগজে একটা সংবাদ পড়ছিলেন। ‘ইছিরো সুজুকি’ নামে জাপানের দশ বছরের এক বালক, পশু পাখিদের কথা বুঝতে পারে। থাকে জাপানের তাকায়ামা শহরে। তাকে দেখতে প্রতিবেশীরা তার বাড়িতে রোজ ভিড় করে।
লিলির বাবা স্ত্রীকে ডেকে খবরটা পড়ে শোনালেন। সংবাদটা শুনে লিলির মা গম্ভীর ভাবে কিছু ভাবছিলেন। তা দেখে সনাতনবাবু বললেন, কি ভাবছো?

  • আমাদের লিলিও তো দেখি, কাক,শালিক, কুকুর, কাঠবিড়ালির সাথে কথা বলে।
  • তাই নাকি?
  • হুম।
  • তবে তো লিলির সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে, কি কথা বলে ওদের সঙ্গে?
  • আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলে কি জান?
  • কি বলে?
  • ওদের সুখ দুঃখের কথা শোনে।
  • তাই নাকি? ভারি ইন্টারেস্টিং।
  • তুমি লিলির সঙ্গে কথা বলে দেখো।
  • হুম।

লিলির বাবা, একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মানুষ। তিনি লিলির সঙ্গে কথা বলে হয়তো ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারবেন।

লিলি বই পড়ছিল, এমন সময় একটা কাক উড়ে এসে আমগাছের ডালে বসে ‘কা কা’ করে ডাকতে ডাকতে লিলির দিকে তাকতে লাগল। লিলি তখন বই ছেড়ে উঠে গিয়ে কাচের বয়াম খুলি একটা বিস্কুট এনে কাকটা দিকে ছুঁড়ে দিতেই, কাকটা উড়ে এসে সেটা মুখে নিয়ে চলে গেল।
সনাতনবাবুর চোখেে পড়ল সেটা। তিনি লিলিকে কাছে ডেকে বললেন, আচ্ছা মা তুমি পড়তে পড়তে উঠে গিয়ে, একটা বিস্কুট এনে কাকটাকে দিলে কেন?

  • বাবা কাকটার খুব খিদে পেয়েছিল।
  • তুমি কি করে বুঝলে মা?
  • কাকটা বলছিল আমাকে কিছু খেতে দাও।
  • কাকটা তোমায় বলছিল?
  • হ্যাঁ বাবা।
  • তুমি কাকেদের কথা বুঝতে পার?
  • পারি।
  • কি করে?
  • যেমন করে তোমার কথা বুঝতে পারি।
  • আমি তো বাংলায় কথা বলি, কাকটা কি ভাষায় কথা বলে?
  • তুমি যেমন বাংলায় কত বল, কাকটা তেমন কাকিনাড়া ভাষায় কথা বলে।
  • সেটা আবার কেমন ভাষা?
  • কাকেদের ভাষা। কাকেরা ওই ভাষায় কথা বলে।
  • তুমি ওই ভাষা জান?
  • হ্যাঁ বাবা।
  • শিখলে কি করে?
  • কাকেদের কথা শুনে শুনে।
    এরপর সনাতনবাবু লিলিকে আর কি প্রশ্ন করবেন, বুঝতে পারলেন না। তাই মেয়েকে বললেন, আচ্ছা এবার যাও। গিয়ে বই পড় গিয়ে।
    লিলি বাবার কাছ থেকে সরে এল।

এইভাবে লিলির বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলি। ধীরে ধীরে তার ভিতরে কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। মাঝে মাঝে সে তার চেনা মানুষগুলিকে পর্যন্ত চিনতে পারে না। এমন কি তার মা বাবাকে কেমন অচেনা মনেহয়। শুধু তাই নয়, লিলি তাদের মধ্যে পশু পাখির আদল দেখতে পায়। সেসব কথা সে কাউকে বলতে পারে না।
সকালে একদিন হঠাৎ লিলির মনেহল, সনাতন হাজরাকে বিচক্ষণ ঘুঘু পাখির মতো দেখতে লাগছে। লাবণ্যদেবীকে (লিলির মা) লাগছে একটা টিকটিকির মতো দেখতে, যে সারা ঘর ঘুরে বেড়ায়। স্কুলের বড়দিকে সেদিন, ঝগরুটে চড়াই পাখির মতো লাগছিল লিলির। সেটা অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না তার চোখে। সাময়িক সময়ের জন্য তার এই বিভ্রান্তিটা ঘটে।
এইসব কারণে লিলি আজকাল মন খারপ করে, ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। সনাতনবাবু তা লক্ষ্য করলেন একদিন। সেদিন সে লিলিকে কাছে ডেকে নিয়ে, তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে খুব আন্তরিক সুরে বললেন, তোর কি হয়েছে মা? সারাদিন মর খারাপ করে চুপচাপ ঘরে বসে থাকিস?
লিলি তাকে সব কথা খুলে বলল।
শুনে সনাতনবাবু খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
তিনি তার বিশেষ কয়েকজন বন্ধুকে কথাটা জানিয়ে, তাদের কাছে পরামর্শ চাইলেন, এখন কি করা যায়?
আত্মীয় স্বজন কাউকে ব্যাপারটা জানালেন না তিনি। কারণ, তারা শুনলে ভাববে লিলির মাথা খারাপ হয়েছে। তাদের কেউ কেউ আবার রটিয় বেড়াবে, লিলি পাগল হয়ে গেছে। এ’কথা কোনও ভাবে লিলির কানে এসে পৌঁছালে, তা’তে লিলির মনের উপর খুব খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। তাই তিনি তাদের জানাননি।
তার এক বন্ধু বিমল দত্ত শুনে বলল, আপনি সাইক্রিটিক ডক্টর সান্যলের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। আমার কাছে তার ফোন নাম্বার আছে। আমার এক ভাগ্নে তাকে দেখিয়ে ভাল হয়েছে। এখন সুস্থ স্বাভাবিক আছে।

  • তবে একটা কাগজে লিখে দিন তার ফোন নাম্বারটা।
  • হ্যাঁ। বলে তিনি ঘরের ভিতে চলে গেলেন। একটুপরে একটা ডাইরী হাতে বেরিয়ে এলেন।
    ডাইরীটা খুঁজে ফোন ডাক্তার সান্যালের নাম্বারটা বের করলেন। তারপর একটুকরো কাগজে তার নাম আর নাম্বারটা লিখে সনাতনবাবুর হাতে দিলেন।

বাড়ি ফিরে সনাতনবাবু ডাক্তার সান্যালকে ফোন করলেন। কিছুক্ষণ রিং বাজার পর ফোনটা তুলে এক তরুণী বলল, হ্যালো, কে বলছেন?

  • আমি সনাতন হাজরা। আমি ডাক্তার সন্যালের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
  • ধরুন।
    দশমিনিট কেটে গেল। সনাতনবাবু কানে ফোন দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে মনে ভাবলেন, আর কতক্ষণ ফোন কানে ধরে রাখতে হবে রে বাবা।
  • আমি ডাক্তার অবনী সান্যাল বলছি। বলুন কি বলতে চান আমাকে?
    সনাতনবাবু যতটা পারেন গুছিয়ে সংক্ষেপে লিলির সমস্যার কথটা তাকে সহজভাবে জানালেন।
  • কাল সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ওকে নিয়ে আমার চেম্বারে চলে আসুন। আমি বসি গড়িয়ায় ‘মেন্টাল হেলথ ক্লিনিক’-য়ে। ঠিকানা ৫৬/সি, এন এস সি বোস রোড।
  • আচ্ছা।

সনাতনবাবু সময় মতো লিলিকে নিয়ে সেখানে গেলেন। ডাক্তার সনাতনবাবুকে বাইরে বসিয়ে রেখে লিলিকে নিয়ে তার চেম্বারের ভিতরের ঘরে ঢুকলেন।
তারপর নিজে একটা চেয়ারে বসে, লিলিকে অন্য চেয়ারটায় বসতে বলল।
লিলি নিঃশব্দে পাশের চেয়ারটায় বসে ডাক্তারের
মুখের দিকে তাকল।

  • কি নাম তোমার?
  • লিলি হাজরা।
  • কোন ক্লাসে পড়?
  • ক্লাস ফোর।
  • বাবা কি করেন?
  • দালালি।
  • কিসের?
  • যখন যে রকম সুযোগ পান।
  • তোমার কা’কে বেশি ভাল লাগে, বাবা না মাকে?
  • দু’জনকেই?
  • বেশি কা’কে?
  • কাউকেই না।
  • কাউকেই ভাল লাগে না?
  • না।
  • তোমার তবে কি ভাল লাগে?
  • পশু পাখিদের আমার ভাল লাগে।
  • কোন পশু পাখি?
  • সব পশু পাখিই।
  • কেন ওদের ভাল লাগে?
  • ওরা অসহায় বলে।
  • বেশ, বেশ। এবার চল, তোমার বাবার কাছে যাই, উনি অনেকক্ষণ বসে আছেন।
  • হ্যাঁ, চলুন।
    ওরা ডাক্তারের চেম্বারের ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
  • কেমন দেখলেন ডাক্তার বাবু? সনাতনবাবু আকুল হয়ে জানতে চাইলেন।
  • ভাল। তবে আরও কয়েকবার কাউন্সেলিং করতে হবে।
  • মানে? সনাতনবাবু জানতে চাইলেন।
  • মানে, ওর সঙ্গে আরও কয়েকবার বসে আমার আলোচনা কর দেখতে হবে, সমস্যাটা কোথায়।
  • আচ্ছ।
  • সপ্তাহে দু’দিন করে আপনি লিলিকে এখানে নিয়ে আসবেন। বুধবার আর শনিবার সন্ধ্যা সাতটার সময়।
  • ঠিক আছে।
    সনাতনবাবু ডাক্তারের ভিজিট পাঁচশ’ টাকা দিয়ে লিলিকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

ডক্তার সান্যালের কাছে এইভাবে সনাতনবাবুর দু’মাস যেতে হয়েছিল লিলিকে নিয়ে। লিলিকে কাউনসিলিং করাবার জন্য। ডক্তারের কাছে দু’মাস কাউনসিলিং করার পর, লিলি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। তারপর ডাক্তার সন্যাল সনতনবাবুকে ডেকে বললেন, ওকে আপনাদের একটু সময় দিতে হবে। যেমন আপনি ওকে নিয়ে প্রতিদিন পার্কে ঘুরতে যাবেন।
আপনার স্ত্রীকে বলবেন দিনে এক ঘন্টা করে সময় দিতে। তিনি লিলিকে বই পড়াতে পারেন। লিলির সঙ্গে গল্প করে কাটাতে পারেন। কিংবা তার সাথে লুডু খেলতে পানেন। মানে লিলিকে প্রতিতিন ওনার কিছুটা সময় দিতে হবে। আর একটা কথা ওর সামনে কোন পশু পাখির উপর নিপীড়ণ হতে দেবেন না। তাতে ওর মনে বিরূপ পতিক্রিয়া হবে। যেমন পশু পাখিদের গায়ে ঢিল ছোড়া, বা তাদের গায়ে গরমজল বা গরমফ্যান ছুঁড়ে দেওয়া, কিংবা কুকুরের লেজে পটকা বা তারা বাজি বেঁধে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিভৎস মজা উপভোগ করা, এসব দেখলে ওর মনে কু*প্রভাব পড়বে তার। তাই এইসব দৃশ্য যেন তার চোখে না পড়ে, তা থেকে ওকে সামলে রাখবেন।

  • আচ্ছা।
  • লিলির স্মুতিশক্তির জটিল প্রক্রিয়াগুলি, যেমন তার ভাব ও ভাষা প্রকাশের ক্ষমতার হ্রাস ঘটে, বিচার বুদ্ধির প্রয়োগে তার কিছু হাল্কা স্থানীয় প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে সে, সাময়িক সময়ের জন্য তার চেনা মানুষদেরও চিনতে পারে না। এই সাময়িক স্নায়ু দুর্বলতার লক্ষণ। এই রোগটির নাম সংক্ষেপে বলে এম সি আই (MCI). সাময়িক সময়ের জন্য সে লোকজন চিনতে পারে না। তবে, আমি যা যা আপনাকে বললাম তা মেনে চলতে পারলে, আশা রাখি লিলির আর কোন সমস্যা হবে না।
    সনাতনবাবু প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে, তার থেকে একটা পাঁচশ’ টাকার নোট বের করে নিয়ে, ডাক্তার সন্যালের ফিস মিটিয়ে দিয়ে, মানিব্যাগটা পকেটে ভরে রেখে, ডাক্তারকে হাতজোড় করে নমস্কার করে লিলিকে নিয়ে ডাক্তার সান্যালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন।

তারপর দু’বছর কেটে গেছে। লিলির এখন বয়স বারো বছর। সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। এখন তার সেই সমস্যা আর নেই। তবে একটা নতুন সমস্যা হয়েছে, সে এখন আর আগেকার মতো পশু পাখিদের কোনও কথা বুঝতে পারে না। আর পারে না তাদের সাথে আগের মতো কথা বলতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *