এবং হিমু – ৩য় পরিচ্ছেদ
বাদুর-স্বভাব আয়ত্ত করার চেষ্টা সফল হচ্ছে না। বাদুর-ভাব কয়েকদিন থাকে তারপর ভেতর থেকে মানুষ-ভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাতে ঘুমুতে ইচ্ছে করে। দিনে হাজার চেষ্টা করেও ঘুমুতে পারি না। এখন আমার মানুষ ফেজ চলছে। রাতে ঘুমুচ্ছি, দিনে জেগে আছি। রাস্তায় যাচ্ছি। হাঁটাহাঁটি করছি। দিনে হাঁটাহাঁটি করার মধ্যেও কিছু থ্রিল আছে। হঠাৎ হঠাৎ খুব বিপদজনক কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। যার সঙ্গে নিশি রাতে দেখা হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। রাত তিনটার সময় নিশ্চয়ই রেশমা খালার সঙ্গে নিউমার্কেটের কাছে দেখা হবে না।প্রায় দু’বছর পর রেশমা খালার সঙ্গে দেখা। পাজারো নামের অভদ্র গাড়ির ভেতর ড্রাইভারের পাশে বসবেন ভাবাই যায় না। তবে শুনেছি পাজেরো গাড়িগুলি এমন যে ড্রাইভারের সীটের পাশে বসা যায়। এতে সম্মানহানি হয় না।
রেশমা খালা হাত উঁচিয়ে ডাকলেন, এই হিমু, এই….। ড্রাইভার ক্রামগত হর্ন দিতে লাগল। আমার উচিত দ্রুত পালিয়ে যাওয়া। কোন গলিটলির ভেতর ঢুকে পড়া। গলি না থাকলে ম্যানহলের ঢাকনি খুলে তার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া। কিছু কিছু ট্রাকের পেছনে লেখা ১০০ গজ হাত দূরে থাকুন। রেশমা খালা সেই ট্রাকের চেয়েও ভয়াবহ। আশে পাশে গলি বা ম্যানহোল নেই। কাজেই আমি হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম। রাস্তা পার হবার আগেই খালা চেঁচিয়ে বললেন, হিমু, তুই নাকি গলার কাঁটা নামাতে পারিস?
রেশমা খালা আমার কেমন খালা জানি না। লতায়-পাতায় খালা। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশ পার হলেও এই মুহূর্তে খুকি সেজে আছেন। মাথা ভর্তি ঢেউ-খেলানো ঘন কাল চুল। এই চুল হংকং থেকে আনানো। ঠোট লাল টুক টুক করছে। জামদানী শাড়ি পরেছেন। গলায় মাটির মালা। কানে মাটির দুল। এটাই লেটেস্ট ফ্যাশান। শান্তিনিকেতন থেকে আমদানী হয়েছে।
আমি গাড়ির কাছে চলে এলাম। রেশমা খালা চোখ বড় বড় করে বললেন—বাদলের মা’র কাছে ঘটনা শুনলাম। বড় বড় সার্জন কাত হয়ে গেছে—তুই গিয়েই মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে কাঁটা নামিয়ে ফেললি। কি রে, সত্যি?
‘হ্যাঁ সত্যি। তোমার কাঁটা লাগলে খবর দিও, নামিয়ে দিয়ে যাব।’
‘তোকে খবর দেব কি ভাবে? তোর ঠিকানা কি? তোর কোন কার্ড আছে?’
‘ঠিকানাই নাই—আবার কার্ড।’
‘তুই এক কাজ কর না। আমার বাড়িতে চলে আয়। একতালাটা তো খালিই পড়ে থাকে। একটা ঘরে থাকবি। আমার সঙ্গে খাবি। ফ্রী থাকা-খাওয়া।’
‘দেখি, চলে আসতে পারি।’
‘আসতে পারি-টারি না। চলে আয়। তুই কাঁটা নামানো ছাড়া আর কি পারিস?’
‘আপাতত আর কিছু পারি না।’
‘কে যেন সেদিন বলল, তুই ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলতে পারিস। তো সিক্সথ সেন্স নাকি খুব ডেভেলপড।’
আমি হাসলাম। আমার সেই বিশেষ ধরনের হাসি। হাসি দেখে রেশমা খালা আরো অভিভূত হলেন।
‘এই হিমু, গাড়িতে উঠে আয়।’
‘যাচ্ছেন কোথায়?’
‘কোথাও যাচ্ছি না। খালি বাড়িতে থাকতে কতক্ষণ আর ভাল লাগে! এই জন্যেই গাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে বের হই।’
‘বাড়ি খালি না-কি?’
‘ও আল্লা, তুই কিছুই জানিস না? তোর খালুর ইন্তেকালের পর বাড়ি খালি না? এত বড় বাড়িতে একা থাকি, অবস্থাটা চিন্তা করতে পারিস।’
‘দারোয়ান, মালী, ড্রাইভার এরা তো আছে।’
‘খালি বাড়ি কি দারোয়ান, মালী, ড্রাইভার এইসবে ভরে? তুই চলে আয়! তোর কাঁটা নামানোর ক্ষমতার কথা শুনে দারুণ ইন্টারেস্টিং লাগছে। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গাড়িতে উঠ।’
‘আজ তো খালা যেতে পারব না। জরুরি কাজ।’
‘তোর আবার কিসের জরুরি কাজ? হাঁটা ছাড়া তোর আবার কাজ কি?’
‘আরেকজনের কাঁটা নামাতে হবে। চিতলমাছের কাঁটা গলায় বিঁধিয়ে বসে আছে। কোঁ কোঁ করছে।সেই কাঁটা তুলতে হবে।’
‘আমাকে নিয়ে চল। আমি দেখি ব্যাপারটা কি?’
‘আপনাকে নেয়া যাবে না খালা। মন্ত্র-তন্ত্রের ব্যাপার তো। মেয়েদের সামনে মন্ত্র কাজ করে না।’
‘মেয়েরা কি দোষ করেছে?’
‘মেয়েরা কোন দোষ করেনি।দোষ করেছে মন্ত্রে। এই মন্ত্র নারী বিদ্বেষী।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে না নিতে চাইলে না নিবি। গাড়িতে উঠ, তোকে কিছুদূর এগিয়ে দি। রোদের মধ্যে হাঁটছিস দেখে মায়া লাগছে।’
কেউ গাড়িতে উঠার জন্যে বেশি রকম পিড়াপিড়ি করলে ধরে নিতে হবে গাড়ি নতুন কেনা হয়েছে। আমি গাড়িতে উঠতে বললাম, গাড়ি নতুন কিনলে?
‘নতুন কোথায়, ছয় মাস হয়ে গেলো না।’
‘ছয় মাসে স্বামী পুরাতন হয়—গাড়ি হয় না। দারুণ গাড়ি।’
‘তোর পছন্দ হয়েছে?’
‘পছন্দ মানে! এরোপ্লেনের মত গাড়ি।’
‘এই গাড়ির সবচে বড় সুবিধা কি জানিস? সামনা-সামনি কলিশন হলে গাড়ির কিছু হবে না, কিন্তু অন্য গাড়ি ভোতা হয়ে যাবে’
‘বাহ দারুণ তো।’
তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগছে রে হিমু। চাকরি-বাকরি কিছু করছিস?’
‘আপনার হাতে চাকরি আছে?’
‘না।তোর খালুর মৃত্যুর পর মিল-টিল সব বিক্রি করে ক্যাশ টাকা করে ফেলেছি। ব্যাঙ্কে জমা করেছি। আমি একা মানুষ—মিল-টিল চালোনো তো সম্ভব না। সবাই লুটে-পটে খাবে। দরকার কি।’
‘কোন দরকার নেই।’
গাড়ি চলছে। কোন বিষেশ দিকে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ড্রাইভার তার ইচ্ছমত চালাচ্ছে। মীরপুর রোড ধরে চলতে চলতে ফট করে ধানমন্ডি চার নাম্বারে ঢুকে পড়ল। আবার কিছুক্ষণ পর মীরপুর রোডে চলে এল।
‘হিমু।’
‘জ্বি খালা।’
‘তোর খালুর স্মৃতি রক্ষার্থে একটা কিছু করতে চাই। কর্মাযোগী পুরুষ ছিল। পথের ফকির থেকে কলকারখানা, গার্মেন্টস, করেনি এমন জিনিস নেই।স্ত্রী হিসেবে তার স্মৃতি রক্ষার জন্যে আমার তো কিছু করা দরকার।’ু
‘করলে ভাল। না করলেও চলে।’
‘না না করা দরকার। ভাল কিছু করা দরকার। উনার নামে একটা আর্ট মিউজিয়াম করলে কেমন হয়।’
‘ভাল হয়। তবে খালু সাহেবের নামে করা যাবে না। মানাবে না।’
‘মানাবে না কেন?’
“গনি মিয়া মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট” শুনতে ভাল লাগছে না। খালু সাহেবের নামটা গনি মিয়া না হয়ে আরেকটা সফেসর্টিকেটেড হলে মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট দেয়া যেত। তোমার নিজের নামে দাও না কেন?“রেশমা মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট” শুনতে তো খারাপ লাগছে না।’
গাড়ি মীরপুর রোড থেকে আবার ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ঢুকে পড়েছে। আবারো মনে হয় মীরপুর আসবে। ভাল যন্ত্রণায় পড়া গেল!
‘খালা, আমার তো এখন যাওয়া দরকার। চিতল মাছের কাঁটা নামানো খুব সহজ না।’
আহা বোস না। তোর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। কথা বলার মানুষ পাই না। কেউ আমার বাড়িতে আসে না। এটা একটা আশ্চয় কাণ্ড। তোর খালুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কার্ড ছাপিয়ে পাঁচশ লোককে দাওয়াত দিয়েছি। তিনটা দৈনিক পত্রিকায় কোয়াটার পেইজ বিজ্ঞাপন দিলাম। লোক কত হয়েছে বল তো?’
‘একশ?’
‘আরে না—আঠারো জন। এর মধ্যে আমার নিজের লোকই সাতজন। ড্রাইভার, মালী, দারোয়ান, কাজের দুটো মেয়ে।’
‘আমাকে খবর দিলে চলে আসতাম।’
তোর কোন স্থায়ী ঠিকানা আছে? ঠিকানা নেই। রাস্তায় যে ফকির গুলি আছে তাদেরও ঠিকান আছে। রাতে তারা একটা নিদিষ্ট জায়গায় ঘুমায়। আজীজ মার্কেটের বারান্দায় যে ঘুমুরে সে সেখানেই ঘুমাবে। সে কমলাপুর রেল স্টেশনে ঘুবুবে না। আর তুই তো আজ এই মেসে, কাল ঐ মেসে। হিমু, তুই চলে আয় তো আমার কাছে। গুলশানের বাড়ি নতুন করে রিনোভেট করেছি। টাকাপয়সা করচ করে হুলস্থুল করেছি। তোর ভাল লাগবে। আসবি?’
‘ভেবে দেখি।’
‘ভাবতে হবে না। তুই চলে আয়। থাকা-খাওয়া খরচার হাত থেকে তো বেঁচে গেলি। মাসে মাসে না হয় কিছু হাতখরছও নিবি।’
‘কত দেবে হাতখরচ?’
‘বিড়ি-সিগারেটের খরচ—আর কি। কি, থাকবি? তুই থাকলে একটা ভরসা হয়। দিনকালেন যে অবস্থা চাকর-দারোয়ান এরাহ বর্টি দিয়ে কুপিয়ে কোনদিন না মেরে ফেলে। এমন ভয়ে ভয়ে থাকি। চলে আয় হিমু। আজই চলে আয়। বাড়ি তো চিনিসই। চিনিস না?’
‘হু।’
‘তোকে দেখে আরেকটা কথা ভাবছি—বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা আছে প্যারা নরমাল পাওয়ার যাদের, এদের বাড়িতে নিয়ে রাখলেন কেমন হয়? এসট্টলজার, পামিস্ট, বুঝতে পারছিস কি বলছি?’
‘পারছি—ইন্সটিটউট অব সাইকিক রিসার্চ টাইপ।’
‘ঠিক বলেছিস। বাংলাদেশে তো এরকম আগে হয় নি। না-কি হয়েছে?’
‘না হয়নি। করতে পার। নাম কি দেবে।“গনি মিয়া ইন্সটিটউট অব সাইকিক রিসার্চ”।’
‘নামটা কেমন শুনাচ্ছে?’
‘মিয়াটা বাদ দিলে খারাপ লাগবে না—গনি ইন্সটিটউট অব সাইকিক রিসার্চ। খালা, এইখানে আমি নামব। ড্রাইভার, গাড়ি থামাও। গাড়ি না থামালে আমি জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়ব।’
ড্রাইভার গাড়ি থামালো। রেশমা খালা বলল, কি ঠিক হল? তুই আসছিস?
‘হুঁ। আমার এ মাসের হাতখরচের টাকা দিয়ে দাও।’
‘থাকাই শুরু করলি না—হাতখরচ কি?’
‘আমি তো খালা চাকরি করছি না যে মাসের শেষে বেতন। এটা হল হাত খরচ।’
‘তুই আগে বিছানা-বালিশ নিয়ে উঠে আয়, তারপর দেখা যাবে।’
‘আচ্ছা।’
আমি লম্বা লম্বা পা ফেলা শুরু করলাম। উদ্ধার পাওয়া গেছে, এখন চেষ্টা করা উচিত যত দূরে সরে পড়া যায়। সম্ভাবনা খুব বেশি যে খালা তার গাড়ি নিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসবে। আমার উচিত ছোট কোন গলিতে ঢুকে পড়া, যেখানে পাজেরো টাইপ গাড়ি ঢুকতে পারে না।
‘এই হিমু, এই, এক সেকেন্ড শুনে যা। এই, এই।’
বধির হয়ে যাবার ভান করে আমি গলি খুঁজছি। গাড়ির ড্রাইভার ক্রামগত হর্ন দিচ্ছে। না ফিরলে চারদিকে লোক জমে যাবে। বাধ্য হয়ে ফিরলাম।
‘নে, হাতখরচ নে। না দিলে আবার হাত খরচ দেয়া হয় নি এই অজুহাতে আসবি না।’
রেশমা খালা একটা চকচকে পাঁচশ টাকা নোট জানালা দিয়ে বাড়িয়ে ধরল।
‘তুই সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসিস। সন্ধ্যার পর থেকে আমি বাসায় থাকি। নানান সমস্যা আছে, বুঝলি? ভয়ংকর ব্যাপার ঘটেছে। কাউকে বলা দরকার। রাতে এক ফোঁটা ঘুমুতে পারি না।’
‘চলে আসব।’
‘টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পকেটে রাখ। হারিয়ে ফেলবি তো।’
‘খালা, আমার পকেট নেই। যাবতীয় টাকাপয়সা আমাকে হাতে নিয়ে ঘুরতে হয়।’
‘বলিস কি!’
‘খালা যাই?’
‘যাই বলে দেরী করলাম না, প্রায় দৌড়ে এক গলিতে ঢুকে পড়লাম।
টাকা কি কেউ হাতে নিয়ে ঘুরে? বাসের কন্ডাক্টাররা টাকা হাতে রাখে। আর কেউ? পাঁচশ টাকার চকচকে একটা নোট হাতে রাখতে বেশ ভালই লাগছে। নোটটা এতই নতুন যে ভাজ করতে ইচ্ছা করছে না। চনমনে রোদ ওঠায় গরম লাগছে। নোটের সাইজ আরেকটু বড় হলে টাকা দিয়ে বাতাস খেতে খেতে যাওয়া যেত।
খালার হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছি শ্যামলীতে। সেখান থেকে কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। হেঁটে হেঁটে আবার নিউ মার্কেটের কাছে চলে আসা যায়। ইচ্ছা করলে রিকশা নিতে পারি ভাড়া দেয়া সমস্যা হবে না। বুড়ো অথর্ব টাইপ রিকশাওয়ালা যাদের রিকশায় কেউ চড়ে না, এমন কেউ যে রিকশা ঠিকমত টানতেও পারে না, বয়সের ভারে কানেও ঠিক শুনে না, গাড়ির সামনে হঠাৎ রিকশা নিয়ে উপস্থিত হয়—এইসব রিকশায় চড়া মনে পদে পদে বিপদের মধ্যে পড়া।
যেহেতু রেশমা খালার বাড়িতে আমি থাকতে যাব না, সেহেতু এই পাঁচশ টাকা কোন এক সৎকর্মে ব্যয় করতে হবে।
অনেকদিন কোন সৎকর্ম করা হয় না। ভাড়া হিসেবে পুরো নোটটা দিয়ে দিলে সাধারণ মানের একটা সৎকর্ম করা হবে।
পছন্দসই কোন রিকশাওয়ালা পাওয়া যাচ্ছে না। একজনকে বেশ পছন্দ হল, তবে তার বয়স অল্প। বুড়ো রিকশাওয়ালা কেউেই নেই। বুড়োরা আজ কেউই রিকশা বের করেনি। আসাদ গেটে এসে একজনকে পাওয়া গেল। চলনসই ধরনের বুড়ো। রিকশার সীটে বসে চায়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খাচ্ছে। সকালের ব্রেকফাস্ট বোধ হয় না, বারোটার মত বাজে। লাঞ্চ হবারও সম্ভাবনা কম। সম্ভবত প্রি-লাঞ্চ।
‘রিকশা, ভাড়া যাবেন?’
বুড়ো প্রায় ধমকে উঠলো—না। খাওয়ার মাঝখানে বিরক্ত করায় সে সম্ভবত ক্ষেপে গেছে।
‘কাছেই যাব। বেশি দূর না—নিউ মাকেটে।’
‘ঐ দিকে যামু না।’
‘ফার্ম গেটে যাবেন? ফার্মগেটে গেলেও আমার চলে।’
‘যামু না।’
‘যাবেন না কেন?’
‘ইচ্ছা করতাছে না।’
‘আমি না হয় অপেক্ষা করি। আপনি চা শেষ করেন, তারপর যাব। ফার্মগেট যেতে না চান তাও সই। অন্য যেখানে যেতে চান যাবেন। আমাকে কোন এক জায়গায় নামিয়ে দিলেই হবে।’
মনে হল আমার প্রস্তাবে সে রাজি হয়েছে। কিছু না বলে চা-পাউরুটি শেষ করল। লুঙ্গির ভাজ থেকে বিড়ি বের করে আয়েশ করে বিড়ি টানতে লাগল। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছি। কাউকে দান করতে যাওয়াও সমস্যা। দান করতেও ধৈর্য লাগে। হুট করে দান করা যায় না। বুড়ো বিড়ি টানা শেষ করে রিকশার সীট থেকে নামল। আমি উঠতে যাচ্ছি সে গম্ভীর গলায় বলল, কইছি না, যামু না। ত্যক্ত করেন ক্যান?’
সে খালি রিকশা টেনে বেরিয়ে গেল। পাঁচশ টাকার চকচকে নোটটা তাকে দেয় গেলো না।
আমি ফার্মগেটের দিকে রওয়ানা হলাম। নানান কিসিমের অভাবী মানুষ ঐ জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ভিক্ষার বিচিত্র টেকনিক দেখতে হলে ফার্মগেটের চেয়ে ভাল কোন জায়গা হতে পারে না। একবার একজনকে পেয়েছিলাম ইংরেজিতে ভিক্ষা করেন।
‘Sir, I am a needy man, sir.’
‘Three school going daughters.’
`Lost my job, presently pennyless,’
আমি বললাম, ইংরেজিতে ভিক্ষা করছেন কেন? বাংলা ভাষার জন্যে আমরা এত রক্ত দিয়েছি সে কি ইংরেজিতে ভিক্ষা করার জন্যে? ভিক্ষার জন্যে বাংলার চেয়ে ভাল ভাষা হতেই পারে না।
ইংরেজি ভাষার ভিক্ষুক চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল। আমি বললাম, ফেব্রুয়ারি মাসেও কি ইংরেজিতে ভিক্ষা করেন? না-কি তখন বাংলা ভাষা?
আরেকজন আছেন, ভদ্রচেহারা। ভদ্র পোশাক। তিনি এসে খুবই আদরের সঙ্গে বলেন, ভাই কিছু মনে করবেন না—কয়টা বাজে। আমার ঘড়িটা বন্ধ।
যাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি ভদ্রলোকের ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে যান—ঘড়ি দেখে সময় বলেন।
অসংখ্য ধন্যবাদ। আজকাল মানুষ এমন হয়েছে সময় জিজ্ঞেস করলে রেগে যায়।
‘না না, ঠিক আছে।’
তখন ভদ্রলোক গলা নিচু করে বলেন—ভাই সাহেব, একটা মিনিট সময় হবে? দু’টা কথা বলতাম।
যে সময় দিয়েছে সেই মরেছে। তার বিশ পঁচিশ টাকা খসবেই।
আরেক ভদ্রলোককে মাঝে মাঝে দেখা যায়। খদ্দরের পায়জামা পাঞ্জাবির পকেটে সম্রাট আকবরের সময়কার একটা মোহর। দেড় ভরির মত ওজন। তাঁর গল্প হচ্ছে—তিনি একসময় মুদ্রা ভর্তি একটা ঘটি পেয়েছেন। কাউকে জানাতে চাচ্ছেন না। জানলে সরকার সীজ করে নিয়ে যাবে। তিনি গোপনে মুদ্রাগুলি বিক্রি করতে চান। তাই বলে সস্তায় না। সোনার যা দাম সেই হিসেবে কিনতে হবে। কারণ খাঁটি সোনার মোহর। ভদ্রলোকের মূল ব্যবসার জায়গা ফার্মগেট না। ফার্মগেটে তিনি অন্য উদ্দেশ্যে আসেন। উদ্দেশ্যেটা আমার কাছে পরিষ্কার না।
পরিচিত ভিক্ষুকের কাউকেই পেলাম না তবে আশ্চার্যজনকভাবে আবদুর রশীদকে পেয়ে গেলাম। চশমা দেখে চিনলাম। চশমার ডাঁট নেই, সূতা দিয়ে কানের সঙ্গে বাঁধা। হাতে এক তাড়া কাগজ নিয়ে এর-তার কাছে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান। হলুদ রঙের একটা খামও আছে। নির্ঘাৎ এক্সরে প্লেট।
‘রশীদ সাহেব না? কেমন আছেন? চিনতে পারছেন?’
ভদ্রলোক চশমার আড়াল থেকে পিট পিট করে তাকাচ্ছেন। চিনতে পারছেন কি-না বোঝা যাচ্ছে না।
‘চশমার ডাঁট আবার ফেলে দিয়ে সূতা লাগিয়েছেন? এতে কি ভিক্ষার সুবিধা হয়?’
আপনাকে চিনতে পারছি না।’
‘চিনবেন না কেন? আমি বদরুল সাহেবের বন্ধু। আপনার হাতে কি? প্রসক্রিপশন? এতো পুরানো টেকনিকে গেলেন কেন?’
আবদুর রশীদ কাঁপা কপা গলায় বললেন, ছেলে মরণপন্ন। লাংসে পানি জমেছে।প্লুরিসি। প্রফেসর রহমান ট্টিটমেন্ট করেছেন। বিশ্বাস না হলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ নং ওয়ার্ডে যেতে পারেন।
‘অবস্থা খারাপ?’
আবদুর রশীদ জবাব দিলেন না। ক্রুর দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। আমি বললাম, টাকাপয়সা কিছু জোগাড় করতে পেরেছে?
‘তা দিয়ে আপনার দরকার কি?’
‘দরকার আছে। আমি এককাপ চা খাব। চা এবং একটা সিগারেট। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। হাতে একদম পয়সা নেই।’
‘পাঁচশ টাকার একটা নোট তো আছে।’
‘নোটটা আমার না। বুড় এক রিকসাওয়ালার নোট। তাকে ফিরত দিতে হবে। খাওয়াবেন এক পাপ চা? আপনার কাছে আমার চা পাওনা আছে। ঐদিন আপনাকে চা-সিঙ্গাড়া খাইয়ে ছিলাম।’
আবদুর রশীদ চা খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। শুকনো গলায় বললেন, চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন?
‘সিঙ্গাড়া খাওয়ান। তাহলে শোধবোধ হয়ে যাবে। আপনিও আমার কাছে ঝণী থাকবেন না। আমিও ঝণী থকবো না।’
চায়ের সঙ্গে সিঙ্গাড়াও এল। আমি গলার স্বর নামিয়ে বললাম, রশীদ সাহেবে, ভিক্ষার একটা ভাল টেকনিক আপনাকে শিখিয়ে দেই। কিছুদিন ব্যবহার করতে পারবেন, তবে এক জায়গায় একবারের বেশি দু’বার করা যাবে না। জায়গায় বদল করতে হবে। বলব?
রশীদ সাহেবে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। তাঁর চোখ-মুখ কঠিন। আমি খানিকটা ঝুঁকে এসে বললাম, ময়লা একটা গামছা শুধু পরবেন। সারা শরীরে আর কিছূ থাকবে না। চোখে চোশমা থাকতে পারে। আপনি করবেন কি—মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত টাইপের লোকদের কাছে যাবেন। গিয়ে নিচু গলায় বলবেন—আমার কোন সাহায্য লাগবে না, কিচ্ছু লাগবে না, দোকান থেকে আমাকে শুধু একট লুঙ্গি কিনে দেন। কেউ টাকা দিতে চাইলেও নিবেন না, দেখবেন দশ মিনিটের ভেতরে আপনাকে লু্ঙ্গি কিনে দেবে। তবে একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন—বড় লোকের কাছে কিছু চাইবেন না। কিন্তু যারা নিম্নবিত্ত তারা আপনাকে দেখে আতংকগ্রস্ত হবে। ওদের মনে হবে একদিন আপনার মত অবস্থা তাদেরও হতে পারে। তখন তারা ব্যস্ত হয়ে পড়বে লুঙ্গি কিনে দিতে। সেই লুঙ্গি আপনি বিক্রি করে দেবেন। আবার আরেকটা ব্যবস্থা করবেন। বুঝতে পারছেন? মন দিয়ে কাজ করলে দৈনিক পাঁচ থেকে ছয়টা লুঙ্গির ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে।
আবদুর রশীদ কঠিন চোখে তাকালেন। আমি বেনীত ভঙ্গিতে বললাম, ভাল বুদ্ধিু দিয়েছি, এখন একটা সিগারেট খাওয়ান।
আবদুর রশীদ খাওয়ালেন না। চা-সিঙ্গাড়া দাম দিয়ে উঠে চলে গেলেন। বুড়ো রিকশাওয়ালা একজন পাওয়া গেল। বুড়ো হলেও তার গায়ে শক্তি সামর্থ ভালই। টেনে রিকশা নিয়ে যাচ্ছে। গল্প জমাবার চেষ্টা করলাম। গল্প জমল না।শুধু জানালো তার আদি বাড়ি ফরিদপুর।
সাতটাকা ভাড়ায় জায়গায় পাঁচশ টাকা ভাড়া পেয়ে তার চেহারার কোন পরিবর্তন হল না। নির্বিকার ভঙ্গিতেই সে টাকাটা রেখে দিল। গামছা দিয়ে মুখ মুছল। মনে হয় তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
ম্যানেজার হায়দার আলী খাঁ আমাকে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, সকাল থেকে আপনার জন্যে একটা মেয়ে বসে আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, শেষে আমি আপনার ঘর খুলে দিলাম।
‘ঘর খুলে দিলেন কেন?’
‘মেয়েছেলে কতক্ষণ আর দাড়িঁয়ে থাকবে।’
‘নাম কি মেয়ের?’
‘নাম জিজ্ঞেস করি নাই। নাম জিজ্ঞেস করলে বেয়াদবী হয়। সুন্দর মত মেয়ে। রূপা না-কি? রূপা হবার সম্ভনা খুবই কম।সে এসে দীর্ঘ সময় বসে থাকবে না। গাড়ি থেকেই তার নামার কথা না। সে গাড়িতে বসে থাকবে—ড্রাইভারকে টাঠাবে খোঁজ নিতে। তাহলে কে হতে পারে?
ঘরে ঢুকে দেখি বাদলের বাসায় যে মেয়েটিকে দেখেছিলাম—সে। পদার্থবিদ্যার ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। মীরা কিংবা ইরা নাম।
আমি খুব সহজ ভাবে ঘরে ঢুকে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য না হওয়ার ভঙ্গি করে বললাম, কি খবর ইরা,ভাল?
ইরা বসেছিল, উঠে দাঁড়ল। কিছু বলল না। তার মুখ কঠিন। ভুরু কুঁচকে আছে। বড় ধরনের ঝগড়া শুরুর আগে মেয়েদের চেহারা এরকম হয়ে যায়।
‘আমার এখানে কি মনে করে? গলায় কাঁটা?’
‘আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। আমি সেই সকাল এগারোটা থেকে বসে আছি।’
‘বোস। তারপর বল কি কথা।’
‘আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল যে আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলবেন।’
‘আমার একদম মনে থাকে না। কোন কোন মানুষকে প্রথম দেখা থেকেই এত আপন মনে হয় যে শুধু তুমি বলতে ইচ্ছা করে।’
‘দয়া করে মেয়েভুলানো কথা আমাকে বলবেন না। এই জাতীয় কথা আমি আগেও শুনেছি।’
‘পাত্তা দেননি?’
‘পাত্তা দেয়ার কোন কারণ আছে কি?’
‘আছে। ছেলেরা নিতান্ত অপারগ হয়ে এইসব কথা বলে। প্রথম দেখাতে তো সে বলতে পারে না—“আমি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।” বলতে লজ্জা লাগে। যে শোনে তারো খারাপ লাগে। কাজেই ঘুরিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়।’
‘প্রেম বিষয়ক তত্ত্বকথা আমি শুনতে আসিনি। আপনার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে। আমি কথাগুলি বলে চলে যাব।’
ইরা বসল না। দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ-মুখ যতটা কঠিন ছিল তারচেয়েও কঠিন হয়ে গেলো।
‘কথাটা হচ্ছে বাদলের বাড়িতে যে কাজের বুয়া আছে—তার একটা মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল।’
‘ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। লুৎফা নাম।’
‘সে না-কি আপনাকে বলেছিল তার মেয়েকে খুঁজে দিতে।’
‘হ্যাঁ, বলেছিল। এখনো খোঁজা শুরু করেনি। আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম।আপনি বলায় মনে পড়ল।’
‘আপনাকে খুঁজতে হবে না। মেয়ে পাওয়া গেছে।’
‘বাঁচা গেল। তিরিশ লক্ষ লোকের মাঝখান থেকে লুৎফাকে খুঁজে পাওয়া সমস্যা হত।’
‘আপনাকে সে যেদিন বলল, সেদিন দুপুরেই মেয়ে উপস্থিত। ব্যাপারটা যে পুরোপুরি কাকতালীয় তাতে কি আপনার কোন সন্দেহ আছে?’
‘কোন সন্দেহ নেই।’
‘আপনি নিশ্চয়ই দাবি করেন না যে আপনার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন?’
‘পাগল হয়েছেন!’
‘বুয়ার ধারণা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়ে কাজটা করা হয়েছে। বাদলেরও তাই ধারণা।’
‘কার কি ধারণা তাতে কি যায় আসে? মেয়েটাকে পাওয়া গেছে এটাই বড় কথা।’
ইরা কঠিন গলায় বলল, কে কি ভাবছে তাতে অনেক কিছুই যায় আসে। এই ভাবেই সমাজে বুজরুক তৈরি হয়। আপনার মত মানুষরাই সোসাইটির ইকুইলিব্রিয়াম নষ্ট করেন। বাদলের মাথা তো আপনি আগেই খারাপ করেছিলেন, এখন বুয়ার মাথাও খারাপ করলেন।
‘তাই না-কি।’
‘হ্যাঁ তাই। বাদলের মাথা যে আপনি কি পরিমাণ খারাপ করেছেন সেটা কি আপনি জানেন?’
‘না, জানি না।’
‘দু-একদিনের ভেতর একবার এসে দেখে যান। ব্রাইট একটা ছেলে। বাবা-মা’র কত আশা ছেলেটাকে নিয়ে…আপনি তাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলেছেন। ফালতু বুজরুকি। উদ্ভট উদ্ভট কথা। মহাপুরুষ মহাপুরুষ খেলা। রাতদুপুরে রাস্তায় হাঁটলেই মানুষ মানুষ মহাপুরুষ হয়ে যায়?’
ইরা রাগে কাঁপছে। মেয়েটা এতটা রেগেছে কেন বুঝতে পারছি না। এত রাগার তো কিছু নেই। আমার বুজরুকিতে তার কি যায় আসে?
ইরা বলল, আমি এখন যাব।
‘চা-টা কিছু খাবেন না?’
‘না। আপনি দয়া করে বাদলকে একটু দেখে যাবেন। ওর অবস্থা দেখে আমার কান্না পাচ্ছে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে আসলে আপনার শাস্তি হওয়া উচিত। কঠিন শাস্তি।’
ইরা গট গট করে বের হয়ে গেল। মেয়েটা বেশ সুন্দর। রেগে যাওয়ার আরো সুন্দর লাগছে। যে রাগের সঙ্গে ঘৃণা মেশানো থাকে সেই রাগের সময় মেয়েদের সুন্দর দেখায় না। যে রাগের সঙ্গে সামান্যতম হলেও ভালবাসা মেশানো থাকে সেই রাগ মেয়েদের রুপ বাড়িয়ে দেয়। ইরা কি সামান্য ভালবাসা আমার জন্যে বোধ করা শুরু করেছে? এটা আশংকার কথা। ভালবাসা বটগাছের মত। ক্ষুদ্র বীজ থেকে শুরু হয়। তারপর হঠাৎ একদিন ডালপালা মেলে দেয়, ঝুড়ি নামিয়ে দেয়।
ইরার ব্যাপার সাবধান হতে হবে। বাদলদের বাড়িতে ভুলেও যাওয়া যাবে না। ইরা মেসের ঠিকানা বের করে চলে এসেছে কি ভাবে সেটাও এক রহস্য। ঠিকান তার জানার কথা না। ঐ বাড়ির কেউ জানে না।
রাতে খেতে গিয়ে শুনি বদরুল সাহেব আমার খাওয়া খেয়ে চলে গেছেন। মেসের বাবুর্চি খুবই বিরিক্ত প্রকাশ করল।
‘রোজ এই কাম করে। আফনের খাওয়া খায়।’
‘ঠিকই করেন। আমি তাঁকে বলে দিয়েছি। এখন থেকে তিনিই খাবেন।’
‘আপনি খাবেন না?’
‘আমি কয়েকদিন বাইরে থাকব।’
ক্ষুর্ধাত অবস্থায় ঘুমানোর আলাদা আনন্দ আছে। সেই আনন্দ পাবার উপায় হচ্ছে—পেট ভর্তি করে পানি খেয়ে ঘুমুতে যাওয়া।পেট ভর্তি পানির কারণেই হোক কিংবা অন্য করণেই হোক—নেশার মত হয়।ঝিমুনি আসে।ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমের সময়ের স্বপ্নগুলি হয় অন্যরকম। তবে আজ তা হবে না।রাতে না খেলেও দিনে খেয়েছি। ক্ষুধার্ত ঘুমের স্বরূপ বুঝতে হলে সারাদিন অভুক্ত থাকার পর পেট ভর্তি করে পানি খেয়ে ঘুমুতে যেতে হয়।নেশার ভাবটা হয় তখন।
বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। বদরুল সাহেব মিহি গলায় ডাকলেন, হিমু ভাই। হিমু ভাই। আমি উঠে দরজা খুললাম।
বদরুল সাহেব লজ্জিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে এক ঠোগ্গা মুড়ি, খানিকটা গূড়। আমি বললাম, ব্যাপার কি বলুন তো?
‘শূনলাম আপনি খেতে গিয়েছিলেন। এদিকে আমি ভেবেছি আপনি আসবেন না…’
‘ও, এই ব্যাপার।’
‘খুব লজ্জায় পড়েছি হিমু ভাই। আপনার জন্যে মুড়ি এনেছি।’
‘ভাল করেছেন। আজ রাতটা উপোস দেব বলে ঠিক করেছি। মাঝে মাঝে আমি উপোস দেই।আপনি গূড়-মুড়ি খান। আমি মুড়ি খাওয়ার শব্দ শুনি।’
‘কিছু খাবেন না হিমু ভাই?’
‘না। তারপর ঐ দিন কি হল বলুন—পুলিশরা যত্ন করে খাইয়েছিলেন?’
‘যত্ন বলে যত্ন।এক হোটেলে নিয়ে গেছে। পোলাও, খাসির রেজালা, হাঁসের মাংস, সব শেষে দৈ মিষ্টি। এলাহী ব্যাপার। খুবই যত্ন করেছে। হাঁসের মাংসটা অসাধারণ ছিল।এত ভাল হাঁসের মাংস আমি আমার জীবনে খাইনি। বেশি করে রসুন দিয়ে ভুনা ভুনা করেছে। এই সময়ের হাঁসের মাংসে স্বাদ হয় না। হাঁসের মাংস শীতের সময় খেতে হয়।তখন নতুন ধান উঠে।ধান খেয়ে খেয়ে হাঁসের গায়ে চর্বি হয়। আপনার ভাবীও খুব ভাল হাঁস রাঁধতে পারে।নতুন আলু দিয়ে রাঁধে। আপনাকে একবার নিয়ে যাব। আপনার ভাবীর হাতের হাঁস খেয়ে আসবেন।’
‘কবে নিয়ে যাবেন?’
‘এই শীতেই নিয়ে যাব। আপনার ভাবীকে চিঠিতে আপনার কথা প্রায়ই লিখি তো।তারও খুব শখ আপনাকে দেখার। একবার আপনার অসুখ হল—আপনার ভাবীকে বলেছিলাম দোয়া করতে। সে খুব চিন্তিত হয়েছিল। কোরান খোতম দিয়ে বসে আছে। মেয়ে মানুষ তো, অল্পতে অস্থির হয়।’
‘আপনার চাকরির কি হল? শনিবারে হবার কথা ছিল না? গিয়েছিলেন?’
বদরুল সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, যাননি?
‘জ্বি, গিয়েছিলাম। ইয়াকুব ভুলে গিয়েছিল।’
‘ভুলে গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ। সে তো একটা কাজ নিয়ে থাকে না।অসংখ্য কাজ করতে হয়।তার পি-এ সে ফাইল দেয়নি। কাজেই ভুলে গেছে।’
‘এখন কি ফাইল দিয়েছে?’
‘এখন তো দেবেই। পি-এ-কে ডেকে খুব ধমকাধমকি করল। আমার সামনেই করল।বেচারার জন্যে মায়া লাগছিল। সে তো আর শক্রতা করে ফাইল আটকে রাখেনি। ভুলে গেছে।মানুষ মাত্রেরেই তো ভুল হয়।’
‘ইয়াকুব সাহেব এখন কি বলছে? কবে নাগাদ হবে?’
‘তারিখ-টারিক বলেনি। আরেকটা বায়োডাটা জমা দিতে বলেছে।’
‘দিয়েছেন?’
‘হুঁ।’
‘এবারো কি ফাইলের উপর আর্জেন্ট লিখে দিয়েছেন?’
‘হুঁ।’
‘আবার কবে খোঁজ নিতে বলেছেন।’
‘বলেছে বার বার এসে খোঁজ নেবার দরকার নেই। ওপেনিং হলেই চিঠি চলে আসবে।’
‘সেই চিঠি কবে নাগাদ আসবে তা কি বলেছে?
‘খুব তাড়াতাড়িই আসবে। আমি আমার অবস্থার কথাটা বুঝিয়ে বলেছি।চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলাম যে অন্যের খেয়ে বেচেঁ আছি। শূনে সে খু্বই মন খারাপ করল।’
‘বুঝলেন কি করে যে মন খারাপ করেছে? মুখে কিছু বলেছে?’
‘কিছু বলেনি। চেহারা দেখে বুঝেছি।’
‘আমার কি মনে হয় জানেন বদরুল সাহেব, আপনার অন্যান্য জায়গাতেও চাকরির চেষ্টা করা উচিত। ইয়াকুব সাহেবের উপর আমার তেমন ভরসা হচ্ছে না।’
‘ভরসা না হবার কিচ্ছু নেই হিমু ভাই।স্কুল জীবনের বন্ধু।আমার সমস্যা সবটাই জানে। আমার ধারণা এক সপ্তাহের মধ্যেই চিঠি পাব।’
‘যদি না পান?’
‘না পেলে অফিসে গিয়ে দেখা করব।বার বার যেতে লজ্জাও লাগে। নানান কাজ নিয়ে থাকে। কাজে ডিসর্টাব হয়।’
ঘর অন্ধকার।কচ কচ শব্দ হচ্ছে। বদরুল সাহেব মুড়ি খাচ্ছেন।
‘হিমু ভাই।’
‘জ্বি।’
‘ফ্রেস মুড়ি। খেয়ে দেখবেন?’
‘আপনি খান।’
মুড়ির আসলে স্বাদও পাওয়া যায় শীতকালে।আপনার ভাবী আবার মুড়ি দিয়ে মোয়া বানাতে পারে। কি জিনিস তা না খেলে বুঝবেন না।’
‘একবার খেয়ে আসব।’
‘অবশ্যই খেয়ে আসবেন।’
‘বদরুল সাহেব।’
‘জ্বি।’
‘আমি কিছুদিন অন্য জায়গায় গিয়ে থাকব। কেউ আমার খোঁজে এলে বলে দেবেন মেস ছেড়ে দিয়েছি। মিথ্যা কথা বলতে পারেন তো?’
‘আপনি বললে—মিথ্যা বলব।আপনার জন্যে করব না এমন কাজ নাই। শূধু মানুষ খুনটা পারব না।’
মানুষ খুন করতে হবে না শূধু একটা মিথ্যা বলবেন। ইরা নামের একটা মেয়ে আমার খোঁজে আসতে পারে, তাকে বলবেন আমি সুন্দরবনে চেলে গেছি। মাসখানিক থাকব। তবে রূপা এলে আমি কোথায় আছি সেই টিকানা দিয়ে দেবেন।’
‘ঠিকানাটা কি?’
‘আমার এক দুর সম্পর্কের খালা আছে। রেশমা। গূলশানে থাকে। গূলশান দুই নম্বর।বাড়ির নাম গনি প্যালেস। ঐ প্যালেসে সপ্তাহখানিক লুকিয়ে থাকব। না থাক, ওকেও সুন্দরবনের কথাই বলবেন।’