একুশে পা (Ekushey Paa) : 05
‘ভারতবর্ষে আছে শুধু ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টট্যান্ট আর কোটি কোটি ফালতু…’
বিবেকানন্দ রোডের একটা দোতলা বাড়ির একতলার বড় ঘর। খুব সম্ভব দুটো ঘর ছিল। মাঝখানের দেয়ালটা, ভেঙে একটা বড় ঘর করে নেওয়া হয়েছে। ঠিক কলেজ বা স্কুলের মতোই সারি সারি চেয়ার ও বেঞ্চ। বি. কে. সি.-র কোচিং এ অঞ্চলে এক ডাকে সবাই চেনে। ‘দোতলায় বোধ হয় সার থাকেন’ —বলছিল গৌতম, ‘একতলায় গোয়াল’ ভেঙ্কট বলল, ‘কদাচ আত্মগ্লানি করিবে না।’ গৌতম বলল, ‘নাঃ আসলে ভাবছিলুম পূর্বপুরুষরা এইভাবে প্ল্যান করে বাড়ি করে গেলে, কত সুবিধে বল।’ ভেঙ্কট বলল, ‘শুধু আমরাই নেই, ওদিকে রান্নামহল আছে। একেকদিন ছ্যাঁচড়ার গন্ধ আসে।’ ‘ছ্যাঁচড়া?’ গৌতম নাক কুঁচকোলো। ‘কিছু মনে করিসনি ভেঙ্কট বি. কে. সি.-র এখন আমাদের দৌলতে যা মালকড়ি তাতে করে এবেলা ওবেলা মাংস খাওয়া উচিত। ইল্লিশ মৎস্য, রোগন জুস, মুর্গ মুসল্লম, কাশ্মীরি কাবাব, তা না খেয়ে ছ্যাঁচড়া খাচ্ছেন? ছিঃ। এইজন্যই কবি বলেছিলেন, “রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি”।’
বি. কে. সি. আজ বেশ মেজাজে আছেন মনে হচ্ছে। বেশ টুসটুসে চেহারাটি ভদ্রলোকের। গাল-টালগুলো বেশ লালচে। কিন্তু চোখগুলো খুব সিরিয়াস। বি. কে. সি. উদাস মুখে বললেন, ‘বুঝলে বাবারা, পড়তে এসেছ, পড়ো, পরীক্ষা পাস করো। সবাই করো। কিন্তু চোখ-কান খোলা রেখে দিও। এমন একটা যুগ এসেছে যে তোমাদের নিজেদের জোরেই চলতে হবে। তাই বলে কি আর আমাদের কাছ থেকে গাইড্যান্স পাবে না? সে কথা বলছি না। কিন্তু মনে রেখো তোমরাই এভরিথিং। আমাদের নানা দিকে বাঁধন। বহু ওবলিগেশনস। অত কর্মশক্তি নেই। তোমাদের বয়সে আমরা প্রায় পুরোটাই অভিভাবকদের দ্বারা পরিচালিত হতাম। এই সমাজ, সংস্কার, এই রাজনীতি, এর ভেতরে ছোট ছোট নাট বল্টু ছিলাম। যে যার নিজের জায়গায় পুরো সিসটেমটার সঙ্গে সঙ্গে পাক খেতাম। ভাবতাম খুব করছি। ফলে কখনও কখনও খুব আত্মপ্রসাদ হত, আবার কখনও কখনও খুব হতাশ হয়ে পড়তাম। এখনও ঘুরছি। চাকাটার সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছি। কিন্তু এটাকে ভিশাস সাইকল বলে এখন চিনতে পারি, বুঝতে পারি। পুরো ঘোরাটা দেখতে পাই। তোমরা আমাদের থেকে ভালো পোজিশনে আছ এই জন্যে যে অনেক ছোট থেকেই তোমরা বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছ। এখন এ যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে কিছুই আর গোপন নেই। আমরা পরিণত বয়সে এসে তবে এই চক্র দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তোমরা দেখতে পেয়েছ এখন থেকেই। হয়ত শনাক্তও করেছ এটাকে অনেকেই। সমাজের নানা স্তরে—শিক্ষায়, রাজনীতিতে সামাজিক নানান ব্যাপারে, সর্বত্র যে চাকাটা একইভাবে গড়িয়ে চলেছে তাকে থামানো দরকার। থামিয়ে আবার নতুন করে ঘুরিয়ে দিতে হবে। এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাজটা একদিনে হবার নয়। কারণ এ চাকার এই অভিমুখে ঘূর্ণন তো একদিনে হয়নি। বহু শতাব্দী ধরে হয়েছে।’ বি. কে. সি. থামলেন।
বি. কে. সি.-র কোচিং ক্লাসে দু ব্যাচ ছাত্র আসে। ফার্স্ট ব্যাচ, সেকেন্ড পার্ট। দশ জনের জায়গা আছে। সেকেন্ড ব্যাচ, ফার্স্ট পার্ট। দশ জন। দক্ষিণা আড়াইশ। বি. কে. সি. নাকি দুর্দান্ত সব নোটস দেন। সম্ভাব্য প্রশ্নের তালিকাও প্রত্যেকবার শতকরা আশি ভাগ মিলে যায়। গৌতম, ভেঙ্কট, রাজেশ্বরী, বিষ্ণুপ্রিয়া এবং আরও কেউ-কেউ ভর্তি হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনও নোটস পায়নি। সম্ভাব্য প্রশ্নতালিকা তো নয়ই। অবশ্য দেরি আছে অনেক। ইতিমধ্যে সার বেশ কিছু প্রশ্ন লিখতে দিয়েছেন। শক্ত শক্ত ইংরিজি টেক্সট বুক থেকে সংক্ষিপ্ত করতে দিয়েছেন। সংক্ষিপ্তকরণে গৌতম আর রাজেশ্বরী সারকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। উত্তর প্রায় কারোই মনোমত হয়নি। সার আজকে খাতাগুলো ফেরত দিয়ে কিছুটা আলোচনা করে আবার লিখে আনতে বললেন। তারপর অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলেন।
একটি ছেলে হঠাৎ উঠে দাড়িয়ে হেঁড়ে গলায় বলল, ‘সার, প্লিজ এক্সকিউজ মি, ওই ভিশাস সাইকলের ব্যাপারটা কি আমাদের সিলেবাসে আছে? এবার কোয়েশ্চেন আসার কোনও চান্স আছে?’
বাকিরা শিউরে উঠল। কেউ কেউ মজা পেল। বি. কে. সি. কিন্তু রাগলেন না। বললেন, ‘য়ুনিভার্সিটি পরীক্ষায় ঠিক এই ফর্মে আসার চান্স নেই। তবে এখনও ওই চক্রের মধ্যে আছ। ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই এখন থেকে সচেতন করে দিচ্ছি।’
‘আপাতত য়ুনিভার্সিটি পরীক্ষার সিলেবাস মাফিক নোটস-টোটসগুলো পেলেই আমাদের চলবে সার। মাস-মাস আড়াইশ টাকা করে গচ্চা যাচ্ছে। প্লিজ ডেলিভার দা গুডস সার! গার্জেনদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়।’
এতটা খোলাখুলি আক্রমণে বি. কে. সি. একটু থতিয়ে গেলেন। তারপরে বললেন, ‘গুডস সম্পর্কে তোমার ধারণাটা কী শুনি! কী পেলে তুমি মনে করবে তোমার আড়াইশ টাকা উশুল হল?’
‘নোটস ন্যাচারালি। সাজেশনস! যাতে পরীক্ষাটা ভালোভাবে উতরোতে পারি।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমার ভাগ্য। চাকরিবাকরি জোটা সবই তো কপাল! লাইন মারতে হবে। ঠিকঠাক লাইন করতে পারলে চাকরি পেয়ে যাব।’
‘অর্থাৎ চক্রটার মধ্যে ঢুকে পড়বে?’
‘চক্র-ফক্র জানি না সার। স্রেফ লাইন, লাইন মেরে একটা কলেজে ঢুকে যাব। তারপর দেখি আমাকে কে ঠেকায়।’
‘কী পড়াবে?’
‘এই তো নোটস যোগাড় করছি। এই সবই স্রেফ ঝেড়ে দেব ক্লাসে। কোচিং খুলব। পাঁচশ নেব, এই নোটসগুলোই দেব।’
‘তাহলে হরে-দরে চাকা ঘুরে ঠিক এই জায়গাতেই পৌঁছবে—ভিশাস সাইকল?’
ছেলেটি এবার সত্যি-সত্যি ভিশাস চেহারা ধারণ করল। চেঁচিয়ে বলল, ‘তো আপনি কী করছেন? আপনি নেই এই ভিশাস সাইকলে? কলেজে ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে কোচিং করছেন না? দু হাতে কামাচ্ছেন না? একগাদা নোটস তৈরি করে রেখে বছরের পর বছর সেগুলোকে ভাড়া খাটাচ্ছেন না?’
‘নো।’ বি. কে. সি. উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘প্রথমত আমি কলেজ আওয়ার্সের বাইরে কোচিং করি, এবং নোটস প্রত্যেক বছর রিভাইজিং করি, দ্বিতীয়ত,’ দু হাত মুঠো করে টেবিলের ওপর আঘাত করে তিনি বললেন, ‘আই অ্যাম ট্রাইং টু ব্রেক দিস সাইকল ইন মাই ওন, স্মল, লিমিটেড ওয়ে। আমি তোমাদের নোটস দোব না, দরকার মনে না করলে। আমি তোমাদের শেখাতে চাইছি। নিজেরা যাতে বিষয়টা ধরতে পার, দখল আসে তার ওপর, এবং লিখতে পার সেই চেষ্টাই আন্তরিকভাবে করব বলে, গোড়ার থেকে নোট দেওয়া বন্ধ করেছি। তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি খাটছি তোমাদের জন্যে। এর চেয়ে বেশি চার্জ করলেও অন্যায় হত না। রাতে যখন শুই, আই ফিল কমপ্লিটলি ড্রেইনড। একেবারে ছিবড়ে হয়ে যাই, বুঝলে?’
আরেকটি ছেলে এই সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না সার, আমরা আপনর নোটের খ্যাতি শুনেই এসেছি। গত দু বছরের ছাত্রদের তো আপনি নোটস দিয়েছেন, আমাদের বেলায় দেবেন না কেন?’
‘শুনবে তাহলে কেন? বি. কে. সি. গম্ভীর গলায় বললেন, ‘সাইক্লোস্টাইল করে সেই নোটস ছাত্ররা বিক্রি করেছে। কিছু কিছু মাস্টারমশাইও সেগুলো কিনেছেন এবং তাঁদের ক্লাসে ও কোচিঙে ব্যবহার করছেন।’ চেয়ারের ওপর বসে পড়েছেন বি. কে. সি.। অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বললেন, ‘এই পাইরেটেড নোটস তোমরা কিনতে পাবে। সেগুলো নিয়ে আমাকে নিষ্কৃতি দাও।’
রাজেশ্বরী এই সময়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। সে যেমনি লম্বা, তেমনি চওড়া। টকটকে ফর্সা তার ওপর। সে ক্লাসে এলে সবাই তার দিকে তাকাবেই এমনি তার ব্যক্তিত্ব। সে বলল, ‘সার, আমি পুলকের অভদ্র আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা এখানে শিখতেই এসেছি। আপনার ক্লাস-লেকচার শুনেই আমরা এসেছি। নোট কিংবা সাজেশ্নের জন্যে নয়। আপনি যেমন বুঝবেন, দেবেন। আপনি আমাদের গাইড করলেই আমরা খুশি।’ বলেও রাজেশ্বরী দাঁড়িয়েই রইল। সার তখনও দু হাতে মাথার চুল আঁকড়ে বসে আছেন।
ভেঙ্কট বলল, ‘এই পুলক, মাফ চা সারের কাছ থেকে।’
পুলক নামের ছেলেটি কিছু বলবার আগেই বি. কে. সি. বললেন, ‘শ্রদ্ধয়া দেয়ম, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম—বলে একটা কথা আছে। আমি তো পুলক এবং তার মতো মনোবৃত্তিসম্পন্ন কোনও ছাত্রকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দিতে পারব না। কাজেই মাফ চেয়ে কোনও লাভ নেই। পুলক, আমি তোমাকে তোমার গত মাসের টাকাটা ফেরত দিচ্ছি?’ তিনি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের একটা ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুললেন, টাকাটা বার করলেন।
পুলক পেছন থেকে ভারী ভারী পা ফেলে এগিয়ে এল, টাকাটা নিল, তারপর হঠাৎ সেগুলোকে খুব নাটকীয়ভাবে কুচিয়ে কুচিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে দুমদুম করে বেরিয়ে গেল। একা একা।
বি. কে. সি. বললেন, ‘আই অ্যাম সরি স্টুডেন্টস, আজ আর ক্লাস নেবার মুড নেই। আমি তোমাদের একটা এক্সট্রা দিন নিয়ে নেব। ডোন্ট ওয়রি।’
ওরা ন’জন খাতাকলম গুছিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। সেই বিমান বলল, ‘কী বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেল বলো তো!’
বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘তুমিও তো যোগ দিলে, তাইতে তো ও আরও জোর পেয়ে গেল।’
‘তা তোমরাও অনেস্টলি বলল, নোটস দিচ্ছেন না বলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ছিলুম না! সকলেই?’
রাজেশ্বরী বলল, ‘কিন্তু আমরা ওভাবে সারের ওপর বিশ্বাস, ধৈর্য, এসব হারাইনি। তা ছাড়া উনি তো যথেষ্টই খাটছিলেন, ধরো ওই যে সামারিটা করতে দিয়েছিলেন, প্রত্যেকেরটা আলাদা করে দেখে দিয়েছেন, যে সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিলেন প্রত্যেকটি পয়েন্ট দিয়েছেন। মাস্টারমশাই কিভাবে পড়াবেন যদি আমরাই বলে দিতে পারি তো তাঁদের কাছে যাওয়ার দরকার কী? আর বি. কে. সি.-র মতো সিনসিয়ার টিচার!’ রাজেশ্বরীর গলায় ক্ষোভ ফেটে পড়ছিল।
‘সে দেখো’, বিমান বলল, ‘তোমরা কলেজে ওঁর কাছে পড়ছ, ওঁর ক্যালি জানো। আমরা অন্য কলেজের। আর পুলকের তো সত্যি কথা বলতে পড়বার সময়ই নেই। বাড়িতে বাবা পেনশন নিয়েছেন। বড় ভাই কেটে পড়েছে। বাড়ির যেখানে যা কাজ সব একধার থেকে পুলক। কলেজেও ও এস এফ-এর চাঁই। কম কাজ না কি ওর?’
রাজেশ্বরী মুখটা বিমানের দিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘প্রিয়া, যাবি নাকি?’ মেয়েদের দলটা চলে গেল। ভেঙ্কট বলল, ‘কী কেলো! এর পর সারকে মুখ দেখাতে লজ্জা করবে, যাই বল গৌতম! কোত্থেকে সব আসে বল তো এরা! সামান্য ভদ্রতাটুকুও শিখে আসেনি!’
বিমান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মুখ সামলে কথা বলবে।’ একজনের দোষে সব্বাইয়ের হাতে মাথা কাটছ!’
গৌতম উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘এই ঘেঁটু চলে আয়, চলে আয়। কী হচ্ছেটা কী?’
ভেঙ্কট চলতে চলতে আস্তিন গুটোতে লাগল। বলল, ‘যা বলেছি, ঠিক বলেছি। ভেঙ্কটেশ পাল কাউকে ভয় পায় না।’
বিমান রাস্তা পার হতে হতে চেঁচিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, পুলককে বলব কথাটা!’ চট করে একটা ট্রামে চড়ে উল্টো দিকে চলে গেল সে।
গৌতম ভেঙ্কটের সঙ্গে নিজেদের বাড়ির অভিমুখে চলতে চলতে হঠাৎ বলল, ‘এই ঘেঁটু, আমাদের ভবিষ্যৎ কী রে?’
ভেঙ্কট বলল, ‘এই যাই, জিজ্ঞেস করে আসি।’
‘কাকে জিজ্ঞেস করবি?’
‘দেখি, আল্লা, কালী, গড় যাকে পাই, আর কাউকে না পাই রাজরাজেশ্বরীকে। ও মেয়েটা মনে হয় সব রাশিফল টল জানে।’
গৌতম বলল, ‘যাঃ, সব সময়ে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। স্কুল ফাইনালে স্টার পেলুম। এইচ এস-এ সেটা হয়ে গেল মাটির পিদিম। কোথাও কোনও কিছুর সার্টনটি নেই। স্টেবিলিটি নেই। ভাবলুম মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়ব, এখন পড়ছি পল সায়েন্স। ওই পুলককেই দেখ না, বাম পলিটিক্স করে, অত বড় একটা কলেজের ইউনিয়নের চাঁই, তা সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত নয়। কী রকম ডেসপ্যারেট হয়ে গেছে দেখলি তো? আমাদের তো লাইন-ফাইন কিস্যু নেই। ধর সারের কাছে পড়ছি, চেষ্টা চরিত্তির করে একটা হাই-সেকেন্ড ক্লাস পেলুম। ধর এম.এ-টাও করলুম। তারপর? কী করব?’
‘চাকরি করব’, নিশ্চিন্তমুখে ভেঙ্কট বলল।
‘চাকরি করবি কী রে শালা। চাকরি নিয়ে তোর জামাইবাবু বসে আছে?’
‘দেখ গৌতম, আমার মেজাজ ভালো নেই। জামাইবাবু তুলিসনি।’
‘তো তুই কক্ষনো সিরিয়াস হবি না?’
‘যাহা আসিবেক তাহা আসিবেক বৎস, ভাবিয়া-চিন্তিয়া কোনও কিনারা করিতে পারিবে না। যে মুহূর্তে ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স ইত্যাদিতে চান্স না পাইয়াছ, কিংবা কমার্সে না গিয়াছ, সে মুহূর্তেই তোমার ভাগ্য ফুটা হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীতে, মানে ভারতবর্ষে আছে শুধু ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আর কোটি কোটি ফালতু। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনগুলি দেখো নাই? তুমি আমি সেই ফালতু। ভাবিয়া লাভ নাই।’
‘দূর। তোর সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ নেই, সত্যি কিছু ভাবিস না?’
‘কী তখন থেকে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করছিস বল তো! আছি আমি হেসে খেলে, বেশ আছি। যখন প্রবলেম আসবে তখন সলভ করব। এখন বলে আমার মেজাজ খারাপ!’
‘এই তো বলছিস হেসে-খেলে বেশ আছিস, আবার মেজাজ খারাপ কেন?’
‘রাজেশ্বরীর চেয়ে আমি দু আঙুল বেঁটে!’ ভেঙ্কটেশ কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল।
‘তুই কি ওদিকে লাইন মারছিস নাকি? সাবধান ভেঙ্কট, ওদিকে গেলে চিরকাল ল্যাং-বোট হয়ে থাকতে হবে। কী পার্সন্যালিটি! যেন ক্লিওপ্যাট্রা!’
ভেঙ্কট ছদ্ম কান্নার সুরে বলল, ‘যেদিন থেকে ঠাকুমা শত্রুতা করে এই জগঝম্প নাম গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে সেইদিন থেকে কেউ আমায় কোনও গুরুত্ব দেয় না রে গৌতম। এ বুকটায় বড় দুঃখ!’
‘বাড়ি গিয়ে বুকে একটু জল থাবড়ে শুয়ে পড়’, গৌতম পা চালাল।
রঙমহলের কাছাকাছি একটা গলিতে ভেঙ্কটেশের বাড়ি। বাড়ি ওদের একার নয়। তিনতলা বাড়িটাতে পাঁচ শরিক। এই পাঁচ আদি শরিকের আবার ডালপালা আছে। সব্বাইকার নাম বাইরে নেম প্লেটে লেখা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে পলি-ক্লিনিক না কি? দরজাটা রাত এগারোটার আগে বন্ধ হয় না। দিবারাত্র রাস্তায় কোনও না কোনও হুজুগে মাইক লেগে আছে। আলো, লোকজন। চুরি-ডাকাতির কোনও ভয় এ পাড়ায় নেই। ভেঙ্কট বলে, ‘আমরা গুপ্তযুগে বাস করি। দরজা সব সময়ে খোলা।’ এখন ছটার কাছাকাছি। এত সকাল সকাল সে কোনদিনই বাড়ি ফেরে না। দরজা দিয়ে ভেতর ঢুকেই একটা চৌকো উঠোন। কাঁচা উঠোন, তার ওপরে রাজ্যের ময়লা এবং আগাছা। শরিকদের যার যখন ইচ্ছে উঠোনটায় আবর্জনা ফেলছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ভেঙ্কটের খেয়াল হল সিঁড়িগুলো বোধ হয় কালে-ভদ্রে পরিষ্কার হয়। পায়রার। বিষ্ঠায় ভর্তি। একটা হুমদো-মতো বেরাল নেংটি ইঁদুর মুখে করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সিঁড়িতে আলো জ্বলছে না। চারদিক ঘিরে বারান্দা। তারও অবস্থা তথৈবচ। যেখানেই সবাইকার চলনপথ সেখানেই আর কারুর হাত পড়বে না। দোতলার ডানদিকের দুটো ঘর তালাবন্ধ। মেজ ঠাকুর্দার ছেলে নেই। তিন বিবাহিত মেয়েই প্রবাসে থাকে। একজন কানাডায়। তার ছেলে- মেয়েরাও সেখানে বসবাস করছে। কেউ কোনদিন আসবে না। আরেক জন থাকে পুনে, তারও ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে। পিসিমা নিজে ডাক্তার, ওখানে ফলাও প্র্যাকটিস। আসে না বিশেষ। ছোট পিসিমা থাকে আসাম। অনেক ভেতরে, কোথায় সরকারের এগ্রিকালচার্যাল রিসার্চ সেন্টার আছে, সরভোগ না কি, সেইখানে। এ পিসির মেয়ের বিয়ে হয়েছে দিল্লি। মাঝে মাঝে সেখানে গেছে ভেঙ্কট। যাই হোক, এদের কথা মনে রেখেই দোতলার এই চমৎকার ঘর দু’খানা মেজ ঠাকুর্দা তালা দিয়ে রেখেছেন। তলায় বিরাট গারাজ। তাতে ছোড়দাদুর গাড়ি থাকে। কিন্তু আরও তিনটে গাড়ি থাকতে পারত অনায়াসেই। সেই জায়গায় তার এক দাদার স্কুটার। ঘর দুটোর নাম পিসিমার ঘর। গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনও পিসিমা এখানে এসেছেন বলে মনে করতে পারল না ভেঙ্কট। মেজ ঠাকুর্দা নিজে থাকেন আর একটু এগিয়ে দু’খানা ঘর নিয়ে। ঠাকুমা বহুদিন গত। ভেঙ্কটের মা-ই তাঁর দেখাশোনা করেন। দোতলাটা পুরোই ছিল ঠাকুমা-ঠাকুর্দাদের দখলে। বড় ঠাকুর্দা অনেক দিন গেছেন, ঠাকুমা গেলেন সম্প্রতি, তাঁদের ঘরখানা তালা দেওয়া থাকে। তিন তলায় উঠতে উঠতে ভেঙ্কট মায়ের গলা পেল, ‘একটু ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দেবে, তাতেও এদের ভাগাভাগি, আমি কেন, তুমি নয় কেন, ছি ছি ছি! এ বাড়িতে মানুষ থাকে!’
‘তুমিও থাকো দিদি, মানুষের মধ্যে তাহলে তুমিও পড়ো না।’ ঝাঁঝাল গলার জবাব এলো।
‘নারদ, নারদ, নারদ নারদ’, বলতে বলতে দু তিন সিঁড়ি টপকে নিজেদের ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ভেঙ্কট। মা ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়েই তাকে দেখে চমকে গেল, ‘কি রে, তুই? এত তাড়াতাড়ি?’
‘কাজ হয়ে গেল, বাড়ি আসব না?’
‘কিছু একটা মতলব আছে নিশ্চয়ই’, কাকিমা সঙ্গে সঙ্গে বলল।
মা বলল, ‘যা বলেছ, নির্ঘাৎ কিছু মতলবে এসেছে।’
‘বাঃ, কী সুন্দর মাতৃসম্বোধন।’ মা কাকিমার দিকে পরপর চেয়ে ভেঙ্কট বলল, ‘এই তো ঝগড়া কাজিয়া করছিলে। যেই ঘেঁটু এলো অমনি দুজনে এককাট্টা হয়ে গেলে? মাইরি কাকিমা, তোমাদের প্রতিভা আছে। করো না, কাজিয়াটা কনটিনিউ করো, শুনি, যদি কিছু শিখতে পারি!’
‘ভালো হবে না ঘেঁটু, আমার হয়েছে এখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল!’ মা বলল।
কাকিমা বলল, ‘ঝগড়া থেকে কী শিখতে পারিস? শুনি!’
‘কথার পিঠে কথা, লাগসই সব প্রবাদ-বাক্য। আমাদেরও তো দরকার হয়!’
কাকিমা ছদ্মকোপে বলল, ‘হনুমান একটা।’
‘সে কাকিমা তুমিও। তুমিও হনুমতী, দেখো এইটাকে হনু বলে, কাকিমার মুখে হনু-নির্দেশ করে ভেঙ্কট মার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সমস্যাটা কী তোমাদের?’
মা বলল, ‘তোকে বলে কী করব? করিস তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।’
‘বলো না। বলো না, দেখাই যাক না ঘরের খেয়ে ঘরের মোষ তাড়াতে পারি কি না!’
‘উঠোনটা দেখেছিস? কী অবস্থা! থাকতে ঘেন্না হয়। মেজ জ্যাঠামশাই গন্ধে টিকতে পারছেন না। আমরাও টের পাচ্ছি। অসম্ভব মাছি-মশা বেড়ে গেছে। কেউ পরিষ্কার করাবে না। জমাদারও পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘আমি যদি করে দিই, কী দেবে?’
‘তুই? তুই করবি? তাহলেই হয়েছে! তবে করলে ধন্যবাদ দেব।’ কাকিমা বলল।
‘শুকনো ধন্যবাদে আর চিঁড়ে ভিজবে না আন্টি। ডেভেলপ্ড কানট্রিতে ছেলে-মেয়েদের ঘরের কাজের জন্যে পে করতে হয়। তা জানো?’
‘এটা তো ভেডেলপড্ কানট্রি নয়। এটা উন্নয়নশীল।’
‘কিন্তু এখানকার ছেলেমেয়েরা উন্নত হয়ে গেছে অলরেডি। সবাই মিলে কিছু কিছু পহা ছাড়ো আমি শুধু উঠোন কেন, সিঁড়ি, বারান্দা সব পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’
পরদিন ভোরবেলা এক অভিনব দৃশ্য দেখা গেল। হাফ-প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা ভেঙ্কট মুড়ো ঝাঁটা, খুরপি, শাবল আর বালতি নিয়ে উঠোনে নেমে পড়েছে। প্রথমেই সে তার পেল্লাই ঝাঁটা দিয়ে ময়লাগুলো সব জড়ো করল বালতিতে। দু তিনবারে সেগুলো গলির বাঁকে কর্পোরেশনের ট্যারা-হয়ে-থাকা ডাস্টবিনটাতে ফেলে দিয়ে এলো। একটা মরা ছুঁচো থেকেই মারাত্মক গন্ধটা বেরোচ্ছিল। এরপর সে খুরপি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আগাছাগুলো তুলে ফেলল। সেগুলোরও গতি হল ডাস্টবিনে, তিন চার দফায়। এবার সে আগাগোড়া উঠোনটার মাটি শাবল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ওলটপালট করে দিল। দশটা নাগাদ যখন তার কাজ শেষ হল ঘামে গা চকচক করছে, পা হাঁটু পর্যন্ত মাটি মাখা, মুখে জয়ের উল্লাস। তার নিজস্ব কাকিমা বলল, ‘কী নিঘ্ঘিন্নে ছেলেরে বাবা!’ শেষ দাদাটি অফিসে বেরিয়ে যাবার সময়ে বলে গেল, ‘ব্রাভো, ঘেঁটু থ্যাংকিউ।’ ভেঙ্কট নিচের কলতলায় আপাদমস্তক চান করে তার পরিষ্কৃত ঝাঁটা বালতি শাবল খুরপি ব্লিচিং ইত্যাদি কলঘরের কোণে গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে এলো। এই বস্তুগুলো সে কাল বাড়িরই বিভিন্ন শরিকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। ব্লিচিং পাউডার ফিনাইল ইত্যাদি কেনা হয়েছে মেজদাদুর পয়সায়।
খেয়ে-দেয়ে কলেজ বেরোবার মুখে সে মেজদাদুর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী মেজদাদু, গন্ধ আর পাচ্ছ?’
উত্তরে মেজদাদু বললেন, ‘আয় ঘেঁটু ইদিকে আয়।’
কাছে যেতে মেজদাদু সরু গলায় বললেন, ‘আমাদের স্বর্গীয় পিতৃদেব ব্যারিস্টার সর্বাণীভূষণ পাল এই বাড়ি করেছিলেন অনেক সাধ করে, পরের জেনারেশনগুলোয় অকৃতী অধমও তেমন কেউ নেই, তবু তাঁর সাধের বাড়ি কেউ নিজের বলে ভাবে না। একটু যত্ন করে না, তুমি করলে—আশীর্বাদ করি জয়ী হও।’
‘জয়ী হলে কী পুরষ্কার দেবে?’
‘যা চাইবে বাপধন, এখনও একটু ব্লিচিং-এর গন্ধ পাচ্ছি যেন!
‘শিগগিরই সুগন্ধ পাবে কথা দিচ্ছি। তখন কিন্তু পুরস্কারের কথা ভুলো না।’
মাসখানেক ধরে ভেঙ্কট তাদের এজমালি বাড়ির উঠোন, সিঁড়ি, বারান্দা পরিষ্কার করল। প্রতিদিন। তারপর মেজদাদুকে একদিন বলল, ‘সুগন্ধ চাও তো!’
‘—আর কী চাইব বল! ওই একটি ক্ষমতাই তো এখনও টিকে আছে। আজকাল তো খাবার-দাবারে পর্যন্ত সোয়াদ পাই না। বউমা রাগ করে বলে আপনার মন আর কোনদিনই পাব না। কিন্তু সত্যি বলছি ঘেঁটু মুখে দিলে সব অন্ন-ব্যঞ্জন আমার ঘাস মনে হয়।’
‘টেস্ট-বাডগুলো গেছে আর কি! তা সুগন্ধ চাও তো শতখানেক টাকা ছাড়।’
মেজদাদুর নিজের তো যথেষ্ট টাকাকড়ি আছেই। তিন মেয়ে যখন-তখন টাকা পাঠায়। শেষোক্ত টাকাগুলো তিনি ব্যাঙ্কে তোলেন না। তোশকের তলা থেকে একটা খাম বার করে তিনি দুশ টাকা ভেঙ্কটকে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিচের উঠোন ফুলের টবে ভরে উঠল। সবই গন্ধপুষ্প। ভেঙ্কট নিজে এগুলোর পরিচর্যা করে। দু একটি ভাইপো ভাইঝি ফুল দেখে আকৃষ্ট হল। তখন সে তাদেরও লাগিয়ে দিল ফুলবাগানের কাজে।
কয়েকদিন আগেই কর্পোরেশন থেকে একটা নোটিস এসেছিল। বাড়ি অবিলম্বে সারাই করতে হবে, নইলে বাড়ি ভাঙা হবে। সেই নোটিসটা নিয়ে ভেঙ্কট তার ছোড়দাদুর কাছে গেল।
‘ছোড়দাদু, নোটিসটা দেখেছ তো! কী করবে ঠিক করলে?’
‘ওসব ঘুষ-ঘাষ দিয়ে কপোরেশনকে ঠেকিয়ে রাখা কিছু শক্ত না। তুই ছেলেমানুষ ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?
ভেঙ্কট বলল, ‘যা ব্বাবা গ্র্যান্ডি ফ্লোরা, কেউ মাথা ঘামাবে না, এদিকে বিশুকাকাদের ছাতে মাঝে মাঝেই আমাদের কার্নিসের চাঙড় খসে পড়ছে, সে কথা জানো? ওদের ঠাকুরের ছবি ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে গিয়েছিল একদিন, তা জানো? যদি কোনও মানুষের ঘাড়ে পড়ে তো তোমাদের সবার হাতে দড়ি পড়বে কিন্তু ছোড়দাদু।’
‘পড়লে পড়বে। ঘানি টানব এখন। তুই যা দিকি নি। কী পড়ছিস আজকাল? হঠাৎ বাড়ি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?’
‘বাঃ একেই বলে গ্র্যান্ডি ফ্লোরা। দিবারাত্র শুনছি ঘরের খেয়ে নাকি বনের মোষ তাড়াই। যেই একটু চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম করতে গেলুম অমনি মাথা ঘামাচ্ছিস কেন? পরিষ্কার সিঁড়ি দিয়ে পরিষ্কার বারান্দায় উঠতে কেমন লাগছে বলো? দুরকমের গোলাপ এনেছি। ক্রমশ গোলাপবাগান করে ফেলব উঠোনটা। কেমন লাগছে?’
‘ভালোই করেছিস। এ বাড়ির ছেলেগুলো তো সব স্বার্থপরের চূড়ান্ত। যে যার নিজের টুকুর বাইরে আর কিছুই দেখতে পায় না। মক্কেলগুলো আসে, সদর দিয়ে ঢুকেই ধাপার মাঠ। অ্যাদ্দিন কী লজ্জাই করত! এই তো গত পরশু দ্বিজেন সমাদ্দার, একজন ধনী মক্কেল জিজ্ঞেস করছিল পড়ো উঠোনটা কী করে এমন হল!’
‘ম্যাগনিফিকো প্রোফান্ডিস! ছোড়দাদু তুমি যদি অনুমতি দাও বাড়িটা আমি সারাবার ব্যবস্থা করি।’
‘তুই বাড়ি সারাবি? তুই?’
‘হ্যাঁ আমি। আমার ভান্ডার আছে ভরে তোমা সবাকার ঘরে ঘরে, জানো না! সহযোগিতা করতে হবে। সর্বপ্রথম লাগবে অনুমতি।’
‘তো যা, দিলুম অনুমতি।’
‘লিখিত দাও।’
‘লিখিত আবার কী রে? পালা পালা। বড্ড ডেঁপো হয়ে গিয়েছিস।’
‘অ, যেই আটঘাট বেঁধে কাজ করতে নামছি অমনি ডেঁপো হয়ে গেলুম। শাস্ত্রে পড়েছ শতং বদ, মা লিখ। সেইটে ফলো করছ ছোড়দাদু! কিন্তু তুমি এখন ভার্চুয়াল হেড অফ দা ফ্যামিলি, তুমি লিখিত অনুমতি না দিলে আমার স্ট্যাটাস কী? লোকে আমায় টাকা দেবে কেন! এই দেখো মেজদাদু লিখে দিয়েছে।’
মেজদাদু এবং ছোড়দাদুর অনুমতি-পত্র হাতে করে, বাড়ি সারানোর এস্টিমেট এক হাতে, কর্পোরেশনের নোটিস আরেক হাতে ভেঙ্কট অতঃপর সবার দ্বারস্থ হতে লাগল গলবস্ত্র হয়ে। কোথা থেকে একটা নতুন গামছা যোগাড় করেছে, সেইটাকে গলায় ঝুলিয়ে হাত জোর করে প্রত্যেককে বলে ‘আজ্ঞে আমার গৃহদায়, কিছু ছাড়ুন, পুরো হিসেব পেয়ে যাবেন।’
কেউ বিরক্ত হয়ে, কেউ চক্ষুলজ্জায়, কেউ বা ভালোই হবে, আমাকে ঝামেলা পোয়াতে হবে না এই মনে করে প্রাথমিকভাবে কিছু কিছু দিল। কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্কটের তত্ত্বাবধানে, সম্ভবত পঞ্চাশ বছর পরে পালবাড়ি আগাপাশতলা সারাই আরম্ভ হল।