Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একুশে পা || Bani Basu » Page 23

একুশে পা || Bani Basu

স্থির ধারণা যে সে যিশুখ্রীষ্টকে দেখেছিল

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের কাছে একটা গলিতে ঠিকানাটা। মূল রাস্তাটা মোটামুটি চওড়া। কিন্তু আসল ঠিকানাটায় সরু একটা মাটির গলি পেরিয়ে পৌঁছতে হয়। খুঁজে খুঁজে নাজেহাল রাজেশ্বরী অবশেষে স্থানীয় ছেলেদের শরণাপন্ন হয়ে তবে পেল। বহু কালের পুরনো বাড়ি। নিচু দরজা। প্রথমেই সে হোঁচট খেয়ে পড়ল। দড়াম করে একেবারে। চৌকাঠটা উঁচু। তারপরে মেঝেটা খুব নিচু। কতটা, অন্ধকারে সে ধরতে পারেনি। ছেলেগুলো বাইরে দাঁড়িয়েছিল। বলল—‘ইসস্ আপনি পড়ে গেলেন?’ দু চারজন ভেতরে এসে ধরাধরি করে তাকে তুলল। ভাগ্যিস জায়গাটা শুকনো। তাই শাড়ির ধুলো-বালি ঝেড়ে নিতেই রাজেশ্বরী মোটামুটি ভদ্রস্থ হয়ে গেল। তার চিবুক একটু ছড়ে গেছে, জ্বালা করছে। হাঁটুতে বেশ লেগেছে। সে দাঁড়িয়ে হাঁটুটাকে দু-একবার সামনে পেছনে মুড়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে, একটি ছেলে বলল, ‘লেগেছে খুব? সত্যি, লীলাদি পারেনও বটে, এই একজন ওঁর সঙ্গে যা তো!’ এত অন্ধকার আর উঁচু উঁচু সিঁড়ি যে রাজেশ্বরী এই সাহায্য প্রত্যাখ্যান করতে সাহস করল না। ছেলেটি তার আগে আগে পথ দেখিয়ে উঠে গেল, তারপর সামনের ঘরে ঢুকে গেল। একটু পরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘যান।’

ভেতরে ঢুকে এই দিনের বেলাতেও বিজলি-বাতি-জ্বলা ঘরে বহু মেয়েকে সে ছুঁচ সুতোর বাণ্ডিল হাতে মাদুরে বসে বড় বড় কাপড় নিয়ে এমব্রয়ডারি করতে দেখল। মেয়েগুলি কেউ-কেউ একটুক্ষণের জন্যে মুখ তুলে দেখল তাকে, তারপর আবার যে যার কাজে মন দিল। এ ঘরটা পেরিয়ে একটা ছোট ঘর। ঘরটা জুড়ে একটা টেবিল। তার ওপর স্তূপীকৃত কাগজপত্র। ওধারে একজন শীর্ণ কিন্তু বেশ শক্তপোক্ত চেহারার ভদ্রমহিলা। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। আন্দাজে সে বুঝল ইনিই লীলাদি। ব্যাগের ভেতর থেকে সুকান্তদার চিঠিটা বার করে সে ভদ্রমহিলার হাতে দিল।

‘কী হল? অরুচি না অজীর্ণ?’ চিঠিটা পড়ে ভদ্রমহিলা কর্কশ, শ্লেষমিশ্রিত স্বরে বললেন। রাজেশ্বরী চুপ করে চেয়ে আছে দেখে বললেন, ‘বুঝতে পারছ না? বলছি পলিটিক্স অমন রসালো আঁটি, কত বক্তৃতা, মেলা-মেলাদ, কত লড়াই, মিছিল, স্লোগান—সব অরুচি ধরে গেল?’

রাজেশ্বরী এত হতবাক হয়ে গেছে যে কিছুই তার মুখে আসছে না।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হবে না, পারবে না।’

‘কী পারব না? কেন?’ রাজেশ্বরী এতক্ষণে বলল।

‘শাড়িটার কত দাম? যেটা পরে আছ?’

‘দাম?’ বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে রাজেশ্বরী।

‘শ তিনেক তো হবেই। বাপের কিনে-দেওয়া দামী শাড়ি পরে এ ধরনের সোশ্যাল ওয়ার্ক হয় না। আমরা শখের সোশ্যাল ওয়ার্ক করি না। দুঃস্থ মানুষ নিয়ে আমাদের কারবার। ও ঘরে ওই মেয়েগুলো কাজ করছে, দেখেছ? সব শ্যামপুকুর-বেলগেছের বস্তির মেয়ে। সারা দিন বাড়ি-বাড়ি হাড়ভাঙা খাটনি খাটে, আর রাত্তিরবেলায় ঘরের মানুষের হাতে চোরের ঠ্যাঙানি খায়। বেশির ভাগেরই আবার পুরুষটি ভেগেছে। এন্ডি-গেন্ডি ছেলেপুলে। ছেলেপুলেদের পড়াতে পারবে বলে সারা সকাল খাটনির পর দুপুরবেলায় এখানে এসে সেলাই করে। এইখানে এদের অক্ষরপরিচয়, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি, জন্মনিয়ন্ত্রণ এসব শেখাতে পারবে? এখনই তো গলগল করে ঘামছ দেখছি!’

রাজেশ্বরী খুব বিরক্ত স্বরে বলল—‘আপনি ওরকম করে বলছেন কেন? ঘামছি, সেটা আমার দোষ? বাবার কিনে-দেওয়া দামী শাড়ি পরাটা না হয় দোষের হল। যারা আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল, তারা যদি এদের সাহায্য করতে চায় তো লাভটা তো এদেরই!’

‘তাই নাকি? এদেরই লাভ? তোমাদের লাভ নেই বলছ? চাকরি, নেতাগিরি এসবের সুবিধে হবে না বুঝি! এদের লাভ! বটে! এরা যত উচ্ছন্নে যায় তোমাদের তত ছিরি খোলে তা জানো? কাজের লোকের বিয়ে-থা হলে শকুনের মতো বসে থাকো না? কবে বরে নেবে না, গর্তের ইঁদুর আবার গর্তে ফিরে আসবে? এই সেলাই-ঘর খুলেছি বলে এখানকার লোকেদের একটু দাসী-প্রবলেম হয়েছে। আমাকে তার জন্যে যা-নয়-তাই অপমান করে, তা জানো?’

এবার রাজেশ্বরীর হাসি পেল। সে বলল, ‘আমি তো করছি না! আমাকে অত বকছেন কেন? তা ছাড়া আমার কিন্তু একটু গ্রামের দিকে কাজ করবার ইচ্ছে।’

‘তাই বলো! ঠিকই ধরেছি! অ্যাডভেঞ্চার! জনসেবা-জনসেবা খেলা খেলতে সাধ গেছে। রোম্যান্স! গ্রাম কাকে বলে জানো? গাঁ? রাতে আলো জ্বলে না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। সাতটার মধ্যে সব সকালের জল দেওয়া ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে। কেরাচিনি নেই যে আলো জ্বলবে। পেঁচা ডাকবে, শেয়াল ডাকবে। বাসি পান্তা দিয়ে ব্রেকফাস্ট। আমানি খেয়েছ? ভাত পচা জল! টকটক! সবে ফার্মেন্টেশন শুরু হয়েছে। মাঠে-ঘাটে বাহ্যে-পেচ্ছাপ যেতে হবে, বিছে-সাপ-হুকওয়ার্ম সবই ধরতে পারে! গ্রাম!!’ ভদ্রমহিলা অবজ্ঞা ও বিদ্বেষের সঙ্গে বললেন। ‘আগে অর্ব্যান প্রোলেটারিয়েটের মধ্যে কাজ করো, দেখো পার কি না, তবে গাঁয়ের কথা ভেবো। আর এটুকু কষ্টও যদি অসহ্য হয়, তো এসো গিয়ে।’ ভদ্রমহিলা কিছুর একটা হিসেব করছিলেন, সেদিকেই চোখ ফেরালেন।

রাজেশ্বরী বলল, ‘আমি আবার আসব। আজ চলি।’ বলবার ইচ্ছে হয়েছিল, সেদিন সস্তার শাড়ি পরে আসব। ভুল হবে না। কিন্তু বলল না। লীলাদির মাথার মধ্যে একটু গণ্ডগোল আছে—বোঝাই যাচ্ছে। সে বেরিয়ে এলো।

সবাই সেলাই করছে। সে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একজনের সামনে উবু হয়ে বসে বলল, ‘কী এমব্রয়ডারি করছেন আপনারা?’ জবাবে মেয়েটি, এবং আশেপাশে আরও কয়েকজন খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে গেল। ভীষণ অপ্রতিভ হয়ে রাজেশ্বরী বলল, ‘হাসছেন কেন? কী হল? বাঃ কী জিনিস করছেন জিজ্ঞেস করছি…।’ হাসি বেড়ে গেল। একজন বয়স্ক মহিলা ওরই মধ্যে হাসি চেপে বলল, কাঁতা ইস্টিচ করছি গো, পাঞ্জাবি, জামা, কামিজ, গায়ে-দেবার চাদর স-ব কাঁতা ইস্টিচ। এখন যে তোমাদের খুব ফেশন গো দিদি!’

‘দেখি কেমন?’ খানিকটা দেখে সে বলল, ‘বাঃ খুব সুন্দর রং মিলিয়েছেন তো? হাসছিলেন কেন?’ আবার হাসির হুল্লোড়। রাজেশ্বরী বুঝে গেল যে কারণেই হোক সে যেমন ভেতরের ওই লীলাদি নামক ভদ্রমহিলার কাছে রাগের জিনিস, তেমনি এদের কাছে হাসির খোরাক।

সে উঠে দাঁড়াল। এবার বেরিয়ে আসবে। এমন সময় একজন জিজ্ঞেস করল, ‘দিদিমণির বাড়ি কোথায়?’ সে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ভবানীপুর।’ একজন বলল, ‘সেটা কোথায়?’ আরেকজন জবাব দিল, ‘মায়ের থানের কাছে রে!’ তখন আরেক জন বলল, ‘তোমার খুব ভাগ্যি দিদিমণি, রোজ মায়ের দর্শন পাও, পুজো দিতে পার’, ‘কত ভাগ্যি করলে তবে মায়ের থানের কাছে বাড়ি হয়!’ আরেকজন মন্তব্য করলে। একটি অল্পবয়সী বউ এই সময়ে ফিক করে হেসে বললে, ‘রাজপুত্তুরের মতো বর হবে দিদিমণির।’ তার পাশের জন বলে উঠল, ‘কী একটা যেন কথা বললি, দিদিমণি জগদ্ধাত্রীর মতো, দিদিমণির হবে না তো কি…’ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বয়স্ক একজন বলল, ‘আবার এসো গো দিদিমণি,’ অল্পবয়সী বউটি বলল, ‘ছেলে কোলে।’ জবাবে একজন বলল, ‘ছেলেও হবে। রামের মতো এত খানিক, ওই যে টি.বির রাম, গোবিল না কি?’ অল্পবয়সী বউটি দাঁত দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে বলল, ‘ছেলেই হবে, রামের মতো হবে, এতো কথা কী করে বুঝলে গো মাসি?’ মাসি বলল, ‘পাছার গড়ন দেখলেই বলতে পারি।’

এই কথাগুলো কানে নিয়ে রাজেশ্বরী বেরিয়ে এলো। ওরা কি সবাই মিলে তার পেছনে লেগেছিল না কি? যাকে বলে আওয়াজ দেওয়া! বর! ছেলে! পাছার গড়ন! উঃ! কী পাল্লাতেই পড়েছিল! লীলাদিদিমণি তো চশমার ফাঁক দিয়ে যা বললেন তার সোজাসুজি মানে দাঁড়ায়, এটা কি নাট্যশালা? নাট্যশালা না কি? রাজেশ্বরীর থেকে নরম ধাতের কেউ হলে হয়তো কেঁদে ফেলত, নয় ঝগড়া করে আসত। সুকান্তদা কি তাকে দমাবার জন্যেই ইচ্ছে করে এরকম জায়গায়, এরকম লোকের কাছে পাঠিয়েছে? তা যদি হয়, সুকান্তদার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

সে একটা ট্রাম ধরল। ভেঙ্কট বেচারির টাইফয়েড। অতদিনের আশার গেট-টুগেদারটা ওর আবার পিছিয়ে গেল। যতই ওর ফাজলামি অপছন্দ করুক—রাজেশ্বরীর মনে হল এত কাছে এসে ওকে না দেখে ফিরে যাওয়াটা খুব খারাপ হবে। এ ঠিকানাটা খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধে হল না। দরজা তো নয়। দেউড়ি যাকে বলে। খোলাই। সে ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। একটু প্যাসেজ পার হয়েই চৌকো উঠোন। প্রচুর ফুলের টব। মাঝখানে একটা বাঁধানো পুকুরে রঙিন মাছ। রাজেশ্বরী ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কোথাও নেই। অথচ সব খোলা। কী করবে? ‘ভেঙ্কট ভেঙ্কট’ করে ডাকাটাও কেমন অশোভন। সে তো এই প্রথম এলো! বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর রাজেশ্বরী বাঁদিকের চওড়া সিঁড়িটা দিয়ে উঠতে লাগল। উঠে সে বারান্দার এক ধারে দাঁড়িয়ে রইল। এখানেও কেউ কোথাও নেই। খুব দূর থেকে যেন লোহাকাটার আওয়াজ আসছে। ধুপ ধুপ করে কাপড় কাচছে কেউ। তার হাত-ঘড়িতে দুপুর আড়াইটে।

হঠাৎ রাজেশ্বরীর মনে হল এই জায়গাটা সে চেনে। আগেও এসেছে এখানে। ঠিক এইরকম পরিস্থিতি আগেও হয়েছে। সে যেন একটা খুব গোলমেলে জায়গায় গিয়েছিল, সেখানে কে তাকে খুব বকে, কারা খুব হাসি-ঠাট্টা করে, তারপর ট্রামে চড়ে সে একটা পুরনো বনেদী বাড়ির চকচকে লাল সিমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এমনি একটা বারান্দার ওপরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল।

এই সময়ে ডান পাশের ঘর থেকে গৌতম বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ‘রাজেশ্বরী?’

রাজেশ্বরী বলল, ‘অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। কি করব বুঝতে পারছিলাম না।’

‘তাই নাকি? ঘেঁটুকে দেখতে এসেছিস?’

‘ন্যাচার‍্যালি। ঘেঁটু বুঝি ভেঙ্কটের ডাক নাম?’ রাজশ্বরী হাসল, ‘যাক একটা ভদ্র নাম তা’হলে ওর আছে!’

চকচকে পালিশের কাজ করা দরজা। গৌতম বলল, ‘আয়। ঘেঁটু যা খুশি হবে না!’

‘আছে কেমন?’

‘একেবারে আসল জিনিস হয়েছিল তো! দুর্বল খুব। জ্বর নেই এখন।’

‘জেগে আছে তো!’

‘একেবারে প্যাঁট প্যাঁট করে, ঘুম বেশি হয় না তো এ রোগে।’

রাজেশ্বরীর গলা শুনতে পেয়েছিল ভেঙ্কটেশ। দু তিনটে বালিশ পিঠে একটা দারুণ সূক্ষ্ম কারুকাজকরা পালংকে ঠেস দিয়ে আধ-বসা হয়ে ছিল।

পাশে টেবিলে ফলের টুকরি। একটা মিক্সি। হীটার। সন্দেশের বাক্স। তার সামনে ভেলভেটের গদী-দেওয়া চুড়ো-অলা চেয়ার। রাজেশ্বরী চেয়ারে বসলে ভেঙ্কট এমন একটা হাসি হাসল যে কিছুক্ষণ আগেকার অভিজ্ঞতাটা রাজেশ্বরী একেবারে ভুলে গেল। সে যে অত্যন্ত বাঞ্ছিত, প্রায় অপ্রত্যাশিত, সম্মানিত একজন রাজকীয় অতিথি এটাই ভেঙ্কটেশের হাব-ভাব থেকে ফুটে বেরোচ্ছিল।

গৌতম বলল, ‘ভাগ্যিস ঘেঁটু, আজই তোর দাড়ি গোঁফ ট্রিম করে দিলুম!’

ভেঙ্কট ক্ষীণস্বরে বলল, ‘ট্রিম করলেই বা কী! না করলেই বা কী! শালগ্রামের শোয়া-বসা!’

গৌতম খুব খুশি-খুশি মুখে বলল, ‘রাজেশ্বরী তুই কিন্তু রিয়্যালি। মিঠু উজ্জয়িনী ফোন করে খবর নিয়েছে, পুলক এসেছে একবার, কিন্তু তুই একেবারে সোজা এভাবে এসে পড়বি—আমরা…’

ভেঙ্কট কথা কেটে বলল, ‘কখন বেরিয়েছ?’

ঘড়ি দেখে রাজেশ্বরী বলল, ‘সাড়ে এগারোটা হবে।’

ভেঙ্কট ভীষণ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘এই গৌতম প্লিজ, রাজেশ্বরীকে কিছু খাওয়া। ভালো করে খাওয়া। ননীর রাবড়ি আন, নদীয়া সুইটস থেকে ভালো…’

‘অমন করছিস কেন?’ গৌতম বলল, ‘এই তো টেবিলে একগাদা ফল মিষ্টি রয়েছে, আমি দিচ্ছি।’

‘না না, ওসব রোগের ঘরের জিনিস। ওসব দিসনি। যা না বাবা একবার ননীর দোকানে।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘এই রোদে সত্যি ওকে পাঠাচ্ছিস কেন! আর তোর কি ছোঁয়াচে অসুখ হয়েছে যে ওরকম করছিস! আমি এইখান থেকেই ঠিক খেয়ে নেব। কিছু হবে না।’

গৌতম বলল, ‘মুসাম্বির রস করে দিচ্ছি তোকে রাজেশ্বরী, বরফ দিয়ে। দাঁড়া।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মস্ত এক প্লেট ফল আর মিষ্টি রাজেশ্বরীর হাতে এনে দিল। ফলের রসের জন্য বরফ আনতে অন্দরের দিকে গেল। সে ফিরতে রাজেশ্বরী বলল, ‘আমার কিন্তু সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে রে, খাচ্ছি কিন্তু সব। গৌতম তুই খাবি না?’

গৌতম ছুরি দিয়ে মুসাম্বি ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘আরে আমি তো একটু আগেই খেলুম!’

ভেঙ্কট বলল, ‘ও তো দু হাতে চালাচ্ছে! বাড়ি থেকে এক দফা খেয়ে আসছে, এখানে আমার মা আহা বাবা কত সেবা করছ, খাও বলে একগাদা খাওয়াচ্ছে। এদিকে আমিও একদম একলা খেতে পারি না। রুগীর ফল সন্দেশ এসবও বেমালুম সাঁটিয়ে যাচ্ছে। কি রকম মোটা হয়ে গেছে দেখছ না?’

সত্যিই গৌতমের বেশ চকচকে চেহারা হয়েছে। সে বলল, ‘বাব্বাঃ, টাইফয়েডের রোগীর ঝামেলা কি কম! বল রাজেশ্বরী!’

‘ঠিক,’ রাজেশ্বরী ফলের রসে চুমুক দিতে দিতে বলল।

কিছুক্ষণ পর ভেঙ্কটের মা ও বউদি পরপর এসে রাজেশ্বরীর সঙ্গে আলাপ করে গেলেন। ভেঙ্কট বলল, ‘রাজেশ্বরী একটা অনুরোধ করব, রাখবে?’

‘কী?’

‘একটা গান শোনাবে?’

‘এই দুপুরে গান?’

‘প্লিজ।’

রাজেশ্বরীকে কোন কিছুর জন্যেই বেশি সাধ্য-সাধনা করতে হয় না। আধো অন্ধকার ঘরখানার মধ্যে সে সামান্য একটু সুর ভেঁজে গান ধরে ফেলল, ‘পনঘটপে নন্দলালা।’

গৌতম টেবিলের ওপর টুক টুক করে ঠেকা দিচ্ছিল। শেষ হলে বলল, ‘সত্যি রাজেশ্বরী, এরকম ফার্স্টক্লাস গাস, কেন যে পলিটিকসে ভিড়লি!’ রাজেশ্বর অবাক হয়ে বলল, ‘দুটোতে কোনও বিরোধ আছে বুঝি? আমি তো ভাবিনি!’

ভেঙ্কট বলল, ‘কমিউনিস্টরা তো ভগবান মানে না, ধর্মকে আফিম গাঁজা গুলি বলে, তা তুমি যে এই ভজনটা গাইলে এটা তো ভগবানকে লক্ষ্য করে গাওয়া, এত ভাব-টাব দিয়ে গাইলে কী করে? ডোন্ট মাইন্ড! আমি হয়ত বোকার মতো করলুম প্রশ্নটা!’

গৌতম বলল, ‘জানিস তো, অসুখটা হয়ে থেকে ভেঙ্কট খুব ভগবান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।’

ভেঙ্কট বললে, ‘অন্যায় কিছু করেছি? মৃত্যুর কাছাকাছি গেলে ভগবানের কথা মনে আসবেই। তুমি যত বড় নাস্তিকই হও।’

‘মৃত্যু? অসুখ করলেই মৃত্যুর কথা ভাবতে হবে না কি?’ রাজেশ্বরী অবাক হয়ে বলল।

গৌতম মৃদুস্বরে বলল, ‘ওর একটা সময়ে খুব বাড়াবাড়ি গিয়েছিল রাজেশ্বরী। জ্বর নামছিল না। ম্যানিনজাইটিস হয়ে যায় আর কি! যাই হোক ফাঁড়াটা কেটে গেছে।’

‘আমার কথার জবাব দিলে না!’ ভেঙ্কট জিজ্ঞেস করল।

রাজেশ্বরী বলল, ‘আমি কি ঠিক কমিউনিস্ট? এস এফ আইয়ের হয়ে দাঁড়িয়েছি তিন বছর পর পর এই পর্যন্ত। সে-ও তোরাই দাঁড় করালি। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন যা পড়েছি পল সায়েন্সে অনার্স কোর্স পড়তে গিয়ে। পার্টি-মেম্বারও নই। কিছুই না। কেউ আমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে নাস্তিক হতে বলেওনি। কিন্তু আমি স্বাধীন বিচার-বুদ্ধি দিয়েই বলছি ভগবানে আমি ঠিক বিশ্বাস করি না। যা যুক্তিবুদ্ধির বাইরে, যার কোনও প্রমাণ নেই, কেমন করে তাতে বিশ্বাস করব?’

‘তাহলে ওই সব গান? গানে ভক্তি আসে কোথা থেকে?’ ভেঙ্কটের মুখটা একটু শুকিয়ে গেছে এখন।

‘অ্যাকচুয়ালি যে গানটা গাইলাম— পনঘটপে… ওটাকে কি ঠিক ভগবানের উদ্দেশে গাওয়া বলা যায়! আমার তো ওটা নির্ভেজাল প্রেমের গান বলেই মনে হচ্ছে। মীরা কৃষ্ণ বলে একজন কল্পনার মানুষকে ভালোবেসেছিলেন, তাঁকে মনে করেই গান বেঁধেছেন। কিন্তু অন্য অনেক ভজন আছে, তাতে সোজাসুজি ঈশ্বর বন্দনা আছে, সে গানও তো আমি গাই। ভালোই লাগে গাইতে। আমি ঠিক এভাবে ভেবে দেখিনি কোনদিন! সত্যি!’

ভেঙ্কট বলল, ‘আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা শুনবে?’

‘বলো না!’

‘ঠাট্টা করতে পারবে না কিন্তু।’

‘না। ঠাট্টা করব কেন?’

‘আমার তখন খুব বাড়াবাড়ি। হেভি জ্বর। পাঁচ ছাড়িয়ে যাব-যাব। নামতে চাইছে না। মাথায় ঘাড়ে আইস ব্যাগ নিয়ে মা আর গৌতম সব সময়ে বসে আছে। তখন আমি এই গানটা শুনতে পেতুম, ঝিঁঝির ডাকের মতন, তোমার গলায়। বুঁদ হয়ে শুনতুম। হঠাৎ একদিন, তখন রাত্তির অনেক। হঠাৎ দেখলুম আলখাল্লা পরা কেউ একজন ঢুকল, গৌতম চেয়ারে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। মা আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই লম্বা চুল আলখাল্লা পরা মানুষটা… এই দেখো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে… এসে আমার কপালে হাত রাখলেন। শীতল হাতটা বরফের মতো নয় কিন্তু। মানুষের ঠাণ্ডা হাতের মতো। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটা হালকা হয়ে যেতে লাগল। ঘাম দিতে আরম্ভ করল। ঘুমিয়ে পড়লুম। দু দিনের মধ্যে জ্বর একেবারে ছেড়ে গেল। গানটাও আর শুনতে পেলুম না।’

গৌতম হেসে বলল, ‘ব্রড স্পেকট্রামের যে অ্যান্টি-বায়োটিকটা তোকে দেওয়া হয়েছিল, লম্বাটে, হাতির দাঁতের রঙের, সবুজ-টুপি-পরা সেই ক্যাপসুলটাই তোর মাথার কাছে দাঁড়িয়েছিল। সেটাকেই দেখেছিস।’

‘বললুম যে ঠাট্টা করবি না।’ ভেঙ্কট রেগে উঠে বলল।

গৌতম বলল, ‘আমাকে তো ঠাট্টা করতে বারণ করিসনি। রাজেশ্বরীকে করেছিস।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘বেশ, তুই অলৌকিক কিছু দেখেছিস বলে তোর বিশ্বাস। ভেঙ্কট, আমার কিন্তু মনে হয় গৌতম যেটা বলল সেটাই কিছুটা সত্যি। সমস্তটাই তো নার্ভের ব্যাপার।’

ভেঙ্কটের মুখটা একেবারে চুপসে গেল। রাজেশ্বরী তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইস! আমার কথাটা তো ভালো লাগল না। না? যদি সত্যি-সত্যি আমাদের শরীর মন আর এই জড় পৃথিবীর বাইরে কিছু থাকত, আমরা তাহলে বেঁচে যেতাম, তাই না? কত সহজ হয়ে যেত জীবনটা। ভেঙ্কট তুই যদি এটা বিশ্বাস করে জোর পাস তাহলে বিশ্বাস কর। কিন্তু যদি তাতে দুর্বল হয়ে যাস, অলৌকিক কিছু ঘটার প্রত্যাশায় অলস হয়ে যাস তাহলে আমি বলব বিশ্বাস করিস না। ওটা ভুল। স্রেফ মাথা গরম হওয়ায় হ্যালুসিনেশন হয়েছে। …কিছু মনে করলি? আমি কিন্তু মিথ্যে বলতে পারি না, স্তোক দিতেও পারি না।’

ভেঙ্কটের ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। গৌতম তাকে ওষুধ খাওয়ালো। সে এবার একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। রাজেশ্বরী বলল, ‘কী রে, শরীর খারাপ লাগছে না কি?’

‘উঁহু, জাস্ট ক্লান্ত লাগছে।’

‘ঠিক আছে। তুই রেস্ট কর। আমি এবার চলি।’ রাজেশ্বরী তার ব্যাগটা তুলে নিল। গৌতম দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। রাজেশ্বরী কিছুতেই তাকে বাস রাস্তায় আসতে দিল না।

বাস-স্টপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ রাজেশ্বরীর মনে সকালবেলাকার ঘটনাগুলো খুব তীব্রভাবে ফিরে এলো। সেই মেয়েগুলোর হাসি, মন্তব্য। হঠাৎ সে বুঝতে পারল ওরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেনি। আসলে তাকে দেখে ওদের যে সর্বোচ্চ আশা-আকাঙ্ক্ষা সেইগুলোই ওরা প্রকাশ করেছিল। রাজপুত্তুরের মতো বর, টিভির রামের মতো ‘এতখানিক’ ছেলে, কালীমন্দিরে পুজো, মানত। বিবাহ, প্রজনন, সাংসারিক সুখ-শান্তি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান —এই নিয়েই তো ওদের জগৎ! সারা সকাল পরের গার্হস্থ্যে খাটুনির পর, দুপুরবেলার অবসরের ফোকরে, রাত প্রহারের নিত্য-নৈমিত্তিক আশংকা বুকে নিয়ে ধনীর পিন্ধনের জন্য ‘কাঁতা ইস্টিচ’।

রাজেশ্বরী চলে গেলে ভেঙ্কট চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে রইল। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে। কেমন একটা ঘোর। তার অভিজ্ঞতার পুরোটা তো সে রাজেশ্বরীকে শোনায়নি। জ্বরের ঘোরে সে রাজেশ্বরীকে একটা উজ্জ্বল কমলা রঙের শাড়ি পরে তার কাছে বসে ‘পনঘটপে নন্দলালা’ গানটা শোনাতে দেখেছে। ঠিক সেই জিনিসটাই কী করে ঘটল! রাজেশ্বরী ঠিক সেই স্বপ্নের মতো, তার সামনে বসে ওই গানটাই গাইল, উজ্জ্বল কমলা না হলেও, ওই জাতীয় একটা রঙই ছিল রাজেশ্বরীর শাড়িতে। মাথার মধ্যে অদূর ভবিষ্যতের একটা ছবি সে দেখতে পেল কেমন করে? আর, আলখাল্লা-পরা, লম্বা চুল মানুষটি? ভেঙ্কটের স্থির ধারণা সে যিশুখ্রীষ্টকে দেখেছিল। এ সব কিসের ইঙ্গিত? দুর্বল মাথায় সেই চিন্তা করতে করতেই ভর বিকেলে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress