একুশে পা (Ekushey Paa) : 12
‘বোলও তো চমৎকার বললে …’
এই সময়ে উজ্জয়িনীদের বাড়ির জমায়েতটা ঋতুর কাছে আশীর্বাদের মতো এলো। এমনিতে উজ্জয়িনী তার বাড়িতে যেতে কাউকে উৎসাহিত করে না। কারণটা ঋতু জানে। অনুকা আর মিঠুরই একমাত্র ও বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। অনুর কাছ থেকেই সে শুনেছে। স্কুলে থাকতে অবশ্য উজ্জয়িনীর জন্মদিনে গেছে। সামান্য কয়েকজন বন্ধুকে ডাকত উজ্জয়িনী। ঋতুদের বাড়ির মতো জমজমাট পার্টি হত না। মাসি বাড়িতেই রান্না করে খাওয়াতেন। সেই সময়ে কখনও কখনও উজ্জয়িনীর বাবাকে দেখেছে। টকটকে ফর্সা, যেন ইংরেজ। দারুণ সুন্দর ছিলেন, এককালে বোঝা যায়। এখনও মোট-টোটা হয়ে গেলেও খুব আকর্ষণীয়। অন্তত ঋতুর তাই মনে হয়। গলার আওয়াজটা? দূর থেকে যেন মেঘের ডাক ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে ভেরি ভেরি মাচ ম্যাসকুলিন। কলেজের অত জনকে বাড়িতে ডেকে উজ্জয়িনী পার্টি দেবে শুনে সে একটু অবাকই হয়েছিল। অনুকে জিজ্ঞেস করে জানলো উজ্জয়িনীর বাবা এখন এখানে নেই। জরুরি কেসে বাইরে গেছেন।
ওই আকর্ষণীয় মানুষটিকে দেখতে পাবে না বলে ঋতুর একটু মেজাজ খারাপ হল। কিন্তু বাড়িতে আরো স্যাঁতসেঁতে থাকে মেজাজ। ঢুকেই মিঠুকে দেখতে পেল ঋতু। তারপর রাজেশ্বরী, অনু। প্রচুর ফুল সাজিয়েছে উজ্জয়িনী। কিন্তু নিজে একদম সাজেনি। একটা হলুদ-কালো হায়দ্রাবাদি শাড়ি পরেছে। ঋতু কিন্তু অনেক দিন পর হল্লা হবে বলে খুব সেজেছে। লিভিংরুমে লম্বা আয়নায় নিজের নতুন ফ্যাশনের সালোয়ার কুর্তা পরা চেহারাটা দেখে সে খুব খুশি হল। ফিল্ম স্টারের মতো দেখাচ্ছে। গ্ল্যামারাস। মিঠু বলল, ‘ঋতু তুই দিন দিন সুন্দর হচ্ছিস।’ ঋতু বলল—‘আহা কে কাকে বলছে?’ এই সময়ে খোলা দরজা দিয়ে আরও কয়েকজন ঢুকে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ঋতুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল! ওই ভেঙ্কট আর গৌতম বলে ফাজিল ছেলেগুলোকে কেন যে উজ্জয়িনী-মিঠুরা এত পাত্তা দেয়! একেবারে ফালতু। তন্ময় হালদারও এসেছে। এটা অত ফাজিল নয়। কিন্তু ওরা কি ঋতুদের ‘সেট’-এর। সে যেখানে বসেছিল সেখানেই বসে বসে উজ্জয়িনীদের য়ুরোপ ঘোরার অ্যালবামটা দেখতে লাগল। মাসি সবার সঙ্গে পরিচয় করছেন।
ভেঙ্কট দারুণ মাঞ্জা দিয়ে এসেছে, গৌতমও তাই। খালি তন্ময় পরিষ্কার শার্ট-প্যান্ট পরা। মাসি বললেন, ‘কোথায়, ঠিক কোন জায়গায় থাকো বলো তো?
‘সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিট।’ ভেঙ্কট বলল।
‘সাহিত্য পরিষদের পালবাড়ি? মঞ্জুষা তোমার কে হয়?’
ভেঙ্কট বলল, ‘মঞ্জুপিসি? আমার পিসি হন, মেজদাদুর মেজ মেয়ে।’
‘তাই বলো, মঞ্জু তো আমার ভীষণ বন্ধু ছিল, কত গেছি এক সময়ে তোমাদের বাড়ি। মঞ্জু এখন কোথায় আছে?
‘পুনেতে।’
‘আসে?’
‘কই আর? ওখানে প্র্যাকটিস করে তো! রেগুলার চিঠিপত্র দেয়। ফোন করে!’
‘খুব ভালো লাগল তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে, আমাদের সেইসব অল্প বয়সের দিনগুলো! মাধুরীদি, অলকা ওদের কী খবর?’
ভেঙ্কট বলল, ‘মাধুরী পিসিমা কানাডায় সেট্লড, অলকা পিসি থাকে আসাম।’
‘কী বিরাট পরিবার ছিল তোমাদের। কত দিনের ঐতিহ্য! তোমার বাবার নামটা বলো তো হয়ত চিনতে পারব।’
‘আমার বাবার নাম পঙ্কজ পাল। আমাদের এখনও ওই রকমই বিরাট ফ্যামিলি মাসিমা।’
‘ওরে ব্বাবা, পঙ্কজদা? দারুণ ফুটবল খেলতেন। ভীষণ ব্রাইট। কোথায় আছেন এখন?’
‘বাবা তো অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, হেলথ ডিপার্টমেন্টে।’
‘আচ্ছা! ক’ভাই বোন তোমরা?
‘—বোন নেই মাসিমা, বড় দাদা আছে, ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার, সি ই এস সি-তে আছে।’ ঋতু কান খাড়া করে ছিল। ফুটবল? বারবেরিয়ানস’ গেম! অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রটারি, হেল্থ! দাদা এঞ্জিনিয়ার? ভেঙ্কটের সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড তো খারাপ না! মাসি যা করছেন, ভেঙ্কটের সঙ্গেই বোধহয় সারাক্ষণ কথা বলবেন!
তন্ময়ের মা যে কলেজের প্রিনসিপ্যাল, সেখানে মাসিরা পড়েছেন দেখা গেল। মাসি এবং ভেঙ্কটেশের পিসিরা—মাধুরী, মঞ্জুষা আর অলকা।
উজ্জয়িনী বলল, ‘মা, তুমি ওদের এমন করে ঠিকুজি-কুলুজি নিতে শুরু করেছ যে!’ মাসি বললেন, ‘আসলে, নর্থ ক্যালকাটায় আমার মামার বাড়ি। ছোটবেলায় বাবার ঘুরে ঘুরে কাজ ছিল, আমরা তো মামার বাড়ি থেকেই মানুষ। সেইসব ছিল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। কত দিন যাওয়া হয় না। অনেক দিন ধরে ভাবছি আমাদের মহিলা-শিল্প সমিতির একটা উত্তরের শাখা খুলব। তোমাদের বাড়ি একদিন মেলোমশাইকে দেখতে যাব ভেঙ্কট।’
‘নিশ্চয়ই যাবেন, আমি তো একটু আগেই বলতে যাচ্ছিলাম।’
ঋতু অ্যালবামটা বন্ধ করে রেখে দিল। মিঠু বলল, ‘এই আজকে ঋতুর নাচ হোক। ঋতুর কত্থকের সিক্সথ ইয়ার চলছে। দারুণ নাচে। ঋতু প্লিজ নাচ্।’ ঋতু বলল, ‘তবলা নেই। তাছাড়া বোল বলে বলে আমি নাচতে পারব না। হাঁফিয়ে যাই।’
রাজেশ্বরী বলল, ‘ঠুংরির সঙ্গে নাচ না। আমি গেয়ে দিচ্ছি।’
গৌতম একটু লাজুক গলায় বলল, ‘তবলা আছে?’
অমনি সবাই হই-হই করে উঠল। মাসি বললেন, ‘সব আছে, তবলা, ঘুঙুর, হার্মোনিয়াম। মেয়ে কিছুই শিখল না।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই সব বেরোল। ঘুঙুরের বাক্স থেকে ঘুঙুরগুলো বার করে নেড়ে-চেড়ে দেখল ঋতু। বলল, ‘খুব ভালো ঘুঙুর রে উজ্জয়িনী, দারুণ আওয়াজ, ওয়েটটাও ঠিক আছে।’
‘তবে তো সাত মন তেল পুড়ল, রাধা এবার নাচুক।’ ভেঙ্কট মন্তব্য করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজেশ্বরী হার্মোনিয়ম নিয়ে, গৌতম তবলা ঠুকতে ঠুকতে বসে গেল। গৌতম বলল, ‘বোল যদি কিছু মাঝখানে বলতে হয়, লিখে দাও। আমি বলে দেব।’
উজ্জয়িনী বলল, ‘সবই যদি হল তাহলে আর আলোকসম্পাতটা বাকি থাকে কেন! খাবার টেবিল একেবারে ধারে সরিয়ে মাঝখানে নাচের ফ্লোর হল। এটা জ্বালিয়ে ওটা নিবিয়ে উজ্জয়িনী এমন আলো জ্বালল, যাতে মাঝখানে ঋতুর ওপরেই শুধু আলো পড়ে। দারুণ জমে গেল। মাসি মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘এ তো প্রোফেশন্যাল স্ট্যান্ডার্ড একেবারে।’ ঋতু গৌতমের দিকে কটাক্ষে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি তো দারুণ বাজাও!’
‘শখ আর কি!’ গৌতম লজ্জা পেয়ে উড়িয়ে দিতে চাইল।
‘বোলও তো চমৎকার বললে!’
‘ওই। শখ। মাঝে মাঝে নাচের সঙ্গেও বাজাতে হয় তো। বলতেও হয়।’
রাজেশ্বরী দুটো ভজন গাইল। তবলায় গৌতম নন্দী। মিঠু গাইল দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত। মাসি খুব হৃষ্ট মুখে বললেন, ‘এ তো রীতিমত জলসা হয়ে গেল রে! যাক তোরা গল্প স্বল্প কর, আমি খাবার জোগাড় করি।’
উজ্জয়িনী আলো জ্বেলে দিল কতকগুলো। বলল, ‘প্রিয়া তুই এতো চুপচাপ কেন রে? কি হয়েছে?’
‘..কই? কিছু না তো!’
মিঠু বলল, ‘সন্তোষকে বলিস নি উজ্জয়িনী?’
‘সন্তোষ আজ দিন আষ্টেক হল কলেজে আসেনি, ফোনও নেই। থাকে বেহালায়। খবর দেওয়া যায়নি।
রাজেশ্বরী বলল, ‘ও জানতে পারলে খুব রাগ করবে রে!’
ভেঙ্কট বলল, ‘তাতে কী হয়েছে? আমাদের পরবর্তী প্রোগ্রাম তো আমার বাড়িতে। তখন আসবে। হই চই হবে।’
এই সময়ে একটা ট্রলি ঠেলে যমুনা প্রবেশ করল, তার ওপর লম্বা ডাঁটির ছোট ছোট সুদৃশ্য পাত্রে লাল রঙের পানীয়।
গৌতম আর ভেঙ্কট সবিস্ময়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। উজ্জয়িনীর মা বললেন, ‘রাজেশ্বরী ইলেকশন জিতেছে, সেই জয়ের অনারে একটা ভোদকার বোতল খুলেছি। সবাই নাও।’ ভোদকার সঙ্গে টোম্যাটো রস, ব্লাডি মেরি।
ভেঙ্কট বলে উঠল, ‘মাসিমা হুর্রে, আপনি না…’
‘কী? গেম?’ হাসতে হাসতে অমিতা বললেন।
ভেঙ্কট মাথা নাড়ল, জনান্তিকে গৌতম আর তন্ময়কে বলল, ‘গেম ফেম নয় মাসিমা একেবারে ঘ্যাম।’
মিঠু বলল, ‘আপনি নেবেন না, মাসি?’
‘হ্যাঁ নেব।’ একটা পাত্র তুলে নিয়ে অমিতা বললেন, ‘চীয়ার্স।’ সবাই প্রতিধ্বনি করল, একটু পরে অমিতা বললেন, ‘এটা কিন্তু একসেপশন, ডোন্ট মেক ইট এ রুল।’ সবাই হেসে উঠল।
ক্রমশ টেবিল খাদ্যসম্ভারে ভরে উঠল। উজ্জয়িনী ওদের হাতে প্লেট চামচ, সব তুলে দিতে লাগল। সে তার মাকে এত হাসিখুশি, উজ্জ্বল, ছেলেমানুষ কখনো দেখেনি। তার নিজের মধ্যেটা এখনও ভারী হয়ে রয়েছে। যদিও যা শুনেছে তা অতি দূর, অদেখা, সুতরাং, গল্পকথার মতো। কিন্তু মা? মা কি গোপন কথা বলতে পেরে হালকা হয়ে গেছে?
বন্ধুরা চলে গেলে উজ্জয়িনী একলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ওরা বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে একে একে। সবাই স্বাভাবিক পরিবারের ছেলে মেয়ে। মা আছে বাবা আছে। এইরকম লজ্জাকর অতীত। লজ্জাকর বর্তমান কি কারো? সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল হে-ভগবান, আমি কেন? আমাকেই কেন? এত জনের মধ্যে থেকে সব রকম দুর্ভাগ্যের জন্যে আমাকেই বেছে নিলে কেন? সব কিছুতে আমাকেই হারতে হবে কেন? আমি কেন? কেন? কেন? এখন আমি কী করব? বাবা যে কোনও মুহূর্তে আমার জীবনটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিতে পারে। যেভাবে শীলা ভার্গবকে নিয়ে বেরিয়ে গেল, বাবা মরিয়া হয়ে গেছে। হয়ত নিজেই ডিভোর্স চাইবে। লোকলজ্জার বালাই তো নেই। সবার চোখের সামনে দিয়েই তো এইভাবে চলছে, মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে। যত লজ্জা, যত দুঃখ, অপমান তো স-বই মায়ের। আর আমার। কত সুখী আর সবাই! ওরা যখন জানতে পারবে আমার পরিচয়। চোখে চোখ ফেলবে না। মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাবে লজ্জায়!
উজ্জয়িনী আর ভাবতে পারছে না। মা এসে বলল, ‘জুনি শুতে চল।’ উজ্জয়িনী আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গেল। মা বলল, ‘ড্রেস চেঞ্জ করে আমার ঘরে আয়। আমার কাছে শুবি।’
অনেক রাতে অমিতার ঘুম ভেঙে গেল, পাশে মেয়ে নেই। জানলার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গালের ওপর রাস্তার আলো পড়েছে। সেই উজ্জয়িনী, গর্বিত, অভিমানী, আদুরে, অসহিষ্ণু, সর্দারি করা যার মজ্জাগত ; কথায় কথায় বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া, এই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আবার দুদিন পরেই ভাব, কোনক্রমেই লেখাপড়া বা অন্য কিছুতে গুরুত্ব দিতে শেখাতে পারেননি। সে যেন চিরকাল তার অবস্থানের জোরেই সব কিছু পেয়ে যাবে, তাকে কোনও উদ্যম নিতে হবে না। আজ তাকে চেনা যাচ্ছে না। অমিতার ভয় করতে লাগল। কিন্তু তিনি কত পাহারা দিয়ে রাখবেন ওকে? তীক্ষ্ণ নজর রাখতে লাগলেন তিনি মেয়ের ওপর। কিন্তু নড়লেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। আধঘণ্টা পরে উজ্জয়িনী ঘরে এলো। ফিসফিস করে বলল, ‘মা, তুমি বসে আছ?’
‘তুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আমার ঘুম ভেঙে গেল।’
উজ্জয়িনী আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। ছটফট করছে। অমিতা মাথায় হাত রাখলেন, ‘ঘুমো, ঘুমো।’
‘ঘুম আসছে না মা।’
ভোর রাত অবধি দুজনে জেগে রইল। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে যেন তারা দুটিই মাত্র বিনিদ্র মানুষ।