একদিন রাত্রে
আজ সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। শীতের প্যাচালো বৃষ্টি। সেই সঙ্গে যথারীতি উত্তুরে হাওয়া। ঠান্ডাও পড়েছে খুব। অনেকদিন কলকাতা শহরে এরকম জমাট ভাব, ভারী ঠান্ডা দেখা যায়নি।
সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা হয়ে গেল, বৃষ্টি থামবার কোনও নামগন্ধ নেই। যদি জোরে দু-চার পশলা হয়ে যেত তবে সে ছিল মন্দের ভাল, হয়তো মেঘটা কেটে যেত। কিন্তু আকাশ ঘন হয়ে শীতের রাতের অন্ধকার নেমে এল, টিপটিপ করে বৃষ্টিও হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে লোডশেডিং, আজ সারাদিন ধরেই বিদ্যুৎবিভ্রাট হচ্ছে। অথচ কাগজে কোলাঘাট-ব্যান্ডেলের কোনও গোলমালের খবর নেই, কী জানি, হয়তো ঠান্ডার জন্যেই বিদ্যুতের বাবুরা কাজে আসেনি, বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লোকের অভাব। হয়েছে।
সে যা হোক, এসব অবান্তর চিন্তা। জয়দেব বলেছিলেন, ঠিক পাঁচটার সময় আসবেন। একেবারে কাটায় কাঁটায় পাঁচটায়। সওদাগরি অফিস মহিমাময়ের, ওই ঠিক পাঁচটাতেই ছুটি হয়। দশটা-পাঁচটা-ইংরেজ আমলের সেই পুরনো রুটিন এখনও বদল হয়নি।
পাঁচটা থেকে জয়দেবের জন্যে মহিমাময় বসে আছেন। এই বৃষ্টির দুর্দিনে বিকেল বিকেলই অফিস ফঁকা হয়ে গিয়েছিল, এখন ছুটির পরে প্রায় কেউই নেই। শুধু বড়সাহেবের ঘরে আলো জ্বলছে। আর ওখানে বড়সাহেবের কাছে বোধ হয় কোনও ভিজিটর এসেছে। আর এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-চারজন দারোয়ান, চাপরাশি রয়েছে। ওরা এ অফিসেরই কেয়ারটেকারের স্টাফ; অফিসেরই একতলায় থাকে।
এ ছাড়া এক প্রান্তে অপেক্ষা করছেন নরহরিবাবু। বিপত্নীক, প্রৌঢ় এবং এই অফিসের বড়বাবু। অফিসের মধ্যে নরহরিবাবুর পোষা নিজস্ব একটা হুলো বেড়াল আছে, সাদাকালো শরীর, মোটা মাথা, বেড়ালটার নরহরিবাবুর প্রদত্ত নাম কালাহরি। কালাহরিটা এক নম্বরের শয়তান, পাকা চোর।
এই পরশুদিনই একটা ফিশ কাটলেট টিফিনের সময় প্লেটে টেবিলের উপর রেখে বারান্দায় কলে হাত ধুতে গিয়েছিলেন মহিমাময়, কালাহরি সেটা নিয়ে চম্পট দেয়।
এসব কথা অবশ্য নরহরিবাবুকে বলা চলবে না। কালাহরি অন্ত-প্রাণ তাঁর। বৃষ্টির মধ্যে এই ঠান্ডায় হুলোটা কোথায় বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। প্রতিদিন অফিস থেকে বেরোনোর সময় নরহরিবাবু কালাহরিকে চারটে মিল্ক বিস্কুট খাইয়ে যান। আজ কালাহরি আসছে না বলে তিনি বেরোতে পারছেন না, এখন ভ্রুকুটিকুটিল মুখে অধীর প্রতীক্ষা করছেন হুলো বেড়ালটার জন্যে।
জয়দেব হুলো বেড়াল নয়, একটা আস্ত মানুষ। মহিমাময় ঘড়িতে দেখলেন, কাটা প্রায় ছটার কাছে পৌঁছেছে। উঠে গিয়ে রাস্তার দিকের জানলায় উঁকি দিয়ে দেখলেন, রীতিমতো অন্ধকার, লোডশেডিং এখনও চলছে, তার মধ্যে বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ আসছে।
এ অফিসটায় একটা জেনারেটর আছে তাই রক্ষা, অন্ধকারে ঘুপচি মেরে জয়দেবের জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। কিন্তু আর নয়, ছটা বেজে যাওয়ার পরে মহিমাময় আর এক মুহূর্তও জয়দেবের জন্যে অপেক্ষা করবেন না।
দুপুরে আড়াইটা নাগাদ মহিমাময় টিফিন করতে বেরিয়ে এক পাঁইট বাংলা দু নম্বর খেয়ে এসেছিলেন। সবদিন এটা করেন না, কিন্তু আজ জয়দেব আসবেন, দুজনের সারা সন্ধ্যার প্রোগ্রাম, তাই টেম্পোটা একটু তুলে রাখতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া জয়দেবের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে একটু তৈরি হয়ে থাকতে হয়।
দুপুর আড়াইটার সে নেশা কখন কেটে গেছে। জয়দেব সত্যিই আসছেন না। মিনিট কয়েক আগে কালাহরি এসে নরহরিবাবুর হাত থেকে বিস্কুট খেয়ে নরহরিবাবুকে ভারমুক্ত করে গেছে। এবার টেবিল গুছিয়ে নরহরিবাবুও রওনা হলেন। মহিমাময় ঠিক করলেন তিনিও উঠবেন, আর অপেক্ষা করা যায় না।
যাওয়ার পথে নরহরিবাবু একবার মহিমাময়ের টেবিলের পাশে এলেন। মহিমাময় ভাবলেন, বোধহয় বড়বাবু কোনও দরকারি কাজের কথা বলবেন। কিন্তু বড়বাবু যা বললেন তা শুনে মহিমাময় বিস্মিত হয়ে গেলেন।
জয়দেবকে বিশ্বসংসারে চেনে না এমন লোক নেই। এ অফিসেও মহিমাময়ের বন্ধু হিসেবে তাকে সবাই চেনে, নরহরিবাবুও চেনেন। নরহরিবাবু অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আপনার বন্ধু জয়দেববাবু বড়সাহেবের ঘরে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
বড়সাহেবকে জয়দেব কী করে চিনল, কবে কোথায় আলাপ হল? তা ছাড়া তাঁর কাছে তার অফিসে এসে, তার ঘরে না গিয়ে, তাকে কিছু না জানিয়ে বড়সাহেবের ঘরে জয়দেবমহিমাময় ব্যাপারটা ঠিক হিসেবে মেলাতে পারলেন না। তবে জয়দেবের কটা ব্যাপারই বা মহিমাময় বা অন্য কেউ কোনওদিন মেলাতে বা বুঝতে পেরেছেন!
সে যা হোক, এখন সমস্যা দুটো। জয়দেব ঠিক কী অবস্থায় আছে এবং বড়সাহেবের ঘরে গিয়ে ডেকে বার করে আনা কতটা সঠিক হবে। এই প্রশ্ন দুটো মনে মনে বিবেচনা করতে করতে মহিমাময় বড়সাহেবের ঘরের দিকে এগোলেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে বাধা পেলেন বড়সাহেবের খাস আর্দালির কাছে। আর্দালি জানাল, এখন কামরায় ঢোকা যাবে না। সাহেব দোস্তের সঙ্গে বাত করছেন।
এরই মধ্যে মহিমাময়ের সুশিক্ষিত কানে একটু গেলাসের টুংটাং, খুব পরিচিত একটা শব্দ ধরা পড়েছে। সর্বনাশ! জয়দেব এখানে অফিসের মধ্যে খোদ বড়সাহেবের সঙ্গে জমিয়ে মদ খাচ্ছে?
নিঃশব্দে কেটে পড়তে যাচ্ছিলেন মহিমাময় বড়সাহেবের দরজার ওপাশ থেকে, কিন্তু ভারী পর্দার অন্তরাল থেকেও সামান্য ফঁক দিয়ে মহিমাময়কে দেখে ফেলেছেন বড়সাহেব, তিনি বেল বাজিয়ে আর্দালিকে ডাকলেন, এই দ্যাখো তো ওখানে কে দাঁড়িয়ে?
আর্দালি এগিয়ে আসার আগেই মহিমাময় পর্দা উঁচু করে বড়সাহেবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ভিতরে আসব, স্যার?
বড়সাহেব যথেষ্টই মুডে আছেন, অস্বাভাবিক সৌজন্যে বিগলিত হয়ে সাদর আহ্বান জানালেন, আরে আসুন আসুন, মহিমাবাবু, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
মহিমাময় ঠিক এতটা আশা করেননি। তা ছাড়া এই মুহূর্তে তার চোখ জুড়িয়ে গেল অন্য একটা দৃশ্য দেখে। একটা মদের বোতল এবং দুটো গ্লাস। খুব মহার্ঘ্য বা দুর্লভ পানীয় বলা যাবে না, স্কচ বা শ্যাম্পেন নয়, তবে মোটামুটি উচ্চমানের দিশি প্রিমিয়াম হুইস্কি।
মহিমাময়ের নজরে এটাও এড়াল না যে বোতল প্রায় অর্ধেক ফাঁকা। তাকে চেয়ারে বসতে বলে বড়সাহেব ভেতরের টিফিনঘরে গেলেন। মহিমাময় বসার পরে জয়দেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বোতলের দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস?
নিজের অফিসের বড়কর্তার ঘর, মহিমাময় নিচু গলায় বললেন, অর্ধেক ফাঁকা।
জয়দেব ভুরু কুঁচকিয়ে বললেন, তুই ভাল কিছু দেখতে পাস না। অর্ধেক ফঁকা দেখলি, অর্ধেক ভরা সেটা দেখলি না?
ইতিমধ্যে বড়সাহেব পিছনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন হাতে একটা কাঁচের গেলাস নিয়ে। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, মহিমাময়কেও পানীয় দেবেন। একটু চিন্তান্বিত হলেন মহিমাময়, অফিসের বড়সাহেবের সঙ্গে বড়সাহেবের ঘরে বসে মদ্যপান কতটা নিরাপদ সে বিষয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন।
কিন্তু ভাবার অবসর দিলেন না বড়সাহেব। নিজেই একটা গেলাসে পানীয় ঢেলে তার সঙ্গে নিজের জলের ফ্লাস্ক থেকে জল মিশিয়ে এগিয়ে দিলেন মহিমাময়কে। তারপর জয়দেবের দিকে তাকিয়ে মহিমাময়কে বললেন, আমার বন্ধু জয়দেব পালের সঙ্গে শুনলাম আপনার আলাপ আছে, তা তো থাকবেই, নামকরা লোক, সিনেমা ডিরেক্টর। আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি।
পরিচয়ের শেষ অংশ শুনে মহিমাময় একটু বিস্মিত হলেন। অবশ্য এরকম আগেও হয়েছে। বহু ব্যক্তিরই মনে ধারণা যে স্বনামধন্য সিনেমা ডিরেক্টর জয়দেব পালের সঙ্গে তিনি একই স্কুলে পড়েছেন। শুধু কলকাতায় নয়, পশ্চিমবঙ্গে বিহারে এমনকী বাংলাদেশে এই সব স্কুল। যেভাবেই হোক জয়দেব বেশ কিছু লোককে সব সময়েই বোঝাতে পারেন কিংবা ধারণা দেন যে তিনি তাদের সঙ্গে এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়তেন। এই ধারণাটা মহিমাময়ের বড়সাহেবের মধ্যেও ঢুকেছে, বিগত বিদ্যালয়-জীবনের মধুর স্মৃতি স্মরণ করে তিনি এখন কাল্পনিক সহপাঠী সুবিখ্যাত জয়দেব পালের দিকে গর্বিত ও আপ্লুত নয়নে তাকিয়ে আছেন।
বহু অভিজ্ঞতা-সূত্রে মহিমাময় জানেন, যদি এই মুহূর্তে বড়সাহেব তার প্রাক্তন স্কুল বিষয়ে কোনও আলোচনা শুরু করেন, অতীতকালের এক সহকারী শিক্ষকের নিষ্ঠুরতা নিয়ে বা ফাঁইনাল খেলায় অবিশ্বাস্যভাবে স্কুলের শূন্য-চার গোলে হেরে যাওয়া বিষয়ে, সেই স্মৃতিচারণে অনায়াস দক্ষতায় জয়দেব যোগ দেবেন। এ ঘটনা বহুবার মহিমাময় প্রত্যক্ষ করেছেন।
এতক্ষণে চিয়ারস বলে গেলাস তুলে বড়সাহেব মহিমাময়কে পানে যোগদান করতে আহ্বান জানিয়েছেন। বহুক্ষণ শুকনো মুখে বিরক্তিকর প্রতীক্ষার পরে মহিমাময়ের এবার দ্বিধা কেটে গেছে। তিনি এক চুমুকে অর্ধেক গেলাস খেয়ে নিলেন। দুপুরের নেশাটা সবে জুড়িয়ে আসছিল, অল্প পান করেই মহিমাময় বেশ চনমনে বোধ করলেন।
চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে মহিমাময় জয়দেবের দিকে একবার, আরেকবার বড়সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমিও জয়দেবের ক্লাসফ্রেন্ড স্যার, একই স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েছি।
মহিমাময়ের কথা শুনে বড়সাহেব চমকিত ও চিন্তিত হলেন, মহিমাময়কে জিজ্ঞাসা করলেন, নেবুতলা?
মহিমাময় বললেন, হ্যাঁ স্যার। নেবুতলা করোনেশন বয়েস হাই ইংলিশ স্কুল। আমরা লাস্ট স্কুল ফাঁইন্যাল ব্যাচ।
বিস্মিত বড়সাহেব বললেন, কিন্তু আমি তো জয়দেবের সঙ্গে পুর্নিয়া জুবিলি স্কুলে একসঙ্গে পড়েছি। সিক্সটির হায়ার সেকেণ্ডারি।
মহিমাময় বলতে যাচ্ছিলেন যে জয়দেবের চোদ্দোপুরুষে কেউ পুর্নিয়া যায়নি কিন্তু তার আগেই জয়দেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, সরি, এখনই আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, রাত্রে দেখা হবে বলে তিনি দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হলেন। মহিমাময় কী করবেন স্থির করতে না পেরে হাতের গেলাসের বাকি অংশটুকু মুহূর্তের মধ্যে গলাধঃকরণ করে জয়দেবের অনুগামী হলেন। বড়সাহেবের সামনে এই রকম আচরণ সমীচীন কিনা, বেরিয়ে যাওয়ার আগে অনুমতি গ্রহণ করা উচিত কিনা এসব প্রশ্ন এই মুহূর্তে চাপা পড়ে গেল।
বাইরে লোডশেডিং এখনও আছে। তবে বৃষ্টিটা ধরেছে। ঠান্ডা আরও জোরদার।
মহিমাময় মোড়ের মাথায় পৌঁছেই দেখতে পেলেন, জয়দেব প্রাণপণ চেষ্টা করছেন যে কোনও একটা ট্যাকসি দাঁড় করাতে। কিন্তু এই দুর্দিনের সন্ধ্যায় কোনও ট্যাকসিই দাঁড়াচ্ছে না। মহিমাময় জয়দেবকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, এই সময় দুম করে বিদ্যুৎ ফিরে এল। আলো ফিরে আসায় মনটা একটু প্রসন্ন হয়েছে, তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন জয়দেব তাকে দেখতে পেয়েছেন এবং হাত তুলে ডাকছেন।
মহিমাময় জয়দেবের কাছে গিয়ে বুঝতে পারলেন যে জয়দেব এখনও পুরো মাতাল হননি, তবে তাঁর বেশ নেশা হয়েছে। জয়দেব মহিমাময়কে দেখে বললেন, তুই পুরো ব্যাপারটা কঁচিয়ে দিচ্ছিলি। জানিস তোর বড়সাহেব আমার একটা বইয়ের প্রডিউসার হতে চলেছে।
এ তথ্যটা মহিমাময়ের জানা ছিল না। নিজের অফিসের বড়কর্তা অফিসে বসে মদ্যপান করছেন, তার ওপর সিনেমা প্রযোজনা করতে যাচ্ছেন সম্ভবত অফিসেরই টাকায় ব্যাপারটা ভাল ঠেকল না মহিমাময়ের কাছে। কোম্পানিটা এবার লাটে না ওঠে।
কিন্তু আশার বাণী শোনালেন জয়দেব, তোর বড়সাহেবের কাছে তোর খুব প্রশংসা করেছি। এবার তুই অফিসার হয়ে যাবি। নির্ঘাত প্রমোশন হবে। খুব যে আশ্বস্ত হলেন মহিমাময় তা নয়, তিনি মনে মনে ভাবলেন, আগে কোম্পানি টিকুক, তারপরে প্রমোশন।
ইতিমধ্যে জয়দেবের অনুরোধ উপেক্ষা করে আরও দু-তিনটি ট্যাকসি তাকে অতিক্রম করে চলে গেছে। কয়েকদিন আগে লালবাজার থেকে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, ট্যাকসি যাত্রী নিতে না চাইলে সেই গাড়ির নম্বর পুলিশে জানিয়ে দিতে।
বেশ কয়েকটি ট্যাকসি পাত্তা না দেওয়ার পর উত্তেজিত জয়দেবের সেই পুলিশি বিজ্ঞপ্তির কথা হঠাৎ মনে পড়ল, তিনি হিপপকেট থেকে একটা নোটবুক বার করলেন আর একটা ডট পেন। এইমাত্র মিটার নামানো যে ট্যাকসিটা তাকে পার হয়ে গেছে তিনি সেটার নম্বর টুকতে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে একটা বিসদৃশ কান্ড ঘটল। যে ট্যাকসিটি চলে গিয়েছিল তার ড্রাইভার পিছন ফিরে তাকিয়ে জয়দেবকে গাড়ির নম্বর টুকতে দেখে ঘ্যাচ করে গাড়িটা ব্যাক করে একদম জয়দেবের পাশে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর ট্যাকসির বাঁদিকের জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, আপনি এখন সিনেমা করেন, তাই না?
এই আকস্মিক প্রশ্নে জয়দেব একটু পিছিয়ে এলেন, একটু আমতা আমতা করে অপ্রস্তুতভাবে একবার মহিমাময়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, হ্যাঁ, আমি জয়দেব পাল, সিনেমা করি। তাই কী হয়েছে?
ট্যাকসিওয়ালা উত্তেজিত হয়ে বলল, কী হয়নি! আজ আপনার নাম হয়েছে। সিনেমা তুলছেন, হিল্লি-দিল্লি যাচ্ছেন। খবরের কাগজে আপনার নাম বেরোচ্ছে ছবি বেরোচ্ছে। আপনি মোটা হয়েছেন, লম্বা জুলফি রেখেছেন, মোটা গোঁফ রেখেছেন। আপনি এখন পকেট থেকে নোটবুক বার করে ট্যাকসির নম্বর নিচ্ছেন। পুলিশকে দিয়ে আমাদের জেল ফাঁসি করাবেন। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! ঘৃণাভরে বার বার ধিক্কার দিল ট্যাকসি-ড্রাইভার।
জয়দেব তখন একেবারে বেকুব বনে গেছেন, কাচুমাচু মুখে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে আছেন, কী যে করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না এবং কেনই বা ট্যাকসিওয়ালা এসব বলছে তাও ধরতে পারছেন না।
ট্যাকসিওয়ালা কিন্তু তখনও নিরস্ত হয়নি, সমানে ধিক্কার বর্ষণ করে চলেছে, ছিঃ ছিঃ জয়দেববাবু, আপনার কোনও লজ্জা নেই! আপনি এত নেমকহারাম! আপনি আজ ট্যাকসি ড্রাইভারদের পিছনে লাগছেন? কিন্তু এই কলকাতার ট্যাকসিওয়ালারা না থাকলে আজ আপনি কোথায় থাকতেন, কোন ভাগাড়ে? জোড়াবাগান থেকে, খালাসিটোলা থেকে, খিদিরপুর থেকে, ফুটপাথ থেকে, গুণ্ডাদের হাত থেকে, পুলিশের হাত থেকে রাত বারোটা, একটা, দুটো, ট্যাকসিওয়ালারা আপনাকে কোলে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। আপনি তাদের গাড়ির সিটে, তাদের গায়ের জামায় বমি করে দিয়েছেন। আজ এই তার প্রতিদান!
এই ভয়াবহ অভিযোগমালার সামনে জয়দেব অসহায় হয়ে পড়লেন, করুণ কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে, যাও যাও। তোমার নম্বর নিচ্ছি না।
ট্যাকসিওয়ালার রাগ তখনও যায়নি, কীসের জন্যে নম্বর নেবেন, দাদা? বৃষ্টির রাতে একটু শেয়ারে ট্যাকসি খাটাচ্ছি, মাতাল-বাদমাইশদের তুলছি না, এটা কি অন্যায় হল?
নিস্তব্ধ হয়ে মহিমাময় এতক্ষণ ধরে এই নাটক দেখছিলেন, এবার যথেষ্ট হয়েছে এই ধরে নিয়ে এগিয়ে এসে ট্যাকসিকে বললেন, ঠিক আছে, এবার আপনি যান। শেয়ারে খাটুন।
মহিমাময়কেও মনে হল ট্যাকসিওলা চেনে, সে বলল, ও আপনিও আছেন! নিশ্চয়ই কোথাও বসবেন। কাছাকাছি কোথাও হলে বলুন আমি আপনাদের নামিয়ে দিয়ে আসছি।
বহুরকম গালাগাল খেয়ে জয়দেব নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন, এই ট্যাকসিতে উঠতে তার ভরসা হচ্ছে না। কিন্তু মহিমাময় বুঝলেন এ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। জয়দেবকে ঠেলে তুলে দিলেন ট্যাকসিতে, তারপর নিজেও উঠলেন, উঠে ট্যাকসি-ড্রাইভারকে বললেন, পার্ক স্ট্রিট।
পার্ক স্ট্রিটে একটা পুরনো বারে ওঁদের দুজনেরই একটা চেনা আজ্ঞা আছে। আজ কিন্তু নিয়মিত আড্ডাধারীদের কেউই আসেনি। এই ঠান্ডায় আর বৃষ্টিতে কেউ বাড়ি থেকে বেরোয়নি মনে হচ্ছে। দুজনে গুটিগুটি বারে ঢুকে এক প্রান্তে এসে একটা টেবিলে বসলেন।
ট্যাকসির মধ্যে জয়দেব গুম মেরে বসেছিলেন, মহিমাময়ও কোনও কথা বলেননি। এখন বারে চুকে দুটো পানীয়ের অর্ডার দিয়ে জয়দেব বললেন, এই ট্যাকসিগুলো যা হয়েছে না।
মহিমাময় এই দুঃখজনক আলোচনায় গেলেন না। এক প্লেট সসেজ নিয়ে নিঃশব্দে পানীয় খেতে লাগলেন। দুজনের মধ্যে একটা ভারী ভাব, কেউ কোনও কথা বলছেন না। মহিমাময় একটা সসেজ তুলে জয়দেবকে অফার করলেন, জয়দেব প্রত্যাখ্যান করলেন।
আরও কিছুক্ষণ পরে আরও দু-তিন গেলাস পানীয় প্রায় নিঃশব্দে শেষ হওয়ার পরে মহিমাময় আপনমনে বললেন, আবার বোধ হয় বৃষ্টি আসছে। যাই বাড়ি ফিরি।
জয়দেব এবার হাত তুলে বাধা দিলেন। বললেন, কোথায় যাচ্ছিস? আজ রাতে যে তোর বড়সাহেবের বাড়িতে আমাদের ডিনারে নিমন্ত্রণ, তোকেও নিয়ে যাব বলেছি।
মহিমাময় আতঙ্কিত হয়ে বললেন, সন্ধ্যায় অফিসে বড়সাহেবের সঙ্গে মদ খেয়েছি, তারপরে রাতে তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে ডিনার খাব। এবার নির্ঘাৎ চাকরিটা খোয়াব।
জয়দেব শুনে বললেন, আরে এত ভয় কীসের? আমার যে বইটায় উনি টাকা দেবেন সেটা নিয়ে আলোচনা আছে। আরও দু-একজন আসবে, তুইও যাবি। নিশ্চয়ই যাবি, আমার জন্যে এটুকু করবি না।
মহিমাময় বললেন, কিন্তু তোর স্কুল নিয়ে যদি আবার কথা ওঠে!
জয়দেব বললেন, ধুর, ওসব এড়িয়ে যাব। কত লোক যে ভাবে আমি তার সঙ্গে পড়েছি, সবাইকে কি আর সব ব্যাখ্যা দিতে হয়!
কী জানি কী ভেবে উঠতে গিয়েও মহিমাময় বসে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, বড়সাহেবের ব্যাপারটা একবার শেষ পর্যন্ত দেখা যাক।
সুতরাং বারের এক প্রান্তে জয়দেব এবং মহিমাময়ের সময় ধীরেসুস্থে কাটতে লাগল। আরও কিছুক্ষণ পরে আরও বেশ কয়েক গেলাস পানীয়ের অবসানে, যখন জয়দেবের মুখটা মহিমাময়ের কাছে এবং মহিমাময়ের মুখটা জয়দেবের কাছে ঝাঁপসা দেখাতে লাগল দুজনে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন।
দুজনেরই প্রচুর মদ্যপান হয়েছে। দুজনেরই এখন টইটম্বুর অবস্থা। জয়দেব বললেন, দাঁড়া একটু বাথরুম থেকে আসি। মহিমাময় একটা দেয়াল ধরে বাইরের দরজার ধারে দাঁড়িয়ে রইলেন কিন্তু জয়দেব সেই যে গেলেন আর আসেন না। ঝিম মেরে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একসময় মহিমাময়ের মনে হল জয়দেব বহুক্ষণ গেছেন, দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার আর কোনও মানে হয় না।
মহিমাময় কিঞ্চিৎ টলতে টলতে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, পাশে একটা চেনা পানের দোকান। বহুদিনের পুরনো অভ্যেস, এখান থেকে এক খিলি জর্দাপান খেয়ে তারপরে বাড়ি ফেরা। পানের দোকানটায় এখন বেশ একটু ভিড়। আশেপাশের বার-রেস্তোরাঁগুলো খালি হচ্ছে। রাত দশটা বেজে গেছে। বৃষ্টিটা নেই, হাওয়া কম। ঠান্ডাটাও তেমন নয়। আসলে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলেই ওরকমটা মনে হচ্ছে মহিমাময়ের।
সে যা হোক, পান কিনতে গিয়ে ভিড়ে বাধা পেয়ে একটু সামনের দিকে একটা বন্ধ ওষুধের দোকানের সিঁড়িতে একটু বসলেন মহিমাময়। তাঁর ঝিমুনি মতো এসেছিল, হঠাৎ একটা রাস্তার কুকুর এসে পাশে শোয়ার চেষ্টা করতেই তার তন্দ্রাটা আচমকা ভাঙল।
তন্দ্রা কেটে যাওয়ামাত্র মহিমাময়ের খেয়াল হল জয়দেবের কথা এবং মনে পড়ল সেই বারের বাথরুমে তিনি ঢুকেছিলেন, বারটা যে পাশেই, মাত্র কয়েক কদম দূরে এটা তার চট করে খেয়াল হল না। বিশেষ করে গাড়িবারান্দার নীচে এই সিঁড়িতে কুকুরের পাশে বসে পরিচিত জায়গাটা নেশার ঘোরে বেশ অচেনা লাগছিল তাঁর।
মাতালের আর যতই দোষ থাক, কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে না। মহিমাময়ও মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এইভাবে জয়দেবকে ফেলে যাওয়া উচিত হবে না।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাথে নেমে সামনের রাস্তায় একটা ট্যাকসিকে ডাকলেন। এই সময়ে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় ট্যাকসির অভাব নেই, দিগদিগন্তের নেশাতুরদের জন্যে সারি সারি ট্যাকসি অপেক্ষমান রয়েছে।
ডাকতেই সামনের ট্যাকসিটা দাঁড়িয়ে গেল। মহিমাময় সেটায় উঠে বসলেন, পার্ক স্ট্রিট।
বলেই সিটে হেলান দিয়ে আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। ড্রাইভার একটু অবাক হলেও এরকম সওয়ারি নিয়ে চালানো তার অভ্যেস আছে। সে একটুক্ষণ থেমে থেকে বলল, পার্ক স্ট্রিটে কোথায়? জড়ানো কন্ঠে চোখ বোজা মহিমাময় একটু আগে ছেড়ে আসা বারের নামোল্লেখ করলেন। বারের নাম শুনে ড্রাইভারও আর দ্বিরুক্তি না করে তিন সেকেন্ডে ব্যাক করে ট্যাকসিটাকে ওই বারের দরজার সম্মুখে নিয়ে এসে বসল, এই তো আপনার বার!
মহিমাময় চোখ খুলে দেখেন সত্যি তাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গাড়ি থেকে নেমে বখশিশসুদ্ধ একটা দশ টাকার নোট ড্রাইভারকে দিয়ে বললেন, খুব তাড়াতাড়ি চালিও না, অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে। একদিন।
বারের দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে মহিমাময় দেখতে পেলেন জয়দেব দাঁড়িয়ে আছেন। জয়দেব মহিমাময়কে দেখে বললেন, আমি ভাবলাম তুই বোধ হয় কোথায় চলে গেলি!
এই সময় জয়দেবের পরিচিত এক ভদ্রলোক কালুবাবু, বারে ঢুকছিলেন, তিনি জয়দেবকে দেখে বললেন, কী হল, এত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছেন নাকি?
জয়দেব মহিমাময়কে দেখিয়ে বললেন, না, এই আমাদের দুজনের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, ডিনার। তাই একটু তাড়াতাড়ি।
কালুবাবু আটকালেন, এক রাউণ্ড, বসে যান।
মহিমাময় কোনও আপত্তি করার সুযোগ পেলেন না, জয়দেবের সঙ্গে তাকেও বসতে হল। মাতালের শেষ রাউন্ড কিছুতেই শেষ হতে চায় না, ওয়ান ফর দা রোড, ওয়ান ফর দা ডিনার, এই রকম ধারাবাহিক চলতে থাকে। তা ছাড়া কালুবাবুর নিজস্ব একটা ভয়াবহ সমস্যা আছে, তিনি বারে এসে সদাসন্ত্রস্ত থাকেন। নিজেই দুঃখ করে ভাঙলেন ব্যাপারটা, জানেন জয়দেববাবু, আমার স্ত্রীর জন্যে মুখ দেখাতে পারছি না। প্রত্যেকদিন বারে আসে।
মহিমাময়ের নেশাটা জমজমাট হয়ে উঠেছে, কিন্তু কথাটা তার কানে গেল, তিনি বললেন, ছিঃ ছিঃ, তিনি বারে আসেন কেন?
কালুবাবু সদ্য আলাপিত মহিমাময়ের হাত ধরে বললেন, আর বলবেন না দাদা, প্রত্যেকদিন রাতে এসে আমাকে জামার কলার ধরে এখান থেকে টেনে বার করে বাড়ি নিয়ে যায়। আজ আপনারা আছেন দাদা, আমাকে একটু রক্ষা করবেন।
জয়দেব ঝিমাচ্ছিলেন, সন্ধ্যা থেকে পেটে কম তরল পদার্থ পড়েনি! কিন্তু তিনি মাতাল হলেও সেয়ানা মাতাল, কালুবাবুর দজ্জাল স্ত্রীর কথা তার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। মহিমাময়ের ব্যাপারটা ভাল জানা নেই, কারণ তিনি সাধারণত রাত করেন না। কিন্তু জয়দেব জানেন কালুবউদি মধ্যরজনীর বারে এক মূর্তিমতী বিভীষিকা। জয়দেব চট করে গেলাসের অবশিষ্ট পানীয়টুকু গলাধঃকরণ করে মহিমাময়কে বললেন, এই ওঠ। ডিনারের নেমন্তন্নে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারপর মহিমাময়ের হাত ধরে প্রায় হিঁচড়ে বার করে রাস্তায় নেমে এলেন, অসহায় কালুবাবুর ঘাড়ে বিল মেটানোর পুরো দায় ঢেলে দিয়ে।
রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। এখন আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। নিঝুম, শীতল পার্ক স্ট্রিট। তবে ভাগ্য ভাল, এখনও দু-একটা ট্যাকসি রয়েছে শেষ সওয়ারির আশায়।
মহিমাময়ের স্ত্রী পিত্রালয়ে গেছেন দুদিনের জন্যে। তবু এত রাত হবে তিনি ভাবেননি। এখন বাড়ি ফিরলে সিঁড়ির নীচে থেকে ঘুমন্ত বুড়ি ঝিটাকে ডেকে তুলে দরজা খোলাতে পুরো পাড়া জেগে যাবে। সুতরাং জয়দেবের সঙ্গে থাকাই মহিমাময় শ্রেয় মনে করলেন। তা ছাড়া অতিরিক্ত মদ্যপান করে তার মনে একটা সাহস এসেছে, চাকরি তুচ্ছ করে আজ তিনি এখন বড়সাহেবের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
সুতরাং জয়দেব এবং মহিমাময় দুজনে এবার ট্যাকসিতে রওনা হলেন বড়সাহেবের বাড়ির ডিনারে। বড়সাহেবের বাড়ি সেই সল্টলেকে। ট্যাকসিওয়ালা কুড়ি টাকা একস্ট্রা চাইল। জয়দেব তাতেই রাজি হলেন। পার্ক স্ট্রিটে আলো ছিল কিন্তু সল্টলেকে এখন গভীর অন্ধকার। লোডশেডিংয়ে ধুকছে উপনগরী।
দেখা গেল, জয়দেব বাড়িটা চেনেন। কোনও রকমে খুঁজে খুঁজে বাড়িটা বেরোল। নতুন একতলা বাড়ি, বাইরের ঘরের সঙ্গে লাগানো ছোট একটা শোয়ার ঘরে কোনও অজ্ঞাত কারণে সংসার থেকে একটু আলাদা হয়ে বড়সাহেব থাকেন। জয়দেব ঘরটা জানেন। ঘরের জানলায় গিয়ে টুকটুক করতে অন্ধকারে কম্বল জড়িয়ে এসে বড়সাহেব একপাশের দরজাটা খুলে দিলেন। তিনি আশা করেননি রাত বারোটার পরে এই দুই ব্যক্তি ডিনার খেতে আসবেন। তবু ভদ্রতার খাতিরে তিনি এঁদের দুজনকে ভেতরে নিজের শোয়ার ঘরে নিয়ে বসালেন।
বড়সাহেব একটা মোমবাতি ধরানোর জন্যে বালিশের নীচে দেশলাই হাতড়াচ্ছিলেন। জয়দেব বললেন, গলাটা বড় শুকিয়ে গেছে। কোনও ড্রিঙ্ক আছে?
দেশলাই খুঁজতে খুঁজতে বড়সাহেব বললেন, না, বাসায় তো কোনও ড্রিঙ্ক নেই! ততক্ষণে দেশলাই জ্বালিয়ে সামনের তেপায়া টেবিলের ওপরে একটা মোমবাতি ধরিয়ে ফেলেছেন তিনি।
মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় জয়দেব দেখতে পেলেন, বড়সাহেব মিথ্যে কথা বলেছেন, তেপায়া টেবিলের নীচে একটা পানীয়ের বোতলে প্রায় গলা পর্যন্ত ভর্তি পানীয় রয়েছে।
হঠাৎ দমকা ফুঁ দিয়ে, কেউ কিছু বুঝবার আগে জয়দেব মোমবাতিটা নিবিয়ে দিলেন, তারপরে তবে রে শালা, মদ নেই এই বলে তেপায়া টেবিলের নীচ থেকে অন্ধকারে বোতলটা তুলে নিয়ে মুখের মধ্যে ঢকঢক করে ঢেলে দিলেন।
বড়সাহেব যথাসাধ্য বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তার আগেই জয়দেবের আর্ত চিৎকার শোনা গেল, সর্বনাশ, ওরে বাবা রে মারা গেলাম, গলা পুড়ে গেল, বুক জ্বলে গেল! হচতে হঁচতে কাশতে কাশতে বমি করতে লাগলেন জয়দেব। ঘটনার আকস্মিকতায় ভীষণ ভয় পেয়ে ঘামতে লাগলেন মহিমাময়, ভাবলেন হয়তো বোতলে অ্যাসিড-ট্যাসিড কিছু ছিল, জয়দেব তাই খেয়ে ফেলেছেন। এদিকে বড়সাহেব আবার মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলেছেন, মোমবাতির আলোয় পানীয়ের বোতলটার আর এক পাশে উবু হয়ে জয়দেব গলায় আঙুল দিয়ে বমি করেছেন।
বড়সাহেব কপাল চাপড়াতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন ছিঃ ছিঃ, আমার শালা খাঁটি জিনিসটা এনে দিয়েছিল আলিগড় থেকে, কলের ঘানির খাঁটি সরষের তেল, সেটা এইভাবে নষ্ট হল।
মহিমাময় কিছু বুঝতে পারছিলেন না। একে ঘোর নেশা হয়েছে, তার উপরে এই বিচিত্র বিপজ্জনক কাণ্ড। ব্যাপারটা বড়সাহেবের খেদোক্তিতে ক্রমশ স্পষ্ট হল।
বড়সাহেবের শীতকালে গায়ে সরষের তেল মাখার বাতিক আছে। শীতকালে তার চামড়া ফেটে যায় প্রত্যেক বছর। উত্তরপ্রদেশে আলিগড়ে থাকেন তাঁর এক শালা। তিনি শীতের আগে জামাইবাবুকে সরষের তেল দিয়ে গেছেন গায়ে মাখবার জন্যে। সেই তেলটাই ছিল বিছানার কাছে তেপায়া টেবিলের নীচে ওই খালি হুইস্কির বোতলে। আর তাই পান করে জয়দেবের এই দুর্দশা।
এই গল্প এর পরে আর টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু পরবর্তী একটি মর্মান্তিক দৃশ্যের কথা না বললে ঘটনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়, যদিও ঘটনাটির সঙ্গে মদ্যপানের কোনও সম্পর্ক নেই।
সেদিন রাত্রে বড়সাহেবের বাইরের ঘরে জয়দেব আর মহিমাময় শুয়েছিলেন। পরদিন সকালবেলা মহিমাময় ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, মেঘ কেটে গেছে, বৃষ্টি নেই, নির্মল আকাশ, সুন্দর ঝকঝকে রোদ উঠেছে। জানলা দিয়ে রোদ এসেছে বড়সাহেবের ঘরে। সেই রোদে একটা লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পরে মহিমাময়ের পরম শ্রদ্ধেয় বড়সাহেব মেঝের বমির উপরে ভাসমান সরষের তেল হাত দিয়ে আলতো করে তুলে গায়ে মাখছেন। মহিমাময়ের এদিকে দৃষ্টি পড়ায় কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলেন তিনি, তারপরে বললেন, জিনিসটা বড় খাঁটি। নষ্ট করতে মন চাইছে না। আপনিও মাখবেন নাকি একটু?