Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একটি ডলফিন শিশু এবং বলরামের বউ || Samaresh Majumdar

একটি ডলফিন শিশু এবং বলরামের বউ || Samaresh Majumdar

আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আকাশে মেঘ দেখে তথাগত ঠিক করলেন একটি লাইনও লিখবেন না। প্রত্যেকদিন লেখার টেবিলে তার সাত-আট ঘণ্টা কেটে যায়। লিখতে বসলেই লেখা হুড়মুড়িয়ে আসে না তাঁর কলমে। ভাবতে হয়, কাটাকুটি, পাতা ছিঁড়ে ফেলা এসব তো আছেই। কলকাতা থেকে প্রকাশক ফোন করেছিলেন, বইমেলার এক মাস আগে বই বাজারে ছাড়বেন। অতএব যত তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে পাণ্ডুলিপি পৌঁছাবে তত কাজটা সহজ হবে। বলেছেন, দু চারদিনের মধ্যে উপন্যাসটার নাম যদি বলে দেয় তাহলে এখনই আর্টিস্টকে প্রচ্ছদ আঁকতে দিয়ে দিতে পারি। এরা এত দেরি করে আঁকে যে সমস্যায় পড়তে হয়।

প্রকাশক জানেন যে তথাগত উপন্যাস শেষ করে দু-তিনদিন ভাবেন নাম নিয়ে। সঞ্চয়িতা হাতড়ান। শব্দ খোঁজেন। জীবনানন্দও বাদ দেন না। কোনও একটা শব্দ মনে লেগে গেলে সেই

শব্দ ভেঙে আচমকা একটা নতুন শব্দ তৈরি হয়ে যায়। তখন আর নামকরণ করতে কোনও অসুবিধে নেই। লেখা শেষ হওয়ার আগেই এমন অনুরোধ করলে তিনি যে অস্বস্তিতে পড়বেন। জেনেও কেন করা?

ভোরবেলায় বিছানা ছেড়ে নিজে চা বানিয়েছেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে হালকা মনে টেবিলে বসার আগে জানলার সামনে যেমন রোজ দাঁড়ান তেমনি দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মন। খারাপ হয়ে গেল আজ। সমুদ্রের রং কালচে। মাথার ওপরের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। সে-কারণেই সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন একটু বেশি নাচানাচি করছে। এসব দেখার পর আর লিখতে ইচ্ছে হল না তার। বেরিয়ে এসে বারান্দার ডেক-চেয়ারে বসলেন তিনি।

সমুদ্রের চেহারাটা দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল তথাগতর। টিলার গায়ে এই বাংলো-বাড়িতে এসেছেন মাস দশেক হল। প্রায় সবকটা ঋতুকেই এই চেয়ারে বসে দেখে গেছেন তিনি। কিন্তু রাগি বাইসনের মতো মনে হয়নি কখনও ঢেউগুলোকে। আধ-মাইল দূরে যে জেলেদের গ্রাম, যেখানকার যুবকরা সারারাত মাছ ধরে সকালে ফিরে এসে তুলে দেয় পাইকারদের হাতে, তারা কি সমুদ্রে গিয়েছিল? ঘরের ভেতর থেকে দূরবিনটা নিয়ে এসে চোখের ওপর তুললেন। অন্য দিন, রোদ বা ছায়া থাকলেও, সমুদ্রের অনেকটাই এই যন্ত্রে ধরা পড়ে। আজ মনে হল আকাশ খুব কাছাকাছি সমুদ্রে মিশে গেছে।

কটকের বিশ্বনাথ ঢড়ের বাংলো এটা। বিশ্বনাথবাবু বড় ব্যবসায়ী নন, অত্যন্ত অভিজাত ব্যক্তি। ইংরেজি, ওড়িয়া এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠকও। বছর পাঁচেক আগে কটকে প্রজাপতি পত্রিকার বিষুব মেলা উৎসবে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। যোগাযোগ রাখতেন ভদ্রলোক। এই বাংলোর কথা জানতে পেরে ভাড়া নিয়ে থাকতে চাইলে এককথায় রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু। ভাড়াটা তাঁকে টাকায় না দিয়ে এই বাংলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় করতে হবে ওই শর্ত দিলেন। দশ মাস তাই করে আসছেন তথাগত। জল, বিদ্যুৎ, পরিষ্কার করার লোকের পেছনে যা খরচ হয় তা নামমাত্র। কিন্তু বাংলোটি অসাধারণ। উঁচু টিলার গায়ে বাংলো। ও-পাশে বালি-পাথরের আড়াল, এ-পাশে সমুদ্র। পেছন দিক থেকে রাস্তা নেমে মিশেছে পিচের পথে। সমুদ্র অন্তত চল্লিশ ফুট পায়ের নিচে।

হঠাৎ হাওয়া বইল। বাড়তে-বাড়তে রেগুলেটার ফুল স্পিডে নিয়ে গেলে যেমন হয়, তেমনি শোঁ শোঁ আওয়াজে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভূখণ্ডে। মজবুত বাংলোটা একটু নড়ে উঠল বলে মনে হল তথাগতের। এবং তারপরেই তিনি দৃশ্যটি দেখলেন। এতক্ষণ যে ঢেউগুলো রাগে ফুঁসছিল সেগুলো আচমকা গুটিয়ে গিয়ে বড় হতে-হতে যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। তারপর তীব্র গতিতে ছুটে এল এক পাড়ের দিকে। নড়ে উঠল বাংলো থরথরিয়ে। ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝতে পারলেন। তথাগত।

ভয়ঙ্কর শব্দে সেই ঢেউ ভেঙে পড়ছে বাংলোর দু-পাশের জমিতে। সেটাকে টপকে ঢুকে পড়েছে ওপাশে। একটা নয়, বারবার ধেয়ে আসতে লাগল ওরা। চল্লিশ ফুট উঁচুতে ছুঁড়ে মারতে লাগল। জল প্রবল আক্রোশে। শেষপর্যন্ত একটা ঢেউ এত ওপরেও উঠে এল তীব্র গতিতে। বাংলোর। পিলারগুলো থরথর করছে এবার। তথাগত এইবার ভয় পেলেন। মনে হল মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ সমুদ্র গ্রাস করবে পৃথিবীকে। কোনও মানুষকে নোয়ার মতো পৃথিবীর সব প্রাণীদের নিয়ে জাহাজ ভাসানোর অবকাশ দিল না। দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতেই বারান্দা পেরিয়ে জল ধাক্কা মারল দরজায়। গলে এল ঘরে। তথাগত দৌড়ে পেছন দরজায় এসে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। নিচের রাস্তা, ওপারের চালাঘরগুলো এখন জলের তলায়। এই বাংলো থেকে নেমে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। শোঁ-শোঁ শব্দে জল বয়ে যাচ্ছে। সাঁতার জানলেও কোনও মানুষের পক্ষে এই জলে নামা সম্ভব নয়। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ কানে এল। নড়বড়িয়ে উঠল বাংলো, তারপর একপাশে কাত হয়ে গেল। কোনও মতে দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিতে পারলেন তথাগত। আবার ফিরে গিয়ে বাংলোর বারান্দায় দাঁড়াবার সাহস তাঁর হল না। তিনি বুঝতে পারছিলেন আর একটা বড় ধাক্কা পেলেই বাংলোটা চল্লিশ ফুট নিচে গড়িয়ে পড়বে। দরজার এপাশের দেওয়ালে একটা রাবারের টিউব ঝুলছিল। বাংলো কাত হয়ে গেলে সেটা মেঝের ওপর পড়ে গড়িয়ে গিয়েছিল ঢালুর দিকে। হাওয়া ভরতি বড় টিউবটাকে তুলে নিলেন তথাগত। এরকম টিউব চড়ে অনেকেই সমুদ্রে স্নান করে থাকে। মাথার ওপর দিয়ে টিউবটাকে শরীরের মধ্যভাগে নিয়ে এসে তৈরি থাকলেন তিনি। বাংলো জলে পড়লেই তিনি বাঁচার জন্যে চেষ্টা করবেন এর সাহায্যে। এই মুহূর্তে তাঁর মনে টাকাপয়সা, জামাকাপড় তো দূরের কথা, পাণ্ডুলিপির কথাও মনে এল না।

ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। তারপর অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন তথাগত। চরাচর ভাসিয়ে যে জল। ফুসছিল তারা ফণা গোটাল। তারপর হু-হুঁ করে ফিরে যেতে লাগল সমুদ্রের দিকে। তার টানে ভাঙাচোরা গাছপালা থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিস ধেয়ে যাচ্ছে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে। একসময় জল চলে গেলে আঁতকে উঠলেন তথাগত। পিচের পথটায় বিশাল বিশাল গর্ত, মনে হচ্ছে কেউ যেন ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। কোনও গাছপালা কখনও যেন এখানে ছিল না। বালির ভেতর বড়-বড় গর্ত এবং সেখানে সমুদ্রের জল জমে আছে।

কোনওমতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন তথাগত। যত দূর চোখ যাচ্ছে শুধু সমুদ্রের তাণ্ডবলীলার স্মৃতি। এবং তখনই তাঁর চোখে পড়ল, টিলার ওপরের অংশ যা বাংলোর গায়ে ছিল তা ভেঙে পড়েছে বাংলোর ওপরে। পড়ার ফলে বাংলোটা আটকে গেছে শক্তভাবে।

ওপরে উঠলেন তিনি। ঘুরে ঢুকে আলো জ্বালতে গিয়ে দেখলেন বিদ্যুৎ নেই। থাকাটাই যে অস্বাভাবিক হত তা তিনি বুঝে গেছেন। ঘরে যে জল ঢুকেছিল তা এরমধ্যে বেরিয়ে গেলেও মেঝে ভিজে চপচপ করছে। তাঁর জুতো জোড়াকে দেখতে পেলেন না। বাইরের ঘরে, যেখানে বসে তিনি লেখেন, সেখানে পৌঁছে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। লেখার টেবিলটা উলটে পড়েছে মেঝেতে। যাবতীয় কাগজ, এমনকী লেখা হয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির ফাইলও সেখানে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে হাত দিতেই বুঝলেন, সব শেষ হয়ে গেছে। জলের তলায় কিছুক্ষণ থাকায় কাগজগুলো প্রায় কাদার পর্যায়ে চলে এসেছে।

যেভাবে অসুস্থ শিশুকে মায়েরা কোলে তুলে নেন, ঠিক সেইভাবে পাণ্ডুলিপির ফাইলটা তুললেন তথাগত। সেটাকে চেয়ারের ওপর রেখে টেবিলটাকে সোজা করে ফাইল খুললেন। ওপরের মোটা কাগজই ভিজে এত নরম হয়ে গেছে যে খুলতেই খসে গেল। আশিটি ফুলস্কেপ পাতা এখন জড়িয়ে আছে গায়ে-গায়ে। ওপরের পাতার কালি জলে ভিজে ঝাঁপসা করে দিয়েছে লেখাগুলো।

শোওয়ার ঘরে নিয়ে এলেন প্যাকেটটাকে। সযত্নে একটা-একটা পাতা তুলে খাটের ওপর। সাজিয়ে রাখতে লাগলেন। জলে ঝাঁপসা হয়ে গেলেও চেষ্টা করলে পড়া যাবে অক্ষরগুলো। শুকিয়ে যাওয়ার পরে কী অবস্থা হয় তাই দেখার। এতদিনের পরিশ্রম, ভাবনা সব এক নিমেষেই খেয়ে ফেলল সমুদ্র। যে ছিল চল্লিশ ফুট নিচে সে এমন সর্বনাশ করবে দু:স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তথাগত। আশিটি পাতাকে খাট জুড়ে আলাদাভাবে রাখা সম্ভব নয়। কোনও-কোনওটা একটু ওপর-ওপর রইল। করুণ চোখে নিজের সৃষ্টির প্রায় ধ্বংসাবশেষ দেখতে লাগলেন তথাগত।

সহ্য হল না তাঁর। বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন তিনি। এসেই অবাক হয়ে গেলেন। মেঘ এখনও রয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের সেই ভয়ঙ্কর চেহারা উধাও। জল নেমে গেছে যেখানে রোজ থাকে। একেবারে শান্ত ভঙ্গিতে ঢেউগুলো নড়াচড়া করছে এখন। মাঝে-মাঝে গড়িয়ে এসে চল্লিশ ফুট নিচে বালিতে আছড়ে পড়েই নিস্তেজ ভঙ্গিতে ফিরে যাচ্ছে আবার। কে বলবে এই সমুদ্রই কিছুক্ষণ আগে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল এবার। হঠাৎ তথাগত দেখতে পেলেন বারান্দার সামনে বালিতে মাঝারি আকারের গর্তে যে জল জমে গেছে সেখানে কিছু একটা ছটফট করছে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে চোখ বড় হয়ে গেল তাঁর। ওটা যে ডলফিনের বাচ্চা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাচ্চাটার বয়স দিন সাতেকের বেশি নয়। এখনও ভালো দৃষ্টিশক্তি হয়নি। ওই অল্প জলে সে বেশ বিড়ম্বনার মধ্যে রয়েছে।

তাড়াতাড়ি বাংলোয় ঢুকে কোদাল খুঁজতে লাগলেন তথাগত। ছোট্ট স্টোররুমে ও ধরনের জিনিস দেখেছিলেন আগে। আজ পেয়ে গেলেন। বারান্দার নিচে বালিতে একটা বেশ বড় গর্ত খুঁড়লেন। তিনি। কলে জল আছে এখনও। অর্থাৎ ওপরের ট্যাঙ্কের জল যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ জল পাবেন খাওয়ার জন্যে। কিন্তু এই শিশুটিকে বাঁচাতে সমুদ্র থেকে যদি জল বয়ে আনতে হয়। তাহলে যে সময় যাবে ততক্ষণ কি ডলফিনটা বাঁচবে? তারপরেই খেয়াল হল, বেচারা জন্মেছে। লোনা জলে। ট্যাঙ্কের মিষ্টি জল ওর পছন্দ হবে তো? সেই জলে সামুদ্রিক প্রাণী বাঁচবে কি সেটাও জানা নেই।

তবু ট্যাঙ্কের জল কল থেকে বের করে সদ্য খোঁড়া গর্তে ঢাললেন তথাগত। তারপর সন্তর্পণে। তুললেন ডলফিন শিশুকে। স্পর্শ পাওয়ামাত্র বেচারা স্থির হয়ে গেল। দেখা বা দেখার মধ্যে না গিয়ে মুখ নামাল। দ্রুত ওকে বড় গর্তে নামিয়ে দিলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইল প্রাণীটি। তারপর হঠাৎই যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে সাঁতার কাটতে লাগল। ওর শরীরের পক্ষে যথেষ্ট জায়গা আছে এই গর্তে। তথাগত লক্ষ করলেন, ডলফিনশিশুর শরীরের বাঁ-দিকে একটু থেঁতলে যাওয়ার দাগ আছে। ওই দিকটা বেচারা নাড়তে পারছে না। সমুদ্রের ঢেউ এতটা ওপরে ওকে তুলে দেওয়ার সময় নিশ্চয়ই আঘাত লেগেছিল।

এর চিকিৎসা কীভাবে করা যায় ঠাওর করতে পারলেন না তিনি। তারপর উঠে গেলেন ঘরে। একজন ডাক্তার, যদিও মানুষের ডাক্তার, মাইল দশেক দূরে থাকেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। রিসিভার কানে চেপে ডায়াল করতে যেতেই থেমে গেলেন তিনি, ডায়াল টোন নেই। টেলিফোন একেবারে মৃত।

অর্থাৎ আলো নেই, টেলিফোন নেই। জল যা ওপরের ট্যাঙ্কে আছে তা বেশি ব্যবহার না করলে দিন দুই-তিন চলবে।

আহত ডলফিনশিশুর সুস্থতা প্রকৃতির ওপর ছেড়ে না দিয়ে কোনও উপায় নেই। ভাগ্যিস মাথায় চোট পায়নি, তাহলে আর এমন ফুর্তিতে সাঁতার কাটতে হত না। কিন্তু ডলফিনরা খায় কী? ফ্রিজ থেকে দুধ বের করলেন তথাগত। কাজের লোকটি সাতসকালে আসে না। আজ আর আসবে বলে মনে হয় না। বেঁচে আছে কি না সন্দেহ। গতকালের এনে দেওয়া দুধ পেয়ালায় ঢেলে চামচ দিয়ে তথাগত চলে এলেন ডলফিনশিশুর কাছে। ঠিক মাঝখানে স্থির হয়ে ছিল সে। তাকে দেখামাত্র এই দিকে মুখ ঘোরাল। বালির ওপর বসে দুধের কাপ রেখে ডান হাত বাড়াতেই সরে গেল ডলফিনশিশু। তথাগত কথা বললেন, আয়, কাছে আয়, তোকে দুধ খাওয়াব। আয়। ডলফিনশিশু দূরে সরে গিয়ে পাক খেতে লাগল।

মিনিট পাঁচেক পরে ওকে হাতের নাগালে পেলেন তথাগত। ধীরে-ধীরে জলের ধারে নিয়ে এসে মুখটাকে উঁচু করে ধরতেই হাঁ করল। সঙ্গে-সঙ্গে এক চামচ দুধ ওর মুখে ঢেলে দিয়ে অপেক্ষা করলেন একটু, দুধটা গিলে ফেলল ও। ছেড়ে দিতেই দূরে সরে গেল কিন্তু ফিরে এল আরও দ্রুত। এসে হাঁ করল। এবার না ধরে দু-চামচ দুধ ঢেলে দিলেন ওর মুখে। তথাগত হাসলেনও, মানবশিশুর সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়? সদ্য হাঁটতে শেখা শিশু যেমন মুখে খাবারের গ্রাস নিয়ে টলমলে পায়ে দৌড়ে পালাতে চায় এ-ও তেমনি করছে। ধীরে-ধীরে পেয়ালার দুধ শেষ হয়ে। গেল। ওর পক্ষে এই পরিমাণ যথেষ্ট কিনা বুঝতে পারলেন না তথাগত। এখানে ডলফিনদের সম্পর্কে কেউ কিছু জানে কিনা খোঁজ নিতে হবে। ওদিকে ফিশারিজ বিভাগের দপ্তর আছে, ওরা নিশ্চয়ই কিছু খবর দিতে পারবে।

খোলা আকাশের নিচে ডলফিনশিশুকে রেখে দেওয়া কি ঠিক হবে যদিও বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তেই জোর বর্ষণ হতে পারে। তা ছাড়া বড়-বড় পাখিও জুটে যেতে পারে। বাংলোর ওপাশে খসে পড়া একটা বড় টিন টেনে এনে এমনভাবে গর্তের ওপর চাপা দিলেন যাতে ভেতরে বাতাস স্বচ্ছন্দে ঢুকতে পারে।

একটা ছাতি নিয়ে কোনওমতে রাস্তায় নামলেন তথাগত। কিন্তু রাস্তা কোথায়? যেদিকে তাকান শুধু দুমড়ে যাওয়া প্রকৃতি। সমুদ্রের ঢেউ স্থলভূমির ছালচামড়া ভয়ঙ্কর শক্তিতে তুলে দিয়ে গিয়েছে। সেই চালাঘরগুলো নেই। গর্ত বাঁচিয়ে কোনওমতে সিকি মাইল হেঁটে আসার পরে একটা বিশাল বটগাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় গোটা চারেক মানুষকে দেখতে পেলেন তিনি।

কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকাডাকির পরেও ওদের কোনও প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে তাঁর শরীর কেঁপে উঠল। ওদের কেউ জীবিত নেই। জল ওদের ওই ওপরে ছুঁড়ে দিয়েছিল। প্রাণহীন শরীরগুলো আটকে আছে গাছের ডালে। গাছটাও হেসে পড়েছে একদিকে। গুঁড়ির ওপরে কিছুটা জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে।

তথাগতর মনে হল তিনি এখন মৃত্যুপুরীতে দাঁড়িয়ে আছেন। সমুদ্র থেকে ভেসে আসা গর্জন ছাড়া কোথাও কোনও প্রাণের ইঙ্গিত নেই। ধীরে-ধীরে ফিরে এলেন বাড়িতে। আসার পথে কিছু মাছ চোখে পড়ল। ছোট-ছোট পারশে, তপসে। ঢেউয়ের সঙ্গে উঠে এসেছিল, ফিরে যেতে পারেনি। এখনও টাটকা রয়েছে। ফিরে এসে বাংলো থেকে ব্যাগ নিয়ে মাছগুলোকে সংগ্রহ করলেন তথাগত। ছুরি দিয়ে পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফ্রিজে ঢোকতে গিয়ে খেয়াল হল, বিদ্যুৎ নেই, আর কিছুক্ষণ বাদেই ফ্রিজের ভেতরটা গরম হয়ে যাবে। তখন ওই মাছগুলোকে আর খাওয়া যাবে না।

অতএব এক প্লেট মাছ ভেজে নিয়ে লাঞ্চ সারলেন তিনি। দুটো সিলিন্ডার ভরতি গ্যাস আছে। কিচেনে। আগুন জ্বেলে রান্না করার সমস্যা নেই। আছে চাল আর আলু পেঁয়াজ। ডালও কিছু থাকা উচিত। অর্থাৎ তাঁর নিজের খাওয়া নিয়ে কোনও চিন্তা আপাতত নেই।

সমস্যা হবে এই ডলফিনশিশুর। টিনের আড়াল সরাতেই শিশুটি চলে এল তাঁর কাছে। এখন ওর মায়ের পেটের সঙ্গে সেঁটে থাকার কথা। মা যা করবে তাই নকল করবে এখন থেকে। ওই বিশাল সমুদ্রে মা কোথায় আছে, আদৌ আছে কি কে জানে! তিনি ফিশফিশ করে ডাকলেন, ফিন, ফিন। সঙ্গে-সঙ্গে শিশুটি পাক খেয়ে চলে গেল ওপাশে।

তথাগত লক্ষ করলেন গর্তের জল অনেকটা কমে গেছে। বালি শুষে নিচ্ছে। আগে জল ভরে দেওয়া দরকার। তিনি উঠতেই বৃষ্টি আরম্ভ হল। বড়-বড় ফোঁটা থেকে বাঁচতে দৌড়ে কাত হয়ে থাকা বারান্দার ছাদের নিচে চলে এলেন। বৃষ্টি আরম্ভ হল। সঙ্গে-সঙ্গে সমুদ্র চলে গেল সাদা পরদার আড়ালে। বারান্দায় ছাদের একপাশ দিয়ে জল ঢুকছে ভেতরে। তাঁর পক্ষে এখনই। সারানো সম্ভব নয়। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধিটা এল। বাংলোয় ছোট বড় যত পাত্র ছিল, এমনকী একটা বড় ড্রামও, বৃষ্টির জল ভরার কাজে লাগালেন। ড্রামের ভেতরটা পরিষ্কার করার মতো জল। জমতে মিনিট পাঁচেক লাগল। খুশি হলেন তথাগত। ওপরের ট্যাঙ্কের জল শেষ হয়ে গেলেও এই জল কিছুদিন তাঁকে সাহায্য করবে। বৃষ্টির জল ফুটিয়ে নিলে খেতে তো অসুবিধে নেই।

এই তুমুল বৃষ্টি বেশিক্ষণ দেখতে ভালো লাগল না। ঘরে ঢুকে দেখলেন এখনও ছাদ থেকে জল পড়েনি। তাঁর লেখাগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে খাটের ওপরে। শুতে গেলে ওগুলো সরাতে হবে। সেই পরিশ্রম করতে ইচ্ছে করল না। বাইরের ঘরের ইজিচেয়ারে শরীর ছেড়ে দিতে মনে হল এর চেয়ে আরাম আর কিছুতেই নেই। বড় বেশি পরিশ্রম করেছেন আজ, অনেকদিন বাদে। কিন্তু আজ এরকম হল কেন? সমুদ্র এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ধ্বংস করে গেছে সব এমন ঘটনার কথা কি।

আগে শুনেছেন?মনে পড়ছে না তার। এই তল্লাটে একমাত্র টিলার ওপর বাংলো এইটে। আর সবাই থাকেন সমুদ্রের লেভেলে। জোয়ারের সময় জল যত দূর ওঠে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে। কিন্তু আজ যদি চল্লিশ ফুট উঁচুতে ঢেউ ডলফিনশিশুকে ছুঁড়ে দিতে পারে তাহলে মাইলের-পর মাইল জনপদ এক মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই স্বাভাবিক। ওই যে জেলে বস্তি, বাসস্ট্যান্ডের পাশের দোকানপাট, মাছের আড়তগুলো, ও পাশের গ্রাম–ভাবতে পারছিলেন না তথাগত। ওই গ্রাম থেকে হেঁটে আসত বলরাম। তাঁর সংসারের প্রায় সব কাজ শেষ করে দুপুরের খাবার নিয়ে গ্রামে ফিরে যেত। লোকটার ব্যবহার দেখে খুশি হয়ে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কিনে। দিয়েছিলেন তিনি, খুব খুশি হয়েছিল বলরাম। কিশোর বয়সে বিয়ে করেছিল সে বাড়ির চাপে। ভগবানের আশীর্বাদে বাচ্চা হয়নি। একথা ও নিজেই বলে। ভাগ্যিস হয়নি নইলে কী খাওয়াতাম তাকে!

তথাগতর মনে হল তিনি আর বলরামকে দেখতে পাবেন না। ওর গ্রাম এখন নিশ্চিহ্ন। বলরাম বলেছিল, বাবু, আপনি যখন কলকাতায় ফিরে যাবেন আমাকে নিয়ে যাবেন?

আমি তো আর কখনও কলকাতায় ফিরব না বলরাম।

সত্যি! তাহলে আর আমার কোনও চিন্তা নেই।

মানুষ কেন চিন্তা করে ভবিষ্যৎ ভেবে? কোনও মানে হয়? অনেকে কিছু ভেবে যদি কেউ সিদ্ধান্ত নেয় এইভাবে বাকি জীবন কাটাবে সেভাবে কি কাটাতে পারে? এক লহমায় মৃত্যু তাকে তুলে নিয়ে সেই চিন্তার আর কি মূল্য থাকছে!

বৃষ্টি পড়েই চলেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই একটা স্যাঁতসেঁতে সন্ধ্যা হুড়মুড়িয়ে এসে যেতেই ঘরদোর অন্ধকার হয়ে এল। আলো জ্বালতে গিয়েই হাত নামালেন তথাগত। সেই সাতসকালেই কারেন্ট গিয়েছে। খুঁজে-খুঁজে কয়েকটা মোমবাতি পেয়ে গেলেন। এগুলো বলরামই বাসস্ট্যান্ডের পাশের দোকান থেকে এনেছিল। মোমবাতি জ্বালালেন তিনি। আলো হল, সেইসঙ্গে ছায়াও কাঁপতে লাগল।

রান্নাঘরে মোমবাতি নিয়ে গিয়ে গ্যাস জ্বালিয়ে প্যাকেট থেকে তৈরি রাখা নুডল বের করে জলে ফুটিয়ে নিতেই খাবার হয়ে গেল। মশলা ছড়িয়ে চামচ দিয়ে খেতে-খেতে মনে পড়ল ফিন-এর কথা। বেচারা সেই কখন এক কাপ দুধ খেয়েছে। খিদের জ্বালায় নিশ্চয়ই ছটফট করছে এখন। কয়েকটা নুডল প্লেট থেকে সরিয়ে জলে ধুয়ে নিলেন তিনি। তারপর ছাতি মাথায় এক প্লেট নুডল আর চামচ নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে নিচে পা রাখলেন। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেলেও একটা আলোর মায়া বাইরের প্রকৃতিতেও তখন রয়েছে। গর্তের কাছে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। বৃষ্টির জল গর্তে পড়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ফিন গর্তে নেই। আশেপাশে লক্ষ করতেই দেখতে পেলেন ওকে। ভেজা বালির ওপর মুখ গুঁজে পড়ে আছে। দ্রুত ওর পাশে গিয়ে বসতে-বসতেই ভিজে গেলেন তথাগত। হাত দিয়ে বুঝলেন ফিন এখনও মরেনি। ক্রমাগত জল গায়ে পড়ায় শুকিয়ে যায়নি শরীর। ওকে তুলে নিয়ে আবার গর্তে ছেড়ে দিলে আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল কিছুক্ষণ। তথাগত ডাকলেন, ফিন, ফিন।

অন্ধকার হয়ে আসছে। আলোর মায়া চলে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। শেষপর্যন্ত মুখ তুলল। ডলফিনশিশু। জলের ভেতর হাত দিয়ে ওকে আদর করলেন তথাগত। তারপর প্লেট থেকে এক চামচ নুডল নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরলেন। হাঁ করল ফিন। নুডল মুখে দিতেই গিলে ফেলল অনায়াসে। একটু-একটু করে প্লেট খালি হয়ে গেল। তথাগত বুঝলেন ওর খেতে খারাপ লাগছে এবং পরিমাণ আর একটু বেশি হলে ভালো হত। পেটে খাবার যাওয়ামাত্র চাঙ্গা হয়ে গেল ফিন। ঝট করে একটা পাক ঘুরে এল সে। মুখ তুলে হাঁ করল।

ছাতি ছাড়াই চলে এলেন তথাগত। ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল বের করতেই নজরে পড়ল রবারের গ্লাভস দুটোর দিকে। ফ্রিজের ওপর পড়ে আছে। এখনও ব্যবহার করেনি। ওটার ভেতর জল ঢুকিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে আঙুলগুলোয় দুধ ভরলেন। তারপর একটা আলপিন দিয়ে আঙুলের ডগা ফুটো করতেই এক ফোঁটা দুধ বেরিয়ে এল।

প্রায়ান্ধকারে গ্লাভসের পাঁচ আঙুলে দুধ চুষে খেয়ে ফেলল ডলফিনশিশু। এই সময় বৃষ্টি থামল। মুখ তুলে তথাগত দেখলেন কেউ যেন ঝেটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মেঘগুলোকে। গর্ত থেকে খানিকটা জল বের করে টিন দিয়ে চাপা দিলেন তিনি। বাতাস ঢুকবে কিন্তু ফিন চেষ্টা করলেও বেরুতে পারবে না।

একটু হাওয়া দিল। সঙ্গে-সঙ্গে কেঁপে উঠলেন তথাগত। বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস তাঁর নেই। নির্ঘাত সর্দিজ্বর আসবে। তাড়াতাড়ি মোমবাতি নিয়ে বাথরুমে চলে এসে ভালো করে স্নান সেরে পাজামা-পাঞ্জাবি পরলেন তিনি। গায়ে একটা চাদর জড়াতে আরাম হল। তারপর বোতল থেকে হুইস্কি বের করে গ্লাসে ঢাললেন। মনে-মনে বললেন, এই বস্তুটি পেটে গেলে সর্দিজ্বর পালাবেই।

গোটা তিনেক হুইস্কি খাওয়ার পর অভ্যেসমতো বারান্দার দরজা বন্ধ করতে এসে থমকে গেলেন। তিনি। সামনের আকাশে যেন ময়ূরের গলার রিং। কি দারুণ! দূরে সমুদ্রের বুকে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। আর নিচের সমুদ্র পোষ বেড়ালের মতো সেই আকাশে মুখ ঘষছে। সকালের সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটির কথা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবে না এখন এই ছবির সামনে দাঁড়ালে। প্রকৃতির কি খেয়ালি খেলা। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলেন তিনি। কিছুক্ষণ দেখার পর বুকের ভেতরটা কীরকম মোলায়েম হয়ে গেল। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন ওটা আর আগের জায়গায় নেই। ছাদ নেমে আসায় বেঁকে গেছে দরজা। তারপর মনে হল, কেন বন্ধ করছেন? আজ এই রাত্রে এখানে আসার মতো কোনও প্রাণ এই চরাচরে নেই।

ফ্রিজে খাবার ছিল। সেগুলো এখন বিদ্যুতের অভাবে আহারযোগ্য কিনা তা যাচাই করতে ইচ্ছে হল না তথাগতর। কুড়িয়ে এনে রাখা মাছগুলো চটপট ভেজে নিলেন তিনি। তারপর হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে আরামচেয়ারে বসলেন। মোমবাতির শরীর ইতিমধ্যে খাটো হয়েছে কিছুটা।

তথাগত ভাবছিলেন। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিশ্চয়ই মাইলের-পর-মাইল সমুদ্র তীরে ঘটেছে। মাথার ওপরের ছাদ মোটামুটি ঠিক থাকলেও এখানে আর দু-একদিনের বেশি থাকা সম্ভব নয়। জল এবং খাবার না পেলে না খেয়ে মরতে হবে। অতএব কালই রওনা হওয়া দরকার। এখান থেকে প্রতিদিন তিনটি বাস শহর যায় আসে। ঘণ্টা আড়াই লাগে। সেই বাস চলছে কিনা তা। স্ট্যান্ডে না গেলে জানা যাবে না। ট্রেন লাইন মাইল কুড়ি দূরে সমুদ্রের কাছাকাছি ছিল। সেটা উড়ে গেলে সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর যেতে হলে খালি হাতে যেতে হবে। এখানকার। জিনিসগুলো নিয়ে তাঁর পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল পাণ্ডুলিপিগুলোর কথা। এতক্ষণে কাগজগুলোর শুকিয়ে যাওয়া উচিত। খুব ইচ্ছে করছিল পাশের ঘরে গিয়ে ওগুলো দেখতে। যতই ঝাঁপসা হোক, চেষ্টা করে পড়া গেলে পাবলিশার হাতে স্বর্গ পাবে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে সংবরণ করলেন তিনি। ধরা যাক, শুকিয়ে যাওয়ার পর ওগুলো বেশ পড়া যাচ্ছে। এটুকু ভাবলেই আজ রাত্রে স্বস্তি পাচ্ছি। উলটোটা যদি ঘটে থাকে তাহলে খামোখা আজ রাত্রের স্বস্তি নষ্ট করে কি লাভ!

আজ দু-পেগ খেয়েই ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। সারাদিনের টেনশন, পরিশ্রমের ক্লান্তি এবং বৃষ্টিতে ভেজার অনভ্যাস তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। সেই ঘুমের মধ্যে তিনি শুনতে পেলেন, বাবু বাবু!

বলরামের গলা। বেচারা বলরাম! মরে গিয়ে প্রেত হয়েও তাঁর কথা ভুলতে পারেনি। তিনি ঘুমের মধ্যেই বললেন, এই যে আমি। কিছু বলবে বলরাম?

বাবু! ও বাবু! এবার গলায় কান্নার আওয়াজ।

প্রেতেরা কি কাঁদে?বলরামের জন্যে খুব কষ্ট নিয়ে নড়ে উঠলেন তথাগত। আরামচেয়ারের দুই হাতলে পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুতেই পায়ে কারও স্পর্শ পেলেন।

বাবু, আমি বলরাম!

চোখ খুললেন তিনি। ঘরে মোমবাতির আলো কাঁপছে। তাঁর পায়ের কাছে বলরাম দুটো হাত বুকের ওপর জড়ো করে দাঁড়িয়ে।

তুমি?

হ্যাঁ বাবু!

বেঁচে আছ?

হ্যাঁ বাবু।

এতক্ষণ কোথায় ছিলে? এখন তো অনেক রাত!

জল আসছে দেখে আমি বউকে নিয়ে কাঁঠাল গাছের মগডালে উঠে বসেছিলাম। ঢেউ গাছের নিচের ডালগুলো মুচড়ে ভেঙে নিয়ে গিয়েছিল। অত উঁচুতেও আমাদের গলা পর্যন্ত জল উঠেছিল। তারপর জল নেমে গেলে আর নামতে পারছিলাম না।

কেন?

নিচে কোনও ডাল ছিল না। কাঁঠাল গাছটা যেন নারকোল গাছ হয়ে গিয়েছিল। একটা লোক নেই চারপাশে যে সাহায্য করবে। গাঁকে গাঁ সমুদ্র গিলে ফেলেছে বাবু। ডুকরে কেঁদে উঠল বলরাম।

তা নামলে কী করে?

এই একটু আগে গাছটার মাজা ভেঙে পড়তে আমরা কোনওমতে পড়লাম। জলের সময় যদি গাছটা ভাঙত তাহলে–!

আমরা মানে?

আমি আর আমার বউ।

ও।

বাবু। আপনার কোনও বিপদ হয়নি তো? বলরামের গলায় উদ্বেগ।

হলে কি আমাকে দেখতে পেতে। উঠে দাঁড়ালেন তথাগত। বলরামের পেছনে একটা লম্বা শরীর, মুখ ঘোমটায় ঢাকা। শাড়িটিতে কাদা শুকিয়ে আছে।

নিশ্চয়ই না খেয়ে আছ?

খাবার কোথায় পাব বাবু! চারধার শ্মশান!

না। বাইরে বৃষ্টির জল ধরা আছে। গ্যাস জ্বেলে ভাত আলু ফুটিয়ে নাও। আজ রাত্রে বারান্দায় শোও তোমরা। আমার শোওয়ার ঘরে জায়গা নেই।

আয়। বলে বউকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল বলরাম।

ঘণ্টা বারোর বেশি যারা গাছে ঝুলে ছিল প্রাণভয়ে তারা এত স্বচ্ছন্দে হাঁটে কী করে! তথাগত আবার হুইস্কি নিলেন। প্রত্যেক মাসে শহরে গিয়ে দশটা বোতল কিনে নিয়ে আসেন তিনি। এখনও যেমন খেয়েছেন তেমন খেলে দিন পনেরো চলবে। তারপর? হাসলেন তথাগত। আজকের রাতটায় তুমি বেঁচে আছে, তাই আজকের কথাই ভাব। সব ঠিকঠাক থাকলে খুশি হও। কালকের ভাবনা কালকে ভাবা যাবে।

ভোর হতে-না-হতে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠলেন তথাগত। এরকম ভঙ্গিতে শোওয়ার অভ্যেস তাঁর নেই। ফলে পিঠে কোমরে একটু ব্যথা বোধ হল। এখনও আলো তার সঠিক চেহারা নেয়নি। আতপ চালের গুড়ো জলে গুলে যেন ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর ওপর। তথাগত বেরুতে। গিয়ে থমতে গেলেন। বারান্দার একপাশে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে বলরাম। মুখ হাঁ করা। পা ছড়ান। ওপাশে ওর বউ কাত হয়ে রয়েছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। সপ্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে গর্ত চাপা দেওয়া টিনের কাছে এলেন। পায়ের নিচে তো বটেই, আশেপাশের বালি ভিজে রয়েছে।

টিনের আড়াল তুললেন তথাগত। গর্তের জল কমে গেলেও ফিনের শরীর ডুবিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। স্থির হয়ে ছিল সে। তথাগত যেই ডাকলেন, ফিন, ফিন, অমনি নেচে উঠল যেন। কিনকিন আওয়াজ তুলে গর্তের ধারে এগিয়ে এসে হাঁ করল ফিন। ওর মাথায় হাত বোলালেন তথাগত, খিদে পেয়েছে? কিন্তু তোর দুধ তো আর একটুখানি ফ্রিজে পড়ে আছে! নুডল খাবি?

মাথা ঘষে তথাগতর হাতে আদর করল ফিন।

সমুদ্রের দিকে তাকালেন তথাগত। সমুদ্র এখন স্থির। মৃদু বাতাস আঁচড়ে যাচ্ছে তার জল। এই বিপুল জলরাশির কোথাও নিশ্চয়ই ফিন-এর মা খুঁজে বেড়াচ্ছে সন্তানকে। কিন্তু ওকে সমুদ্রে ছেড়ে দিলেই যে মায়ের কাছে পৌঁছতে পারবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ওই শিশু অন্য কোনও প্রাণীর আক্রমণের লক্ষ্য হলে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না।

বাবু! এটা কী? বলরামের গলা পেছন থেকে ভেসে এল।

এটা একটা ডলফিনের বাচ্চা। কাল সমুদ্র ওকে তুলে আমার এখানে ছুঁড়ে দিয়ে গেছে। আমি ওর নাম দিয়েছি ফিন।

এই এখানেও জল উঠেছিল? হাঁ হয়ে গেল বলরাম।

হ্যাঁ। জল না, ঢেউ উঠছিল ছোবল মেরে। ওই দ্যাখ, বারান্দার ছাত কাত হয়ে আছে। কাল তোমরা ভাত খেয়েছিলে?

হ্যাঁ বাবু!

হাঁড়ি পরিষ্কার করে খেয়েছ না কিছু পড়ে আছে?

বেশি খেতে পারোনি বাবু, অনেকটা থেকে গেছে।

বাঃ। এক প্লেট ভাত জল দিয়ে ভিজিয়ে একটা চামচ সমেত নিয়ে এসো তো। তথাগত উবু হয়ে বসলেন গর্তের পাশে, একটা পাক খেতে-খেতে ফিন শব্দ করল, কিন। তথাগতর খেয়াল হল, কোথায় পড়েছিলেন, ডলফিন গান গাইতে পারে ওদের মতো করে। মানুষের ন্যাওটা হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি।

ভাত নিয়ে এল বলরাম। তথাগত ফিনের মুখে ধরতে গেলে সে হাঁ করল। অতএব এক চামক ভাত সেই হাঁ মুখে ঢেলে দিলেন, আস্তে খাবি।

গপগপ করে গিলে ফেলল ফিন। আর একবার জলে পাক দিয়ে এসে হাঁ করল। বলরাম মুগ্ধ হয়ে। দেখছিল, এ ভাত খায়?

সমুদ্রের ভেতর ও ভাত পাবে কোথায়? মায়ের দুধ খাওয়ার বয়স এখন। আমাদের বোতলের দুধ তো শেষ। কাল রাত্রে নুডল দিয়েছিলাম, খেয়েছিল। তাই এখন ভাত দিচ্ছি। নরম খাবার হলে গিলতে পারবে সহজে।

প্লেটের ভাত শেষ হলে উঠে দাঁড়িয়ে বলরামকে তথাগত বললেন, এক বালতি বৃষ্টির জল গর্তে ঢেলে দিতে। এই সময় খসখসে গলা ভেসে এল, হয়ে গেছে।

নিয়ে আয়। বাবুর কাছে লজ্জা কীসের। এক কাপ চা খেয়ে বাবু বাথরুমে যায়। নিয়ে আয় এখানে। বলরাম হুকুম করল।

হেসে ফেললেন তথাগত। এক হাতে চায়ের কাপডিশ, অন্য হাতে ঘোমটার প্রান্ত গলার নিচে ধরে বলরামের বউ বারান্দা থেকে নামছে, হোঁচট খেয়ে পড়ল বলে।

তুমি তো পড়ে যাবে। পথে দেখে হাঁটো। বললেন তিনি।

বললাম এত লজ্জার কিছু নেই। দিনভর যখন গাছে ঝুলছিলি তখন তোর মাথায় ঘোমটা ছিল? তখন তো মরতে বসেছিলি। বলরাম খেঁকিয়ে উঠল।

ঘোমটা চিবুকের কাছে উঠল।

চায়ের কাপ নিয়ে তথাগত জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বউ-এর নাম কী?

বলরাম বলল, নাম বল। লক্ষ্মী!

ঘোমটার আড়াল থেকে খসখসে গলা ভেসে এল।

চায়ে চুমুক দিলেন তথাগত। ভেবেছিলেন খাওয়া যাবে না কিন্তু ততটা খারাপ লাগল না। তথাগত বললেন, বলরাম, বাড়িতে যা আছে তাতে কটা দিন চলতে পারে। তারপর তো এখানে থাকা যাবে না। আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তোমরা কী করবে ভেবে দ্যাখো। তোমাদের ঘর–!

কিছু নেই বাবু। একেবারে মাটি হয়ে গেছে।

তাহলে?

বাবু আপনি এখান থেকে যাবেন না। আমি যেখান থেকে পারি সব জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসব। দরকার হলে সাইকেলে শহরে চলে যাব। আমি একা থাকলে, দিকবিদিকে চলে যেতাম। কিন্তু গলায় তো কাঁটা বিঁধে আছে। ওকে নিয়ে কোথায় যাব বলুন! কাতর গলায় বলল বলরাম।

পাণ্ডুলিপির কাগজগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকটা পাতায় পাতলা কালির আড়ালে অক্ষরগুলো অস্পষ্ট। অনেকক্ষণ ঠাওর করলে তবে বোঝা যায় কী লেখা হয়েছে। এখন এগুলো নিয়ে বসার কথা ভাবতেই পারছেন না তথাগত। বইটা যদি মেলায় না বের হয় তাহলে তাঁর কিছু করার নেই। কাগজগুলোকে গুছিয়ে রাখলেন তথাগত।

সাড়ে নটায় জলখাবার নিয়ে এল বলরাম। রুটি আর আলুর তরকারি। দেখা মাত্র টের পেলেন তাঁর খিদে পেয়েছে।

খাওয়া শেষ হলে বলরাম বলল, কী পাওয়া যায় গিয়ে দেখি বাবু।

কিছুই পাবে না।

তবু–। সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি।

তুমি এখন শহরে যাবে নাকি?

মোমবাতি দরকার অনেকগুলো। চাল ডাল আছে। আলু পেঁয়াজ আদা লঙ্কা রসুন আর চিনি যদি পাই তাহলে কোনও চিন্তা নেই। বলরাম বলল।

দুশো টাকা দিলেন তথাগত। বড় নোট না দিয়ে দশটাকার নোটে দিলেন। জলখাবার খেয়ে সাইকেল নিয়ে চলে গেল বলরাম হ্যান্ডেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে। অনেকটা পথ তাকে সাইকেলকেই বহন করতে হবে।

বেলা এগারোটা নাগাদ ফিনকে দেখতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ফিন ওর মতো জলে পাক খাচ্ছে। কাছে যেতেই মুখ তুলে দেখল। তারপর প্রবল আনন্দে ঘুরপাক খেতে লাগল, মুখ হাঁ। করল না। বালির প্রান্তে বাঁধানো দেওয়ালের কাছে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালেন তথাগত। বেশ বাতাস বইছে। দেখতে-দেখতে চল্লিশ ফুট নিচের বিচে নজর পড়ল তার। প্রায় কোমর জলে নেমে কিছু করছে একটি স্ত্রীলোক। এ কোত্থেকে এল?কী করছে ওখানে। ঢেউ এসে ওকে নাচিয়ে দিচ্ছে। তারপর চোখ পড়ল, দু-দিকে দুটো খুঁটি পুঁতে লম্বা কাপড় জলে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তথাগত পেছন দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, লক্ষ্মী!

ভেতর থেকে সাড়া এল না।

স্ত্রীলোকটি লক্ষ্মী ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু বুঝতে সময় লাগল তাঁর। লক্ষ্মী মাছ ধরছে সমুদ্রের ছোট ঢেউ-এ কাপড় পেতে। কী মাছ পেতে পারে ও? তীরের এত কাছে কোনও মাছ সচরাচর আসে না। তা ছাড়া কালকের ঘটনার পর তীরের কাছাকাছি যত সামুদ্রিক ছোট প্রাণী ছিল সব মারা পড়েছে। মেয়েটা কি পাগল?

ঘণ্টাখানেক বাদে কাপড় তুলে পাড়ে উঠে এল লক্ষ্মী। এখন ওর পরনে কালো রঙের শায়া, যা বুকের ওপর গিট দিয়ে বাঁধা। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল মেয়েটি বেশ ফরসা এবং শরীর লম্বা ও আঁটোসাঁটো। উবু হয়ে বসে কাপড় থেকে কিছু তুলে-তুলে বালির ওপর রাখছিল লক্ষ্মী। সব তোলা হয়ে গেলে আবার নেমে গেল সমুদ্রে কাপড়টা নিয়ে। ভালো করে জলে ডুবিয়ে ধুয়ে জল নিংড়ে উঠে এল ওপরে। ওটা যে ওর পরনের কাপড় তা বুঝতে পারলেন তথাগত। সংগৃহীত বস্তু একটা থালায় তুলে লক্ষ্মী ওপাশ দিয়ে ওপরে আসার জন্যে পা বাড়াল।

ঘরে ঢুকে গেলেন তথাগত। ওর এই অবস্থায় মুখোমুখি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু তাঁর খুব কৌতূহল হচ্ছিল। কী ধরেছে লক্ষ্মী? তারপর খেয়াল হল, ও তো একবস্ত্রে এসেছে। এখন ভেজা শাড়ি সায়া পরে থাকবে নাকি? তাঁর কাছে কোনও মেয়েদের পোশাক নেই। কী মনে হতে একজোড়া পুরোনো পাজামা পাঞ্জাবি বের করে বারান্দায় রাখলেন।

লক্ষ্মী এসেছে বুঝতে পেরে ঘর থেকেই গলা তুলে বললেন, সমুদ্রে গিয়ে ভিজে এলে কেন?কী ধরতে গিয়েছিলে?

চিংড়ির বাচ্চা।

চিংড়ির বাচ্চা? কেন?

ওর জন্যে। লক্ষ্মীর গলায় খুশি।

তথাগত কী বলবেন ভেবে পেলেন না। কাল ওই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে আর আজ বউ নেমে গেছে সমুদ্রে স্বামীর জন্যে চিংড়ির বাচ্চা ধরতে। এদের প্রেমট্রেম বেশ জোরালো বলে মনে হল তাঁর। তিনি বললেন, তোমার তো আর জামাকাপড় নেই। বারান্দায় যেগুলো রেখেছি সেগুলো পরে শাড়ি শুকিয়ে নাও।

মিনিট আটেক অপেক্ষা করল তথাগত। তারপর বাইরে এসে লক্ষ্মীকে দেখে তাঁর মুখে হাসি ফুটল। পাজামা এবং পাঞ্জাবি, দুটোই বড় হয়েছে। হাতা গুটিয়ে নিয়ে ম্যানেজ করেছে কিছুটা। লক্ষ্মী সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁকে বালিতে নামতে দেখে লক্ষ্মী তাকাল। না, প্রথাগত সুন্দরী এই মেয়েটা না। ঠোঁট পুরু, চোখ চাপা। কিন্তু কীরকম একটা উগ্র ব্যাপার আছে। ঠিক এই রকম অনুভূতি হয়েছিল তাঁর ফিল্মের এক মহিলাকে দেখে। কাকে? মনে করতে চেষ্টা করলেন। তিনি। লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করল, ভাত করব?

ওর গলার স্বর ও বলার ভঙ্গিতে মনে পড়ে গেল, সোফিয়া লোরেন, হেসে ফেললেন তিনি। কার সঙ্গে কার মিল খুঁজছেন তিনি।

তাহলে থাক। লক্ষ্মী বলল।

মানে?

আপনার খাওয়ার ইচ্ছা নাই যখন তখন থাক।

আমার যে ইচ্ছে নেই তুমি বুঝলে কী করে?

হাসলেন যে!

না, সত্যি খিদে নেই। তোমার খেতে ইচ্ছে করলে রাঁধতে পারো।

মাথা নেড়ে না বলল লক্ষ্মী। তারপর এগিয়ে কানাতোলা থালা সামনে এনে ধরল, দ্যাখেন!

গুঁড়ি-গুঁড়ি, মাছের মতো দেখতে নয়, পোকাই বলা চলে, থালার জলে থিকথিক করছে।

অবিশ্বাসী গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো চিংড়ির বাচ্চা?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল লক্ষ্মী।

বলরাম এগুলো খায়?

না-না। ওর জন্যে–। আঙুল তুলে ফিনকে দেখিয়ে দিল লক্ষ্মী।

অবাক হয়ে গেলেন তথাগত। ডলফিনশিশুর খাবার আনতে ওইভাবে সমুদ্রে নেমেছিল লক্ষ্মী? আর তিনি ভেবেছিলেন স্বামীর জন্যে প্রেম উথলে পড়েছে! বেশ লজ্জিত হলেন তথাগত। বললেন, এক চামচ দাও তো, কেমন খায় দেখি!

দূরে দাঁড়িয়ে তথাগত দেখলেন একটা চামচে করে চিংড়ির বাচ্চা তুলে গর্তের কাছে গেল লক্ষ্মী। ফিন সাঁতার কাটছিল। লক্ষ্মীকে দেখামাত্র ডুব দিয়ে নিচে গিয়ে বসে রইল। বেশ কয়েকবার। ডাকাডাকি করল লক্ষ্মী কিন্তু ফিন-এর প্রতিক্রিয়া হল না।

লক্ষ্মী চামচ জলে ডুবিয়ে দেওয়া সত্বেও ফিন নড়ল না। তথাগত ব্যাপারটা দেখে বললেন, ওগুলো বালির ওপর রেখে তুমি সরে যাও তো।

লক্ষ্মী একটু দূরে চলে গেলে তথাগত গর্তের ধারে উবু হয়ে বসলেন। তৎক্ষণাৎ ফিন উঠে এল। ওপরে। ঘুরে-ঘুরে অদ্ভুত শব্দ করতে লাগল। মাথায় হাত বোলানোর পর ফিন শান্ত হল। তথাগত এক চামচ চিংড়ির বাচ্চা তুলে জলে ফেলতেই সে ঘাই মেরে গিলে ফেলল ওগুলোকে।

হাততালি দিয়ে হেসে লক্ষ্মী বলল, বদমাশ, আমাকে হিংসে করে। তোমাকে হিংসে করবে কেন? আপনার সঙ্গে ও ছিল, এখন আমি এসে গেছি। মেয়েছেলের মন তো! মেয়েছেলে? এটা মেয়ে নাকি?

দ্যাখেননি? দ্যাখেন, আপনার হাত কী করে চাটে! আর একটু দিন না।

ডলফিনের বাচ্চাটাকে দেখার পর থেকে একবারও তথাগতর মনে ওর লিঙ্গ নিয়ে কোনও চিন্তা আসেনি। শোনার পর তাকিয়েও পার্থক্য বুঝতে পারলেন না।

ওকে ছেড়ে দেন। লক্ষ্মী বলল।

ছেড়ে দেব মানে? সমুদ্রে গেলে ও বাঁচতে পারবে?

নিজের জায়গায় পারবে না কেন? ঠিক পারবে!লক্ষ্মী জোর দিয়ে বলল।

কথাটা পছন্দ হল না তথাগতর। এত তাড়াতাড়ি ফিনকে ছেড়ে দিতে তিনি মোটেই রাজি নন। মনে হল, লক্ষ্মী বোধহয় ঈর্ষা করছে ফিনকে। তাই বা কী করে হয়। তাহলে ফিন-এর জন্যে চিংড়ির বাচ্চা ধরতে যেত না!

এই সময় দূরের আকাশে শব্দ বাজল, গোঁ-গোঁ শব্দটা পাক খেতে-খেতে এদিকে এগিয়ে আসছে। লক্ষ্মী ভয়ে দৌড়ে ঢুকে গেল বারান্দায়। মুখ তুলে তথাগত দেখতে পেলেন একটা হেলিকপ্টার আকাশে পাক খাচ্ছে। এই বাংলোটাকে দেখে অনেকটা নিচে নেমে এল। পাইলট এবং তার। পাশে বসা লোকদের দেখতে পেলেন তিনি। ওরা হাত নাড়ছে। হাত নাড়লেন তথাগত। সমুদ্রের ওপর চলে গেল হেলিকপ্টারটা। ওরা নিশ্চয়ই সমীক্ষা করতে এসেছে। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট দিলে ত্রাণ আসবে। হেলিকপ্টারটা আবার ফিরে এল। ঠিক মাথার ওপর এসে হাত নেড়ে সরে যেতে বলল তাঁকে। ওরা একটা বড় প্যাকেট ফেলে দিল নিচে। শোঁ করে নেমে আসছে সেটা, হঠাৎ খেয়াল হতে দৌড়ে গিয়ে পাশে পড়ে থাকা টিনটাকে গর্তের ওপর চাপিয়ে দিতেই প্যাকেটটা পড়ল সেখানে সশব্দে। হেলিকপ্টার চলে গেল।

ছুটে বাইরে এল লক্ষ্মী। তথাগতর সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। ওই প্যাকেট তাঁর মাথার ওপর পড়লে আর দেখতে হত না। খুব ঝুঁকি নিয়েছিলেন তিনি। লক্ষ্মী প্যাকেটটা টেনে নামাল নিচে। পলিথিনের শক্ত প্যাকেটের মুখ দড়ি দিয়ে বাঁধা। গিঁট খুলতেই তা থেকে ছোট-ছোট প্যাকেট বেরুতে লাগল। চিড়ে, মুড়ি, মুড়কি, চালে ডাল মেশানো। খুব খুশি হল লক্ষ্মী। অন্তত ছ-সাত কেজির প্যাকেট ওটা। কয়েকদিন না খেয়ে থাকতে হবে না।

কিন্তু টিনটা গর্তের ওপর থেকে তুলতে ভয় করছিল তথাগতর। প্যাকেট যখন টিনের ওপর পড়েছিল তখন খানিকটা জায়গা নিচু হয়ে গিয়েছিল চাপে। একে ওই ওজন, তার ওপর অত উঁচু থেকে পড়ার কারণে তা অনেক বেড়ে গেছে।

ধীরে-ধীরে টিনটাকে সরালেন তথাগত, জল ঘোলা। টিনের যাবতীয় জং প্যাকেটের আঘাতে। জলে পড়ায় রং পালটেছে। একেবারে নিচে বালির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে পড়ে আছে ফিন।

মরে গেছে। ফিশফিশ করে বলল লক্ষ্মী কাঁধের ওপর থেকে। উবু হয়ে বসা তথাগত স্তব্ধ হয়ে গেলেন। টিনটা যদি না চাপা দিতেন তাহলে গর্তের মধ্যেই প্যাকেটটা পড়ত। সেক্ষেত্রে–।

ঝুঁকে হাত বাড়ালেন তথাগত। ধীরে-ধীরে তুলে আনলেন ফিনকে। মনে হল, লক্ষ্মী ঠিকই বলেছিল, ওকে সমুদ্রে ছেড়ে দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। বালির ওপর ফিনকে শুইয়ে দিয়ে ওর শরীরে হাত বোলাতে লাগলেন তিনি। লক্ষ করলেন যে জায়গায় ও ঢেউ-এ ধাক্কায় ওপরে উঠে এসে আঘাত পেয়েছিল সেই জায়গাটা রক্তে ভিজে গেছে। মিনিটখানেক বাদে হঠাৎ নড়ে উঠল ফিন। চমকে উঠে কোলে তুলে নিলেন তথাগত। লক্ষ্মী চিৎকার করল, বেঁচে আছে।

এবার চোখ পিটপিট করতে লাগল ফিন, তথাগত বুঝলেন টিনের চাপে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বেচারা। অদ্ভুত শব্দ বের হল ওর গলা থেকে। তারপর ওকে গর্তের একপাশে শুইয়ে দিলেন। যাতে ওর শরীরের নিচের দিকটা জলে ডুবে থাকে।

মন খারাপ হয়ে গেল। কী দরকার ছিল হেলিকপ্টারটার প্যাকেট ফেলার! তাদের জন্যে পাঠানো খাবারের চাপে মারা যাবে ফিন?

বাবু! ভাত করব? লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করল।

নাঃ। আমার খিদে নেই। ঘরে চলে এলেন তথাগত। তারপর কখনই যা করেন না, দিনের বেলায় গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন। বারংবার ফিন-এর কথা মনে আসছিল। একে কি মায়া বলে? সারাজীবন একা থেকেছেন। যত দিন মা ছিলেন সব কর্তব্য করেছেন। প্রেমেও পড়েছেন। কয়েকবার। আশ্চর্য ব্যাপার, সবই বিবাহিত মহিলার সঙ্গে। আসলে লেখালেখির জগতে স্থিতু হয়ে বসতেই চল্লিশে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার আগের সময়টা ছিল পায়ের তলায় মাটি আনার লড়াই। তখন প্রেম করার কথা ভাবতেই পারতেন না। একটি অবিবাহিত মেয়ের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক তৈরি হলে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া কর্তব্য। কিন্তু তার সেই সামর্থ না থাকায় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। তারপর যখন সক্ষম হলেন তখন আশেপাশে কেউ আর অবিবাহিতা নেই। থাকলেও তাঁরা আকর্ষণীয়া না। অথচ বিবাহিতা মহিলারা, যাঁরা স্বামী থাকতেও নিজেকে একা ভাবেন তাঁদের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারতেন না তথাগত। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলেন। এইরকম সম্পর্কের পরিণতি কখনই সুখের হতে পারে না। অন্যের সংসার ভেঙে নিজের সংসার তৈরি করলে সেটা সেই বাড়ির মতো দাঁড়াবে যার কোনও ভিত নেই। শেষপর্যন্ত সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে এসেছিলেন এখানে। এসে বেশ ছিলেন। কিন্তু ফিন তাঁকে দু-দিনেই বুঝিয়ে দিল, শুধু প্রেম নয়, মায়ার শক্তি কম জোরদার নয়।

বাবা!

চোখ ফেরালেন তথাগত। পাজামা পাঞ্জাবি ভাঁজ করে নিয়ে শাড়ি পড়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাকাতেই সে বলল, এগুলো কি ধুয়ে দেব?

না। রেখে দাও ওখানে।

লক্ষ্মী একটা টেবিলের ওপর রেখে দিল পাজামা পাঞ্জাবি।

বলরামকে বললে পারতে তোমার জন্যে একটা শাড়ি পেলে নিয়ে আসতে।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল লক্ষ্মী।

আজই বলরামকে পাঠানো ঠিক হয়নি। রাস্তা বলে তো কিছু নেই। কোথায় জিনিস পাবে কে জানে! যদি শহরে যাওয়ার চেষ্টা করে তো আজ ফিরতে পারবে না। গ্লাস শেষ করলেন তথাগত। কী আশ্চর্য! আজ দুপুরেই বেশ মেজাজ হচ্ছে।

ও বলেছে আজ নাও ফিরতে পারে।

আ! এটা ঠিক না। তোমাকে একা রেখে ও বাইরে থাকবে কেন? দ্বিতীয় পেগ গ্লাসে ঢাললেন তথাগত, জল মেশালেন।

আপনি আছেন। গেল বছর ও এক মাস আমাকে রেখে শহরে কাজের জন্যে গিয়েছিল। এখানে তো আপনার কাছে আছি।

যখন গিয়েছিল তখন তোমাদের আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই পাশে ছিল।

লক্ষ্মী শ্বাস ফেলল শব্দ করে, সবাই লোভ দেখাত। কেউ-কেউ পালাতে বলত। এখানে তো সেসব হবে না।

ঠিক আছে, মুড়কি চিড়ে যা ইচ্ছে খেয়ে বিশ্রাম করতে যাও। ওটা কি বিলিতি মদ?

হ্যাঁ।

শরীর খারাপ হবে না?

না। বড়জোর ঘুম পাবে। ঘুমিয়ে পড়ব। যাও।

লক্ষ্মী চলে গেল। তিনটে পেগ পেটে যাওয়ার পর হঠাৎই ঘুম এসে গেল। একে প্রায় খালি পেট, তার ওপর মনটাও বিগড়ে ছিল। খেতে-খেতেই ঘুমিয়ে পড়লেন চেয়ারে বসে। মাথাটা কাত হয়ে গেল একপাশে।

হঠাৎ তথাগতর মনে হল তিনি যেন শূন্যে ভাসছেন। কিন্তু সেই ঘোরটা কাটল দ্রুত। তাঁর। শরীরটাকে দু-হাতে তুলে বিছানার কাছে নিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মী। ওর শরীর থেকে জলের গন্ধ বের হচ্ছে। শ্যাওলা জমা জল। টের পেলেন তিনি। ভাবলেন ঝটপটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল তাঁর বেশ আরাম হচ্ছে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে লক্ষ্মী মুখে হাত বুলিয়ে দিল। তথাগতর শরীর শিরশির করে উঠল। তিনি বাঁ-হাত দিয়ে লক্ষ্মীর কোমর জড়িয়ে ধরলেন। ধরতেই লক্ষ্মী নুইয়ে পড়ল তাঁর পাশে। তথাগত আবার ঘুমের গভীরে তলিয়ে যেতে-যেতে পাশবালিশের মতো জড়িয়ে ধরলেন ওকে। কিন্তু কী করছেন তা তাঁর বোধে ছিল না।

ঘুম ভাঙতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলেন তথাগত। কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না লক্ষ্মী তাঁর পাশে কী করে এল। সন্তর্পণে নিজের হাত ওর শরীর থেকে তুলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন। একেবারে শিশুর ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ্মী! মদের ঘোরে তিনি কি ওকে কাছে ডেকেছিলেন! ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাহলে তো তাঁর নেশা করাই উচিত নয়। তিনি বসেছিলেন চেয়ারে, খাটে কী করে চলে এলেন? লক্ষ্মী কি তাঁকে নিয়ে এসেছে। চেয়ারে বসে তাঁকে দেখে ওর খারাপ লেগেছিল?

তথাগত বাইরে বেরিয়ে গেলেন। এখন বিকেল। সমুদ্র শান্ত। আকাশ পরিষ্কার। মনে পড়তেই গর্তের দিকে তাকালেন। নড়ছে ফিন। সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে। তিনি পাশে যেতেই অদ্ভুত মুখ করে তাকাল। হাঁটু মুড়ে বসে তথাগত জিজ্ঞাসা করলেন, কষ্ট হচ্ছে? মাথায় হাত বোলাতেই ফিন অনেকগুলো শব্দ করল। তথাগতর মনে হল বাচ্চাটা আবদার করছে। ওর প্রাণশক্তি এবং ভাগ্য খুব ভালো। নইলে দু-দুবার যে কাণ্ড ও সহ্য করেছে তা করার কথা নয়। লক্ষ্মীর কথা মনে এল। এভাবে যে বেঁচে থাকতে পেরেছে সে সমুদ্রে গেলে ঠিক নিজেকে বাঁচাতে পারবে।

ফিনকে কোলে নিয়ে নামতে লাগলেন তথাগত। টিলার ওপর থেকে বালিতে পা রেখে নামতে গিয়ে হড়কে পড়তে-পড়তে সামলালেন কোনওক্রমে। তারপর সমুদ্রের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। জোয়ার আসছে। ফিন-এর দিকে তাকালেন পরম মমতায়। তারপর জলে নেমে ফিনকে নিচু করে ধরলেন যাতে ও জলের স্পর্শ পায়। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থেকে। নড়াচড়া আরম্ভ করল ফিন। তারপর সাঁতার কেটে তথাগতর হাতের চৌহদ্দি থেকে বের হল। আবার ফিরে এল হাতের কাছে। মুখ তুলে দেখল তথাগতকে। তারপর পাক খেয়ে মিলিয়ে গেল জলের গভীরে। কষ্ট হল, খুব কষ্ট হল তথাগতর।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি জলের ভেতর। সন্ধের অন্ধকার তিরতির করে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ সমুদ্রের জলে উচ্ছাস দেখতে পেলেন। তারপরেই এক ঝাঁক ডলফিন এসে তার চারপাশে পাক খেয়ে শব্দ করে কিছু বলে যেতে লাগল। ভয় পেয়েছিলেন প্রথমে, পরে বুঝলেন, আঘাত করতে নয়, খুশিতে ওরা এমন করছে। একবার মনে হল ফিনকে ওদের মধ্যে দেখলেন, বোঝার আগেই ওরা ফিরে গেল সমুদ্রে।

বাবা, ও চলে গেল? চমকে পেছন ফিরলেন তথাগত। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে আছে বালির ওপর। চুল উড়ছে। শব্দগুলো তথাগতর বুক থেকে বেরিয়ে এল, হ্যাঁ মা, মেয়েরা তো এভাবেই চলে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress