কীসের গন্ধ বেরোচ্ছে
০১.
কীসের গন্ধ বেরোচ্ছে?
ঋক বলল।
–কই? না তো!
তৃষা বলল। ওপরে নাক তুলে।
–স্পষ্ট পাচ্ছি যে, আমি।
–কী জানি! কীসের গন্ধ!
–নিশ্চয়ই গ্যাসের। গ্যাস সিলিণ্ডার লিক করেছে।
শুনেই তৃষা লাফিয়ে উঠল বসবার ঘরের সোফা ছেড়ে। আতঙ্কিত গলায় একটি সংক্ষিপ্ত আওয়াজ করে রান্নাঘরের দিকে দৌড়োল। পরক্ষণেই বাড়ির পেছন দিকে গিয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় জোরে ডাকল, মুঙ্গলীরে! ও মুঙ্গলী।
ডেকেই তৃষার মনে পড়ল মুঙ্গলীকে তো হাটে পাঠিয়েছে; মনে পড়তেই, দৌড়ে বসার ঘরে ফিরে এসে বলল, আপনি পারেন না? ঠিক করে দিতে? ঋক?
ঋকও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছিল। অত্যন্ত লজ্জিত ও বিব্রত মুখে সে বলল, না। আমি তো স্টোভে অথবা কাঠের উনুনে রান্না করে খাই। গ্যাস সিলিন্ডারের আমি কিছুই জানি না।
এদিকে গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বাড়িময় ছড়িয়ে যাচ্ছিল। এই ছোট্ট জনপদের ডিসেম্বরের কাঁচাপথের রাশ রাশ ধুলোর গন্ধ আর বিভিন্নরঙা পুটুস ফুলের উগ্র গন্ধকে ছাপিয়ে গ্যাসের গন্ধ যেন দমবন্ধ করে দিচ্ছিল।
তৃষা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কিছু একটা করুন না! কীরকম পুরুষ মানুষ আপনি!
অপ্রস্তুত গলায় বোকার মতো ঋক বলল, কাউকে বরং ডেকে আনি বাইরে গিয়ে। আমি এসব পারি না।
–কী পারেন আপনি?
ঝাঁঝালো স্বরে বলল তৃষা।
ঠিক তক্ষুনি বাড়ির সামনের মস্ত মহুয়াগাছটার গুঁড়ি ও ডালপালার প্রতিধ্বনির সিরসিরানি তুলে নতুন অ্যাম্বাসাডর গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ করে প্রণত ঢুকল। তৃষা দৌড়ে গেল বাইরে। বলল, আর কাছে এনো না গাড়ি, রান্নাঘরে গ্যাস লিক করছে। ঋক বসে আছেন, কিন্তু উনি জানেন না কিছুই। তুমি এসো শিগগির।
সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন বন্ধ করে প্রণত গাড়িটাকে গ্যারাজের পাশে পার্ক করিয়ে দৌড়ে ভেতরে এসে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। এবং একটু পরেই বেরিয়ে এল।
বলল, কখন ফিট করে দিয়ে গেছে গ্যাস কোম্পানির লোক?
–এই তো। হবে আধঘণ্টাটাক।
–ভারি ইরেসপনসিবল তো! কমপ্লেইন করতে হবে। আর তুমিই বা কেমন? রান্নাঘরের ব্যাপার তুমি নিজেও তো একটু জানবে। মুঙ্গলী কোথায়?
–হাটে গেছে।
অপরাধীর মুখে তৃষা বলল।
–রান্না তো আমি দু-একটি পদ মাত্র করি। তাও রোজ নয়। সব-ই তো করে মুঙ্গলীই।
তা হলেও এগুলো এলিমেন্টারি জিনিস। একটুকুও না জানলে চলবে কী করে।
কী বলবে, ভেবে না পেয়ে তৃষা মুখ নামিয়ে বলল, আমি বুঝি এর আগে কোনোদিনও রান্না করেছি!
–আমার মতো সাধারণ অবস্থার মানুষকে যখন বিয়ে করেছ তখন করতে তো হবে। আস্তে আস্তে সব-ই শিখে নিতে হবে। নইলে চলবে কী করে। আজকাল রাজা-মহারাজার স্ত্রীদেরও রান্না করতে হয়।
বলেই, বিব্রত হয়ে উঠে দাঁড়ানো ঋক-এর দিকে ফিরে প্রণত বলল, বোসো ঋক। তুমি আজ হাটবারে হাটে না গিয়ে অসময়ে আমার এখানে যে!
–স্যার! আপনার টেলিফোন কি খারাপ? টেলিফোনে আপনাকে কিছুতেই কনটাক্ট করতেনা পেরেই আমাকে দিয়ে ম্যানেজার সাহেব বলে পাঠালেন যে, কলকাতা থেকে এম. ডি.আসছেন কালকে। আপনাকে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে যেতে হবে পাটনাতে। এম. ডি কে রিসিভ করতে। আমারও এখুনি ফিরে গিয়ে অ্যাকাউন্টস-ট্যাকাউন্টস সব আপ-টু ডেট করে রাখতে হবে। ব্যাকলগ জমে গেছে। আজ বোধ হয় রাত দেড়টা-দুটো হয়ে যাবে বাড়ি যেতে যেতে। আমি যাই এখন স্যার।
–ক-টায় বেরুবেন উনি?
–বলেছেন তো ভোর ছটায়। ওঁর গাড়ি করেই আপনাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবেন। এম. ডি. কলকাতা থেকে হপিংফ্লাইটে আসছেন। রাঁচি হয়ে।
–ও।
–ম্যানেজার সাহেব আরও বলেছেন যে, কালকে দুপুরে আপনি সস্ত্রীক ওঁর বাড়িতেই খাবেন। এম. ডি. ওঁর বাড়িতেই লাঞ্চ করবেন।
–আমি যাব না।
তৃষা বলল। প্রণত ও ঋক দু-জনকেই শুনিয়ে।
-কেন?
বিরক্ত গলায় শুধোল প্রণত।
আমার ভালো লাগে না। একটানা ইংরেজি বলতে হবে। হেঁ হেঁ করতে হবে।
কেন ইংরেজি বলতে কি তুমি পারো না? পারো বলেই তো তোমাদের বাড়ির সকলে বলেছিলেন। স্বামীদের চাকরির উন্নতিতে স্ত্রীদেরও একটু সাহায্যর দরকার। বিশেষ করে আজকাল।
–আমি ওসব পারি না। ভালো লাগে না।
তৃষা বলল, অপরাধীর গলায়।
–তা বললে চলবে কেন? তোমায় যেতেই হবে। ঋক, তুমিই সাড়ে বারোটা নাগাদ এসে একটা সাইকেল রিকশা ধরে তৃষাকে নিয়ে যাবে ম্যানেজার সাহেবের বাংলোতে। আমি খুব ই ব্যস্ত থাকব। তোমাকেও নিশ্চয়ই লাঞ্চ-এ বলেছেন উনি।
–না স্যার। আমাকে বলেননি। না বলেছেন ভালোই করেছেন। কোনোক্রমে আমি ডেবিট-ক্রেডিটটা সামলাই। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি, ইংরিজি-ফিংরিজি আমি তো একেবারেই বলতে পারি না। আমাদের লেভেলের কাউকেই ম্যানেজার সাহেব বলেননি।
–কিন্তু লেখো তো বেশ ভালোই। ম্যানেজারের সঙ্গেও তো কাজ চালিয়ে নাও দেখি।
–লেখা আর বলা তো এক নয় স্যার। তেমন সমাজে না মেলামেশা থাকলে, তেমন স্কুলে না পড়লে, ফটাফট ইংরিজি বলা যায় না। অভ্যেসের ব্যাপার।
–বাজে কথা। আমিও তো বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি। চেষ্টা থাকলেই শেখা যায়। তোমরা হলে টিপিক্যাল বাঙালি। সাধে বাঙালি সব জায়গাতেই পিছু হটে যাচ্ছে! অদ্ভুত তোমরা! সত্যি!
–আমি যাব স্যার?
–হ্যাঁ, এসো। শ্রীবাস্তব সাহেবকে বলে দিয়ো যে, আমি তৈরি হয়েই থাকব।
ঋক বলল, হ্যাঁ স্যার। আসি বউদি।
বলেই, দু-জনকে নমস্কার করে চলে গেল, সাইকেলের টায়ারে কাঁকুরে মাটিতে কিরকির শব্দ তুলে।
–আমার খুব খিদে পেয়েছে।
প্রণত বলল।
তৃষার মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল, গ্যাসটা একটু জ্বেলে দেবে? আমি মাংসর চপ গড়েই রেখেছি। আমি মানে, আমি আর মুঙ্গলী। এক্ষুনি ভেজে দিচ্ছি।
–গ্যাস জ্বালাটাও কি এমন কঠিন কাজ? চলো, জ্বেলে দিচ্ছি। আজকে দেখে নাও। এরপরে আর কোনোদিন বোলো না যে, পারি না।
–আমার ভয় করে। তুমি তো জানই যে, আমার মা আগুনে পুড়ে… আগুনকে বড়োভয় পাই আমি।
সব বাড়ির সব আনপড় কাজের লোক-ই গ্যাস জ্বালছে। তোমার মতো এমন ঢং কাউকেই করতে দেখিনি।
তৃষা কথা না বলে প্রণতর সঙ্গে রান্নাঘরে গেল। গ্যাসটা প্রণত জ্বেলে দিতেই ও বলল, সবাই কি সব পারে?
–সব না পারে তো কিছু তো পারে!
উত্তরে কিছু না বলে তৃষা একবার তার চোখ দুটি তুলে প্রণতর দিকে তাকাল। প্রণতর দু-চোখে বিরক্তি। যদিও ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ-মাস। তৃষা পরিষ্কার বুঝতে পারে যে, প্রণত ওকে পছন্দ করে না। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিল তৃষা। বলল, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে নাও, আমি চা আর চপ নিয়ে যাচ্ছি খাওয়ার ঘরে।
রান্নাঘর থেকেই তৃষা শুনতে পেল যে, প্রণত খুব বকছে মালিকে। চপ ছেড়েছিল সবে কড়াইয়ে। কী নিয়ে যে, বকাবকি তা ঠিক বুঝতে পারল না চপ ভাজার শব্দে। চপ ভাজা হলে, স্যালাড সাজাল একটি প্লেটে। টোম্যাটো আর চিলি-গার্লিক সস-এর শিশি দু-টি ফ্রিজ থেকে বের করে খাওয়ার ঘরের ম্যাটের ওপর সাজিয়ে ডাকল প্রণতকে। একটু পর প্রণত এসে টেবিলে বসল।
তৃষা বলল, তুমি খাও, আমি চা-টা নিয়ে আসছি।
রান্নাঘরের জানলা দিয়ে শীতের বিকেলের রোদ এসে পড়েছিল। কম্পাউণ্ড ওয়ালের পাশে বড়ো বড়ো সেগুন গাছের পাতাদের পেছন দিকে কমলা রঙা রোদ পড়ায় যেন সবুজ ধূলিধূসরিত পাতাগুলির রং পালটে গেছে। এবারের শারদীয় আনন্দবাজারে বাণী বসুর উপন্যাসে পড়েছিল কমলালেবুর রসের মতো রোদ! বা ওইরকম কিছু। ভারি ভালো লেগেছিল উপমাটি। এমন এমন বিকেলে শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন মনে পড়ে যায় তৃষার। মন খারাপ যেমন লাগে তেমন একরকমের ভালো লাগাও মনকে ছেয়ে ফেলে যেমন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনলে হয়। এসব জিনিস প্রণত বোঝে না। সকালবেলার আলো বা সন্ধে হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্ত প্রণতর মনে কোনো দাগ কাটে না। নিজের কোম্পানির কাগজপত্র এবং স্টেটসম্যান কাগজ ছাড়া প্রণত আর কিছুই পড়ে না। গান ভালোবাসে না ও। কাজকর্ম সেরে ফিরে এসেই চান করে। পটাপট কয়েকটা হুইস্কি খায়। তারপর খাবার খেয়েই শুয়ে পড়ে। তৃষা খেল কি না এবং কী খেল তা কোনোদিনও চোখ মেলে দেখেও না প্রণত, যদিও দু-জনে একসঙ্গেই খেতে বসে। প্রণত ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লে তৃষা কখনো খুব নীচুগ্রামে বিয়ের সময়ে তার সেজোমামিমার প্রেজেন্ট করা ক্যাসেট-প্লেয়ারে কোনো প্রিয় গান শোনে। কখনো-বা, চাঁদ থাকলে বারান্দার চেয়ারে বসে থাকে একা।
তৃষার যুবতী শরীরটার প্রতিও কোনো আকর্ষণ নেই প্রণতর। মনের খোঁজ তো সে রাখেই না। রাখে না একথাটা বুঝতে পেরে বড়ো অপমানিতও বোধ করে ও। ও সুন্দরী নয়, কিন্তু কুশ্রীও নয়। তা ছাড়া সকলেই বলে ওর ফিগার খুব ভালো। কিন্তু প্রণত তো, ওকে দেখেশুনেই বিয়ে করেছে। শুধু তাই নয়, মেজোমামার কাছে লম্বা তালিকাও ধরিয়ে দিয়েছিল প্রণত তৃষাকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার খেসারত দাবি করে। গডরেজের ফ্রিজ, টেলেরামার কালার টি. ভি., ডাবল বেড় খাট–সি. পি. টিক-এর, গডরেজের আলমারি, সোফাসেট, কার্পেট এবং আরও কত কী! তার ওপরে কুড়ি হাজার টাকা নগদ বউভাতের খরচ হিসেবে। এই তালিকার পেছনে প্রণতর নিজের হাত কতখানি ছিল আর তৃষার-ই সমবয়সি ছোটোমামির হাত কতখানি ছিল ও এখনও জানে না। কী একটা রহস্যর গন্ধ পায় ও সবসময়। অথচ তার তল পায় না।
এসব কথা আগে জানলে এ বিয়েতে রাজিই হত না তৃষা। ও তো পণ্য নয় যে, তাকে ঘর বদলাতে দাম দিতে হবে! যে-শিক্ষিত পুরুষ কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার বদলে টাকা দাবি করে, বউভাতে ঘটা করে আত্মীয়-বন্ধু খাওয়ানোর খরচ দাবি করে মেয়ের বাড়ি থেকে, তার শিক্ষা বলে আদৌ কিছু আছে বলে মনে করে না তৃষা। প্রণত ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে কিন্তু শিশুকাল থেকে তৃষা শিক্ষা বলতে যা-কিছুকেই জেনে এসেছে তার ছিটে ফোঁটাও দেখে না প্রণতর মধ্যে। অন্তত এই ছ-মাসে দেখেনি। প্রণত নিজেকে ইচ্ছে করে লুকিয়ে রাখলে আলাদা কথা।
তৃষার বাবা যখন মারা যান তখন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তৃষার বয়স পাঁচ। মামারা ওকে আর ওর মাকে যত্ন করে নিয়ে এসে তাঁদের কাছেই রাখেন। আদর-যত্ন স্বাচ্ছল্যর অভাব ছিল না বড়োলোক এবং উদার মামাদের আশ্রয়ে। কিন্তু তাদের দাবি বলতেও কিছু ছিল না। দয়াপ্রার্থীই ছিল তারা মানে তৃষা ও তৃষার মা। বিয়ের আগে অনেক আকাশ-কুসুম কল্পনা করেছিল যে, বিয়ে হলে স্বামীই হবে তার জোর খাটাবার মানুষ। তার সব আবদারের, আহ্লাদের দাবির মানুষ।
তৃষার মা দু-বছর আগে হঠাৎ রান্নাঘরে আগুনে পুড়ে মারা যান। আর কেউ জানুক আর না জানুক তৃষা জানে যে, ছোটোমামির ব্যবহার-ই মাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল। মায়ের মৃত্যুর পর-ই মামা-মামিরা তৃষার বিয়ে দিতে খুব-ই ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
বিশেষ করে ছোটোমামা-ছোটোমামি। বিপত্নীক মেজোমামাকে এতসব কথা বলা যেত না। এ বিয়েতে তৃষার রাজি হওয়াটাও একধরনের আত্মহত্যাই বলা চলে। ওর না-তেমন পছন্দ হয়েছিল প্রণতর চেহারা, না কথাবার্তা। কিন্তু ছোটোমামির জন্যে মামাবাড়িতে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
–কই? চা কি হল?
হঠাৎ প্রণতর ডাকে চমকে উঠল তৃষা। বলল, যাই। ও এরকম-ই। সংসার করার সম্পূর্ণ অযোগ্য।
চা নিয়ে গিয়ে বলল, আর চপ লাগবে তোমার? নিয়ে আসি?
–লাগত। যদি সময়মতো জিজ্ঞেস করতে? এখন আর লাগবে না।
–‘তুমিও তো চাইতে পারতে, শুধুই আমাকে গালমন্দ করার সুযোগ খোঁজো তুমি!
মনে মনে বলল তৃষা। কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। নিজের জন্যেও এককাপ চা ঢালল প্রণতকে দেওয়ার পর। দুধ-চিনি মিশিয়ে নিয়ে বারান্দায় এসে বসল।
পথ দিয়ে সাইকেল-রিকশা যাওয়ার আওয়াজ হচ্ছিল ক্রিং ক্রিং করে। লোহার গেটটা টিনের পাত দিয়ে ঢাকা। বাইরের চলমান পৃথিবীর কিছুই দেখা যায় না ভেতর থেকে। শুধু শোনা যায় মাত্র। দূরে কারা যেন মাইকে গান বাজাচ্ছে! কিশোরকুমারের গান। গান শুনতে শুনতে চা-টা শেষ করল তৃষা।
জামাকাপড় পরে এসে প্রণত বলল, আমি একটু বেরুচ্ছি। আজ তাস খেলার নেমন্তন্ন আছে সুরদের বাড়িতে। সেখানেই খেয়ে আসব। তুমি কি যাবে?
–না। তোমরা মদ খাবে, সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার করবে আর তাস খেলবে। আমি গিয়ে কী করব?
–মডার্ন মেয়ে। তাস খেলতেও জানে না? ভাবাই যায় না। তোমার মামারা তোমাকে যে, কী শিখিয়েছিলেন তা তাঁরাই জানেন। বিয়ের জন্যে কিছুটা প্রস্তুতি লাগে। এরকম থরোলি আনপ্রিপেয়ার্ড ব্রাইডের কথা ভাবা পর্যন্ত যায় না।
তৃষা কথা না বলে বাইরে চেয়ে বসে রইল। প্রণতর অ্যাম্বাসাডর ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। গেটটা একমুহূতাঁর জন্যে খুলল মালি। পথটা চোখে পড়ল একঝলক। কতরকম মানুষ, দোকান, যানবাহন। পরমুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল গেট। গেটটা টিনের পাত দিয়ে বন্ধ করা না থাকলে তাও সময় কেটে যেত তৃষার গেটের দিকে চেয়েই।
তৃষা ভাবছিল, প্রণতর নাম কে রেখেছিলেন জানে না ও, তবে নামটি প্রণত না হয়ে উদ্ধত হলেই মানাত বেশি।
প্রণত চলে যেতেই মুঙ্গলী এসে ঢুকল। খুব সেজেছে ও আজকে। হাট থাকলেই সাজে। জবজবে করে তেল মেখেছে! গাঢ় লাল রঙের ব্লাউজের সঙ্গে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরেছে। রুচিশীল চোখে ধাক্কা লাগে। কিন্তু মুঙ্গলী যাদের জন্যে সাজে তারা হয়তো এইরকম সাজ পোশাক-ইপছন্দ করে।
মুঙ্গলী হাসল। বলল, তোমার জন্যে বগারী পাখি এনেছি। এখন খাবে? না রাতে?
তৃষা বলল, খাব না। তোর সাহেবকে দিস। সে ভালোবাসে। রাতে এবং কাল দুপুরেও সাহেবের নেমন্তন্ন। কাল রাতে রোস্ট করে দিস।
মুঙ্গলী চলে গেলে তৃষা ভাবছিল কেন যে, পাখিগুলো খায় মানুষে। ক্ষুদে ক্ষুদে পাখি। বর্ষার সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো দ্রুতগতিতে এ গাছ থেকে ও গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায়। মানুষের খিদে বড়ো আগ্রাসী হয়ে গেছে। এই লোভের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে শিগগিরই। হাটে জ্যান্ত পাখি সামনে মেরে ভেজে দেয় আর গবগ করে খায় লোকে।
সন্ধে হয়ে যাবে একটু পর-ই। মনটা বড়ো খারাপ লাগছিল তৃষার। ওর মন খারাপ-ই থাকে। আজকে যেন বেশি খারাপ লাগছে। সংসারে যার আপনজন বলতে কেউই নেই সেই শুধু জানে মন খারাপের এই রকমটি।
খস খস করে রুক্ষ পায়ের আওয়াজ করে মালি এল। যেন মাটি ফুড়েই উঠল। চমকে গেল তৃষা। কোন দিক দিয়ে এল কে জানে!
-কী ব্যাপার?
–সাহেব বড়ো বকাবকি করলেন আমাকে।
–হ্যাঁ। রান্নাঘর থেকে শুনছিলাম বটে! কিন্তু বুঝিনি। কেন?
–আপনি ওই জংলি পালশগাছগুলো কাটতে বারণ করেছিলেন।
–হ্যাঁ। করেই তো ছিলাম। ডিসেম্বর শেষ হতে চলল, মার্চের গোড়া থেকেই ফুল আসবে গাছগুলোতে। লালে লাল হয়ে যাবে কম্পাউণ্ড। তুমিই তো বলেছিলে মালি।
–বলে তো ছিলাম-ই মেমসাহেব। আপনারা তো এ বাড়িতে এসেছেন মাত্র তিনমাস। আর আমি তদারকি করছি ত্রিশ বছর। আমি জানি না তো কে জানে? জনস্টন সাহেব আর মেমসাহেবও খুব ভালোবাসতেন তাই রেখে দিয়েছিলেন কম্পাউণ্ডের দেওয়ালের পাশের গাছগুলোকে। কত বড়ো হয়ে গেছে গাছগুলো।
–তা তোমার সাহেব বকলেন কেন?
–সাহেব বলেছেন, এই রবিবারের মধ্যেই তোক এনে সব জংলি পলাশ কেটে ফেলতে হবে। সাহেব ওখানে চাষ করে আলু, বেগুন আর তামাকপাতা লাগাবেন।
–তামাকপাতা?
-হ্যাঁ, মেমসাহেব। সাহেব কাগজ পাকিয়ে সিগারেট খান না। নিজের চাষের তামাক এবার থেকে পাকিয়ে খাবেন।
–তাই?
অন্যমনস্ক গলায় বলল তৃষা।
তারপর বলল, আমার জন্যে তোমায় বকুনি খেতে হল মালি। আমি খুব দুঃখিত। তোমার সাহেবের বাড়ি, সাহেব তোমার মনিব, সাহেব যা বলেন তুমি তাই করবে। আমি আর কিছু কখনো বলব না তোমাকে।
আমাকে মাপ করে দেবেন মেমসাহেব।
মালি বলল মাথা নীচু করে।
–না, না। তুমিই আমাকে মাপ করে দিয়ো।
.
০২.
ভোর ছ-টাতে বেরিয়ে গেছিল প্রণত। চা করেছিল মুঙ্গলীই। তৃষা তার আগেই উঠেছিল। দরজা অবধি পৌঁছেও দিয়েছিল প্রণতকে। তবে দরজার আড়ালেই ছিল। বারান্দাতে আসেনি। ম্যানেজার শ্রীবাস্তব সাহেবের চোখের চাউনিটা মোটেই ভালো লাগে না তৃষার। মেয়েদের চোখ ঠিক-ই বোঝে। কিছু পুরুষ থাকে-না, যারা চোখ দিয়ে মেয়েদের চেটে খায়, লোকটা সেই শ্রেণির। বদমাইশ ব্যাচেলার। প্রণতর সঙ্গে এই লোকটার কোম্পানির সম্পর্ক ছাড়াও আরও কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় তৃষার। সদ্য-বিবাহিতা স্ত্রীর শরীরের প্রতিও এমন অনাসক্তি কোনো পুরুষের স্বাভাবিকতার মধ্যে পড়ে না। তৃষা, ব্যাপারটা ঠিক কী তা বুঝতে পারে না। তবে অনুমান করতে পারে। অস্পষ্ট অনুমান। অতিস্বল্পবার-ই প্রণত বিয়ের পরে । ওকে আদর করেছিল। তার স্মৃতিও আদৌ সুখাবহ নয়। বরং কৈশোর থেকে সুন্দর সব নানা। রঙিন কল্পনায় রাঙা এই ব্যাপারটি ওর কাছে রীতিমতো ভীতিজনক-ই হয়ে উঠেছে। প্রণতকে সেইসব মুহূর্তে মনে হয়েছে কোনো জঘন্য দস্যু। তৃষাকে প্রণত সেই হৃদয়হীন, রোমান্টি। কতাহীন একটি যন্ত্রর-ই মতো কামড়ে ছিঁড়ে ধর্ষণ-ই করেছে। সেই প্রক্রিয়াতে একফোঁটাও ভালোবাসা ছিল না একবারও। ভালোবাসার কথা মাইকে ঘোষণা করতে হয় না। কুকুর বেড়ালও চোখ দেখে, ভাব দেখে তা বোঝে। তাই, ভালোবাসা যে, এই সম্পর্কে একটুও নেই, তা তৃষা নিঃসন্দেহে বুঝে গেছে! কিন্তু বোঝেনি ভালোবাসার বদলে আর কী আছে। প্রণতর তাকে বিয়ে করার পেছনে ঠিক কোন উদ্দেশ্য ছিল– সেটাই স্পষ্ট হয়নি এখনও তৃষার কাছে! বড়ো ভয়ে ভয়ে দিন কাটে তার। ছোটোমামিই আগ বাড়িয়ে এই সম্বন্ধ । এনেছিল। অনেকদিন থেকেই নাকি চিনত প্ৰণতকে। এই চেনার রকমটাও ঠিক জানে না তৃষা।
সকালের কাজকর্ম সেরে রোজ যে-সময়ে স্নান করে সেই সময়েই স্নান করেছিল। বিয়েতে অনেক বই পেয়েছিল তৃষা। তারমধ্যে আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতিও ছিল। কয়েকদিন হল পড়া আরম্ভ করেছে। ভারি ভালো লাগছে। স্নান করে উঠে ভিজে চুল ঝকঝকে রোদে মেলে দিয়ে বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে বইটি পড়ছিল এমন সময়ে গেট খুলে একটি সাইকেল ঢুকল। কিরকির শব্দ হল কাঁকুরে মাটিতে। বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে, ঋক।
ঋক রায় প্রায় তৃষার সমবয়সিই হবে। প্রণতর চেয়ে তিন-চার বছরের ছোটো। ভারি লাজুক প্রকৃতির মানুষ ঋক। তবে সেই লজ্জা প্রায়-ই হীনম্মন্যতার দরজায় পৌঁছে যায় এবং যখন তা পৌঁছোয় তখন ঋককে অত্যন্ত অপছন্দ করে তৃষা। প্রণতদের অফিসের বেয়ারা, রামখেলাওন ছাড়া একমাত্র ঋকের-ই যাওয়া-আসা আছে প্রণতর বাড়িতে। তাও কাজ বা খবর নিয়েই আসে, যখন আসে। তৃষার সঙ্গে ঋকের ব্যবহারে তৃষা খুব মজা পায়। বিলক্ষণ বোঝে যে, কোনো দুজ্ঞেয় কারণে ঋক তৃষাকে খুবই পছন্দ করে।
–আসুন!
তৃষা বলল।
–যাবেন না বউদি? তৈরি হননি এখনও?
–ক-টা বাজে? ভালো বই হাতে পেলে আমার সময়জ্ঞান থাকে না।
–বাজে এগারোটা। কী বই?
–প্রথম প্রতিশ্রুতি। আশাপূর্ণা দেবীর।
–আপনার পড়া হয়ে গেলে আমাকে দেবেন।
-–দেব। কিন্তু আপনার তো সাড়ে বারোটায় আসার কথা ছিল। তাই না?
–হ্যাঁ। কিন্তু এম. ডি-র ইন্সপেকশান শেষ হয়ে যেতেই এম. ডি. এবং স্যারেরা সবাই শ্রীবাস্তব সাহেব মানে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে চলে গেলেন। শুনতে পেলাম, আসলে ইনস্পেকশন একটা ছুতোেমাত্র। আমাদের মাদ্রাজি এম, ডি. এসেছেন ওঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে। রাতটা কাটিয়ে কাল-ই চলে যাবেন কলকাতা। বাঁচা গেল। যা টেনশানে ছিলাম!
–আপনি কোন সময়ে টেনশানে থাকেন না?
–তা ঠিক।
–প্রণত কি আমাকে এখুনি যেতে বলেছে?
–না। ঠিক তা নয়। আমি ভাবলাম ইন্সপেকশন-ই যখন হয়ে গেল তখন একটু আগে। আগেই যাই।
তৃষা ঋকের চোখে চোখ রেখে বলল, কেন?
–মানে, এমনিই! যদি আপনি আগে যেতে চান তাহলে আগেই নিয়ে যাব। নইলে…
–নইলে কী? আমি যদি না যাই?
–অ্যাইরে! না-গেলে তো আমার-ই গিয়ে স্যারকে খবর দিতে হবে।
তৃষা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বলল, আপনি বসুন। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। কিছু খাবেন? চা বা কফি!
–না, না। অফিসে একটু আগেই কফি খেয়েছি।
তৈরি হতে হতেই তৃষা মুঙ্গলীকে ডেকে বলল মালিকে একটা রিকশা ডাকতে বলতে।
রিকশাও এল তৃষাও তৈরি হয়ে বেরোল।
ঋক বলল, আপনি রিকশাতে উঠুন আমি আপনার আগে সাইকেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।
–সে কী? আমি তো গভর্নর নই যে, আমার আগে আগে পাইলট-এর দরকার। তা ছাড়া প্রণত তো আপনাকে সাইকেল-রিকশা করেই আমাকে নিয়ে যেতে বলেছিল। তাই-না?
–তা ঠিক। তবে আমার সাইকেল?
–গ্যারাজের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখুন। মালির কোয়ার্টার পাশেই। বাড়ির ভেতর থেকে চুরি হবে না। ভয় নেই।
রিকশাতে তৃষা উঠে বসলে ঋক বলল, দু-জনে আঁটবে?
তৃষার দু-চোখে চকিত কৌতুক ঝিলিক মেরে গেল। বলল, সব রিকশাতেই তো দু-জন করেই যায় লোকে। উঠে আসুন।
যতখানি সম্ভব তৃষার ছোঁয়া বাঁচাবার চেষ্টা করেই একপাশে বেঁকে বসল ঋক। তবুও ছোঁয়া বাঁচানো গেল না। তৃষার স্নান-করে-ওঠা শরীরের ছোঁয়া এবং পারফিউমের গন্ধে বেচারি ঋক বেশ বেসামাল হয়ে পড়ল।
তৃষা বলল, আপনার বাড়ি কোনদিকে? রিকশাওয়ালাকে বলে দিন।
–সুরাইয়াগঞ্জে। কিন্তু আমার বাড়ি কেন?
–কতদূর? লাগবে কতক্ষণ? যেতে?
–সাইকেল-রিকশাতে পনেরো-কুড়ি মিনিট।
–আপনার বাড়ির দিকেই যেতে বলুন।
–কী-কী-কী বলছেন? কেন?
–এমনিই! এতআগে ওখানে গিয়ে কী করব?
–স্যার রাগ করবেন না?
-কার ওপর?
–আপনার ওপর না হোক আমার ওপর। –সে আপনার স্যার-ই জানেন। আমি কী করে বলব বলুন?
–ও।
অস্বস্তির গলায় বলল ঋক।
–আপনার কি খুব-ই কষ্ট হচ্ছে আমার পাশে বসে যেতে? অমন হাঁসফাঁস করছেন কেন?
–না-না-না। সেকথা বলছি না। বলছি, এমন তো কথা ছিল না!
–আমার বাড়িতে যে, আমি একা থাকি।
–তা তো জানিই। নইলে কী আর স্টোভে রান্না করে খান!
–আপনি জানেন? ও হ্যাঁ, আমিই তো স্টোভে রান্না করার কথা কাল বলেছিলাম।
–মনে পড়েছে? আপনি মানুষটা বড়োভুলো মনের।
–হ্যাঁ, আমার মা তাই বলতেন বটে!
–বলতেন মানে? মা নেই?
–না। মা-বাবা-কেউই নেই।
ঋক বলল।
–তাই?
–হ্যাঁ।
তারপর একটু চুপচাপ। সাইকেল-রিকশার চেইনের শব্দ। অন্য সাইকেল-রিকশা এবং সাইকেলের শব্দ। লোকজনের কথাবার্তার টুকরো-টাকরা।
–আমার বাড়িতে কী দেখতে যাচ্ছেন?
-–আপনার পরিবেশ। একজন মানুষকে পুরোপুরি জানতে হলে মানুষটির রুচি, তার বাড়িঘর, তার পরিবেশ সম্বন্ধেও তো জানতে হবে।
–আমাকে পুরোপুরি জেনে আপনার কী লাভ? তা ছাড়া আমি যে, মাইনে পাই তাতে আমার পক্ষে যে, খুব ভালো করে থাকা সম্ভব নয়, তা তো আপনি ভালোই জানেন। আপনার বাড়িতে যা-আছে আমার তার কিছুমাত্র নেই।
–জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। তবে আপনার বাড়িতে হয়তো কিছু আছে যা, আমার বাড়িতে একেবারেই নেই। কে বলতে পারে?
–কেন যে, যাচ্ছেন?
অস্বস্তিভরা গলায় বলল ঋক।
–এমনিই….।
–বেশ।
রিকশাওয়ালাকে আগেই পথ বলে দিয়েছিল ও। একটা বাঁক নিয়েই রিকশাটা একটি নির্জন পথে পড়ল। সেপথে পড়েই মনে হল মুরাদগঞ্জের সঙ্গে এই সুরাইয়াটোলির কোনো যোগাযোগ-ইনেই। দু-পাশে বড়ো বড়ো মহুয়া আর শিমুলগাছ। ঝাঁটি জঙ্গল। খোওয়াই। পথের বাঁ-দিকটা ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে।
তৃষা বলল, বা :। নদী আছে বুঝি বাঁদিকে?
–হ্যাঁ। আর বাড়ির পেছনের বারান্দাতে বসলে একেবারে কাছেই নদী। ভারি সুন্দর। কালো পাথরের, লালমাটির আর সবুজ জঙ্গলের মধ্যে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে।
–নাম কী নদীর?
–হুরি-নালা।
–‘হুরি মানে কী?
–পরি-উরি হবে হয়তো। কথায় বলে না? হুরি-পরি।
–বলে বুঝি? কখনো শুনিনি।
–ওই যে, ঘন শালজঙ্গল দেখছেন সামনে, তারইমধ্যে আমার বাড়ি।
–নিজের নাকি?
হাসল ঋক। না, না। ভাড়াবাড়ি। আসলে এক জমিদারের ভান্ডার ছিল একসময়। শরিকে শরিকে ঝগড়াতে এখন জমিদারেরা ফকির হয়ে গেছে। এক শরিক এই ভান্ডারটি ভাড়া দিয়েছেন আমাকে। সব-ই ভালো শুধু ইলেকট্রিসিটি-ই নেই।
–গরমের সময়ে কী করেন?
–গরমের সময়ে দুপুরবেলা তো অফিসেই কেটে যায় সপ্তাহে ছ-দিন। যখন ফিরি তখন আর গরম থাকে না। তা ছাড়া খুব পুরুমাটির দেওয়াল তো! গরম এবং শীতও এমনিতেই কম লাগে। গরমকালে মনে হয় এয়ারকণ্ডিশানড আর শীতকালে মনে হয় সেন্ট্রালি হিটেড।
–রাতের বেলা ভয় করে না?
–কীসের ভয়? আমার কী আছে হারাবার মতো? কোন চোর সিঁদ কাটবে আমার ঘরে? যা সামান্য সঞ্চয় তা তো ব্যাঙ্কেই থাকে।
-–চোর সিঁদ কাটবে কী কাটবে না, তা কে বলতে পারে? চোরেরও তো নানারকম হয়।
–কোনো চোরের-ই আমার ঘর থেকে কিছু নেওয়ার নেই।
–সেকথা তো চোরেরাই জানবে। আপনি-আমি জানব কী করে?
শীতের দুপুরের গায়ের একটি নিজস্ব গন্ধ আছে। কাঁচাপথের ধুলোর গন্ধ, শালবনের গন্ধ, নদীর গন্ধ আর মধ্যদিনের রোদের গন্ধ মিলেমিশে যাওয়ায় কেমন এক আচ্ছন্নতা বোধ করছিল তৃষা।
সাইকেল-রিকশাটাকে দাঁড় করিয়ে রাখল ঋক। বলল, বকশিশ দিয়ে দেব। তারপর নিজে নামতে নামতে বলল নামুন। এখানে এই এক মুশকিল। ওই মোড় অবধি হেঁটে না গেলে সাইকেল-রিকশা পাওয়া যায় না। সাইকেল থাকলে অবশ্য কোনো অসুবিধে নেই।
–বাঃ। কী শান্তি এই জায়গাটাতে! ওটা কী পাখি ডাকছে?
কান খাড়া করে শুনল ঋক। তারপর বলল, আমি জানি না। রাম সিং বলছিল, কালি তিতির। মানে ব্ল্যাক-প্যাট্রিজ।
–সে আবার কী?
–পাখি-ই একরকমের। আমরা আর ক-টি পাখি চিনি।
–মানুষ-ই বা ক-টি চিনি।
তৃষা বলল।
–তা ঠিক। আসুন এইদিকে।
–রাম সিং কে?
–রাম সিং নদীর ওপারে মাইলখানেক দূরের এক গ্রামে থাকে। খেতি-জমিন আছে। ও মাঝে মাঝেই আমার কাছে থেকে যায় রাতটা। কতকিছুর গল্প করে। কত-কী জানে রাম সিং। গ্রামের মানুষেরাই কিন্তু আসল দেশ। আমরা শহরের মানুষেরা দেশের কোনো খবর-ই রাখি না। আমাদের কোনো শেকড় নেই। আমি তো ভাবছি আর মাস ছয়েক চাকরি করার পর রাম সিং-এর গ্রামে গিয়ে আমিও খেতি-জমিন করব। পরের টাকার হিসেব রাখার চেয়ে নিজের হাতে বাজরা, কুলথি, পালং শাক, মুলো জন্মানো অনেক আনন্দের। তা ছাড়া আমার প্রয়োজনও তো সামান্যই। প্রয়োজন হচ্ছে আগুনের মতো। ঘৃতাহুতি দিলেই বাড়ে। আর বাড়ানোর কি শেষ আছে? বলুন?
–তা ঠিক।
তৃষা বলল।
ঋক শালকাঠের এবড়ো-খেবড়ো দরজার তালা খুলল। এ পাশে দু-টি আর ও পাশে দু-টি মাটির ঘর। ভেতরে উঠোন। কুয়ো।
পেছনের দিকের একটি দরজা দিয়ে পেছনের বারান্দার নিয়ে গেল তৃষাকে ঋক। হুরি নালা নদীটি সত্যিই ছবির মতো। মাছ ধরছে কারা যেন। ছোটো ছোটো খেপলা জাল মাথার ওপর ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে জলে। একজোড়া মাছরাঙা নদীপারের বাজ-পড়া শিমুলের ডাল থেকে ছোঁ মেরে মেরে কুচো মাছ ধরছে নদী থেকে।
ঋক বলল, আসলে বাড়ির চারদিকেই বারান্দা। তার ওপরে মাটির ছাদ। শীতে গ্রীষ্মে দিক বদলাই। সূর্যের যে, অয়নপথ বলে একটা ব্যাপার আছে তা এই বাড়িতে না থাকলে এমন করে বুঝতে পারতাম না কখনোই। আমাদের ছেলেবেলার শ্যামবাজারের গলির সঙ্গে তো সূর্যর খুব একটা ভাব ছিল না!
বাঃ। তৃষা বলল, আপনমনেই।
তারপর বলল, এবারে আপনার ঘর দেখি।
ঘরটা একটু অন্ধকার। তবে জানলাগুলি খুলে দিতেই সব পরিষ্কার হল। দেওয়ালের বড়ো বড়ো কুলুঙ্গিতে ঠাসা বই। বিভিন্ন বিষয়ের বই। তবে কবিতা ও উপন্যাস-ই বেশি। ইংরিজি বইও খুব কম নেই।
–আপনি তো খুব খারাপ লোক। এত বই আপনার আর একটিও পড়তে দেননি কখনো আমাকে! অথচ আমার কাছ থেকে কত বই নিয়ে এসেছেন পড়তে।
ঋক হাসল। ঋকের যে, দু-টি গজদন্ত আছে এবং হাসলে যে, তাকে ভারি সুন্দর দেখায় তা আগে জানত না তৃষা। আসলে ঋককে কখনো হাসতেই দেখেনি এর আগে।
তৃষা বলল, আপনার বাড়িতে খাওয়ার মতো কিছু আছে? এতভালো লাগছে আমার যে, আজ আর শ্রীবাস্তব সাহেবের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই দুপুরটা কাটিয়ে দিই।
–সর্বনাশ! আমার চাকরি খেয়ে নেবেন ম্যানেজার। স্যারও ছেড়ে দেবেন না। তা ছাড়া মেয়েদের ব্যাপারে দায়িত্ব অনেক। দোষ হলে আমার-ই হবে। আপনাকে কেউ দোষী করবেন না।
এবার তৃষা হাসল।
বলল, সত্যি দোষ তো আপনার নেই-ই কিছু। যদি মিথ্যে দোষ কেউ চাপিয়ে দেয় তা নিতেও এত ভয়?
–বাঙালির ছেলে বউদি! চাকরি যাওয়ার ভয় যে, বাঘের ভয়ের চেয়েও বেশি। চাকরিটা চলে গেলে নতুন চাকরি জোটাতে লেগে যাবে অনেকদিন। তা ছাড়া আদৌ জুটবে কি না কে জানে?
–জুটবে না কেন? আপনি তো কাজ জানেন।
–কাজ নিশ্চয়ই জানি। কিন্তু কাজ জানার সঙ্গে চাকরি পাওয়ার খুব একটা সম্পর্ক আছে। কি এ দেশে?
–প্রাইভেট সেক্টরে এখনও আছে।
তৃষা বলল।
–তবু, জানাশোনা, কানেকশান ছাড়া কিছুই হয় না।
–আপনি এই চাকরি যদি সত্যিই ছেড়ে দিতে চান তো আমাকে বলবেন। আমার সেজোমামাকে যদি আমি লিখি, তো সেজোমামা এখানেই অন্য চাকরি ঠিক করে দেবেন। কলকাতাতে চান তো কলকাতাতেও।
–আপনার সেজোমামার নাম কী?
–গোপেন মিত্তির।
–বাবাঃ! তিনি তো ভীষণ পাওয়ারফুল লোক। এখানে মস্ত কোম্পানি, রবার্টসন কোম্পানিরও তো, তিনি ডিরেক্টর শুনেছি। খুব-ই ভালো কথা। তবে ঈশ্বর করুন কারও কাছেই কোনো করুণা যেন চাইতে না হয়।
–ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন আপনি? আপনার বয়সি কোনো মানুষ-ই তো করেন না আজকাল।
–মূর্খ ও দাম্ভিক লোক সংসারে চিরদিন-ই ছিল। ঈশ্বরে বিশ্বাসের আবার এখন-তখন কী? সকলের পক্ষে তো সব উচ্চতাতে ওঠা সম্ভব নয়। ঈশ্বরবোধ তো সকলের মধ্যে থাকার কথা নয়।
–যাক গে। আপনি কী খাওয়াবেন বলুন?
–এক্ষুনি ফাস্ট ক্লাস চিড়েভাজা করে দিচ্ছি, কড়াইশুটি আর শুকনো লঙ্কা ভাজা দিয়ে চিনেবাদামও দেব। সঙ্গে ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ আর দুধ দিয়ে ওমলেট। আমি খুব খাঁটি দুধ পাই। রাম সিং ওর গ্রাম থেকে দিয়ে যায়। তবে বর্ষাকালে নদী পেরুনো যখন মুশকিল হয় তখন একটু অসুবিধে হয় অবশ্য।
বিস্ময়ের গলায় তৃষা বলল, আপনি সত্যিই এতসব রান্না করতে পারেন?
গজদন্তে ঝিলিক তুলে খিলখিল করে হেসে উঠে ঋক বলল, এগুলো আবার রান্নার মধ্যে পড়ে নাকি? আপনারা যে, কত কী রান্না জানেন?
-–আমি?
লজ্জিত গলায় বলল তৃষা।
–হ্যাঁ। আপনি। মুখে যাই বলুন কে বিশ্বাস করছে। রান্না যে, মেয়েদের মস্ত গুণ! সে আর আমি কী বলব?
লজ্জার শেষ থাকল না আর তৃষার। কিছু বলতে গিয়ে, কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে গেল।
ঋক বলল, আপনি শুধু আমার চাকরিটা বাঁচাবেন। দেখুন, এক্ষুনি স্টোভ ধরিয়ে আপনাকে কেমন খাবার করে দিচ্ছি। সঙ্গে গোরখপুরি চা-ও খাওয়াব।
–সেটা আবার কী চা?
-–এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা সব দিয়ে। খেয়েই দেখুন না।
তৃষা এবারে হতভম্ব হয়ে গেল।
রিকশাওয়ালা পথ থেকে ক্রমাগত ঘণ্টি বাজাতে লাগল।
ঋক বলল, এক সেকেণ্ড দাঁড়ান। ওকে শান্ত করে আসি।
বলেই, চলে গেল।
ঋক চলে যেতেই, ওর লেখাপড়ার টেবিলে ঝুঁকে পড়ে দেখল তৃষা। দু-টি ফ্রেমে বাঁধানো ফোটো। একটিতে বর্ষীয়ান-বর্ষীয়সী ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার ফোটো। সম্ভবত ঋক-এর মা বাবার। অন্যটি অতিসুন্দরী একটি মেয়ের। সেই প্রায়ান্ধকার ঘরের স্বল্পআলোতেও মেয়েটিকে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও রূপসি বলে চিনতে ভুল হল না তৃষার। হঠাৎ-ই ওর মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। মনে হল কী করছে ও এখানে? শ্রীবাস্তব সাহেবের বাড়ি না গিয়ে ও এখানে কী করতে এল? কীসের খোঁজে? কীসের লোভে? পাখিরা সব জোড়ায় থাকে। তাদের কারও নীড়েই অন্য পাখির জায়গা নেই। যার যার নীড়ে ঠোকরা-টুকরি, কামড়া-কামড়ি করে অথবা গভীর সুখের নিশ্বাসের নিঃস্বনেই দিন কাটাতে হয়। যার যেমন কপাল। ঋকের চাকরির আগে ওর নিজের-ই একটা চাকরির খুব-ই দরকার। স্বাবলম্বী না হতে পারলে এবং ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন না, হয় তবে এখনও এদেশের মেয়েদের ভারবাহী জানোয়ারের মতোই দিন কাটাতে হয়। সেরকম জীবন ও সইবে না, বইবেও না। ও বুঝে গেছে যে, প্রণতর সঙ্গে তার থাকা হবে না। তার পক্ষে মামাবাড়িতে ফেরার পথও নেই! মা-বাবা, দাদা-বউদি থাকলেও কথা ছিল। তাও আজকাল মা-বাবা ছাড়া আর কারও আশ্রয়েই ফেরা যায় না। অন্যরা সকলেই বোঝা মনে করে। কিছু একটা করতেই হবে তৃষাকে।
চিঁড়েভাজা ওমলেট এবং চা খেয়ে যখন ওরা আবার বেরোল তখন ভরদুপুর। শালগাছেদের ছায়া তাদের পায়ের কাছে মেয়েদের শাড়ির ফলস-এর মতো পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পর থেকেই তারা প্রলম্বিত হতে হতে দীর্ঘ হয়ে উঠবে। কাঁচাবোদ কমলালেবুর রসের মতো হবে। আঠা আঠা। তারপর অন্ধকার এসে সেই আঠাকে শুষে নেবে।
সাইকেল-রিকশাটা চলছে ক্যাঁচোর কোঁচোর। এবারে ঋক আর তত আড়ষ্ট নেই। বরং তৃষার ঊরুর সঙ্গে ওর উরু এখন ছুঁয়ে রয়েছে। এই শীতের দুপুরে অন্য শরীরের মোড়কভরা উষ্ণতা বেশ এক ভালোলাগা এনে দিয়েছে তৃষার বুকে। নববিবাহিত স্বামীর নগ্ন শরীরের ছোঁয়াতেও এমন সিরসির করে না ওর শরীর। কে জানে! কেন এমন হয়। কাউকে ভালো লাগে আর কাউকে লাগে না। কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারণ যে, মিশে থাকে এই ভালোলাগা-না লাগার মধ্যে বিশ্লেষণ করার সময় বা ধৈর্য তৃষার নেই। হয়তো ক্ষমতাও নেই।
–কী বলবেন স্যারকে? স্যার কিন্তু খুব রাগ করবেন।
হঠাৎ বলল ঋক।
–আপনার স্যার তো সবসময়েই রেগে আছেন। আজ দেখি সেই রাগ তুঙ্গে উঠলে কেমন হয়? মৃদু হেসে বলল তৃষা।
–আমার ভয় করে। যদি আমার ওপর রেগে যান।
–আপনি কীরকম পুরুষ মানুষ। নিজের ওপর বিশ্বাস নেই কেন? আপনার সমস্ত জীবন ই কি আপনার স্যারের রাগ এবং মর্জির ওপর নির্ভর করছে। এমনভাবে বেঁচে লাভ কী?
–তা ঠিক। বেঁচে কি আর আমরা আছি? বেশিরভাগ মানুষ-ই শুধু তার জীবিকাকেই আঁকড়ে আছে এটুলি পোকার মত। যদি কেউ দু-আঙুলে জোর করে তুলে ফেলে দেয় তাহলেই শেষ। উপোষ করে মরার ভয়ে জীবিকা-ই যে, জীবন নয়– একথাটা ভাবতেও ভুলে গেছি আমরা। তাই ভাবি, আপনার কিন্তু খুব সাহস বউদি!
–কীসের সাহস?
–আপনারা কত গুণ্ডা বদমায়েশকে শায়েস্তা করতে পারেন, নিজের উপার্জনের ভাত বেঁধে খেতে পারেন, অন্য কেউ আপনাদের অপমান করলে বা নিগ্রহ করলে আপনারা তাকে উলটে অপমান করতে পারেন। মারতে পারেন।
–আমরা তো অবলা। পরমুখাপেক্ষী। আমাদের আবার সাহস!
–এটা কিন্তু ঠিক বললেন না। সাহস ব্যাপারটা শরীরের নয়, মনের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করেছিল তখন ফ্রেঞ্চ আণ্ডারগ্রাউণ্ডে কত যুবতী এবং বৃদ্ধা নাম লিখিয়েছিলেন। নিশ্চিত ধর্ষণ এবং মৃত্যু এবং নানারকম পাশবিক অত্যাচারের ভয় থাকা সত্ত্বেও তাঁরা গোপনে কাজ করে গেছেন, খবর চালাচালি করেছেন, ইংলিশ, আমেরিকান, ইটালিয়ান সৈন্যদের আশ্রয় দিয়েছেন, যখন ইনভেশান হল তখন সবরকম অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম করেছেন। তাঁরা কি যেসব সৈন্যরা রাইফেল হাতে লড়াই করেছেন ফ্রন্ট-এ, তাঁদের চেয়ে কিছু কম সাহসী! সেনাবাহিনীর অফিসারদের যখন শিক্ষা দেওয়া হয়, খাড়াকভাসলাতে কমিশন পাওয়ার আগে তখন তাদের এই কথাটা শেখানো হয়, ফিজিক্যাল কারেজ ইজ দ্যা লিস্ট ফর্ম অফ কারেজ। মনের সাহস-ই আসল সাহস।
–তাই।
নিজের মনে বলল তৃষা। রিকশাটা মুরাদগঞ্জের পথে পড়ল। নির্জনতা হারিয়ে গেল। আবার লোকজন, চিৎকার, ধুলোবালি, পানের পিক, মিষ্টির দোকানের সামনে ফেলে দেওয়া শালপাতার দোনার শীতের দুপুরের উত্তরের হাওয়াতে ওড়াউড়ি, বাসের কনডাক্টর ছোকরার চিলচিৎকার। একটা মারুতি গাড়িকে দেখে পাদানিতে দাঁড়ানো ছোকরা চেঁচিয়ে উঠল, এ ছারপোকা। সরে যা। নইলে টিপে মেরে দেব। সর এখুনি নইলে মর।
হেসে উঠল তৃষা। কিন্তু মাঝপথে ওর হাসি থেমে গেল। ওদের উলটোদিক থেকে প্রণতর ক্যাটক্যাটে নীলরঙা অ্যাম্বাসাডার আসছে। প্রণতর পাশে রামখেলাওন বসে।
গাড়ি দেখেই ঋক রিকশা থামাতে বলল।
প্রণত দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলল ভেবেছটা কী? কোথায় গেছিলে তোমরা? তৃষা বলল, যাচ্ছিলাম তো শ্রীবাস্তব সাহেবের ওখানেই। কিন্তু আমার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল, বমি বমি করতে লাগল। তাই ঋকবাবুর বাড়িতে গিয়ে বমি করে, বাথরুম করে ফিরছি।
–ঋক তোমার বাড়ি কোথায়?
–সুরাইয়াগঞ্জে।
–কে কে আছেন তোমার বাড়িতে?
–আমি একা। ম্যানেজার সাহেব, রামখেলাওন সকলেই জানে।
–অ।
তারপর তৃষাকে প্রণত বলল, তা এখন দয়া করে গাড়িতে ওঠো।
–ইম্পসিবল। আমার যা শরীরের অবস্থা তাতে বাড়ি গিয়েই শুয়ে পড়ব।
-–খাবে না কিছু দুপুরে? রান্না তো হয়নি বাড়িতে।
–নাঃ। চিনি, লেবু দিয়ে শরবত করে খেয়ে শুয়ে পড়ব।
–আর কী খাবে! আর কিছু নিজে রাঁধতে পারলে তো খাবে? মুঙ্গলীকে ছুটি দিয়েছ তো! এবেলা?
–হ্যাঁ।
–রিকশা ছেড়ে, এখন দয়া করে গাড়িতে ওঠো বাড়িতে নামিয়ে দিচ্ছি।
–রিকশা করেই চলে যাব। তুমি যাও-না। দেরি হয়ে যাবে না তোমার?
–দেরি যা হবার তা তো হয়েইছে। তার ওপর এমবারাসমেন্ট। প্রত্যেকের স্ত্রী এসেছে। সেলসম্যানেজার, পারচেজ ম্যানেজার, চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট পি. আর. ও., এখানের কমার্শিয়াল ট্যাক্সঅফিসার, ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, এস. ডি. ও., এস. ডি. পি. ও. প্রত্যেকেই স্ত্রী নিয়ে এসেছেন, কেবল আমার স্ত্রী-ই….
তৃষা রিকশাতে বসেই শুনল।
–কী হল? নামবে না?
–নাঃ। তুমি যাও।
এবার গলা নামিয়ে বলল প্রণত, কী সিনক্রিয়েট করছ? একজন জুনিয়র অ্যাকাউন্টেন্টের সঙ্গে রিকশায় বসে সারাবাজার ঘুরে কি আমার বদনাম করতে চাও? তোমার মতলবটা কী? এই ঋক! তুমি নেমে রিকশা ছেড়ে দাও।
–না। আমি রিকশাতেই বাড়ি যাব। চলো রিকশাওয়ালা।
–আমি নেমে যাই?
ভয়ের গলায় ঋক বলল।
–আপনি কি পুরুষ মানুষ? আমি আমার স্বামীকে ভয় পেতে পারি, আপনি পাবেন কোন দুঃখে?
–স্যার! প্লিজ পাৰ্ডন মি!
বলল ঋক।
ঘেন্না হল তৃষার ঋকের ওপরে।
বলল, নেমে যান আপনি। আমি একাই চলে যাব। সোজাই তো রাস্তা।
–আমার স্ত্রী কখনো রিকশা করে বাজারে ঘুরবে না।
–বাঃ। তুমি-ই তো বলেছিলে রিকশা করে যেতে।
–বলেছিলাম। রিকশা করে কোনো ডেস্টিনেশনে যাওয়া এক আর এরকম ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো আর এক।
প্রণতর চিৎকারে কিছু উৎসাহী বেকার জুটে গেল মজা দেখতে।
তৃষা কঠিন গলায় বলল, চলো রিকশাওয়ালা।
রিকশাওয়ালার যে-যখন সওয়ারি সেই তখন তার মালিক। সে সওয়ারির কথামতো প্যাডেলে চাপ দিল।
প্ৰণত বলল রিকশাওয়ালাকে, মারেগা এক ঝাপ্পট।
রিকশাওয়ালা বলল, জবান সামহালকে বাত কিজিয়ে গা। গাড়িপর সওয়ার হুয়া তো নবাব বন গ্যায়া কি আপ? ম্যায় দাঁত তোড় দুংগা আপকি।
–ক্যা বোলা? তুম জানতে হো ম্যায় কওন? আভভি এস. ডি. পি. ও সাহাবকো বোলকে তুমকো ভর দেগা থানেমে।
-কিঁউ? হাম কওসি কসুর কিয়া? বড়া খানদান কি ক্যা এহি হরকত হ্যায়? মিয়াবিবি রাস্তেপর আকর কুত্তেকি মাফিক লড়তে হেঁ।
রিকশাওয়ালা ঘেন্নার সঙ্গে বলল।
–ক্যা বোলা তুমনে?
এবার প্রণত রিকশাওয়ালাকে বলল ঘুসি পাকিয়ে এগিয়ে এসে।
রিকশাওয়ালা ফট করে নেমে দাঁড়িয়ে রিকশার পেছন থেকে একটা সাইকেলের চেইন বের করে হাতে নিয়ে বলল, আপনা জান সামহালকার ঔর আগে বাড়িয়ে গা।
প্রণত কিন্তু মারতে পারল না রিকশাওয়ালাকে শেষপর্যন্ত। রিকশাওয়ালার সংহারমূর্তি দেখে পেছিয়ে গিয়ে বলল, রিকশাওয়ালাসে ম্যায় ক্যা লড়েগা? হামারা ইজ্জত……
হঠাৎ ঋক বলল রিকশাওয়ালাকে, আররে! ই সাব স্টিভেন কোম্পানিকো মেইনটিনেন্স ইঞ্জিনিয়র হ্যায়। ভারি বড়া সাব।
রিকশাওয়ালা বলল, ছোড়িয়ে তো! হামারা ক্যা আয়াগ্যায়া? নোকরি দিজিয়েগা উনোনে হামারা লেড়কাকো? ফজুল বাঁতে করতে হ্যায় ইনলোঁগোনে। ডরপোক কাঁহাকা। মারনেকা হিম্মত হোত তো তব কুছ সমঝতাথা। আপনা ইজ্জত পর থুক কর আপনা বিবি লেকর ঘর চলা যাইয়ে সাহাব।
এবার ঋকের দিকে ঘুরে বলল, হামারা ভাড়া দে কর মুঝে ছুট্টি কর দিজিয়ে।
ঋক পকেট থেকে একটা ফাটা মানিব্যাগ বের করল।
তৃষা বলল, আমি দিচ্ছি।
প্রণত বলল, কিতনা হুয়া?
–বহত টাইম খাড়াথা উ জঙ্গলমে, হুরিনানাকি পাস। পঁদরো রুপাইয়া দিজিয়ে কমসে কম।
তৃষা ভেবেছিল প্রণত দর করবে। কারণ রিকশাওয়ালা অনেক বেশি চাইছে। কিন্তু প্রণত দু-টি দশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল, যাও পাঁচ রুপেয়া বকশিশ। সেলাম করকে লেনা।
রিকশাওয়ালা নিজের সবুজরঙা ছেঁড়া মার্কিনের পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি সবুজ পাঁচ টাকার নোট বের করে তাতে থু: করে থুথু ফেলে বলল, হামারা সেলাম বহত মাঙ্গা হ্যায়। কমিনে আদমিওঁসে ম্যায় বকশিশ নেহি লেতা হ্যায়। লিজিয়ে, রাখিয়ে ই নোট।
প্রণত কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ফস করে নোটটাকে ছিঁড়ে ফেলে ওপরে উড়িয়ে দিল।
তৃষাও ততক্ষণে নেমে দাঁড়িয়েছিল।
রিকশাওয়ালা বলল, আসলি রহিস আদমিকা জবানসে ঔর এতলাক, ঔর তমদুনসে পাত্তা চলতা রহিসি কি। আপ ফালতু আদমি হ্যায়। সিঁফ পইসোসে রহিসি কভভি না আতি হ্যায় জনাব।
হঠাৎ তৃষা বলল, আমি হেঁটেই বাড়ি যাচ্ছি।
–না।
প্রণত বলল।
ঋক ডাকল, বউদি।
তৃষা কারও কথায় উত্তর না দিয়ে শাড়ির আঁচলটা দিয়ে বুক ঢেকে সোজা বড়ো বড়ো পায়ে এগিয়ে চলল।
ঋক বলল, স্যার আমি সঙ্গে যাই।
-–নো। তুমি জাহান্নমে যাও। কাল অফিসে তুমি দেখা করবে আমার সঙ্গে আমি এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এলেই।
–ইয়েস স্যার।
.
০৩.
এখন রাত প্রায় দশটা। তৃষা গরম জলে স্নান করে শুয়েছিল কম্বল গায়ে দিয়ে। টিভির ইংরিজি খবরটা বহুদিনের অভ্যেসবশে শোনে তাই সেটা শুনছিল।
মুঙ্গলী অনেকবার খাওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু খায়নি তৃষা কিছুই। প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ি ঢোকার শব্দ পেল গ্যারাজে। অথচ প্রণতর তো আসবার কথা ছিল না। রাতটা পাটনাতেই কাটাবার কথা ছিল। তারপর-ই ঝনঝন-ক্রিং ক্রিং একটা আওয়াজ শুনতে পেল। মুঙ্গলীকে ডেকে তৃষা বলল, দ্যাখ তো মুঙ্গলী কী হল?
মুঙ্গলী বলল, সাহাব বহত পিকে আয়া হুয়া হ্যায় মেমসাব। হিক বাবুকি সাইকেল থা ফেক দেলিন বড়ি গোসসেসে।
প্রণত ঘরে ঢুকল একটু পর-ই। গাঢ় লাল চোখ। ওর মুখে প্রচন্ড ক্রোধ পুঞ্জীভূত কিউমুলাস নিশ্বাস, মেঘের-ই মতো থমথমে হয়ে জমে ছিল। ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিল ও। শীতের জন্যে জানলার পর্দা সব টানাই ছিল। জানলাও বন্ধ ছিল। দরজা বন্ধ করেই বিবস্ত্র হয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিল তৃষার দিকে। খাটটা শব্দ করে উঠল।
তৃষা আতঙ্কে উঠে বসল। দু-পা বুকের কাছে গুটিয়ে বলল, না, না। না–আ।
প্রণত যে-ভাষায় কথা বলল তখন তা উচ্চারণ করাও যায় না। বিড়বিড় করে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ও-ও। বুঝেছি ঋককে দিয়ে…আর স্বামী…..
বলেই, তৃষার ওপরে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ল। তৃষা আর্তনাদ করে বুকের কাছে দু-পা জড়ো করে খুবজোরে একটি লাথি মারল তাঁর পতিদেবতাকে। দেবতা ছিটকে পড়লেন দূরে। তৃষা তাড়াতাড়ি উঠে বেডসাইড টেবিল থেকে পেতলের ফুলদানিটা তুলে নিয়ে বলল, আবার যদি কাছে এসেছ তবে তোমাকে খুন করব আমি।
বলতেই প্রণত বেরিয়ে গেল এবং ফিরে এল গাড়ি টো করার মোটা দড়িটা নিয়ে। দড়িটাকে ফাঁসের মতো করে ছুঁড়ে দিল তৃষার মাথার ওপর দিয়ে তারপর এক হ্যাঁচকা টানে বেঁধে ফেলল তাকে। খুব-ই লাগল তৃষার। তৃষা ভাবছিল, যা বড়ো সোহাগে, আদরে স্বামীকে দেওয়ার ছিল তা যে, এমনভাবে দিতে হবে তা কে জানত!
প্রণত তৃষাকে দড়িবাঁধা অবস্থায় হেঁচড়ে টেনে বালিশের ওয়াড় খুলে তার দুটি হাত এবং পা বাঁধল। মুখের মধ্যে ঘামের গন্ধমাখা নোংরা রুমাল ঢুকিয়ে দিয়ে তৃষাকে তুলে এনে রকিং-চেয়ায়টার ওপরে বসাল। বসিয়েই আবার বেরিয়ে গেল।
তৃষার এবারে খুব ভয় করতে লাগল। ওকে যখন রকিং-চেয়ারে বসিয়ে গেল তখন তৃষার শরীরে আর কোনো ভয় নেই। শারীরিকভাবে আর উৎপীড়ন করবে না প্রণত। এবার কোনো নতুন মানসিক অত্যাচারের কথা ভাবছে বোধ হয় ও। কিন্তু সেটা কী? ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল তৃষার। রুমাল ঢোকানো থাকাতে এমনিতেও শুকিয়ে যাচ্ছিল গলা।
একটুপর-ই মুঙ্গলীর গলার স্বর শুনতে পেল তৃষা। মুঙ্গলী আর্তচিৎকার করছে না। নীচু গলায় বলছে, নেহি নেহি মেমসাহাবকি সমনা নেহি। ছোড় দিজিয়ে সাহাব। আব যব বলিয়েগা, যাঁহা বলিয়েগা…ম্যায় কভভি না বোলতি!
মুঙ্গলীর এইসব কথা শুনে আত্মারাম কেঁপে উঠল তৃষার। মুঙ্গলী! তার স্বামীর আসল শয্যাসঙ্গিনী তাহলে, ওই সরল শক্ত-সমর্থ মাংসল শরীরের আদিবাসী মেয়েটি।
মুঙ্গলীকে জোর করে টানতে টানতে এনে প্রণত ঘরে ঢুকল। মুঙ্গলী কাঁদো কাঁদো গলায় বলছিল, ইয়ে ঠিক নেহি হ্যায়। বহত-ই খরাব….। বহত-ই…..
প্ৰণত বলল তৃষাকে, দ্যাখো তোমার সামনেই মুঙ্গলীকে আমি…. তোমার চেয়ে ও সব দিক দিয়ে সুন্দর। কী আছে তোমার বিদ্যার গুমোর আর বদমাইশি জেদ ছাড়া। তোমার যোগ্য হল ওই জুনিয়র অ্যাকাউন্টেন্ট।
বলেই বলল, আই মুঙ্গলী খোল। খোল শাড়ি। সব খোল।
প্রণতর ক্ষণিক অন্যমনস্কতার সুযোগে মুঙ্গলী দৌড়ে পালিয়ে গেল ঘর থেকে। পিছু পিছু প্রণতও দৌড়োল।
তৃষা ভাবছিল, ভারি ভালো মেয়ে মুঙ্গলী। ও কী করবে। গরিবি মানুষ, প্রয়োজন আছে, মেয়েদের যা সবচেয়ে বড়ো সম্পত্তি তাই ভাঙিয়ে কিছু করে নেয়, নিরুপায়ে। মেয়েদের নিরুপায়তার স্বরূপ শুধু মেয়েরাই জানে। তবু মুঙ্গলী যদি রাজি হত প্রণত যা বলছিল তা তৃষার সামনেই করতে, তবে তৃষাকে যে, কতবড়ো অপমান করা হত তা মুঙ্গলী মেয়ে বলেই বুঝেছিল।
বাইরে থেকে প্ৰণত আর ফিরল না। গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনল। ঋকের সাইকেলটাকে চাপা দিয়ে মুড়মুড় করে ভেঙে দিয়ে গাড়িটা চলে গেল। হেডলাইটের আলো কম্পাউণ্ড ঝেটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মালি যে, গেট বন্ধ করল সেই শব্দ শুনতে পেল তৃষা। মুঙ্গলীও কিন্তু ফিরে এল না আর। তৃষা জোরে ডাকল মালি-ই-ই। কিন্তু আওয়াজ হল না কোনোব্যথা করছিল গলায়, গালে আর চোখে। তৃষার দু-চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। শীতও করতে লাগল খুব। কম্বলটা যে, গায়ে দিয়ে দেয় কেউ এমনও নেই একজন।
অনেকক্ষণ পর বসবার ঘরের মেঝেতে সাবধানি খস খস একটা শব্দ শুনতে পেল তৃষা। কথা না বলতে পেরে বসবার ঘরের আর শোয়ার ঘরের মধ্যের পর্দার দিকে চেয়ে রইল ও। কেউ আসছে ঘরের দিকে। বাইরের কেউ? মালি? ভাল্লুকের মতো রোমশ চেহারা। খুব শক্তি ধরে শরীরে।
বেডরুমে কেন আসছে মালি? মালি কি? পুরুষজাতকে কখনো বিশ্বাস নেই। মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন এক বিশেষ দিনে যেদিন ও বড়ো হয়ে গেছিল হঠাৎ। সে বড়ো সুখের অথচ দুঃখের দিন। বড়োভয়ের দিন। মা বলেছিলেন…
মালিই। পর্দা ঠেলে মালি কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল হলুদরঙা স্বচ্ছ নাইটি পরা তৃষার দিকে। পরক্ষণেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। বিড়বিড় করে বলল, হায় ভগবান।
মালি কী ভাবল একটুক্ষণ, তারপর এগিয়ে এসে তৃষার হাত-পায়ের বাঁধন, মুখের রুমাল তারপর দড়িটাও খুলে ফেলল একে একে।
তৃষা মাথা নীচু করে বসেছিল। তখনও হতভম্ব ভাবটা কাটেনি।
মালি বলল, হাতে-মুখে জল দিয়ে নিন মেমসাব।
তারপর তৃষার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আপনি কী করবেন? কলকাতা যাবেন বাপের বাড়িতে?
–আমার বাপের বাড়ি নেই মালি।
–নেই মানে?
–ওই। না থাকার-ই মতো।
–ওঃ ।
–মুঙ্গলী কোথায় গেছে মালি?
–মুঙ্গলীকে তো সাহাব সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ম্যানেজারবাবুর বাড়ির পথে গেলেন।–মুঙ্গলী কি খারাপ মেয়ে? মালি? মালি মাথা নীচু করে বলল, খারাপ বলব না। খারাপ ও নয়। মনে হয় সাহাব-ই ওকে খারাপ করে দেন মাঝে মাঝে। ওরা বড়ো গরিব। স্বামীটা রোজগার করতে পারে না, ওকে আদরও করতে পারে না। গাছ কাটতে গিয়ে পায়ের ওপর গাছ পড়ে ওর দু-টি পা-ই গেছে। তাই মুঙ্গলীর প্রয়োজন অনেকরকম। এবং জরুরি প্রয়োজন সব। সাহাব তার-ই সুযোগ নিচ্ছেন।
–মুঙ্গলীর ছেলে-মেয়ে নেই? আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি।
–না, ওর ছেলে-মেয়ে হবেও না।
তারপর-ই বলল, আপনি এখন কী করবেন মেমসাহেব?
-–তুমি আমাকে একটা রিকশা ডেকে দেবে? পাওয়া যাবে রিকশা শীতের এতরাতে?
–তা পাওয়া যাবে। তবে বাজার অবধি হেঁটে যেতে হবে। যদি আপনি বলেন তো যাব ডাকতে। কিন্তু যাবেন কোথায়? এতরাতে? আপনার তো রিস্তেদার কেউ নেই এই মুরাদগঞ্জে।
–না। তা নেই। আচ্ছা মালি, আমি চোখে-মুখে একটু জল দিয়েই আসছি। তুমি। বারান্দাতেই থাকো।
–জি মেমসাব।
বাথরুমের দরজার ছিটকিনি তুলে দিতেই হুহু করে জল নামল তৃষার দু-চোখে। কত স্বপ্ন আর কল্পনা মিশিয়েই এই বাথরুম না রেনোভেট করেছিল। দেওয়ালের রং, সেই রঙে মেলানো টাইলস, শাওয়ার, শাওয়ায়ের পাশে হালকা সবুজরঙা পলিথিনের আড়াল! কত ভেবেছিল। কী ভেবেছিল, স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে স্নান করবে একদিন শাওয়ারের নীচে। আরও কত কত কৈশোর থেকে জমিয়ে রাখা সব নানারঙা কল্পনা! সব-ই মিথ্যে হয়ে গেল। বড়ো তাড়াতাড়ি সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেল। এর পেছনে কি ছটোমামির কোনো হাত ছিল? মাঝে মাঝেই প্রণতর কাছে খামে চিঠি আসে কলকাতা থেকে Personal লেখা। যে লেখে তার হাতের লেখাটি একেবারে ছোটোমামির হাতের লেখার মতো। ছোটোমামা মায়ের থেকে বয়সে অনেক-ই ছোটো ছিলেন। ছোটোমামিও বয়সে তৃষার সমবয়সিই হবে। মেজোমামা নিঃসন্তান এবং বিপত্নীক। মেজোমামার তৃষার ওপর অন্ধ ও অগাধ স্নেহটা ছোটোমামি তার বিয়ের পর থেকে কোনোদিন-ই ভালো চোখে দেখেনি। ছোটোমামার বিয়ে হয়েছে দু-বছর। মামাদের মধ্যে ছটোমামাই একমাত্র Waster। পরিবারের যৌথ ব্যাবসাও দেখে না। শুধু রেসের মাঠ আর মদে টাকা ওড়ায়। অনেক ছোটো, আদরের ভাই বলে অন্য মামারা কিছুই বলেন না। ছোটোমামার বিয়েতেও মামাদের আপত্তি ছিল। একবার পাটনাতে বেড়াতে গিয়ে অজ্ঞাতকুলশীল এই ছোটোমামি, সুন্দরী বৃন্দাকে সঙ্গে করে এনে তোলে ছোটোমামা। চেহারা সত্যিই বেশ ভালো, কিন্তু সেজোমামি বলেছিলেন হাবভাব যেন বাইজির মতো! সেই সৌন্দর্যে কোনো সম্ৰান্ততা ছিল না। রেজিষ্ট্রি করেই এসেছিল পাটনা থেকে। তাই বিয়ে দিতে হয়।
ছোটোমামির আত্মীয় বলতে শুধু এক মামা। হাজামত-এর মতো হাবভাব তাঁর। কান দুটো বড়ো বড়া। অত্যন্ত ধূর্ত এবং দুশ্চরিত্র মানুষ। চেহারা দেখলেই মনে হয় প্রতি সন্ধেবেলা গাঁজা খান। ওঁকে নিয়ে মামাবাড়িতে বেশ অশান্তিও হয়েছিল। এই ছোটোমামিমা বৃন্দাই প্রণতর সঙ্গে সম্বন্ধ এনেছিল তৃষার। প্রণতর বাবা-মায়ের পরিচয় দিয়ে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা প্রণতর আসলে কেউ যে, নন একথা তৃষা বিয়ের অনেক পরে জানতে পেরেছে। আসল বাবা-মা নাকি মতিহারীর এক বস্তিতে থাকেন। প্রণত কোনো দিনও তাঁদের খোঁজ নেয় না। তাঁরা নাকি প্রায় না খেয়েই থাকেন। এসবও তৃষা জেনেছে মতিহারী থেকে তৃষাকে গোপনে লেখা প্রণতর ছোটোবোনের চিঠি থেকে। মাত্র কদিন আগে। একবার সে মতিহারীর একজন লোককে সঙ্গে করে তৃষার সঙ্গে মুরাদগঞ্জে দেখাও করতে এসেছিল। প্রণত তখন ট্যুরে, রাঁচিতে গেছিল দশ-দিনের জন্যে। মেয়েটির মাথায় একটু গোলমাল আছে! তবে ভারি সরল ও বঞ্চিত। মুঙ্গলীকে তার আসল পরিচয় দেয়নি তৃষা। মুঙ্গলী মেয়েটা এমনিতে সরল-ই। আজ তার অন্য রূপ জেনে ভারি আহত বোধ করছিল ও।
মুখ ধুয়ে নাইটি ছেড়ে শাড়ি পরল। যে-শালটা বের করেছিল ক-দিন আগে এবং হাতের কাছে ছিল সেটাই জড়িয়ে নিল। ছোটো অ্যাটাচিতে মামাদের দেওয়া গয়নাগাটি, নিজের ব্যক্তিগত কিছু জিনিস এবং হাজার টাকা, যা বিয়েতে পাওয়া টাকা থেকে ব্যাঙ্কে দেওয়া হয়নি তাই শুধু সঙ্গে নিল। একটি বলপয়েন্ট পেন। তারপর চটি গলিয়ে বাইরে এল।
কৃষ্ণপক্ষর রাত অন্ধকার। কিন্তু ঝকঝক করছে তারারা আকাশময়। একবার মুখ তুলে ওপরে তাকাল। তাকাতেই দু-চোখ আবার জলে ভেসে গেল। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরল তৃষা। কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে এসে বসল চেয়ারে। একটি কুকুর কেঁদে যাচ্ছে পথ দিয়ে। জোরে কেউ সাইকেল চালিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে যেতেই কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে তাকে ধাওয়া করে গেল। তারপর আবার চুপচাপ। গেটের একটু বাঁ-পাশে চা-শিঙাড়ার দোকানি রাত গম্ভীর হলে শুয়ে পড়ার আগে রোজ তুলসীদাস পড়ে সুর করে। বেশ একটা আমেজের সৃষ্টি হয়। অন্য এক পরিবেশ।
মালি ওর ভাবনার রেশ কাটিয়ে নিয়ে বলল, কাঁহা যাইয়েগা মেমসাব?
–কোনো হোটেল টোটেল নেই? তোমাদের মুরাদগঞ্জে?
–যেরকম হোটেল আছে তাতে একা আওরাতের পক্ষে থাকাটা খুব-ই বিপদের হবে।
না বলে বলল, বিপদ এখানেই বা কম কী!
মামাদের ওপরে, এই দেশের ওপরে, এ দেশের মেয়েদের এই নিদারুণ অসহায়তার কারণে তীব্র এক ঘৃণামিশ্রিত রাগ হল তৃষার। এ দেশে একা একজন মেয়ের মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্যে আরও কতদিন যে, অপেক্ষা করে থাকতে হবে তা কে জানে। উইমেনস লিব শুধু শহরের কিছু উচ্চবিত্ত মেয়েদের শখের পাস-টাইম। গ্রামে-গঞ্জে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোটি কোটি মেয়েদের যে, কী নিদারুণ লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অত্যাচারের মধ্যে এবং আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তা যদি সেইসব শৌখিন লিবারেশনের প্রবক্তারা একটুও জানতেন!
ভাবল তৃষা।
তবে এখানে সে আর একমুহূর্তও থাকবে না। এই অপমানকর অবস্থার চেয়ে বরং ভেসেই যাবে ভাগ্যের ভরসায়, যেখানে গিয়ে ঠেকে; কিন্তু মরে গেলেও আর কিছুতেই এই বর্বরের সঙ্গে একদিনও ঘর করবে না।
মালি দাঁড়িয়েছিল মেরুন রঙা একটা ছেঁড়া ফুলহাতা সোয়েটার আর ধুতি পরে। খালি পা। ওর শীত করছিল খুব। বুঝতে পারছিল তৃষা।
তৃষা বলল, রিকশা ডাকো মালি। দুটো রিকশা ডেকো।
–দুটো কেন?
–একটাতে আমি যাব। আর একটাতে ঋকবাবুর সাইকেল। সাইকেলটা কি মেরামত হবে?
–বোধ হয় না।
-–যাও তবে। ডেকে আনো রিকশা।
–আপনি কি ঋকবাবুর ডেরায় গিয়ে উঠবেন? লোকে কী বলবে মেমসাব?
–লোকে কী বলবে তা নিয়ে আমি আর ভাবি না মালি। এখানে আমি আর থাকব না। ঋকবাবুকে আমি বেশি না জানলেও এটুকু জেনেছি যে, মানুষটি ভালো। তিনি এই বিপদের সময়ে আমাকে পথে বের করে দেবেন না। রাতটা তো কাটুক তারপরে কী করা যায় ভেবে দেখব। কালকে দুপুরে তুমি একবারের জন্যে যদি সুরাইয়াটোলিতে আসো। চেন কি ঋকবাবুর বাড়ি? তাহলে তোমার হাতে তোমার সাহেবকে একটি চিঠি দেব। পারবে দিয়ে আসতে?
–দেখি। বাড়ি আমি চিনি। সে তো বহুত-ই সান্নাটা জায়গাতে। রাতভর একা আওরাত আপনি থাকবেন কী করে সেখানে?
–সব আওরাত-ই একা মালি! পৃথিবীর সব আওরাত-ই আমার মতোই একা। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। এবারে তুমি যাও। বড়ো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
–যাই মেমসাব।
মালি চলে যেতে বারান্দাতে বসে তৃষা ভাবছিল, মালির সঙ্গে এতকথা বলা তার উচিত হয়নি। মালি হয়তো এতকথা বুঝলও না। উলটে কী ভাবল হয়তো ওকে। কিন্তু যে, মানুষের কেউ নেই সে হয়তো কুকুর-বেড়ালের সঙ্গেও কথা কয়। মানুষকে যখন কথায় পায় তখন সে হাওয়ার সঙ্গে, গাছের সঙ্গে, পথের সঙ্গেও কথা কয়।
রিকশাটা আসতে যতক্ষণ দেরি। তারপর-ই তৃষার জীবনে এক নতুন অধ্যায় আরম্ভ হবে। আরম্ভটুকুই জানে শুধু সে, শেষটুকু জানে না। ঋক তাকে এতরাতে আদৌ আশ্রয় দেবে কি না কে জানে? রাতটুকু আশ্রয় দিলেও তারপরে কী করবে তা একেবারেই অজানা। অথচ ঋক ছাড়া অন্য কাউকেই তৃষা জানে না এখানে যার কাছে সে যেতে পারে! এত রাতে এত গয়নাগাটি, নগদ হাজার টাকা নিয়ে ওই নির্জনপথে যাওয়া আদৌ উচিত হবে না হয়তো। কিন্তু তৃষার মন থেকে সব ভয় উবে গেছে। কিছুকেই সে আর ভয় পায় না। তার নারীত্বের এমন এক গোপন নরম কুঠুরিতে যে, চরম আঘাত পেয়েছে তার পক্ষে আর কোনো আঘাতকেই আঘাত বলে মনে হবে না যে, সে-বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। ভয় এখন একটাই। ঋক যদি তার চাকরি খাওয়ার ভয়ে তৃষাকে ফিরিয়ে দেয়, আশ্রয় না দেয়! তাহলে কী-যে হবে তা ভাবতে পর্যন্ত পারছে না ও।
কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে। ভাবনায় পেলে সময়ের হুশ থাকে না কোনো। মালি যখন দু-টি রিকশা নিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল, দু-টি রিকশার চার চাকাতে কিরকির শব্দ উঠল কাঁকুরে মাটিতে তখন সংবিৎ ফিরে পেল তৃষা। উঠে দাঁড়িয়েই বলল, চলো।
মালি একটি রিকশাকে গ্যারাজের কাছে নিয়ে গিয়ে তালগোল পাকানো ঋক-এর সাইকেলটাকে তুলল তাতে। তুলে নিজেও সিটের ওপর উঠে বসল।
–তুমি যাবে মালি? তোমার সাহাব যদি ফিরে আসেন এরমধ্যে।
–এলে আসবেন।
–তোমার ওপর যদি রেগে যান? যদি ছাড়িয়ে দেন তোমাকে?
–আমি আমার মালিকের চাকর। ভাড়াটের চাকর নই। সাহাব তো মালিকের ভাড়াটে। আর তেমন হলে চাকরি না হয় ছেড়েই দেব। পেটের জন্যে চাকরি করি মেমসাব। যতক্ষণ এই হাতদুটো আছে ততক্ষণ এ চাকরি গেলেও অন্যকিছু করতে পারব। কিন্তু ইনসান-এর মতো না বাঁচলে বেঁচে থেকে লাভ কী? আমার জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না।
বাগানের আলোতে মালির শক্ত সুগঠিত শির-ফোলানো হাত দু-টির দিকে তাকিয়ে তৃষা ভাবল ওর যদি অমন দু-টি হাত থাকত! তাহলে ও-ও হয়তো বলতে পারত, আমার জন্যে কারও চিন্তা করার দরকার নেই। যে, যাই বলুক এখনও একজন পুরুষে আর নারীতে অনেক-ই তফাত এই দেশে। কবে যে, তারা সমান হবে!
রিকশা চলেছে। আগে মালির রিকশা, পেছনে তৃষার। দু-পাশের দোকানপাট প্রায় সব-ই বন্ধ। দু-একটি দোকানের প্রায়-বন্ধ ঝাঁপ থেকে আলোর ফালি এসে পড়ছে পথে। দু-একটি সাইকেল যাচ্ছে। রিকশা প্রায় নেই বললেই চলে। দোতলা বাড়ির মতো উঁচু মাল-বোঝাই মার্সিডিস ট্রাক জোরে হর্ন বাজিয়ে হেডলাইট জ্বেলে ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে ছুটে চলেছে।
স্যুটকেসটি কোলের ওপরে নিয়ে অন্ধকার পথের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে আছে তৃষা। চোখ দুটি মাঝে মাঝেই ভিজে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে জলে। কিন্তু রুমাল দিয়ে মোছারও চেষ্টা করছে না ও। জীবন-ই যখন ভেসে গেল তখন ভাসা-চোখের খোঁজ কে আর রাখে।
সুরাইয়াটোলির দিকে মোড় নিতেই অন্ধকার গ্রাস করে ফেলল রিকশাদুটোকে। আগে আগে যাওয়া সামনের রিকশাটাকেও যেন দেখা যাচ্ছে না। ওই রিকশার পেছন দিকে তলায় ঝুলোননা আলোটা আর ওর রিকশায় হ্যাঁণ্ডেলের মাঝে বসানো কেরোসিনের আলোটা যেন অন্ধকারকে আরও বাড়িয়ে দিল।
মাথার ওপরে আঁচলটা তুল দিল তৃষা। শিশির পড়ছে। শিশিরে রিকশার সিট ভিজে গেছে। বড়ো শিমুল, মহুয়া আর ঝটিজঙ্গল বোধ হয় ছাড়িয়ে এল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। শালবন থেকে ভেজা শালপাতার আর ভেজামাটির মিষ্টিগন্ধ আসছে। নদীর দিক থেকে শেয়াল ডেকে উঠল। প্রথমে একটি। তারপরে অনেকগুলো। রাত এখন প্রায় বারোটা হবে। প্রচন্ড শীত। তাই মনে হচ্ছে রাত দুটো। বিশেষ করে সুরাইয়াটোলির এই রাস্তায়। কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। দু-টি বাদুড় উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে সপসপ শব্দ করে। ভয় পেল তৃষা।
মালি সঙ্গে না থাকলে ঋক-এর নিষ্প্রদীপ মাটির বাড়ি এই অন্ধকারে চিনতেই পারত না তৃষা। বাড়ি ফেলে চলে গেল এই পথ বেয়ে কোথায় যে, গিয়ে পৌঁছোত তাও ও জানে না।
রিকশাওয়ালাকে ফিসফিস করে শুধোল, এই পথ কোথায় গেছে?
রিকশাওয়ালা বলল, সুরাইয়াটোলি-র কবরখানায়।
গা ছমছম করে উঠল তৃষার।
.
ততক্ষণে মালি রিকশা থেকে নেমে ঋক-এর বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হিক বাবু। হিক বাবু শো গ্যয়া ক্যা? হিক বাবু! বলে ডাকতে লাগল। ওর রিকশাওয়ালা কিরিং কিরিং করে ঘন্টা বাজাতে লাগল। তার দেখাদেখি তৃষার রিকশাওয়ালাও।
তৃষা বলল, আস্তে। ভাবল, গাঢ়ঘুমের মধ্যে এমন হঠাৎ শোরগোলে বেচারার ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল শরীর খারাপ হতে পারে।
কিছুক্ষণ ডাকাডাকি আর ঘণ্টি বাজানোর পর হাতে একটি লণ্ঠন নিয়ে ঋক দরজা খুলল। অন্য হাতে লাঠি।
মালি বলল, মেমসাব আয়া। রাত হিয়াই বিতানা।
–কওন মেমসাব?
–হামারা মেমসাব।
–কাহে? ক্যা হুয়া?
–সে, উনোনে খুদহি বাতায়েঙ্গি আপকি।
অবাক হয়ে ঋক তৃষার রিকশার দিকে এগিয়ে এল। লণ্ঠনটা তুলে ধরল ওর মুখের কাছে। জলের ধারা চোখ থেকে নেমে দু-গাল বেয়ে বুকের কাছে শাড়ি ভিজিয়ে দিয়েছিল। অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল ঋক। ওর চোখ এড়াল না তা।
তৃষা একবার ওর সাইকেলটার দিকে চেয়ে মালিকে বলল, ক্যায়সে, হুয়া?
মালি বলল, সাহাব গাড়িয়া চড়হা দিয়ে থে।
নিরুত্তাপ গলায় ঋক বলল, কাহে?
–গোসসেসে।
–ও।
বলেই, লাঠিটা আর লণ্ঠনটা মালির হাতে দিয়ে বাঁ-হাতে তৃষার হাত থেকে স্যুটকেসটা নিয়ে ডান-হাতে তৃষাকে হাত ধরে রিকশা থেকে নামাল যত্ন করে। বলল আসুন বউদি। নির্ভয়ে আসুন। আমার বাড়িতে আসার জন্যে দেখলেন তো কত হেনস্থা হল। বলেছিলাম আমি আপনাকে। আগেই বলেছিলাম। কথা তো শুনলেন না।
তৃষা বলল, বউদি নয়, বলুন তৃষা।
একমুহূর্ত থেমে, তৃষার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঋক বলল, হ্যাঁ তাই বলব। অনেকদিন আগে থেকেই বলব ভাবছিলাম।
তৃষা বলল, মালি, তুমি তাড়াতাড়ি যাও। বাড়ি খালি পড়ে আছে। সব খোলা। চুরি হলে
তুমিই দায়ী হবে।
–আপনিই চলে গেলেন মেমসাব! বাড়ি তো খালিই হয়ে গেল। চোরের নেবার মতো আর কী রইল? নমস্তে মেমসাব।
তৃষা ওর হাত-ব্যাগ থেকে একটি কুড়ি টাকার নোট বের করে মালিকে দিল। আর দশ টাকা রিকশাওয়ালাদের। রিকশাওয়ালারাও বলল, নমস্তে মেমসাব।
তারপর রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল। রিকশা দু-টির পেছনে দুলতে থাকা লালচে আলো দু-টিকে অন্ধকার আর কুয়াশা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিল। আকাশে মেঘ করেছে। নদীর দিক থেকে কনকনে হাওয়া আসছে।
ঋক বলল, ভেতরে চলো।
তৃষা একটু অবাক হল। ঋক তাকে শুধু তুমি বলে সম্বোধন করল বলেই নয়, ঋক-এর গলার স্বরে এক দারুণ আত্মপ্রত্যয় ঝরে পড়ল বলে। আজ দুপুরবেলায় ঋক বা যে-ঋককে সে তিনমাস ধরে চিনত, বিয়ের পর যখন প্রথম মুরাদগঞ্জে ওরা এল তখন যে-ঋক পাটনা স্টেশনে ওদের রিসিভ করতে এসেছিল রামখেলাওনের সঙ্গে, সেইসব ঋক-এর সঙ্গে এই ঋক-এর কোনোই মিল নেই। একজন মানুষের মধ্যে যে, কতজন মানুষ লুকিয়ে থাকে। এইমুহূর্তের তৃষার সঙ্গে আজ সন্ধেবেলার তৃষার কোনো মিল নেই। ঋক বলল, কিছু খাবে?
–একটু জল।
–এই ঠাণ্ডাতে জল? চা করি একটু? তোমার এই মধ্যরাতের অভিসারের রহস্যটা শুনতে শুনতে চা হয়ে যাবে।
–আমি যে, কম্বল-টম্বল কিছু নিয়ে আসিনি। বিছানা!
–সব হয়ে যাবে। সেসবের জন্যে চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। রান্নাঘরে চলো। আমি চায়ের জলটা গরম করি ততক্ষণে তুমি বলো তো কেন এই মাঝরাতে চলে এলে এখানে।
তৃষার বলতে ইচ্ছে না করলেও ওকে বলতে হলই। ওই ঘটনা বা ঘটনাবলির কথা বলতে গিয়ে তৃষার নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। বড়ো ঘেন্না হচ্ছিল নিজের ওপর। এবং তা শুনতে শুনতে ঋক-এর চোয়াল শক্ত হয়ে এল। স্টোভের সামনে উবু হয়ে বসা ঋকের টকটকে ফর্সা গাল, চোয়াল এবং চিবুকে আগুনের লাল আভা লেগে আশ্চর্য দেখাচ্ছিল ঋককে। মনে মনে খুব খুশি হল তৃষা। এই আপাত লাজুক, চাকরি হারাবার ভয়ে সদাই ভীত মানুষটিকে চিনতে ভুল করেনি তাহলে ও।
তৃষার হাতে চায়ের কাপটি দিয়ে ঋক বলল, আশ্চর্য! তুমি যা বললে তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। স্যার মানুষটা কিন্তু খারাপ না। মদ-ই খেয়ে ফেলল ওঁকে। আর লোভ। ভাবলে কষ্ট হয়। চোখের সামনে কত ভালো ভালো মানুষ এই লোভে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তারপর একটু থেমে বলল, ভাগ্যিস আমি ওখানে ছিলাম না। থাকলে প্রণতবাবু মার্ডার হয়ে যেতেন আমার হাতে। যাই বলো, তুমি দুপুরে আমার এখানে জোর করে না এলে এতসব ঘটত না কিন্তু। আমি খুবই লজ্জিত, বিব্রতও। তোমার এতবড়ো ক্ষতি করে দিলাম।
–হয়তো আজ ঘটত না, কিন্তু এরপরে, ছ-মাস পরে একবছর পরে বা দু-বছর পরে ঘটতই। এতবড়ো একটা ভুলকে আরও এতদিন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে কি এই ভালো হল না? তার সত্য প্রকৃতি তো চাপা থাকত না! কী বলো?
–তা অবশ্য ঠিক। তবে আমি কোনো মানুষকেই খারাপ বলে মানতে রাজি নই। এভরিবডি হ্যাঁজ হিজ সানি সাইডস।
একটু চুপ করে থেকে ঋক বলল, আমি ভাবতেও পারছি না যে, নিজের স্ত্রীকে গাড়ি টো করার দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে তার চোখের সামনে নোকরানির সঙ্গে সংগমে প্রয়াস করার মতো রুচির মানুষ সত্যিই থাকতে পারে। আমাদের ছেলেবেলায় আমাদের বাড়ির কাছেই একজন মোটর ভেহিকেলস ইন্সপেক্টর ছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে এইরকম ব্যবহারের গুজব শুনতে পেতাম বড়োদের মুখের কানাঘুসোয়। কিন্তু গুজব তো গুজব-ই। সত্যিই যে, এমন কেউ করতে পারে, শিক্ষিত কোনো মানুষ, তা ভাবতে পর্যন্ত পারছি না আমি।
চায়ের কাপ দু-টি গরম জলে ধুয়ে রেখে একটি বোতলে গরম জল ভরে নিল ঋক। তারপর বলল চলো, নতুন চাদর আর বালিশের ওয়াড় বের করে দিচ্ছি। তুমি আমার চৌপাইতেই শুয়ে পড়ো। আমার লেপের নীচেই শোও আজ। আমার শরীরের গরমে গরম হয়ে আছে। কাল থেকে একটা পাকাঁপোক্ত বন্দোবস্ত করা যাবে।
–তুমি কোথায় শোবে?
–আমি রান্নাঘরেও শুতে পারি।
–সে কী? মাটিতে?
–খড় বিছিয়ে নেব।
–না, না সে কী।
–কোনার ঘরে খড় রাখাই আছে, পেছনের দিকে ছাদ মেরামত করার জন্যে। ঘরের তো কোনো অভাব নেই আমার প্রাসাদে।
–না না। আমার ভয় করবে একা ঘরে শুতে। এই নির্জন বাড়ি তার ওপর আবার মাটির।
–তাহলে ওই ঘরেই শোব এখন দরজা আগলে। তুমি চলো, আগে চাদর আর বালিশের ওয়াড়টা বদলে দিই।
–এতরাতে ওসবের কী দরকার! থাক না। কাল-ই যা করার কোরো।
–ঘুম পেয়েছে? তা তো পাবেই। বাজল ক-টা?
–দেড়টা। –দেড়টা! ও বাবা। তাহলে তুমি শুয়েই পড়ো। জামাকাপড় বদলালে বদলে নাও। আমি দরজাটা টেনে দিয়ে যাচ্ছি কোণের ঘরে খড় আনতে।
তৃষার খুব উত্তেজনা বোধ হচ্ছিল। এই উত্তেজনা প্রণতর হাতে অত্যাচারিত হওয়ার উত্তেজনার থেকেও বেশি। ও শাড়ি ছাড়বে না ঠিক করল। ঋক-এর সঙ্গে একই ঘরে শুলে নাইটি পরে শোয়া চলবে না। আলাদা ঘরে শোয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারলে তখন দেখা যাবে। ঘরের কোণে একটি লণ্ঠন রাখা আছে, ফিতে নামানো। মিটমিট করে জ্বলছে সেটা। ব্রেসিয়ারটা শুধু ঢিলে করে নিয়ে তৃষা আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ল ঋক-এর লেপের তলাতে, চৌপাইয়ে। সত্যিই ওর শরীরের গরমে গরম হয়ে আছে বিছানা এবং লেপ। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে একটা লেপ থেকে বালিশ থেকে। আতরের গন্ধ। বালাপোশে যেমন থাকে। কী আতর কে জানে! কখনো ঋক-এর এতকাছেও আসেনি যে, আতরের গন্ধ পায়। ঋক যে, আতর মাখে তা জানত না তৃষা। আতরের গন্ধ ও সইতে পারে না। প্রচন্ড তীব্র লাগে। কিন্তু আজ কেন যে, ভালো লাগছে কে জানে! নিশ্চয়ই আতরের অনেক রকম আছে।
ও তখনও পুরোপুরি শোয়নি এমন সময় একটা গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলোর ঝলক এসে পড়ল ওর মুখে জানলার ফুটো-ফাটা দিয়ে। তারপর-ই গাড়িটা হর্ন দিল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে।
ঋক দরজায় টোকা দিল। তারপর দরজা একটু ফাঁক করে বলল, তুমি শুয়ে থাকো ভয় নেই, আমি আসছি।
লাঠি আর লণ্ঠন হাতে দরজা খুলল ঋক।
অত্যন্ত ক্রুদ্ধস্বরে প্রণত বলল, হাউ ডেয়ার ইউ ঋক। তুমি আমার ওয়াইফ-এর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছ?
–আমি আপনার স্ত্রীকে রাতের মতো আশ্রয় দিয়েছি।
–আশ্রয় দিয়েছ মানে? হু দ্যা হেল আর ইউ?
–প্রণতবাবু, বিহেভ ইয়োরসেল্ফ। আপনি তৃষার সঙ্গে যে, ব্যবহার করেছেন তারপরেও কৈফিয়ত চাইবার মতো নির্লজ্জতা আপনার আছে?
–আমাকে স্যার বলে অ্যাড্রেস করো।
করতাম-ই তো বরাবর। আর করব না।
–আই উইল স্যাক ইউ।
–প্লিজ স্যু।
–তুমি আমার স্ত্রীকে ইলোপ করেছ।
–এতরাতে এবং এই শীতে আপনার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। আপনি দয়া করে চলে গেলে ভালো হয়।
–চলে যাব? ইউ স্কাউড্রেল। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তুমি শুয়ে থাকবে আর আমি চলে যাব? এমন সময় ঋক-এর পাশে এসে দাঁড়াল তৃষা। বলল, আমি তোমার স্ত্রী নই।
–তার মানে? আমি থানায় যাচ্ছি। আমি অ্যাডলটারির কেস করব।
–করো। কোর্টে যা বলার বলব আমি। এখন চেঁচামেচি না করে চলে যাও। একা শুতে ভয় পাও তো মুঙ্গলীকে ডেকে নিয়ে।
–শাট আপ।
–এবারে আপনি গেলে আমি খুশি হব প্রণতবাবু।
–না গেলে?
ঋক ডান হাতের ছ-ফিট লম্বা তেলমাখানো লাঠিটা দেখাল।
তারপর বলল, আমি একা নই। আমার বাড়ির ভেতরে আমার চার-পাঁচজন বন্ধু আছে। প্রয়োজনে……
–আচ্ছা! তাই?
–হ্যাঁ। নিজের সম্মান নিজের কাছে রাখবেন প্রণবাবু। এখন সম্মান নিয়ে দয়া করে বাড়ি ফিরে যান। কাল আপনার সঙ্গে কথা বলব অফিসে। আর আপনি যদি তৃষার সঙ্গে কথা বলতে চান এবং তৃষাও বলতে চায় আপনার সঙ্গে তাহলে কাল এখানেই এসে কথা বলবেন।
তৃষা বলল, আমার আর কোনো কথা নেই ওর সঙ্গে।
–কথা নেই?
খুব অবাক ও ব্যথিত গলায় বলল প্রণত!
–না। নেই।
বলেই তৃষা ভেতরে চলে গেল।
ঋক বলল, গাড়িটা দেখে ব্যাক করবেন, একটা গাড়া আছে রাস্তার ডানপাশে।
তারপর বলল, গরিবের সাইকেলটা না ভাঙলেও পারতেন।
প্রণত পুরো ব্যাপারটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না তখনও। যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। হাত তুলল ও। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, গুড নাইট।
ঋক বলল, গুড নাইট। সাবধানে যাবেন। আস্তে। রাস্তা ভালো নয়। তা ছাড়া কুয়াশা হয়েছে খুব।
প্ৰণত উত্তর না দিয়ে গাড়ি ব্যাক করে সত্যিই খুব-ই আস্তে আস্তে চলে গেল। টেইল লাইটের লাল আলোদুটো ক্রমশ ছোটো হয়ে আসতে লাগল। পথ এবং দু-পাশের জঙ্গলকে আলোর বৃত্তে উদ্ভাসিত করে অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা শব্দ করতে করতে খুব-ই আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল। বুশ কেটে গেছে বলে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করছিল গাড়িটা।
–এত আস্তে কেন যাচ্ছে?
তৃষা বলল পাশ থেকে। আসলে, ভাবছে প্রণত। ভাবনার এই তো শুরু। তৃষা বলল।
–আরে তুমি ভেতরে যাও। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এখানে ভীষণ-ই ঠাণ্ডা। তৃষা হাসল। বলল, আমার কিন্তু একটুও লাগছে না।
–চলো।
ভেতরে ঢুকে তৃষা বলল, তোমার বাড়িটাতে কিন্তু একটুও শীত নেই।
ঋক বলল, আছে, আছে। প্রথম দিন এলে সব জায়গাকেই ভালো লাগে। প্রথম প্রথম সব মানুষকেই।
.
০৪.
শীতের রাতের অন্ধকারে এবড়ো-খেবড়ো পথে গাড়ি চালিয়ে মত্ত অবস্থায় যখন বাড়ির দিকে ফিরছিল প্রণত তখন তার মাতলামি প্রায় উবে গেছিল। নিজের ওপর বড়ো ঘেন্না হচ্ছিল ওর। আজ ঋকের মতো একজন সাবঅর্ডিনেট, যে, একদিন ওকে যথোচিত মর্যাদা দিয়েছে, সম্মান করে কথা বলেছে, স্যার স্যার করেছে সবসময়-ই, সে কেমন আশ্চর্য ব্যবহার করল, ওই ঋক-এর মধ্যে যে, এই ঋক ছিল তা কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি আগে। ওই পুরোনো ঘাড় গোঁজা, চোখের জল-ফেলা, নরম অভিমানী তৃষার মধ্যেও যে, এই তৃষা ছিল তাও। কখনো ভাবেনি। একজন মানুষের মধ্যে সত্যিই অনেক মানুষ থাকে। এবং ঠিক কোন সময়ে যে, কোন মানুষটি তার পুরোনো খোলস ছেড়ে ফেলে ঝকঝকে নতুন চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এসে পরিচিতদের চমকে দেয় তা আগের মুহূর্তেও জানা যায় না।
নিজের জন্যে কষ্ট হচ্ছিল প্রণতর। এইসব কিছুর মূলে তার লোভ, এবং অন্য দু-জন মানুষের প্ররোচনা। একজন ম্যানেজার শ্রীবাস্তব। সে এর আগেও কৃপালনী বলে আর এক কলিগের স্ত্রীকেও বশ করেছিল এমনভাবে, কৃপালনীকে দিয়েই। কৃপালনীকে আত্মহত্যা করে মরতে হয় এই মুরাদগঞ্জেই। বাড়ির কম্পাউণ্ডের তেঁতুলগাছ থেকে সে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছিল। আর তার সুন্দরী স্ত্রী অনিতা পাগল হয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। এক-ই লোভ দিখেয়েছিল শ্রীবাস্তব তাকে। তৃষাকে তাকে দিলে প্রণতকে ম্যানেজার করে দিয়ে সে লক্ষৌ বা এলাহাবাদে চলে যাবে। প্রণত তখন মা আর বোনকে নিয়ে আসতে পারবে নিজের কাছে। মাইনে বাড়বে তিনগুণ।ক্ষমতা। ঘুস। বোনটার মাথার চিকিৎসা করানো দরকার। বাড়ি ছেড়ে নাকি আজকাল পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গা থেকে শাড়ি খুলে যায়। গরিব পাড়ায়ও খারাপ লোকের অভাব নেই। একবার তো এক শেঠ ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে খারাপ পাড়ায় নিয়ে গিয়ে তোলবার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু ও কী করবে? যা মাইনে পায় তাতে নিজের-ই ভালো করে চলে না। তার ওপর স্ট্যাটাস বাড়িয়ে ফেলে এখন ছুঁচোর হাতি গেলার অবস্থা। ভালো করে চলা মানে, এমন বাড়িতে থেকে, গাড়ি চড়ে, প্রতিসন্ধ্যায় মদ খেয়ে, শনিবার রবিবার তিনপাত্তি খরচ করে, তার জামাকাপড়, ঠাট-বাট, মালি, মুঙ্গলীর মাইনে সব নিয়ে যা খরচ পড়ে তা ঘুস না পেলে মেটানো যায় না। আর এই ঘুস যা খায় তার অর্ধেকটা তুলে দিতে হয় শ্রীবাস্তবের হাতে। কারণ তার অজ্ঞাতসারে ঘুস খেলে চাকরিটাই চলে যেত অনেকদিন আগে। তারপর মুঙ্গলী যা মাইনে পায় সেটাই তো সব নয়। মাসে চার-পাঁচশো টাকা ওকেও ধরে দিতে হয়। অভাবের সংসার। অকর্মণ্য স্বামী। কিছু টাকা প্রতিমাসে দিতে হয় বৃন্দার মা বাবাকেও। বৃন্দার মা-ই নষ্ট করেছে সবচেয়ে প্রথম তরুণ আদর্শবাদী অতি অল্পে সন্তুষ্ট এই প্রণতকে। প্রণত এরকম ছিল না। সুন্দরী মাথা মোটা, কিন্তু চরম দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন বৃন্দাকে পোষা সাপের মতো লেলিয়ে দিয়েছিল বৃন্দার-মা একজন যুবকের তারুণ্য, সততা, চরিত্র সব সুন্দর স্বপ্ন চিবিয়ে খাওয়াতে। শরীর বড়ো সাংঘাতিক। বিশেষ করে পুরুষের শরীর। এবং একটা বয়সে শরীরের দাস হয়ে কত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, সর্বার্থে চমৎকার মানুষ-ই যে, নিজেকে কত কুকর্মের শরিক করে তোলে, নিজেকে কীভাবে নষ্ট করে ফেলে, তার প্রমাণ প্রণত নিজে। প্রণতর সঙ্গেই হয়তো বিয়ে হত বৃন্দার। মানে না করে উপায় থাকত না। এমন সময় প্রণতর চেয়ে এমনকী শ্রীবাস্তবের চেয়েও ভালো মুরগি পেল বৃন্দার মা, তৃষার ছোটোমামা কুভলু যখন ফুর্তি করতে এল পাটনাতে। প্রণত, শ্রীবাস্তব সব তখন পাটনাতেই পোস্টেড ছিল। বৃন্দার বিয়ের পর বৃন্দা বুঝেছিল যে, কোনোক্রমে কুভলুকে ছেড়ে ও বাড়ির সবচেয়ে সচ্ছল, বিপত্নীক, উদার, একা মেজোমামা, বিপ্রদাসকে একবার হাত করতে পারলে বাকি জীবনে আর কিছু চাইবার থাকবে না। আর পুরুষের চরিত্র যতই লখিন্দরের বাসরঘরের মতো লোহা দিয়ে নিচ্ছিদ্র করে তৈরি হোক-না-কেন তাতে সাপের প্রবেশ করার মতো উপায়ও থাকে। সবসময়ই থাকে। বৃন্দার মতো কিছু মেয়ে জানে যে, সংসারে অসম্ভব বলে কিছুই নেই এবং পুরুষমাত্রই কাঁচের বাসনের চেয়েও বেশি ভঙ্গুর। উপোসি। নিজেদের গাম্ভীর্যর আর ব্যক্তিত্বর মুখোশ পরে কোনোক্রমে নিজেদের বাঁচিয়ে ফেরে তারা। যে, পুরুষ বাইরে থেকে যত রাশভারী, যত গম্ভীর, যত চরিত্রবান, সে ভেতরে আসলে ততই ঠুনকো। খারাপ মেয়ে বৃন্দাকে তার খারাপতর মা এসব সহজ পাঠ যৌবনারম্ভের সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে রেখেছিল। বেড়ালে যেমন করে ইঁদুর ধরে তেমন করে খেলিয়ে এইসব শিকার ধরতে হয়। সময় লাগে, ধৈর্য লাগে। কিন্তু জেদ থাকলে ধরা নিশ্চয়ই যায় কোনো-না-কোনো সময়ে।
তৃষার মেজোমামার সবচেয়ে আদরের পাত্র ছিল মা-মরা তৃষা। সকলেই জানত যে, মেজোমামা বিপ্রদাসের সব সম্পত্তি নিঃসন্তান তিনি তৃষাকেই দিয়ে যাবেন। সুতরাং, তৃষাকে সরিয়ে দেওয়াই শুধু নয়, তৃষাকে হয় পাগল প্রতিপন্ন করা, নয় একেবারে পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়ার চক্রান্তে বৃন্দা লিপ্ত হয়েছিল শ্রীবাস্তব আর প্রণতর সঙ্গে, তৃষার বন্দোবস্ত করতে করতে বৃন্দা নিজেই বিপ্রদাসকে কবজা করে তার অঙ্কশায়িনী হতে যে, পারবে সে-বিশ্বাস বৃন্দার ছিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষেরা এসব ব্যাপারে বড়ো অসহায় হয়ে পড়ে। একটু কার্নিক মারলেইে তাদের ঘুড়ি ভো-কাট্টা হয়ে যায়। ছেনালি এবং কামকেলির সবরকম কলাই তার রপ্ত ছিল। কীভাবে শিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রলোকের মেয়েরা স্ত্রী হিসেবে স্বামীদের অনেকভাবে বঞ্চিত করে রেখে স্বামীদের হারায় তা বৃন্দা জানত। এবং সেইসব মেয়ের অপূর্ণতাই ছিল বৃন্দার পূর্ণ হওয়ার সুযোগ। পুরুষমাত্রই জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যন্ত আদিম, গুহামানব এখনও। সেই ক্ষণিক গুহামানবের সঙ্গে গুহামানবী হয়ে খেলতে না পারলে পুরুষের মধ্যে ধীরে ধীরে একধরনের অবসন্নতা, ক্লান্তি, বিরক্তি, একঘেয়েমি জমে ওঠে যা পরে তাকে তিল তিল করে ফুরিয়ে দেয়। জীবনের কিছু কিছু আপাতস্থূল ব্যাপার থাকে, যা সমস্ত সূক্ষ্মতার ধারক ও বাহক। একথা যে-পুরুষ ও নারী না বোঝে তারা একদিন মর্মান্তিকভাবে ঠকে যায়। আর যখন বোঝে তখন বড়ো দেরি হয়ে যায়।
বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। অন্য অনেক অবাস্তব ভাবনাতে ডুবে গেছিল প্রণত। পাঁচ-মাইল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিল বোধ হয়। অনেকদূর অবধি চলে গেছিল মনে মনে। বাড়িতে গাড়িটা ঢোকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তৃষা নেই অথচ বেডরুমের বেডসাইড ল্যাম্প দুটো হালকা হলুদরঙা শেডের নীচে জ্বলছে। যেমন রোজ জ্বলে। এমনটি ও চায়নি আসলে। নিজেকে যে, কোন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে সেকথা ভেবে বড়ো ঘেন্না হল ওর নিজের ওপর। গাড়িটা গ্যারাজ করল। গাড়িটাও তৃষার মেজোমামার দেওয়া।
আর রাতে ঋকের সাইকেলটা অমন করে ভাঙা একদমই উচিত হয়নি প্রণতর। বুঝল ও লজ্জা হল। এই ঋককে দেখে ওর নিজের কথা মনে পড়ে যায়। চাকরিতে ঢোকার দু-বছর অবধি ও-ও ঠিক ঋক-এর মতোই ছিল। সরল, আদর্শবাদী। ঋক আজকে যখন লাঠিটা দেখিয়েছিল প্রণতকে, তখন প্রণতর মনে যেমন আঘাত লেগেছিল, যতখানি অপমানিত হয়েছিল ও ঠিক ততখানি আনন্দিতও হয়েছিল। ওর হঠাৎ-ই মনে হয়েছিল এই প্রণতর সামনে পুরোনো প্রণত দাঁড়িয়ে আছে যেন।
গাড়িটা লক করে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। দু-চোখ জলে ভরে এল প্রণতর। বড়ো শীত করছে আজ। পুরোনো দিনের ভালোতর, স্বাভাবিকতর উষ্ণতার দাঁড়ে ফিরে যেতে চাইছে যেন অনেকদিন জলে-থাকা কোনো উভচর পাখি। কিন্তু তার জন্যে কোনো গাছ নেই, ডাল নেই। নিজে হাতে সেই উষ্ণতার স্থলের আশ্রয় সে-ই ছিন্নভিন্ন করেছে।
জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে ভাবছিল প্রণত যেকোনো মানুষ-ই বোধ হয় জন্ম থেকেই খারাপ হয় না। তাকে তার পরিবেশ, তার পরিজন, তার বন্ধুবান্ধব, তার পরিচিতির মন্ডলী এবং আরও পরে তার চামচেরা তাকে খারাপ করে দেয়। তার জীবনসঙ্গিনী অথবা সঙ্গীও করে। একজন মানুষের অতিবড়ো হওয়ার লোভের মধ্যেই বোধ হয় তার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বীজ নিহিত থাকে, তা সে যতবড়ো অর্থবান, ক্ষমতাবান বা যশস্বী যাই হতে চাক না কেন। আসলে যার বীজ যেমন, জীবনে ফল তেমন-ই হয়। তার চেয়ে বড়ো হতে চাইলে সেটা হয়ে যায় খোদার ওপর খোদকারি। সেই বড়োত্ব থাকে না বেশিদিন। প্রথম থেকেই ও খারাপ ছিল না বলেই আজকে প্রণত তা বুঝতে পারছে। বড়ো অসহায় লাগছে।
মুঙ্গলীর ঘরে তখনও আলো জ্বলছিল। এই মেয়েটিকে সে নষ্ট করেছে, মুঙ্গলী তাকে নষ্ট করেনি। তবে নষ্ট করেছে বলবে কেন? এ পৃথিবীর সব সম্পর্কই লেনদেন-এর। মুঙ্গলী অনেক নিয়েছে তার কাছ থেকে। প্রতিমাসেই নেয়। তার বদলে ও যা দেয়, তারজন্যে খুব একটা অপরাধবোধ করে না প্রণত। ঋক ঠিক-ই বলে অ্যাকাউন্ট্যান্সির বাড়া সায়ান্স নেই। একটা ডেবিট হলেই একটা ক্রেডিট হতে হবে।
প্রণত ডাকল, মুঙ্গলী।
মুঙ্গলী ওর র্যাপার জড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে এল।
প্রণত বলল, শিগগির আয়, ঢাক লেপের নীচে। শীত করছে আমার। ওরা দুজনেই জানে যে, একে আদর বলে না। আদর করা কাকে বলে তা কোনোদিন শেখার অবসর-ই হয়নি প্রণতর।
ভয় পেয়েছিল আসলে প্রণত। নানারকম ভয়। অপমান তো আছেই। আজ মুঙ্গলীকে আদর করতে করতে নিজের প্রতি ঘেন্নায় প্রণতর দু-চোখ জলে ভরে এল। মুঙ্গলীরও তাই। তবে দু-জনের কারণগুলো বিভিন্ন।
ঋক তাকে আজ লাঠি দেখাল বলেই, সে মাথা নীচু করে ফিরে এল! দুপুরে রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকেও সে ভীরুর মতো মাথা নীচু করে ফিরে এসেছিল। ওরা বলেছিল ঘৃণার সঙ্গে, ডরপোক। একজন গাড়িওয়ালা মানুষের সঙ্গে পথের রিকশাওয়ালার এরকম ব্যবহার আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগে ভাবা পর্যন্ত যেত না। তখন যে-লোকই গাড়ি চড়ত সে সমাজে সম্মানিত ছিল। তার গাড়ি তাকে কোনো বিশেষ সম্মান দিত না। কিন্তু সকলেই জানত যে, গাড়ি যে-মানুষ চড়ে তার সম্মান পাওয়ার মতো অন্য গুণপনা নিশ্চয়ই আছে। আজকে চোর, বদমাশ, অশিক্ষিত, ব্যাবসাদার, মেরুদন্ডহীন অসৎ চাকুরে, স্মাগলার সকলের-ই গাড়ি আছে। তাই গাড়িচড়া লোকদের সম্মান করা তত দূরের কথা সাধারণ মানুষে আজকার তাদের অসম্মান-ই করে। আর যাঁরা সত্যিই সম্মানিত তারাই পড়েন মুশকিলে। প্রণত জানে যে, সে সম্মানের যোগ্য নয়। আজকে রিকশাওয়ালাদের সামনে তার ব্যবহার রিকশাওয়ালাদের ভবিষ্যতে গাড়িচড়া মানুষদের প্রতি আরও দুর্বিনীত করে তুলবে যে, সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত।
মুঙ্গলী চলে গেল। শরীরের গ্লানি, উত্তাপ অথবা শীতার্ততা ক্লান্তি অপনোদিত হল ঠিক-ই কিন্তু প্রণতর মনের মধ্যে আজকে ঝড় চলছে। বৃন্দার কথায় আর তার নিজের অসীম লোভে সে তৃষার জীবন তো নষ্ট করলই নিজের জীবনটাও নষ্ট করল।
ঘুম এল না। ও উঠে বসে চিঠি লেখার প্যাড ও কলম নিয়ে এল। কে জানে বৃন্দার কোনো চিঠি তৃষার হাতে পড়েছে কি না! খুলে যদি পড়ে থাকে, তবে তো কিছুই আর জানতে বাকি নেই। তবে বৃন্দা প্রতিচিঠিতে নম্বর দিত প্রণতর বিয়ের পর থেকে। যাতে কোনো চিঠি মিসপ্লেসড হলে প্রণত বুঝতে পারে। কোনো চিঠি তো মিসপ্লেসড হয়নি!
অনেকক্ষণ কলম কামড়ে তারপর প্রণত লিখল,
মুরাদগঞ্জ
তৃষা, মাই ডার্লিং,
আমি যাহা করিয়াছি তাহার জন্য আমি অত্যন্ত অনুতপ্ত। প্লিজ আমাকে শেষবারের মতো ক্ষমা করিয়ো।
যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ভুলিয়া গিয়া সবকিছু আবার নতুন করিয়া শুরু কি করা যায় না? আমাকে শেষবার সুযোগ দিয়া দ্যাখো। প্লিজ।
তোমাকে আমার অনেক কিছুই বলিবার আছে। আমি অনেকপ্রকার অন্যায় করিয়াছি। তোমাকে সবকিছুই বলিব। কিছুমাত্রই বাকি না রাখিয়া। আমার অপরাধ স্বীকার করার পরও তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না করো তাহা হইলে আমি তোমাকে জোর করিব না। তোমার জীবন হইতে মুছিয়া যাইব।
মালির হাতে এই চিঠি পাঠাইতেছি। মালির হাতেই উত্তর দিবে। উত্তর পাইবামাত্র আমি গিয়া তোমার-ই গাড়ি করিয়া তোমাকে লইয়া আসিব।
–ইতি ক্ষমাপ্রার্থী প্রণত
পুনশ্চ-তোমাকে আমি আমার মতো করিয়াই ভালোবাসিয়াছিলাম, এইবারে তোমার মতো করিয়া, মানে তুমি ভালোবাসা বলিতে যাহা বোঝো, তেমন করিয়াই ভালোবাসিব। যদি সুযোগ দাও।