Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উদ্বাসন কাব্য || Swapnamoy Chakraborty

উদ্বাসন কাব্য || Swapnamoy Chakraborty

১৯৭৯ সালের বসন্তকালে অবশেষে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলল কমল মুখার্জির বাড়িতে। রান্নাঘরেও একটা বাল্‌ব। কনকলতা ভেবেছিলেন রান্নাঘরে বোধহয় ডুম দেবে না। কারণ, ওটা ‘রান্নাঘর’ তো। খাওয়া ছাড়া পুরুষদের ওই ঘর লাগে না। রান্নাঘরেও ডুম আসাতে খুব খুশি কনকলতা। ঘরের বাঁশের খুঁটিতে কাঠের বোর্ড বসিয়ে এখানে কালো রং-এর গোল গোল সুইচ। টুনি আর আওয়া সুইচটা বারবার জ্বালাচ্ছিল আর নেভাচ্ছিল। দেবু ছোট ও জানে পুরুষ সন্তান, সুতরাং বুঝে নিয়েছে সংসারে কর্তৃত্ব করতে হবে ওকে। বলে, দিদি আলটাবিনা, আলটাবিনা, লাইট খারাপ হলে কিন্তু আমি জানি না। টুনি ওর পাকা পাকা কথা শুনে হাসে। আরও বেশি করে সুইচ অফ-অন করে। আজ খুশির দিন। পাশের দুই বাড়িতেই সেই কবে থেকে ইলেকট্রিক এসেছে, মুখার্জি বাড়িতেই আসেনি। আজ মুখার্জি বাড়ির পাশে রাস্তাটার ওপারের বিশ্বাসবাড়িতেও এসেছে। বড় ঘরটার দু’পাশে দুটো ডুম। দুটো সুইচ। আর একটা কালো জিনিস, তাতে তিনটে ছোট গর্ত। হাবুলদা বলে গেছে ওই গর্তের মধ্যে যেন কক্ষনো কিছু না ঢোকানো হয়। ওটা কী কাজে লাগবে কনক ঠিক জানে না। যদি শিবু থাকত, শিবু সব বুঝত।

বেলা বারোটা নাগাদ হাবুল চলে গেছে। এখন একটা বেজে গেছে। কমলবাবু কাজে চলে গেছেন। কনকলতা রান্নাঘরে। হাতে খুন্তি, কড়াইতে কচুর শাক নাড়ছেন। আসলে চিঠি লিখছেন। কালো কচুর শাকের গায়ে খুন্তির নাড়াচাড়ায় শিবুকে চিঠি। শিবু, আলো আইছেরে ঘরে, ইলেকট্রিকের। তুই হ্যারিকেনের আলোয় কত কষ্ট কইরা পড়ছস। তুই অখন আছস কেমন? কে তোরে রাইন্ধা দেয়? অখন আমি কচুর শাক পাক করতাছি। তুই কত কচুর শাক ভালবাসিস। তুই যাইবার পরে কচুর শাক পাক করি নাই। আইজ উপায় নাই, তরিতরকারি কিছুই নাই, তাই ক’টা কচু গাছ উঠাইয়া পাক করলাম। কচুর শাকের গায়ে খুন্তি টেনে শেষ লাইনটা কেটে দেয় কনকপ্রভা। ঘরের অভাবের কথা বলে ছেলেকে বিব্রত করা উচিত হবে না।

আজ বৃহস্পতিবার। কচুর শাকটা জাল দিয়ে দুটো দিন রেখে দেবে কনকপ্রভা। শনিবার শিবু আসতে পারে। গত শনিবার আসেনি, তার আগের শনিবার এসছিল। লণ্ঠনের আলো ডিম করে রেখে অনেক রাত অব্দি গল্প করেছে।

হেমকান্ত উপরের কাঁড় থেকে টিনের সুটকেসটা নামিয়ে দিতে বললেন দেবুকে। দেবু নামিয়ে দিল। ওটাকে সুটকেস বলেন কেন কে জানে, ওটা তো একটা টিনের বাক্স। হেমকান্ত যে তক্তাপোষটার উপর শোন, তার পাশেই বাঁশের খুঁটিতে একটা বাল্‌ব লাগানো হয়েছে। হেমকান্ত পড়াশুনো করতে ভালবাসেন। একটা আতস কাচ রয়েছে তাঁর, ওই আতস কাচ চোখের কাছে রেখে পড়েন-টড়েন। কিছুদিন আগে একটা পুরনো শারদ সংখ্যা পেয়েছিলেন, সম্ভবত শিবুই এনেছিল। মলাট ছিল না। আতস কাচ চোখের সামনে রেখে সমরেশ বসুর ‘বিবর’ পড়ছিলেন আর গাল দিচ্ছিলেন এইডা সাহিত্য? হুঃ। অশ্লীল। অশ্লীল। তবু পড়ছিলেন। হেমকান্তর ধারণায় রবীন্দ্রনাথও ‘অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট’। স্তন, চুম্বন, ইত্যাদি হেডিং দিয়া কবিতা ল্যাখে! ছিঃ। কবি হইলেন গিয়া নবীন সেন। পোহাইল বিভাবরী পলাশি প্রাঙ্গণে, পোহাইল যবনের সুখের রজনী।’ আহা! আহা!

হেমকান্ত বাক্সটার ধুলো ঝাড়লেন। একটা কৌটো খুললেন, কৌটোর ভিতরে চাবি। চাবিটা দিয়ে বাক্সটা খুললেন। ভিতরে হলুদ হলুদ কাগজপত্র। বইটই। বাক্সটার ডালা বন্ধ করলেন হেমকান্ত। তক্তাপোষের তলায় আর একটা বাক্স আছে হেমকান্তর। ওখানে থাকে টাকাপয়সা। কমল সংসার খরচা ওর বাবার কাছেই দিয়ে দেয়। এ ছাড়া হেমকান্ত পেনশনও পেয়ে থাকেন। ছত্রিশ টাকা। এ ছাড়া ওই বাক্সে একটা কৌটোয় থাকে তালমিছরির টুকরো। হেমকান্ত মাঝে মাঝে কৌটোটি খুলে তালমিছরি মুখে দিয়ে চোষেন। দেবু যখন আরও ছোট ছিল, মাঝে মাঝে দু-এক টুকরো পেত। শিবুর একদিন খুব টাকার দরকার হয়েছিল। দুটো টাকা ঝুমুর চেয়েছিল। বাক্সটা খুলেছিল দুপুরবেলায় চুপিচুপি। মাত্র চারটি এক টাকার নোট ছিল। মাসের সেদিন তেইশ বা চব্বিশ হবে। কিছু নেওয়া যায় না এখান থেকে। বাক্স ঘাঁটলে একটা রুমালে বাঁধা কয়েকটি রুপোর টাকা। এটা থাক! এটা থাক! আরও গভীরে কী লুকোনো কিছু নেই! খুঁজতে গিয়ে একটা বই পেয়ে গিয়েছিল শিবু। ‘নরনারীর যৌন প্রভেদ’। প্রচ্ছদে ভেনাস। এখন সে কথা থাক।

হেমকান্ত দেবুর পেড়ে দেওয়া সুটকেসটির উপর একটা কিল মারলেন। ঠং শব্দ। হেমকান্তর উচ্ছ্বাস। বললেন, তা হইলে শ্যাষম্যাষ রিফিউজি ঘরেও বিজলি বাতি আইল? আমাদের দ্যাশের বাড়িতে ছিল না। পাকিস্তানে থাকলে কিন্তু বিজলি বাতি ভোগ করতে পারতাম না। বাঁশের খুঁটিটির দিকে তাকালেন হেমকান্ত। তখন আলোটা জ্বলে রয়েছে। হেমকান্ত বললেন, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি। আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।’ এখন দিনেরবেলায় বাত্তি নিভাও। টুনি বলল— এটা মোমের বাতি নয় দাদু, ডুম বাতি, ডুম হেমকান্ত বললেন, মিটারটা বসানো হয়েছে একটা শালের খুঁটিতে। যে আতস কাচটা দিয়ে বিবর পড়েন, হিসেব লেখেন, সেই কাচটা দিয়ে মিটারে চাকার ঘূর্ণন দেখেছেন হেমকান্ত। টুনি লাইটটা নিভিয়ে দেয়। হেমকান্ত বলেন, আসলে এই ঘরটা কিঞ্চিৎ অন্ধকার। জানালাগুলি ছোট। পর্য্যাপ্ত আলো আসতে পারে না। ইলেকট্রিকের আলোর কল্যাণে এই সত্যটা বুঝতে পারলাম। আরও একবার জ্বালো দেখি মা, একটু পরেই নিভাইয়া দিও।

হেমকান্তও ওর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আলো জ্বালার খেলা খেলতে থাকেন। কনকলতা ব্যাপারটা দেখবার জন্য ঘরে এসে দেখল— হেমকান্তর চোখে গামছা বাঁধা। হেমকান্ত চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের তক্তাপোষ থেকে উঠে সুইচ অন করে ডুম জ্বালাতে চলেছেন। শ্বশুরের ব্যাপার-স্যাপার দেখে ঘোমটা দিল কনকলতা, শ্বশুরের চোখ বাঁধা। তবুও, কনকলতা গলা খাটো করে বলল— একখান মুছিব্বত বাধাইবি তোরা, বুড়া পইর‍্যা গেলে কী হইব? মুছিব্বত কথাটা উর্দু। পাকিস্তান থেকে ক্যারি করে এনেছে। কথাটা হেমকান্ত শোনেননি। কানে কম শোনেন তিনি। রান্নাঘরে গিয়ে কনকলতা কচুর শাকের গায়ে আবার লেখে— আজ বাড়িতে বড় আনন্দ।

খাওয়ার সময় হেমকান্ত বলল, রাত্রে আর আমার জন্য খাওয়ন লইয়া ঘরে যাইতে হইব না। আমি রান্নাঘরে আইস্যাই খামু অনে। দুই ঘরের দুই আলোয় উঠানটাও ফক ফইক্যা হইয়া যাইব। টুনি বলে, কখন সন্ধ্যা হবে মা? আজকের সময় কাটে না।

সন্ধে হল। অবশেষে সন্ধের আগেই আলো জ্বালাতে হল। হ্যারিকেনটার দিকে তাকিয়ে হেমকান্ত বললেন, ওই যে ওইটা আমি। বলেই একা একা হাসলেন। বললেন, আর দরকার নাই। কনকলতা বলে উঠল— কে কইল দরকার নাই, যা লোডশেডিং। কনকলতা ধুনো জ্বালাল, ঘরের দরজায় জল ছিটাল, শাঁখ বাজাল, আর হেমকান্ত তাঁর ওই সুটকেস থেকে বের করলেন রিফিউজি সার্টিফিকেট, এনট্রি পাস। বাস্তুহারা পরিষদের ইশ্‌তেহার একটা প্রাচীন নোটবুক, আর একটা বাহাদুর খাতা। বাহাদুর খাতাটা দিন কয়েক আগেই দেবুকে দিয়ে আনিয়েছিলেন হেমকান্ত। মলাটের উপর লিখলেন—॥ উদ্বাসন ॥

ব্যাকেটে লিখলেন মহাকাব্য। প্রথম পৃষ্ঠায় লিখলেন— অমর কাব্য তোমরাও লিখিও বন্ধু যাহারা আছ সুখে। পরের পৃষ্ঠায় লিখলেন— ॥ প্রথম সর্গ ॥ সন ১৯৪৬ ॥

আসিল ক্রিপ্‌স সাহেব ভারত মাটিতে

সুভাষের যুদ্ধ তাঁর রয়েছে স্মৃতিতে

কিছুদিন আগে হল নাবিক বিদ্রোহ

তলোয়ার জাহাজের বীর নাবিকেরা

উপেক্ষা করিয়া সব ব্রিটিশ শাসন

বাজাইল রণ ডংকা। শুরু হ’ল রণ।

লেবার পার্টির মন্ত্রী— অ্যাটনি সাহেব

ভাবিল এইবার, আর দেরি নয়

ভারতেরে দেহ স্বাধীনতা। সেই হেতু ক্রিপ্‌স

আসিল ভারতে।

প্রাদশিক নির্বাচন কিছুকাল আগে হল শেষ

বাংলায় জিতিয়াছে মুসলিম লিগ।

১৬ই অগস্ট হ’ল কলঙ্কের দিন

পাকিস্তান মাগিল জিন্না। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।

তার পরে পাল্টে গেল আমাদের গ্রাম।

বিজলি বাতিতে লিখছেন হেমকান্ত। কনকলতা উলটো দিকের তক্তাপোষে। সবাই বিজলি বাতির রোশনাই উপভোগ করছে।

হেমকান্ত হঠাৎ কনকলতার দিকে তাকালেন। বললেন, বৌমা, সেইদিনের ঘটনাখান একবার কও দেখি। সেই দ্যাশের ঘটনাটা, তুমি আমাদের খিড়কির পুকুরে স্নানে গেছিলা শীতকালে। কমল বোধহয় তখন বরিশালে। তুমি পুকুরে, কয়েকটা ছ্যামরা চিল্লাইয়া উঠল— পাক-পাক-পাক পাকিস্তান…।

কনকলতা ঘোমটা দিলেন। বললেন— সেই কথা অখন ক্যান? অনেক পুরানো কথা। অন্ধকার কথা। হেমকান্ত বলেন- এই আলোয় আমার অন্ধকার কথা দরকার। কও, কও, লাজ কী, য্যান কইছিল হেই ছ্যামড়া গুলাইন? সব লিখা যামু।

কনকলতা মাথা নিচু করে থাকেন।

কও না, কও, আমি জানতাম, ভুইল্যা গেছি গিয়া। তখন সব গ্রামেই এইরকম কথা শুনা যাইত। কনকলতা চুপ।

কিছুক্ষণ বিড়বিড় করেন হেমকান্ত। তারপর বলেন পাক-পাক-পাক পাকিস্তান হিন্দুর ভাতার মোছলমান। পাইছি। পাইছি।।

কনকলতার মনে সেই শীত-সন্ধ্যার কথা। ঋতুস্নান সেরে পুকুর থেকে উঠবে, এমন সময় ওই রব। পাক-পাক-পাক পাকিস্তান…। কনক তখন ভয়ে চুপ। ওই মানুষগুলো কুয়াশায় আর অন্ধকারে অচেনা। আবার পাক-পাক-পাক পাকিস্তান…। অন্য স্বরে হিন্দুর ভাতার মোছলমান। একজন পুকুর পাড় দিয়ে জলে নেবে আসে। বলে, বিবিযান দেরি হইয়া যাইতেছে। পানিতে আর কতক্ষণ থাকবা? শীত লাগে না বুঝি? হাত ধরো। তখনই কনকলতা চিৎকার করে উঠেছিল ভীষণ জোরে। হেমকান্ত সেই আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এসেছিল। ওরা পালিয়ে গিয়েছিল তখন।

রাত আটটা বেজে গেল, কমল এল না। রাগ ধরে না বুঝি? আজকের দিনে কোথায় একটু আগে আগে আসবে। রাগ ধরে কনকলতার। কনকলতা ঘরের ভিতর থেকে উঠানের দিকে চেয়ে দেখে কাঁঠাল গাছটার গায়ে আলো পড়েছে। আলো পড়েছে পায়খানাতলা যাবার পথেও। মুগ্ধ হয়ে আলো দেখে কনকলতা, আলো দেখে টুনি, আওয়া, দেবু। আর আলোর তলায়, তক্তাপোষের উপর জলচৌকি, তাতে কাগজপত্র খুলে রেখেছে হেমকান্ত, যেন রাত্রিবেলা পড়াশুনো না করলেই নয়।

হেমকান্ত বলেন— কলোনিতে দুই বছর আগে যদি কানেকশনটা দিত, শশাঙ্ক ঘোষের পোলাটা মরত না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হ্যারিকেন থাকলে শিখাটা কেঁপে উঠত।

শশাঙ্ক ঘোষের ছেলেটা ছিল শিবুর সমবয়সি। ঘর থেকে রান্নাঘরে যাবার সময় সাপ কামড়েছিল। অন্ধকার ছিল উঠোন।

তখন টুনি অন্য কথা ভাবছিল। অন্য অন্ধকার। সেই অন্ধকার পুরুষ মানুষটির অন্ধকার মুখ। রাস্তায় তখন কোনও আলো ছিল না। রাস্তার টিউবওয়েল থেকে জল পাম্প করছিল। বালতি ছিল কলে। আর অন্ধকার ছিল। হঠাৎই পিছন থেকে কেউ। দুই বুকে দুটো হাত। টিউবওয়েলের শব্দ বন্ধ। ও চিৎকার করার চেষ্টা করতেই ওই হাতের একটা থাবা হয়ে বসে গিয়েছিল টুনির মুখে, আর একটা হাতের আঙুলগুলো সব পোকা হয়ে গিয়েছিল, ঠ্যাং হয়ে গিয়েছিল, শিং হয়ে গিয়েছিল, ছুরি, করাত, বাটালি। টুনির দুটো হাত, রোগা হাত কিছুতেই এ হাতটাকে সরাতে পারছিল না। টুনি পিছনে তাকিয়ে মুখটাও দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু একটা সাপের মতো হাত, আর সাপের ফণার মতো হাতের পাঞ্জা। দূরের একটি সাইকেল ও তার আলোর পরে ওই হাতটা সরে গিয়েছিল।

এক আকাশ অন্ধকার নিয়ে ঘরে গিয়েছিল টুনি। কাউকে বলেনি, কেউ জানে না, শুধু বালতিটা, আর কলটা।

সেই থেকে খুব আলোর শখ টুনির, আলোর ইচ্ছে। প্রায়ই বলত কলোনিতে কবে লাইট আইব গ মা। কনকলতা শুধু ঠোঁটটা উলটে দিত।

টুনিরা দেখেছে— সোদপুরের কত জায়গায় ইলেকট্রিক এসে গেছে। স্টেশন রাস্তাটা তো কবে থেকেই ঝলমল। রবীন্দ্রপথ, প্রফেসর পল্লি, অঞ্জনগড় সব জায়গায় ইলেকট্রিক শুধু কলোনিগুলিতে নেই।

আসলে কলোনিগুলোতে বিদ্যুৎ দিতে অনেক অসুবিধে ছিল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের। কলোনিগুলো তো বৈধই নয়। এই মহাজাতি নগর কলোনি যেমন। খাতায়-কলমে এই জমি চৌধুরিদের। এখানে যদি ট্রান্সফর্মার বসাতে হয়, পোস্ট বসাতে হয়, খাতায়কলমে চৌধুরিদেরই তো জানাতে হবে। উন্নয়ন কমিটি অনেকদিন চেষ্টা করেও বিদ্যুৎ নিয়ে আসতে পারেনি কলোনিতে। অবশেষে এল বছর দুয়েক আগে। এই মুখার্জি বাড়িতেই একটু দেরি হয়ে গেল আর কী।

বাইরের উঠোনে পাতা মাড়ানোর শব্দ পেয়ে কনকলতা বলে, এতক্ষণে এলে, কেউ সাড়া দেয় না। উঠোনে গড়ানো আলোয় দেখে কুকুর।

কমল আজ ইচ্ছে করেই একটু রাত করছিল। কমল কাজ করে হাটখোলার দত্তদের বাড়িতে। সেরেস্তার কাজ। মূল কাজ বাড়িভাড়া আদায়। দত্তদের অনেক বাড়ি আছে কলকাতায়। কমল ঘুরে ঘুরে বাড়িভাড়া আদায় করে। ভাড়া আদায় করতে বাড়ি বাড়ি যাওয়াকে বলে তাগাদায় যাওয়া। তাগাদায় যাওয়া ছাড়াও আরও কাজ আছে কমলের। বাড়িভাড়ার হিসেব করে তার অংশ আলাদা আলাদা শরিকদের ভাগে জমা করা, ভাড়াটেদের সঙ্গে যে ক’টা মোকদ্দমা চলছে, তার তত্ত্বতালাশ করা, তা ছাড়া বাবুদের ইলেকট্রিক বিলগুলো জমা দেওয়া, যে-বাবুদের টেলিফোন আছে, তাদের বিলগুলো জমা দেওয়া, দরকার মতো রেলের টিকিট কেটে দেওয়া, বাবুদের সিনেমার টিকিটও। বউদিরাও চাকরদের দিয়ে চিরকুট পাঠায় মাঝে মধ্যে। এই পরশু দিনই মেজ বাড়ির চাকর একটা চিঠি নিয়ে এল— মুখার্জিবাবু, ঝটুর হাতে দশ টাকা পাঠালাম। ছোটিসি মুলাকাতের চারটি টিকিট কাটিয়ে রাখবেন, কাল তিনটে-ছটা। দুপুরবেলা গিয়ে ঝটু টিকিট নিয়ে নেবে। কারুক্কে বলবেন না। কাল আড়াইটের সময় দুটো রিকশা আনিয়ে রাখবেন।

চিঠিটা পড়ে কমল ঝটুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। ঝটু বাবুদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। কিন্তু কমলের চোখের দিকে তাকিয়েই ছোট করে চোখ মারল। বলল, উত্তম-বৈজয়ন্তীমালা। এইসব সম্মান-টম্মান নিয়ে কমল মাথা ঘামায় না। ওর মায়ের কাছে একটা প্রবাদ শুনত— শালগ্রাম চিবাইয়া খাইলাম চালতায় ডর করে না। কত রকমের কত অপমান সয়েছে কমল। এসব তো কিছু না। কমলকে টিকিট কাটতে বলা হয়েছে কিন্তু কোন হল-এ বলা হয়নি, খবরের কাগজ দেখে হল জেনে নেয়, তারপর লাইন দিয়ে টিকিট কাটে।

দত্তবাড়ির সেরেস্তায় চাকরি করার আগে কমল কাজ করত পণ্ডিত রমেশচন্দ্র জ্যোতির্ভূষণের কাছে। তারও আগে, মানে দেশের বাড়িতে চাকরি করত চৌধুরিদের সেরেস্তায়। দত্তপাড়ার চৌধুরিরা ছিল জমিদার। জমিদারদের ছেলেরা সবাই হেমকান্তর ছাত্র। হেমকান্ত জিলাস্কুলের হেড পণ্ডিত। হেমকান্তর অনুরোধেই সেরেস্তায় একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছিল কমলের। বামুনবাড়ির ছেলে বিষয়-আশয় ভাল বোঝে না, কিন্তু ওদের নায়েব ন কড়ি মিত্র কাজ শিখিয়েছিলেন কমলকে। চৌধুরিদের সেরেস্তাতেই দলিল, পরচা, খতিয়ানে হাতেখড়ি। কারা রায়ত, কারা কোর্ফা, কোনটা শিকস্তি জমি, কোনটা পয়স্তি, কোনটা লায়েক পতিত, কোনটা গড়লায়েক পতিত বুঝতে শিখেছিল কমল। মোকরি পত্তনী পাট্টা কাওলা কবুলিয়ত এইসব শব্দগুলির অন্তর্নিহিত অর্থগুলি বুঝেছিল।

দেশ ভাগের পর এদিকে চলে এল কমলরা। চৌধুরিদের জমিদারি এখন শত্রু-সম্পত্তি। নকড়ি নায়েব মারা গিয়েছিলেন রানাঘাট ক্যাম্পে। আর চৌধুরিদের সেজ হিস্যার ছোটছেলের সঙ্গে কয়েক বছর আগে কমলের দেখা হয়েছিল শেয়ালদা স্টেশনে। বলেছিল, একটা সিনেমা হল খুলেছে চাকদায়। নাম দিয়েছে হাসি টকিজ। বলেছিল— এটা সেই ছোট নদীটার নামে। নদীটার নাম হাস্যমুখী। হাস্যমুখী নদীটি এঁকেবেঁকে ফেনিতে পড়েছে। হাস্যমুখী নাকি সিনেমা হলের নাম হয় না। তাই হাসি টকিজ। কমল তখন রমেশ জ্যোতির্ভূষণের কাছে কোনওরকম একটা কম বেতনের চাকরি করে। ছেলেটা বলেছিল, চাকদায় ওই সিনেমা হলে টর্চ লাইট দিয়ে সিট দেখানোর চাকরি দিতে পারে— যদিও একথা বলতে লজ্জা করছে।

কর্মহীন দশায় রমেশ জ্যোতির্ভূষণ দয়া পরবশ হয়েই— তাঁর কাছে রেখেছিলেন। হ্যান্ডবিল ছাপা, হ্যান্ডবিল বিলি করা, আর ওঁর চেম্বারে নাম ডাকা এই ছিল কাজ। রমেশ জ্যোতির্ভূষণ দেশ ভাগের আগেই কলকাতা এসেছিলেন। তাঁর দেশ ছিল নোয়াখালি। হেমকান্তর বিশেষ বান্ধব। তাঁর বাড়িতেও চার-পাঁচটি বাস্তুহারা পরিবার দীর্ঘদিন ছিল। কমলও সারাদিন কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় হ্যান্ডবিল মেরে জ্যোতিষসম্রাটের চেম্বারেই রাত কাটিয়েছে। আসলে কলকাতাটাকে চিনেছে হ্যান্ডবিল মেরেই। আসার সময়ে হ্যান্ডবিলটাই পড়েছে। এখনও মুখস্থ।

অলৌকিক দৈবশক্তি সম্পন্ন ভারতের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ। মহামান্য ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জ মহোদয়ের কোষ্ঠী প্রস্তুতকারক, দেশীয় রাজন্যবর্গ কর্তৃক নিযুক্ত রাজ-জ্যোতিষীদের অগ্রগণ্য, জ্যোতিষপ্রভাকর, নিখিল ভারত জ্যোতিষ মহামণ্ডলের প্রেসিডেন্ট, বিগত ইউরোপীয় মহাযুদ্ধের ফলাফলের নির্ভুল ভবিষ্যত বক্তা। সম্রাট ৮ম এডোয়ার্ডের বিবাহ ও সিংহাসন ত্যাগের ভবিষ্যত বক্তা, জওহরলাল নেহরু ও আয়ুব খাঁয়ের কোষ্ঠী প্রস্তুতকারক, দমদম সেন্ট্রাল জেলের ধর্মোপদেশক জ্যোতিষ সম্রাট রমেশচন্দ্র জ্যোতির্ভূষণ সামুদ্রিক রত্ন এম আর এস (লন্ডন) মানব কল্যাণার্থে এখন প্রতিদিন চেম্বার করিতেছেন…।

এখানেই, এই চেম্বারেই গিলে পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি পরা নারায়ণ দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয়। নারায়ণবাবু ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে কমলের হাতে একটা টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিল আমার নামটা আগে ডেকে দিয়ো ভাই। বড্ড তাড়া আছে। কমল টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল এইভাবে হয় না। আমি ঠিকই ডেকে দিব। তখন, ১৯৬০ সালে এক টাকায় দেড় সের দুধ কিংবা দু’ কিলো মোটা চাল পাওয়া যেত। কমল নারায়ণ দত্তকে একটু আগেই ডেকে দিয়েছিল। চেম্বারে ঢোকার সময় নারায়ণ দত্ত কমলকে একটা ঠাংকু ছুড়ে দিয়েছিল। দত্তবাবুর মুখে পান ছিল। চেম্বারে ভিতরে পিকদানি থাকে। জ্যোতির্ভূষণ মশাইও খুব পান খেতেন। চেম্বারের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকলে অনেক কথাবার্তা শোনা যায়। নারায়ণ দত্ত ওঁর সমস্যার কথা বলছিলেন। এক্কেবারে শান্তি নেইকো ঠাকুরমশাই, জেরবার হয়ে গেলুম। যে ভাইপোদের কোলেপিঠে করে মানুষ করলুম ওরাই বাঁশ দিচ্ছে। একটা বাগানবাড়ি, বুঝলেন বহু সালের কেনা…

বাগানবাড়ি শুনেই বুকটা ধক করে ওঠে কমলের। রিফিউজিরা দখল করেনি তো? করলে বড্ড লজ্জা করবে কমলের।

না, রিফিউজিরা নয়। এই বাগানবাড়িটা বাঁশবেড়িয়াতে। ওদিকে রিফিউজিরা ধাওয়া করেনি। দখল করে রেখেছে নারায়ণবাবুর এক ভাইপো। এখন তাঁর প্রশ্ন কবে দিনক্ষণ ভাল, মামলা ফাইল করবে। আর কোষ্ঠী দেখে বলে দিতে হবে এখন সময়টা কেমন। মামলা করলে জিতবে কি না। জ্যোতির্ভূষণ গণনা করে বললেন—এখন সময় ভাল নয়। আপোষে মিটিয়ে নেওয়াই ভাল। পরের কথাবার্তা একটু নিচু গলায়। আরেকটা ব্যাপার ঠাকুরমশাই, একটা মেয়েছেলের কাছে যাই মাঝে মাঝে, ওকে রাখতে চাইছিলুম, ওর ভাইটাই আছে। যদি একটা বাড়িতে নিয়ে রাখি, ও কি সম্পত্তিটা ক্লেইম করবে? জ্যোতিভূষণ বললেন— ওই মহিলার কোষ্ঠী না দেইখ্যা কিছু বলা সম্ভব নয়।

নারায়ণ দত্ত বললেন— আমার ছক দেখে হবে না? জ্যোতির্ভূষণ বললেন ওই জাতিকার জন্মতারিখ নিয়া আর একদিন আসেন। নারায়ণ দত্ত বললেন— ওদের কি আর জন্মতারিখ জানা যাবে? জ্যোতির্ভুষণ বললেন— তা হলে ওকেই নিয়া আসেন হস্তরেখা দেখা দরকার। আমি ওই জাতিকার স্বভাব-চরিত্র সবই বলে দেব।

কমলের খুব বলতে ইচ্ছে করল— এইসব পরামর্শ দেয় উকিল। জ্যোতিষী নয়। কিন্তু বলা উচিত মনে হল না। বেরোবার সময় ওই নারায়ণ দত্ত কমলের দিকে একবার তাকাল। ওই দৃষ্টির মধ্যে বেশ একটা কৃতজ্ঞতা ছিল। লোকটা কমলের দিকে চেয়ে একটু হাসল। যেন বন্ধু। একটা টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে বলে এতটা? কমলও ওর দৃষ্টিতে একটা উত্তর দিল। কলকাতার বনেদি বড়লোকের সঙ্গে এক রিফিউজির অসম দৃষ্টি বিনিময়। কমল হঠাৎ বলেই ফেলল— একটা কবুলিয়ৎ করায়ে ন্যান, তা হলে আর কোনও ক্লেম থাকব না। নারায়ণ দত্ত একজন জ্যোতিষীর রুম-বেয়ারার কাছ থেকে এরকম কথা আশা করেনি। বড়জোর একটা বিপত্তারিনী-কবচ ধারণ করুন গোছের কিছু বলতে পারত, কিন্তু এ যে আইনি উপদেশ। নারায়ণ দত্ত ওকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। বলে, এসব কবুলিয়ৎ-টবুলিয়ৎ সম্পর্কে কী করে জানো? কমল বলে, আমি স্যারেস্তায় কাজ করতাম।…

তারপর নারায়ণ দত্তের সঙ্গে আরও দু-তিন বার দেখা হয়েছে। দৃষ্টি ও হাস্য বিনিময় হয়েছে। একদিন নারায়ণবাবুই কমলকে বললেন— আমার সেরেস্তায় একজন বিশ্বাসী লোক দরকার। কাজ করবে?

অবাক হবার আগেই কমল প্রথম কথাটা বলেছিল— ব্যাতন?

নারায়ণবাবু বলেছিলেন, এখানে যত পাও তার চে বেশিই দেব। দ্যাখো সম্পত্তির ব্যাপার। টাকাপয়সা নিয়ে নাড়াচাড়া। এক টাকা ঘুষ তুমি নাওনি, ফিরিয়ে দিয়েছিলে কিন্তু বেশি টাকা ঘুষ ফিরিয়ে দিতে পারবে তো!

কমল বলেছিল, ঈশ্বর যদি দুর্মতি না দেয়…।

রমেশ জ্যোতির্ভূষণ বলেছিলেন, নিশ্চই, নিশ্চই। নিজে উপযাজক হইয়া যখন কাজ প্রদান করতাছে, নিশ্চই গ্রহণ করো। আমি তোমারে ছাইড়া দিলাম।

অসময়ে রমেশ জ্যোতির্ভূষণ কমলদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। রমেশ বেতন ছাড়াও মাঝে মধ্যে চার আনা আট আনা দিতেন। বাড়ি থেকে ফল নিয়ে আসতেন রমেশ। কমল সেই ফল ছুরি দিয়া কেটে রিকাবে সাজিয়ে দিত। আপেলের টুকরো, দু-একটা আঙুর, কিংবা একটা মর্তমান কলা কমলও পেত। তখন শিবু খুবই ছোট। সন্তানকে না দিয়ে এই মূল্যবান ফল খেতে খুবই খারাপ লাগত কমলের। দু-একদিন কাটা আপেল পকেটে করে নিয়ে গিয়ে বাড়ি গেছে। বাড়ি গিয়ে দেখেছে সেই কাটা আপেল কালো হয়ে গেছে।

রমেশ জ্যোতির্ভূষণ অনেক নিজের কথাও বলতেন। অনেক কিছুই জেনেছিল রমেশের কাছে। যেমন ১৫ অগস্টের স্বাধীনতা দিবসের দিন ঘোষণা।

মাউন্টব্যাটেন সাহেব ১৫ অগস্ট দিনটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ভেবেছিলেন, কারণ ঠিক তার দু’ বছর আগেই, ১৯৪৫ সালের ১৫ অগস্ট জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল মিত্র শক্তির কাছে। তখন উনি নেতাদের চিঠি লিখে জানান ১৫ অগস্ট অশুভ দিন। চন্দ্র অশুদ্ধ। বিষযোগাদি দোষ। তবে ১৪ তারিখ শুভ। কিন্তু ১৪ তারিখ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। নেহরুর পরামর্শে তখনই ঠিক হয় তা হলে ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে। বিলিতি মতে সময়টাকে ১৫ অগস্টই বলতে হবে, কিন্তু দেশি মতে ওটা ১৪ তারিখ। সূর্য উঠলে তবে না চন্দ্র অশুদ্ধ হবে। মধ্যরাতে বিষযোগাদিদোষ নেই।

স্বাধীন ভারত তার যাত্রা শুরু করেছিল এভাবে কুসংস্কারের সঙ্গে সমঝোতা করে।

১৪ অগস্ট মাঝরাতে দিল্লির পরিষদ ভবনে স্বাধীনতার উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ভাবগম্ভীর বক্তৃতা দিলেন। কবিতার শব্দ ভরা ছিল তাতে।

বহুকাল আগে নিয়তির কাছে আমার একটি প্রতিশ্রুতি রেখেছিলাম; সম্পূর্ণভাবে না পারলেও সেই প্রতিশ্রুতি আজ বহুলাংশে পূরণ করার সময় এসেছে। মধ্যরাতের ঘণ্টা যখন বাজছে, বিশ্ব সুপ্তিমগ্ন, ভারত তখন জেগে উঠছে জীবন আর স্বাধীনতার কেতন নিয়ে।

এরপর সুচেতা কৃপালনির গলায় বন্দেমাতরম। বরিশালের সেনগুপ্ত বাড়ির মেয়ে সুচেতা। বরিশালের গ্রামের মানুষরা, ওর জ্ঞাতি-আত্মীয়রা শুনতে পেল না। ওর গ্রামের মেয়ের গলার সুমধুর বন্দেমাতরম। এরা তখন পেয়ে গেছে অশনি সংকেত। ধানসিঁড়ি নদীটিকে বিদায় জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

সেদিন, স্বাধীনতার দিন, দিন তো নয়, রাত, সেই মধ্যরাতে আকাশ কালো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বৃষ্টিও। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে আছেন পরিষদ ভবনের সামনে। সেখানে শিখও আছেন অনেক। লাহোরের শিখ মহল্লায় আগুন লেগেছে তখন এরা জানে না। রাত বারোটার ঘণ্টা বাজার পর বাড়িতে বাড়িতে বেজে উঠল শাঁখ, বিউগল, ড্রাম। যাদের এসব নেই, টিন বাজাল। নোয়াখালি জেলার দত্তপাড়া গ্রামের হেমকান্ত জানেন ওই রাতে ভারত স্বাধীন হচ্ছে, আগেরদিন আল্লা হো আকবর আর কায়েদে আজমের জয়ধ্বনিতে জেনেছিলেন ওর জন্মভূমি পাকিস্তান হয়ে গেল। ওই রাতে হেমকান্ত বিনিদ্র শুয়েছিলেন। প্যাঁচার শব্দ শুনেছিলেন। বম্বে-মাদ্রাজ-কলকাতার বন্দরে বন্দরে নোঙর ফেলা জাহাজগুলি বাঁশি বাজিয়ে স্বাধীনতার মুহূর্ত ঘোষণা করল।

দিল্লির পরিষদ ভবনে স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করলেন। লেডি মাউন্টব্যাটেন খুব সেজেছিলেন সেদিন। হিরের লকেট, ঘন লিপস্টিক, রাষ্ট্রপতি মাউন্টব্যাটেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেলের পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। মাউন্টব্যাটেন সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় দিল্লির দরবার হলে। মাউন্টব্যাটেন এবং নেহরু পানীয় বিনিময় করলেন, মাউন্টব্যাটেন শুভকামনা জানাচ্ছেন ভারতের প্রতি, আর নেহরু ইংরেজ-রাজ ষষ্ঠ জর্জের প্রতি। লুধিয়ানায় বস্তি জ্বলছে। লালকেল্লায় ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করলেন নেহরু।

সেই সকালে দিল্লির রাজপথে জনসমুদ্র। দূর দূর থেকেও মানুষ আসছে বাসে, লরিতে, ট্রেনে, গোরুর গাড়িতেও। ভিড়ের চাপে মাউন্টব্যাটেনের গাড়ি এগোতে পারছে না। ব্যাটন হাতে পুলিশ যা আছে, সংখ্যায় কম। স্বাধীনতার দিনেই লাঠিচার্জ ভাল দেখায় না। নেহরু নিজেই চিৎকার করে জনতাকে বলতে লাগলেন—সরো, অতিথিকে রাস্তা করে দাও।

এরপর স্বাধীন ভারতের সামরিক বাহিনী ফাঁকা বন্দুক ছুড়ল। জনতা ভয় পেল। আসলে ওই বন্দুকের ফঁকা আওয়াজ মাউন্টব্যাটেনকে সম্মান দেখানোর জন। একুশবার ফাঁকা আওয়াজ করা হয়েছিল। সুকুমার রায় অবশ্য এর অনেক আগেই একুশে আইন লিখেছিলেন।

ব্যান্ড বেজে উঠল। ব্যান্ডে গড সেইভ দি কিং ব্রিটিশ জাতীয় সংগীত। বাইরে সেই অগস্টে দুপুরে চড়া রোদ উঠল। ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের তাপ নিয়ে মানুষেরা নতুন রাজাকে দেখতে চাইছে। কিন্তু তখন ভিতরে, ঠান্ডায়, পুরনো রাজা আর নতুন রাজা পাত্র-মিত্র-অমাত্য নিয়ে মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত।

বিকেলবেলা পতাকা উত্তোলন প্রিনসেস পার্কে। স্বাধীন দেশের মানুষেরা ভিড় করেছে। মাউন্টব্যাটেন সাহেব পতাকা তুলবেন। যেতেই পারছেন না ভিড়ের চাপে। জওহরলাল নেহরু চিৎকার করছেন, উত্তেজিত পাগলের মতো দু’দিকে হাত চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে অনেক কষ্টে লর্ড-লেডি মাউন্টব্যাটেন মঞ্চে উঠেছেন। তাদের মেয়ে পামেলা পারেনি। পামেলা মেম-যুবতি। এত ভিড়ে কী করে যাবেন? কালো কালো লোকের ঘাম লেগে যাবে না বুঝি? নেহরু বললেন— মানুষেরা সব বসে যাও। মানুষেরা নিচু হলে ওদের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে পামেলা-যুবতি মঞ্চে এলেন। পতাকা উড়ল। ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা নয়, গভর্নর জেনারেলের নিজস্ব পতাকা। ঘন নীলের মাঝখানে সোনালি বৃত্ত। ইউনিয়ন জ্যাক নামানো হয়নি। মাউন্টব্যাটেনের অনুরোধ ছিল ব্রিটিশ-রাজের ইউনিয়ন জ্যাক যেন না নামানো হয়, ওটা এক্ষুনি নামিয়ে ফেললে ইংরেজদের অসম্মান হবে।

মানুষ জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। মাউন্টব্যাটেন কী জয়। রানিজি কী জয়। পণ্ডিত নেহরু কী জয়। কেউ কেউ বলে ফেলছিল পণ্ডিত মাউন্টব্যাটেন কী জয়। আর বোম্বাইতে খাজা আহমেদ আব্বাস একটি টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন তখন পানিপথ থেকে, লিখছেন তার বোন। আর পারছি না। মরে যাব। এক্ষুনি বম্বে নিয়ে চলো। আর হেমকান্ত শুনলেন তাঁর বাড়ির উঠানে একটি চিৎকৃত কণ্ঠস্বর হিন্দুস্থান হই গেছে গই। আমাগোর পাকিস্তানে হিন্দুরা য্যান না থাকে কই দিলাম। মোছলমানের মাতাত লবণ থুই হিদুগো বরে খাওনের দিন শ্যাষ। কই দিলাম (মুসলমানের মাথায় নুন রেখে হিন্দুদের কুল খাবার দিন শেষ বলে দিলাম) শুইনছেন কি কত্তা…

হেমকান্ত জানালা খুলে মুখ দেখাতে ভয় পাচ্ছিলেন।

এইসব পুরনো কথা লিখে যাবার ইচ্ছে হয়। এটাকে তিনি মহাকাব্য করতে চান। কত ঘটনা। কত স্মৃতি। ক’টা দিনই-বা আর বাঁচবেন। এরই মধ্যে তাঁর কাজটা শেষ করতে হবে। এই যে এত বড় একটা উথাল-পাথাল, দেশত্যাগ, কলোনি জীবন, নতুন বসতি, বোমাযুদ্ধ, আবার হালের এই বোমাযুদ্ধ, সবই তো তার জীবনে ঘটে যাওয়া স্মৃতি। তিনি কি পারবেন সব লিখে যেতে? ক’দিন আগে লাল ঝান্ডার দল একটা মিছিল করে গেল। মাঝে মাঝে মিটিং হচ্ছে। নাগরিক কমিটি তৈরি হয়েছে। শশাঙ্ক ঘোষ হেমকান্তকে বলেছে, আপনিই নাগরিক কমিটির সভাপতি হন। হেমকান্ত নিষেধ করেছেন। কমুনিস্টদের সংস্রব পছন্দ করেন না তিনি। মুসলিম লিগের পতাকার সঙ্গে মাখামাখি করা লাল পতাকা তিনি প্রথম দেখেছিলেন ফিরোজপুরে। ১৯৪৬ সালে পটুয়াখালি থেকে নির্বাচনে দাঁড়ালেন কংগ্রেসের সতীন সেন। তপশিলি জাতি ফেডারেশনের পক্ষে যোগেন মণ্ড্‌লও দাঁড়ালেন। হীরালাল সেনগুপ্ত তখন কমুনিস্ট। কমুনিস্টরা নেতাজিকে গালমন্দ দিয়ে যতটা না ক্ষতি করেছিল তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল মুসলিম লিগ আর তার দোসর যোগেন মণ্ডলকে সমর্থন করে। পাকিস্তান হবার পর যোগেন মণ্ডলকে মন্ত্রী করেছিল লিগ। একদিন যোগেন মণ্ডলের সঙ্গে হেমকান্তর দেখা— গৌরীপুরের হাটে। হেমকান্ত সস্তার বাজার করতে রবিবার রবিবার গৌরীপুর হাটে যেতেন। যোগেন মণ্ডলের তখন ছেঁড়া পাঞ্জাবি। মুখে দাড়ি। উনি পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এসেছেন। উনি চেষ্টা করছেন পলিটিকাল সাফারারের ভাতাটা জোগাড় করা যায় কি না। আজ কলোনির উদ্বিগ্ন নেতা শশাঙ্ক ঘোষের মধ্যে হীরালাল সেনগুপ্তের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন হেমকান্ত।

হেমকান্তকে যখন শশাঙ্ক ঘোষ নাগরিক সমিতির সভাপতি হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, হেমকান্ত বলেছিলেন— সাধু-সাবধান। ফাঁন্দে পড়িয়া বসা কান্দেরে গানটা জানো তো? মনে রাইখ্যো।

শশাঙ্ক ঘোষ বলেছিলেন— পুরানো কথা আর মনে রাইখো না কাকা। ভুইল্যা যান। অখনকার বাস্তব পরিস্থিতিটা দ্যাখেন। বিজয় মজুমদার তো কমুনিস্টই। অনিল সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী সবই তো ওগো লগেই আছে। জ্যোতিবাবুও অনেক করছেন, রাধিকাবাবুও।

হেমকান্ত বলেছিলেন— যা কইরো, ভাইব্যা কইরো। উন্নয়ন কমিটি ভাইস দিয়ো না। নাগরিক কমিটি য্যান আমাদের নিজের সংগঠনটা গ্রাস না করে দেইখ্যা।

হেমকান্ত এখন উদ্বাসন কাব্যের এই জায়গাটা একবার পড়ে নেন। দেশ ভাগ ফর্মুলা বিষাক্ত রুটিরই সমান বুঝিয়া গান্ধীজি কহে— হে জিন্না ভ্রাতঃ তুমি করো মন্ত্রিসভা। তুমি হও মন্ত্রিপ্রধান— কংগ্রেস হল না রাজি। গান্ধীজির অরণ্যেরোদন বৃথা গেল:—

এইটুকু লিখে আর এগোতে পারেননি হেমকান্ত। ওর কেবলই ধাঁধা লাগে গান্ধীজি কি পারতেন দেশ ভাগটা আটকাতে? গান্ধীজি কতবার অনশন করেছেন জীবনে। গান্ধীজি যদি আর একবার অনশন করে কংগ্রেস নেতাদের দেশভাগ মেনে নেবার প্রস্তাবটা প্রত্যাহারে বাধ্য করতেন, কিংবা? থাকুক কংগ্রেস, তোমার দরকার নেই বলে অখণ্ড ভারতের জন্য আর একটা আন্দোলন শুরু করতেন? নতুন আন্দোলন করার ক্ষমতা একমাত্র গান্ধীজিরই ছিল।

কিন্তু তখন আন্দোলনের ডাক দিলে কে আসত! মুসলমানরা সব তখন জিন্নার পিছে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের অনুগামী অল্প কয়েকজন। রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসি নেতারা অপেক্ষা করছেন, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় নেতারা অপেক্ষা করছেন প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় কবে ঢুকবেন। কারুর সবুর সয় না।

১৯৪৬-এর শীতকালে হেমকান্তর ভিটের খেজুরগাছ থেকে রসের হাঁড়ি পেড়ে আমিনুদ্দি বলেছিল, কী কত্তা, আইয়ে বচ্ছর এই গাছগুলি আঞি পাইয়ুমনি? আঞার কী নসিবে আছে নি? কে পাইব?

অবাক হেমকান্ত জিজ্ঞাস করেছিল— এইরকম কও ক্যা?

আমিনুদ্দি বলেছিল, শুনতাছি মোছলমানের রাজ আইতাছে, নোয়া বাদশা হইব কায়েদে আজম। নবাব হইব নাজিমুদ্দিন। ইস্কুলে ক্যাবল মোছলমান মাস্টর, কাছারিতে মোছলমান হাকিম, মোছলমান দারোগা, মোছলমান জমিদার…। খেজুরগাছের হকও কি… অমিনুদ্দি খুব সরল। ভাল মানুষ। তাই ওইভাবে বলেছিল। কিন্তু অবস্থা ঠিক ওইরকম। চাচা-মিঞা ডাকা ধনী মুসলমান লোক তুই-তোকারি করা গরিব মুসলমান প্রত্যেকের মনেই নতুন উন্মাদনা। নতুন স্বপ্ন। একটা মুসলমানের দেশ হচ্ছে। এই অবস্থায় কি কিছু করা যেত? পারতেন না গান্ধীজি। হয়তো পারতেন জিন্না। জিন্নাই বোঝাতে পারতেন সাড়ে ছয় কোটি মুসলমানকে। জিন্নাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দেওয়া হলে জিন্না রাজি হতেন। কিন্তু আসন্ন প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি হননি জওহরলাল।

সেইসব ভুলতে চেষ্টা করা দিনগুলিকে আঁকশি দিয়ে টেনে আনতে কষ্ট হচ্ছে হেমকান্তর, তবুও এটা করছেন এখন। পুরনো দিনগুলির সঙ্গে কথা বলছেন যেন।

কৃষক প্রজাপার্টির ফজলুল হক কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন চেয়েছিলেন। কংগ্রেস রাজি হল না। তাই মুসলিম লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন করলেন হকসাহেব। কিছুদিন পর হেমকান্তর স্কুলে একটা সরকারি সার্কুলার এল। সেই সার্কুলার অনুযায়ী ক্লাসে নাম ডাকার পর লিখতে হত এম।

M—……………………………………………..

N.M—………………………………………………

…………………………………………………………

Total…………………………………………………

মানে উপস্থিত ছাত্রসংখ্যার মধ্যে মুসলিম এত, নন-মুসলিম এত। মোট এত। মানুষের দুই ভাগ। মুসলমান এবং অমুসলমান হেমকান্তর মনে পড়ে ছেচল্লিশের শীতকালে বোর্ডে লিখেছেন এম ১২ এন এম ৩৬, সাতচল্লিশের শীতকালে এম ১২, এন এম ৬, সব ফাঁকা, সব ফাঁকা। হেমকান্ত দেশ ভাগের পরেও দেশ ছাড়েননি। মনে পড়ে বাংলা বইয়ের রামধনু পাকিস্তানে কীভাবে রংধনু হয়ে গেল। হালিমকে মনে পড়ে, গ্রামের হালিম, স্বভাব কবি। গানের গলা ছিল ভাল। সরমা নাটকে রামের অভিনয় করে মাতিয়ে দিত। ছেচল্লিশের দুর্গাপূজায় চৌধুরিদের মণ্ডপে হরধনু ভঙ্গ অভিনয়। হালিম রাজি হল না। বলল, নিষেধ আছে। অথচ এই হালিমই গান বেঁধেছিল—

পচা দড়ি যাবে ছিঁড়ে টানাটানি কইর না
ভাই টানাটানি কইর না।
কলিকাতার শুন ঘটনা।
কলিকাতার হিন্দুগণ আর কত মুসলমান
তারা করে খুনাখুনি কার কথা কেহ শুনেনা
কলকাতার শুন ঘটনা।

গান্ধীজি যখন নোয়াখালি এসেছিলেন, হালিমের লোকেরা গান্ধীজির এই গানটা শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে গাওয়া হয়েছিল। হেমকান্তও ছিলেন সেই কোরাসে।

মনে পড়ে গানটার আরও কথা—

প্রভু নিরাকার কী কারবার ভবের মাঝে হইল
তোমার সৃষ্টি কত লোক প্রাণে মারা গেল
হায়রে খোদাতালা
হায়রে খোদাতালা কী করিলা আমাদের কপালে
কত অপরূপ কাণ্ড ঘটে কলিকালে
যত হিন্দুগণ
যত হিন্দুগণ মুসলমান এক জাগাতে বাস
কী কারণে বাংলা দেশে হাজার হাজার লাশ
তাহা কেবা জানে
তাহা কেবা জানে নিরঞ্জনে যদি রক্ষা করে
রাজত্ব করিতে আছে ইংরাজ বাহাদুরে
তাদের বিচার ভাল
তাদের বিচার ভাল চিরকাল সবে দেখতে পাই—
স্বাধীন স্বাধীন করি কেন প্রাণে মারা যাই

গান্ধীজি বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতেন। শেষ দু’ লাইন শোনবার সময় কপালটা একটু কুঁচকেছিলেন তিনি। সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তকে কী যেন বলেছিলেন। ওরা জানতে চেয়েছিলেন এই গানের লেখক কে! হালিম ছিল না সেখানে। সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত বলেছিলেন—এই গানটার শেষটা পালটে দিয়ো।

গান্ধীজিকে খুব কাছে পেয়েছিলেন হেমকান্ত মিনিট দশেকের জন্য, কিন্তু কোনও কথা হয়নি। কাছ থেকে দেখেছিলেন। কনকও ছিল। কনক পাখার বাতাস করেছিল। গান্ধীজির মুখ থেকে হেমকান্ত শুনেছিলেন— মাই হার্ট ব্লিড্‌স। আই কান্ট ডু এনিথিং বাট ক্রাইং।

হাতের কলমটা অনেকক্ষণ হাতেই আছে। হ্যান্ডেল পেন। ক্রাউন নিব। দোয়াতে পি এম বাগচির কালি। পুরনো অভ্যেস। ফাউন্টেন পেন একটা আছে হেমকান্তর। রাইটার। দেড় টাকা দাম। সামান্য লিক করে। নাতি-নাতনিরা কেউ হ্যান্ডেল কলম ব্যবহার করে না। ওরা ফাউন্টেন পেনই ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে শিবু দেখাল ডট পেন। সরু কাঠির মধ্যে কালি ভরা। ডট পেনে লিক করার সম্ভাবনা নেই। হেমকান্তর হ্যান্ডেলই ভাল। দোয়াতে কলম ডোবান অনেকক্ষণ পর। দিনের আলো মলিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি গান্ধীজির অরণ্যেরোদন বৃথা গেলর পর লিখলেন—

এ সময়ে উদ্ধারিতে পারিত সুভাষ।
পরবাস হতে যদি আসিয়া তখনি
বজ্র নির্ঘোষে যদি বলিতেন তিনি
বন্ধ কর বেয়াদপি বাইচলামি যত
শত শত কণ্ঠে তাহা হইয়া ধ্বনিত—
ছড়াত ভারত মাঝে। আমাদের মনে
এই আর্তি আসে শুধু শয়ন স্বপনে।

এই আর্তি এখানে আসে। স্বাধীনতা, কিংবা দেশ ভাগের ২৫ বছর পরেও। আকাশে উড়োজাহাজ উড়ে গেলে হেমকান্তর মনে হয় কোনও একটা উড়োজাহাজ থেকে প্যারাসুটে নেমে আসবেন সুভাষ বোস।

অন্ধকার হয়ে আসছে। কনক এসে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। একরাশ আলো হেমকান্তর খাতার উপর এসে পড়ল। খাতার সাদা পৃষ্ঠাটার বাকি অংশের শূন্যতা জুড়ে আলোময় হয়ে রইলেন সুভাষ বোস।

শারদ রাজপথ, ২০০০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *