রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – লব-কুশের রোদন
লব কুশ শুনিয়া হাতের ফেলে বীণা।
ভূমে লোটাইয়া কান্দে ভাই দুই জনা।।
কোথা গেলে জননি গো জনক-দুহিতে।
আমরা তোমার শোক না পারি সহিতে।।
তোমা বিনা মাতা ওগো অন্যকে না জানি।
তুমি বিনা আর কেবা দিবে অন্ন পানি।।
ক্ষুধা হৈলে অন্ন দেহ জল পিপাসায়।
সংসারে দুর্ল্লভ গুণ সে গুণ তোমায়।।
দশমাস আমা দোঁহে ধরিলে উদরে।
যে দুঃখ পাইলে তাহা কে কহিতে পারে।।
ছোটকে করিলে বড় লালিয়া পালিয়া।
পলাইয়া মাতা হেন পুত্রে কারে দিয়া।।
জনক-ঝিয়ারী তুমি শ্রীরাম-ঘরণী।
অযোনিসম্ভবা লব-কুশের জননী।।
মাতৃহীন বালক যে সর্ব্বদা অস্থির।
যার মাতা আছে তার সফল শরীর।।
আজি হৈতে অনাথ হইলাম দুই জন।
এ দুই পুত্রেরে মাতা হৈলে নিদারুণ।।
পাইয়া বিস্তর দুঃখ গেলে মা পাতালে।
অনাথ করিয়া গেলে এ দুই ছাওয়ালে।।
লব কুশ কান্দিতেছে লোটাইয়া ধূলি।
ধূলায় ধূসর অঙ্গ ননীর পুতলী।।
পুত্রের ক্রন্দনে রাম হইয়া কাতর।
অন্তঃপুরে পাঠালেন মায়ের গোচর।।
কৌশল্যা কৈকেয়ী আর সুমিত্রা এ তিনে।
যতেক প্রবোধ দেন প্রবোধ না মানে।।
মা হইয়া পুত্রেরে যে হৈল নিদারুণ।
সে মায়ের জন্য কেন করহ ক্রন্দন।।
মাতৃ সহ দেখা নাই গেল দূরদেশে।
পিতামহী আমরা যে আছি কি বিশেষে।।
দুই নাতি প্রবোধিতে নারে তিন বুড়ী।
প্রবোধ করিতে তবে গেল তিন খুড়ী।।
বিধির নির্ব্বন্ধ বাপু আর কর্ম্মফলে।
এ সুখ ছাড়িয়া সীতা নামিল পাতালে।।
লব কুশ উঠ বাপু কান্দ কি কারণ।
মায়ের সমান যে আমরা তিন জন।।
মাতৃসঙ্গে তোমাদের না হবে দর্শন।
আমা সবা দেখি বাপু সম্বর ক্রন্দন।।
দুভায়ের নেত্রজলে তিতিল মেদিনী।
প্রবোধ করিতে নারে কোন ঠাকুরাণী।।
ভরত লক্ষ্মণ শত্রুঘন তিন জন।
চলিলেন অন্তঃপুরে প্রবোধ কারণ।।
দুই ভায়ে বসাইয়া রত্ন-সিংহাসনে।
তিন খুড়া প্রবোধেন মধুর বচনে।।
শুন লব শুন কুশ মোদের বচন।
অস্থির না হও বাপু স্থির কর মন।।
পিতা মাতা ভ্রাতা কার থাকে নিরন্তর।
অনিত্য লাগিয়া কেন হইলা কাতর।।
কালি বা পরশ্ব বাপু হইবে যে রাজা।
অস্থির হইলে বাপু কে পালিবে প্রজা।।
গঙ্গা আনিলেন রাজা নাম ভগীরথ।
তাঁর নাম গায় সদা সকল জগৎ।।
তোমা সবে বর্জ্জিলেন জানকী নিশ্চিত।
সর্ব্বলোকে গাহিবেক সীতার চরিত।।
তিন খুড়া প্রবোধেন প্রবোধ না মানে।
দুই বালকেরে দিল রাম-বিদ্যমানে।।