রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – সীতার নিকটে লব কুশের যুদ্ধ- বার্ত্তা কথন, সীতার বিলাপ ও অগ্নি-প্রবেশের উদযোগ
সতের দিবসে দুই ভাই গেল ঘর।
কান্দিয়া জানকী দেবী অত্যন্ত কাতর।।
হনুমান জাম্ববান দুর্জ্জয় শরীর।
দ্বারে না সান্ধায় তেঁই থুইল বাহির।।
এক দৃষ্টে চাহেন জানকী করি ধ্যান।
হেনকালে দুই ভাই গেল সেই স্থান।।
দেখিয়া জানকী হইলেন উতরোলী।
দুই ভাই লইল মায়ের পদধূলি।।
দুই ভাই বসিল মায়ের বিদ্যমান।
যুদ্ধ-কথা কহিতে লাগিল তাঁর স্থান।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ হে ভরত শত্রুঘন।
এ সবার সহিত করিলাম বহু রণ।।
বহু অক্ষৌহিণী সেনা ভাই চারি জন।
বাহুড়িয়া দেশেতে না করিল গমন।।
এসেছিল যত সেনা কেহ তার নাই।
কহি যে অপূর্ব্ব-কথা শুন মাতা তাই।।
দুর্জ্জয় দুইটা জন্তু এনেছি বান্ধিয়া।
দ্বারে না আইসে মাগো দেখহ আসিয়া।।
ধনুর্ব্বাণ আনিয়াছি রথের সাজন।
এই দেখ এনেছি রামের আভরণ।।
দেখিয়া জানকী দেবী চিনিয়া তখন।
শিরে করি করাঘাত করয়ে রোদন।।
হায় হায় কি করিলি ওরে লব কুশ।
পিতৃহত্যা করিয়া কি রাখিলি পৌরুষ।।
কোন্খানে মারিলি সে কমল-লোচনে।
চল ঝাট পড়ি গিয়া প্রভুর চরণে।।
কেমনে দেখিব গিয়া শ্রীরাম লক্ষ্মণে।
কেমনে দেখিব সে ভরত শত্রুঘণে।।
কোন্ খানে হয়েছিল সমর-প্রসঙ্গ।
শৃগাল কুক্কুর পাছে স্পর্শে প্রভু অঙ্গ।।
ধেয়ে যায় সীতাদেবী কেশ নাহি বান্ধে।
তাঁর পিছে শিরে হাত দুই ভাই কান্দে।।
সীতা আসি বাহিরে দেখেন বিদ্যমান।
হস্ত পদ বান্ধা হনুমান জাম্ববান।।
মৃতপ্রায় অচেতন বহে মাত্র শ্বাস।
দেখিয়া সীতার মনে হইল হুতাশ।।
জানকী বলেন লব করিলি কি কর্ম্ম।
তোরা বিদ্যা শিখিয়া নাশিলি জাতিধর্ম্ম।।
তোমা হতে জ্যেষ্ঠ পুত্র হয় হনুমান।
এই হনুমান মোর দিল প্রাণদান।।
বানর হইয়া গেল সাগরের পার।
হনুমান পুত্র মোর করেছে উদ্ধার।।
ইহারে করিলি বধ অবোধ বালক।
শুনিলে এ সব কথা কি কহিবে লোক।।
পিতা পিতৃব্যের তোরা বধিলি জীবন।
বিষপান করি প্রাণ ত্যজিব এখন।।
এখনি মরিব আমি প্রভুর সাক্ষাৎ।
কলঙ্ক না লুকাইবে হইবে বিখ্যাত।।
কোথায় মারিলি তাঁরে ঝাট চল দেখি।
এতক্ষণ প্রাণ আর কার তরে রাখি।।
অশ্রুজলে জানকীর তিতিল বসন।
লব কুশ প্রতি কত করেন ভৎসন।।
লব কুশ শীঘ্র এদের ঘুচাও বন্ধন।
হনুমান জাম্ববানে করহ মোচন।।
পাইয়া মায়ের আজ্ঞা ভাই দুই জন।
খসাইল উভয়ের সে দৃঢ় বন্ধন।।
উঠিয়া বসিল জাম্ববান হনুমান।
কহিলেন সীতাদেবী আসি বিদ্যমান।।
এক সত্য হনুমান করিও পালন।
করো ঠাঁই না কহিও এ সব বচন।।
তোমার রামের পুত্র এই দুই ভাই।
না চিনি করিল যুদ্ধ ক্রোধ কর নাই।।
যান সীতা মণিহারা ভুজঙ্গিনী প্রায়।
ক্রন্দন করিয়া তাঁর পিছে দোঁহে ধায়।।
শ্রীরামের উদ্দেশেতে চলে তিন জন।
উপস্থিত হইলেন যথা হৈল রণ।।
দেখিলেন সংগ্রামে পড়িয়া চারি জন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ শ্রীভরত শত্রুঘন।।
হস্তী ঘোড়া ঠাট কত পড়েছে অপার।
দেখিয়া ত জানকী করেন হাহাকার।।
কাতরা হইয়া সীতা করেন ক্রন্দন।
রামের চরণ ধরি কহেন তখন।।
হইয়া তোমার পুত্র মারিল তোমারে।
এ কেবল ঘটে সে আমার কর্ম্মফেরে।।
মন্দর তোমার বাণে নাহি ধরে টান।
ছাওয়ালের বাণে প্রভু হারাইলে প্রাণ।।
সর্ব্বলোকে বলিতেন অবিধবা সীতা।
আমারে বিধবা কৈল কেমন বিধাতা।।
অগ্নিতে প্রবেশ করি ত্যজিব জীবন।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার চরণ।।
শিরে হাত লব কুশ করিছে ক্রন্দন।
মায়ের চরণ ধরি বলিছে বচন।।
ক্ষমা কর জননি গো না কর ক্রন্দন।
মজিলাম তব দোষে মোরা তিন জন।।
তুমি না বলিলে মাগো শ্রীরাম মম পিতা।
আপনার দোষে এত হইলে তাপিতা।।
পিতৃবধ করিয়া বড়ই পাই লাজ।
অগ্নিতে পুড়িয়া মরি প্রাণে নাই কাজ।।
এই মহাপাপে আর নাহিক নিস্তার।
অগ্নিতে পুড়িয়া আজি হইব অঙ্গার।।
সীতা বলে, আগে অগ্নি করিব প্রবেশ।
যাহা ইচ্ছা তাহাই করিও অবশেষ।।
তিন জন গেল তারা যমুনার তীরে।
তিন কুণ্ড কাটিলেন দুই সহোদরে।।
তাহাতে আনিয়া কাষ্ঠ জ্বালিল অনল।
জ্বলিয়া উঠিল অগ্নি গগন-মণ্ডল।।
স্নান করি পরিলেন পবিত্র বসন।
অগ্নি প্রদক্ষিণ করিলেন তিন জন।।