রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – শঙ্করের বিবাহার্থ যাত্রা
প্রভাত হইল রাত্রি প্রত্যূষে বিহানে।
দেশে দেশে পাঠাইল কুটুম্ব-জানানো।।
চারিদিগে গিরিগণে দিলা আমন্ত্রণ।
আনন্দিত দেবগণ এ তিন ভুবন।।
সবাকে জানান দেব গৃহ ব্যবহার।
আমন্ত্রণ পেলে সবে হবে আগুসার।।
উদয় ও অস্তগিরি এল দুইজন।
নীলগিরি ময়ভঙ্গ এল নারায়ণ।।
আসিল অজয়-মুখ কলিঙ্গ কেশরী।
রুইদাস ধর্ম্মদাস মহীদাস গিরি।।
বিন্দু মেঘ আইল ও কৈলাস শিখর।
শরাসন অঞ্জন ও পর্ব্বত শ্রীধর।।
বর্দ্ধমান কুমুদ্বান্ সে গন্ধমাদন।
ঋষ্যমূক গিরি আর মলয় চন্দন।।
ত্রিকূট পর্ব্বত এল আর হেমকূট।
চন্দ্রকূট সূর্য্যকূট এল বজ্রকূট।।
ধবলগিরি গোবর্দ্ধন বরাহ বাসত।
বসন্ত শ্রীমন্ত এল মৈনাক পর্ব্বত।।
ত্রিভুবনের গিরিগণ কৈল আগুসার।
পর্ব্বত চলিতে হৈল সংসার আঁধার।।
আইল পর্ব্বতসব পরম হরিষে।
বুঝিয়া আপন কার্য্য সুমেরু না আসে।।
আপনি মেনকা আর হেমন্ত-নন্দন।
সুমেরুকে আনে গিয়া করিয়া যতন।।
সুমেরু হেমন্ত পদে কৈল নমস্কার।
বসিতে আসন দিল কৈল পুরস্কার।।
স্নান ভোজন করি সবে হৈল সুশীতল।
নাটগীত দেখি মুনি অতি কুতূহল।।
নানা মঙ্গল নাটগীত হিমালয়-ঘরে।
পরম আনন্দে লোক আপনা পাসরে।।
গিরিরাজ ঘরে বাজে যতেক বাজন।
হোথা মহারঙ্গে আছে যত দেবগণ।।
গঙ্গারে আনিতে গেলা সুমন্তের ঘরে।
রন্ধন করিলে গঙ্গা দেবে ভোজন করে।।
গঙ্গাকে লইয়া যাবে যতন করিয়া।
রন্ধন করিলে গঙ্গা রাখিহ আনিয়া।।
দেবের বচন আমি নাহি করি আন।
গঙ্গাকে থাকিতে বেলা আন মোর স্থান।।
এতেক শুনিয়া হর বলেন বচন।
রন্ধন করিলে গঙ্গা দেবের ভোজন।।
রন্ধন-ভোজনে বেলা হৈল অবসান।
করুণা-আধার হর গঙ্গা লয়ে যান।।
সুমন্ত ক্রোধিত দেখি বেলা অবসান।
গঙ্গা লয়ে গেলা হর সুমন্তের স্থান।।
গঙ্গা দেখি সুমন্ত রহেন কোপমনে।
এতেক বিলম্ব তোর হৈল কি কারণে।।
তোর রূপ দেখে যত দেবের সমাজ।
দেবের রান্ধুনি হৈতে না বাসিলি লাজ।।
কিমতে দেবতাদের করিলি রন্ধন।
তোর রূপ-যৌবন দেখিল দেবগণ।।
কেহ বা দেখিল তোর সুন্দর বদন।
কেহ বা দেখিল তোর যুগল নয়ন।।
অন্ন দিতে গেলি তুই যার যার পাশ।
সেইসব দেবে করে তোরে অভিলাষ।।
অপবিত্রা তুই কেন এলি মোর স্থান।
স্বগৌরবে যাহ, নহে পাবি অপমান।।
কোপে মুনি করিল সে গঙ্গারে বর্জ্জন।
হাসিয়া গঙ্গারে শিরে ধরে ত্রিলোচন।।
মহাদেব-শিরে রহে গঙ্গা গোঁসাইনী।
গঙ্গারে ধরিয়া শিরে হাসে শূলপাণি।।
সর্ব্বাঙ্গে বিভূতি শোভে, গঙ্গা শোভে শিরে।
গলাতে বাসুকি নাগ, ভালে শশধরে।।
কখনো থাকেন গঙ্গা মহাদেব-শিরে।
কখনো বা ব্রহ্মা কমণ্ডলুর ভিতরে।।
স্বর্গ হৈতে গঙ্গা সে আইলা মর্ত্তলোকে।
গঙ্গার মহিমা লোক জানে দুঃখ শোকে।।
যত কিছু পাপ লোক করে মহীতলে।
সর্ব্বপাপ হরে স্নান কৈলে গঙ্গাজলে।।
মহাদেব-অধিবাস করায় দেবগণ।
ব্রহ্মার বচনে বৈসে দেব-নারায়ণ।।
প্রাতঃকালে দেবলোকে আমন্ত্রণ করি।
স্নান সন্ধ্যা নান্দীমুখ কৈলা ত্রিপুরারি।।
স্নান করি প্রবেশিলা রন্ধন শালাতে।
দেবগণ একঠাঁই বৈসে ভোজনেতে।।
মধুর অমৃত তুল্য গঙ্গার রন্ধন।
মহাসুখে দেবলোক করিলা ভোজন।।
করেন শিবের বেশ নিজে নারায়ণ।
সোণার মুকুট শিরে, বাহুতে কঙ্কণ।।
ললাটেতে চন্দ্র শোভে, শিরে সুরেশ্বরী।
বৃষোপরি চাপিয়া চলিলা ত্রিপুরারি।।
রাজহংস-রথে চাপি চলে প্রজাপতি।
ঐরাবতে চাপিয়া চলিলা সুরপতি।।
মকরে বরুণ চড়ে, মহিষে শমন।
ছাগলে চড়েন অগ্নি, হরিণে পবন।।
গরুড়ে চড়িয়া চলে নিজে নারায়ণ।
যে যার বাহনে চড়ি চলে দেবগণ।।
সর্ব্বাগ্রে নারদ যান কলহ লইয়া।
কন্দিল-ধোকড়ি সাত কাঁখেতে করিয়া।।
নারদে দেখিয়া হরষিত হিমাচল।
হরিষ বদনে পুছে তাঁহার কুশল।।
আগু আইল নারদের কন্দলি-ধোকড়ি।
যথা আছে শঙ্করের শ্বশুর-শাশুড়ী।।
দেখিয়া তোমার কন্যা লাগে বড় ব্যথা।
সাবধান হয়ে শুন জামাতার কথা।।
ঘরে ভাত নাহি তার, চালে নাহি খড়।
শুইতে নাহিক শয্যা, পরিতে কাপড়।।
অমঙ্গল চিতাভস্ম লেপে সর্ব্বগায়।
গলেতে হাড়ের মালা, সাপিনী ফোঁপায়।।
ত্রিনয়নে অগ্নি জ্বলে, শিরে শোভে গাঙ্গ।
উলঙ্গ উন্মত্ত বেশ, খায় ধুতুরা ভাঙ্গ।।
ঘরের নফর নন্দী, কাল ভীমা ভায়া।
ঘরে ঘরে ঘুরে তারা ভাতের লাগিয়া।।
এত শুনি মেনকা স্বামীকে পাড়ে গালি।
কোপে গিরিরাজ ধরে মেনকার চুলি।।
সাত পাঁচ দশ বিশ করে মারামারি।
কেবা কারে মারে, নারদ দেয় টিটকারী।।
নারদ বলেন কেন কর মারামারি।
এ তিন ভুবনে রাজা দেব-ত্রিপুরারি।।
কোন্ জনা বুঝে বল মহাদেব-কাজ।
মহাধনী মহাদেব দেবের সমাজ।।
কোন্দল ঘুচায়ে নারদ গেল দেবপাশ।
রচিলা উত্তরকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।