উত্তরসুরি
প্রতিদিনের অভ্যাসটা বদলাতে পারছে না সায়ন। ডিনার শেষ হলেই মহানগরের পথে কেউ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে তাকে। নীলাশার সাথে ব্রেকআপের পর বেশ কিছুদিন মনমরা হয়ে থাকতো। দশটা-পাঁচটা কলম চালানোর কাজ আর তারপর একলা এসে গড়িয়ার ফ্ল্যাটে ঢোকা- দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল দিনদিন। একদিন ঝোঁকের বসেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাতের রাজপথে…..
আলো ঝলমলে রাস্তা যেন ম্যাজিশিয়ান। কি আশ্চর্য ! নিমেষেই মন খারাপ গায়েব। এরপর রোজ রাতেই নিজের সাথে চলে একলা অভিসার! এক এক দিন আলাদা আলাদা রাস্তা, আলাদা আলাদা অলিগলি…. কত নতুনত্ব! এভাবেই চলছিল বেশ।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। আশ্বিন মাস, তবু থেকে থেকে বৃষ্টির বিরাম নেই। ভাগ্যিস মাস খানেক হল, গাড়িটা কিনেছে। নাহলে অকাল শ্রাবণে গরুভেজা ভিজতে হতো! এই সব ভাবতে ভাবতে কখন বাড়ির সামনে চলে এসেছে খেয়াল করেনি সায়ন। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে টিভির একঘেঁয়ে সংবাদের বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। খিস্তি দিয়ে বলে ওঠে, “তোরা সব শালা চোর। আমি হাতে শাসনের লাগাম থাকলে দেখিয়ে দিতাম”… ফাঁকা ঘরে ওর কথা শোনার যদিও কেউ নেই, তবু সায়ন মনে মনে নিজেকে সুশাসক ভাবে। নোংরা রাজনীতির খবর বন্ধ করে উঠে এসে ল্যাপটপে নিজের পছন্দের সিনেমা দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা কখন এগারো’র ঘর ছুঁতে চলেছে, সেটাও খেয়াল করেনি সে।
“নাহ, এবার উঠে ডিনার টা সেরে ফেলি”… মানদা মাসি সকালেই সব রেঁধে দিয়ে যায়। মাইক্রোওভেনে মাংস ভাত গরম করে বৃষ্টির রাতে জমিয়ে একলা একলা ডিনার সেরে সায়ন ভাবে, ” বৃষ্টিতে আজ আর বেরোবো না”
গা এলিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকে বোকাবাক্সের দিকে তাকিয়ে। ইদানিং রোজ মনে হয় কি একটা অপূর্ণতা যেন গ্রাস করছে তাকে, কিন্তু সেটা কি বুঝে উঠতে পারে না। উঠে গিয়ে টি’শার্ট গলিয়ে নিয়ে নেমে আসে গ্যারেজ ঘরে। গাড়ির এসি’টা চালাতেই একরাশ ভালোলাগা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা দিয়ে যায় চোখেমুখে। রাতের মহানগর ডাকছে তাকে দু’হাত বাড়িয়ে……
সময় তখন রাত বারো’টা ছুঁয়েছে। খানিক আগে ইস্টার্ণ বাইপাস দিয়ে সায়ন ছুটে চলেছে তার ময়ূরপঙ্খী তে। নির্দিষ্ট কোন দিক নেই, এলোমেলো পথ চলা….. শ্যামবাজারে ঢোকার আগেই সিগন্যালের রঙ টা বদলে লাল হয়ে গেল! এসি’র শীতলতা আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি কাঁচগুলোকে ঝাপসা করে রেখেছে….. সময় যেন কিছুতেই পেরোতেই চায় না। হঠাৎ কানে এলো শব্দটা। টগবগ টগবগ…. ধুয়ে যাওয়া পিচ রাস্তার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে….. ঘষা কাঁচে ঝাপসা অবয়ব! মন্ত্রমুগ্ধ যেন সায়ন! গাড়ির কাঁচটা ধীরে ধীরে নামাতে থাকে সে… ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে বেদী থেকে পিছলে পড়া ধাতব রঙের জন্তু’টা। একটু করে এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে….. বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজে গেছে সায়নের কপাল। একরাশ ভয় মনের মধ্যে….. এভাবেই সময় কতক্ষণ কেটে গেছে মনে নেই! গাড়ির হর্ণে সম্বিৎ ফেরে তার। একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ায় তার গাড়ির পাশে। পুলিশ অফিসার বলে ওঠেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, তাই জিজ্ঞেস করছি, ভাল আছেন তো?”……
“না, মানে হ্যাঁ…সব ঠিক আছে, তবে ঐ…. “
“ও, ঘোড়াটার কথা বলছেন তো? হো হো হেসে ওঠেন অফিসার। “ওকে মাঝে মধ্যে রাজপথে দেখা যায়। স্ট্যাচু থেকে নেমে এসে রাতের আঁধারে খুঁজে বেড়ায় তার উত্তরসুরি কে। ” পাঁচ মাথার মোড়ে একলা দাঁড়িয়ে থাকা নেতাজীর মূর্তিটা দূর থেকে তখনও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
তবে কি ধাতব ঘোড়া নীরবে দেখে যাচ্ছে রাজ্য ও দেশের ক্রম পরিবর্তন? তাই কি উত্তরসূরির খোঁজে নিখোঁজ হয় রোজ রাত্রে !!!