উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 03
কলেজ স্কোয়্যারের দক্ষিণমুখী একটা বেঞ্চে বসেছিল দেবপ্রিয়। বসেছিল এমনভাবে যেন ইউনিভার্সিটি ইনসটিট্যুটের উচ্চ-কণ্ঠ বাউল-আলাপ তার কানে যাচ্ছে না। বাঁ হাঁটুর ওপর ডান হাঁটুটা তুলে হাত দুটো আলগাভাবে বেঞ্চির পিঠে দুদিকে ছড়িয়ে সে বসেছিল বহু দূরের দিকে চেয়ে।
অনেকেই জানে না দেবপ্রিয় এই কাছেই হুগলি জেলার ছেলে। তার বাবা বলেন আদিতে তাদের পূর্বপুরুষ সপ্তগ্রামে বাণিজ্য করতেন তারপর চতুর্ধুরিণ উপাধি নামে জমিদার হয়ে বসেন। বণিকদের সঙ্গে সদাসর্বদাই কিছু লেঠেল থাকত, তীরধনুক, বর্শা ছোট লাঠি বা পাবড়া সব চালাতেই তারা ওস্তাদ। জমিদার হওয়ার পরও এদের জমি দিয়ে বসত করাতে হয়, মাঝে মধ্যেই নানা ছলে ছুতোয় এদের ব্যবহার করা চলতেই থাকে। চতুর্ধুরিণদের একটি শাখা এতে বিরক্ত হয়ে কিছু দূরে শ্বশুরবাড়ির গ্রাম দায়পুরে বসবাস করতে থাকেন। বৈঁচি স্টেশনে নেমে ভেতর দিকে যেতে হয়। একটাই ত্রুটি গ্রামখানার। কোনও নদী নেই। নদী না থাকলে যেন কোনও জায়গার স্বয়ম্ভরত্ব থাকে না, তার আত্মপরিচয় স্ফুট হয় না। কিন্তু নদীর অভাব গত সাত আট বছর থেকেই পুষিয়ে যাচ্ছে পৃথ্বীন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি নামে এক মানুষ নদী আসায়। কোন বিস্মৃত অতীতে পৃথ্বীন্দ্রনাথের ভিটে ছিল দায়পুরে। তাঁর ঠাকুর্দার বাবা ঠাকুর্দা নিশ্চয়ই জমিদার শ্রেণীরই ছিলেন। কিন্তু পুরুষানুক্রমে শহরে বাস করায় গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। বছরে একবার কি দুবার এসে জমির ফসল বিক্রির টাকাকড়ি বুঝে নেওয়া ছাড়া আসা যাওয়া ছিল না। জঙ্গল হয়ে যাওয়া বাগান এবং ভাঙাচোরা বাস্তুর মুখ চলতি নাম ছিল গাঙ্গুলি বাগান। দু তিনখানা বাগান, বিরাট দোতলা কোঠা বাড়ি এবং সংলগ্ন চাষ জমি নিয়ে বিশাল এলাকা। পৃথ্বীন্দ্রনাথ কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে একদিন একলা একলা গ্রামে এসে উপস্থিত হলেন। গাঙ্গুলি বাগান সাফ হতে থাকল, দোতলা কোঠার অধিকাংশ ফেলে দিয়ে বাকি সারিয়ে স্কুল হল, তাঁর নিজের জন্য টালি ছাওয়া বাংলো হল। জঙ্গল কেটে ডেয়ারি, পোলট্রি, বিরাট কিচেন গার্ডেন হল। স্কুলটি দিনে ছোটদের, সন্ধ্যায় বয়স্কদের। প্রথমে দায়পুরের লোক প্রবলভাবে প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করে এসব, বিশেষত পৃথ্বীন্দ্রনাথের এসে বসাটা। তাঁর তিনটি বাগানের গাছপালা ছিল গ্রামের বহু লোকের রুজির উপায়। কিন্তু তিনি এই সব লোকেদের দিয়েই তাঁর কাজকর্ম করাতে লাগলেন ভালো পারিশ্রমিক দিয়ে। দুটি স্কুলই এখন রমরম করে চলছে। এই পৃথ্বীন্দ্রনাথকেই দেবপ্রিয় গ্রাম সুবাদে মেজজেঠু বলে ডাকে, এবং তিনিই তার যাবতীয় উন্নতির মূলে। দেবপ্রিয়র বাবা গ্রামের বহুদিনের বাসিন্দা। জমিজমাও বেশ কিছু আছে, কিন্তু জ্ঞাতি-গুষ্টি এতো এবং গ্রাম পলিটিক্স এত সাংঘাতিক যে এই জমি জমার পুরো স্বত্ব ভোগ করতে পাওয়া এখন দেখা যাচ্ছে দুরাশা। পুকুরের মাছ রাতারাতি বেপাত্তা হয়ে যায়, ভাগের বাগানের ফলফুলুরি ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। বড় বড় গাছ লোপাট হয়ে যায়। বাবার ইচ্ছে দেবপ্রিয় আইন পড়ুক। সদরে প্র্যাকটিস করতেও পারবে, নিজেদের সম্পত্তি উদ্ধারের কাজটাও করবে।
মেজজেঠু সরকারি চাকরি করতেন। ঠিক কি চাকরি দেবপ্রিয় জানে না, খুব বড় চাকরি এই পর্যন্ত সবাই জানে। তবে খুব সিগার খান, এই বয়সেও বুশ শার্ট আর প্যান্ট ছাড়া পরেন না। রাত্রে স্লিপিং স্যুট পরে শোন। মানুষটির হাবেভাবে কিছু সাহেবি ব্যাপার আছে। শৃঙ্খলাবোধটাও হয়তো তারই অন্তর্গত। কিন্তু কথাবার্তায় এবং গ্রামের সবার প্রতি দরদে তিনি খাঁটি এদেশি।
মেজজেঠুই তার দেবব্রত নামটাকে দেবপ্রিয় বানালেন। যত্ন করে পড়ালেন। তার মধ্যে ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস পড়ালেন যেন তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে। জেলা স্কুলে দেবপ্রিয় আগে ভালোই রেজাল্ট করত। সে জানে গ্র্যাজুয়েশনটা করেই তাকে কোর্টে ছুটতে হবে। মেজজেঠু তার মধ্যে অন্য আগ্রহ জাগালেন। সে যখন মাধ্যমিকে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেল মেজজেই তার সম্মানে একটা ছোট্ট ভোজ দিলেন। ভোজে নিমন্ত্রিত মাত্র দুজন—তিনি স্বয়ং আর দেবপ্রিয়। বললেন ‘তুই পাশ করলেই এ ভোজটা হত। এটা শুধু পাশের ভোজ, স্কলারশিপ পাওয়ার ভোজ নয়। এতে প্রমাণ হয় না তুই হৃদয়বান মানুষ কিনা, তোর স্বকীয়তা আছে কি না, তোর নেতৃত্ব গুণ, উদ্ভাবকের মেজাজ আছে কি না, আত্মপ্রত্যয় কতটা, সহনশক্তি, টলারেন্স কতটা, কল্পনা আছে কি না। কিছুই বোঝা যায় না। শুধু বোঝা যায় তোর স্মৃতিশক্তিটা ভালো। হয়ত তোর চেয়ে অনেক খারাপ করেছে এমন একটি ছাত্র বা ছাত্রীর এসব গুণ তোর চেয়ে অনেক বেশি। কিছু বলা যায় না। সুতরাং তুই পাশ করেছিস ভালোভাবে পড়াশোনা করে এটাই যথেষ্ট।
মেজজেঠু খাওয়ালেন তাঁর নিজের ক্ষেতের দুধের সর চালের ভাত, ঢেঁকি-ছাঁটা। হাত রুটি, কয়েকরকম সবজি সেদ্ধ তার ওপর দুরকম সস ঢেলে, নিজের পোলট্রির লেগহর্ন মুরগীর ডিমের ডালনা। নিজের ডেয়ারির ছানা ও দুধ দিয়ে ছানার পায়েস। প্রত্যেকটি নিজের হাতে করা। জেঠিমা মারা যাবার পর থেকেই জেঠু নিজের হাতে রাঁধতে অভ্যস্ত। তাঁর ভেতরে বোধহয় একটা চাপা অভিমানও যে তাঁর একমাত্র ছেলে মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়েছে।
খাওয়ার শেষে হাতমুখ ধুয়ে অনেকক্ষণ দাবা খেলা হল। তারপর জেঠু আসল কথাটা বললেন। তাঁর আশা তাঁর এই স্কুল কলেজ হবে, সব থাকবে এক ক্যাম্পাসের ভেতর। কলেজের নিজস্ব ক্ষেত, খামার, বাগান, পোলট্রি, ডেয়ারি থাকবে বলে এই স্কুল-কলেজ অনেকটাই স্ব-নির্ভর হবে। সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হবে না বলে নিজেদের পাঠ্য তালিকা ও পরীক্ষা-পদ্ধতি তৈরি করার স্বাধীনতা থাকবে। এই প্রতিষ্ঠানের ভার দেবপ্রিয়কে নিতে হবে। খুব আনন্দের সঙ্গে এ প্রস্তাবে তখনই রাজি হয়েছিল দেবপ্রিয়। মেজজেঠু বলেন— ‘বহুদিন ধরে গ্রাম থেকে শহরের দিকে একটা বর্হিযাত্রা শুরু হয়েছে। ফলে গ্রাম শুধু দরিদ্র নয়, দীন হয়ে পড়ছে, প্রতিভাবাদীন, কল্পনাদীন। এই ব্যবস্থা পাল্টানো দরকার। গ্রামকে করতে হবে এতো শান্তিময়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ, অথচ জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধাসম্পন্ন যে শহরের লোক ক্রমে গ্রামের দিকে মুখ ফেরাবে।’
উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হয়ে তার হয়ে গেল মহা মুশকিলে। মেজ জেঠু বা তার পরিবারের কেউ তো ভাবেনই নি, সে স্বয়ংও ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে জেলাস্কুলের ফার্স্ট বয় উচ্চ মাধ্যমিকে রেকর্ড মার্কস পেয়ে প্রথম হবে। লক্ষ্য বদলে গেল। দেবপ্রিয়র নিজেরই ইচ্ছে হল সে ডাক্তারি পড়বে। পঞ্চায়েত প্রধান হাবু জ্যাঠা এবং গ্রামের অন্য পাঁচজন মাতব্বর ব্যক্তিও তাকে জয়েন্টের ফলাফল অনুযায়ী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবার জন্য চাপাচাপি করতে লাগলেন। মেজ জেঠুকে একটু চিন্তিত দেখাল। কিন্তু তিনিও পরে বললেন ‘গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসঙ্কট ও শিক্ষাসঙ্কট—কোনটা যে বেশি ভয়াবহ ঠিক করা মুশকিল।’ তাঁর আগের পরিকল্পনাটাকে তিনি সামান্য পাল্টালেন। দায়পুর গ্রামে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকলেও চলবে। বরং স্কুলের সঙ্গে একটি বৃত্তিমূলক কলেজ থাক। সেই সঙ্গে থাক স্বাস্থ্যকেন্দ্র যা ক্রমে একটি বড় আধুনিক হাসপাতালে পরিণত হবে। কলকাতা এবং আশপাশের হাসপাতালগুলোয় এই চূড়ান্ত অরাজকতা ও অব্যবস্থার দিনে জেলায় জেলায় উন্নত মানের হাসপাতাল গড়ে ওঠা আশু প্রয়োজন। দেবপ্রিয় নিজেকে এই হাসপাতালের কর্ণধার হিসেবেই তৈরি করুক। মেজ জেঠুর চিন্তাধারার মধ্যে না আছে কোনও গোঁড়ামি, না আছে অহমিকা, তিনি এইভাবে নিজের আশাকে দেবপ্রিয়র আশার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলেন।
দেবপ্রিয় সেই থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করছে। মামার বন্ধুর বাড়িতে থাকে সে পেয়িং গেস্ট হিসেবে। একতলায় তার নিজস্ব একটি ঘর আছে, দালান পার হয়ে বাথরুম। বাকি বাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না রাখলেও চলে। গোয়াবাগান অঞ্চলের বহু-শরিকি বাড়ি। এক বৃদ্ধ শরিক তাঁর নিজের অংশের একটি ঘর তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। দেবপ্রিয়র উচ্চাশার রকম সকম এখন ক্রমশই পাল্টে যাচ্ছে। তার মা বাবার আশা ছেলে তাঁদের বিষয় রক্ষা করবে, মেজ জেঠুর আশা সে তাঁর সমাজকল্যাণকেন্দ্রের অধ্যক্ষ হবে, তার প্রোফেসররা ইতিমধ্যেই মনে করতে শুরু করেছেন তার বিদেশ চলে যাওয়া ভালো। এদেশে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। দেবপ্রিয় অন্ধকারে পথ খুঁজছে। তার নিজের ধরনে। এই অন্ধকার বহু তরুণ-তরুণীর মধ্যে ভয়াবহ কাণ্ডজ্ঞানশূন্য এক প্রতিযোগিতার অন্ধকার। ছাত্রের উচ্চাশার সঙ্গে সমাজের উচ্চাশার প্রচণ্ড ফারাকের অন্ধকার। দেবপ্রিয় এই ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছু করবে কিন্তু তা তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের আশা পূর্ণ নাও করতে পারে। দেবপ্রিয় এখনও জানে না সে ঠিক কি করবে। ইতিমধ্যে তার ভালো লাগে সহপাঠী সহপাঠিনীদের প্রাণ-চাঞ্চল্য, কলকাতার নানারকম সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ, ভালো লাগে কলম ছোঁওয়াতেই শ্রেষ্ঠ উত্তরের মর্যাদা পাওয়া, মানবদেহের অন্ধিসন্ধির বিস্ময়, ভালো লাগে কোনও কোনও অধ্যাপকের সস্নেহ মনোযোগ, কারুর প্রতিভার পরিমণ্ডল, মামার বন্ধুর বাড়ির মামা-মামীদের উঁকিঝুঁকি স্নেহ-কৌতূহল। অথচ, এই সমস্ত ভালো লাগার অন্তরালে নির্ভুলভাবে কাজ করে যায় এক নাম না জানা বিষাদ। কেন, কি বৃত্তান্ত তা যেন দেবপ্রিয় জানে অথচ পুরোপুরি জানে না।
লোকগীতির অনুষ্ঠানের শেষে শান্তনু, বুল্টু, প্রমিত সবাই কলেজ স্কোয়্যারের মধ্য দিয়ে শর্ট কাট করছিল। তারা দেবপ্রিয়কে ওই ভাবেই বসে থাকতে দেখে।
—‘কি রে, এখানে?’ শান্তনু বলল।
—‘এমনি!’
—‘এমনি মানে? গান শুনিস নি। থ্যাচারের থাপ্পড় খাবার ইচ্ছে হয়েছে?’
দেবপ্রিয় বলল—‘শুনেছি। অফ অ্যান্ড অন। ঘরের মধ্যে বেশিক্ষণ আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। জানোই তো গ্রামের ছেলে।
—‘পালানকে তো তুই-ই যোগাড় করে দিলি। কিরকম পার্ফর্ম্যান্স দ্যায় দেখলি না! দারুণ গেয়েছে কিন্তু। হাঁড়ি বাজানো ছেলেটা কি যেন নাম? খগেন না? দুর্দান্ত।’
—‘জানি। ইনস্টিট্যুটে আর কি শুনলে? খোলামেলায় আরও ভাললা খুলত। আমি তো বলেই ছিলুম প্রেসিডেন্সির মাঠে শুদ্ধু একটা তক্তা পেতে হোক।’
—‘ও, তাই রাগ হয়েছে? রীগনস অবজেকশন ওভাররুল্ড্ বাই থ্যাচার? চলি। দেবপ্রিয় বাড়ি যাবি না।’
—‘তোমরা যাও। আমার তো এখান থেকে দু পা। আর শোনো, ওসব রাগটাগের কোনও ব্যাপার নেই।’
শান্তনু বলল—‘আহা হা হা, পার্সন্যালিটি থাকলেই পার্সন্যালিটি ক্ল্যাশ হবে। আমাদের নেই তাই হয় না।’
প্রমিত, বুল্টু, পুলকেশ আগেই এগিয়ে গিয়েছিল। শান্তনুও এবার পা বাড়াল। দেবপ্রিয় গলা তুলে জিজ্ঞেস করল—‘উজান যায়নি?’
—‘উজান? উজান এখনও পালান অ্যান্ড কোং-এর সুবন্দোবস্তর কাজে ব্যস্ত।’ ম্যাডামের আদেশ। লুকুও আছে। আরও দু এক জন তোদের নর্থের দিকের রয়েছে।’
দেবপ্রিয় কেন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। প্রমিতরা চলে যাবার পরও সে একই ভাবে বসে রইল। ঘণ্টাখানেক পরে, অর্থাৎ রাত প্রায় সোয়া নটায় উজান, মৈথিলী এবং লুকু যখন ওই একই জায়গা দিয়ে কলেজ স্ট্রিট যাবার জন্য শর্ট কাট করে তখনও তাকে বসে থাকতে দেখে। উজান বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে চটপটে। একে সে খেলোয়াড়, তার ওপরে আজকাল যোগাসন ধরেছে। স্পোর্টস শার্ট আর জিন্স পরে আছে। রঙ কালো। নাক চোখ মুখ খুব কাটা-কাটা, সমস্ত মুখটাই খুব সচল, সপ্রতিভ, তীক্ষ্ণ এবং মিষ্টি। উজান চলে প্রায় সব সময়েই কুইক মার্চের ভঙ্গিতে। সে আগে আগে আসছিল প্রায় লাফাতে লাফাতে, শূন্যে বল ছোঁড়ার ভঙ্গি করতে করতে মাঝে মাঝে। লুকু একবার বলল ‘উজান, কবে রণ্জিতে ফোর্টিন্থ্ সিলেক্টেড হয়েছিলি ভুলতে পারছিস না, না?’
উজান বলল—‘হাত পাগুলো ছাড়িয়ে নিচ্ছি।
মৈথিলী আর লুকু একটু পেছিয়ে পড়েছে। দুজনেই নিজেদের কথায় মগ্ন। মৈথিলী বলছিল ‘তুই প্রবলেমটা ধরতে পেরেছিস? কেষ্ট চায় পাবলিসিটি। ও আমাকে ওর পাবলিসিটি ম্যানেজার বানাতে চাইছে। পালান কিন্তু অতশত বোঝে না।’
লক্ষ্মীশ্রী বলল—‘বোঝে না তুই বুঝলি কি করে?’
—‘বাঃ, সমানে কদিন ওদের সঙ্গে ঘুরছি, এটুকু বুঝব না? পালানটাকে ও আলটিমেটলি ঠকাবে।’
উজান থেমে গিয়েছিল, ওদের শেষ কথাটা কানে যেতে হেসে বলল —‘তুই যে বলছিলি ওরা সহজ সরল। তুই-ই বোধহয় শহরে নিয়ে এসে ওদের মায়ামৃগ দেখালি তাহলে?’
মৈথিলীকে চিন্তিত দেখাল। সে বলল—‘ওরা গান করুক, পয়সা রোজগার করুক এটা আমিও চাই। সেই সঙ্গে ওদের সরলতটাও টিকে থাকুক! এই চাওয়ায় কি খুব অসঙ্গতি আছে?’
—‘আছে বই কি’ উজান বলল, ‘সেটা তুই নিজেই এখন বুঝতে পারছিস।’
—‘আচ্ছা উজান, সরলতা আর বোকামি কি এক? ইজ্নট্ সিম্পলিসিটি আ ভার্চু?
এই সময়ে দেবপ্রিয়কে ওদের চোখে পরল। উজান বলে উঠল—‘আরে দেব, তুই এখনও রয়েছিস?’
—‘হুঁ।’
‘লুকু বলল— ‘মৈথিল, তোর প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সামনে বসে রয়েছে। দেব সরল, কিন্তু দেবকে কি কেউ বোকা বলবে?’
উজান আশ্চর্য হয়ে বলল—‘দেব সরল? লুকু তুই দেবকে সরল বললি কি হিসেবে? মৈথিলী তোর মত কি? দেব কি সরল?’
লুকু বলল—‘ওর চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় ও কত ইনোসেন্ট।’
মৈথিলী বলল—‘তুই ভুল করছিস লুকু, সরল না হলেও কিন্তু নিস্পাপ হওয়া আটকায় না।’
উজান বলল—‘কি জানি, আই থিংক দেব ইজ আ ভেরি কমপ্লেক্স ক্যারেক্টার। দেব, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।’
দেব উঠে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ বসে বসে তার কোমর ধরে গেছে। এই সমস্ত কথাবার্তায় যোগ দেবার মেজাজ তার নেই। ভেতরে ভেতরে সে যেন প্রতীক্ষা ক্লান্ত। আড়মোড়া ভাঙ্গার ভঙ্গিতে দু হাত ছড়িয়ে সে শুধু বলল—‘আই ডোন্ট মাইন্ড।’
—‘যাবি না?’ উজান বলল।
—‘যাবো।’
ওদের সঙ্গে লম্বা লম্বা শিথিল পায়ে হাঁটতে লাগল দেবপ্রিয়। ওরা তিনজনে একই বাসে উঠবে, তিনজনেই দক্ষিণে থাকে। দক্ষিণের নানান বিন্দুতে, কিন্তু গড়িয়াহাট যাবার বাস পেয়ে তিনজনেই উঠে পড়ল। উজান দাঁড়িয়ে ছিল। মৈথিলী জানলার পাশে, লুকু খুব সম্ভব উল্টো দিকে জায়গা পেয়েছে। দেবপ্রিয় হাঁটছে। খুব মন্থর গতিতে। গোলদিঘির ঘুরন গেটের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়াল যেন ভেতরে যাবে না বাইরে থাকবে স্থির করতে পারছে না। একটি চেনা ফুচকাঅলা তার জিনিসপত্র গুটিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। বই পাড়া বহুক্ষণ বন্ধ। দেবপ্রিয় খুব সন্তর্পণে এক প্যাকেট সিগারেট বার করল, অনভ্যস্ত শ্লথ কাঁপা কাঁপা আঙুলে সে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর যেদিক থেকে এসেছিল সেই বাসস্টপের দিকেই ফিরে গেল। তার সিগারেটের ধোঁয়া এলোমেলোভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।