উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 02
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুট। লম্বা চওড়া মেরুন রঙের ব্যানার। মেরুনের ওপর সোনালি। রঙগুলো খুঁজে বার করতে মেলা ঝামেলা হয়েছে। গড়পড়তা ডেকোরেটরের কাছে গড়পড়তা রঙই পাওয়া যায়। যেখানে সেখানে সেই একই জিনিস ঝোলে। অথচ বর্ণছায়ের সামান্য এদিক-ওদিক হলেই ফলাফল কত আলাদা! আমরা আলাদা কিছু বলতে চাই। এই সমাজ, এই সংসার, এই-ই জীবনযাপন তবু ঠিক এই নয়। কোথাও একটা আলাদা উদ্দেশ্য, আলাদা বক্তব্য আছে। রঙে সেটা প্রকাশ না হলে চলে? বাজার উজাড় করে ফেলেছে ওরা ঠিক পছন্দসই মেরুনের শেডের জন্য। সঠিক, বিশুদ্ধ সোনালির জন্য। তা সত্ত্বেও গুঞ্জনের পছন্দ হতে চায় না। সে বলে, ‘মেরুন-সোনালি একেবারে প্রিহিসটরিক কম্বিনেশন। তোরা প্লীজ আর কিছু খোঁজ।’ অতঃপর মেরুন-সাদা, নীল-সোনালি প্রস্তাব আসে। যতীনবাবু ডেকোরেটর অনেক দিনের অভিজ্ঞ লোক, তিনি হাত উল্টে বলেন—‘তোমরা চাও আমি করে দিচ্ছি। কিন্তু খুলবে না। দূর থেকে চোখে পড়া চাই তো!’ অতএব মেরুন-সোনালিই বহাল। গুঞ্জনের আপত্তি সত্ত্বেও। গুঞ্জনের গুঁইগাঁই অগ্রাহ্য করে। গুঞ্জন সিং-এর অবশ্য ব্যাপারই আলাদা। ও সন্ধেবেলায় ইনটিরিয়র ডেকোরেশনের কোর্স নিচ্ছে। ক্রোম ইয়লো, সের্যুলিয়ান ব্লু, সানসেট অরেঞ্জ এইসব ওর রঙের নাম। উইলিয়ম মরিস, চিপেনডেল এইসব বুকনি সে যখন তখনই ঝাড়ে। আরে বাবা ব্ল্যাক মানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে এমনি তো সব তোর হবু-ক্লায়েন্ট। টাকাটা তাদের খরচ করতে পারলেই ভালো। হাজার হাজার টাকা দিয়ে নটরাজ কিনবে, শঙ্খ কিনবে, গণেশ-টণেশ কিনবে। আর এ হল ছাত্রসঙেঘর ব্যাপার, ছাত্রদের হাতখরচের টাকা দিয়েই যা-কিছু সব। মৈথিলী বার বার বলেছে : ‘ফান্ডের অবস্থা আমাদের ভালোই। কিন্তু বাইরের জাঁকজমক করতে গিয়ে টাকাটা আমরা খরচ করছি না। আসল উদ্দেশ্যটার কথা কেউ এক মিনিটের জন্যেও ভুলিব না। সেখানে কমপ্রোমাইজ নয়।’
‘লোকোৎসব, চ্যারিটি শো, আয়োজক ছাত্রসংঘ।’ মাঝে মাঝেই লাউড স্পীকারে একটা গম্ভীর গলা ভেসে আসছে—‘আমরা সামগ্রিক উন্নয়ন চাই। শিক্ষা যদিও যে কোনও উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত, আমরা জানি আর্থিক উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষাও কতদূর ব্যর্থ হতে পারে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থ এই তিনটে আমাদের প্রথম লক্ষ্য। আপাতত আমাদের উদ্দেশ্য একটি অনুন্নত, সহায়হীন গ্রামকে এই তিন স্তরেই সমর্থ করে তোলা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কেওড়াখালি গ্রাম….’
ইনস্টিট্যুটের গেটের বাইরে জটলা করছিল পাঁচ ছ’জন ছেলে মেয়ে। শান্তনু বলল—‘কি দিচ্ছে রে উজান! জ্ঞানকুম্ভ উজাড় করে দিলে যে!’
সুমেরু শান্তনুর সাক্ষাৎ সহপাঠিনী এবং খুড়তুতো বোন। সে মন দিয়ে তার আইসক্যান্ডির শেষাংশটুকু চাটছিল। সবুজ জিভ বার করে বলল—‘তুইও তোর কুম্ভ উজাড় করে দে না। দে! কে তোকে বারণ করছে।’
‘মাইকের ধারে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না যে উজোটা! দেখলেই বলছে—‘শান্ত, প্লীজ তফাৎ যা।’
—‘তাই সেই থেকে ঝুট হ্যায় ঝুট হ্যায় স্লোগান দিচ্ছিস?’ পুলকেশ সিগারেটের ছাই টোকা দিয়ে ফেলে বেশ কায়দা করে দাঁড়িয়ে বলল।
সুমেরু মন্তব্য করল ‘ওকেও একটু মাইকটা ছাড়লে পারত। ফাটা কাঁসির আওয়াজও তো একটা বিশিষ্ট আওয়াজ! ফর এ চেঞ্জ ভালো লাগতে পারে।’
শান্তনু বললে- ‘যা যা বাজে বকিস না, আইস-ক্রিম আর কোল্ড ড্রিংক খেয়ে খেয়ে তো নিজের গলাকে ট্রাঙ্কে পুরেছিল। গান করতে বসিস গাধা ছুটে আসে।’
সুমেরু হারবার পাত্রী নয়। সে হেসে বলল- ‘তাই সেদিন যখন মারোয়া সাধছিলুম, তুই ছুটে এলি!’
পুলকেশ বলল—‘ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি। তোরা তোদের লাঠালাঠি থামাবি? আসলে কি জানিস শান্তনু, কেউ কেউ নিজের গলা শুনতে বড্ড ভালবাসে।’
শান্তনু বলল—‘ভবিষ্যতে তারাই অব্যর্থ পলিটিক্যাল লীডার এবং ব্যর্থ অভিনেতা হয়। উজোটার নেতা হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।’
—‘সে তো হতেই পারে, বাড়ির ট্রাডিশন ফলো করতেই পারে।’ পুলকেশ বলল।
—‘বাড়ির ট্রাডিশন ফলো করবে উজান আফতাব? তবেই তোরা খুব বুঝেছিস,’ সুমেরু কাঠির সঙ্গে লেগে-থাকা অংশগুলো চেটে পুটে নিতে নিতে বলল।
—‘তবে কি ও রেভেলিউশন করবে?’-পুলকেশ জিজ্ঞেস করল।
—‘ও রেভিলিউশনের এককাঠি বাড়া কিছু করবে।’ সুমেরু বলল, ‘না করে আমার নাক কান কেটে নিস।’
শান্তনু বলল—‘নাক কান দুটোই দিয়ে দিলি? ব্যালান্স রাখবি কি দিয়ে?’
শুভব্রত এই সময়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল—‘হ্যাঁরে, ক্লাসে তো সব ভালো ভালো পাত্তর দেখেই টিকিট-বই ধরিয়েছিলি। তো সিনিয়ার কেউ আসছে না কেন বল তো!’
ছাত্র সংঘের সদস্যরা স্থানীয় ও বৃহত্তর কলকাতার কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ছড়িয়ে আছে এটা সত্যি। যে যার শিক্ষায়তনে টিকিট বিক্রি করছে। গোটা গোটা টিকিট-বই বাইরেও বিক্রি হয়েছে। আশা ছিল অনেক অভিভাবক স্থানীয় ব্যক্তিরা টিকিট কিনেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে গেট দিয়ে যারা দলে দলে ঢুকছে তাদের কেউই বাইশ পেরোয় নি। এরাই ঢুকছে প্রচুর, হই-হল্লা করতে করতে।
শান্তনুদের পাশ দিয়েই চার পাঁচ জন হাত ওপরে ছুড়ে হাসতে হাসতে ঢুকছে। একজন বলল—‘এই, টিকিট বিক্রির সময়ে যে বলল—‘ছাত্রমেলা, এ কেমন ছাত্রমেলা রে! তাহলে তো কলেজর কেলাসগুলোও ছাত্রমেলা!’
আরেকজন বলল—‘আহা হা হা, এটা ওদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, বুঝছিস না? মেয়েলি গলায় জবাব হল—‘সেটা পরিষ্কার করে বললেই তো পারত! মেলা ইজ ফাইন, অল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানস আর বোর্স। গোড়ায় স্পীচ, মাঝে স্পীচ, শেষে স্পীচ। মালা ফালা পরানো। বোগাস।’
—‘যা বলেছিস। কিছু লেখা টেকাও তত নেই। ইংরেজিতে একেই বলে চিটিংবাজি।’
—‘জার্মানে কি কয় জানিস?—চীটাগং-।’
আরেক জন সরু গলায় বলল—‘এবং ফ্রেঞ্চে ইহাকেই বলিয়া থাকে সাঁজেলিজে।’
দলটা হাসতে হাসতে ঢুকে গেল।
শান্তনু বলল—‘দিস ইস হিউমিলিয়েটিং। ছাত্রমেলা-ফেলা কি বলছে রে?’
—‘ওসব থ্যাচার সাহেবার ব্রেনওয়েভ’ সুমেরু বলল—‘সারা বছর ধরে ছাত্রমেলা করবে, এই লোকোৎসব দিয়ে শুরু…প্রদর্শনী..সেমিনার..কর্মশালা..অল অন নিরক্ষরতা দূরীকরণ..এই সব সেদিন ক্যানটিনে এসে বলছিল না! ওর সেলসম্যানরা কেউ কেউ নিশ্চয় সে সব বুকনি তুলে নিয়ে ওদিকে নামিয়ে দিয়ে এসেছে।’
কোরা রংএর শাড়ির ওপর নীল গোলাপি ব্যাজ লাগিয়ে গুঞ্জন এদিকে আসছে দেখা গেল। হাতে এক গোছা ব্যাজ।
—‘এই তোমরা এখনও ব্যাজ পরো নি। শো তো শুরু হতে চলল।’
শান্তনু বলল—‘আমরা ভলান্টিয়ার নই। সুমেরু বা পুলকেশ হতে পারে। আমি নই।’
—‘কী তবে তুই? আর কোন কাজে লাগবি?’
—‘কেন? ঘোষক, পরিবেশক, প্রতিবেদক।’
—‘ওরে বাবা রে থামলি কেন? বলে যা.. প্রচারক, প্রসারক, প্রতারক…’ সুমেরু বলল—‘আমাকে একটা দিতে পারিস গুঞ্জন। বেশ স্মার্ট লুকিং রে তোর ব্যাজগুলো।’
গুঞ্জন ব্যাজের গোছাশুদ্ধ হাতটা শট করে সরিয়ে ফেলল—‘ও সব চলবে না। গজল্লা ছাড়ো। আইসক্রিমও ছাড়ো। ছেড়ে ভেতরে যাও, হলের সামনে লোক আছে। টর্চ নিয়ে ভেতরে যাও। নইলে পাচ্ছে না। স্পেশাল ডিজাইন, অর্ডার দিয়ে করিয়েছি ঠিকই। তাবলে এগুলো গয়না নয়।’
হলের ভেতর এই সময়ে আলো নিভতে শুরু করল। নিভন্ত আলোয় বোঝা যায় হল প্রায় ভর্তি। ব্যস্ত-সমস্ত কর্মীরা মাথা নিচু করে স্টেজের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। হলময় একটা মৃদু গুম গুম ধ্বনি। জমাটি আসরের লক্ষণ। এবং যেহেতু সবাই তরুণ-তরুণী, অনুষ্ঠান দেখা বা শোনার আগ্রহের চেয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ ও মত বিনিময়ের ইচ্ছেটা বেশি প্রবল।
সামনের সারিতে মউমিতা তার পাশে-বসা চিত্রলেখাকে বলল—‘এখনও দেখতে পাচ্ছিস না? ওই তো থার্ড রোয়ের ডান দিকের কোণে!’
মউমিতা ও চিত্রলেখা প্রতিবেশী। এক হাইরাইজে থাকে। কিন্তু দুজনের কলেজ, বিষয় সবই আলাদা। মউমিতার চিত্রলেখাকে ছাত্র সংঘের সদস্য করার ইচ্ছে। চিত্রলেখার কৌতূহল খুব। ছাত্র সংঘ গড়েছে কলকাতার কিছু নামকরা ছেলে মেয়ে যাদের অনেককেই ছাত্রমহলে এক ডাকে চেনে।
চিত্রলেখা বলল—‘কোন জন?’
—‘পেছন ফিরে কথা বলছে। ঘাড় ফেরালেই মুখটা পুরো দেখতে পাবি। চেক শার্ট।’
—‘ঢেউ খেলানো চুল মাথায়? শামলা?’
—‘উঃ। ওকে আমি চিনি না। ওর পাশে। বেশ ফর্সা। ঝাঁকড়া চুল। সেকেন্ড ফ্রম রাইট!’
—‘দাঁড়া দাঁড়া বুঝেছি। ও-ই দেবপ্রিয় চৌধুরী?
—‘ও-ই দেবপ্রিয় চৌধুরী। কৌতুহল মিটল তো? এবার নাচটা দেখতে দে।’
—‘আহা কি নাচ। বিহু নাচ, চালি নৃত্য একটা যা হোক বলে দিলেই তো লোকনৃত্য হয়ে যায় না! মেয়েগুলো তাদের এক সাথে পা ফেলাটাও প্র্যাাকটিস করেনি মনে হচ্ছে। স্টেজের এদিকটাই বেশি ইনটারেস্টিং।’
—‘বাবা, এরই মধ্যে এতো? তবু তো এখনও উজানকে দেখিস নি!’
—‘উজান! উজান কে!
—‘উজানকে আমরা টি. ডি. এইচ বলি নিজেদের মধ্যে। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসম, মেয়েদের হার্ট থ্রব। তুই উজান আফতাবের নাম শুনিস নি?’
—‘শুনেছি শুনেছি মনে হচ্ছে! ক্রিকেট, না?’
—‘টেনিসও।’
—‘কোনটা রে উজান?’
—‘আগে দেবপ্রিয় চৌধুরীকে গলাধঃকরণ কর। কোন কাল থেকে নাম শুনছিস, আজই তো প্রথম চক্ষু সার্থক করলি?’
—আচ্ছা মউ, সত্যি সত্যি দেবপ্রিয় গাঁয়ের ছেলে!’
—‘সেন্ট পার্সেন্ট সত্যি। রেকর্ড মার্কস পেয়েছিল জানিস তো?’
—‘জানি বলেই তো বলছি, গ্রীন রেভোলিউশন না কি রে?’
—‘বলতে পারিস।’
—‘আলাপ করাবি তো আজ?’
—‘কথা দিতে পারছি না। ওকে ধরা মুশকিল।’
এই সময় রঙ্গশালায় দেবপ্রিয় পাশের ছেলেটিকে কি যেন বলে উঠে দাঁড়াল। পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে, মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে অন্যমনস্কভাবে সে চলে যাচ্ছে। সামনের চুলগুলো কপালের ওপর এলোমেলোভাবে এসে পড়েছে। যতটা লম্বা তার চেয়েও বেশি দেখায় দেবপ্রিয়কে। কারণ পাগুলো ওর বেশি লম্বা। হাঁটার ধরণটাও কেমন আলগা আলগা। বড় বড় পা ফেলে খুব কম সময়ের মধ্যে সে পার হয়ে গেল অডিটোরিয়ামটা। প্রথমটা স্টেজের আলো ছিটকে পড়েছিল তার মুখে। অল্পস্বল্প দাড়ির ওপর। খয়েরি চেক শার্টটার কাঁধের ওপর। তারপর তার মুখ অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে চলে গেল।
আসলে দেবপ্রিয়কে নিয়ে ছাত্রমহলে, বিশেষত ছাত্রীদের মধ্যে খুব কৌতূহল। ছেলেটি অতিমাত্রায় চুপচাপ। অহংকারী তো নয়ই। বিনয়ীও নয় আদৌ। কেউ বলে অজ পাড়া-গাঁ থেকে এসেছে। কেউ বলে মফঃস্বল শহর থেকে, কেউ আবার বলে ওর পরিবার ভিন্ন রাজ্যে থাকে, ও বরাবর বোর্ডিঙে মানুষ। এরকম কথাও প্রচলিত আছে যে অভিভাবক বলতে ওর কেউ নেই। দূর সম্পর্কের আত্মীয়-পরিবারে টিউটর হিসেবে থাকে। যেহেতু দেবপ্রিয় মিশুক নয়, কারও কোনরকম কৌতূহলকে তৃপ্ত করবার পাত্রই নয়, তাই কৌতুহল বেড়েই চলে। কিছু মেয়ে চটপট তার জন্য পাগল হতে থাকে। কিন্তু বেশিদিন এ অবস্থা থাকে না। কারণ দেবপ্রিয় না রাম না গঙ্গা। সে যেন নিজের ভেতরে কোথাও ডুব গেলে বসে আছে। আবহমান কাল থেকে সে যেন কোথাও থেকে অন্য কোথাও উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে যাচ্ছে। তার চোখ নেই পথের দুপাশে, মাথার ওপর আকাশে, অথবা চারপাশের বাতাবরণে কি ঘটছে দেখার। এই উদাসীনতা তার এক ধরণের আবরণ। এমন এক মোহ-আবরণ যা চট করে ছিন্ন হতে চায় না, কষ্ট দেয়। এই উদ্দেশ্যহীনতা তার আকর্ষণও। কারণ, আপাততঃ জগতে তো বটেই, এমন। কি এই ছাত্র-জগতেও এমন বিশেষ কেউ নেই, যে উদ্দেশ্যহীন, কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য যে হিসেব-পত্র করে এগোচ্ছে না। এত মন্থর, এতো আনমনা, অথচ এতো আত্মস্থ ঠিক কাউকে চোখে পড়ে না আজকাল। যদিও জানা যায় না দেবপ্রিয় সত্যি সত্যিই উদাসীন, লক্ষ্যহীন, না কি এটা শুধুই তার সম্পর্কে একটা ধারণা। তার চারপাশে সেই অজানারও আবরণ। অজানা মানেই রহস্য, রহস্য মানেই মোহ।
স্টেজের ওপর এখন ঘোষক। ঠিকঠাক বলতে গেলে ঘোষিকা। মাইক হাতে ভাঙা-ভাঙা মিষ্টি গলায় বলল—‘এইবার আরম্ভ হবে আমাদের আজকের আসল অনুষ্ঠান। নাচ সহযোগে বাউলগান। আপনারা শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় বা কেঁদুলিতে জয়দেবের মেলায় বাউল গান শুনেছেন। আমাদের বাউল-বন্ধুদের প্রথম বৈশিষ্ট্য এঁরা কেউই কোনদিন মাইক্রোফোনের সামনে, শহর বাজারের পরিবেশে গান করেন নি। এঁদের গানে পাবেন সহজিয়া শ্রেণীর সরলতা ও বিশুদ্ধতা। এঁদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য…’
মউমিতার সঙ্গিনী চিত্রলেখা বলল—‘কে রে মেয়েটা! জঘন্য দেখতে। মউমিতা একটু বিরক্ত হয়ে বলল—‘শুধু দেখিসনি। শোনও। ইচ্ছে হয় চোখ বুজে শোন। গলা, ডেলিভারি, থ্রো এগুলো শোনবার জিনিস।’
চিত্রলেখা বলল—‘তা অবশ্য। গলাটা সত্যি দারুণ!’
—‘স্বীকার করছিস তাহলে? এ হল মৈথিলী ত্রিপাঠী।’
—‘এ-ইতোদের মৈথিলী?’ চিত্রলেখা উত্তেজনায়, সোজা হয়ে বসল, ‘তোদের বিশ্ববিখ্যাত স্কুলের বিশ্ববিখ্যাত ফার্স্টনন্দিনী? যে এইচ-এস-এ স্ট্যান্ড করবে বলে তোদের হোল স্কুল বাজি ধরে হেরেছিল? এখন কি করছে রে?’
—‘ডাক্তারি পড়ছে। জয়েন্টে ফার্স্ট এসেছিল। জয়েন্টের রেজাল্ট নিয়ে তো আর হই-হই হয় না।’
—‘বাব বাঃ। কি করে পারে রে?’
মউমিতা বলল—‘কপাল!’
—‘সবই কপাল বলছিস?’
—‘কপালের ভেতরেও কিছু আছে ডেফিনিট।’
ঘোষণাটা শেষ হয়ে গেছে। মৈথিলী ত্রিপাঠী মাইক ছেড়ে বাঁ-উইঙ্স্-এর দিকে ঢুকে গেল। একটু পরেই দেখা গেল পাশের দরজা দিয়ে সে রঙ্গশালায় ঢুকছে। মৈথিলী বেশি লম্বা নয়। বেশ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য, মুখটা চওড়া। নাক একটু চ্যাপটা ধরনের, ফলে চেহারায় মধ্যে একটা চৌকো ভাব এসে গেছে। বেশ কালো রং কিন্তু খুব চকচকে। ঠোঁটদুটি বেশ স্কুল এবং ঢেউ খেলানো। তার চোখের মণি খয়েরি। একটু মোটা সংক্ষিপ্ত ভ্রু। চুল ঈষৎ লালচে। কপালের ওপর কয়েক গুচ্ছ, কানের লতির তলা থেকে ফণার মতো কিছু চুল বেরিয়ে আছে, বাকিটা পিঠের ওপর। মৈথিলী ব্যাগিজ ছাড়া কিছু পরে না।। ওপরের শার্টটা মেটে লাল, তাতে সাদা চক্র চক্র ছাপ। ছোট চাকা, বড় চাকা।
মউমিতা চাপা গলায় ডাকল—‘মৈথিলী, এখানে জায়গা আছে, বসবে?’ তার গলায় সম্ভ্রম, আগ্রহ। সে যে মৈথিলীকে একটা উঁচু বেদীর ওপর বসিয়ে রেখেছে সেটা তার প্রশ্নের ধরনেই স্পষ্ট।
মৈথিলী চট করে মুখ ফিরিয়ে তাকাল, মুখে মৃদু অন্যমনস্ক হাসি। বলল—‘আমি মাঝের রোয়ে একটা জায়গা রাখতে বলেছি লুকুকে। মাঝখান থেকে দেখব, ডোন্ট মাইন্ড।’ বলতে বলতেই সে সামান্য নিচু হয়ে স্টেজের সামনেটা পার হয়ে গেল।
চিত্রলেখা বলল—‘ডাঁটিয়াল? না রে?’
মউমীতা বলল—‘ডাঁটিয়াল? কই না তো। মাঝখান থেকে দেখবে বলল শুনলি না! লোকগীতি নিয়ে মেতেছে এখন ওর কোনদিকে খেয়াল নেই। এই যে বাউল ছেলেগুলো গাইছে ওদের দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব ও নিয়েছে। নিজেই খুঁজে বার করেছে ওদের, ট্যাঁকে করে করে ঘুরছে চব্বিশ ঘণ্টা। রাম পাগল একটা।’
—‘তোর সঙ্গে আলাপ কেমন?’
—‘আছে। তবে ওদের গ্রুপ আলাদা, ওরা ছাত্রসংঘের একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার। সমস্ত প্ল্যানিং, পলিসি মেকিং ওরা করে, আমরা সাধারণ সদস্য। চাঁদা দিই। প্ল্যান, পলিসির কথা শুনি। বাইরে থেকে কাজ করি। ওই যে লুকু শুনলি না? লুকু ওর ফাস্ট ফ্রেন্ড, স্কুল ডেজ থেকে। একেবারে ল্যাং বোট, লুকুটা স্লাইট ডাঁটিয়াল। মৈথিলী কিন্তু ভীষণ ভদ্র মেয়ে, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে আলাপ করে, ডেকে ডেকে, প্রথম যে ছাত্রসংঘের সভ্য হবে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সবার সঙ্গে বসতে হবে। রীতিমত ইনটারভিউ, কেন সদস্য হচ্ছে, কি আশা করে, দেশ সম্পর্কে ভাবে কি না, রাজনীতি করে কি না।’
‘ছাত্রসংঘের রাজনীতি কি রে? নিশ্চয়ই মার্কসিস্ট।’
‘একেবারেই না। কোনও দলীয় রাজনীতি করে এমন ছাত্র-ছাত্রীকে আমরা সদস্যই করি না। মৈথিলী বলে, যারা রাজনীতি করে তারা একভাবে চেষ্টা করছে, আশা করি দেশের জন্যই করছে। এ নিয়ে বেশি তর্ক-বিতর্কের মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু ছাত্রসংঘ এদের সমান্তরালে চলবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ অ-রাজনৈতিক। আমরা কি স্টাডি করি জানিস তো? পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক সোস্যাল সায়েন্স বলতে পারিস।’
‘দারুণ পার্সন্যালিটি, না?’
‘ওরে ব্বাবা দারুণ। নইলে এত বড় প্রতিষ্ঠান চালাতে পারে? একে আই এ এস এর মেয়ে তার ওপর লেখাপড়ায় ওইরকম। যতটা করা উচিত ততটা ভালো রেজাল্ট অবশ্য সেই এইচ এস থেকেই করছে না। করবেই বা কি করে? সারাক্ষণই তো কোনও না কোনও কাজ নিয়ে রয়েছে। চিন্তা কর মেডিক্যাল কলেজের সিলেবাস সামলে সারাক্ষণ ছাত্রসংঘ করছে। ওর সঙ্গে কাজ করতে কত বস্তিতে গেছি। সাক্ষরতা-অভিযানে যাবে আমাদের সবাইকে নিয়ে। মাসি, পিসি, চাচা করে এমন গল্প জুড়ে দেবে না! বর্ণ-লীডার রে মেয়েটা। ওই যে ওই দ্যাখ লুকু…’
‘কই?’
‘ওঃ তুই তালকানা আছিস। পেছন থেকে এগিয়ে আসছে, দ্যাখ না!’
—‘সাদা চুড়িদার, পিংক ওড়না?’
—‘হ্যাঁ।’
—‘ফ্যানটাসটিক দেখতে যে রে!’
—“ও তো স্কুল ডেজ থেকে মডলিং করছে টুথ পেস্টের, চা-এর।’
—‘তাই কেমন চেনা-চেনা লাগছিল।’
—‘এখন আর করে না অবশ্য। ওর যা পীয়ার গ্রুপ, তাল রাখতে হলে সীরিয়াস হতেই হবে। ও তো দেখছি মৈথিলীর জায়গা রাখে নি, নিজেই বসতে পাচ্ছে না বোধহয়। গেল কোথায় মৈথিলীটা।’
—‘তুই যে বললি ও মৈথিলীর ল্যাং-বোট!’
—‘শুধু আমি কেন! সবাই বলে।’
—‘বিউটি অ্যান্ড দা বীস্ট যে রে।’
—‘যা বলিস।’ মউমিতা কথা বাড়াতে চাইল না। স্পষ্টই বোঝা যায় যে মৈথিলী ত্রিপাঠীর গুণমুগ্ধ। চিত্রলেখার কথা শুনতে তার একটুও ভালো লাগছে না। মউমিতা ও চিত্রলেখা এবার মঞ্চের বাউল গানে মন দিল। ঘুরে ঘুরে নাচছিল যে ছেলেটি তার মুখটা খুবই কচি-কাঁচা, বয়স এদের থেকে কম বই বেশি হবে না। এখনও গোঁফ ওঠে নি। কোমল চামড়া। মঞ্চের পেছনের অংশে তার সঙ্গে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে গাইছে আর একটি ছেলে। সে গানের বিশেষ বিশেষ জায়গায় বিশিষ্ট বাউল ভঙ্গিতে পাক খাচ্ছিল। এ ছেলেটির বয়স সামান্য বেশি। মৈথিলী এর নাম ঘোষণা করে কেষ্টপদ দাস। সামনের ছেলেটি নিরুপাধিক পালান।
মৈথিলী জায়গা পায়নি। লুকুকে সে মোটে দেখতেই পায়নি। মঞ্চের ওপরকার ব্যবস্থা মৈথিলীর, সে তার গ্রামীণ অতিথিদের সাজ পোশাক, স্টেজে তাদের দাঁড়াবার জায়গা, আলোকসম্পাত ইত্যাদি নিয়ে গোড়া থেকেই ব্যস্ত আছে। লুকু খাওয়া-দাওয়ার দিকে। ইনস্টিট্যুটে এসেছিল দুজনে এক সঙ্গে। কিন্তু তারপর থেকে আর সম্পর্ক নেই। ভেবেছিল দুজনে বসে দেখবে এক সঙ্গে। অবশ্য একটা রুমাল ফেলে বা ব্যাগ রেখে ‘জায়গা রাখা’ তাদের কারোই পছন্দ নয়। এক যদি স্বেচ্ছাসেবকদের কাউকে বসিয়ে রাখা যেত। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, লুকু এ ব্যবস্থাটা করতে সমর্থ হয়নি। কিছুক্ষণ জায়গা পাবার আশায় বৃথা ঘুরে, বিরক্ত হয়ে সে মঞ্চের দিকে যাচ্ছিল, উইংস-এর আড়াল থেকে একটা টুল পেতে বসে শুনবে, পালান হয়ত তাকে দেখলে উৎসাহিত হতে পারে। ছেলেটা কখনও এত লোককে গান শোনায়নি। তার ওপর সামনে মাইক যন্ত্র। ভিতু ভিতু চোখে তাকিয়ে বলেছিল, —“বাব্রে, কুয়োর মধ্যে এ যে দেখি অনেক নোক গো দিদি, মাইক যন্তরে গলা বসে যায় না তো।
এই সময়ে মৈথিলী রঙ্গশালার বাইরের করিডর দিয়ে প্রোফেসর মেধা ভাটনগরকে ঢুকতে দেখল। মৈথিলী তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে মিস ভাটনগর বললেন—‘মৈথিলী, আমি কিন্তু অনেকক্ষণ এসেছি। একদম পেছনে বসেছি। তোমাকে খুঁজতেই এদিকে এলাম।
মৈথিলী বলল—‘সে কি আপনি সামনের দিকে জায়গা পান নি? ভলান্টিয়াররা কি করছে?’
—‘শোনো, ওরা বলেছিল, প্রমিত সামনের সারিতে জায়গা করে দিতে চাইছিল। আমি ইচ্ছে করে সামনের দিকে আসিনি। কাউকে উঠিয়ে বসতে আমার একদম ভালো লাগে না। তাছাড়াও, তোমাদের মঞ্চটাই তো সব নয়, প্রেক্ষাগৃহটাও আমার দ্রষ্টব্য ছিল, আই ওয়ান্টেড টু সি দা এনটায়ার প্রজেক্ট ইন ইটস রাইট পার্সপেকটিভ। রূপাদের গ্রুপের নাচটা কিন্তু একদম লোকনৃত্য হয়নি। ওদের অনেক অভ্যেস করে তবে নাবা উচিত ছিল। বাউল গানটা তোমরা একদম খাঁটি জিনিস দিচ্ছো, লোকনৃত্যের বেলায় সিউডো ফোক ডান্স দিচ্ছো এটা ঠিক না। কসটিউম যদিও খুবই ভালো হয়েছে।’
মৈথিলী বলল—কসট্যুম গুঞ্জনের এলাকা। নাচের পরিকল্পনা রূপা নিজেই করেছে। মধুচ্ছন্দাদি তো এখন ট্রুপ নিয়ে উত্তরভারত ট্যুর করতে গেছেন। পরের বারে ওঁকে ধরব।’
—‘রূপা অবশ্য খুব খারাপ করে নি। কিন্তু টিকিট বিক্রি করেছে যখন, এর থেকে ভালো স্ট্যান্ডার্ড লোকে আশা করবে। যাই হোক পালান অসাধারণ। কেষ্ট দাসও ভালো। কিন্তু পালান একটা আবিষ্কার। এমন বাঁশের বাঁশির সুর অথচ এতো জোরালো আমি শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে ও বড্ড বাচ্চা। ওর গলা পাল্টাবে।’
মেধা ভাটনগরের কথায় মৈথিলী মনে মনে খুব উদ্বেলিত হয়ে উঠল। তার কিশোর-বন্ধু পালানের গলা সোনালি জরির সুতোর মতো, চকচকে, টানটান, ধারালো। একেক সময়ে যেন তারার সা ছুঁয়ে আসছে। কেষ্টপদ আর পালানের এই দ্বৈত সঙ্গীত তারই পরিকল্পনা। যে পটভূমিতে বাউলগান সবচেয়ে মানানসই, সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে নেই। মৈথিলীর মনে হয়েছিল তার কিছু একটা বিকল্প চাই। তাই এই দ্বৈত সঙ্গীত। পালানের চিকণ গলার সঙ্গে কেষ্টপদর ভারি খসখসে তসরের মতো গলার বুনোট সত্যি একটা অভিনব পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নাচের পুরো এফেক্টটা সে দেখতে পাচ্ছে না। পালান প্রায় সর্বক্ষণই নেচে নেচে গাইছে, তার হাত পা মুখ সবই খুব কচি। ঠিক একটা সতেজ লাউডগার মতো তার নড়ন-চড়ন, খুব হালকা ফুরফুরে। কেষ্টপদ নাচছে তার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে, খুব মাঝে মাঝে, এ যদি ডাইনে পাক দেয় তো ও দেয় বাঁদিকে।
মেধা বললেন, ‘আরও হাফ-ডজন বাউল ছেলেকে গানের অন্তরায় সঞ্চারীতে ঢুকিয়ে দিতে পারো এর পর। মুখটা পালান একা আরম্ভ করল, তারপর ধরো ওই ছেলেটি কেষ্টপদ, তারপর একে একে বাকিরা। তাতে তোমার ভিশুয়ালটা আরও জমবে।’
মৈথিলী বলল—‘আর কিন্তু যোগাড় করতে পারি নি, দিদি।’
—‘আহা পারো নি, এর পরে পারবে। পালানদের যদি ভালো পাবলিসিটি দিতে পারো তো ওরাই যোগাড় করে আনবে।’
মৈথিলী একটু দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল, ‘এই অনুষ্ঠানটা কিম্বা বাউলদের পাবলিসিটি দেওয়া কিন্তু আমাদের সঙেঘর আসল উদ্দেশ্য নয় দিদি। আমাদের সব কথা এখনও আপনাকে বোঝানো হয় নি।’
মেধাদি আশ্চর্য হয়ে তাকালেন—‘তোমরা অবশ্য খুব বেশি কথা আমায় বলো নি, মৈথিলী। কিন্তু আমি যতদূর বুঝেছি তোমাদের প্রজেক্ট ঠিকঠাক চালাতে হলে এরকম অনুষ্ঠান আরও করতে হবে। তাছাড়া একটা গ্রামের উন্নয়ন যখন করছ, তখন সেটা করতে গিয়ে অন্যান্য যাদের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে তাদেরও অটোমেটিক্যালি কিছু না কিছু ফললাভ হবেই। উন্নয়নও হবে। কোনও কাজই স্বতন্ত্র, আইসোলেটেড নয়। নদী যখন পাহাড় থেকে নামছে তখন তাঁর লক্ষ্য সমুদ্র, কিন্তু পুরো অববাহিকাটা সে সবুজ করে দিয়ে যাচ্ছে। তোমরা একটা সচেতন, চিন্ময় নদী, তোমাদের অববাহিকা তোমরা কনশাসলি সবুজ, মরুহীন, সমৃদ্ধ করবে। উজান কোথায়?’
—‘উজান বাইরের মাইকটা কনট্রোল করছে, তাছাড়াও আরও অনেক কাজ। কি জানি কোথায়।’
—‘দেবপ্রিয়কে কোনও কাজ দাও নি? মনে হল ও বেরিয়ে গেল।’
—‘জানেন তো মেধাদি, ও পেছন থেকে অনেক কিছু করে দেয়, সামনে কিছুতেই আসবে না।’
মেধা একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দেবপ্রিয়র এই কূর্মস্বভাব কিছুতেই কাটানো যাচ্ছে না। বললেন—‘যাক তোমাদের টাকা কেমন উঠেছে?’
—‘আমাদের ফাণ্ডের টাকা সামান্যই খরচ হয়েছে। এই অনুষ্ঠানের জন্য সামান্য যেটুকু হয়েছে ইলেকট্রিসিটি, টিকিট-ছাপানো আর পালানদের দক্ষিণাবাবদ কিছু গিয়ে ব্যালান্স ভালোই আছে। আর শো থেকে মোট কত উঠল সেটা এখনও গোনা গাঁথা হয়নি। ওটা দেব করবে।’
—‘ঠিক আছে। আমি কিন্তু একটু পরেই চলে যাবো। আমার কাজ আছে জরুরি।
—‘গানগুলো পুরো শুনবেন না?’
—‘কিছুটা তো শুনবোই। শেষ অবধি থাকতে পারছি না। তুমি হিসেবপত্র সেরে কাল-পরশুর মধ্যে একবার এসো, তোমরা সকলেই এসো। নিরঞ্জনকেও আমি জানিয়ে রাখবো। ঠিক আছে তো?’
মেধা আর না দাঁড়িয়ে রঙ্গশালার দিকে চলে গেলেন।
লুকু অডিটোরিয়ামে ঢুকেছিল আগে একবার। জায়গা ছিল না, তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল, তাছাড়াও সে বড় অন্যমনস্ক ছিল, যেন কাউকে খুঁজছে, না পেয়ে হতাশ, বিভ্রান্ত বোধ করছে। এই সময়ে সে পেছন দিক থেকে এসে আরেকবার ঢুকল। মেধা তখন নিজের জায়গায় বসছেন। তাঁকে দেখেই লুকু চট করে বেরিয়ে গেল একেবারে বাইরের গেটের কাছে। সেখানে তখন প্রচুর ভলান্টিয়ার জড়ো হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবার পর প্রথম আধঘণ্টা পর্যন্ত ভলান্টিয়ারদের খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। এখন সে ব্যস্ততা কমে এসেছে। অনেকেই হলের ভেতরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ-কেউ বা জায়গা পেয়ে বসে গান শুনছে। প্রমিত, বুল্টু, শুভব্রত, শান্তনু সবাই একে একে প্রমিতের লাইটারের সাহায্যে সিগারেট ধরাচ্ছিল গেটের কাছে। লুকুকে আসতে দেখে প্রমিত বলল—‘হয়ে গেল। কে জি বি আ গয়া।’
লুকু আঙুল তুলে চোখ পাকিয়ে বলল—‘দেখো কে জি বিই বলো আর পেন্টাগনই বলো তোমরা তোমাদের অ্যালটেড ডিউটি ঠিক মতো না করলেই হেড কোয়ার্টার্সে রিপোর্ট করতে বাধ্য হবো। প্রমিত, তোমার ওপর খাওয়া-দাওয়ার ভার ছিল না? তুমি এখানে স্মোক করছো!’
প্রমিত বলল—‘একটু রেসপাইট দাও মাদমোয়াজেল। কতগুলো প্যাকেট বাঁধা যে সুপারভাইজ করেছি যদি জানতে! নইলে বাকি ভাণ্ডারাটার ভার না হয় ইয়োর হাইনেসেই নিলেন। শ্রীমান পালান এবং সম্প্রদায় ও বেলা যা টেনেছে, এ বেলায় আমি আর এগোতে সাহস পাচ্ছি না। ওই যে হাঁড়ি বাজায় যে ছেলেটা। উরি ত্তারা!’
বুল্টু বললে—‘খগেন। আচ্ছা এইটুকু একটা ছেলের নাম খগেন্দ্রনাথ। কোনও মানে হয়? এদিকে দেখবি বুড়ো জ্যাঠামশায়ের নাম হয়ত খোকা। পাকা চুল, পাকা গোঁফ, পাকা ব্রেন, খোকাবাবু আসছেন।’
শান্তনু বলল, ‘যা বলেছিস, তবে এ ছেলেটা যেরকম সাঁটাচ্ছে, তাতে খুব কুইক ও খগেন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে পারবে। মানিয়ে যাবে নামটা দেখিস।’
—‘কি মেনাস রে এ বেলা! এই লুকু! ওবেলা তো খিচুড়ি আর লাড়া ঢালালি।’ বুল্টু সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল।
প্রমিত বলল—‘লুচি, আলুর দম আর মোহন ভোগ। লুচি ডালদার। মোহনভোগে নাকি রিয়্যাল ঘি আছে। থ্যাচার সাহেবার নিজের করা মেনু। লুকু কি কাউকে খুঁজতে এদিকে এলে? এনিবডি ইন পার্টিকুলার?’
লুকু জবাব দিল না। সে সুমেরুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
বুল্টু বলল—‘এরকম পিকিউলিয়ার মেনু কোথেকে পায় রে?
প্রমিত বলল—‘মেনুর সম্বন্ধে তুই কি বুঝিস রে? থ্যাচারের বিশেষ হুকুম আছে ওদের সরল, গ্রামীণ জিহ্বা যেন কোনমতেই শহুরে জটিলতায় নষ্ট না হয়, মোহন ভোগ বাড়ি থেকে করিয়ে এনেছে।’
—‘বলিস কি রে? গ্র্যান্ড মা থ্যাচারের নিমন্ত্রিতদের স্টম্যাকের ক্যাপাসিটি সম্পর্কে কনসেপশন আছে তো? আমাদের বোধ হয় আর জুটবে না।’
লুকু বলল—‘ওদের ক্যাপাসিটি সম্পর্কে তুই না-ই ভাবলি বুল্টু। অয়েল ইয়োর ওন মেশিন। তাছাড়া মোহনভোগ তোদের জন্য নয়। এমনিতেই পচ্ছিস না। ওদের স্পেশাল।’
—‘কেন রে, ওরা কি বরযাত্রী নাকি?’
লাউড স্পিকারে উচ্চস্বরে পালানের গান শোনা যাচ্ছিল। একটু আগেই কেষ্টদাস একটা ভাটিয়ালি শেষ করেছে। পালানের এটা দ্বিতীয় গান।
প্রমিত বলল—‘শুনতে দে। শুনতে দে। বড় ভালো গাইছে রে ছেলেটা আহা হা হা।’