উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 16
লুকুর দিনগুলো ভারহীন, হালকা কাটছে। পাখির মতো উড়ানে মত্ত, কিংবা মাছের মতো সাঁতারে সমর্পিত। এম এ পার্ট ওয়ানটা দেবার পরই সে গুঞ্জনের পরামর্শে একটা বিউটিশিয়ানস কোর্স নিয়ে নিয়েছিল। কিছু কিছু মডেলিং শুরু করেছে আবার। ভালো টাকা রোজগার করছে লুকু। ভাইয়ার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছে পার্কে গিয়ে। আরও কিছু কিছু পাড়ার বন্ধুরা আসে। তাদের অনেককেই অবশৎ সে পছন্দ করে না। কিন্তু খেলার মধ্যে দিয়ে সম্পর্কটা ভালোই থাকে।
বিশ্বজিৎ মজুমদারের সবচেয়ে স্বস্তির কারণ লুকু আজকাল আর ঝড়ুর ওপর নির্ভর করছে না। সংসারের যে জায়গায় তার মা ছিল, সেখানে সে ক্রমশই খাপে খাপে বসে যাচ্ছে। একটি গভীরভাবে জীবনাসক্ত মানুষ যেদিন দুমাসের মধ্যে জরায়ুর ক্যানসারে মারা গেল সেদিন নিজের কষ্টের চেয়েও তাঁর বিপদ হয়েছিল দুটি ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে লুকুকে নিয়ে। তিনি বেসরকারী ফার্মের এগজিকিউটিভ। তাঁকে কিছু কিছু ওপরমহলের এবং ইউনিয়নের চাপ সামলে চলতে হয়। এই ব্যালান্স রাখার কাজটার জন্য তাঁর নিজের মানসিক ও পারিবারিক সুস্থিতি বজায় থাকাটা ভীষণ জরুরি। স্ত্রীর অসুখে প্রচুর ছুটি ঋণ ইত্যাদি হয়ে গেছে। অফিস থেকে অনেকটাই পান। তবু আরও নিতে হয়েছিল। এখন খুব খাটতে হচ্ছে। এদিকে বাড়িতে লুকু ওইরকম। তিনি বুঝতে পারছেন লুকু স্মোক করছে, ঝগড়াঝাঁটি করছে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে, কেঁদে-কেটে আধা-অচেতন হয়ে যাচ্ছে সময়ে সময়ে। ভালো সাঁইকিয়ট্রিস্ট দেখালেন। সে ভদ্রলোক এতো ট্র্যাংকুইলাইজার দিলেন যে খেতে খেতে লুকুর প্রায় জীবন্মৃত অবস্থা। শেষ পর্যন্ত ওষুধগুলোকে নিজেই টান মেরে ফেলে দিল ও। ছাত্রসঙ্ঘের কাজ-কর্ম করে, মেধা ভাটনগরের বাড়িতে গিয়ে মেয়েটা ভালো আছে। তারপর একটি ছেলে আজকাল প্রায়ই আসছে। দুজনে একসঙ্গে কি পড়াশোনা করে ওরাই জানে। তবে লুকু যে অধীর আগ্রহে ছেলেটির জন্যে অপেক্ষা করে এটা তাঁর চোখ এড়ায়নি। ছেলেটি অমিশুক। তাঁর ছেলে জয়দীপের সঙ্গেও বিশেষ মেলামেশা করে না। তাঁর সঙ্গে একটা বিনীত দূরত্ব রাখে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, এই ছেলেটি বড় উদাসীন, অন্যমনস্ক। কে জানে ও দায়িত্ব নিয়ে মেলামেশা করছে কিনা। লুকুর অন্যান্য বন্ধু উজান আফতাব, প্রমিত, বুল্টু এরা খুব স্মার্ট। এদের বেশি পছন্দ করেন বিশ্বজিৎ মজুমদার। এই ছেলেটিকে ঠিক মফঃস্বলী বলতে দ্বিধা হয়, চকচকে পালিশ না থাকলেও এর ভেতরে কোথাও একটা অনমনীয় সপ্রতিভতা আছে। সেটা তিনি দু একবার কথা বলে বুঝতে পেরেছেন। ডাক্তার হতে যাচ্ছে। সার্জারিতে নাকি অসামান্য হাত। মৈথিলী বলছিল। ভালো। ভালো হলেই ভালো। কোনও নিশ্চিন্ততা যেন ওপরঅলার চোখে না ঠেকে।
জীবনটা তো নিশ্চিন্ত, সুখী সুন্দরই ছিল। মঞ্জুশ্রী ছিল একটা তাজা চন্দ্রমল্লিকা ফুলের মতো। চটপট কাজ করে ফেলছে। এই বাজার-হাট করে এলো। তারপরেই বসবার ঘরের যাবতীয় সাজ-সজ্জা একটু এদিক-ওদিক করে পাল্টে ফেলল। পরক্ষণেই ফোন করে শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির ডজনখানেক আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিয়ে ফেলল। লম্বা চুলগুলোকে একদিন ছেঁটে-ছুঁটে কুঁকড়ে ফিরে এলো—কি ব্যাপার? না, তোমায় অবাক করে দেবো।’
—‘আমায় না অন্য কাউকে?’
মঞ্জুর সে কী হাসি। বললে ‘সে তো আছেই। অন্যদের মুণ্ডু তো আকচার ঘোরাচ্ছিই। তুমি উনিশ বছর দেখে দেখে আজকাল একটু আসবাবপত্রের মতো দেখতে আরম্ভ করেছ আমাকে টের পাচ্ছি। তাই একটা এক্সপেরিমেন্ট করলাম।
—‘তুমি কি সত্যি ভেবেছ নাকি চুল-টুল ছেঁটে নিজেকে আমার কাছে নতুন করবে? হোয়াট ননসেন্স?’
—‘তাহলে কি পুরো চরিত্রটাই পাল্টে ফেলতে হবে? এবার থেকে তাহলে ন্যাগিং ওয়াইফ হই?’
—‘ওরে বাবা, রক্ষা করো।’
এসব কথা বাড়তে দিতেন না কখনও বিশ্বজিৎ। গুরুত্ব দিতেন না। এখন অতীতের কথা মনে করলে বুঝতে পারেন মেয়েরা সবসময়ে প্রিয়জনের মনোযোগ চায়। বয়সটা কোনও ব্যাপার নয়। সব বয়সে, সব অবস্থায় তারা মনোযোগ চায়। দীর্ঘদিন দাম্পত্য-সুখের পর পুরুষদের আসে একটা নিশ্চিন্ততা, প্রশান্তি। কেজো জগতের দিকে মন ফিরে যায়। তার অর্থ এই নয় যে ভালোবাসার খাতে কিছু কম পড়ল। তার চেহারাটা একটু পাল্টে গেল শুধু। এটা মেয়েরা সইতে পারে না। অন্তত মঞ্জুশ্রী পারত না। প্রথম দিনের উচ্ছ্বাস, প্রথম যুগের মনোযোগ তাদের সারা জীবন চাই। তা নয়ত তারা ফুলের মতো ফুটে থাকবে না। তাদের কাজকর্মে আর ছন্দ আসবে না, জীবনযাপন থেকে লাবণ্য অন্তর্হিত হবে। যখন পেটে ব্যথা পেটে ব্যথা করে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল, ডাক্তার দেখিয়ে ধরা পড়ল কুসুমে কীট প্রবেশ করেছে, তখন বিশ্বজিৎ দিশেহারা, ছুটি নিচ্ছেন, নার্সিং হোমে কাটাচ্ছেন প্রায় সব সময়ে, কি পেলে মঞ্জুশ্রী খুশী হয়, ফুল, চকোলেট, নিয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছেন, ব্যাকুল চোখ সবসময়ে তার মুখের ওপর স্থির—কী খুশি মঞ্জুশ্রী। লুকুকে রোগশয্যা থেকেই শেখাচ্ছে গাৰ্হস্থ্যের নানান খুঁটিনাটি। খেয়াল নেই সে একটা বালিকা, মায়ের অভাবনীয় অসুখে তার সুখের দুর্গ ভেঙে পড়েছে। মঞ্জুশ্রীর মতো প্রাণবন্ত, জীবনের প্রতি ভালোবাসায় নিবেদিত বিচিত্ররূপা রমণী যদি ভেতরে আসন্ন মৃত্যুর বীজ বহন করতে পারে তো প্রকৃতির দ্বারা সবই সম্ভব। বিশ্বজিৎ খুব সন্তর্পণে বাঁচেন। লুকুর মুখে হাসি ফুটেছে তিনি খুব খুশী। কিন্তু খুশীটা আদৌ প্রকাশ করেন না।
এ শনিবার দেব এলো না। গ্রীক সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে হয় লুকুদের। দেব বলেছিল বাছা বাছা কয়েকটা গ্রীক ট্রাজেডি পড়বে। ওরা সোফোক্লিসের ‘ইলেকট্রা’ পড়ে ফেলেছে। এখন শুরু করেছে ইউরিপিদিসের ‘মিডিয়া’। আজকে হয়ত সেটা শেষ হয়ে যেত। দেব কোথাও আটকে গেছে, আসতে পারল না। ও আজকাল ছাত্র পড়াচ্ছে। ছাত্রর পরীক্ষা-টরীক্ষা না কি? কিছু তো বলেনি। সন্ধেবেলা বাপী ফিরলে লুকু জলখাবার এনে দিল, বাপীর ঘরে।
বিশ্বজিৎ বললেন—‘কি রে, দেবপ্রিয় আসেনি?’
—‘না বাপী। আজকে কিন্তু তোমাকেই আমার সঙ্গে ‘মিডিয়া’ পড়তে হবে।’
—‘আমাকে? মিডিয়া? সেকি?’ বিশ্বজিৎ জীবনে কখনও মিডিয়া নাটকের নাম শোনেননি।
—‘কেন বাপী, নাটক হয়েছে তো মিডিয়া কাগজে বিজ্ঞাপন দেখোনি? খেয়াল করোনি?
—‘কই না তো।’
—‘তোমাকে আমার সঙ্গে ওটা পড়তেই হবে।’
বিশ্বজিৎ প্রচুর গাঁইগুঁই করেও সুবিধে করতে পারেন না। তাঁকে বসতে হয়। তবু রক্ষা যে লুকু আবার গোড়ার থেকে শুরু করেনি। সে অনেকটা অংশই গল্পটা বলে দিল। পড়া-টড়া শেষ করে বিশ্বজিৎ বললেন—‘এতো একেবারে বর্বর কাহিনী রে। গ্রীকরা এরকম বর্বর ছিল?’
লুকু হেসে কুটিপাটি। বলল—‘সবাই তো একদিন বর্বর ছিল। গ্রীকরা সভ্যশান্ত হবার অনেক আগেকার পুরাণ কথা এসব। আমাদের যেরকম শুনঃসেফের কাহিনীটা আছে! জমদগ্নি, রেণুকা পরশুরামের গল্প আছে! সেইরকম। শুনঃসেফের কাহিনীটাই কি বর্বর ধরো না। রাজপুত্র রোহিত নিজের বিকল্প হিসেবে গরিবের ছেলেকে বরুণ দেবতার কাছে বলি দিতে চাইলেন। বাবা বললে বড়টিকে দেবো না, মা বললে ছোটটিকে দেবো না। মেজোটাকে দিতে দুজনেই রাজি হয়ে গেল। রাজা নিশ্চয়ই অনেক ধনরত্ন দিলেন। শুনঃসেফ বরুণের স্তব করতে তিনি তাকে অব্যাহতি দিলেন। পরশুরামের গল্পটা তো আরও বীভৎস। রামের দ্বন্দ্ব তিনি বাবার কথা শুনবেন না মার প্রাণ রাখবেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ন্যায় অন্যায়ের ধারণা সাঙ্ঘাতিক রিজিড, প্রো-ফাদার, তাই তিনি মাকে হত্যা করলেন।’
—‘কিন্তু সেই মা আবার জমদাগ্নির বরে বেঁচে উঠলেন তো!’
—‘বেঁচে ওঠা কি সম্ভব বাপী? আর যে ভদ্রলোক অনায়াসে স্ত্রীকে মারবার হুকুম ছেলেকে দিতে পারেন, তাঁর কাছে আর কোনও প্রতিভা ঘেঁষতে পারে বলে মনে হয় না। এইসব বর্বর কাহিনীগুলোতে অলৌকিকের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। গ্রীক পুরাণের গল্পও তো আছে—ট্রয়যুদ্ধে জয়ের জন্য মানসিক করে আর্গস-এর রাজা আগামেমনন তাঁর মেয়ে ইফিজিনিয়াকে দেবী আর্তেমিসের কাছে বলি দিয়েছিলেন। সে মেয়ে নাকি আদৌ বলি হয়নি। আর্তেমিস মায়ার সৃষ্টি করে তাকে লুকিয়ে ফেলেছিলেন। আচ্ছা বলো একি সত্যি হতে পারে? আসলে, দেবী নিজের প্রসন্নতার জন্য কারো রক্ত চাইছেন এই বিসদৃশ ব্যাপারটা পুরাণকারদের নিশ্চয়ই খারাপ লাগত, তাই তাঁরা কৌশলে ইফিজিনিয়াকে বাঁচিয়ে দিলেন। পেছনে আছে সেই নরবলি, কুমারীবলির বীভৎস রীতিনীতির দিনগুলো।’
বিশ্বজিৎ বললেন—‘বাইবেলের আব্রাহাম আইজাকের গল্পটাও তো সিমিলার রে। আব্রাহাম ছেলে আইজাককে বলি দিতে নিয়ে যাচ্ছেন ঈশ্বরের আদেশে, ঠিক শেষ মুহূর্তে ঝোপের মধ্যে ঈশ্বর আবির্ভূত হলেন। তিনি আব্রাহামকে নিরস্ত করলেন। শুনঃসেফ আব্রাহাম আইজাক আর তোর আগামেমননের গল্পের মধ্যে প্রচুর মিল।’
—বাইবেলের গল্পে আসল সত্যটা তাহলে কি বলো তো বাপী।’
—‘তোর মত অনুসরণ করলে বলতে হয় আব্রাহামের পিতৃহৃদয় জেগে উঠল, তিনি ছেলেকে শেষ পর্যন্ত বলি দিতে পারলেন না। তাঁর হৃদয়ই যেহোভার কণ্ঠ হয়ে তাঁকে বারুণ করল।’
—ওয়াণ্ডারফুল। বাপী ওয়াণ্ডারফুল! তুমি একদম দেবের মতো করে বললে।
বিশ্বজিতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। ছেলেমেয়ে এরা নতুন প্রজন্ম। এদের হাতে বাবা মারা বড়ই নাকাল হন। এরা হয় অনেক বেশি জানে। তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দেয় সব কিছু নয় তো বড্ড নির্ভর করে। নতুন প্রজন্মের কাছে বাহবা পেয়ে বালকের মতো খুশি হয়ে গেলেন তিনি। মঞ্জুশ্রীর মৃত্যুর পর থেকে তাঁকে বাহবা দেবার, সাহস দেবার কেউ নেই। তিনি কখন নিজের অজান্তেই ছেলে মেয়ের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন। তিনি বললেন—‘দেবপ্রিয় এইসবই বলে নাকি?’
—‘হ্যাঁ বাপী আমি আগে কখনও ঠিক এইভাবে ভাবিনি। মেধাদি ক্লাসে কিছু কিছু বলতেন বটে, কিন্তু সপ্তাহে ওঁর মোটে একটা ক্লাস ছিল। শুনতাম, ভালো লাগত, তারপর আমার স্বভাব জানো তো। ভুলে যেতাম। দেব নিয়মিত আসে। আমার সঙ্গে পড়ে এইভাবে আলোচনা করে, আমার এতো ভালো লাগে যে কী বলব। তুমিও থাকো না কেন বাপী। তুমি মনে করো…আমরা বিরক্ত হবো, না?’ লুকু দুষ্টু হাসি হাসছে।
বিশ্বজিৎ বললেন—‘না, হ্যাঁ, তা…’
—‘আমতা আমতা করছো কেন? তোমার ধারণা কি আমি জানি।’ বলে লুকু ফুলে ফুলে হাসতে লাগল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘আমি ঠিক করেছি এম এর পর মিথ নিয়ে রিসার্চ করবো। এইসব বর্বর যুগের মিথ। আমি দেখাবো বাপী আমাদের এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির যুগেও আমরা কিরকম বর্বর রয়ে গেছি। কোনও কোনও সমাজে খোলাখুলি চলছে এইসব। কিন্তু সভ্য সমাজেও নরবলির ইনসটিংট, ভাগ্যকে যে কোনও মূল্যে খুশি করার ইনসটিংট এখনও কি প্রবলভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
বিশ্বজিৎ বললেন—‘তবে তো তুই তোর লাইন পেয়েই গেছিস। মনে আছে তোকে হিসট্রি পড়তে জোর করেছিল কে! তুই তো সায়েন্স পাবো না, সায়েন্স পাবোনা করে দাপাদাপি আরম্ভ করেছিলি।
…হ্যাঁরে লুকু’ বিশ্বজিৎ একটু নিচু গলায় ভিতু ভিতু স্বরে বললেন, ‘তুই স্মোক করিস?’
লুকুর মুখটা সাদা হয়ে গেল। মায়ের মৃত্যুর আগে বাপী ছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা। গোটা সংসারটা চলত বাপীকে খুশি করবার জন্য। বাপীর ওয়ার্ডরোব, বাপীর স্যুট, জুতো সব ঠিকঠাক ঝকঝকে চকচকে থাকা চাই। বাপী যখন বাড়ি ফিরবে, কোনও গোলমাল চলবে না। যখন অফিস যাবে জয় যদি ‘দুঁধ খাঁবো না’ বলে নাকি কান্না ধরে সে প্রচণ্ড একটা ধমক খাবে। মা চলে যাবার পর বাপীর সমস্ত প্রকৃতি থেকে সেই প্রতাপের খোলস একটু একটু করে খসে পড়ছে। ভিতু ভিতু স্বরে বাপী বলছে ‘লুকু তুই স্মোক করিস?’ আগে হলে বাপী বলত ‘মঞ্জু ওকে ধরে আনো, ধরে আনো তো আমার সামনে। হাঁ কর দেখি, এত বড় স্পর্ধা…বিশ্বজিৎ মজুমদারের মেয়ে হয়ে তুমি….দাঁড়াও তোমার উপযুক্ত সাজা আমি বার করছি।’ এখন বাপী কুণ্ঠিত। যেন মাফ-চাওয়া স্বরে জানতে চাইছে ‘লুকু তুই স্মোক করিস?’ প্রশ্নটা নিশ্চয়ই বাপীর মনের মধ্যে অনেক দিন ধরে ঘোরাফেরা করছে। লুকুর মরিয়া ভাব, যখন তখন হিস্টিরিক হয়ে যাওয়া এসব কারণে বাপী প্রশ্নটা করেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তায় খুব কষ্ট পেয়েছে। খুব। লুকুর ভীষণ মায়া হল। সে টেবিলের ওপর কনুই রেখে বলল—‘বাপী তুমি কি করে বুঝলে?’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাকে তোরা যতটা বোকা ভাবিস, ততটা বোকা আমি নই রে! আমি সিগারেট গুনে গেঁথে খাই, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যদি আমার প্যাকেট ফুরিয়ে যায়, আমি জানবো না? জয় আমার পাশে শোয়, ওর জামা কাপড়ে আমি গন্ধ পাই না। তোর ওয়ার্ডরোব খুললেই…ক্যাপস্টানের কড়া গন্ধ তুই লুকোবি কোথায়? লুকু প্লীজ, স্মোক করিস না।’
লুকু বলল—‘কেন বাবা, আজকাল ফ্যাশনেব্ল্ মেয়েরা তো অনেকেই স্মোক করে। তোমার বস মিঃ সুদের স্ত্রী সন্তোষ সুদের ছবি দেখেছি কতো সিগারেট ঠোঁটে। বিদেশে তো অনেকদিন চালু। এদেশেও নবাব-টবাবদের বেগমরা রীতিমতো স্মোক করত, জানো?’
বিশ্বজিৎ বললেন—‘যে যেখানে যাই করুক, অভ্যেসটা ভালো নয় এটা তো স্বীকার করবি? তোর মত বাচ্চা মেয়েকে একেবারেই মানায় না।’
লুকু বলল—‘বাপী, একটা কথা বলব, ভয় পাবে না। রাগ করবে না।’
ভেতরে ভেতরে খুব শঙ্কিত হয়ে বিশ্বজিৎ বললেন—‘কি কথা? ভয় পেতে হবে কেন?’
লুকু নিচু গলায় বলল—‘আমি ড্রাগ খেতে আরম্ভ করেছিলাম বাপী। অবশ্য না জেনে। কিন্তু আমি আস্তে আস্তে অ্যাডিক্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। দেব আমাকে বাঁচালো, ছাড়ালো নেশাটা। কিন্তু এখনও মুখটা কিরকম সুড়সুড় করে তাই দেবকে লুকিয়ে তোমার থেকে একটা দুটো নিয়ে খাই। ধরা দিনে দুটো, কখনও তিনটে। বাপী প্লীজ। আস্তে আস্তে ছেড়ে দেবো।’
বিশ্বজিতের বুকের ধুকধুকি থেমে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড। বললেন—‘ড্রাগ? কি ড্রাগ? কোথায় পেলি? না জেনে কি করে খেলি?’
‘—তুমি জানো না বাপী ড্রাগের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে! আমিও ভালো করে জানি না কোথা থেকে পেয়েছি। তুমি এসব নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। দ্যাট চ্যাপ্টার ইজ ক্লোজড নাউ। ওনলি হ্যাভ পেশেন্স উইথ মাই স্মোকিং হ্যাবিট। ওটা আস্তে আস্তে যাবে।’
ঝড়ুকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে লুকু আজকে কি একটা পদ রান্না করিয়েছে। ছোট ছোট মুচমুচে পরোটা তার সঙ্গে। শিখেছে নাকি মৈথিলীদের রাঁধুনি বৈজুদার কাছ থেকে। আনন্দ-বিষাদে মেশা কী অদ্ভুত এই রাতের খাওয়ার স্বাদ। লুকু তুলে দিচ্ছে। যা হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে বলে বিশ্বাস হঠাৎ দেখা যায় না তা পূর্ণমাত্রায় দেদীপ্যমান হয়ে রয়েছে তা হলে যে আনন্দ হয় সেই আনন্দ এখন লুকুর বাবার মনে।
—‘বাপী আমি বড্ড কম আইটেম করি, তোমার খেতে কষ্ট হয়, না? অনেস্টলি বলবে।’
—‘আরে না না, আবার কি?’
—‘মা অনেক রকম করত।’ মা চলে যাবার পর লুকু সহসা মায়ের কথা মুখে আনে না। বিশ্বজিতও না। সে আছে ফুলে-মালায় সাজানো ঘরের মধ্যের ছবিতে, আর আছে দুজনেরই মনের কোণে। বিশ্বজিৎ লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, বললেন—‘তোর মা বড় বাহুল্য ভালোবাসত। অত বাড়াবাড়ির দরকার কি? এই তো বেশ খাচ্ছি।’
জয়দীপ বলল—‘কেন বাপী, হোটেলে কেমন মেনু-কার্ড থাকে। তুমি এক রকম পছন্দ করলে, আমি আরেক রকম পছন্দ করলুম, হয় না? ধরো সেদিন পার্ক স্ট্রিটে তুমি খেলে চীনে, আমি খেলাম পিজা আর দিদি তুই শুধু আইসক্রিম। কটা খেলি রে দিদি? তিনটে। তিনটে আইসক্রিম খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেললি!’
—‘কেন, তুই খাসনি বুঝি?’ লুকু বলল।
—‘আমি তো পিজা খেয়েছি তার আগে। যাই বলো বাপী সেটাই ভালো। নানা রকম থাকবে, যে যার পছন্দসই জিনিস তুলে নেবে।’
—‘তুই তো সবগুলোই তুলবি!’ লুকু ঘাড় নেড়ে বলল।
—‘নট নেসেসারিলি। পায়েস তুলব না। চচ্চড়ি তুলব না। সুক্তো তুলব না। স্টু তুলব না।’
—‘হ্যাঁ তোর তো আবার সব গরগরে চাই। বাবা মনে আছে ও কি রকম মাকে বলত—মা মামার বাড়ির মতো দরদরে তারিয়া করতে পারো না?’
‘গরগরে কালিয়াটা মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না দরদরে তারিয়া।’ লুকু হাসছে।
জয়দীপ বলল—‘প্লেয়ার তো, সব হজম হয়ে যায়। যদি হালকা জিনিসই দিস তো স্টম্যাকটাকে কোনও কষ্টই করতে হয় না। শরীরের যন্ত্রপাতিকে অত রেস্টে রাখতে নেই। বুঝলি? কুঁড়ে হয়ে যায়।’
রবিবার সকাল আটটা নাগাদ মেধা ভাটনগরের ফোন পেলেন বিশ্বজিৎ মজুমদার।
—‘বিশ্বজিৎদা আমি লালবাজার থেকে বলছি। একবার আসতে পারবেন লুকুকে নিয়ে?’
—‘কেন? কি বলছেন?’
—‘দেবপ্রিয়কে এরা অ্যারেস্ট করেছে, ড্রাগ ট্রাফিকিং-এর দায়ে। লুকুকে খুব দরকার।’
—‘লুকু কি করবে?’—বিশ্বজিতের গলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
—‘লুকু অনেক কিছু জানে।’
—‘আমি যেতে পারি। লুকুকে নিয়ে ওখানে যাবো না। শী ইজ ডেলিকেট।’
—‘না নিয়ে এলে ভুল করবেন। আপনি ওকে নিয়ে আসুন, কোনও ভয় নেই।’