উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 13
কেউ হারায় কেউ পায়। একজন বঞ্চিত না হলে আরেকজন লাভবান হয় না, এই কি জগতের নিয়ম? যে কোনও লাভেরই উল্টোপিঠে চাঁদের অন্ধকার পিঠের মতো একটা ক্ষতির দিক থেকেই যাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির সম্পদের ভাঁড়ার শূন্য করে। জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাচ্ছে, সৌহার্দ্য কমে যাচ্ছে। জীবনের সঙ্গে দর্শন, তত্ত্বের সঙ্গে অভিজ্ঞতা এমনভাবে তাল পাকিয়ে যেতে থাকে যে মনে হয় বিশুদ্ধ চিন্তার পেছনে এতো সময় দেওয়া, তত্ত্বের জন্য, দর্শনের জন্য সারা জীবন উৎসর্গ করার কোনও মানে হয় না। জীবন, জীবনের ঘটনা নিয়ে সমস্ত তত্ত্বকে ছাড়িয়ে অনেক সময়ে এড়িয়ে অবস্থান করে। মেধার শূন্য ঘর ক্রমশ ভরে উঠছে। নিচেটা প্রায় বন্ধই থাকতো। ওপরের দালানের একদিকে সামান্য একটু রান্নার আয়োজন তাঁর। ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের সঙ্গে তিনি নিচেই দেখা করেন। কিন্তু বাকিরা সবাই ওপরেই আসে। সকালবেলা যতক্ষণ না ইউনিভার্সিটি যাবার বেলা হচ্ছে তিনি একা। খুব ভোরবেলা উঠে গাছগুলোর পরিচর্যা করে চান করে নেন। তারপর চা, তারপর পড়াশোনা, বেরোবার এক ঘন্টা আগে ভাতে ভাত চাপিয়ে দেন, জামাকাপড় বদলাতে বদলাতে সেটা হয়ে যায়। খেয়ে পাঁচ মিনিট বজ্ৰাসন, তারপরই স্কুটারে চেপে কর্মস্থল। পনের মিনিটের মধ্যে ইউনিভার্সিটিতে। নিজের ঘরে বসে বসে ডিপার্টমেন্টাল কাজ কিছু করতে হয়, ঘড়ি দেখে ক্লাসগুলোয় হাজিরা দেন। আণ্ডারগ্র্যাজুয়েট পোস্টগ্র্যাজুয়েট দুরকম ক্লাসই আছে। এম ফিলের ক্লাসও থাকে কোন কোনদিন। কলেজের সময়টুকু তিনি পড়াশোনা করেই কাটান, সহকর্মীদের মধ্যে হাতে গোনা যায় এমন কয়েকটি মানুষ মেধার ঘরে আসেন। প্রথমেই তো তাঁর প্রোফেসরশিপ পাওয়া নিয়ে বেশ আপত্তি ওঠে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জনা দুই ক্যানডিডেট ছিলেন। কিন্তু মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, গুটিকয় প্রকাশিত পেপার, পড়ানো ও গবেষণার অভিজ্ঞতা এ সমস্ত অগ্রাহ্য করবার সাধ্য বোর্ডের ছিল না। অনেকেই অত্যুজ্জ্বল ভাটনগর পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। সেই শুরুর থেকেই নিজের বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর আলগা-আলগা সম্পর্ক। এঁরা হয়ত আশা করেছিলেন এঁদের তিক্ত ব্যবহার, এবং অসহযোগিতা তাঁকে খেপিয়ে তুলবে, কোণ ঠাসা হয়ে তিনি নানারকম বাজে ব্যবহার করবেন, ফলে এঁরা তাঁকে অপমান করবার সুযোগ পেয়ে যাবে। কিন্তু এ সুযোগ তিনি তাদের একেবারেই দ্যাননি। তিনি একেবারে উদাসীন। ভাগ্যে এঁরা প্রোফেসরদের একটা করে ঘর দ্যান। নিজেকে তিনি সেই ঘরে বন্দী রাখেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো। এম ফিলের ছেলেমেয়েরা যাদের মধ্যে অনেকেই অন্যান্য কলেজের লেকচারার, তাঁর কাছে ঘন ঘন আসে। মেধা যদিও বিদ্যার জন্য বিদ্যার তত্ত্বতে আস্থা হারিয়েছেন, বিদ্যার সুপ্রয়োগ বলতেও যে ঠিক কি বোঝায় কতখানি বোঝায় তা-ও তাঁর মস্তিষ্কে এবং জীবনে এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে, তবু ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি মেটানোর মতো পড়াশোনা তিনি এখনও করে থাকেন। সংস্কৃতিবিভাগের এক সহকর্মী তাঁর খুব গুণমুগ্ধ। তিনি মেধার নাম দিয়েছেন ‘তেজোময়ী বাক’। তাঁর বক্তৃতায় নাকি, তেজ, যাকে বলে ওজস্ তা সবসময়ে থাকে। তুলনামূলক সাহিত্য-বিভাগের আরেকজন সহকর্মিণী তাঁকে বলেন ক্লাইটেমনেস্ট্রা। তিনি নাকি কোনও সন্তানতুল্য মতবাদের অপমৃত্যুতে ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। বাইরে যতই শান্ত দেখাক, ভেতরে কোথাও ধূমল, আগ্নেয় তিনি। ইউনিভার্সিটিতে আরেকজন কাছের মানুষ ডাঃ সোম। ডাঃ সোমের সম্পর্কে মেধা যতটা জানেন, মেধার সম্পর্কে ডাঃ সোম জানেন অনেক বেশি। তিনি অবশ্য এঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির। ছাত্রসংঘের সৌজন্যে আলাপ। ডাঃ সোম খুব মজার মানুষ। মেধার সম্পর্কে নানান রটনা, নামকরণ ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব হল—‘বলছে বলুক, ওদের বলতে দাও।’
ফার্ন প্লেসের বাড়ি ভরে উঠছে। একেই তো একতলার দুটো ঘর এখন ছাত্রসংঘের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বিকেলের দিকে ছেলেমেয়েরা অনেকেই আসে। তার ওপর মৈথিলী এখন মেধার কাছেই থাকছে। মৈথিলীর মা ওরকম হঠাৎ চলে যাবার পর মেধা তাকে নিজের কাছেই এনে রাখেন। রঘুনন্দনকে ট্রাঙ্ক কল করা হয়। কিন্তু তিনি তখন দিল্লিতে নেই। যাই হোক, দিন তিনেক পরে তিনি এসে উপস্থিত হলেন। মৈথিলী তখন কলেজে। মেধার তিনটের সময়ে ক্লাস। তিনি সবে খাওয়া শেষ করে মুখ ধুচ্ছেন। গাড়ির শব্দ পেলেন। ওপরের জানলা দিয়েই দেখতে পেলেন রঘুনন্দনের গাড়ি। বেল বাজবার আগে তিনি পৌঁছে গেছেন।
—‘মুন্নি কোথায়?’ —রঘুনন্দন ঢুকতে ঢুকতে বললেন।
—‘কলেজ গেছে।’
—‘কবে থেকে কলেজ পাঠাচ্ছো!’
—‘গতকাল থেকেই।’
—‘ও যদি কলেজ থেকে পালায়?’
—‘সে কি? কোথায় পালাবে?—মেধা অবাক।
—‘ধরো, ওর মার খোঁজে।’
—‘গেলে আমায় বলে যাবে, পালাবে কেন? যেতে তো আমি বাধা দিচ্ছি না!’
—‘বাধা দিচ্ছো না? তাতো দেবেই না। নিজের তো সন্তান নেই। খুব সহজে এ কথাগুলো বলা যায়।’
—‘ওর মা যখন নিষেধ করে গেছেন তখন তার কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল না পেলে যাবে না। তাছাড়া মুন্নি বরাবর খুব র্যাশন্যাল, ধীর-স্থির।’
—‘বৈজুর কাছে যতদূর শুনেছি শী ইজ ডিসট্রাক্টেড। শী ওয়াজ হার মাদার্স চাইল্ড। ভেরি ভেরি মাচ।’
—‘একটু তো ডিস্ট্র্যাক্টেড় হবেই। কিন্তু এখনও অনেক শান্ত হয়ে গেছে। বুঝেছে। ওর মাকে বুঝতে পেরেছে। আর না বোঝা জিনিস বুঝতে পারলেই শান্তি।
—‘কি বুঝেছে? ওর মাকে বোঝবার কি আছে? শী ইজ অ্যাবসল্যুটলি ম্যাড।’
—‘কি করে তুমি এই সিদ্ধান্তে এলে?’
—‘এ সিদ্ধান্তে আসি নি। দেয়ার ইজ নাইনটি পার্সেন্ট চান্স দ্যাট শী হ্যাজ বিন কিডন্যাপড্।’
—‘একি বলছো? উনি চিঠিপত্র লিখেছেন। যথেষ্ট দিন আলাপ আলোচনা করেছেন, নিজের মনকে বুঝিয়েছেন, মৈথিলীকে বুঝিয়েছেন, তবে গেছেন।
—‘শী হ্যাজ বিন ফোর্সড্, পারহ্যাপস্ ব্ল্যাকমেইলড। তুমি ব্যাকগ্রাউন্ড জানো না মেধা তাই এতো কথা বলছো। মৈথিলী কেম ফার্স্ট, দা ওয়েডিং আফটারওয়ার্ডস। ওরা বুনো কুকুরের পালের মতো ক্ষেপে গিয়েছিল, আমার জন্য বিষাক্ত তীর শানিয়ে দিনের পর দিন পেছন পেছন ঘুরেছে।’
মেধা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন—‘রঘুদা, এটা আমি তোমার থেকে আশা করি নি। এ তুমি কি বললে?’
—‘কেন? এক যুগ আমেরিকায় থাকবার পরও তোমার এই সামান্য কথা শুনলে এমন রি-অ্যাকশন হয় কেন?’
—‘আমেরিকায় থাকা, আমেরিকায় থাকা শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি রঘুদা। তোমরা এটা বন্ধ করো। দশ বছর কেন সারাজীবন আমেরিকায় বা অন্য কোথাও থাকলেও আমার মূল্যবোধ বদলাবে না।
—‘সেক্ষেত্রে বলব তুমি কনজারভেটিভ, রিজিড, এনিওয়ে, তুমি এ ব্যাপারে আমাকেই শুধু দায়ী করছ কেন? রাধিকা সোরেন নামে নব্য ডাবলু বি সি এস অফিসারটি তখন পরিণত ছাব্বিশ বছরের যুবতী। অমি তো তার ওপর বলাৎকার করি নি। সে স্বেচ্ছায় এসেছিল। তার আদিবাসী ইনস্টিংট তাকে টেনে এনেছিল। তুমি জানো না মেধা সেক্সের ব্যাপারে আদিবাসী মেয়েরা তোমাদের চেয়ে অনেক অ্যাগ্রেসিভ, অনেক খোলামেলা। ওদের সিসটেমটাই তো অনেক ন্যাচারাল। আজ তথাকথিত সভ্যসমাজ বিশেষত হিন্দু ও ক্রিশ্চান সমাজের সঙ্গে মিশে ওরা এই প্রথাগুলোকে লজ্জা পেতে শুরু করেছে। কিন্তু এ জিনিস ওদের রক্তে আছে।’
—‘তা-ই যদি হয়, সে যদি স্বেচ্ছায় এসে থাকে, তাহলে এতো কথা কেন? তুমি তো তাকে ভালোবেসেছিলে! তুমি তো তাকে, তার সন্তানকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ছিলে?’
—‘ন্যাচারলি। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। ওরা অরুণাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছিল। আমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলে সেটা আর হবে না এটাই ওদের ধারণা হয়। খুব সম্ভব ওদের মধ্যে অরুণার কিছু অ্যাডমায়ারারও থেকে থাকবে। ওরা প্রাণপণে বিয়েটাতে বাধা দেয়। বলতে থাকে আমি ওদের রাধিকে নষ্ট করেছি। ওরা আমার রক্ত চায়। ওর বাবা দাদা যত নয়, আরও কিছু সাঁওতাল যুবক একেবারে লাঠি সোঁটা নিয়ে তৈরি ছিল। তাদের মধ্যেই কেউ হয়ত ওর প্রণয়ী ছিল।
‘থাকতেই পারে। অবস্থা তো দেখছি খুবই জটিল’, মেধা চিন্তিত স্বরে বললেন।
—‘এখন মৈথিলী যদি ওদের মধ্যে যায়, তাকে ওরা আমার প্রতিনিধি বলে দেখবে। আমার ওপর ওদের এতদিনের রাগ মেয়েটার ওপর ঢালবে। তুমি কি তাই চাও?’
—‘না। কিন্তু এসব কথা মৈথিলীকে বলা দরকার।’
—‘বলবেটা কি? ওর মা বাবার বিবাহপূর্ব সম্পর্কের কথা? ওর জন্মের কথা? তুমি পাগল হয়েছো মেধা? তোমাকে বলাই আমার ভুল হয়েছে। আমি একটার পর একটা ভুল করে যাচ্ছি, দেখছি। চমৎকার! অতি চমৎকার!’ রঘুনন্দন উঠে পড়ে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে থাকলেন।
মেধা বললেন—‘না। ওর মায়ের বিপদ নেই, অথচ ওর বিপদ আছে এই কথাটা ওকে বোঝানো দরকার। তবে আমার ধারণা ও যাবে না।’
—‘তোমার কাছে ওকে রেখে কি আমি সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি?’ রঘুনন্দন বললেন।
—‘সেটা তুমি বোঝ। তুমি যদি জোর করে ওকে নিয়ে যাও, যেতে পারো। কিন্তু অতবড় বাংলোয় শুধু বৈজুলাল আর ও, জায়গাটাও নির্জন, তুমি যদি কলকাতায় থাকোও, সবসময়ে তো বাইরে বাইরেই থাকবে। আমি ওর শারীরিক নিরাপত্তার কথা ভাবছি না। মনের কথাটাই ভাবছি।’
—‘ও তোমার কাছে ভালো আছে?’
—‘আছে। কিন্তু তাই বলে তোমার দায়িত্ব কমছে না। তুমি যতদিন আছো ওর সঙ্গে দেখা করতে হবে, কথা বলতে হবে এবং অরুণাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এই বিশ্বাসে ওখানে পুলিস নামানো চলবে না।’
রঘুনন্দন চমকে উঠলেন।
মেধা বললেন—‘হ্যাঁ। ওরা অরুণাকে সত্যি-সত্যিই নিজেদের মধ্যে চায় বলে নিয়ে গেছে। ওদের এখন অরুণার মতো মানুষ খুব দরকার। যারা সরকারের এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির হাড়-হদ্দ জানে, নিজেদের কথা গুছিয়ে বলতে পারে, লিখতে পারে। বছর কুড়ি আগেও যেমনি স্বেচ্ছায় তোমার কাছে এসেছিল, আজ ঠিক তেমনি স্বেচ্ছায় চলে গেছে। আদিবাসী ইনস্টিংট বলতে পারো।’
রঘুনন্দন দুপা ঈষৎ ফাঁক করে বসেছিলেন। তাঁর শাদা পলিয়েস্টারের ট্রাউজার্সে ছুরির ধার। এখন দুই হাঁটুর ওপর কনুই রেখে তিনি মুখটাকে নানাভাবে রগড়াতে থাকলেন। অবশেষে বললেন—‘তোমার কি মনে হয়, হ্যাভ আই লস্ট হার ফর এভার?’
—‘মেয়েকে যা লিখেছেন তাতে তো মনে হয় অবশ্যই ফিরে আসবেন, কিন্তু তুমি পারলে এখনই মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করো। দাঁড়াও ও কোথায় থাকতে পারে আমি ওর টেব্ল্টা দেখে তোমায় বলে দিচ্ছি।’
মেধা ঘরে চলে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে একটুকরো কাগজ রঘুনন্দনের হাতে দিলেন। বললেন—‘নিশ্চয় পেয়ে যাবে। ওকে আশ্বস্ত করো যে ওর মা ভালো আছেন। তুমি ব্যাপারটাতে ঘাবড়াচ্ছো না। তুমি এখন ওর আমার কাছে থাকাটাই ভালো মনে করছ। এগুলো দরকার।’
রঘুনন্দন খুব বিচলিত হয়ে বললেন, ‘তুমি অনেস্টলি ওর ভার নিচ্ছো মেধা? আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি? তুমি বরাবর বাঁধন এড়াতেই চাও। অ্যাট লীস্ট দ্যাট ইজ মাই ইমপ্রেশন। য়ু আর আ ফ্রি বার্ড। কেন? কেনই বা ওর ভার নিতে যাবে?’
মেধা বললেন—‘অনেক দিন আগে তুমি একবার বলেছিলে তোমার মেয়ে আমার মতো, মনে আছে?’
রঘুনন্দন আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন।
—‘আমার আদলে যে গড়া সে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার মেয়ে।’
রঘুনন্দন চমকে উঠলেন। তারপর গাঢ়স্বরে বললেন—‘মেধা তোমার মধ্যে মাদার ইনস্টিংক্ট খুব কম। খুব উইক। তুমি কিন্তু বদলে যাচ্ছো। এর থেকে প্রমাণ হয়, যে মেয়ে যেমন করেই স্বাভাবিক নারীত্বকে অস্বীকার করুক না, শেষ পর্যন্ত তাকে প্রকৃতির কাছে নতি স্বীকার করতেই হবে।’
মেধা মিটিমিটি হাসছিলেন। বললেন—‘কার কি ইনসটিংক্ট, সে সম্পর্কে তোমার রীতিমতো গবেষণা রয়েছে দেখছি। আদিবাসী ইনস্টিংক্ট, মাদার ইনস্টিংক্ট, রঘুদা তুমি যদি আমেরিকায় দশ বছর থাকতে দেখতে পেতে মাদার ইনস্টিংক্ট ফাদার ইনস্টিংক্ট এ সবই আমাদের সংস্কার। বহুযুগের সামাজিক শিক্ষার উত্তরাধিকার। বাঘিনী শাবককে ততদিনই বাঁচায় যতদিন তার দেহে ল্যাকটেশন হয়। পক্ষিমাতাও দেখো ছানা উড়তে শিখে গেলেই আর তাকে চেনে না। মানুষ এর থেকে বেশি যেটুকু হয়েছে সেটা হল তার পূর্বপুরুষেরা সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্য যে-সব নীতি নিয়েছিলেন তারই বিবর্তিত চেহারা। যুগের পর যুগ, এই শিক্ষা মানুষের রক্তে মিশেছে—একেই বলব হিউম্যান ইনস্টিংক্ট। মানবিকতা। মানবিকতাকে যতই কোণঠাসা করা হচ্ছে, প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে দলীয় রাজনীতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, স্বার্থ আর ভোগবাদকে ততই উবে যাচ্ছে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন, ভাই-বোনের সম্পর্ক। মানুষে মানুষে হার্দ্য সম্পর্কের কথা, সহনশীলতা, ক্ষমা এসব তো এ যুগ ভুলেই গেছে। তাছাড়া চিরকালই যেখানে নিজের স্বার্থের প্রশ্ন আছে মা-বাবা সন্তানের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার করেছে। সন্তানের ওপর নির্যাতনের কথা উঠলেই তো আগে ভারতবর্ষের কন্যা-হত্যা, সতীদাহ, বিধবা-হত্যা ইত্যাদির উদাহরণ তুলে ধরা হয়। ইংলন্ডের ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীর ঘটনা জানো? নিজের বারো তের বছরের মেয়েকে বৃদ্ধ ডিউকের সঙ্গে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য তার বাবা-মা এমন অকথ্য অত্যাচার করে যে মেয়েটি মারা যায়। এর পেছনে কি? ডিউকের দেওয়া ভূ-সম্পত্তির লোভ। আমাদের দেশে শিশু কন্যা হত্যার পেছনে কি ছিল? —সমাজের চাপ। আবার দেখো, ধনী দেশগুলো এখন অনাথ-বাচ্চাদের দত্তক নিচ্ছে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মানুষ করে তুলছে এ-ও তো হচ্ছে। একই সঙ্গে সমাজে দেখবে কেউ মানবিক গুণের আকর, কেউ আবার স্বার্থপর দানব। মূল বিষয় থেকে বোধহয় অনেকটা সরে এলুম। রঘুদা আসল কথা আমাদের সব সময়েই কাজ হবে মানবিকতাকে সাহায্য করা, প্রোমোট করা।’
রঘুনন্দন উঠে পড়লেন। হাসছেন। এতক্ষণে একটু একটু, বললেন—‘একদিনের পক্ষে একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে মিস ভাটনগর।’
—‘কি?’
—‘লেকচার। আরেক দিন এসে নিশ্চয় শুনবো। তুমি কি সত্যি মনে করো অরুণার কোনও বিপদ নেই।’
—‘আই ক্যান বেট।’
‘ও কে, তুমি কি সত্যিই মনে করো, মুন্নি পালাবে না!’
—‘সত্যি মনে করি।’
—‘তবে তুমি ওকে রাখো। আমি নিশ্চিন্তে কাজ করি। তবে আমি এখন চট করে দিল্লি ফিরছি না। অরুণার একটা খবর পাওয়া আমার বড্ড দরকার।’
‘লুকু অর্ধেক দিন কলেজ থেকে বেরিয়ে মেধার সঙ্গে চলে আসে। কখন মৈথিলী আসবে অপেক্ষা করে। ছাত্রসঙেঘর কাজ করে। এখন ওদের সদস্য-সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মাসিক চাঁদার হার বাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও। বড় বড় চ্যারিটি শো, সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করে ওরা। টাকা উঠছে হু হু করে। সে সব বিনিয়োগ হচ্ছে। ওদের কাজ অনেক। লুকু ফার্ন প্লেসে এসেই একপট কফি তৈরি করে ফেলে। বলে—‘দিদি আজ চিঁড়ে ভাজব?’ মেধা বলেন, ‘ভাজ্। আমি আলু কুরে দিচ্ছি। আলুর কুটভাজা চিঁড়ের সঙ্গে ভালো লাগবে। একটু অপেক্ষা কর। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে তো ভালো লাগবে না।’
লুকু বলে—‘জানেন দিদি, আমি আগে চিঁড়ে ভাজতে জানতুম না। মা করত ঠিক সাদা ধবধবে ফুলের মতো দেখতে হত। ঝড়ু ভাজতো সেগুলো কিরকম ভিজে-ভিজে কালো-কালো শুঁটকে-শুঁটকে হত। তারপর একদিন বাপী বলল আমাতে তোতে চেষ্টা করি ঠিক পেরে যাবো। চিঁড়ে বার করতে করতে তেলটা খুব পুড়ে উঠেছে, আমাদের ব্যাপার তো! বাপী তাড়াতাড়ি একমুঠো ছেড়ে দিয়ে গ্যাসটা কমিয়ে দিয়েছে। অমনি চিঁড়েগুলো ফুলে ঢোল। বাপী বলছে—“লুক লুক শীগগীর তোল, এইবারে হয়েছে। পারবো না মানে?” সেই থেকে আমি চিঁড়ে ভাজতে খুব ভালো পারি।’
কিছুক্ষণ পরই মৈথিলী আর দেব আসে। কোনও কোনও দিন উজান ইউনিভার্সিটি থেকেই লুকুদের সঙ্গ নেয়। মোটামুটি চার পাঁচজন এসে গেলেই লুকু চিঁড়ে ভাজতে আরম্ভ করে, মেধা আলু কুরতে আরমভ করেন।
একটা বড় স্টীলের কানা-উঁচু থালায় ওরা চিঁড়ে ভাজাটা মাঝখানে রাখে, সবাইকার হাতে একটা করে কাগজের গ্লাসে কফি। মেধা বলেন—‘দেব তুই আর খোলস থেকে বেরোলি না, কি অতো ভাবিস বল তো? প্রেমে ট্রেমে পড়েছিস, না কি?’ এরকম হালকা ঠাট্টা মেধা সাধারণত করেন না। একমাত্র চিঁড়ে ভাজা খাওয়ার সময়েই তাঁর এই মেজাজটা আসে, এটা লুকু লক্ষ্য করেছে। তাই মাঝে মাঝেই সে চিঁড়ে ভাজার উদ্যোগটা নেয়। যথেষ্ট রাতে বাড়ি যায় সব। অর্থাৎ ছাত্রসংঘের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্যরা। লুকু অর্ধেক দিন মৈথিলীর হাতটা জড়িয়ে ধরে বলে—মৈথিল, আমায় থাকতে বল্ না রে!’
মৈথিলী বলে—‘লুকু তুই থাক। প্লীজ।’
লুকু বলে—‘দিদি, মৈথিলী কিন্তু আমাকে আজকেও থাকতে বলছে।’
মেধা ডায়াল ঘোরান।
‘বিশ্বজিৎদা! হ্যাঁ আমি মেধা বলছি। লুকু থাকছে। আপনারা ঠিক থাকবেন তো!’ বিশ্বরজিৎ মজুমদার, লুকুর বাবা বলেন—‘থাকুক। কাল আসবে তো?’ গলায় যেন একটু হতাশা।
‘আচ্ছা, আমি ওকে ফোনটা দিচ্ছি।’
লুকু ফোন ধরে—‘বাপী, আজ মৈথিলীর মন খারাপ, থাকি?’
‘হ্যাঁ, তা…কিন্তু জয় একটু গোলমাল করছে।’
‘ভাইয়াকে দাও, ভাইয়া, কাল ভোরবেলা চলে যাবো, হ্যাঁ। ঘুম থেকে উঠেই দেখবি দিদি। বাবাকে দে। বাবা, আজকের দিনটাই শুধু, তুমি মন খারাপ করবে না তো?’
‘নাঃ।’ নাটা বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য শোনায় না। স্ত্রী মারা যাবারপর, লুকুর বাবা বিশ্বজিৎ মজুমদার ছেলেমেয়ের ওপর খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। মানসিক নির্ভরতা যাকে বলে।
লুক্ একদিন থাকে। আবার দুদিন বাবার কাছে। তৃতীয় দিন সন্ধে উৎরে গেলে হয়ত বলবে—‘দিদি, মৈথিল আজ আমায় একটু থাকতে বলুক না?’
‘বলুক—’ মেধা হাসবেন। তাঁর চিবুকের ওপর টোলটা গভীর হয়।
সেইদিকে তাকিয়ে লুকুর কি যেন মনে হয়, ভেতর থেকে একটা আবেগ উথ্লে ওঠে। কোনমতে সামলে নিয়ে সে ফোনের দিকে ছোটে। —‘বাপী, আজকের দিনটা আমি দিদির কাছে থাকি।’
মেধার পাশের ঘরে, দু বন্ধু খাটে শোয়। লুকুর অভ্যেস গলা জড়িয়ে শোওয়া। মৈথিলী আবার ওভাবে শুতে পারে না। সারা রাত সে গলা থেকে লুকুর হাত নামাতে থাকে, তারপর এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে যায়। মাঝখানের দরজাটা খোলা থাকে। অনেক রাত অবধি শুয়ে শুয়ে স্ট্যান্ডিং ল্যাম্পের আলোয় পড়তে পড়তে এক সময়ে মেধা বই নামিয়ে রাখেন। ল্যাম্পের সুইচটা নিবিয়ে দিলে প্রথমটা সব ঘোর অন্ধকার হয়ে যায়, তারপরই পাশের ঘরে সাদা বিছানায় দুটি দুধ শাদা রাত জামার জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকার দৃশ্যটা দেখতে পান। ঘুমের বড়ি খাবার মতন নিশ্চিদ্র নিদ্রা আসে।