Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উত্তরসাধক || Bani Basu » Page 10

উত্তরসাধক || Bani Basu

গ্রীষ্ম আসতে আসতে কেওড়াখালির পাতকুয়োগুলো সব হয়ে গেল। নলকূপ পাঁচটা। একটি যৌথ পোলট্রি ও ডেয়ারি। লেগহর্নের ছানা এসেছে দেবপ্রিয়র মেজ জেঠুর ফার্ম থেকে। পুরোটাই ফ্রি। ডেয়ারি আরম্ভ হয়েছে আপাতত দুটো মহিষ এবং দুটি মাত্র গরু দিয়ে। এগুলিও পৃথ্বীন্দ্রনাথ অনেক কমদামে দিয়েছেন। মুরগী প্রতিপালন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেবার জন্য তিনি স্বয়ং একটি কর্মী নিয়ে এসে কদিন থেকে গেছেন। ছাত্রসংঘের কড়া নির্দেশ এই দুধ এবং ডিম গ্রামের সব পরিবারকে প্রয়োজন অনুসারে বিতরণ করা হবে। যৌথ মালিকানা ছাত্রসংঘের এবং গ্রামের। আপাতত যা হচ্ছে তাতে ওরা পেটে খাক। ব্যবসার কথা পরে ভাবা যাবে। লোকগুলো যেমনি গরীব, তেমনি অলস। চাষবাসের কাজ ছাড়া আর কিছু করতে চায় না। মেয়েরা যত সহজে লেখাপড়া শিখে গেল, বয়স্ক পুরুষদের তত সহজে শেখানো যাচ্ছে না। যাই হোক সার্ভের রেজাল্ট ভালোই। গণস্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, স্বাস্থ্যের নিয়ম পালন করতে শিখেছে মোটামুটি। অল্পবয়সীরা সবাই ব্যায়াম ও খেলাধুলো করে, দুধ ডিম খাচ্ছে সবাই এবং প্রত্যেকটি লোকের প্রাথমিক বর্ণপরিচয় হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালাচ্ছে নীলমণি ও রতন নামে দুটি ঊনিশ কুড়ি বছরের ছেলে। নিরঞ্জন খাঁড়া হেড মাস্টারমশাই বয়স্ক শিক্ষার স্কুলের জন্য খুব পরিশ্রম করছেন। মাথায় ঘোমটা টেনে শ্রদ্ধাশীলা চাষী-বউরা পড়তে আসছে, নিরঞ্জনবাবু দেয়ালের দিকে তাকিয়ে পড়িয়ে চলেছেন। গ্রামের মেয়েদের জলের জন্য অত সময় ও শ্রম ব্যয় হচ্ছে না, সে সময়টুকু তারা খুশী হয়ে লেখাপড়া শিখছে। মেধার পরিকল্পনা মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য তাদের কিছু শেখানো দরকার। তিনি পরামর্শ নিচ্ছেন কি করা যায়।

এই সময়ে, অপারেশন কেওড়াখালির তৃতীয় পর্যায়ের শুরুতে মৈথিলী ঠিক করল একটা মস্ত দল কেওড়খালি যাবে। ডাঃ দাশগুপ্তর ফার্মাকোলজি ক্লাসেই সে দেবপ্রিয়কে ধরল। ওকে চট করে ধরা যাচ্ছে না আজকাল। পড়াশোনা নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত বলেও তো মনে হয় না। ওর মেজজেঠুকে বলে মুরগী ও গরু মহিষের ব্যবস্থা করে দিল। মেজজেঠু ট্রেনিং-এর জন্য স্বয়ং কেওড়াখালি গেলেন পর্যন্ত। কিন্তু সেই চ্যারিটি শোর পর থেকেই দেবপ্রিয় ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ হয়ে আছে। ক্লাসের শেষে পেছন থেকে এগিয়ে গিয়ে দেবের কনুইটা শক্ত করে ধরল মৈথিলী। দেবপ্রিয় চমকে পেছন ফিরে তাকাল। এক লহমার জন্য তার চোখে যেন কেমন একটা ধরা-পড়ে-যাওয়ার দৃষ্টি দেখল মৈথিলী। সে বলল—‘দেব, আজ আমাদের বাড়ি চলো, দরকার আছে।’

—‘কি দরকার?’

‘সে যাই-ই হোক না কেন, জরুরি দরকার, এখানে বলা যাবে না।’

বাসে দুজনে আলাদা আলাদা বসেছে। চুপচাপ আসতে হল। মৈথিলীর বাড়ি চ্যাপেল রোডে, খুব ছায়াময় রাস্তাটা। পাশাপাশি চলতে চলতে দেবপ্রিয় হঠাৎ বলল—‘আমিই আসতুম। দরকারটা তোমার চেয়ে আমারই বেশি। কিন্তু সময় পাচ্ছিলুম না।’

বৈজু দরজা খুলে দিল। এখন মৈথিলীর বাবা-মা দুজনেই দিল্লি। দেবপ্রিয়কে নিজের ঘরে বসিয়ে মৈথিলী মায়ের ঘরে জামাকাপড় বদলাতে গেল। বৈজুকে বলতে হবে ভালো কিছু জলখাবার তৈরি করতে। দেব অনেক দিন পর এলো।

নিজের ঘরে ঢুকে সে অবাক হয়ে গেল, দেবপ্রিয় স্মোক করছে। মৈথিলীর কাছ থেকে একটা ছাইদান চাইল।

—‘দেব, তুমি সিগারেট ধরলে কবে?’

—‘অনেক দিন। ধরো, যতদিন তুমি তোমার খবরটা আমার কাছে চেপে রেখেছ।’

—‘কি খবর?’ মৈথিলী হালকা সুরে বলল।

দেবপ্রিয় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল—‘কি খবর তুমি জানো না? তোমার রেজাল্টের সঙ্গে আমার রেজাল্ট অদল-বদল হয়ে গেছে এই সাংঘাতিক জরুরি খবরটা!’

মৈথিলী বসে পড়ে বলল—‘দেব, ইট মাস্ট হ্যাভ বিন অ্যানাদার মিসটেক। দেখো এইচ.এস.-এ আমার রেজাল্ট দেখে স্কুলের কেউ বা আমি নিজে বিশ্বাস করতে পারিনি। তাই রিভিউ করতে দিয়েছিলুম। দুবছর পর রেজাল্ট যখন এলো খুলে দেখলুম তারা কৈফিয়ত দিচ্ছে অন্য কার সঙ্গে নাকি আমার রেজাল্ট অদল-বদল হয়ে গিয়েছিল। মার্ক্সগুলো হুবহু তোমার। আমি বিশ্বাস করিনি। এই নিয়ে কী অসম্ভব হই-চই হবে জেনে আমি নিজে বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করি। ওঁরা তখনও তোমাকে জানাননি। বুঝতেই পারছ, ওদেরও কী ভয়াবহ অবস্থা। চেয়ারম্যানের কাছে তখনই আমি জানিয়ে আসি আমি আমার আগের রেজাল্টটাই অ্যাকসেপ্ট করব। কারণ দেব, এবারের রেজাল্টটাও আমি অ্যাকসেপ্ট করতে পারছিলাম না। অঙ্কে আমি সিম্পলি দুশর মধ্যে দুশ পেতে পারি না। সেকেন্ড পেপারে দশ নম্বর আমি উত্তরই করিনি। আমার ধারণা আমার স্কুল, বাবার নাম, হোম সেক্রেটারির চিঠি ইত্যাদিতে ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে ওরা আরও একটা সাঙ্ঘাতিক ভুল করেছে। কোথাও একটা গণ্ডগোল ঠিকই আছে, সেটা লোকেট করতে পারেনি, শুধু শুধু তোমার মার্কশীটটা নিয়ে টানাটানি করছে শুদ্দু তোমাদের সেন্টারের কোড নং ওয়ান এইট এইট আর আমাদেরটা সেভন ফোর ফোর বলে। সেভন আর ওয়ানে লেখবার দোষে গোলমাল হয়, আর ইংরেজি এইট আর বাংলা ফোর এক। আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলাম। বলে এসেছি উনি যদি ফারদার এ নিয়ে আর কিছু করেন আমি কেস করব। তখন স্টেট এবং সেন্টারের মন্ত্রীদের কাছ থেকে পর্যন্ত চাপ আসবে। খাতাগুলো নিয়ে ছেলেখেলা করবার দুবছর বাদে এসব সংশোধন করা যায় না।

দেবপ্রিয় বলল—‘শুনেছি। উনি আমার স্কুলে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে আমায় ডেকে পাঠান। সমস্ত ঘটনা জানান। মৈথিলী আমি কি তোমার চ্যারিটির ওপর আমার কেরিয়ার গড়ব?’

মৈথিলী বলল—‘দেব, য়ু হ্যাভ প্রুভড্‌ ইয়োর সেল্‌ফ্‌ এগেইন অ্যান্ড এগেইন। মেডিক্যাল কলেজের টার্মিনাল পরীক্ষাগুলো তো আর এইচ-এস-এর প্রহসন নয়।’

—‘হয়ত প্রোফেসররা আমার রেজাল্টের কথা জানেন বলে বায়াজ্‌ড্‌ হয়ে মার্কগুলো দ্যান।

—‘ক্লাসগুলো? ক্লাসে তোমার উত্তরগুলো? আমরা যেগুলো কেউ পারি না, তুমি তো সেগুলো…’

—দেবপ্রিয় বলল—‘আমার ধারণা মৈথিলী, তারপর থেকে তুমি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গেছ। পড়াশোনা সীরিয়াসলি নিচ্ছো না, যে জন্য নিজেকে ভোলাতে তুমি ছাত্রসংঘও নিয়ে মেতেছে।’

মৈথিলী বলল—‘বিশ্বাস করো দেব, আমি আমার যা পড়ার পড়ছিই। এর চেয়ে বেশি মনোযোগ আমি একটা জিনিসে দিতে পারি না। আর পড়াশোনার চেয়ে এইসব কাজে আমার আগ্রহ অনেক বেশি। ডাক্তারি পড়া মানে এতো সময়, এত ডিভোশন যদি আমি আগে জানতাম ফিজিওলজি কি বায়ো-কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়তাম। এদিকে আসতামই না। আমি বিশ্বাস করি ওরা আমারটা ঠিক করতে গিয়ে আরেকটা মারাত্মক ভুল করেছে। না হলে অঙ্কের ব্যাপারটা কি করে এক্সপ্লেন করবে?’

—‘ওটা তুমি বানাচ্ছো, মৈথিলী!’

—‘কী! বানাচ্ছি! আমি…দেব তুমি আমাকে জানো না। আমি সত্যি বলছি—সেকেন্ড পেপারে দশ নম্বর আমি সল্‌ভ্‌ করিনি। সময় পাইনি। কিন্তু আমি শিওর ছিলাম একশ নব্বই আমি পাবোই। ঠিক আছে অনেস্টলি বলো—তুমি কত উত্তর করেছিলে?’

দেবপ্রিয় বলল—‘উত্তর দুশই করেছি। কিন্তু তোমার মতো শিওর ছিলুম না যে দুশয় দুশই পাবো।’

‘এনি ওয়ে তুমি দেখছ তো। তোমার দুশ আসতে পারে। আমার আসতে পারে না। অথচ রিভিউ করে ওই অদ্ভুত চারশ বিশ রেজাল্টটা ওরা আমায় পাঠালো। আমি নিশ্চিত ওরা জানে তোমাদের মফঃস্বলের স্কুল বা তুমি ক্যানডিডেট এ নিয়ে বিশেষ কিছু করতে পারবে না। অপর পক্ষে, আমি হয়ত সব তোলপাড় করে ফেলব। ভয়ের চোটে ওরা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়েছে। দেব, প্লীজ এ নিয়ে তুমি একদম ভাববে না। তোমার ওপর অন্যায় অবিচারটা আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বন্ধ করেছি। আই অ্যাম সরি দ্যাট আই এভার স্টার্টেড ইট। দীজ পীপ্‌ল আর অল সো ইনকমপিটেন্ট, সো ক্যালাস অ্যান্ড সো করাপ্‌ট্‌।’

দেবপ্রিয় ভাবিত গলায় বলল—‘আমি খুব ভালো পরীক্ষাই দিয়েছিলুম। কিন্তু স্বপ্নেও ওই রেজাল্ট আশা করিনি মৈথিলী।’

—‘আশা করো নি, কারণ মফঃস্বলে তোমাদের মাস্টারমশাইরা আমাদের এদিকের মতন চুলচেরা বিচার করেন না। ওঁদের অ্যাসেসমেন্টে হয়ত একটা কমপ্লেক্সও কাজ করে। তাছাড়াও প্রতিযোগিতা কম। কলকাতার মতো শহরে, আমাদের মতো স্কুলে কমপিটিশন কি চেহারা নেয় তুমি ধারণাই করতে পারবে না। ধর কোনও কম্পোজিশনের টাস্‌ক আছে। এক্স-এর সঙ্গে ওয়াই-এর এক নম্বরের তফাৎ। আমাদের ক্লাসে বোঝানো হত এক্স একটা চমৎকার ইডিয়মেটিক ফ্রেজ ব্যবহার করেছে, বড় বড় মনীষীদের ব্যবহার করা বাক্যবন্ধ। সুতরাং, ওয়াই তোমাকে ওইরকম দুটো ব্যবহার করতে হবে বেশি মার্কস পেতে গেলে। একদম পরীক্ষা-মুখী পড়াশোনা, কোচিং। কী বিশ্রী তুমি ভাবতে পারবে না দেব। তোমরা যা করো স্বাধীনভাবে নিজেরা করো, তোমাদের কাজে স্বকীয়তা থাকে, আনন্দও থাকে। কবে যে এই কোচিং সিসটেম, পরীক্ষার এই পদ্ধতি ভেঙে পড়বে, চুরমার হয়ে যাবে আমি সেইদিনের অপেক্ষায় আছি। আমার নিজের ধারণা প্রথম একশ কি দুশ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে গুণগত কোনও তফাৎ নেই। এদের মধ্যে যে কেউ প্রথম আসতে পারে। সবটাই নির্ভর করছে সেই অজানা এক্স-ফ্যাকটার-এর ওপরে। যাকে অবৈজ্ঞানিক মনের লোকেরা লাক নাম দিয়েছে। তার উপরে আছে ভুল, গাফিলতি। পর্বতপ্রমাণ। ওদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ওরা করুক। আমরা কেন করতে যাবো!’

—‘তুমি তো করছো। তোমাকে করতে হচ্ছে। জয়েন্টে তুমিই সর্বপ্রথম ছিলে মৈথিলী!’

—উঃ আবার সেই এক কথা। তুমি কি বিশ্বাস করো জয়েন্টটা সত্যি-সত্যি ট্যালেন্টের পরীক্ষা?’ প্রত্যেকটি প্রশ্নের সঠিক সংক্ষিপ্ত জবাব তোমার আগে থেকে জানা চাই, নইলে তুমি পারবে না।’

—‘তোমার জানা ছিল?’

—‘প্রত্যেকটি জানা ছিল। আমাকে যিনি কোচ করতেন তিনি প্রত্যেকটা ঘড়ি ধরে করিয়েছিলেন। সেখানে তুমি নিভর্র করছে তোমার স্বাভাবিক স্মৃতি, স্বাভাবিক বুদ্ধি ও স্পীডের ওপরে। আমাদের সঙ্গে তুমি পারবে কি করে?’

—‘তুমি কি বলতে চাও তোমার কোচ সব প্রশ্ন জানতেন? এই রকম করাপ্‌ট্‌ সবাই?’

—‘আমি জানি না। আপাততঃ আমি জানতে চাই না। আই অ্যাম নাউ এ হানড্রেড টাইম্‌স্ মোর ইন্‌টারেস্টেড ইন হেল্পিং বিল্ড অ্যান আইডিয়্যাল ভিলেজ।’

দেবপ্রিয় উঠে দাঁড়াল। বলল—‘কিন্তু আমি যে জানতে চাই! শিক্ষাব্যবস্থা যদি এভাবে আমাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তবে ছাত্র হিসেবে আমার প্রথম কর্তব্য কি নয় এই দুর্নীতি আর গাফিলতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। এই করাপশন তো সর্বত্র ছড়াবে। যার যেখানে পৌঁছবার কথা সে সেখানে পৌঁছতে পারবে না। তোমার আদর্শ গ্রামই কি এর থেকে বাঁচবে? মৈথিলী, আমার মনে হয় তোমার শক্তি তুমি ভুল খরচ করছ। বলব না তুমি স্বার্থপর, তুমি আমার জন্য যে স্যাক্রিফাইস করলে তার ম্যাগনিচুড আমি এখনও কল্পনা করতে পারছি না। কিন্তু প্রোগ্রাম নির্বাচনে তোমার কোথাও ভুল হয়ে যাচ্ছে। হয়ত তোমার এতো পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত বৃথা প্রমাণিত হবে।’

—‘হোক দেব। তুমি বসো তো! আমরা যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করি। পুরোপুরি সফল হবার আশা যে দুরাশা তা আমার জানা আছে। তুমি কি জানো, পালানকে আমি আর ধরতে পারছি না! উত্তর কলকাতায় একটা দক্ষিণ কলকাতায় একটা আসর করলাম, ইচ্ছে ছিল—জেলায় জেলায় করব। কিন্তু ওকে দূরদর্শনে সুযোগ করে দেওয়ার পর ও নানা জায়গায় আমন্ত্রণ পাচ্ছে। আমার কাছে খবর আছে ভারত সরকার লোকোৎসব করবে আবারও। দলবল নিয়ে রাশিয়া যাবে। এখন ছাত্রসংঘের জন্য গান করতে হলে ওকে অনেক কম টাকায় করতে হবে। কেষ্ট পালান খগেন কাউকে আমরা ধরতে পারছি না। এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা। কিন্তু দুতিনজন সত্যিকারের শিল্পী এই যে পরিচিতি পেল, মান পেল, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারল-এটাও তো খানিকটা সাফল্য!’

‘সাফল্য নয়, জীবনযাত্রার মাপকাঠি হবে সততা, আন্তরিকতা, দক্ষতা, মৈথিলী, অন্য কিছু নয়। আমাদের নিজেদের মধ্যে যেন অন্তত পক্ষে এই মূল্যবোধ নিয়ে বিভ্রান্তি না থাকে। সাফল্যের চাকচিক্য দেখে যদি ভুলে যাই এর ভেতরে অনেক স্বার্থপরতা, গৃধ্নুতার অন্ধকার আছে তবে আমাদের সংঘ টংঘ গড়ে কোনও লাভ নেই। এরকম প্রতিষ্ঠান তো চারদিকে প্রচুর আছে। তাদের সংখ্যায় আর একটা যোগ করাই কি আমাদের উদ্দেশ্য! পালান গ্রামে গ্রামান্তরে গান গেয়ে সাধারণ চাষীভুষো গরিব লোককে অনাবিল আনন্দ দিচ্ছে, পরিবর্তে সে পরিশ্রমের অন্ন খাচ্ছে তার গ্রামের মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে, এ দৃশ্যটা সুন্দর। সুটবুট পরে ভি. আই. পি. সুটকেস হাতে রাশিয়ায় যাবে বলে সে প্লেনে উঠছে এবং তোমাকে এড়াবার জন্য যথাসম্ভব কৌশল অবলম্বন করছে এ দৃশ্যটা কল্পনা করতে আমার মোটেই ভালো লাগছে না।’

বৈজু অনেক খাবার-দাবার করে এনেছে, সে হাসিমুখে এসে বললে—‘দেবুদাদা, খাও। অনেকক্ষণ পড়া লেখা করেছ দুজনে। বাব্‌বাঃ আমারই গলা শুকিয়ে গেল।’

বৈজু চলে গেলে মৈথিলী বলল—‘দেব তুমি আমাকে কথা দাও, ওই পরীক্ষার রেজাল্টটার ব্যাপার নিয়ে তুমি তোমার মনের মধ্যে কোনওরকম কমপ্লেক্স রাখবে না!’ দেবপ্রিয় উত্তর দিল না।

—‘কথা দাও দেব। আমি তোমাকে যথেষ্ট কারণ দেখিয়েছি আমার সিদ্ধান্তের।’

—‘যদি কথা-টথা না-ই দিই, তো তুমি কি করবে?’—দেবপ্রিয়র মুখে দুর্লভ হাসি। মৈথিলীর মনে হল দেবপ্রিয় সহসা হাসে না, খুব গম্ভীর প্রকৃতির। তার হাসি দুর্লভ বলেও এত অসামান্য সুন্দর। যেন গম্ভীর নিশীথ আকাশের বুক হাসিয়ে হঠাৎ ত্রয়োদর্শীর ফালি চাঁদ ওঠা।

মৈথিলী হেসে বলল—‘ইন দ্যাট কেস আমি বোর্ডের যতজন পারি কর্মীর চাকরি খাওয়ার জন্যে চেষ্টা করব। এনকোয়ারি কমিশন বসবে, বার করবে আমার অঙ্কের খাতা কে দেখেছিল। পরীক্ষক, স্ক্রুটিনিয়ার যে যেখানে আছে সবাইকে খাবো। শুধু হোম সেক্রেটারি নয়, ডেপুটি কমিশনার ক্যালকাটা পুলিস আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মন্ত্রী শান্ত্রী মহলেও কিছু কিছু চেনাশোনা আছে।’

দেবপ্রিয়র হাসিটা ক্রমশঃ বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। বললে—‘বাজে কথা বলছো।’

—‘কোনটা, চাকরি খাওয়ার কথাটা? না চেনাশোনা থাকার কথাটা?’

—‘প্রথমটা।’

—মৈথিলী বলল—‘হায় দেবপ্রিয় তুমি জানোই না আমি হোয়াইট লাই ছাড়া মিথ্যে কথা বলি না।’

দেবপ্রিয় মিটিমিটি হেসে বলল—‘জানি। তা এটা সেইসব সাদা মিথ্যের একটা নয় তো?’

—‘ন্‌ নো! নেভার!’ মৈথিলী জোরে জোরে হেসে উঠল।

দেবপ্রিয় বলল—‘মৈথিলী তোমাকে আমি যতই আবিষ্কার করছি ততই ভালোবেসে ফেলছি। নিশ্চয় বুঝতে পারছ কি বলতে চাইছি!’

মৈথিলী চেয়ারটা দোলাতে দোলাতে বলল ‘শিওর! তোমাকেও আমি যে পর্যন্ত প্রীতি করি, তাহা বোধ করি মনুষ্যে সম্ভবে না।’

দুজনেই খেতে খেতে হাসছে। হঠাৎ চেয়ারটা থামিয়ে মৈথিলী বললে—‘ভুলেই গিয়েছিলাম। দেব, তুমি সিগারেট খাওয়া কবে থেকে ধরলে!’

দেবপ্রিয় বলল—‘যেদিন বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ইন্টারভিউটা সেরে এলুম সেইদিন থেকে। কিন্তু সেটা ছিল সাময়িক। সিগারেটের নেশাটা জমে উঠেছে যেদিন থেকে একজন আমার পকেটের নির্দোষ প্যাকেটটা বার করে নিয়ে সেখানে অন্য একটা প্যাকেট ভরে রাখে। একই রকম দেখতে, খালি সিগারেটগুলো আলাদা।’

—‘মানে?’

—‘মানে খুব জটিল মৈথিলী। ছাত্রসংঘের কেউ আমাকে ড্রাগ ধরাতে চাইছে।’

—‘হো-য়াট!’ মৈথিলীর হাত থেকে টুং করে চামচ পড়ে গেল—‘কি বলছো? কে?’

—‘এখনও শিওর হতে পারি নি। কিন্তু প্রায় ধরে ফেলেছি। আমি প্যাকেট থেকে দুটো খেয়েই বুঝতে পারি, কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। আগে কখনো খাইনি বলে ধরতে দেরি হল। ভেবেছিলুম অ্যানালিসিস করবো, কিন্তু লুকু সব মাটি করে দিল।’

—‘লুকু?’

—‘হ্যাঁ। ও আবার হয়ত মজা করেই আমার প্যাকেট থেকে বাক্সটা চুরি করে, না পেয়ে প্রথমটা আমি বুঝতে পারিনি, ভেবেছি যে দিয়েছিল সেই নিয়ে নিয়েছে। তারপর কেমন সন্দেহ হয়। লুকু সেদিন চ্যারিটি শো-এ থেকে থেকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছিল—‘কার কি হারিয়েছে, মদনমোহন পালিয়েছে।’ তোমরা চলে গেলে কেওড়াখালি, শুনলুম লুকু যায়নি, অসুস্থ। কেমন মনে হল, ওর বাড়ি গেলুম দুপুরবেলায়। যা ভেবেছি ঠিক। একটু আগেই সিগারেট খেয়েছে। গন্ধ পেলুম। ভীষণ বমি করল। স্বীকারও করল। ও অবশ্য বুঝতে পারেনি সিগারেটে ড্রাগ ছিল। ও নিশ্চয়ই আমার কার্যকলাপ খুব রহস্যজনক মনে করেছে। কিন্তু খালি প্যাকেটটা পেলুম, আটটা সিগারেট ফুঁকে দিয়েছে। অ্যানালিসিস করানো হল না। যাই হোক আমার ধারণা—ওটা হেরোইন।

—‘বলো কি? সেইজন্যে তুমি কেওড়াখালি যাচ্ছো না?’

‘সেটা একটা কারণ। কিন্তু আমি প্রবলেমটাকে এড়াতে চাইছি না। আমি ওই ছেলেটিকে খুঁজে বার করবই। মৈথিলী তোমরা কিন্তু সাবধান। আমি একাই যে ওর লক্ষ্য তা না-ও হতে পারে। প্রথমে আমার তাই মনে হয়েছিল, এখন আমি শিওর ও সব্বাইকে ড্রাগ ধরাতে চাইবে। যারা যারা স্মোক করে, তাদের সবাইকে সাবধান করে দেওয়া দরকার।’

—‘কেন এর উদ্দেশ্য কি? নিজে লেজ কাটা শেয়াল, তাই সবাইকার লেজ কাটতে চাইছে?’

—‘উঁহু তাহলে তো সোজাসুজি অফার করতে পারত। কলকাতায় এসে আমি বেশ কয়েকটা নেশাড়ে গ্রুপের সংস্পর্শে এসেছি যারা আমাকে সোজাসুজি ‘গুরু গুরু’ বলে নেশা ধরাতে চেয়েছে। এরা নিজেরা নেশাড়ে, এখন ড্রাগ-পেডলারও হয়ে গেছে। এটা অন্য কিছু। কি আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারি নি। বোঝবার চেষ্টা করছি।’ বলতে বলতে দেবপ্রিয় অস্থিরভাবে পায়চারি করতে শুরু করল। ফিরে দাঁড়িয়ে বলল—‘মৈথিলী তোমরা বারবার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছো, মনে আছে সেদিন দুদলের দুজন তোমাকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বললে তুমি কিভাবে ওদের এড়িয়ে গেলে! এই রাজনৈতিক দলগুলো সব একেকটা বড় বড় ক্ষমতালোভী চক্র। এরা যেমন তেমন করে নিজেদের দল বাড়াতে চায়। যে কোনও মূল্যে। বয়স্ক ভোটাধিকারের দেশে এটাই ওদের একমাত্র উপায়। কোনও নীতি নয়, আদর্শবাদ নয়, শুদ্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ফলে হু হু করে বেনোজল ঢুকছে সর্বত্র। এ যদি রামা গুণ্ডাকে তোষণ করে তো আরেকজন করে শামা গুণ্ডাকে। ছাত্র-ছাত্রীরা কোনও রাজনৈতিক দল ছাড়াই শুধু সোশ্যাল ওয়ার্কের জন্য সংঘবদ্ধ হচ্ছে এটা কোনও পার্টিরই ভালো লাগবার কথা নয়। আবার দেখো, দেশের যুবশক্তিতে ঘুণ ধরিয়ে দেবার জন্যও একটা চক্র আছে। স্বদেশী কি বিদেশী জানি না। তাছাড়াও আছে সিম্পলি টাকা। মাদকের ব্যবসা করে যারা কোটি কোটিপতি হচ্ছে তাদের জাল ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর সর্বত্র। এখন কি মোটিভ এখানে কাজ করছে বলা শক্ত। তবে তুমি সতর্ক হয়ে তোমার কাজ করে যাও, আমি এর শেষ দেখবই।’

মৈথিলী উদ্বিগ্ন হয়ে বলল—‘আমায় বলবে না দেব, ঠিক কাকে তোমার সন্দেহ?’

—‘সন্দেহের কথা বলতে নেই। মৈথিলী, তোমার ঘনিষ্ঠদের মধ্যেই কেউ। বি ভেরি ভেরি কেয়ারফুল।’

—‘তুমি একা এই সব চক্রের পিছনে ঘুরো না দেব। এগুলো হঠকারিতা। মেধাদিকেই বা বলছ না কেন?’

দেবপ্রিয় চেয়ারে বসে পড়ল, বলল—‘মৈথিলী মিস ভাটনগরের ব্যাকগ্রাউন্ডটা আমায় বলতে পারো? উনি দু দফায় দশ বছরের ওপর স্টেটসে কাটিয়ে হঠাৎ ফিরে এলেন কেন? ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গেই বা ওঁর দহরম মহরম কেন? সহকর্মীদের সঙ্গে তেমন সদ্‌ভাব নেই। একা-একা থাকেন। ভদ্রমহিলা খুব রহস্যময়!’

মৈথিলী হেসে বলল—‘সি আই এর জুজু দেখছ না কি? তুমি মেধাদির সঙ্গে একটু মেলামেশা করো। অত রহস্যময় ওঁকে আর লাগবে না। আসলে তুমি রজ্জুতে সর্পভ্রম করছ। দেবপ্রিয় বলল—‘তুমি কি জানো মৈথিলী, মেধা ভাটনগর ছাত্র-জীবনে বিপ্লবী মার্কসিস্ট ছিলেন পরে হঠাৎ উধাও হয়ে যান। ওর নেকস্‌ট ট্রেস পাওয়া যায় বস্টনে। এখন আবার উনি হঠাৎ কলকাতায় এসে বসেছেন।’

মৈথিলী বলল—‘মার্কসিস্ট হওয়াটা কি অপরাধ?’

—‘একেবারেই না। মৈথিলী দেখো, আজকালকার যুগে এমন কে আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছে যে মার্কসিজমের কতকগুলো বেসিক টেনেট অস্বীকার করে! কে সাম্য চায় না? আমাদের ছাত্রদের মধ্যে এমন কে আছে যে পুঁজিবাদের সপক্ষে কথা বলবে? কেউ না। আমরা সবাই চাই এ এসট্যাবলিশমেন্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে যাক। অন্য কিছু আসুক। কিন্তু আমরা যা চাই সেই দুর্নীতিমুক্ত কুসংস্কারমুক্ত, ভয়হীন, ন্যায়পরায়ণ খোলা আবহাওয়া যেখানে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন—খাদ্যের, স্বাস্থ্যের, বস্ত্রের, শিক্ষার, প্রয়োজন মিটবে সে কি মার্কসিজমের পথেই কোথাও এসেছে? বিপ্লবের পথ দিয়েই কি তা এলো? বরং ঘোলা জলকে আরও ঘুলিয়ে দিয়ে গেল সব।’

—‘ঠিক আছে আসেনি। তুমি তার জন্য মেধাদিকে একা দায়ী করছ কেন?’

—‘প্রথমত এই জন্য যে এঁরা অল্প বয়সে মার্কসিজমে দীক্ষিত হয়েছিলেন, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছেন। কোনও মতবাদই বাস্তব অবস্থা নিরপেক্ষ তো হতে পারে না। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসিস্ট থিয়োরিতে কোথায় কোথায় পরিবর্তন দরকার সেটা তাঁদের বুঝতে পারার সময় ও সুযোগ ছিল, সেটা তাঁদেরই দেখবার কথা, মার্কসের ভূত তো সেটা দেখবেন না! কোনকালে ওল্ড টেস্টামেন্ট বলে গেছে সাতদিনে বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল, ক্রিশ্চানরা আজ কি তা মানে? কোন কালে টলেমি বলে গিয়েছিলেন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে আজ কি আমরা তা মানি? তবে? তাঁরা ভাবলেন না। কিচ্ছু করলেন না, স-ব পশ্চাদপসরণ করলেন। কেন? ঊনিশ শতকের য়ুরোপে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশনের পটভূমিকায় যে থিয়োরি গড়ে উঠেছিল ভারতের অর্থনৈতিক বিন্যাসে তার কতটা রদবদল করা দরকার তাঁরা ভাবলেন না। কিচছু করলেন না, স-ব পশ্চাদপসরণ করলেন। কেন? যে আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন তার রূপায়ণে যেই অসুবিধে দেখা দিল, অমনি মোহভঙ্গ হল, অমনি পলায়ন করলেন? যাই বলো, এটাও সুবিধাবাদ। একবার প্রমাণ হয়ে গেছে উনি কিচ্ছু করতে পারেন নি। এখন আবার ফীল্ডে নেমেছেন, কেন? দুনিয়ার বহু ইনটেলেকচ্যুয়ালকে আমি এইভাবে পালাতে দেখছি। প্রথমে মার্কসিজম লেনিনিজম মাওইজম তাঁদের ভীষণ আকর্ষণ করে, তাঁরা বড় বড় কবিতা লিখে ফেলেন। পরে মোহভঙ্গ হয়, গালাগাল বর্ষণ করতে থাকেন। তাঁদের খেয়াল হয় না, ভুলটা দেখতে পেয়েও তাকে না শুধরে পালিয়ে যাবার জন্য তাঁরা আরও বেশি সমালোচনার যোগ্য।’

—মৈথিলী তর্কে যোগ দিল না। শুধু বলল—‘দ্বিতীয় কারণ?’

—‘দ্বিতীয় কারণ এই যে মিস ভাটনগর তাঁর পূর্ব পরিচয় আমাদের কাছে গোপন রেখেছেন। আমি তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতে পেরেছি মেজজেঠুর কাছ থেকে। মেজ জেঠু সে সময়ে সরকারি চাকরি করতেন। অনেক কিছু জানেন। মেধা ভাটনগর নাম শুনেই চিনতে পেরেছিলেন, আমাকে পরে বলেছিলেন এরা ভাঙার দলে। খালি ভাঙতে চায়।’

—‘দেব, মানুষ কি বদলায় না? যিনি এক সময় ভাঙার পক্ষে ছিলেন, তিনি কি এখন গড়ার দলে আসতে পারেন না?’

—‘মানুষ বদলায় মৈথিলী, কিন্তু যখন কেউ কোনও তত্ত্বকে গভীরভাবে জীবনে গ্রহণ করে তখন সেই তত্ত্বটা সম্পর্কেও তার দায়িত্ব থাকা দরকার। ধরলুম আর ছাড়লুম, ছাড়লুম আর আমেরিকা উড়ে গেলুম আমার সুবিধে আছে বলে—এ আমি সমর্থন করতে পারি না।’ মৈথিলী স্পষ্টই খুব উদ্‌বিগ্ন হয়ে পড়েছে, সে বলল—‘দেব, তুমি মেধাদিকে এমন কঠোরভাবে বিচার করার আগে ওঁর সঙ্গে মেশো। ওঁর দৃষ্টিভঙ্গিটা জানো। জেনারালাইজ করো না। মেধাদির ভিতরে কোথাও একটা তীব্র জ্বালা আছে, দুঃখ আছে। সেটা ঠিক ব্যক্তিগত কারণে নয় বলে আমার মনে হয়। আমরা শুধু শুধু ওঁকে আমাদের চেয়ার পার্সন করিনি।’

দেবপ্রিয় এখন অনেকটা শান্ত হয়ে গিয়েছিল, আস্তে আস্তে বলল—‘আমার আশঙ্কাগুলো সম্পর্কে ওঁকে আমি কিছুদিন আগে একটা চিঠি দিয়েছিলুম মৈথিলী। তখন আমারও ওঁর ওপর আস্থা তোমার মতোই। উনি সেই জরুরি চিঠিটার কোনও উত্তর তো দিলেনই না। মাঝে মধ্যে যখন দেখা হয় সেটার উল্লেখও করেন না। উপরন্তু আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন যেন আমি একটা বাচ্চা ছেলে, আমার অসুখ করেছে, উনি আমাকে লজেন্স দিয়ে ভোলাবেন। মৈথিলী আমি তোমাদের প্রত্যেককেই স্টাডি করছি। তুমি এই পরীক্ষায় পাশ করে গেছ তাই তোমায় এতো কথা বললুম। অন্য অ্যানালিসিসগুলোর রিপোর্ট-এর জন্য অপেক্ষা করছি। ইন দা মিন টাইম তুমি গোপনতা রক্ষা করবে।’

মৈথিলী হেসে বলল—‘তোমার কি সন্দেহ আছে, তাতে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress