Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উত্তরঙ্গ (১৯৫১) || Samaresh Basu » Page 13

উত্তরঙ্গ (১৯৫১) || Samaresh Basu

১৩. পবনের ভিটা-ত্যাগ

সত্য বটে পবনের ভিটা-ত্যাগ কেউ ঠেকাতে পারল না, আর একটি নতুন ঘটনা পবনের সমস্ত জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিল।

আতপুরের রাজাদের সেজবাবুর আরদালির সঙ্গে ঘটনাচক্রে পবনের কিছুটা বন্ধুত্ব ছিল। অবশ্য সে বন্ধুত্বের মধ্যে একটা রাজোচিত ফারাকও ছিল। গাঁজা ডলে দেওয়া, সাজানো, মদ সংগ্রহ ইত্যাদি নানা কাজের জন্যই পবন তার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আর পবনের কৃতিত্বও কম ছিল না। সাহসী বলবান এবং সারা পরগনায় ঢেউ তুলে পরের বিয়ের আসর থেকে কনে তুলে নিয়ে এসেছিল সে নিজের জন্ম-পিরিতের বউ বলে।

ভিটা সম্পর্কে দুঃসংবাদ পেলেও পবন হেসেছে, নেশা করেছে, বউ তারাকে নিয়ে সোহাগ করেছে। তারপর মাথায় তেল জল দিয়ে পাট করে, সেজেগুছে এসেছে আতপুরে আরদালি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তাদের দেখা করার জায়গা ছিল মালাপাড়ার আন্ন চুনুরির বাড়িতে। যুবতী আন্নাকে সবাই বলে স্বৈরিণী বেবুশ্যে, কিন্তু আন্না বলে, তা যদি হতাম তবে ফরাসডাঙার গঞ্জে যেতাম, নয় তো মনুমতির রাঁড়ের ঘরের ধারে চালা বেঁধে থাকতাম। তা বলে যে পুরুষে মন ওঠেনি, তার ঘরের বউ হয়ে থেকে আড়ালে বারোভারি করে বেড়াব তেমন মেয়ে আমাকালী নয়।

তাই আন্নাকালি মালোসমাজের বুকের উপর ডঙ্কা বাজিয়ে পিরিত করে মেজরাজার আরদালির সঙ্গে, প্রেমিকের দান ও খরচায় পাকা বাড়ির মধ্যে হাত ধরাধরি করে প্রেমের গান গায়। গভীর রাতে সে গান শুনতে পায় মালোপাড়ার লোক। চাঁদনীরাতে গঙ্গার ধারে বসে তাদের প্রেমগুঞ্জন হয়। চুনুরিমেয়ে তার কালো রূপের লহর তুলে আঁধার রাতকেও আলোকিত করে তোলে।

এ আন্না পবনকে ভারী খাতির করত। বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কের খাতিরে পবনকে ভাই বলে ডাকত।

সেদিন পবন এসে আন্না ও তার প্রেমিকের কাছে তার দুর্দশার সমস্ত কথা বলল। কিন্তু তার মুখে দুশ্চিন্তার বিশেষ কোনও ছাপ না দেখে আন্না উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, তা হলে তুমি কী করবে?

পবন গাঁজায় দম দিয়ে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে বলল, তাই যদি জানব দিদি, তবে আর তোমাদের কাছে এলুম কেন?

আন্না বুঝল পবন ঋণশোধের টাকাটা পাওয়ার জন্যই এসেছে। কিন্তু অত টাকা তার ছিল না। তা সম্ভব একমাত্র তার প্রেমিকের দ্বারাই। কিন্তু সে বেঁকে বসল এই বলে যে, জমিদারের সঙ্গে এ বিবাদের ফল ভাল হবে না। তারপর যদি জমিদারে জানতে পারে পবন তার কাছ থেকে টাকা পেয়েছে, তখন রাজাবাবুদের কানে সে কথা আসবেই। এলে মেজবাবু তাকে তৎক্ষণাৎ মাগনা বিদায় দেবেন। অতএব ধ্বন জমিদারের কাছে ক্ষমা চেয়ে অবস্থাটা পরিবর্তন করুক।

তখন পবন উঠে তার রক্তচোখে ঘৃণা নিয়ে বলল, চিরকাল জমিদারের পা টিপে মানুষ তুমি, তুমি তো তা বলবেই।

আরদালি একথায় চটে উঠে পায়ের থেকে খড়ম তুলে মারতে গেল। আন্না তাকে ধরে ফেলে পবনকে ধমকে উঠল, ভাই হয়ে তোমার এমন কথা?

পবন বেরিয়ে যাওয়ার মুখে বলে গেল, দুর্দিনে যারা দেখে না, তাদের ভাইবন্ধু হয়ে লাভ কি, দিদি। তবে পানের টান যদি থাকে আবার আসব, বলে গেলাম।বলে সে পথে বেরিয়ে পড়ল।

বেলা গড়িয়ে যায়। আতপুরের পালেরা বারবাড়ির বারান্দায় কয়েকজন বয়স্ক পড়শির সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করছেন। এঁরা সদ্‌গোপ চাষী। অবস্থাপন্ন তো বটেই, অনেক জায়গাজমি কিনে এঁরা জমিদার হয়েছেন। এ-সৌভাগ্যের দরজা এদের কোম্পানির দৌলতে। এ বংশের একজন কোম্পানির কমিসারিয়েট ট্রান্সফার বিভাগের দার্জিলিং-এর সাপ্লাই এজেন্ট ছিলেন। তখন কোম্পানির সেবার ফল অনেকেই যেমন পেয়েছে, এঁরাও তেমনি পেয়েছেন।

পবনকে যেতে দেখে একজন গড়গড়ার নল মুখ থেকে সরিয়ে হাঁক দিলেন,কে যায় ওটা?

পবন দূর থেকেই হাতজোড় করে বলল, এঁজ্ঞে পবন চাঁড়াল।

বটে! পালকর্তার গলায় একটা গর্জনের ভাব শোনা গেল। বোঝা গেল, নামটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। বললেন, এদিকে আয়।

পবন কাছে যেতেই পাশ থেকে ছড়িটা তুলে দারুণ রোষে তিনি তার মাথায় ঘা দিয়ে খুঁচিয়ে সমস্ত পাট করা চুল এলোমেলো করে দিলেন। হারামজাদা, চুলের বাহার করে টেরি কেটে যাচ্ছিস এখান দিয়ে? ঘাড় থেকে তোর মাথা নামিয়ে দেব আমি, ছোটলোক কোথাকার।

এ-আচমকা আক্রমণ ও অপমানে পবন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর সকলে টেরিচুল এবং ছোটলোকের স্পর্ধার কথা নিয়ে যা খুশি তাই বলতে লাগলেন ধ্বনকে।

কর্তা হাঁক দিলেন চাকরকে। বললেন, যা তো নাপতে ডেকে এনে ব্যাটার মাথা মুড়িয়ে বের করে দে এখান থেকে।

পবন স্তব্ধ, আড়ষ্ট, যেন পাথরের মূর্তি। কী করবে সে ভেবে পেল না। বুক পুড়ে গেল অপমানে। দৌলতের ক্ষমতার কাছে তার তপ্ত চাঁড়াল রক্তের আসুরিক বল থমকে রইল।

নাপিত এসে মাথা কামিয়ে দিল ওর। সে জানত এখানে কোনও কথাই চলবে না। অর্থের এ পাশবিক শক্তি তাতে আরও নতুন কৌশল রচনা করবে। সে বিনাবাক্যে পথ ধরল।..নিস্তব্ধ নিঝুম পথ। দুপাশে গাছের ঝুপসিঝাড়ের ছায়ায় ভরা। সে পথের উপর দিয়ে দ্রুত চলল সে। কিন্তু কোথায়, কেন যাবে সমস্ত যেন এলোমেলো হয়ে গেল তার মনে। অপমানে রাগে দুঃখে বুক পুড়ে যেতে লাগল। সে যন্ত্রণার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই শুধু সে হাঁটছিল, তার কোনও গন্তব্য নেই।…এক সময় তার চোখ ফেটে দরদর ধারে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। অপমানে ঠাসা বদ্ধ হৃদয়ের ক্লেদ প্রকাশের জন্যই বুঝি এ চোখের জল। তাই তার কান্না যেন আরও উদ্দাম হয়ে উঠতে চাইল। কিন্তু তাতে তার বেগ যখন মানল না, তখন হঠাৎ সে একটা গাছের কাছে দাঁড়িয়ে তার গুঁড়িতে মাথা ঠকতে ঠুকতে রক্ত বার করে ফেলল আর বার বার বলতে লাগল, ভগবান এ হাত-পা বাঁধা ছোটলোকদের তবে কেন তুমি জাে দেও, কেন দেও, কেন দেও! আর সে জন্মো দিয়ে যদি এই তোমার খেলা হয়, তবে বলি ভগবান, তুমি গরিবের কেউ নও।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress