উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : ওরা, তিনি, জেঠু
মিঠু খুব ভারী পা ফেলে চলছিল। চারদিকে বাস-ট্যাক্সির আওয়াজ হঠাৎ যেন প্রবল বেড়ে গেছে। চারদিকে চলেছে অপরিচিত এমনকী বৈরী জনস্রোত। যে-কোনও মুহূর্তে এরা সব ভাঙবে চুরবে, গাড়িগুলো তাকে চাপা দেবার জন্যেই আসছে। সে একটা দোকানে ঢুকে বসে পড়ল। ঘামছে। মাথা ঘুরছে। একটা অন্ধ কষ্ট শরীর ছেয়ে ফেলছে ক্রমশ। কেন এরকম হল, হঠাৎ? সে কি প্রতিদিন একটু একটু করে ভুলছে না সেই কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণা দ্যাখার, কিছু করতে না পারবার সেই কষ্ট! একজন সদাব্যস্ত পুরো কর্মশক্তি ও স্বাস্থ্যসম্পন্ন মানুষকে হঠাৎ অমন ভেঙে যেতে দ্যাখার নিদারুণ কষ্ট! ভুলছে তো! সময়ের নিজস্ব নিয়মেই ভুলছে! কষ্ট চলে যাবে, স্মৃতি থাকবে। স্মৃতি পবিত্র, স্মৃতির মধ্যে এই দহনকারী শোক নেই। থাকবে না। বাবার মধ্যে স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে একটা শূন্যতাবোধ আছে— সে বোঝে। কিন্তু এ-ও বোঝে ওই শূন্যতার সঙ্গে মোকাবিলা বাবাকেই করতে হবে। সে সাহায্য করতে পারবে না। বাবার স্ত্রী আর তার মা তো এক ব্যক্তি হয়েও এক নয়! দু’জনের অভিজ্ঞতাও আলাদা, মোকাবিলা করার রীতিও আলাদা। সে কষ্ট দেখা যায় না, তবু সে সেঁটে থাকত। এক মুহূর্তও মাকে ছেড়ে নড়ত না, চাইত মার কষ্ট ভাগ করে নিতে। সেই ভগবানকে অনন্যমনে ডাকত, যাঁর অস্তিত্বে তার বিশ্বাস পোক্ত নয়। বাবাও ডাকতেন, বাবা বিশ্বাসও করতেন, কিন্তু বাবা দেখতে পারতেন না, পালিয়ে যেতেন। ওহ্, দিদি আমাকে কেন ওই ভয়ংকর প্রশ্নটা করলেন?
—মৈত্রী, মৈত্রী, কী হয়েছে? এত ঘামছ কেন? শরীর খারাপ করছে?
ক্যাসেটের দোকানটা, এখন গাঢ় সকাল, খরিদ্দার কম। শিখরিণী। সি.ডি. কিনছে। শিখরিণী উঠে এসেছে।
নিজের ব্যাগ থেকে ঠান্ডা ঠান্ডা টিস্যু বার করে তার কপালে চেপে ধরতে লাগল শিখরিণী। —আপনাদের কাছে একটু ঠান্ডা জল হবে? একজন কাছাকাছি দোকান থেকে ঠান্ডা পানীয় কিনে আনল। খানিক মুখেচোখে দিয়ে, বাকিটা আস্তে আস্তে খাওয়াচ্ছে তাকে শিখরিণী।
মিঠু এবার হাসে, জোর করে হাসা, তবু তো হাসি। ভাল জিনিসের ভানও ভাল। আর হাসির মতো তাপহর আর কী আছে?
—কী করলি দ্যাখ তো! কপাল-টপাল সব চটচট করছে।
—করুক, একটু তো ঠান্ডা হলে! যা গরম! এখন একটু ভাল বোধ করছ!
—হ্যাঁ, ঠিক আছি। শিখরিণী, আমাকে এক্ষুনি এক জায়গায় যেতে হবে। খুব অভদ্রতা করে চলে এসেছি।
—এক্ষুনি যাবার দরকার কী! পরে গিয়ে ক্ষমা-টমা যা চাওয়ার চেয়ো।
—না, না, আমার ডিউটি আছে।
—ঠিক আছে। মিঠু, ভাগ্যক্রমে আজ আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। চলো তোমায় পৌঁছে দিই।
তিনের একের সামনে এসে মিঠু বলল, শিখরিণী, এখানে একজন অন্যরকম মানুষ আছেন, তুমি যখন এতটাই এসেছ, চলো না আলাপ করিয়ে দিই।
—আলাপটা তত জরুরি নয় মিঠু। তোমার সঙ্গে যাওয়াটা জরুরি, এখনও তুমি ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছ।
—এসো তবে, এসো না!
কস্তুরী দরজার দিকে মুখ করে বসে ছিলেন। তাঁর পায়ের কাছে কাজল। শালপাতাগুলো সব জড়ো করছে। দেখলেন মিঠু উঠে আসছে, তার সঙ্গে— বাপ রে এ যে স্বয়ং দেবী অম্বিকা। তাঁকে কি বর দান করতে আসছেন? মা ভৈঃ, পারবে, পাবে! এই জাতীয় কোনও বর?
বিস্ময়ে তিনি প্রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। মিঠু এসে মেঝেতে বসে পড়ল। মেয়েটিকে দেখে কাজল বলে উঠল, শিখরিণী! তুমি এখানে?
শিখরিণী কড়া চোখে কাজলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি না মৈত্রীর বন্ধু! ওকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছ, ও যদি গাড়ির ধাক্কা খেত, যদি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যেত … যদি …
কস্তুরী বললেন— সেকী! মৈত্রী!
হঠাৎ শরীরটা কেমন করে উঠল দিদি, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
মাইন্ড করব কী! আমি কি পাগল? এসো তো!
তিনি ওর মাথায় হাত দিলেন। —এঃ চটচট করছে যে!
হেসে মিঠু বলল, এই যে আমার বন্ধু শিখরিণী, ও ঠান্ডা জল না পেয়ে, কোল্ড ড্রিঙ্কস ঢেলেছে আমার মাথায়।
—দাঁড়াও। তখনই কলঘর থেকে জল নিয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে তার মাথা, কপাল, ঘাড় সব মুছে দিলেন কস্তুরী। মিঠু চেষ্টা করেছিল ওঁকে নিরস্ত করতে। পারেনি।
নিজের কোলের ওপর ওর মাথাটা রেখে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন কস্তুরী। প্রতিরোধহীন, মিঠু বসে থাকল ওইভাবে!
খুব খানিকটা আদর খেয়ে নিলি, হ্যাঁ! —কাজল মুচকি হেসে বলল।
শিখরিণী বলল, হ্যাঁ। তোমার যখন দরকার হবে, তখন তোমাকেও দেখব। কত আদর-যত্ন লাগে।
আমার প্রয়োজন খুব অল্প— কাজল অনমনীয়।
আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। তুমি বীরপুরুষ, মৈত্রী একটু ভাল বোধ করছ?
মাথা হেলিয়ে জবার দিল মিঠু। তার মাথা এখনও কস্তুরীর কোলের ওপর। খুব নরম গদির মতো কোলটা। শাড়ি থেকে খুব শুভ্র একটা আভা আর সুগন্ধ তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে। মিঠু চোখ বুজল।
—কাজল তুমি এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও। কস্তুরী বললেন—
ও শিখরিণী, মিঠুর বন্ধু। খুব, মানে প্রাণের বন্ধু।
সে তো শুনলুম।, আর …
শিখরিণী বলল, আমি আর মৈত্রী এক ইউনিভার্সিটিতে পড়তুম দিদি। ও তুলনামূলক সাহিত্য মানে কমপ্যারেটিভ লিটারেচার, আমি বাংলা। সেই থেকে ভাব। ওর সঙ্গে আসলে আমার মতামতের মিল আছে। এখানে তো আমি মামার বাড়ি থাকি এখন। কলেজে পার্ট-টাইম পড়াই।
—কোন কলেজ?
—মুরলীধর।
—মুরুলিধর? তবে তো তুমি আমার বন্ধু।
—আমি এমনিই আপনার বন্ধু হতে পারি, মুরলীধরের সঙ্গে সম্পর্ক কী?
—আমি যে ছুটবেলায় মুরুলিধর স্কুলে পড়েচি।
কাজল বলল, উনি কস্তুরীবেন। কস্তুরী মেহতা। গুজরাতে থাকেন। সমাজসেবিকা। এখানেও সমাজসেবা করবার জন্য এসেছেন, দেখছ না মিঠুরূপ সমাজকে উনি কীরকম সেবা করছেন!
এবার মিঠু মাথা তুলে একটা মুঠো তুলে কাজলকে দ্যাখাল। তারপর সোজা হয়ে বসল।
ফিলিং ওয়েল?
শিখরিণী বলল, এরকম রুড বন্ধু হলে ভাল না হয়ে উপায় কী?
কস্তুরী এবার উঠে টেবিলের ওপর থেকে চ্যাঙারি-ভরতি কচুরি, ভাঁড়ে আলুর দম নিয়ে এলেন।
—স্যরি শিখরিণী, তুমাদের এই চ্যাংড়াতেই খেতে হবে।
—তাতে কী হয়েছে?
শিখরিণী তক্ষুনি উঠে শালপাতা আলাদা করে সাজাতে লাগল খাবারগুলো।
—না না। আমরা— আমি আর কাজল খেয়েচি। তুমাদের দু’জন বাকি আচে।
কাজল বলল, আমরা কি আজকে যাচ্ছি, দিদি?
—শিয়োর, আমার না গেলে চলবে না। মৈত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমরা যাব।
—না, না, আমি যাব দিদি। আমি কখনও স্বাধীনতা-সংগ্রামী দেখিনি।
—ওর্কম ততো নন ইনি, তবে হ্যাঁ জেল খেটেচেন, কুইট ইন্ডিয়া করেচেন।
—আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? —শিখরিণী জিজ্ঞেস করল।
কাজল বলল, শিকদারবাগান, রবিপ্রসাদ বর্মনের বাড়ি!
—শিকদারবাগান? আমিই তো আপনাদের পৌঁছে দিতে পারি। আমার মামার বাড়ি হাতিবাগান গ্রে-স্ট্রিট। ওদিকেই তো যাচ্ছি। কস্তুরীদি, আপনার যদি অসুবিধে না থাকে আমিও স্বাধীনতা-সংগ্রামী দেখে আসতে পারি।
কাজল বলল— আমরা তো রেন্টাল গাড়ির ব্যবস্থা করছিলাম দিদি।
—আমার গাড়িতে যেতে কোনও আপত্তি আছে? আমরা বরং গাড়িতে যাই। তুমি পেছন পেছন মেট্রোয় এসো, এখান থেকে অটোয় কালীঘাট যাবে। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে নামবে, তারপর … কলুটোলা পার হয়ে, কলেজ স্ট্রিট থেকে ট্রাম নেবে। চমৎকার পৌঁছে যাবে।
কস্তুরী হাসতে লাগলেন— যেকর্ম একটা জার্নি বললে শিখরিণী, তাতে ও বেচারার আর এবার ফ্রিডম ফাইটার দেখা হল না।
—আমি গাড়িটা পুরো এবেলার জন্য পেয়েছি দিদি। কোনও ভাবনা নেই। আসলে আমি কলেজ আসি তো, পার্ট-টাইম; এগারোটায় আজ আমার ক্লাস শেষ।
সামনে কাজল, পেছনে তিনজন— পুরনো অ্যামবাসাডর, ভালই ধরে গেল।
—তুমার পার্ট-টাইম কেন শিখরিণী! সময় পাচ্ছে না?
—আরে আর বলবেন না। এখন তো কলেজের চাকরির জন্য নেট স্লেট পরীক্ষা চালু করেছে কলেজ সার্ভিস কমিশন, স্কুলের চাকরির জন্য আছে স্কুল সার্ভিস কমিশন। কখনও পাশ করবেন, কখনও করবেন না। কেন, এসব প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। তার ওপরে আবার সব জায়গায় এস.সি-এস.টি সংরক্ষণ। হাজারে হাজারে পোস্ট খালি পড়ে রয়েছে। এস.সি-এস.টি পাওয়া যাচ্ছে না। পোস্টগুলোকে ফাঁকা কর! তা নয়, পড়েই রয়েছে। ভাল না! সরকারকে মাইনে দিতে হচ্ছে না। স্যরি কাজল, হঠাৎ থেমে গেল শিখরিণী, সে মিঠুর কাছ থেকে একটা চিমটি খেয়েছে।
আমাকেই শুধু দুঃখিত হতে হবে কেন— তোমরা দুঃখিত নয়, যে স্বাধীনতার ছাপ্পান্ন বছর পরেও উপযুক্ত এস.সি, এস.টি পাওয়া যায় না! কাজলের গলায় ঝাঁঝ নেই, খুব নির্লিপ্ত প্রশ্ন।
একটু পরে সে বলল, সংরক্ষণের একটা নীতি থাকা উচিত। স্পষ্ট নীতি। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এসব পড়ার ক্ষেত্রে। সংরক্ষণ খুব বিপজ্জনক, গ্রেস দিয়ে তো ডাক্তারি পাস করানো যায় না। কিন্তু সকলের জন্য যে মিনিমাম শিক্ষা এখনও চালু হল না তার কী কৈফিয়ত?
শিখরিণী বলল, অফিসের নিচুতলার চাকরিতে সংরক্ষণ থাক। কিন্তু স্কুল-কলেজে পড়াতে হলে উপযুক্ত প্রতিযোগিতা করে আসাই উচিত, তুমি যাই বলো কাজল।
—তার পরেও আমার প্রশ্নটা একই থাকে— স্বাধীনতার এত বছর পরেও সকলের জন্য মিনিমাম শিক্ষা কেন চালু হল না!
কস্তুরী বললেন— মিনিমাম শিক্ষা বলতে তুমরা কী বুঝো জানি না। আমি মনে করি— কারু জন্যেই মিনিমাম শিক্ষা চালু হোয়নি। কী শিখে? ডিসিপ্লিন? নিজেরটা নিজে করে নেওয়া! অন্যকে সাহায্য করা! হিউম্যান ভ্যালুজ কিছু শিখছে, কেউ? যে শিখে সে আপনি শিখে। কাউকে শিখানো হয় না, ব্যবস্থা নাই। সহবত নাই, কনসিডারেশন নাই, রেসপেক্ট নাই, সংযম নাই, খালি লোভ, খালি জিনিস, জিনিসের পিছন ছুটতে শিখাচ্ছে। আর হোতাশায়, ডেসপ্যারেশন, ডাকাত চোর আত্মহত্যা।
রবিপ্রসাদ বর্মনের বাড়ির সামনে এসে শিখরিণী বলল, এ বাড়ি আমি চিনি। বর্মন বাড়ির একটি মেয়ের সঙ্গে আমার ছোটবেলায় খুব আলাপ ছিল। ওরই কি দাদু? রবিপ্রসাদ বৰ্মন? নামটা তো আমি শুনিনি। তবে একজন বুড়ো মানুষ এখানে থাকেন আমি জানি। অঙ্গনাদের দাদু, কি কী, আমি জানি না।
বাড়িটার সামনে এসে কাজল বলল, দিদি আপনি যান। আমরা ঘণ্টা খানেক পরে এসে ফ্রিডম-ফাইটার দেখব।
—না না তুমরা এসো না!
ওরা কিছুতেই এল না।
কস্তুরী সত্যি বলতে কি স্বস্তিই পেলেন। ছেলেমেয়েগুলির বিবেচনার প্রশংসা করলেন মনে মনে। এখন তিনি একা এবং অদূরে তাঁর অতীত। মোকাবিলা করতে যাচ্ছেন। মাঝখানে সময়ের সমুদ্র। তিনি জানেন না সেই সমুদ্রে ভাসতে জাহাজ লাগবে না নৌকো কি ভেলাই যথেষ্ট।
বাড়িটা বেশ পুরনো হলেও শক্তপোক্ত। লাল ইটের বাড়ি। মার্কামারা ব্রিটিশ সময়ের গাঁথিনি। সবুজ জানলা। সবুজ দরজা। একটা ছোট প্যাসেজ দিয়ে উঠোনে পড়লেন কস্তুরী। বড় বড় দরজা খোলাই ছিল।
উলটো দিকের ঘর থেকে এক বৃদ্ধ মানুষ বেরিয়ে এলেন। সাদা ফতুয়া, ধুতি, ভুরুগুলো পাকা। চোখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। একহারা মানুষটি, বেশ মজবুত।
গলাটা একটু তুলে কস্তুরী বললেন, এখানে কি রবিপ্রসাদ বর্মন থাকছেন?
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, আমিই। আপনাকে তো ঠিক…
আমি কস্তুরী মেহতা, কিকি, জ্যাঠামশায়। —উনি নিচু হয়ে প্রণাম করলেন। এত সহজে অতীতের মুখোমুখি হওয়া যাবে তিনি ভাবতে পারেননি। অজিতমোহন অন্য লোকে গিয়ে বসে আছেন। নিবেদিতা মাসির মধ্যে অতীতকে পাওয়া গেল, তবু আসল কেন্দ্রীয় প্রশ্নের উত্তর মিলল না। স্নেহকাকিমা এতদিন, সাতাশি বছর বেঁচে রইলেন। কিকির জন্য আর দু’এক মাস থাকতে পারলেন না। সব সময়েই তাই মনে হয় ফসকে গেল। বুঝি ফসকে গেল।
কিকি! কিকি! তুমি এখানে, এতদিন পরে … ভদ্রলোক বিস্ময়ে আনন্দে দিশাহারা হয়ে গেলেন।
একটু সামলে বললেন, যাক, একেবারে চলে যাবার আগে এমন কারও সঙ্গে দেখা হল যার সঙ্গে কথা বলা যায়। এসো মা। এসো এসো।
এটাই ওঁর ঘর। বেশ বড়। একদিকে শোবার খাট। আর একদিকে টেবিল চেয়ার। মাঝখানে দুটো মুখোমুখি সোফা। মনে হয় এগুলো যেন নতুন যোগ হয়েছে। কোণে টেলিফোন, তার পাশে আলমারি।
বুঝলে কিকি— এদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। নোবডি নোজ এনিথিং। কেউ কথা বলতে জানে না। আক্ষেপে ফেটে পড়লেন রবি জ্যাঠামশায়। বৃদ্ধদের সেই চিরন্তন আক্ষেপ। ভুরু কুঁচকে বললেন— কী বিষয়ে কথা বলবে! জীবন সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে? জগৎ সম্পর্কে? এসব নিয়ে কখনও কিছু ভেবেছে? জিজ্ঞেস করলে বলে— দাদামশায়, বই লিখুন না, এখন আর মুখে মুখে ফিলসফি কেউ মানে চর্চা করে না। আরে বাবা, ফিলসফি কে চেয়েছে তোদের থেকে? ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোতেই চান্স পাচ্ছিস। ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছে নেই। তবু তাইতেই ঢুকছে। ডাক্তারিতে এসট্যাবলিশ হতে সময় লাগে। তা ছাড়া ঝামেলা আছে। ডাক্তার পিটোচ্ছে, প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিচ্ছে। আরে বাবা, অন্যায় করছিস তাই পিটছে। ভাল করে দরদ দিয়ে চিকিৎসা কর, মাথায় করে রেখে দেবে, তা না, দ্যাখাতে যাও চেম্বারে বসেই আছি, বসেই আছি। আরে আমার পরে এসে তিনটে টাই-পরা যুবক ছেলে ঢুকে গেল, হাতে ওই ব্রিফকেস। একেক জন কুড়ি মিনিট আধঘণ্টা নিচ্ছে। এ কী অন্যাই! কমপ্লেন করি, বলে কি ওরা নাকি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। বোঝো! রুগি বসে আছে ঘর ভরতি। আমার মতো বুড়ো মানুষ, তা ছাড়া হয়তো কারও জ্বর, মাথা ঘুরছে, কারও বা পেটের যনতন্না। সব বসানো রইল, দেড় ঘণ্টা ধরে দেনা-পাওনার মিটিং হচ্ছে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে। পিটুনি এরা খাবে না তো কে খাবে!
হঠাৎ ওঁর চৈতন্য হয়— এ হে হে, দ্যাখো তো তোমাকে বসিয়ে রেখেছি। বক বক বক। আমার ছেলেরা বলে— বাবা, এবার আপনাকে দেখলে লোকে পালাবে।— খুব হাসলেন উনি।— তা কিকি, কত বড়টা হয়ে গেছ মা। দেখতে দেখতে কত দিন কেটে গেল। সেই ছোট্ট কিকি, কোলে কুকুর নিয়ে ঘুরত, কাঁখে পুতুল।— নাঃ আমি ভাবতে পারছি না। চেনা যায় না। তবে নরেন্দ্রর মুখের আদলটা— হ্যাঁ এইবারে ধরতে পেরেছি। রংটা, চুলের ধরন, জ্বলজ্বলে চোখ দু’টি। সে কেমন আছে?
তিনি শান্তি পেয়েছেন জেঠু। আমার মা কোথায়, আপনার কাছে কোনও খবর আছে? —কস্তুরী আর ভণিতা করতে পারছেন না।
একদম চুপ করে গেলেন বৃদ্ধ মানুষটি। অনেকক্ষণ পরে বললেন, কেন জানতে চাও কিকি? জানলে যদি কষ্ট পাও!
—কষ্ট পাব না। কষ্ট সহ্য করা আমার অভ্যাস আচে। আপনি বলুন।
—সে যে আমাকে সত্যবদ্ধ করে গেছে মা! তা ছাড়া দরকারই বা কী! সে তো তোমার সত্যি মা নয়?
—নয়?
—না, সৎমা যাকে বলে। তুমি নরেন্দ্র ভাইয়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে। তোমার বাবার খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। উনি তো আন্দোলন করতে কলকাতায় চলে এলেন। এখানে নরেন্দ্র কল্যাণীকে বিয়ে করলেন, মাঝেমাঝে দেশে যেতেন। কী জানো, সে আগুনের মেয়ে, যখন জানল আগের বিয়ের কথা নরেন্দ্র গোপন করেছেন, ক্ষমা করেনি। তারপর তোমার মা আমদাবাদে তোমার জন্মের সময়েই মারা গেলেন। কল্যাণীর জেদেই তুমি এখানে এলে মা। ছোট্ট এতটুকুনি পুতুলের মতো মেয়ে। তখনও কথা বলতে শেখোনি।
—তা হলে যাঁকে সৎ মা বলছেন, তিনিই তো আমার মা। বাবার যে আর একটা বিয়ে ছিল বাবা আমাকে বলেছিলেন, কিন্তু আমি যে তাঁর মেয়ে একথা বাবা কখনও বলেননি। আপনারা ঠিক জানেন না। আমি এই মায়েরই মেয়ে।
—বেশ মা। তাই। তুমি যা ভেবে শান্তি পাও। হয়তো তুমি শক পাবে বলেই নরেন্দ্র বলেনি। আর … কিকি … হয়তো … হয়তো তুমি নিজের মেয়ে নয় বলেই সে তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিল। ওভাবে কেউ যায়?…কোথায়? আমি ঠিকঠাক জানি না। তবে নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে সে আর সুধা এখন মেদনিপুরের কোন গ্রামে সেটল করেছে শুনি।
মাঝিহিড়া?
না না, ওরকম অদ্ভুত নাম তো নয়! ট্রাইবাল বেল্টেই বোধহয়। কিকি, ছেড়ে দাও মা। যে গেছে তাকে যেতে দেওয়াই ভাল। তার বয়সও কি কম হল? পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর! হ্যাঁ … তা হবে। তার বেশিও হতে পারে…। আমারই তো হল নব্বুই কমপ্লিট।
কাজল, মিঠু আর শিখরিণী যখন এক ঘণ্টা পরে ঘুরে এল, বাড়ির ভেতর থেকে চিড়ে-বাদামভাজা চা সন্দেশ এসে গেল। রবিপ্রসাদ বর্মনের পুত্রবধূ নিয়ে এলেন সব, তাঁর এক পুত্রবধূর সঙ্গে। খাওয়াদাওয়া হতে লাগল। কস্তুরী এদের সঙ্গে রবিপ্রসাদ ও তাঁর বাড়ির লোকেদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রসিকতা, পুরনো দিনের বহু কথা গল্প করতে লাগলেন রবিপ্রসাদ। তাঁকে চট করে থামানো যায় না। রাসবিহারী বসু পুলিশ এড়াতে কীভাবে জমাদার সেজে মলভাণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সুভাষচন্দ্র কীভাবে আফগানের ছদ্মবেশ ধরেছিলেন, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’তে কীভাবে সুভাষের ছায়া পড়েছিল, বন্দেমাতরম জাতীয় সংগীত করা নিয়ে কত পলিটিকস হয়েছিল, জিন্না সাহেব কংগ্রেসের নেতাদের কাছ থেকে, বিশেষত মহাত্মাজির কাছে গুরুত্ব না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লিগে যোগ দিলেন, তারপরে পাকিস্তানের জিগির তুললেন, তাঁর সাহেবি পোশাক-আশাককে মহাত্মাজি কীভাবে উপহাস করতেন। একবার গোসলখানা থেকে জিন্না সাহেবের জন্য কুরসি আনতে বলেছিলেন তাঁর আশ্রমে চেয়ারের ব্যবহার ছিল না বলে, সুইজারল্যান্ডে কমলা নেহরুর মৃত্যুশয্যায় সুভাষ কীভাবে তাঁর ও জেনিভাতে বিঠলভাই প্যাটেলের সেবা করেছিলেন। বিঠলভাইয়ের নাম আজ কেউ জানে না, তিনি বল্লভভাইয়ের বড় ভাই ছিলেন, প্রকৃতই উদার স্বভাবের, কীভাবে সুভাষের বিদেশি প্রচারের জন্য উইল করা তাঁর একলাখ টাকা থেকে ট্রাস্টিরা পলিটিকস করে সুভাষকে বঞ্চিত করেছিল, সরোজিনী নাইডু কীরকম চোখা চোখা কথা বলতেন, ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরও কীভাবে সেই মন্ত্রীসভা আন্দামানের বন্দিদের মুক্ত করেনি, কেন ফজলুল হক লিগে যোগ দিলেন— এরকম অজস্র কথা দাঁড়ি-কমাহীন বলে যেতে লাগলেন। তাঁর পুত্রবধূ ও তাঁর পুত্রবধূ মুখ টিপে মুচকি হেসে চলে গেলেন, ওঁর এক নাতি এসে বলল, ওঃ দাদু, তুমি একটু থামবে, এইসব ইয়াং ছেলেমেয়েরা কী জানে! উনি বললেন, জানা উচিত, নাতি বললেন এইটুকু সময়ের মধ্যে এত আয়ত্ত করা যায় নাকি! ওরা বলল, না না। আমাদের ভাল লাগছে। কাজল বলল, আমি ইতিহাসের ছাত্র। আমার খুব ইনটারেস্টিং লাগছে, তাতে রবিপ্রসাদ উৎসাহিত হয়ে আরও বলতে লাগলেন, আরও আরও, কিন্তু মিঠু, কাজল এমনকি শিখরিণী পর্যন্ত অনুভব করল— পরিবেশের মধ্যে কোথাও অন্ধকার, কোথাও বেসুর এবং স্বভাব-স্নেহশীলা চটপটে ম্যাডাম চুপচাপ। গম্ভীর, অন্যমনা, নেই তাঁর প্রতিদিনকার কৌতুক, উৎসাহ, কস্তুরীবেন যেন এক ঘণ্টার মধ্যে আমূল পালটে গেছেন।
শিখরিণী নিজের বাড়ি অর্থাৎ মামার বাড়ি চলে গেল। যাবার সময়ে বলল, দিদি, যদি আমায় কোনও দরকার লাগে ডাকবেন প্লিজ। আমার আজকের দিনটা মনে থাকবে। মানিকতলায় নেমে গেল কাজল, নামবার সময়ে মিঠুর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল। তারপর ট্যাক্সি ছুটল পুরনো মারহাট্টা ডিচের ইতিহাসের ওপর দিয়ে মৌলালিতে বাঁক নিয়ে, আমির আলি অ্যাভেনিউ দিয়ে গোলপার্কের দিকে।
মিঠু খুব সন্তর্পণে বলল, দিদি আপনি কি খুব ক্লান্ত? আমি আপনার সঙ্গে থাকি একটু।
উনি তার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললেন, সের্কম কিচু না, তুমি আসচ না। স্ট্রেট বাড়ি যাবে।
তিনের একে নামবার সময়ে উনি পুরো ট্যাক্সি ভাড়াটা দিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ মিঠুর কপালে একটু হালকা চুমু খেলেন। বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে, মিঠু দেখল ওঁর হাত, ওঁর ঠোঁট সব ঠান্ডা।