উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : পঞ্চম পর্ব
গর্তের মধ্যে পড়ে প্রচণ্ড লাফিয়ে উঠল গাড়ি। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যাত্রা শুরুর সময়ে মেঘে-ছাওয়া ছিল আকাশ। কিন্তু এমন বৃষ্টি হবে ড্রাইভারজিও ভাবতে পারেননি। না হলে হয়তো একটা দিন থেকে আসতেই হত।
চান্ডিল থানার ছোট্ট গ্রাম নিমডিতে যাচ্ছি আমরা। রাস্তা খুব খারাপ, আশেপাশে কিছু নেই, খালি ধুধু লাল ডাঙায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কিছু গাছ। গর্ত এড়াবার প্রাণপণ চেষ্টায় এক এক সময় গাড়ি একদিকে বিশ্রীভাবে হেলে যাচ্ছে। শিখরিণী পড়ছে আমার গায়ে, আমি নিজেকে প্রাণপণে সামলাচ্ছি, পাছে দিদির ঘাড়ে পড়ে যাই। সবসময়ে যে সামলাতে পারছি তা-ও না। কাজল যেহেতু সামনে বসেছে ওর কোনও হেলদোল নেই। দু’পাশ থেকে ছিটকে উঠছে কাদা। গাড়ির কাচ বন্ধ করে আমরা ঘামছি।
আপনি ঠিক যাচ্ছেন তো ড্রাইভারজি! কাজল জিজ্ঞেস করল।
ঠিকই তো! চিনা জায়গা।— বলে বেশ নিশ্চিন্তে স্টিয়ারিংয়ের ওপর হাত রাখেন অর্জন সিং।
এসব ফাঁকা জায়গায় বাজ পড়লে খুব বিপদ! কাজল আরও নিশ্চিন্ত গলায় বলল।
কস্তুরীবেন বসে আছেন একদম নিশ্চুপ। তিনি কিছু শুনছেন, গাড়ির লাফানি টের পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। একবার আমাকে বললেন, তুমি তো মাউন্টেনিয়ারিং করেছ দিদিমোণি। দার্জিলিং থেকে সন্দকফু ট্রেকিং। তুমি কেন ঘাবড়াচ্ছো?
আমি ঘাবড়াইনি দিদি, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আমার কুনও কোষ্ট নাই। তুমি ওতো এমব্যারাস্ড হচ্ছো কেন? ঠেসো, যত খুশি ঠেসো আমাকে। কিচ্ছু হোবে না। দিদি ট্রেকিং না পারে, পাহাড় চড়া না পারে, কিন্তু দুবলা নোয়, স্ট্যামিনা আচে।
বাগমুন্ডি থেকে উনি আমাদের দু’জনকে ফিরে যেতে বলছিলেন।
ওনেক অ্যাডভেঞ্চার তো হল, এবার অগাস্ট গরম, বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা ভাল নোয়। তুমরা ফিরে যাও। কাজলও ফিরে যেতে পারে।
কাজল কোনও মন্তব্যই করেনি। কোনও জোরজার, যুক্তি দেখানো কিচ্ছু না। খুব পরিষ্কার যে সে তার দায়িত্ব পালন করবেই। শিখরিণীর বোধহয় ফেরবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি ফিরছি না বলে ও-ও ফিরবে না। হয়তো বাধোবাধো ঠেকছে। কিংবা হয়তো অন্য কোনও কারণ আছে। যাক, স্পেকুলেট করে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি, দায়িত্ব আছে বলে, আবার ভাল লাগছে বলেও। কত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হল। সাধারণত আমি যখনই বেরোই একটা ডায়েরি রাখি। এবারেও রেখেছি। তবে মাধব সিং মুণ্ডার উচ্চারণ বুঝতে আমার একটু অসুবিধে হয়েছে। পরে কাজলকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। উনি আবার ভাল ভাল শব্দ ব্যবহার করছিলেন, মাঝখানে মাঝখানে স্থানীয় উচ্চারণে ক্রিয়াপদ। আমাদের কথা ভেবেই বোধহয় আবার কখনও কখনও উচ্চারণটা শুদ্ধ করবার চেষ্টা করছিলেন। হইয়্যাঁ আবার হয়ে। একটা অনুনাসিক টান আছে। খুব অদ্ভুত লাগছিল। গ্রাম, গাছপালা, স্থানীয় মানুষ, ছো নাচ সব কিছু মিলিয়ে খুব চমৎকার মানিয়ে গিয়েছিল এই অনুনাসিকতা। আমি ছৌ আগে দেখেছি, কিন্তু সে শহুরে আবহাওয়ায়, খুব জাঁকজমকের মধ্যে। এরকম বৃষ্টিহীন ভাদুরে সন্ধ্যার ফিকে আকাশের তলায়, হ্যাজাকের আলোয় নয়। আলো পড়ে মুখোশের ঘামতেল জ্বলজ্বল করছিল। তাইই, এখন মনে করে দেখলুম শেষের পালাটাতে অসুরকেই প্রধান করে দেখাল। জনা দশেক সঙ্গী-সাথী, কালো মুখোশে সাদা চোখ লাল ঠোঁট। তামাটে বাবরি চুল, ওদের হাতে ছিল বল্লম, কাঁধে ধনুক, বাণ। আরও জনা দশেক ছিল— সাদা মুখোশ, কালো চুল, লাল ঠোঁট। তার মানে কালোরা হচ্ছে অসুর বা হড় জাতি, যারা মহেঞ্জোদড়ো থেকে সরতে সরতে মেদিনীপুর পর্যন্ত এসেছে। এরপর কোথায় যাবে জানে না। আর সাদারা হচ্ছে সুর বা আর্য জাতি। দুর্গার মুখোশ সবচেয়ে সুন্দর। চাঁপা রঙের মুখোশ। কুঁচি কুঁচি চুল। টানা টানা চোখ, ভ্রূ। হাতে একটা ছোট ঢাল আর বল্লম ছিল ঠিকই। কিন্তু দুর্গা দুই দলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে যেন খেলাখেলা লড়াই করছিলেন। অন্যদের লড়াইয়ের প্রচণ্ডতা নেই। তা হলে এ সবই সেই আর্যকুমারীর ছলনা।।
দুর্গা-অসুরের এই সাঁওতালি মিথ আমাকে স্তম্ভিত করেছে। এক পক্ষের কাছে যিনি দেবী, অন্য পক্ষের কাছে তিনি মায়াবিনী! এক পক্ষের কাছে যিনি বীর, অন্য পক্ষের কাছে তিনি দস্যু। এই ‘মোহিনী’ ব্যাপারটা তো আরও আছে আমাদের পুরাণে। শিখরিণীকে বললাম। ও এসব ভাল জানে। ও বলল, সুন্দ-উপসুন্দর গল্পেও তো এমনই তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করলেন দেবতারা! আর শুম্ভ নিশুম্ভ জানিস তো? কৌশিকী নামে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী বা চণ্ডিকা সৃষ্টি হল। তবে এবারে ওদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয়। যুদ্ধে হারলে তবে কৌশিকীকে পাবে এই শর্ত হয়েছিল। কৌশিকী-চণ্ডীই ওদের মারেন। প্রতিবারেই মোহিনী নারীর দরকার পড়েছে, আর দেবতারা তাকে বানিয়ে নিয়েছেন। এমনকী অমৃত ভাগের সময়েও অসুরকে কী অন্যায়ভাবে ঠকাল দেখ দেবতারা! বিষ্ণু নিজে ‘মোহিনী’ সেজে অসুরদের মোহিত করে অমৃতের বাটি সরিয়ে নিলেন! অথচ দুই পক্ষ মিলেই সমুদ্র মন্থন করেছিল। তবে কী জানো মিঠু! পুরাণের অসুর— অশুভ শক্তির প্রতীক, আর দেবতা— শুভ শক্তির।
কিন্তু প্রতীক হলেও তো তাকে এথিকস্টা মানতে হবে!— আমি বলি। আসলে আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম— আমরা কে? হুদুড় দুর্গাদের? না অভয়া বরদা মহিষাসুরমর্দিনীর। যিনি অতুল রূপলাবণ্যের সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রত্যেক দেবতার কাছ থেকে অস্ত্র-শস্ত্রও পেয়েছিলেন।
দেবতারা অমৃতভাণ্ড চুরি করে নিয়েছিলেন, সেই থেকে অসুররা হাঁড়িয়া খাচ্ছে। এই আর কী! নাকের বদলে নরুন।— সামনের সিট থেকে কাজল বলল। তার গলায় সামান্য হাসির ছোঁয়া।
আমি বললাম— তুই এই সাঁওতালি মিথটা জানতিস?— আমার খুব কৌতূহল হচ্ছিল জানতে যে ও জানে কিনা।
না। এখন জানলাম।
তা হলে তুই কীসের গবেষণা করছিস?
সামহাউ ওটা আমি মিস করে গেছি।
ছৌ তো আরও দেখেছিস, এই পালাটা দেখেছিস?
নাঃ! এই প্রথম। আমি এতদিন তেমন ফিল্ড-ওয়ার্ক করিনি মিঠু। স্যরি। ভেরি স্যরি।
মা, বাঁদিক বরাবর রেললাইন গেছে। ওই দেখুন দূরে ট্রেন যাচ্ছে। আদ্রা-চক্রধরপুর ধরে এলে আপনাদের আর এত কষ্ট করতে হত না। অর্জুন সিং বললেন।
আমরা তো কলকাতা থেকে সোজা আসিনি, কাজল বলল— ঘুরতে ঘুরতে এসেছি।
এবার আমরা একেবারে মাটির রাস্তা দিয়ে যাব— সতর্ক করলেন অর্জুন সিং। আর বলতে না বলতেই গাড়িটা ঝপাং করে একটা গাড্ডায় পড়ে গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে, জানলার কাচ খুলেছিলাম, একগাদা কাদাজল ছিটকে এসে শিখরিণী আর আমাকে ভিজিয়ে দিল। এমা!! শিখরিণী প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী!
কাজল তার অবস্থা দেখে বলল— দিদি তো বলেইছিলেন— তোরা ফিরে যা। দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার— সে অ্যাডভেঞ্চার কি আর শখের অ্যাডভেঞ্চার থাকে শেষ পর্যন্ত?
কিন্তু গাড়ি চলছে না। গাড়া থেকে তুলতে হবে। আমাদের দিকটাই কাত হয়েছে। কাজল লাফ মেরে নামল। অর্জুন সিংও কাজলের পেছন পেছন। দু’জনেই কাদা-মাখা।
এ দু’জনের কাজ নয়। —কাজল বলল। তারপর ওরা দু’জনে পরস্পর কী আলোচনা করে সামনের দিকে এগোতে থাকল। মেঘে-ঢাকা সাদাটে আকাশের তলা দিয়ে ওরা ছোট হতে হতে একটা বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি বললাম, আমরাও একটু নামতে পারলে ভাল হত।
শিখরিণী রাগ করে বলল, আমাদের আর নামতে হবে না। গাড়ি তো অর্ধেকটা নামিয়েই দিয়েছে, বাকিটুকুও দেবে।
দিদির দিকটা উঠে আছে। উনি খুব অসুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
মিনিট দশেক এইভাবে কেটেছে। হঠাৎ দেখি আমাদের গাড়ি ঘিরে এক গাদা ছেলে। প্যান্ট গুটিয়ে পরা, পায়ে গামবুট। সবজে মতো জামা, হাতে সরু সরু বন্দুক না কী! স্থানীয় ছেলেই হবে মনে হয়।
—কে আপনারা?
—কোথায় যাচ্ছেন?
—কোথা থেকে এসেছেন?
—ড্রাইভার কোথায়?
একটার পর একটা বুলেটের মতো প্রশ্ন ছুটে আসছে। শিখরিণী ভয়ে কাঁপছে। দিদি বললেন, তুমরা কে? কোথায় যাচ্ছো? কোথা থেকে এসেচো?
কথার উত্তর দিন। কঠিন গলায় নির্দেশ এল।
—নিমডি যাব— আমি বলি।
—এটাই তো নিমডি!
—একানে কি কুনও সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার আচে? দিদি বললেন।
—তাতে আপনার দরকার?
—আমরা সেকানে যাবো। গাড্ডায় পড়েচি। গাড়িটা তুলে দিলে যেতে পারবো— দিদি অমায়িকভাবে বললেন।
হঠাৎ একটি ছেলে দরজা খুলে তড়াক করে লাফিয়ে গাড়িতে উঠল। শিখরিণী আঁক করে উঠেছে।
এই চোপ— ছেলেটি রাগত চোখে পেছন ফিরে বলল।
শিখরিণী আমার হাত দুটো এমন খামচে ধরেছে যে আমার রীতিমতো লাগছে। ওর হাত সাপের গায়ের মতো ঠান্ডা। আমি প্রাণপণে আমার তাপ থেকে ওকে ধার দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিপদে পড়লে আমার শরীর দিয়ে হলকা ছোটে। চরম সর্বনাশের জন্য আমরা প্রস্তুত। অন্ততপক্ষে আমি। এরকমই হয়। জীবনটা এক গিয়ারে চলেছে। তিরিশ-চল্লিশ সাবধানী স্পিড রেখে যাচ্ছে। হঠাৎ কিছুর মধ্যে কিছু না স্পিড বেড়ে গেল। ষাট সত্তর আশি নব্বই শ’ একশ চল্লিশ ক্র্যাশশ্।
বাবা, তুমি হয়তো কাগজে পড়বে পুরুলিয়া জেলার নিমডি গ্রামের রাস্তায় দু’টি তরুণী ও একজন প্রৌঢ়ার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সম্ভবত খুন হবার আগে এঁরা প্রত্যেকেই ধর্ষিত হয়েছিলেন। বডি পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। রুটিন খবর। তুমি আজকাল এইরকম খবর পড়তে চাও না। তবু বাবা, এইটুকু যদি পড়ে ফেলো, হয়তো তোমার চোখে পড়বে নীচে তিনটে ছাপকা ছাপকা ছবি। তুমি সেভাবে আমাকে আইডেন্টিফাই করতে পারবে না, কেননা বন্দুকের গুলিতে, বাঁটে, ছুরি দিয়ে ওরা আমাদের মুখ তো ফালাফালাই করে দেবে। আরও কিছু! হয়তো যোনিদ্বারে গুলি করবে ধর্ষণের প্রমাণ লোপ করতে। মণিপুরে জওয়ানরা মনোরমাকে যেমন করেছিল। আমি জানি না এরা কারা। কিন্তু যে-কোনও দলের হাতে মেয়েদের এখন এই-ই নিয়তি! তাই প্রস্তুত হচ্ছি। এই কাদাজল এবড়ো-খেবড়ো মাটির ওপর দিয়ে ওরা টানতে টানতে আমাদের নিয়ে যাবে। শিখরিণী, ইসস্, তোকে কত বারণ করেছিলাম, কেন এলি? আর দিদি, দিদি! সেই সুদূর উত্তর-পশ্চিমে অত প্রাণ-বাঁচাবার পর এই হতভাগ্য দক্ষিণ-পূর্বে প্রাণটা দিতে এলেন! কী খুঁজতে এসেছিলেন দিদি! কী কুক্ষণে!
হঠাৎ শুনতে পেলাম একটা গলা বলছে, আমি এস্টার্ট দিচ্ছি, তোরা জোরসে ঠ্যাল। দু’পাশেও থাক। পেছনেও যা। অনেকগুলো হ্যান্ড লাগবে।
তারপর স্টার্ট দেবার শব্দ। হড়হপন হড়হপন করে গাড়িটা গাড্ডা ছেড়ে রাস্তায় উঠে এল।
একটু শ্বাস নেওয়ার সময়। ওরা আপাতত গাড়িটাও চুরি করছে। এই জঙ্গলের মধ্যে চট করে কেউ খুঁজতে আসবে না। এলেও গ্রেনেড, ল্যান্ডমাইন সব রেডি আছে।
দিদি বললেন, ইউ হ্যাভ ডান আ গুড জব। ভাল কাজ করেচো। থ্যাঙ্কিউ। আমাদের ড্রাইভারজি আসছেন বোধহয়। হ্যাঁ ওই তো! তুমাদের আর কোষ্টো করতে হোবে না। ব্লেস ইউ বয়েজ, আশিস করছি তুমাদের।
দূর থেকেই অর্জুন সিং হেঁকে বলছেন শুনছি, কাজলবাবু, গাড়ি উঠে গেছে। উঠে গেছে। আসুন।
ছেলেগুলি বলাবলি করছিল, ওহ্, অর্জুন! অর্জুন সিং।
ওরা একটু দৌড়ে গেল। অর্জুন সিং ও কাজলের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর যেমন এসেছিল তেমনই উবে গেল আশপাশের বনবাদাড়ে।
ওরা দু’জনে গাড়িতে উঠলে দিদি বেশ খুশিখুশি গলায় বললেন— তুমরা এত দূর গেলে, চেষ্টা করলে, পারলে না। দ্যাকো আমি এইকানে বসে বসে লোক জোগাড় করে ফেললুম।
কাজল বলল, ভালই হল, ঠিকঠাক ডিরেকশনটাও পেয়ে গেলাম। এবার স্ট্রেট চলে যাব। কী রে ভয় পেয়েছিলি নাকি মিঠু, শিখরিণী? কথা বলছিস না কেন?
আমাকে আর জবাব দিতে হল না। দিদিই বললেন, ট্রেকিং করেচে দার্জিলিং থেকে সন্দকফু, মাউন্টেনিয়ারিং শিকেচে, তুমার মুন্ডু ভয় পেয়েচে।
ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু পথ। কোনওক্রমে গাড়িটা দুলতে দুলতে যাচ্ছে। অনেকগুলো বাঁক নিল। এইবার বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে কমছে বন, বাড়ছে খোলা জায়গা। একটা বিশেষ এলাকায় ঢুকছি। দিগন্তে মেঘমেঘ পাহাড়। ধানের খেত। মাঝখান দিয়ে পেটা সুরকির রাস্তা। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু জলে ছলছল করছে চারদিক। শুরু হল দু’ধারে শাল, মহুয়া, সেগুন, ছাতিম ছাওয়া পথ। দু’ধারে দুটো বিশাল অশত্থগাছের মধ্য দিয়ে আমরা ঢুকলাম। এখনও বীথিকা ফুরোয় না। কাজল হেঁকে বলল, দিদি, দেখুন দু’পাশে পলাশ, কুসুমগাছ। বসন্তকালে এই গাছগুলোতে আগুন জ্বলে। দেকোরা দলে দলে দেখতে আসে, বুঝলি মিঠু?
মোড়ের মাথায় বাঁক নিল গাড়ি। রে রে করে দু’পাশ থেকে ছুটে এল কিছু লোক। হাঁটু অবদি ধুতি পরা। চকচকে গা। ঝাঁকড়া চুল, হাতে লাঠি।
কে? কে? কোথায় যাচ্ছেন?
অর্জুন সিং মুখ বাড়িয়ে বললেন, সেন্টার।
ভোটের লোক আনোনি তো? সেবারের মতো টিভির লোক?
না না—অর্জুন সিং পেছন ফিরে আমাদের দিকে তাকালেন।— কী দিদি আপনারা টিভি-র লোক নন তো! ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন?
দিদি বললেন, কখুনোই না।
আপনি যদি ডিরেকশন সব জানতেনই আমাদের এত ভোগালেন কেন?— কাজল জিজ্ঞেস করল।
বাপ রে! মেরে ফেলে দিবে—অর্জুন সিংয়ের নিজস্ব বুলি বেরিয়ে এল। তাঁর মুখে চাপা হাসি।
দু’দিকেই টালি ছাওয়া খড়ে ছাওয়া বেশ বড় বড় কুটির। পাকা ছাদঅলা একতলা বিল্ডিংও দেখা গেল। কী অদ্ভুত এক গন্ধে ভরপুর জায়গাটা। গাছের, ফুলের, ভেজা মাটির।
দিদি থামতে বললেন অর্জুন সিংকে। তারপর কেউ কিছু বোঝবার আগেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। হাঁটছেন গটগট করে, যেন এতক্ষণ একভাবে বসে আসেননি, পা ধরে যায়নি, যেন গাড়ি গাড্ডায় পড়ে যায়নি, যেন বন্দুকের সামনে পড়তে হয়নি। আমরাও নামলাম। কাদায় ভিজে জামাকাপড়, পাঁক লেগেছে দু’জনের মুখে। হাতের তালু দিয়ে মুছে নেবার চেষ্টা করলাম। লোকগুলি পেছন পেছন আসছে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গড়গড় করে এগিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। শুধু আমরা কেন, কাজলও পেছনে পড়ে যেতে লাগল।
মেঘ ভেঙে এবার নীল আকাশ বেরিয়ে এসেছে। সেই ঝাড়গ্রাম থেকেই এই অদ্ভুত উজ্জ্বল নীলমণি আকাশ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। তবু যেন আজকের আকাশ আরও নীল। পৌরাণিক নীল। গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। দূরে পাহাড়গুলোর মাথা কমলা, গোলাপি, বেগুনি। একটা মস্ত দাওয়া-অলা কুটির। দু’পাশ থেকে ভিজে মাধবীলতা জড়ানো। মাঝখানে একটা চেয়ারে লাল পাড় গেরুয়া রঙের শাড়ি পরা ঠাকরান। বেশি পাকা কম কাঁচা চুলের চালচিত্রের মাঝখানে একটা ঝলমলে হাসিমুখ ফুটে রয়েছে।
কস্তুরীদি বললেন, মিঠু, কাজল, শিখরিণী, ওই দ্যাখো আমার মা।
আমরা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছি। দিদি এগিয়ে যাচ্ছেন, উনি দু’ হাত বাড়িয়ে বলছেন— আয় কিকি। জানব না কেন? রমাই তো খবর পাঠিয়েছিল।
আমরা বুঝতে পারছি দিদির ভেতরে ঢেউ। প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে দ্যাখা। এক হারানো জেনারেশনের সঙ্গে এক সন্ধানী জেনারেশনের। কখনও পাঁচজনের সামনে আবেগ প্রকাশ করেননি। ভীষণ যুঝছেন নিজের সঙ্গে।
পরস্পরকে চোখের ইশারা করি। ঘাসজলের ওপর দিয়ে ছপছপ করে হাঁটতে থাকি পেছন ফিরে। আশেপাশে ছেলে, মেয়ে, ছোট বড়, ওদের জিজ্ঞেস করতে থাকি। — কোথায় কী? কেন? কী ভাবে?
ওই যে তাঁতঘর। ওখানে আমাদের কাপড় বোনা হয়। ওই দেখুন টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার। দোতলা বাড়িটা স্কুল। না, ওই একটাই, কো-এডুকেশন। না, কলেজ সেভাবে নেই, হায়ার এডুকেশনের জন্যে আমরা বাইরে যাই। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, আরও যা যা টেকনিক্যাল ট্রেনিং। এখানে বৃত্তিশিক্ষা। অ্যাগ্রিকালচার, পিসিকালচার, দূর দূর থেকে ট্রেনিং নিতে আসে। ধরুন বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, ওদিকে রাঁচি, হাজারিবাগ… আমাদের সেন্টার তো একটা নয় দিদি। অযোধ্যা পাহাড়ে আছে, পুঞ্চায় আছে। দলমার ওপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে আছে। সারা পুরুলিয়ায় কুয়ো কাটছি, রাস্তা গড়ছি আমরা। এই যেসব বিল্ডিং দেখছেন— সব করেছে সেন্টারের লোক। … মা তো দলমাতেই থাকেন। বর্ষায় নিমডি কি আর কোথাও নেমে আসেন। নিমডিতেই বেশির ভাগ। হ্যাঁ— ফুলের চাষও হয়, এখন বেল, জুঁই, কামিনী… হ্যাঁ ওটা গন্ধরাজেরই বাস। মা এনে পুঁতেছিলেন। কী জানি আমাদের এখানে সারা গ্রীষ্ম, সারা বর্ষা ফোটে। ফুটে ফুটে হদ্দ হয়ে যায় ভাই। তবে হ্যাঁ, ফুল দেখতে হয় শীতকালে। একেবারে রঙিন। সেসব ফুল মার্কেটিং হয়। আমাদের মৌ, ছাতু এসব নিয়মিত বাজারে যায়। মুরগি চাষ হয়, দুধ প্রচুর। আমাদের খেয়েও প্রচুর থাকে। ঘি, মাখন, ক্ষীর হয়, বাজারে যায়।
ওঁরা দেখান— ওই যে দেখছেন পাহাড় সব— তিল্লা, ভাঙ্গাট, দলমা, চাণ্ডিল পাহাড়। পাহাড়ের দিকে এগোলে দেখতে পাবেন ঘাঘরা নদী। এখন তো খুব জল। এ বছর বৃষ্টি হচ্ছে খুব। আমরা বড় বড় চৌবাচ্চায় ধরে রাখি। কাল ঘাঘরা দেখিয়ে আনব। তবে আমাদের সীমানার মধ্যেও একটা নদী আছে। ঠিক নদী নয়, ঝরনা। আমরা বলি কপিলা। সেটাতে বাঁধ দিয়েছেন আমাদেরই পুরনো ছাত্র— এক ইঞ্জিনিয়ার। নিশ্চয়ই! যাঁরা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বা অন্য কোনও টেকনিশিয়ান হয়েছেন তাঁরা সাহায্য করেন, নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। এখন হাসপাতালে আছেন ডক্টর বীরেন্দ্রনাথ বাস্কে। নার্সিং সেন্টার আছে, অ্যাম্বুলেন্স আছে। তবে কী জানেন— এখানকার জলহাওয়া এত ভাল, আর আমাদের জীবনযাত্রা এত স্বাস্থ্যকর, যে নার্সরাই বেশির ভাগ সামলে দিতে পারেন। ওই তো কপিলা। বর্ষার জল আর তার আওয়াজ শুনেছেন? কাছেই ওটা আমাদের আর্ট স্কুল। সামনের মূর্তিটি আমাদের বাবার। গড়েছে এখানকার ছাত্র সুধন্বা কোটাল। এখন দিল্লির ললিতকলায় আছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের এখানে আটকে থাকার দরকার নেই তো! বহু দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন আমাদের লোকেরা। মা তো তা-ই চান। যাক। কত দূর থেকে এসেছেন সব, কী কষ্ট করে, এই আমাদের অতিথিনিবাস। সব রেডি আছে। গরম জল, সাবান— আসুন আপনাদের ঘর দেখাই। চানটান করে নিন। খাওয়াদাওয়া করুন।
সময়ের ব্যবহার কী অদ্ভুত! কত কাল আগের ঘটনা, মনে হয়, এই তো কাল ঘটল! আমার মাত্র দু মাস আগের কথা মনে হয় কত দিন! মায়ের যন্ত্রণা, মায়ের চলে-যাওয়া, প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি কথাবার্তা সমস্ত এখনও আমার মনের মধ্যে টাটকা। এখনও সেই তীব্র কষ্ট পাকিয়ে উঠতে থাকে নাভি থেকে চোখ পর্যন্ত, ছড়িয়ে যায় মাথার তন্তুতে তন্তুতে। মানি নি, মানব না। মা একটা জলজ্যান্ত সত্য আমার জীবনে। মায়ের কষ্ট একটা জলজ্যান্ত সত্য। কিন্তু কস্তুরীদির সঙ্গে ক’ মাস, ঝাড়গ্রাম, জামবনি, গিধনি, পুরুলিয়া, নিমডি… রতনদা.. মাধব মুণ্ডা… নির্ভয়পুর…?
এই তো সেদিন পুরো জেলা সার্ভে করে মোটা মোটা খাতা নিয়ে ফিরলাম! রীতিমতো ফিল্ড-ওয়ার্ক, মানুষ নিয়ে, মানুষের দশা তাদের গল্পকথা সমস্ত নিয়ে। অথচ মনে হয় কতদিন! এই তো সেদিন কস্তুরীদিকে হাওড়া-আমদাবাদের ফিরতি ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম! তাঁকে আসতেই হল। ফিরতেই হল। কিন্তু সে যেন আরেকবার মায়ের নাড়ি ছেঁড়ার কষ্ট। আমাদেরই তো ছিঁড়ে নিয়ে আসতে হল। নিঃসংকোচে কাঁদছিলেন। এই তো সেদিন! অথচ মনে হয় কত কত দিন আগে! হয়তো বা স্বপ্ন দেখেছিলাম। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাজ সেরে রাসেল স্কোয়্যারের পেভমেন্ট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বলাবলি করি।
—কী রে, স্বপ্ন হলেও সত্যি, না?
—কিংবা সত্যি হলেও স্বপ্ন!
বলি, পাহাড়টার নাম ভাঙ্গাটই তো? ভাঙা ঘাট! আর ঝরনাটা? কপিলা, না কলকল্লোলা!
আর যারা তোদের ধরেছিল? কী করে ভাবলি ওরা রেপিস্ট? ওরা কি পুলিশ? জওয়ান?
—স্যরি। কিন্তু এনকাউন্টার উইথ মাও-গেরিলা, বেঁচে ফিরেছি— বিশ্বাসই হয় না। এখনও নিজেকে নিজে চিমটি কাটি।
—তা যদি বলিস তুই ইনকরিজিবল স্কেপটিক একটা। তোকে কিছুই বিশ্বাস করানো যায় না। আমাকে বিশ্বাস করিসনি। আমরা যেটা করছি সেটা যে মূল্যবান কিছু, নিছক পণ্ডিতি গজল্লা নয়, সেটাও বিশ্বাস করিস না।
—বলি, আর তুই!
—তুইই বল।
—অ্যান ইনকরিজিবল রোম্যান্টিক!
জনবহুল লন্ডনের রাস্তা দিয়ে কপিলা কলকল্লোলে বইতে থাকে। মেঘের ওপারে দলমা … তিল্লা … ভাঙ্গাট …। জল ছলছল ঘাসের ওপর দিয়ে আমরা স্বপ্নের দিকে সম্ভবের দিকে হেঁটে যাই।