উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : চতুর্থ পর্ব
টাটা সুমোয় বলরামপুর। মাঠটা পেরিয়ে ড্রাইভার অর্জুন সিং বললেন, এবার আপনারা একটু বিশ্রাম করে আহার করে নিন। এই দুকানে আমরা খাই। মা, আপনারা খেতে পারেন।
শালের খুঁটির ওপর পাতার ছাউনি। ভেতরে দু’-চারখানা বেঞ্চি। নিচু আর উঁচু।
কীসে দেব? থালি না শালপাতা? দোকানে পাতা মাটির উনুনের পাশে বসা লোকটি বলল।
শালপাতা শালপাতা— কলরব করে উঠল দুই মেয়ে। কাঁচা শালপাতায় ভাত আর শাক!
এত লোক!— কস্তুরী ভাবলেন, বারোমাসই কি এদের রথযাত্রা? কে জানে কে কোথায় যাচ্ছে! কাজে, নিজের বাড়ি, আমোদ-প্রমোদের সন্ধানে, বিশুদ্ধ প্রকৃতি দেখতে ভ্রমণ-পিপাসুরা। তাঁর মতো কি কেউ আছে? এমন পাগল? আতুর?
বুঝলি, বিভূতিভূষণ এসব জায়গা চষে ফেলেছিলেন।
তখন এসব আরও দুর্গম ছিল, জঙ্গল ঘন, জন্তু-জানোয়ার ছিল অনেক। এখন কী আছে জিজ্ঞেস করবে ওই অর্জুন সিংকে?— শিখরিণী ভয়ে ভয়ে বলল।
আমার মনে হয় এইসব বনে-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতেই প্রথম ‘চাঁদের পাহাড়’-এর কল্পনা ওঁর মাথায় আসে।
হতে পারে। একেবারে জঙ্গল-খ্যাপা লোক। অথচ দ্যাখো বাংলার ঝোপ-ঝাড় থেকে শুরু করে সাঁওতাল পরগনা, সিংভূম, পালামৌ, ছোটনাগপুর— জাস্ট একজন মার্কামারা ডাল-ভাত খাওয়া মানুষ এসব গহন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তুমি ওঁর ডায়েরিগুলো পড়ো— অভিযাত্রিক, বনে পাহাড়ে, তৃণাঙ্কুর…।
কথা হচ্ছিল মিঠু আর শিখরিণীর মধ্যে। মাঝেমাঝে ওরা বিভূতিভূষণ ও তাঁর অরণ্য-প্রেমের কথা পাশে বসা অন্যমনস্ক কস্তুরীর কাছে ব্যাখ্যা করছিল। একবার উনি বললেন হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘পথের পাঞ্চালি’ আমি জানি।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’।— শিখরিণী বলল।
সত্যি কীভাবে যে একজন মহৎ লেখক একজন মহৎ পরিচালকের আড়ালে অস্ত গেলেন। সবাই জানে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী।’
কস্তুরী বলে উঠলেন, আমি জানি— বিভূতিভূষোণ ব্যানার্জির। মিঠু, তোমার মতো ব্যানার্জি। তোমার গোর্ব কোরা উচিত।
মিঠু জিভ কাটল— এ মা, ব্যানার্জি পদবির যে কত চোর, জোচ্চোর, বদমাশ, স্বার্থপর লোক আছে কে জানে দিদি! সবাই কি আমরা বিভূতিভূষণের বংশধর? কয়েক জন্ম ঘুরে আসতে হবে।
কাজল খাচ্ছিল কি খাচ্ছিল না, খালি স্থানীয় লোক খুঁজে খুঁজে আলাপ করছিল। —এখানে কি কোথাও মা… মানে মা থাকেন?
মা? সবার ঘরেই তো মা রয়েছেন।
না, অন্যরকম মা! ধরুন কেন সবাই মা বলে তাঁকে।
কীরকম! কথা বাড়ায় না লোকটি, বলে, আপনি খুঁজে দেখুন না। তারপর তাকে আর দেখতে পায় না। এরকম দু’-তিন বার হল। চতুর্থ লোকটির বেলায় একটু কাজ হল।
আপনার নাম কী?
নিরঞ্জন মাহাতো, আপনি?
কাজল মুণ্ডা।
আচ্ছা! আচ্ছা! আপনি কি পলিটিকসের লোক?
না, না, আমি কলকাতায় থাকি, গবেষণার কাজ করি।
লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল— গবেষণা! গবেষণা কথাটা সে কখনও শোনেনি।
হ্যাঁ ধরুন, এখন আমি ট্রাইব্যালদের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি।
ট্রাইব্যাল? এস. টি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা হলে… আপনি যদি মুণ্ডা হন, যদি কী বললেন? ইতিহাস লেখেন? তো বাগমুণ্ডিতে মাধব মুণ্ডার কাছে যান, দাদা, উনি অনেক জানেন।
তা-ই? আচ্ছা এখানে কাছাকাছি কোনও মহিলা নেই, যিনি…ধরুন শিক্ষা-সংস্কৃতির কাজ করেন!
ট্রাইব্যাল ওয়েলফেয়ারের কথা বলছেন?
না। সরকারি কিছু নয়।
আপনি মাধব মুণ্ডার কাছে যান, উনি অনেক খবর রাখেন। আমি তো পুরুলিয়া শহরে কম্পাউন্ডারি করি, এসেছি লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে, অত জানা নাই।
বালিরাম ভুক্তা বা ও অঞ্চলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ কানাই সরেন কেউই ঠিকঠাক মায়ের ঠিকানা বলতে পারেননি। পারেননি, না চাননি কাজল খুব ভাল বুঝতে পারেনি।
কানাই সরেন বললেন, তিনি বিহান হতে না হতে চলে যান। যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কবে কখন তো বলেননি! একদিন উঠে চারদিকে শোর পড়ল— মা নাই, মা নাই। তখন বাবাই আমাদের বুঝালেন, শান্ত করলেন। কেউ না কেউ কখনও না কখনও আমাদের খবর ঠিক নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি পুরুলিয়া জিলার কোথাও আছেন এ বাদে আর কিছুই বলতে পারব না।।
—এখানে উনি কী করতেন?
—ওঁর ছিল সব মেয়্যাঁদের নিয়ে কাজ। নার্সিং, ফেমিলি প্ল্যান, মেয়েদের লেখাপড়া শিক্ষা, বিশ্বের কথা জানানো, গান শিখানো। কত বড় বড় মানুষদের কথা বলতেন। সন্ধেবেলা আমরা সব স্কুল বাড়িতে কি বাগানে জড়ো হতুম। কত গান, গল্প, ট্র্যানজিস্টর রেডিও চলত। খবরাখবর জানতুম। তারপর যেদিন ওঁর মনে হল কাজ শিখে গেছি, চলে গেলেন। তবে কাজ চলছে। এখনও! ছড়াচ্ছে কম। লোকপাড়া থেকে একটু দূর দূর।
—মাধব মুণ্ডা মশায়ের ঘর কোথায় বলতে পারবেন?
—ওস্তাদ? কেন পারব না? ওই যো লইতন খড়ের চাল ছাওয়া ঘরটি? সামনে দুটা ঝিঙা খেলা করে। লোকটি স্নেহের হাসি হাসল।
—মাধব মুণ্ডা মশায়, ওস্তাদজি! ঘরে আছেন হে!
—কে?
নিচু চালের তলা দিয়ে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। মাথায় টোপরের মতো সাদা চুল, পাকা দাড়ি গোল করে কাটা।
—কে বটে?
—আমি কাজল মুণ্ডা, কলকাতার কলেজ থেকে আসছি।
—কাজল মুণ্ডা? চিনতে লারলাম। কার ছেল্যা? বাপ কে? মা কে?
—বাপ মনোহর মুণ্ডা, সাকিন জামবনী, ঝাড়গ্রাম। মা বাসন্তী মুণ্ডা।
—দূর থেকে আসা হচ্ছে?
—আজ্ঞে ।
—এঁরা কাঁরা?
—ওঁরাও সব আমার সঙ্গে এসেছেন।
—ইন্টারভিউ লিবেন? টিবি পগ্রাম?
—না দাদু, টিভি নয়। আমি ইতিহাস গবেষণা করি। রিসার্চ।
—অ। টেপ-ক্যাসেট আনছো?
—আছে দাদু।।
—তো বসতে আজ্ঞা হোক মায়েরা। বুঢ়ার দোষ লিবেন নাই। বুঢ়ার সব স্মরণ থাকে না। লিন, শুরু করুন।— মাধব মুণ্ডা সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত। কাজলও রেডি। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন—
—আচ্ছা দাদু, এই যে আমাদের নামের সঙ্গে একটা করে সিং জুড়ে আছে— এটা কেন?
টেপ চালিয়ে দেয় সে। বৃদ্ধের মনে যেন কোনও সন্দেহ না জাগে।
একগাল হেসে মাধব মুণ্ডা ইন্টারভিউ দিতে শুরু করেন। একেবারে মহড়া দেওয়া, তৈরি। ভাঙা সুরে বলেন—
কে বলে বুঢ়া মরলো
কে বলে আছে
ঝাড় কোলে বসিয়া
রাঙ্গা মাটি মাখিয়া
বুঢ়া কুরমুরে গ
বুঢ়া কুরমুরে
না মা এ বুঢ়া মরে নাই। কুরমুরায় নাই। রাগঝাল নাই। এই কথাটো জানবেন। কথাটো হল সকল ঘেরওয়াল তো একসময়ে এক ঘরই ছিল। কিন্তু শবর মানুষ ঠেলু মারলো, খেলো— ঠেলু আপনারা যারে বানর বলেন, উ তো আমাদেরই আগের জাতি কিনা। বানর মারা বারণ আছে। শুনলো নাই, খিদা লাগলো, কাঁড় মেরে দিল। তো সেই হতেই তারা আর মোদের জাত না। সাঁওতাল, মুণ্ডা, কুঁড়বি সব আলাদা আলাদা হল। কুঁড়বি তো হিন্দুদের সঙ্গে লেনাদেনা খানাপিনা— হিন্দুই হঁয়ে গেল। মুণ্ডাগণও হিন্দু সিং-দের সঙ্গে খানাপিনা করায় তাঁদের ছেল্যারা অনেকে সিং হইল। পুরাতন দেশে মুণ্ডা সিং এখনও রাজা আছে। সেই রাজ্য আর নাই। কিন্তুক রাজা এখনও থাকে। বলি শুনো মা-বাবাগণ, পূর্বকালে একজন সিং-এর কিসকু রাজার মেয়ের সঙ্গে পিরিত হয়। একটি সন্তান হয়, তাকে বনে পেয়ে কুড়িয়ে আনে এক মারাণ্ডি। টাকাপয়সাঅলা লোক। সে ছেলের নাম হয় মান্দো সিং। মস্ত বীর ছেল্যা, তেমন বুদ্ধি। দেওয়ান হইল। তো বিহার বয়স হইল। কেহ বিহা দেয় না। বলে কী জারজ। জন্মের ঠিকা নাই। মান্দো কুপিত হইল। বলে কী, সকল মেয়্যাঁর কপালে সিন্দুর ঘষিব। সব লন্ডভন্ড করিব। ভয়ে অনেক পলাইয়া যায়।
কিছু লোক আবার বলে— মান্দো বড় বীর, তুড়ুকদের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করলো, যে সূর্য ঢাকা পড়ে যায়। লাদলুদ লাদলুদ কর্যাঁ তুড়ুক পলাইয়া গেল।
এইসব রাতকহানি আছে কতক। শুনছি কতদিন বুঢ়া-বুঢ়িদের থেকে। রাতের বেলা পিড়িতে বসে। আরও বলি শুনো— পুঞ্চা থানার ন’পাড়ায় হইল কৈড়া মৌজা। তার নির্ভয়পুর গ্রাম। উত্তরে কংসাবতী লদী। ওই ঠেঁ দুই দেবদেবী আছেন। বাঁইড়্যার থান বলে। হাজার বসর পূর্বে মুণ্ডারা প্রতিষ্ঠা করেন।
—আচ্ছা! মুণ্ডারা বেশ প্রভাবশালী ছিল, বলুন— মিঠু একটু ভরসা পেয়ে কথা বলে।
যত সময় যায় কস্তুরীবেনের মুখ শুকনো হয়ে যেতে থাকে। বুঢ়ার চোখ এড়িয়ে কাজল তাঁকে ধৈর্য ধরতে ইশারা করে। শিখরিণী চমৎকৃত হয়ে ভাবে পুরাকালে মুণ্ডারা রাজা ছিল? বহুদিন স্বাধীন রাজা হিসেবে বাস করেছে। সেই ‘আরণ্যক’-এর রাজকন্যা ভানমতীর কথা মনে পড়ে যায় তার। সেইজন্যে?— সে আপন মনে হাসে।
কাজল বলল, আচ্ছা দাদু, এই ধরুন নতুন নতুন রাত কহানি তৈরি হয় না আপনাদের? প্রাচীন কথা নয়, এই ধরুন পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কী হয়েছে না হয়েছে।
বুঢ়া শুনতে পেল বলে মনে হল না।
—আদিনারায়ণ সিং, বিহারের রাজা— সে হঠাৎ দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করে— তাঁরার পুত্র দেবনারায়ণ সিং শ্রীজগন্নাথ দরশনে পুরী যাচ্ছেন, লক-লশকর, রানি, বান্দি সব। চলতে চলতে রানির প্রসব বেদনা হল। কিছু লক, লশকর, ব্রামহন, রেখে তাঁরা সব চলে গেলেন। জঙ্গলে রানির চাঁন্দের মতো ছেল্যা জন্মায়। দিনের পর দিন যায় কেহ আসে না, খাবার নাই, রানি বিপদে পড়ল্যান। ওই রাজ্যটি ছিল মহাবীর সিং মুণ্ডার। ছোটনাগপুর— গ্রাম — উলিডি। রাজা এঁরার কথা জানতে পারলেন। বাগিচা বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। সে ছেল্যার নাম হয় নিরঞ্জন সিং মুণ্ডা। মহাবীর তাঁকে খুব ভালবাসতেন, রাজ্যের ভার দিল্যান। রাজ্য সব মেনে যায়, মুণ্ডা কিনা রাজা! রাজার কন্যা শক্তিশ্বরীর সঙ্গে বিহা হল। সুখে থাকেন। রাজ্য সুখে থাকে। ওঁরাদের সাত ছেল্যা। ক্রমে মহাবীরের ছেল্যাদের সঙ্গে বিবাদ হল। তাঁরা এঁরাদের তাড়াই দিলেন। কৈড়া গ্রামের রাজাকে হারিয়ে ওইখানে এঁরা বাস- বসত করলেন। নিরঞ্জন সিংয়ের ছেল্যারা আর সঙ্গে কুলের দেবতা। ছয় ভাই ক্রমে চারদিকে চলে যান। কিন্তু পাঁচ বসর পরপর সব কৈড়াতে মিলা হয়। বড় ভাই একদিন দ্যাখেন— কাঁড় হাতে, শিরে পুষ্প এক পরম সুন্দরী শিকারিণী দাঁড়িয়ে আছেন।
পেরনাম করে বলেন, কে মা তুমি?
উনি বললেন, আমি তোমারদের দেবী দুর্গা, কিরাতিনী বেশে শিকার করছিলাম। এখানেই আমার পূজা করিবে।
সব মূর্খ লক কিরাতিনী বলতে পারে না, বলে কিয়াইসনি। এই যেমন এই মা, দশটি বাহু নাই, কাঁড় নাই, কিন্তু কিয়াসিনি বটে।
বুঢ়া অপলকে চেয়ে থাকে অপ্রতিভ শিখরিণীর দিকে। হাত জোড় করে নমস্কার করে। তারপর ঘুরে ঘুরে সবাইকে নমস্কার করে, বলে— নিরঞ্জনের বড় পুত্র যখন কুলদেবতা বাঁইড়্যাকে আনতে গেলেন, দেবতা বললেন— আমি লকালয়ে যাবো নাই। নিরালায় থাকবো।
সেই বাঁইড়্যার থান। বড় জাগরূক দেবতা। আর কিয়াইসিনী। নদীর দক্ষিণ কিনারে পূজা হয়। সিখানে শবরদের কুলি উঠেছে। কিয়াইকচা। ঘাটের নাম হয় কিয়াইসিনির ঘাট।
আচ্ছা দাদু— কাজল বলল, এই যেমন বনের মধ্যে রানি, কি হঠাৎ কিরাতিনী বেশে মা দেখা দিলেন। তেমন আপনাদের কালে আপনারা দেখেননি!
উত্তরে বুঢ়া বলল, বাঘরাই সিং মুণ্ডা ওই বংশের পূজারী। কিন্তু খুব বীর। পঞ্চকোট রাজদরবারে অঁরার কাজ হল। বাঘরাইয়ের এমন দাপুট যে রাতের পাহারা সব নিদ্রা গেলে বাঘরাই একাকীই প্রাসাদ পাহারা দিতেন। মানবাজারের রাজার সহিত লড়াই হল। সে রাজা ভাল লক নয়, তাঁকে ভুলিয়ে ডেকে এনে খুন করলেন। তো তাঁরার ভূতপ্রেত বিরাট মূর্তি যুদ্ধ করতেই লাগল। তখন রাজা হার মানলেন— তাঁর মন্দির গড়লেন। প্রতি মঙ্গলবার হাট হয়। এ যদি ইতিহাস লিখো তো ছেল্যা ওইখানে যাবে। ছোট ডুংরিতে দেবতার থান। বাঁইড়্যা কি বানর, লেজ নাই। কোনও মূর্তি নাই, মাটির ঘোড়া, সিন্দূর, আতপ চাল, তুলসী, ধূপ, দীপ সব দিয়া পূজা হয়। যা মানসিক করবে পেয়েঁ যাবেক। কংসাবতী সেকালে ছিল সোঁতা। এখন নদী বটে। আপনারা পৌষ সংক্রান্তি, কি ফালগুন মাসে সাত তারিখে আসবেন, দেখবেন ভারী মেলা, মোরগ লড়াই।
শিখরিণী কাজলের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল, তাই বলি! এমন বীরপুরুষদের বংশধর তো বীরই হবে!
কাজল হেসে বলল, তাই বলি! এমন শিকারিণী দেবীর বংশধর তো শিখরিণীই হবে।
বুঢ়া বলল, আপনারা এই সময়ে আসছেন। না পাবেন শিকার পরব দেখতে, না পাবেন ছো-নাচ। জাঁত গানও তো হইয়াঁ গেলঁ। এ বসরের মতো মা মনসার পূজা শেষ।
আপনি তো ছো নাচেরই ওস্তাদ, দাদু?— কাজল বলল।
আমি আর তেমন ওস্তাদ কী। ওস্তাদ হইলেন প্রহ্লাদ সইস, যাঁর ঠেঁ আমি শিখেছি।
কখন হয় ছৌ নাচ?— শিখরিণীর খুব দেখবার ইচ্ছে।
মার্চ মাসের পয়লা তারিখ আখ্যান যাত্রার দিন থেকে আখড়ায় মহড়া লিতে হয়। চৈত সংক্রান্তির দিন থেকে নাচ শুরু হয়। রহিন-এর দিন পর্যন্ত চলে। রহিন হল্য পয়লা জ্যৈষ্ঠ। রহিন ফল খায় সব। সাপে কাটে না। তবে এখন কেউ সময়কাল মানছে না। বারো মাসই নাচ করছে। আপনারা দেখবেন মা?
হঠাৎ কস্তুরী বললেন, আপনার দোল আছে? কারা কোরে নাচ?
ই সব সিং, মড়ল, মাহাতো, হাড়ি, মুচি, কামার, কুমার, রাজুয়াড়— এরা বারো মুনিস খাটে, ভাতুয়া খাটে, কি হয়তো তাদের কিছু জমি আছে। আজকাল বড় লোকেরাও করছে। পুরুষ মানুষের নাচ মা। দল আমার আছে। হাঁক দিলেই সব জড়ো হবে। দূর দূর থেকে চলে আসবে। পাহাড় থেকে নামবে, ইদিক উদিক। ছো-র বাজনা অসুরা বাজনা। বাজনা একেবারে চঁ করে লিবেই। বিশ-পঁচিশ লোকের নাচ!
কস্তুরী কাজলকে একান্তে ডেকে বললেন, উনি বলছেন দূর দূর থেকে সব আসে। কাজল, তাদের কাছে খোঁজ পাবে না?
অন্যমনস্কভাবে কাজল বলল, পেতে পারি। খারাপ আইডিয়া না।। আসলে সে ভাবছিল— কেমন একটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। সে টের পাচ্ছে। বালিরাম ভুক্তা বলেছিলেন সাংবাদিকরা এসে বিরক্ত করে, ইন্টারভিউ …, অভিনিবেশ নষ্ট হয়।— যত এদিকে আসা যাচ্ছে— সেই গোপনীয়তা যেন বেড়ে যাচ্ছে। সে একদম নিশ্চিত যে এই মাধব সিং একবার-দু’বার তার প্রশ্নের জবাব দেননি। কথা ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। হ্যাজাক জ্বলছে চারদিকে। ঢোল, মাদল, ধামসা বেজে উঠল। অসুরা বাজনাই বটে। লোক জড়ো হয়েছে খুব। মাঝখানে চমৎকার সব মুখোশ পরা নাচিয়ের দল। শিঙা হাতে এক বাজিয়ে তুড়ুক করে লাফিয়ে উঠল।
মাধব সিং মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।
শোনেন সব— ভাই, বুন, মা, যে যিখানে আছেন। ছো হল কি খাটিয়ে লকদের ডান্স। সারাবছর খাটেখুটে, কখন কখন নাচ করে। এক আনন্দ ফুর্তির নাচ।
চড়িদা থেকে ভাল মুখোশ আছে ওস্তাদের ঘরে। সানাই, ঝাঁঝ স-ব আছে। সিবার একাডেমি টাকা দিয়েছিল। সাজ-বাজনা কিনেছি মা।।
—আমার কথা কী— রাজনীতি করে দলগুলি ভাঙেন না। মানুষের ফুর্তি আনন্দ লষ্ট করেন না। আমি দেখছি— সব ভাঙছে, দলাদলি বাড়ছে। ছো-এর মধ্যে কোনও পার্টি নাই। এ একবার নষ্ট হয়ে গেলে পরে পস্তাবেন।
ওরা বসেছে সামনে। কতকগুলো প্লাস্টিক চেয়ারে। কাজল সবার অলক্ষ্যে উঠে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেল।
—কোথাত্থে আসছেন গ!
—অযোধ্যা পাহাড় থে।
—জোর নাচ, না? বাজনা একবার বাজলে হল।
—যা বলিছেন— লোকটি সাদা দাঁত বার করে হাসল।
—পাহাড় এখন কেমন?
—পাহাড় আর আগের পাহাড় নাই। ম্যালেরিয়ার মশা খুব।
—ওখানে আপনাদের ইস্কুল— পাঠ কিছু হয়েছে। তেমন!
—তা হঁয়েছে, তবে তেমন তেমন হল্যেঁ …
গণেশ-বন্দনা শুরু হল। লোকটি মুখে কুলুপ আঁটল।
সিঁদুর বরণ অঙ্গ
মূষিকবাহন
সর্ব আগে পূজা করি
হর-গৌরীর নন্দন
নমঃ নমঃ নারায়ণ
গুড় গুড় গুড় করে বাজনা আরম্ভ হল। মাদল ধামসা ক্রমেই উত্তেজক হয়ে উঠছে — ঝাগিন গেঝাগিন, একজিন, গেজাগিন, গেজাগিন ঝাঁ।
গণেশের নাচ শুরু হল বাজনার সঙ্গে।
—কী বলছিলেন তেমন … তেমন!
লোকটি উত্তর দিল না। একমনে নাচ দেখছে, তালে তালে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। কাজল আস্তে আস্তে সরে যায়। একদম অন্য দিকে চলে যায়। ভিড়ের সঙ্গে মিশে সে-ও তালে তালে মাথা ঝাঁকায়। আলগাভাবে বলে, ওস্তাদ ঠিক বলিছে, এমন নাচ-ফুর্তি রাজনীতিতে সব লষ্ট করি দিল। তাই তো মা বলেন— আর যা করিস করিস — হাঁড়িয়া ছুঁবি নাই। রাজনীতি করবি নাই।
পাশের লোকটি বলল, ঠিক। রাজনীতিটি কেমন হল জানেন? আরেক নাচ, আরেক বাজনা। অসুরা বাজনা। চঁ করে টেনে লিবে।
আর একজন বলল, মা যেমন পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরেন, উখানে রাজনীতি ঘিঁষতে পারবেক নাই। কিন্তু যখন টান্ডিতে আসেন, খুব বলেন— নিজের পড়া কর, চাষ কর, তাঁত বুন, ঘট গড়, আর আনন্দ কর। হাঁড়িয়া-আনন্দ নয়।
আর একটি গলা, রাজনীতিও এক রসি জিনিস।
কার্তিক আসছে, কার্তিক আসছে, শোর উঠল।
আসিছে যে জন ময়ূর বাহন
চড়া দিয়া ধনুর্বাণেতে
ও ভাই আজ কী হইবে রণেতে।
গেড়েন, ঝাঁ ঝাঁ গেজাঘেন— বাজনা বাজে— ঔর তা তেরে কেটে তা
ঝাঁ-গেঁজাগেন, ঝাঁ-গেঁজাগেন, তাক্, তাক্ তাক্
—মার উখানে কুনও রাজনীতি নাই, দলাদলি নাই— কাজল বলল
—কুন সেন্টারের কথা বলছেন? —নিমডি?
—হাঁ, উখানেই তো উঁর কথা শুনেছি … কাজল বলল। ভিড়ের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে আর এক দিকে চলে গেল— দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।
অনেক রাত হল— মাধব সিং আবার মাঝখানে চলে এলেন— আপনারা সব চলি যাবেন না। ইখানে আজ পরব— দিনের খাওয়া। এক মা এসেছেন গুজজর পদেশ থেকে। নাচ দেখছেন, পরব দেখছেন, আমাদের হিস্ট্রি শুনছেন— বড় পণ্ডিত আছেন মায়ী—সঙ্গে তেনার ছেল্যা ছুলা। উনি আপনাদের সব ভোজ দিবেন।
একটা বিরাট শোর উঠল। সঙ্গেসঙ্গে চত্বর পরিষ্কার হয়ে গেল, পাতা পড়ে গেল। বিরাট বিরাট ডোলে কড়ায় খাবার হয়েছে। আর্টিস্ট, দর্শক, আচার্য, অতিথি, সব বসে গেলেন। খিচুড়ি, লাবড়া, মাছভাজা, চাটনি আর বোঁদে। এখানে কোনও মতেই ভাল রসগোল্লা জোগাড় করা গেল না।
—উনি আমিষ খান না। মাকে আলাদা দাও। মা, আলুভাজা খাবেন তো? বেগুনভাজা?
—হাঁ, নিশ্চয়ই।
—আমিও মাছ খাব না— কাজল গিয়ে একটু দূরে বসে পড়ল কস্তুরীর পাশে। খেতে খেতে বলল, দিদি, কাজ হয়ে গেছে।
চমকে উঠলেন কস্তুরী।
—একসাইটেড হবেন না। জায়গাটার নাম বার করতে পেরেছি। তবে ওঁর একাধিক সেন্টার আছে। দেখি কী করতে পারি!
মাধব সিং বললেন, ছেল্যা। শেষ পালাটি বুঝলেন তো? মায়েরা বুঝেছেন?
কাজল তেমন মন দিয়ে কিছু দেখেইনি।
শিখরিণী বলল, ওটা তো মা-দুর্গার মহিষাসুর বধ মনে হল, কী মিঠু? তাই না? মিঠু মাথা নাড়ল।
চারদিকে একটা হো-হো মতো শব্দ উঠল। মাধব সিং এক হাত তুলে সবাইকে থামালেন। বললেন, না মায়েরা ওইটি মহিষাসুর নন, উনি হলেন দৌরদণ্ডপ্রতাপ হড়দের রাজা—হুদুড়-দুর্গা। আর্য-মানুষদের সর্দার ইন্দ্র তাঁর সঙ্গে রণে এঁটে উঠতে লারছিলেন। তখন একটি কৌশল করিলেন। এক পরমাসুন্দরী আর্য কন্যাকে হুদুড়-দুর্গার সকাশে ভেট পাঠাইলেন। এই হইল রাজার কাল। তিনি আর কিছু চক্ষে দেখেন না। সমরকালে মন পড়ে থাকে যুবতীতে। শেষে মহারণ হইল। হুদুড় জিততে লারলেন। পরাজিত হয়্যাঁ মৃত্যুবরণ করলেন। হড় জাতি চাম্পা রাজ্য থেকে তাড়া খেয়ে অন্যত্র চলে গেল। লককথা বলে কী এই সুন্দরীর জন্য হুদুড়কে জয় করেন তাই ইন্দ্রর আজ্ঞাক্রমে এঁরই নাম হয়ে গেল দুর্গা। পূজা পেতে লাগলেন। দুর্গা বলেন আপনারা, কিন্তু দুর্গা শব্দে সাঁওতালিতে ছেল্যা বুঝায়। বিটিছেল্যা হলে হবে— দুর্গী।
আশ্চর্য হয়ে কাজল বলল, এমন গল্প তো কখনও শুনিনি ওস্তাদজি!
ওস্তাদ বলেন, লককথায় আছে। এ দেশ মাটি তো ঘেরওয়াল হড়হপনদেরই ছিল বাবা। সেই ঠাকুরজিউ যবে থেকে সৃষ্টি করলেন। আর্য মানুষ এসে তাদের ক্রমেই তাড়ায়, ক্রমেই তাড়ায়। এরা তো পূর্বে জংলিও ছিল না। শহর বাজার ছিল, জমি-মাটি, গড়, সেনা স-ব। স-ব যাঁইছে। তারপর তুড়ুক এল, তারপর গোরা সাহেব এল, ব্যস, সব শেষ হইয়্যাঁ গেল।